বিষয়বস্তুতে চলুন

দেনা-পাওনা/এগার

উইকিসংকলন থেকে

এগার

 সকালে উঠিয় হৈম নিজের গতরাত্রির ব্যবহার স্মরণ করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল। নির্দোষ ও চরিত্রবান স্বামীর প্রতি এই অহেতুক অভিমানের উৎপাতটাকে সে ঝড়-জল ও দুর্যোগের মধ্যে তাহার আকস্মিক নিরুদ্দেশের আতঙ্কটার ঘাড়েই চাপাইয়া দিয়া মনে মনে হাসিতে চাহিল, কিন্তু সমস্ত কাণটাকে খুলিয়া দিয়া যে হাসি তাহার চিরদিনের অভ্যাস, কিছুতেই আজ তাহার আর নাগাল পাইল না। চোখের বালি বাহির হইয়া গিয়াছে বুঝিয়াও অবোধ চোখ-দুটা যেন তাহার কোনমতে নিঃশঙ্ক হইতে চাহিল না! শিরোমণি মহাশয় নিজে আসিয়া শুভক্ষণ স্থির করিয়া দিয়াছেন―সাড়ে দশটা না কিছুতেই উত্তীর্ণ হয়। মা ভাঁড়ার ঘরে যাত্রার আয়োজন ও রান্নাঘরে খাবার ব্যবস্থা করিতে অতিশয় ব্যস্ত, তাঁহার মুহূর্তের অবকাশ নাই, এমনি সময়ে সদর হইতে ডাক আসিল, রায়মহাশয় কন্যাকে আহ্বান করিয়াছেন।

 হৈম বাহিরে আসিয়া দেখিল কিসের যেন একটা উৎসব চলিয়াছে! পিতা ফরাসের উপর বাঁধা-হুঁকা হাতে বার দিয়া বসিয়াছেন, শিরোমণিমহাশয় আছেন, জমিদারের গোমস্তা এককড়ি নন্দী আছে, তারাদাস আছে, আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন, তাহার স্বামীও একধারে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। উৎসাহ ও আনন্দের প্রাবল্যে সবাই একযোগে সংবাদটা হৈমর গোচর করিতে গিয়া প্রথমটা কিছু বুঝাই গেল না। শিরোমণির দাঁত নাই, কিন্তু আওয়াজ আছে―তাহার বিপুল শান্তি মুহূর্তেই আর সমস্ত থামাইয়া দিয়া যাহা প্রকাশ করিল তাহা এইরপ―কাল ভয়ানক দুর্যোগের রাত্রে মহৎ কার্য সাধিত হইয়াছে―নির্বিঘ্নে শত্রুপুরী হস্তগত হইয়াছে। ভৈরবী বাড়ি ছিল না, চরের মুখে খবর পাইয়া তারাদাস সেই মেয়েটাকে লইয়া এই অবকাশে গিয়া সমস্ত দখল করিয়া লইয়াছে। বিবাদ করা দূরে থাক, ভয়ে সে কথাটি পর্যন্ত বলে নাই, সামান্য কিছু কিছু জিনিসপত্র লইয়া রাত্রেই বাহির হইয়া গেছে। প্রাচীরের বাহিরে মন্দির-সংলগ্ন যে চালাটার মধ্যে দূরের যাত্রীরা কেহ কেহ রান্নাবাড়া করিয়া খায়, তাহাতেই আশ্রয় লইয়াছে। এ-সমস্ত মা-চণ্ডীর কৃপা এবং এই কৃপাটা আর একটুখানি বুদ্ধি পাইলেই তাহাকে গ্রাম হইতে দূর করিয়া দেওয়াও কঠিন কাজ হইবে না।

 উৎফুল্ল তারাদাস উপরের দিকে একটা কটাক্ষপাত করিয়া সবিনয় হাস্যে কহিল, সমস্তই মায়ের কাজ―যা করবার তিনিই করেছেন, নইলে অতবড় রায়বাঘিনী একেবারে ভেড়া হয়ে গেল। তামাকটি ধরিয়ে সবে ফুঁ দিচ্ছি, মেয়েটা পাশে বসে চা-সিদ্ধটুকু ছেঁকে দিচ্ছে, এমনি সময়ে কোথা থেকে ভিজতে ভিজতে এসে হাজির। আমাদের দেখে ভয়ে যেন একেবারে কাঠ হয়ে গেল, খানিক পরে আস্তে আস্তে বলল, বাবা, আমি ত কখনও বলিনি তুমি যাও, কিংবা এখানে থেকো না। নিজে রাগ করে চলে গিয়ে কত কষ্ট না পেলে!

