পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমাদের এই লিখনপ্রণালী

 গৌরবার্থে বহুবচন রয়ে গেছে শিরোনামায়। আমাদের সর্বনামে প্রচ্ছন্ন রয়েছে অনেক বিচ্ছিন্ন কী ‘আমি’র সমাবেশ। অরণ্যে গাছের মতো পাশাপাশি, কাছাকাছি নয় তবু। ভাষাহীন নৈঃশব্দ্যে এক অপরের থেকে বিস্তৃত, সুদূর। অথচ লেখা গভীর এবং ব্যাপক সেতু হওয়ার কথা ছিল। নিজেরই ভেতরে কত অজানা চোরাবালি, কত কুশ্রী ফাটল, কত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, কত ঝড়ের আকাশ! লেখায় সেইসব ঝলসে ওঠার কথা। নিজেরই সময় ও পরিসরের দ্বিরালাপ থেকে লেখা জন্ম নেয়। কবিতার চিহ্নায়কে কখননা, আর কখনো বা আখ্যানের বয়নে। সমান্তরাল ভাবে বহমান একক ‘আমি’-দের আবর্ত থেকে লেখা ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুতেই তবু লেখার আদল থেকে বিমূর্ত প্রবণতার ছায়া সরে যায় না। ব্যক্তিসত্তা আর সামাজিক সত্তার আততি লেখার প্রক্রিয়াকে জটিলতর করে তোলে কেবলই। লেখা আসলে এক আদ্যন্তহীন গ্রন্থনা। এর কোনো আরম্ভ নেই, কোনো সমাপ্তিও নেই। সুতরাং চিরাগত অভ্যাসে যাকে লেখকসত্তা বলে শনাক্ত করছি, তা আসলে সূত্রধারসত্তা। সুখে দুঃখে আনন্দে যন্ত্রণায় আশায় নৈরাশ্যে জীবনে মরণে—বহু ধরনের অজস্রতায় ওই সত্তা লালিত হচ্ছে অহরহ। সূত্রধারের কাজ শুধু একটাই। লেখাকে অনেকান্তিক দ্যোতনার বিচ্ছুরণে যুক্ত করে রাখা। এইটুকু নিশ্চিত করা, যেন, বিযুক্তি ঘটানোর আশঙ্কাজনক কৃৎকৌশলেও লেখার প্রক্রিয়া অবিন্যস্ত না হয়, পরাস্ত না হয়।

 লেখা মূলত আত্মখননের প্রণালী। একসময় ওই প্রণালীর শুরু হয়। তারপর কোনো-এক উপযুক্ত মুহূর্তে সূচনা হয়ে থাকে লেখার। প্রস্তুতিকে চিনতে পারি হয়তো, কিন্তু প্রস্তুতির ফসলটি উদগত হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণকে পাঁজিপুঁথির অঙ্ক কষে চেনাতে পারি না। শুধুমাত্র ওই আবশ্যিক প্রণালীকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যে অধ্যবসায়ী হতে পারি। অথচ এই অধ্যবসায়ে ঘাটতি থেকে যায় সর্বদা। বিনা পরিশ্রমে শিরোমণি হয়ে ওঠার সাধ লালন করি বলে লেখা-লেখা খেলায় কুঁদ হয়ে থাকি। নিজের চোখে নিজেই ধুলো দিই এবং ঠুলি পরাই। কী চাই লেখায় মধ্য দিয়ে, নিজের কাছে তা স্পষ্ট হয় না কখননা। আত্মপ্রতারণার মাদক আচ্ছন্ন করে রাখে সকাল-সন্ধ্যা। পণ্যায়নের কুযুক্তিশৃঙ্খলায় বন্দী হয়ে যান সেইসব লিখিয়েরা, একদা যাঁরা বলেছিলেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের

১০৩