পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাছাড়া টাকাকড়ি, দলিলপত্র, সোনারূপার বাক্স―অর্থাৎ মূল্যবান যা-কিছু সমস্তই এই সিন্দুকটিতে।

 এককড়ি কহিল, আমি আজকের নয় ঠাকুর, সব জানি। কিন্তু ও-সব কেবল তোমার মুখেই আছে, না সিন্দুকটা হাতড়ালে কিছু পাওয়া যাবে? ওই ত উনি বসে আছেন, চাবিটা চেয়ে এনে একবার খুলে দেখাও না। গ্রামের যোল আনার প্রার্থনা মঞ্জুর করে হুজুর কি হুকুম দিয়েচেন শোননি? চৈত্রসংক্রান্তির পূর্বে সমস্তই যে একদফা মিলিয়ে দেখতে হবে।

 পূজারী হতবুদ্ধির ন্যায় চুপ করিয়া রহিল। মন্দির হইতে ষোড়শীর কর্তৃত্ব যে ঘুচিয়া গেছে তাহা সে শুনিয়াছে এবং নন্দী মশায়ের প্রত্যক্ষ আদেশ অমান্য করাও যে অতিশয় সাংঘাতিক তাহাও জানে, কিন্তু কর্মনিরতা ওই যে ভৈরবী অনতিদূরে বসিয়া স্বকর্ণে সমস্ত শুনিয়াও শুনিতেছে না, তাহাকে মুখের সম্মুখে গিয়া শুনাইবার সাহস তাহার নাই। সে ভয়ে ভয়ে কহিল, কিন্তু তার ত এখনো দেরি আছে নন্দীমশাই। এদিকে সূর্যাস্ত হয়ে এল―

 তারাদাস এতক্ষণ কথা কহে নাই, এবং সঙ্কোচ ও ভয়ের চিহ্ন কেবল পূজারীর মুখে-চোখেই প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহা নয়। আস্তে আস্তে কহিল, মিলিয়ে নিতে অনেক বিলম্ব হবে নন্দীমশাই, একটু সকাল করে এসে আর একদিন এ কাজটা সেরে নিলে হবে না? কি বলেন?

 এককড়ি চিন্তা করিয়া কহিল, আচ্ছা, তাই না হয় হবে। পূজারীকে কহিল, কিন্তু মনে থাকে যেন চক্রবর্তীমশাই, এই শনিবারেই সংক্রান্তি। ষোল আনা পঞ্চায়েতি নাটমন্দিরেই হবে। হুজুর স্বয়ং এসে বসবেন। উত্তর ধারটা কানাত দিয়ে ঘিরে দিয়ে তার জন্যে মখমলের গালচেটা পেতে দিতে হবে। আলোর সেজ-কটাও তৈরি রাখা চাই।

 এককড়ি একটু জোর গলায় কথা কহিতেছিল, সুতরাং অনেকেই কৌতূহলবশে বারান্দার নীচে প্রাঙ্গণে আসিয়া জমা হইয়াছিল। সে তাহাদের শুনাইয়া আরও একটু হাঁকিয়া পূজারীকে কহিল, সেদিন ভিড় ত বড় কম হবে না―ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। মঙ্গলা মেয়েটাকে আদর করিয়া কহিল, কি গো মা ক্ষুদে ভৈরবী! দেখেশুনে সব চালাতে পারবে ত? তবে আমরা আছি, হুজুর এখন থেকে নিজে দৃষ্টি রাখবেন বলেছেন, নইলে ভার বড় সহজ নয়। অনেক বিদ্যেবুদ্ধির দরকার। বলিয়া ষোড়শীর প্রতি আড়চোখে চাহিয়া দেখিল সে ঠাকুরের পূজার সজ্জায় তেমনি নিবিষ্টচিত্ত হইয়া আছে। তারাদাসকে লক্ষ্য করিয়া হাসিয়া বলিল, কি গো ঠাকুরমশাই, নূতন অভিষেকের দিনক্ষণ কিছু স্থির হয়েচে শুনেচ? লোকে ত আমাদের একেবারে ব্যস্ত করে তুলেচে, নাবার খাবার সময় দিতে চায় না।

 প্রত্যুত্তরে তারাদাস অস্ফুটে কি যে বলিল বুঝিতে পারা গেল না। তাহারা সদর দরজা দিয়া যখন বাহির হইয়া গেল, তখন পিছনে পিছনে অনেকেই গেল এবং গুঞ্জন ধ্বনি তাহাদের প্রাঙ্গণের অপর প্রান্ত পর্যন্ত স্পষ্ট শুনা গেল, কিন্তু চণ্ডির আরতির

৮৮