 আমি বললাম, হঃ―

 দোরের উপরে উঠে বলল, এ ঘরে তুমি কি তালা দিয়েচ বাবা?

 বললাম, হঃ―দিয়েছি। কি করবি কর্‌।

 চুপ করে থেকে বললে, তোমার সঙ্গে আমি কিছুই করব না বাবা, তোমরা থাকো। কেবল ঘরটা একবার খুলে দাও, আমার কাপড় দুখানা নিই।

 দিলাম খুলে। মা-চণ্ডীর দয়ায় আর কোন দাঙ্গা করলে না; পরবার খান-দুই কাপড়, একটা কম্বল, আর একটা ঘটি নিয়ে অন্ধকারেই ভিজতে ভিজতে দূর হয়ে গেল। মাকে গড় হয়ে নমস্কার করে বললাম, মা, এমনি দয়া যেন ছেলের ওপর থাকে। তোর নাম না করে কখনো জলগ্রহণ করিনে।

 শিরোমণি হাত নাড়িয়া কহিলেন, থাকবে। থাকবে! আমি বলচি তারাদাস, মা মুখ তুলে চাইবেন। নইলে তাঁর জগদম্বা নামই যে বৃথা।

 এককড়ি কহিল, কিন্তু ঠাকুর, যাই বল, মায়ের গদি কখনো খালি থাকতে পারবে না, তোমার মেয়েটিকে নতুন ভৈরবী করতে বিলম্ব করলেও চলবে না বলে রাখচি।

 রায়মহাশয় পোড়া হুঁকাটা পাশের লোকটির হাতে দিয়া পরম গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, হবে, হবে, সব হবে, আমি সমস্ত ঠিক করে দেব, তোমরা ব্যস্ত হ’য়ো না। জামাতার প্রতি চাহিয়া কহিলেন, কি বাবা, ছুঁড়ির কাছ থেকে একছত্র লিখিয়ে নেওয়া ত চাই? চাই বৈ কি। তাও হবে―ডেকে আনিয়ে দুটো ধমক দিয়ে এও আমি করিয়ে নেব। কিন্তু তাও বলে রাখচি তারাদাস, কদমতলার ওই জমিটি নিয়ে হাঙ্গামা করলে চলবে না। ধানের অড়তটা আমার সামনে সরিয়ে না আনলে চারিদিকে আর চোখ রাখতে পারচি নে। মেলার নাম করে ষোড়শীর মত ঝগড়া করলে কিন্তু―

 কথাটা সমাপ্ত করিতেও হইল না! অনেকেই তারাদাসের হইয়া রাজী হইয়া গেল এবং সে নিজে জিভ কাটিয়া গদগদ-কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, অমন কথা মুখেও আনবেন না রায়মশাই, আপনারাই ত সব! হাতীর সঙ্গে মশার বিবাদ! কি বল মা? বলিয়া সে একটা ভাল কথা কিংবা একটুখানি ঘাড়-নাড়া কিংবা এমনি কিছু একটা শুনিবার প্রত্যাশায় হৈমর মুখের প্রতি চাহিল এবং সেই সঙ্গে অনেকেরই দৃষ্টি তাহার উপরে গিয়া পড়িল। হৈম কিছুই কহিল না; পরন্তু তাহার মুখের চেহারায় ষোড়শীর সেই প্রথম বিচারের দিনটাই সকলের দপ্‌ করিয়া মনে পড়িয়া অপ্রত্যাশিত একটা নিরুৎসাহের মেঘ যেন কোথা হইতে আসিয়া পলকের নিমিত্ত ঘরের মধ্যে ছায়াপাত করিল―কিন্তু পলকমাত্রই। রায়মহাশয় সোজা হইয়া বসিয়া তামাকের জন্য একটা উচ্চ হাঁক দিয়া কহিলেন, বাবা নির্মল, যাত্রার সময়টা শিরোমণিমশায় দশটার মধ্যেই দেখে দিয়েচেন; মেয়েদের কাণ্ড―একটু সকাল সকাল তৈরি না হতে পারলে বার হওয়াই যাবে না।

