আজকের আমেরিকা/বিশ্বমেলা

উইকিসংকলন থেকে

বিশ্বমেলা

 ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের পাশেই কতকগুলি কেবিন ছিল। কেবিন মানে ছোট এক একখানা কাঠের ঘর। তার ভেতরে রান্না করার গ্যাস, স্নানের জন্য গরম ও ঠাণ্ডা জলের কল এবং একটি বৃহৎ টাব। রান্না করার জন্য বাসন বিনা ভাড়ায় দেওয়া হয়। শুধু খাদ্যদ্রব্য কাছের কোনও গ্রোসারের দোকান হতে কিনতে হয়। কেবিনের ভাড়া প্রতি চব্বিশ ঘণ্টার জন্য মাত্র এক ডলার। আমাদের দেশের হিসাবে তিন টাকা চারি আনা। অনেকগুলি কেবিন দেখলাম। প্রত্যেকটি কেবিনই

খালি, কিন্তু আমার জন্য একটি কেবিনও খালি ছিল না। আমি কালআদমী! কালো লোকের থাকবার জন্য বিশেষ কেবিন রয়েছে―সে কথাটি আমার জানা না থাকায় আমায় অনেকক্ষণ চারিদিকে টহল দিতে হয়েছিল। আমার মুখ দেখেই কেবিনের ম্যানেজারগণ আমাকে এস্থান হতে অন্যস্থানে পাঠাতে লাগল। স্পষ্টভাবে কেউ বলল না অথবা কেউ বলতে সাহস করল না,―এই কেবিনগুলি শুধু সাদা লোকের জন্য। শেষটায় যখন নিগ্রোদের কেবিনের কাছে আসলাম তখন একজন ম্যানেজার হেসে বললেন, “Now you have come to the right place, have a cabin।” এতক্ষণে উপযুক্ত স্থানে এসেছেন, এখন একটা কেবিন পেতে পারেন। আমি কেবিনের ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে যখন রেজিষ্টারে আমার নাম বিশুদ্ধ বংগ ভাষায় লিখতে লাগলাম, তখন ম্যানেজারের চমক ভাংল। ম্যানেজার বলল, “আপনি ইংলিশ লিখতে জানেন না?” আমি বললাম, আমি শুধু নিজের ভাষায় লিখতে এবং পড়তে জানি―ইংরেজী শুধু বলতে পারি।” ম্যানেজার তখন আমার দেশ কোথায়, আমার কি জাত এবং আমার দেশের নানা সংবাদ নেবার পর কেবিনটা পরিষ্কার করবার জন্য এক জন লোক পাঠাল। নিগ্রোরা প্রায়ই কেবিন নোংরা করে রেখে যায় বলেই পরিষ্কারের ব্যবস্থা হয়েছিল। ম্যানেজারগণও নিগ্রোদের কেবিন পরিষ্কার রাখার জন্য কোনরূপ চেষ্টা করে না, কারণ এরা বুঝে না কেবিনে অপরিষ্কার রেখে গেলে পরবর্তী আগন্তুক কষ্ট পায়। কেবিনে সাইকেলটা রেখে, আফিসে গিয়ে ফের নিউইয়র্ক-এ টেলিফোন করে আমার অবস্থানের কথা জানালাম তারপর পুনরায় কেবিনে এসে রান্নার বন্দোবস্ত করলাম। ম্যানেজার মহাশয় দু চারজন আশেপাশের লোককে আমারই কেবিনে ডেকে গল্প জুড়ে দিলেন। কথা হচ্ছিল আমাদেরই দেশ

নিয়ে। আমি তাদের কথায় মাঝে মাঝে সায় দিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার মন ছিল ওয়ার্ল্ড ফেয়ার-এর দিকে। খাওয়া সমাপ্ত করে বিশ্বমেলা দেখতে বার হলাম।

