ভানুসিংহের পত্রাবলী/১৮

উইকিসংকলন থেকে

১৮

শান্তিনিকেতন

 আজ সকালে তোমার চিঠি পেয়েছিলুম, কিন্তু তখনি তা’র জবাব দেবার সময় পাইনি। দুপুর বেলাতেও খাবার পরে কিছু কাজ ছিল, তাই এখন বিকেলে তোমাকে তাড়াতাড়ি লিখ্‌তে ব’সেচি—ডাক যাবার আগে শেষ ক’রে ফেল্‌তে হবে। আজকাল আর বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই— আকাশ পরিষ্কার হ’য়ে গেচে। আমার সেই লেখ্‌বার কোণটা তো তুমি জানো—সেটা হ’চ্চে পশ্চিমে বারান্দা; সেখানে বিকেলের দিকে হেলে-পড়া সূর্য্যের সমস্ত কিরণ বন্ধদরজার উপরে ঘা দিতে থাকে—সশরীরে ঢুক্‌তে পায় না বটে, কিন্তু তা’র প্রতাপ অনুভব ক’র্‌তে পারি। তুমি এখন যেখানে আছো, সেখান থেকে আমার পিঠের দিকের বর্ত্তমান অবস্থা ঠিক আন্দাজ ক’র্‌তে পার বে না। কিন্তু আমার আকাশের মিতাটি আমার সঙ্গে যেম্‌নি ব্যবহার করুন, তাঁর সঙ্গে আমার কখনই বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ হয়নি। আমি চিরদিন আলো ভালোবাসি। গাজিপুরে, পশ্চিমের গরমেও, আমি দুপুর বেলায় আমার ঘরের দরজা বন্ধ করিনি। অনেক দিন বর্ষার আচ্ছাদনের পর সেই আলো পেয়েচি,—সেই আলো আজ আমার দেহের মধ্যে, মগজের মধ্যে, মনের মধ্যে প্রবেশ ক’র্‌চে। আমার সামনে পূর্ব্বদিকের ঐ খোলা দরজা দিয়ে ঐ আলো নীল আকাশ থেকে আমার ললাটে এসে প’ড়েছে, আর সবুজ ক্ষেতের উপর দিয়ে এসে আমার দুই চোখের সঙ্গে সঙ্গে যেন কানে-কানে কথা ব’ল্‌চে। পৃথিবীর ইতিহাসে কত হানাহানি কাটাকাটি হ’য়ে গেল, মানুষের ঘরে-ঘরে কত সুখ-দুঃখ, কত মিলন-বিচ্ছেদ, কত যাওয়া-আসার বিচিত্র লীলা প্রতিদিন বিস্মৃতির মধ্যে মিলিয়ে গেল, কিন্তু এই শরতের সবুজটি পৃথিবীর প্রসারিত অঞ্চলের উপরে যুগে-যুগে বর্ষে-বর্ষে আপন আসন অধিকার ক’রেচে,— কিছুতেই এই সুগভীর শান্তি সৌন্দর্য্যের পরে, এই রসপরিপূর্ণ নির্ম্মলতার উপরে, কোনো আঘাত ক’র্‌তে পারেনি। সেই কথা যখন মনে করি, তখন সাম্‌নের ঐ আকাশের দিকে চেয়ে যুগযুগান্তরের সেই শান্তি আমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত ক্ষোভকে আপন অসীমতার মধ্যে মিশিয়ে নেয়।

 আমি বুধবারে কী বলি তাই তুমি শুন্‌তে চেয়েচো। যা বলি তা আমার ভালো মনে থাকে না। এণ্ড্‌রুজ্ উপাসনার পরেই আমার কাছে এসে একবার ইংরেজিতে তা’র ভাবখানা শুনে নেন, তাই খানিকটা মনে পড়ে। এবারে ব’লেছিলুম, জগতে একটা খুব বড়ো শক্তি হ’চ্চে প্রাণ, অথচ সেই শক্তি বাইরের দিক থেকে কত ছোটো, কত সুকুমার, একটু আঘাতেই ম্লান হ’য়ে যায়। এমন জিনিষটা প্রতি মুহুর্ত্তে বিপুল জড়-বিশ্বের ভারাকর্ষণের সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে লড়াই ক’রে দাঁড়িয়ে আছে, বেড়িয়ে বেড়াচ্চে।