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং আর কিছু বলিবার পূর্বেই হৈম নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।

 মুখ-হাত ধোয়া হইতে স্নান পর্যন্ত সমাধা করিতে বসুসাহেবের বেশী বিলম্ব হইল না। বাটীর মধ্যে পা দিয়াই শাশুড়ীর উচ্চকণ্ঠ রান্নাঘর হইতে শুনা গেল, তিনি মেয়েকে লইয়া পড়িয়াছেন। সে যে ঘরের মধ্যে কি করিতেছে তাহা ভাবিয়া পাইতেছেন না। নির্মল ঘরে ঢুকিয়া দেখিতে পাইল হৈম মেঝের উপর স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে। আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি, তোমার মা যে ভারী বকাবকি করচেন? তা ছাড়া সময় ত বেশী নেই।

 হৈম কহিল, ঢের সময় আছে―আজ ত আমাদের যাওয়া হতে পারে না!

 কেন?

 হৈম কহিল, কেন কি? ষোড়শীর এতবড় বিপদে তার সঙ্গে একবার দেখা না করেই যাবো?

 নির্মল কহিল, বেশ ত দেখা করেই এসো না। তারও ত সময় আছে।

 হৈম বলিল, আর তুমিই বা একবার দেখা না করে কি করে যেতে পারবে?

 এই যে সেই গতরাত্রির প্রতিক্রিয়া তাহা মনে মনে বুঝিয়া নির্মল কহিল, চেষ্টা করলে তাও বোধহয় পারা যাবে। অসম্ভব রকমের শক্ত কাজ নয়, কিন্তু আমি একবার দেখা করে গেলেই যে এ বিপদে তার সুবিধে হবে মনে হয় না।

 হৈম প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, না, সে কোনমতেই হবে না।

 হবে না কেন? তা ছাড়া আমার যে সেই সৈদাবাদের চামড়ার মামলা আছে―

 থাক তোমার চামড়ার মামলা, একটা তার করে দাও। আজ তোমার কিছুতেই যাওয়া হবে না।

 বেশ ত, চল না হয় দুজনে একবার দেখা করেই আসি। সে সময় ত আছে।

 হৈম মুখ তুলিয়া একটু হাসিয়া বলিল, না, সে তোমার সেখানে হয়, কিন্তু এখানে হয় না। আর এত লোকের সামনে বাবাই বা কি মনে করবেন? রাত্রে আমরা লুকিয়ে যাবো।

 নির্মলের যথার্থই অত্যন্ত জরুরী মকদ্দমা ছিল, তা ছাড়া কোন্‌ ছুতায় যে যাওয়া এমন স্থগিত করা যাইতে পারে সে ভাবিয়া পাইল না, বিশেষতঃ শ্বশুরের সঙ্গে ইহাতে নিদারুণ বিচ্ছেদ ঘটিবার সম্ভাবনা। চিন্তা করিয়া কহিল, সে হয় না হৈম, যেতে আমাদের আজ হবেই। আর মনে হয় আমরা মাঝে পড়ে বিপদটা হয়ত তাঁর আরও বাড়িয়ে তুলব। আমার কথা শোন, চল অযাচিত মধ্যস্থতায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী হয়।

 হৈম স্বামীর মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে ত তুমি জানো, আজ আমি কিছুতেই যেতে পারব না। আর কালকের অপরাধে যদি আমাকে তুমি শাস্তি দিতেই চাও, ত ফেলে রেখে যাও। আমি আর তোমাকে আটকাবো না।

