পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ক্রন্দনে উপস্থিত সকলকে সচকিত করিয়া পুলিশ-কর্মচারীর পায়ের নীচে পড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, বাবুমশাই, আমার কি হবে? আমাকে যে এবার জমিদারের লোক জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।

 ইন্‌স্পেক্টরবাবুটি প্রবীণ গোছের ভদ্রলোক, তিনি শশব্যস্ত হইয়া তাহাকে চেষ্টা করিয়া হাত ধরিয়া তুলিলেন, এবং আশ্বাস দিয়া সদয়কণ্ঠে বলিলেন, ভয় কি ঠাকুর, তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাকো গে। স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তোমার সহায় রইলেন―আর কেউ তোমাকে জুলুম করবে না। বলিয়া তিনি কটাক্ষে একবার জীবনন্দের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

 তারাদাস চোখ মুছিতে মছিতে কহিল, সাহেব যে রাগ করে চলে গেলেন বাবু!

 ইন্‌স্পেক্টরবাবু মুচকিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, না ঠাকুর, রাগ করেন নি।

 তবে আজকের এই ঠাট্টাটুকু তিনি সহজে ভুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া আমরাও মরিনি, থানাও যা হোক একটা আছে। বলিয়া আর একবার জমিদারের শয্যার প্রতি তিনি আড়চোখে চাহিয়া লইলেন। এই ইঙ্গিতটুকুর অর্থ তাহার যাই হোক, জমিদারের তরফ হইতে কিন্তু ইহার কোনরূপ প্রত্যুত্তর অসিল না। একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, এখন চল ঠাকুর, যাওয়া যাক। যেতেও ত হবে অনেকটা।

 সাব্‌ ইন্‌স্পেক্টরবাবুটির বয়স কম, তিনি অল্প একটু হাসিয়া কহিলেন, ঠাকুরটি তবে কি একাই যাবেন নাকি?

 কথাটায় সবাই হাসিল। যে চৌকিদার দু’জন দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছিল, তাহারাও হাসিয়া মুখ ফিরাইল। এমন কি এককড়ি পর্যন্ত মুখ রাঙ্গা করিয়া কড়ি কাঠে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল।

 এই কদর্য ইঙ্গিতে তারাদাসের চোখের অশ্রু চোখের পলকে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হইয়া গেল। সে ষোড়শীর প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া গর্জন করিয়া উঠিল, যেতে হয় আমি একাই যাবো। আবার ওর মুখ দেখব, আবার ওকে বাড়ি ঢুকতে দেবো আপনারা ভেবেছেন।

 ইন্‌স্পেক্টরবাবু, সহাস্যে কহিলেন, মুখ তুমি না দেখতে পারো, কেউ মাথার দিব্যি দেবে না ঠাকুর। কিন্তু যার বাড়ি, তাকে বাড়ি ঢুকতে না দিয়ে আবার যেন নতুন ফ্যাসাদে পড়ো না!

 তারাদাস আস্ফালন করিয়া বলিল, বাড়ি কার? বাড়ি আমার। আমিই ভৈরবী করেছি, আমিই ওকে দূর করে তাড়াবো। কলকাঠি এই তারা চক্কোত্তির হাতে। এই বলিয়া সে সজোরে নিজের বুক ঠুকিয়া বলিল, নইলে কে ও জানেন? শুনবেন ওর মায়ের―

 ইন্‌পেক্টর থামাইয়া দিয়া কহিলেন, থামো ঠাকুর, থামো। রাগের মাথায় পুলিশের কাছে সব কথা বলে ফেলতে নেই―তাতে বিপদে পড়তে হয়। ষোড়শীর প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তুমি যেতে চাও ত আমরা তোমাকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে

২৩