পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।

 মুখ-হাত ধোয়া হইতে স্নান পর্যন্ত সমাধা করিতে বসুসাহেবের বেশী বিলম্ব হইল না। বাটীর মধ্যে পা দিয়াই শাশুড়ীর উচ্চকণ্ঠ রান্নাঘর হইতে শুনা গেল, তিনি মেয়েকে লইয়া পড়িয়াছেন। সে যে ঘরের মধ্যে কি করিতেছে তাহা ভাবিয়া পাইতেছেন না। নির্মল ঘরে ঢুকিয়া দেখিতে পাইল হৈম মেঝের উপর স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে। আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি, তোমার মা যে ভারী বকাবকি করচেন? তা ছাড়া সময় ত বেশী নেই।

 হৈম কহিল, ঢের সময় আছে―আজ ত আমাদের যাওয়া হতে পারে না!

 কেন?

 হৈম কহিল, কেন কি? ষোড়শীর এতবড় বিপদে তার সঙ্গে একবার দেখা না করেই যাবো?

 নির্মল কহিল, বেশ ত দেখা করেই এসো না। তারও ত সময় আছে।

 হৈম বলিল, আর তুমিই বা একবার দেখা না করে কি করে যেতে পারবে?

 এই যে সেই গতরাত্রির প্রতিক্রিয়া তাহা মনে মনে বুঝিয়া নির্মল কহিল, চেষ্টা করলে তাও বোধহয় পারা যাবে। অসম্ভব রকমের শক্ত কাজ নয়, কিন্তু আমি একবার দেখা করে গেলেই যে এ বিপদে তার সুবিধে হবে মনে হয় না।

 হৈম প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, না, সে কোনমতেই হবে না।

 হবে না কেন? তা ছাড়া আমার যে সেই সৈদাবাদের চামড়ার মামলা আছে―

 থাক তোমার চামড়ার মামলা, একটা তার করে দাও। আজ তোমার কিছুতেই যাওয়া হবে না।

 বেশ ত, চল না হয় দুজনে একবার দেখা করেই আসি। সে সময় ত আছে।

 হৈম মুখ তুলিয়া একটু হাসিয়া বলিল, না, সে তোমার সেখানে হয়, কিন্তু এখানে হয় না। আর এত লোকের সামনে বাবাই বা কি মনে করবেন? রাত্রে আমরা লুকিয়ে যাবো।

 নির্মলের যথার্থই অত্যন্ত জরুরী মকদ্দমা ছিল, তা ছাড়া কোন্‌ ছুতায় যে যাওয়া এমন স্থগিত করা যাইতে পারে সে ভাবিয়া পাইল না, বিশেষতঃ শ্বশুরের সঙ্গে ইহাতে নিদারুণ বিচ্ছেদ ঘটিবার সম্ভাবনা। চিন্তা করিয়া কহিল, সে হয় না হৈম, যেতে আমাদের আজ হবেই। আর মনে হয় আমরা মাঝে পড়ে বিপদটা হয়ত তাঁর আরও বাড়িয়ে তুলব। আমার কথা শোন, চল অযাচিত মধ্যস্থতায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী হয়।

 হৈম স্বামীর মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে ত তুমি জানো, আজ আমি কিছুতেই যেতে পারব না। আর কালকের অপরাধে যদি আমাকে তুমি শাস্তি দিতেই চাও, ত ফেলে রেখে যাও। আমি আর তোমাকে আটকাবো না।

 নির্মল আর কিছু না বলিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। শরীর ভাল নয়, আজ যাওয়া

৬৫

 দেঃ পাঃ―৫