 নির্মল আর কিছু না বলিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। শরীর ভাল নয়, আজ যাওয়া হইল না শুনিয়া শাশুড়ী ঠাকুরানী আশ্চর্য হইলেন, উদ্বিগ্ন হইলেন এবং ততোধিক খুশী হইয়া উঠিলেন, কিন্তু বাহিরের ঘরে বসিয়া শ্বশুর মহাশয় শুধু একটা হুঁ বলিয়াই তামাক টানিতে লাগিলেন। তিনি আশ্চর্যও হইলেন না, উদ্বিগ্নও হইলেন না এবং যাহার কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান আছে, সে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া খুশীর কথা মুখে আনিবে না।

 মকদ্দমার ব্যবস্থা করিতে নির্মল তার করিয়া দিল এবং কাজটা যে কেবল নিরর্থক নয়―মন্দ, তাহাও সে মনে মনে বুঝিল, তবুও সেই মনটাই তাহার সারাদিন একান্ত সংগোপনে সেই দিনান্তের জন্যই উন্মুখ হইয়া রহিল। বিগত রাত্রির হৈমর কান্নাটা যে কত হাস্যাস্পদ, কত অসম্ভব অপেক্ষাও অসম্ভব, সমস্ত দিন ধরিয়া এ কথা তার বহুবার মনে হইয়াছে, তবুও সেই একফোঁটা চোখের জল যেন কোনোমতেই আর শুকাইতে চাহিল না এবং প্রতি মুহূর্তেই সে এমনই একটা অজ্ঞাত ও অচিন্ত্যপূর্ব রহস্যের সৃষ্টি করিয়া চলিল, যাহা একই কালে মাধুর্য ও তিক্ততায় মিশিয়া একাত্ম হইয়া উঠিতে লাগিল।

 রাত্রির অন্ধকারেও পিতার চক্ষুকে ফাঁকি দিবার প্রয়াস নিষ্ফল বুঝিয়া হৈম স্বামী ও তাহার পশ্চিমা চাকরটাকে সঙ্গে করিয়া যখন ষোড়শীর নূতন বাসার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন সন্ধ্যা হয় নাই। ষোড়শী একখানি কম্বলের উপর বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে কি একখানা বই পড়িতেছিল, সম্মুখে জুতার শব্দ শুনিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আসুন। এস দিদি, এস। বলিয়া সে গুটানো কম্বলখানি প্রসারিত করিয়া পাতিয়া দিল।

 আসন গ্রহণ করিয়া স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া হৈম কহিল, দিদির এই নতুন ঘরখানির আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণি মশাই এমন কি আমার বাবা পর্যন্ত দিতে পারবে না। এই আশ্চর্য বস্তুটি দেখাবার লোভেই আজ এঁকে ধরে রেখেছি, নইলে আমাকে সুদ্ধ নিয়ে দুপুরের গাড়িতে চলে গিয়েছিলেন আর কি! স্বামীকে কহিল, কেমন, এ না দেখে গেলে অনুতাপ করতে হ’তো।

 নির্মল কহিল, দেখেও ত কিছু কম করতে হবে মনে হয় না।

 হৈম স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভাল। তাহার পর ষোড়শীর শান্ত মলিন মুখখানির উপর নিজের স্নিগ্ধ চোখদুটি রাখিয়া বলিল, আমরা সমস্তই শুনেচি। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে তুমি ত থাকতে পারবে না। আবেগে ও করুণায় শেষ দিকটায় তাহার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া গেল।

 কিন্তু ষোড়শীর গলায় ইহার প্রতিধ্বনি বাজিল না। সে অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, অভ্যাস হয়ে যাবে। এর চেয়ে কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই? তা ছাড়া, বাবার বড় কষ্ট হচ্ছিল।

 হৈম প্রশ্ন করিল, তা হলে সমস্তই ছেড়ে দিলে?

 ইহার উত্তর তাহার স্বামীর নিকট হইতে আসিল, সে কহিল, এ ছাড়া আর কি উপায় আছে বলতে পারো? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবা রাত্রি বিবাদ করে টিকতে পারে না। ষোড়শীকে কহিল, এই ভাল। যদি স্বেচ্ছায় এইখানে থাকাই সঙ্কল্প করে থাকেন এবং কুটীরও অভ্যাস হয়ে যাবে বিশ্বাস করে থাকেন―সংসারে কিছুই ত্যাগ করা আপনার শক্ত হবে না।

 ষোড়শী মৌন হইয়া রহিল এবং তাহার মুখ দেখিয়াও তাহার মনের কথা কিছুই বুঝা গেল না।

 হৈম বলিল, তুমি সন্নাসিনী, বিষয়-আশয় ছাড়া তোমার কঠিন নয়, কুঁড়েও তোমার সইবে আমি জানি, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?