 সুন্দর রাত। অনেক দর্শক জুটেছে। দর্শকদের মাঝে যারা “হিচ-হাইক” করে এসেছে, তাদের লোটাকম্বল ঘাড়ে বাঁধা দেখলেই চিনতে পারা যায়। তাদের দু-একজনের সংগে কথাও হল। অনেকে “হিচ-হাইক” করে কালিফরনিয়া হতে এসেছে। আমার ইচ্ছা হল আমিও “হিচ-হাইক” করে পর্যটন করি। এতে দেখবার সুযোগ আরও হবে। অনেক চিন্তা করে “হিচ-হাইক” করা ঠিক করে বিশ্বমেলা দেখতে গেলাম। নিউইয়র্কএর বিশ্বমেলা দেখতে আমাদের দেশের দুজন মহারাজা গিয়েছিলেন। তাঁদের বিশ্বমেলা দেখার জন্য সুন্দর বন্দোবস্ত হয়েছিল। তাঁরা যখন মেলা দেখতেন তখন তাঁদের পেছনে বহু লোক চলত। তাঁরা নূতন ধরনের রিকশায় বসতেন। তাঁরা ইচ্ছামত জিনিসপত্রও কিনতেন। তাঁদের বদান্যতা এবং মুক্তহস্ততার জন্য লোকে ভারতবাসী মাত্রকে ধনী বলেই কয়েক দিনের জন্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের মত দরিদ্রের আগমনে ভারতের ভয়ানক বদনাম শুরু হল। আমেরিকান পর্যটকদের দেখে পৃথিবীর লোক যেমন ভাবে আমেরিকায় লোক সবাই ধনী, আমাদের দেশের রাজা মহারাজাদের দেখেও পৃথিবীর লোক ভাবে আমরাও সকলেই ধনী। আমেরিকার গভর্ণমেণ্ট তাদের দেশে যাতায়াতের যে সব আইন-কানুন করে রেখেছেন, তাতে সেখানে শুধু ধনীদেরই যাওয়া চলে। যারা গরীব তারা সেই অধিকারে বন্‌চিত।

 বিশ্বমেলায় পৃথিবীর প্রায় সকল স্বাধীন দেশ থেকেই প্রদর্শনী খোলা হয়েছিল। আমেরিকার প্রত্যেক ষ্টেটও তাদের প্রদর্শনী খুলেছিল। এ সব ছাড়াও আমোদ-প্রমোদের জন্য নানা আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সম্পর্কে আমাদের দেশের লোকদের কয়েকটি কথা বলতে চাই। আমাদের দেশের আমোদ-প্রমোদ এবং আমেরিকার আমোদ-প্রমোদে অনেক প্রভেদ আছে। আমেরিকার প্রত্যেক খেলাতে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়। তারা অর্থ উপার্জন করতে পারে বলেই খরচ করতেও সক্ষম হয়। বিশ্বমেলাতেও অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল। ডুবুরিরা কি করে সমুদ্রের নীচে গিয়ে সেখানে কি আছে দেখে―এমন কি, অনেক সময় সমুদ্রের নীচভাগ সারভে পর্যন্ত করে আসে, আমার তাই দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল।

 একটি কাচের ঘর ক্রেইনের সংগে আঁটা রয়েছে। যখনই চারজন লোক এক শত কুড়ি ফিট জলের নীচে যেতে প্রস্তুত হয়, তখনই তাদের ঐ কাচের ঘরে প্রবেশ করিয়ে একশত কুড়ি ফিট ‘সমুদ্রের নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়’। এতে সকলেরই বেশ আনন্দ হয়, যদিও এতে মরণের বেশ সম্ভাবনা থাকে। জীবন-মরণ নিয়ে খেলা করতে যে আনন্দ, তা সকলে পছন্দ করে না, কিন্তু আমার তা খুব ভাল লাগে। পঁচিশ সেণ্ট দিয়ে এক শত কুড়ি ফিট নীচে নেমেছিলাম। যতক্ষণ জলের নীচে ছিলাম ততক্ষণ কান দুটা বধির হয়ে ছিল। যখন জলের উপর ভেসে উঠলাম এবং কাচের দরজা খুলে দেওয়া হল, তখন মনে হল নূতন জগতে এসে হাজির হয়েছি। আমাদের দেশে, বিশেষত ইউরোপে এমন অনেক বই আছে―যাতে সাগর সম্বন্ধে অনেক আজগুবি কথা লেখা রয়েছে। কিন্তু পাঠকগণ জেনে সুখী হবেন, সোভিয়েট রুশিয়ার ডুবুরিয়া কাস্পিয়ান সাগরের তলদেশ জরিপ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাতে অনেক পুরাতন যুগের বাড়িঘরের সন্ধান পেয়েছে। সাগর গর্ভে প্রাপ্ত জিনিসগুলি যত্নের সহিত উঠিয়ে, সর্বসাধারণের দেখবার উপযুক্ত করে কোনও মিউজিয়মে রেখেছে। ডুবুরিয়ার কাজ বড়ই বিপজ্জনক। সোভিয়েট রুশের লোক বিপজ্জনক কাজ করতে একটুও ভয় পায় না।

