গল্পস্বল্প/শুভ কাজের সুযোগ হারাইও না

উইকিসংকলন থেকে

শুভ কার্য্যের সুযােগ হারাইও না।

 “যানি অনবদ্যানি অনিন্দিতানি কর্ম্মাণি তানি সেবিতব্যানি ত্বয়।
নো ইতরাণি নিন্দিতানি কর্ত্তব্যানি।”

 কল্যাণকর যে সকল কর্ম্ম তাহার অনুষ্ঠান করিবেক, অকল্যাণকর কর্ম্মের
অনুষ্ঠান করিবেক না


 আজ রমেশের ছুটি। ছুটি পাইয়া রমেশের বড়ই আনন্দ হইয়াছে। সারাদিন কত রকম খেলা করিবে তাহাই ভাবিতেছে। এমন সময় রমেশের মা বলিলেন, “রমেশ, আজ ত তােমার কোন কাজ নাই, আমার ঘরে বইগুলি বড় বিশৃঙ্খল হইয়া আছে, যদি তুমি সেই গুলি গুছাইয়া ঘরটি পরিষ্কার কর, তবে আমার কাজের একটু সুবিধা হয়।”

 এই কথা শুনিয়া রমেশ বড়ই বিরক্ত হইয়া ভাবিল, “তাইত। খেলা ধূলা ছাড়িয়া আমি এখন মায়ের কাজ করিতে যাই।”

 রমেশ মায়ের কথা না শুনিয়া খেলা করিতে চলিয়া গেল। খানিক দূর গিয়া বসুদের পুকুর ধারে সুষমাকে দেখিতে পাইল, সুষমাকে তাহার নিতান্ত বিষণ্ণ বলিয়া মনে হইল। সুষমা রমেশের পিতৃব্যকন্যা। তাহাকে রমেশ বড় ভাল বাসে, সুতরাং তাহাকে বিষণ্ণ দেখিয়া নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“সুষমা, কি হইয়াছে? অমন চুপ করিয়া বসিয়া আছিস যে?”

 বালিকা বিষণ্ণভাবে বলিল—“আমার একটি জিনিস হারাইয়া গিয়াছে?”

 রমেশ। কি জিনিস? বলনা—আমি খুঁজিয়া দিই।

 সু। মা বলিয়াছেন—সে জিনিস একবার হারাইলে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না তার প্রতি সর্ব্বদাই নজর রাখিতে হয়।”

 উভয়ের এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছে এমন সময় সুরেন্দ্র আসিয়া বলিল—“কি রমেশ, কি কথা হইতেছে?”

 রমেশ সে কথায় কাণ না দিয়া একটু বিরক্তির ভাবে বালিকাকে বলিল—“তুমি হাজার কথা না বলিয়া কি শুধু জিনিসের নামটি বলিতে পার না?

 বালিকা একটু থতমত খাইয়া বলিল, “আমি সুযোগ হারাইয়াছি।”

 সুরেন্দ্র এই কথা শুনিয়া হাসিয়া বলিল, “হা হা হা—বাস্তবিক সুযোগ হারান বড় কষ্ট। আমি কিন্তু সে বিষয়ে বড়ই সাবধান। আজ সকালে আমার পড়া হয় নাই বলিয়া দুপুর বেলা বাবা আমাকে পড়িতে বলিলেন, বাবা যতক্ষণ বাড়ীতে ছিলেন ততক্ষণ কাজে কাজেই পড়িতে হইল। কিন্তু যেই বাবা বাহিরে গিয়াছেন অমনি আমি পলাইয়া আসিয়াছি—এমন সুযোগ আমি হারাই!”

 সুষমা বলিল, “এ বুঝি সুযোগ! মন্দ কাজ করিতে যে সময় পাওয়া যায় মা তাকে “কুযোগ” বলেন। সেত হারানই ভাল। তুমি যে তোমার বাবার কথা শুনিলে না—তুমিও ত একটি সুযোগ হারাইলে—তবে আবার অত জাঁক করিতেছ কেন?”

সুষমার কথা রমেশেরও বড় ভাল লাগিল না—কারণ সেও ত মায়ের কথা শোনে নাই। বলিল, “ও কথা যাক,—তুমি কিসের সুযোগ হারাইয়াছ?

 বালিকা বলিল, “আমি যে দিন দিদিমার বাড়ী গিয়াছিলাম, সে দিন দিদিমা আমাকে একটি টাকা দিয়াছিলেন। মা তাহা দেখিয়া বলিলেন, “আরে সুষি, তুই টাকা পেয়েছিস, বেশ! ইহাতে কত কাজ হয়, কত গরীব দুঃখীর উপকার করা যায়, এমন সুযোগ যেন হারাস নে।’ কিন্তু খানিক বাদেই আমি সেই টাকাটি দিয়া একটি মোমের পুতুল কিনিয়া ফেলিলাম। অমনি এখনি একজন ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছিল। আহা বেচারা সমস্ত দিন কিছুই খায় নাই। আমি যদি সে টাকা হইতে তাহাকে কিছু পয়সাও দিতে পারিতাম ত তাহার কত খাবার হইত—কিন্তুআমি সে সুযোগ হারাইয়াছি।”

 এই বলিয়া বালিকা কাঁদ কাঁদ হইল। রমেশ আর থাকিতে পারিল না, অনুতপ্ত হৃদয়ে বলিল, “সুষমা, আমিও আজ একটি সুযোগ হারাইয়াছি; আমি আজ মায়ের কাজ করিতে পারিতাম—তাহা করি নাই।”

 সুষমা বলিল, “তবে দেখিতেছি আমরা দুজনেই সুযোগ হারাইয়াছি। কেবল সুরেন্দ্রই লাভ করিয়াছে।”

 ইহা শুনিয়া সুরেন্দ্র একটু লজ্জিত হইয়া বলিল, “সুষমা, আমাকে ক্ষমা কর। এখন আমি বুঝিতেছি আমিও সুযোগ হারাইয়াছি। আমি পিতাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিতাম তাহা করি নাই, নিজের বিদ্যাশিক্ষায় সময় দিতে পারিতাম তাহা দিই নাই, আমি তোমাদের সকলের অপেক্ষা অধিক হারাইয়াছি।”

 সুরেন্দ্র অনুতপ্ত হইয়া ভবিষ্যতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করিবে বলিয়া সঙ্কল্প করিল। সুষমা নিজে সুযোগ হারাইয়া এতক্ষণ যদিও বিষণ্ণ হইয়া পড়িয়াছিল—কিন্তু অন্য দুই জনকে তাহার কথায় জ্ঞান লাভ করিতে দেখিয়া তাহারও সে কষ্ট অধিকক্ষণ রহিল না।