 ষোড়শী হাসিমুখে ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া বলিল, দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে আবার মিথ্যে কাজের সৃষ্টি হয় তার গুরুভারটাই সওয়া যায় না।

 হৈম কহিল, কিন্তু এককড়ি নন্দী যে কথা এবং কাজ দুই-ই মিথ্যে রটিয়ে বেড়াচ্ছে? মেয়েমানুষের জীবনে সে যে অসহ্য।

 ষোড়শী লেশমাত্র উত্তেজিত হইল না, আস্তে আস্তে কহিল, আমি যতদূর শুনেচি, এককড়ি মিথ্যে ত বিশেষ বলেনি। জমিদারবাবু হঠাৎ অত্যন্ত পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন, ঘরে আর কেউ ছিল না―আমি তাঁর সেবা করেছি। এ ত অসত্য নয়!

 হৈম উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। আর একজনের ধীরতার তুলনায় তাহার কণ্ঠস্বর কিছু অনাবশ্যক তীক্ষ্ণ শুনাইল, কহিল, কিন্তু সকলেই ত সব কাজ পারে না দিদি। আর্তের সেবা করারও ত একটা ধারা আছে।

 ষোড়শী তেমনি মৃদুকণ্ঠে বলিল, আছে বৈ কি। কিন্তু স্থান কাল না বুঝে কেবল বাইরে থেকে ধারাটা স্থির করে দেওয়া যায় না হৈম। আপনি কি বলেন? এই বলিয়া সে নির্মলের প্রতি চাহিয়া একটু হাসিল।

 নির্মল এ ইঙ্গিত সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিয়া কহিল, অন্ততঃ আমি ত কোনমতেই অস্বীকার করতে পারিনে। তা ছাড়া কাজের ধারা সকলের একও নয়―এই যেমন সন্ন্যাসিনীর।

 স্বামীর এই উক্তিটাকে হৈম তলাইয়া দেখিল না, কহিল, হোক সন্ন্যাসিনী, কিন্তু তার কি ধর্ম নেই? তিনি কি নারী নন? আপনাকে সে ঘর থেকে ধরিয়ে নিয়ে গেল, অথচ বললেন নিজে গিয়েছিলেন। এই মিথ্যের কি আবশ্যক ছিল? তার অসুখ ত কেবল নিজের দোষে। তবুও এতবড় ঘোর পাপিষ্ঠকে বাঁচাবার আপনার কি দরকার ছিল? এর পরেও মানুষে যদি সন্দেহ করে, সে কি তাদের দোষ?

 স্ত্রীর কথা শুনিয়া নির্মল ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে জানিত, অভিযোগ করিতে হৈম ঘর হইতে বাহির হয় নাই―বাড়ি চড়িয়া অপমান করিবার মত ক্ষুদ্র এবং হীন সে নয়, বস্তুতঃ কৃতজ্ঞতা জানাইয়া একটা বড় রকমের ভরসা দিতেই সে উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু কথায় কথায় এ-সকল কি তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল। কিন্তু পাছে আত্মবিস্মৃত হইয়া আরও বেশী কিছু বলিয়া বসে, এই ভয়ে সে ব্যস্ত হইয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু আবশ্যক হইল না। ষোড়শী হাসিয়া বলিল, তোমার স্বামী বলছিলেন সন্ন্যাসিনীর ধর্ম অ-সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে নাও মিলতে পারে, এই যেমন কুঁড়ের মধ্যে নিরাশ্রয়, ধূলোবালির ওপর একাকী বাস করা তোমার সহ্য হবে না! বলিয়া সে পুনরায় হাসিয়া কহিল, সত্যই আমাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি, আমি রাগের মাথায় আপনিই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

 নির্মল কহিল, কিন্তু আপনার রাগ আছে বলে ত মনে হয় না?