 বালক অভিমন্যু যেমন সপ্তরথীর ব্যূহে ঢুকে লড়াই ক’রেছিলো, আমাদের সুকুমার প্রাণ তেমনি অসংখ্য মৃত্যুর সৈন্যদলের মধ্যে দিয়ে অহর্নিশি লড়াই ক’রে চ’লেচে। বস্তুর দিক থেকে দেখ্‌লে দেখা যায়, এই প্রাণের উপকরণ অতি তুচ্ছ,—খানিকটা জল, খানিকটা কয়লা, খানিকটা ছাই, খানিকটা ঐ রকম সামান্য কিছু, অথচ প্রাণ আপনার ঐ বস্তুর পরিমাণকে বহু পরিমাণে অতিক্রম ক’রে আছে। মৃত-দেহে সজীব-দেহে বস্তুপিণ্ডের পরিমাণের তফাৎ নেই, অথচ উভয়ের মধ্যকার তফাৎ অপরিসীম। শুধু তাই নয়, সজীব বীজের বর্ত্তমান আবরণের মধ্যে মহারণ্য লুকিয়ে আছে। ছোটোর মধ্যে এই-যে বড়োর প্রকাশ,এই হ’চ্চে আশ্চর্য্য। আরেক শক্তি হ’চ্চে, মনের শক্তি। এই মনটি পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় নিয়ে এই অসীম জগতের রহস্য আবিষ্কার ক’র্‌তে বেরিয়েচে। সেই ইন্দ্রিয়গুলি নিতান্ত দুর্ব্বল। চোখ কতটুকুই দেখে, কান কতটুকুই শোনে, স্পর্শ কতটুকুই বোধ করে! কিন্তু মন এই আপন ক্ষুদ্রতাকে কেবলি ছাড়িয়ে যাচ্চে —অর্থাৎ সে যা, সে তা’র চেয়ে অনেক বড়ো। তা’র উপকরণ সামান্য হ’লেও সে অতি-ক্ষুদ্র এবং অতি-বৃহৎ অতি-নিকট এবং অতি-দূরকে কেবলি অধিকার ক’র্‌চে। তা ছাড়া, তা’র মধ্যে যে-ভবিষ্যৎ প্রচ্ছন্ন, সেও অপরিমেয়। একটি ছোটো শিশুর মনের মধ্যেই নিউটনের, সেক্সপীয়ারের মন লুকিয়ে ছিল। বর্ব্বরতার যে-মন পাঁচের বেশি গণনা ক’র্‌তে পার্‌তো না, তারি মধ্যে আজকের সভ্যতার মন জ্ঞানের সাধনায় অভাবনীয় সিদ্ধিলাভ ক’রেচে। শুধু তাই নয়, আরো ভবিষ্যতে সে-যে আরো কী আশ্চর্য্য চরিতার্থতা লাভ ক’র্‌বে, আজ আমরা তা কোনোমতেই কল্পনা ক’র্‌তে পারিনে। তা হ’লেই দেখা যাচ্চে, আমাদের এই-যে মন, যা এক দিকে খুব ছোটো, খুব দুর্ব্বল দেখ্‌তে, আর একদিকে তা’র মধ্যে যে-ভূমা আছে, হিমালয়-পর্ব্বতের প্রকাণ্ড আয়তনের মধ্যে তা নেই। তেম্‌নি আমাদের আত্মা ছোটো-দেহ, ছোটো-মন, ছোটো-সব প্রবৃত্তি দিয়ে ঘেরা, অনেক সময় তাকে যেন দেখ্‌তেই পাওয়া যায় না। কিন্তু তবু তা’র মধ্যেই সেই ভূমা আছেন। সেইজন্যেই তো এক দিকে আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আমাদের রাগ-বিরাগ যখন আমাদের কাছে অন্ন-বস্ত্র ও অন্য হাজার-রকম বাসনার জিনিষের জন্যে দরবার ক’র্‌চে, সেই মুহুর্ত্তেই এই প্রবৃত্তির দাস, এই বাসনার বন্দী, বিশ্বের সমস্ত সম্পদ পায়ের নীচে ফেলে, উঠে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা ক’রেচে,—অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, যা অসীম একেবারে তাকেই চাই। এত বড়ো চাওয়ার জোর এতটুকুর মধ্যে আছে কোথায়? সে-জোর যদি না থাক তো, তবে এত বড়ো কথা তা’র মুখ দিয়ে বেরোতো কেমন ক’রে? এ-কথার কোনো মানে সে বুঝ্‌তো কী করে? আশ্চর্য্য ব্যাপার হ’চ্চে এই-যে, মানবের আত্মা যা নিয়ে দেখ্‌চে, শুন্‌চে, ছুঁচ্চে, খাওয়া-পরা ক’র্‌চে, তাকেই চরম সত্য ব’ল্‌তে চাচ্চে না;— যাকে চোখে দেখ্‌লো না, হাতে পেলো না, তাকেই ব’ল্‌চে সত্য। তা’র একটি মাত্র কারণ, ছোটোর মধ্যেই বড়ো আছেন, সেই বড়োই ছোটোর ভিতর থেকে মানুষের আত্মাকে কেবলি মুক্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্চেন—তাই মানুষের আশার অন্ত নেই। এখন প্রত্যেক মানুষের কাজ হচ্চে কী? নিজের কথায়, চিন্তায়, ব্যবহারে এইটেই যেন প্রকাশ করি-যে, আমাদের মধ্যে সেই বড়োই সত্য। তা না ক’রে যদি মানুষের ছোটোটার উপরেই ঝোঁক দিই,—যে-সব বাসনা তা’র শিকল, তা’র গণ্ডী, যাতে তাকে খর্ব্ব করে, আচ্ছন্ন করে, তাকেই যদি কেবল প্রশ্রয় দিই,— তা হ’লে মানুষকে তা’র সত্য পরিচয় থেকে ভোলাই। আত্মা-যে অমর, আত্মা-যে অভয়, আত্ম-যে সমস্ত সুখদুঃখ, ক্ষতি-লাভের চেয়ে বড়ো, অসীমের মধ্যেই-যে আত্মার আনন্দনিকেতন, এই কথাটি প্রকাশ করাই হ’চ্চে মানুষের সমস্ত জীবনের অর্থ; এই জন্যেই আমরা এত শক্তি নিয়ে এত বড়ো জগতে জন্মেচি,—আমরা ছোটোখাটো এটা-ওটা-সেটা নিয়ে ভেবে কেঁদে ম’র্‌তে আসিনি। ইতি, ৪ঠা আশ্বিন, ১৩২৫।