 ভারতবর্ষ যেমন ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামায় আমেরিকার লোক বিজ্ঞানের এত উন্নত স্তরে উঠেও তেমনি সেই ভাগ্যের কথা ভুলে নি। যেখানে ভাগ্যের দৌরাত্ম্য সেখানে জুয়া খেলার প্রাবল্য। বিশ্বমেলাও সে দোষ থেকে বন্‌চিত হয় নি দেখলাম। ছোট ছোট ঘর বেঁধে জুয়ার সব আডডা হয়েছে। লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য মাইক্রোফোনের সাহায্যে বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সংগে বলতে বাধ্য হচ্ছি, জুওয়াড়ীদের পকেট খালি। যাদের জুয়া খেলার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তাদেরও পয়সায় কুলাচ্ছে না। আমেরিকার অর্থ সর্বসাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে আর ছড়ান নাই, আমেরিকার অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অর্থের ধর্মই হল তাই। আমার ভ্রমণ সময়ে তিনটি বিশ্বমেলা দেখেছি। সর্বপ্রথম বিশ্বমেলা দেখেছিলাম ব্রসেল্মে। সেখানে ভারতের কতকগুলি চিত্র দেখান হয়েছিল। সেই চিত্রগুলি কুৎসিত ছিল। যে কোন লাক তা দেখে ভারতবাসীকে বর্বর বলে নির্ধারণ করতে পারত। দ্বিতীয় বিশ্বমেলা দেখলাম নিউইয়র্কে। এটি সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। এখানে ভারতের কোনও প্রদর্শনী খোলা হয়নি দেখে সুখী হয়েছিলাম।

 গ্রেট বৃটেনের পক্ষ থেকে এখানে একটি প্রদর্শনী খুলা হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীর পুরোভাগে একটি গোলকে, বৃটিশ সাম্রাজ্যে কি করে সূর্য অস্ত যায় না তাই দেখান হয়েছিল; লক্ষ্য করে দেখলাম, অনেক দর্শক এই দৃশ্যটি দেখেই থমকে দাঁড়ায়। দর্শকদের মুখভংগি দেখে বেশ ভাল করেই বুঝতে পারা যায় তারা যেন এই দৃশ্যটি দেখতে ভালবাসে না। এই দৃশ্যটি দেখার পর প্রত্যেকের মুখেই হিংসার ভাব ফুটে উঠছিল। যারা সাম্রাজ্যবাদ ভালবাসে তাদেরই এই দৃশ্য দেখে অন্তর জ্বলে, আমার কিন্তু সেরূপ কিছুই হয়নি কারণ আমি বেশ ভাল করেই জানতাম, সাম্রাজ্য বলে কারো কিছু থাকবে না।

 তারপরই ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের বংশ পরিচয়ের চিত্র। জর্জ ওয়াশিংটন নাকি ইংলেণ্ডের রাজপরিবারের রক্তের সংগে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বেশ ভাল কথাই। রাজার রক্তে এবং প্রজার রক্তে প্রভেদ আছে বলে যারা পরোক্ষভাবে প্রচার করে তারা আদীম যুগের লোকের মনোভাব পোষণ করে। রাজা সমাজেরই একজন, তার রক্তের গুণগরিমা এক দিন নির্যাতিত লোক করত। যারা ডিমক্রেট বলে বড়াই করে তাদের পক্ষে রাজার রক্তের পরোক্ষভাবে বাহাদুরী করা পুরাতন বর্বরতাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি সে দৃশ্যটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর অন্যদিকে চলে গেলাম।

 আমেরিকার তরফ থেকে কতকগুলি দ্রব্য একটি ভূগর্ভে রক্ষিত হয়েছিল। কি কি দ্রব্য রক্ষিত হয়েছিল তার লিষ্ট আমার জানা নাই। তবে শুনেছি একখানা বাইবেলও রক্ষিত হয়েছে। আমেরিকার লোকের ঠিক ধারণা রয়েছে পৃথিবীটা একবার লয় হবে এবং এই পৃথিবীই আবার গঠন হবে। বৈজ্ঞানিকদের জানা উচিৎ যা একবার লয় হয় তা আবার সেই আকৃতি এবং প্রকৃতিতে গড়ে উঠে না।