 ষোড়শী হাসি চাপিয়া শুধু বলিল, আছে বৈ কি। হৈমকে কহিল, কিন্তু সে তর্ক আমি করচি নে, সত্যিই আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কিন্তু ঘোর পাপিষ্ঠ বলে কি তাকে বাঁচাবার অধিকারও কারও নেই? তোমার স্বামী উকিল, তাঁকে বরঞ্চ সময়মত জিজ্ঞাসা করে দেখো।

 নির্মল বলিল, সময়মত সাধারণ বুদ্ধিতে একটা জবাব দিতে পারি, কিন্তু ওকালতি বুদ্ধিতে ত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনে।

 ষোড়শী কহিল, তা ছাড়া এমন ত হতে পারে, সজ্ঞানে অনেক কর্মই তিনি করেন না―

 হৈম বাধা দিয়া কহিল, তাই বলে কি নিজের বাপের বিরুদ্ধেও যেতে হবে? এও কি সন্ন্যাসিনীর ধর্ম?

 ষোড়শী রাগ করিল না, হাসিমুখে কহিল, সন্ন্যাসিনীর হোক না হোক মেয়েমানুষের অন্তত এমন জিনিস সংসারে থাকতে পারে যা বাপেরও বড়। তাই যদি না হতো হৈম ভাঙ্গা কুঁড়ের মধ্যে তোমার পায়ের ধূলোই বা পড়ত কি করে?

 হৈম শশব্যস্তে হেঁট হইয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া কহিল, অমন কথা তুমি মুখেও এনো না দিদি। আমার শ্বশুরকে কোন এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় আমি প্রায় সেখানি খুলে খুলে দেখতাম। খাপখানা তার ধূলোবালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমনি কঠিন, তেমনি খাঁটি―তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয়, দেশসুদ্ধ লোক সবাই ভুল করেচে, কেউ কিছু জানে না―তুমি ইচ্ছে করলে চোখের পলকে সেই খাপখানা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। কেন দিচ্চ না দিদি?

 ষোড়শী তাহার ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া কহিল, আজ তোমাদের যাওয়ার কথা ছিল, হলো না কেন? বোধহয় কাল যাওয়া হবে?

 হৈম তাহার স্বামীকে দেখাইয়া কহিল, কলে রাত্রে কে একে হাত ধরে নদী মাঠ প্রান্তর নিবিঘ্নে পার করে এনে বাড়িতে দিয়ে গেছেন, আমার বাবা তাঁকে পুরো এক টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকাটা তার হাতে পড়বে না, কারণ তাকে খুঁজে পাবেন না। এই অন্ধ মানুষটিকে অমন করে দিয়ে না গেলে যে কি হতো সে কেবল আমিই জানি, আর আমিই কেবল তার নাম জানি। কিন্তু টাকাকড়ি ত তাকে দেবার জো নেই―তাই কেবল একটু পায়ের ধূলো নিতে―বলিয়া সে তাহার হাতখানি টানিয়া লইবার চেষ্টা করিতেই ষোড়শী নিজের মুঠাটা শক্ত করিয়া রাখিয়া কেবল একটু হাসিল।

 হৈম বাঁ হাত দিয়া তাহার চোখের কোণটা মুছিয়া লইয়া হাসিয়া কহিল, পায়ের ধূলো দিতে হবে না দিদি, মুঠোটা একটু আলগা কর―আমার হাত ভেঙ্গে গেল। শক্ত কেবল মনই নয়, হাতটাও কম নয়। ইস্পাতের তলোয়ারটা কি সাধে মনে পড়ে! কিন্তু এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয় এই প্রবাসী বোনটিকে তখন স্মরণ করবে?

 ষোড়শী তাহার হাতের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে লাগিল, কিছুই বলিল না।

 হৈম কহিল, তাহলে কথা দিতে চাও না?

 ষোড়শী বলিল, আমার জন্যে তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয় এই কি আমি চাইতে পারি ভাই?

 নির্মল কহিল, ঝগড়া না করেও ত অনেক জিনিস করা যায়?

