পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ষোড়শী অভিভূতের ন্যায় তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, হ্যাঁ।

 এ-সব তবে সত্য বল?

 ষোড়শী তেমনি অসঙ্কোচে কহিল, হ্যাঁ, সত্যি!

 জীবানন্দ অবাক হইয়া গেল। এই অপ্রত্যাশিত সংক্ষিপ্ত উত্তরের পরে তাহার নিজের মুখেও সহসা কথা যোগাইল না। শুধু কহিল,―ওঃ―সত্যি? তাহার পরে হাত বাড়াইয়া স্তিমিত দীপশিখাটাও উজ্জ্বল করিয়া দিতে দিতে ক্ষণে ক্ষণে তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অবশেষে জিজ্ঞাসা করিল, এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?

 কি আমাকে আপনি করতে বলেন?

 তোমাকে? বলিয়া জীবানন্দ স্তব্ধ নতমুখে বসিয়া তৈলবিরল প্রদীপের বাতিটা অকারণে শুধু শুধু কেবল উস্কাইতে লাগিল। খানিক পরে যখন সে কথা কহিল তখনও তাহার চক্ষু সেই দীপশিখার প্রতি। কহিল, তাহলে এঁরা সকলে তোমাকে অসতী বলে―

 এতক্ষণ পরে সে কথার মাঝখানে বাধা দিল, কহিল, সে কথা এখানে কেন? এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাইনি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কোন কারণ দেখাবার দরকার নেই!

 জীবানন্দ বলিল, তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যে কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী, এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?

 প্রতুাত্তরে ষোড়শী তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কি একটা বলিতে গিয়াও হঠাৎ চুপ করিয়া গেল দেখিয়া জীবানন্দ আপনাকে আর একবার অপমানিত জ্ঞান করিল। বলিল, একটা উত্তর দিতেও চাও না?

 ষোড়শী ঘাড় নড়িয়া বলিল, না।

 জীবানন্দ কহিল, অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভাল, বেশ! কিন্তু সমস্ত স্পষ্টই বোঝা গেছে! এই বলিয়া সে ব্যঙ্গ করিয়া হাসিল।

 কিন্তু ইহাতেও ষোড়শীর কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা নষ্ট হইল না, কহিল, স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে বলুন?

 তাহার প্রশ্ন ও অচঞ্চল কণ্ঠস্বরের গোপন আঘাতে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণ বাড়িয়া গেল, কহিল, তোমাকে কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। সত্যকার অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো আমি জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে। এ-রকম চিঠি তার লেখা চলবে না। বলিয়া সে মুখ তুলিতেই তাহার ঈর্ষার ক্রূরদৃষ্টি ষোড়শীর চোখে পড়িতে তাহার নিজের দৃষ্টি একমুহূর্তে যেমন যোজনবিস্তৃত হইয়া গেল, তেমনি লালসার তপ্ত নিঃশ্বাস নিজের সর্বাঙ্গে অনুভব করিয়া বিশ্ব সংসারে যেন তাহার অরুচি ধরিয়া গেল। মনে হইল হৈম, তাহার সংসার, এই দেবমন্দির, তাহার অসহায় প্রজাদের দুঃখ, তাহার নিজের ভবিষ্যৎ

১১৪