পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না, তোদের সঙ্গে সে তামাশা করেচে। বিশ্বাস না করিবার তাহার বিশেষ হেতু ছিল; একে ত এই-সকল জমিজমা তাহারা পুরুষানুক্রমে ভোগ করিয়া আসিতেছে, তাহাতে সমস্ত মাঠ শুধু কেবল বীজগ্রামের সম্পত্তিও নহে। ইহার কতক অংশ চণ্ডীমাতার এবং কিছু রায়মশায়ের খরিদা। অতএব জীবানন্দ একাকী ইচ্ছা করিলেও ইহা হস্তান্তর করিয়া দিতে পারেন না। কিন্তু বৃদ্ধ বিপিন মাইতি যখন সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিল, কাল কাছারিবাটিতে সকলকে ডাকাইয়া আনিয়া নন্দীমহাশয় নিজের মুখে জানাইয়া দিয়াছেন এবং তথায় জনার্দন ও তারাদাস উভয়েই উপস্থিত ছিলেন, এবং দেবীর পক্ষ হইতে তাহার পিতা তারাদাসই দলিলে দস্তখত করিয়া দিয়াছেন, তখন অপরিসীম ক্রোধ ও বিস্ময়ে ষোড়শী বুহক্ষণ পর্যন্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। অবশেষে ধীরে ধীরে কহিল, তাই যদি হয়ে থাকে তোরা আদালতে নালিশ করা গে।

 বিপিন নিরুপায়ভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিল, তাও কি হয় মা? রাজার সঙ্গে কি বিবাদ করা চলে? কুমীরের সঙ্গে শত্রুতা করে জলে বাস করলে যার যা কিছু আছে―ভিটেটুকু পর্যন্তও থাকবে না!

 ষোড়শী কহিল, তা বলে বাপ-পিতামহের কালের পৈতৃক বিষয়টুকু তোরা মুখ বুজে ছেড়ে দিবি?

 বিপিন কহিল, তুমি যদি কৃপা করে আমাদের বাঁচিয়ে দাও মা, দীনদুঃখী আমাদের নইলে ছেলেপিলের হাত ধরে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাই ত তোমার কাছে সবাই ছুটে এসেচি।

 ষোড়শী একে একে সকলের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। ইহাদের কাহারও কিছু করিবার সাধ্য নাই; তাই এই একান্ত বিপদের দিনে দল বাঁধিয়া অপরের কৃপাভিক্ষা করিতে তাহারা বাহির হইয়াছে। এই সব নিরুদ্যম ভরসাহীন মুখের সকরুণ প্রার্থনায় তাহার বুকের ভিতরে আগুন জ্বলিয়া উঠিল; কহিল, তোরা এতগলো পুরুষমানুষ মিলে নিজেদের বাঁচাতে পারবি নে, আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি যাবো তোদের বাঁচাতে? রাগ করো না বিপিন, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এ জমি না হয়ে মাইতিগিন্নীকে যদি জমিদারবাবু এমনি জবরদস্তি আর একজনকে বিক্রি করে দিতেন, আর সে আসতো তাকে দখল করতে, কি করতে বাবা তুমি?

 ষোড়শীর এই অদ্ভুত উপমায় অনেকের মধেই চাপা হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কিন্তু বৃদ্ধের চোখের কোণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দিল। কিন্তু আপনাকে সংবরণ করিয়া সহজকণ্ঠে বলিল, মা, আমি না হয় বুড়ো হয়েছি, আমার কথা ছেড়েই দাও, কিন্তু মাইতিগিন্নীর পাঁচ-পাঁচজন জোয়ান বেটা আছে, তারা তখন জেল কেন, ফাঁসিকাঠের ভয় পর্যন্ত করবে না, এ কথা তোমাকে মা-চণ্ডীর দিব্যি করেই জানিয়ে যাচ্চি।

 সে আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ষোড়শী বাধা দিয়া কহিল, তাই যদি সত্যি হয় বিপিন, তোমার সেই পাঁচ-পাঁচজন জোয়ান বেটাকে ব’লো এই পিতা-পিতামহের কালের ক্ষেত-খামারটুকুও তাদের বুড়ো মায়ের চেয়ে একতিল ছোট নয়। এঁরা দুজনেই তাদের সমান প্রতিপালন করে এসেছেন।

৯০