 ষোড়শী বলিল, আমি বলি তা-ও আপনাদের চেষ্টা করে কাজ নেই। কিন্তু তাই বলে প্রবাসী বোনটিকেও আমি ভুলে যাবো না। আমার খবর আপনারা পাবেন।

 চাকরটা এতক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরে বসিয়া ছিল, সে কহিল, মা, কালকের মত আজও ঝড় জল হতে পারে―মেঘ উঠেছে!

 হৈম বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিয়া প্রণাম করিয়া এবার পায়ের ধূলা লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। নির্মল হাত তুলিয়া একটা নমস্কার করিয়া কহিল, আমি চিরদিন ঋণীই রয়ে গেলাম, শোধ দেবার আর কোন পথ রইল না। আদালতের মানুষ, বিষয়-সম্পত্তিওয়ালা ভৈরবীর কাজে লাগলেও লাগতে পারতাম, কিন্তু কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসিনীরা আমাদের হাতের বাইরে। সমস্ত না ছেড়েও উপায় ছিল না সত্যি, কিন্তু ছেড়েও যে উপায় হবে তা ভরসা হয় না।

 ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কে বললে আমি সমস্ত ছেড়ে দিয়েছি। আমি ত কিছুই ছাড়িনি।

 নির্মল ও হৈম উভয়েই অবাক হইয়া একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, ছাড়েন নি? কোন বস্তুই ত্যাগ করেন নি?

 ষোড়শী তেমনি শান্তসহজ-কণ্ঠে কহিল, না, কিছুই না। আমি স্ত্রীলোক, আমি নিরুপায়, কিন্তু আমার ভৈরবীর অধিকার একতিল শিথিল হয়নি। তাঁরা পুরুষমানুষ, তাঁদের জোর আছে, কিন্তু সেই জোরটা তাঁদের ষোল আনা সপ্রমাণ না করে আমার হাত থেকে কিছুই পাবার জো নেই―মাটির একটা ঢেলা পর্যন্ত না। নির্মল যাব, আমি মেয়েমানুষ, কিন্তু সংসারে সেটাই আমার বড় অপরাধ যাঁরা স্থির করে রেখেছেন, তাঁরা ভুল করেছেন। এ ভ্রম তাঁদের সংশোধন করতে হবে।

 কথা শুনিয়া দুজনেই স্তব্ধ হইয়া রইল। ঘরে তখনও আলো জ্বলে নাই―অন্ধকারে তাহার মুখ, তাহার চোখ, তাহার ক্ষীণ দেহের অস্পষ্ট ঋজুতা ভিন্ন আর কিছুই লক্ষ্য হইল না, কিন্তু এই শান্ত অবিচলিত কণ্ঠস্বরও যে মিথ্যা আস্ফালন উদ্গীর্ণ করে নাই, তাহা মর্মের মাঝখানে গিয়া উভয়কেই সবলে বিদ্ধ করিল।

 অনতিদূরে পথের বাঁকটার কাছে একটা গোলমাল শুনা গেল। আগে এবং পেছনে কয়েকটা আলোর সঙ্গে গোটা-দুই পালকি চলিয়াছে।

 অন্ধকারে নজর করিয়া দেখিয়া নির্মল কহিল, জমিদারবাবু তাহলে আজই পদধূলি দিলেন দেখচি।

 ষোড়শী ভিতর হইতে সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, জমিদারবাবু! তাঁর কি আসবার কথা ছিল? বলিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

 নির্মল কহিল, হাঁ, তাঁর নদীর ধারের নরককুণ্ডর ঝাড়ামোছা চলছিল। এককড়ি বলছিল, শরীর সারাবার জন্যে হুজুর আজকালের মধ্যেই স্বরাজ্যে পদার্পণ করবেন। করলেনও বটে।

 ষোড়শী নির্বাক হইয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। বিদায় লইয়া নির্মল আস্তে আস্তে কহিল, যত দূরেই থাকি, আমরা বেঁচে থাকতে নিজেকে একেবারেই নিরুপায় এবং নিরাশ্রয় ভেবে রাখবেন না। বলিয়াই সে হৈমর হাত ধরিয়া অন্ধকারে অগ্রসর হইল। ষোড়শী তেমনি স্থির তেমনি স্তব্ধ হইয়াই রহিল, এ কথার কোন উত্তর দিল না।