ভানুসিংহের পত্রাবলী/৩৮

উইকিসংকলন থেকে

৩৮

ব্রুক্‌সাইড্
শিলং

 কাল এসে পৌঁচেচি শিলং-পর্ব্বতে, পথে কত-যে বিঘ্ন ঘ’ট্‌লো তা’র ঠিক নেই। মনে আছে—বোলপুর থেকে আসবার সময় মা-গঙ্গা আমাকে জল-কাদার মধ্যে হিঁচ্‌ড়ে এনে সাবধান ক’রে দিয়েছিলেন? কিন্তু মান্‌লুম না, বৃহস্পতিবারের বারবেলায় কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথিতে রেলে চ’ড়ে ব’স্‌লুম। দুদিন আগে রথী আমাদের একখানা মোটরগাড়ি গৌহাটি-ষ্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, ইচ্ছা ছিল—সেই গাড়িতে ক’রে পাহাড়ে চ’ড়্‌বো। সঙ্গে আমাদের আছেন দিনুবাবু এবং কমলবৌঠান, এবং আছেন সাধুচরণ, এবং আছে বাক্স তোরঙ্গ নানা আকার ও আয়তনের এবং সঙ্গে সঙ্গে চ’লেচেন আমাদের ভাগ্যদেবতা; তাঁকে টিকিট কিন্‌তে হয়নি। সান্তাহার ষ্টেশনে আসাম মেলে চ’ড়্‌লুম, এম্‌নি ক’সে ঝাঁকানি দিতে লাগ্‌লো-যে, দেহের রস-রক্ত যদি হ’তো দই, তা হ’লে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রাণটা তা’র থেকে মাখন হ’য়ে ছেড়ে বেরিয়ে আস্‌তো। অর্দ্ধেক রাত্রে বজ্রনাদ সহকারে মুষলধারে বৃষ্টি হ’তে লাগ্‌লো। গৌহাটির নিকটবর্ত্তী ষ্টেশনে যখন খেয়া-জাহাজে ব্রহ্মপুত্রে ওঠা গেল তখন আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন কিন্তু বৃষ্টি নেই। ওপারে গিয়েই মোটরগাড়িতে চ’ড়্‌বো ব’লে খেয়ে-দেয়ে সেজে-গুজে গুছিয়ে-গাছিয়ে ব’সে আছি—গিয়ে শুনি, ব্রহ্মপুত্রে বন্যা এসেছে ব’লে এখনো ঘাটে মোটর নামাতে পারেনি। এদিকে বলে, দুটোর পরে মোটর ছাড়্‌তে দেয় না। অনেক বকাবকি দাপাদাপি ছুটোছুটি হাঁক্‌ডাক ক’রে বেলা আড়াইটের সময় গাড়ি এলো। কিন্তু সময় গেল। তীরের কাছে একটা শূন্য জাহাজ বাঁধা ছিল, সেইটেতে উঠে মুটের সাহায্যে কয়েক বাল্‌তি ব্রহ্মপুত্রের জল তুলিয়ে আনা গেল;—স্নান কর্‌বার ইচ্ছা। ভূগোলে পড়া গেছে—পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল, কিন্তু বন্যার ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা স্রোতে সেদিন তিনভাগ স্থল একভাগ জল। তাতে দেহ স্নিগ্ধ হ’লো বটে কিন্তু নির্ম্মল হ’লো ব’ল্‌তে পারিনে। বোলপুর থেকে রাত্রি এগারোটার সময় হাওড়ার তীরে কাদার মধ্যে প’ড়ে যেমন গঙ্গাস্নান হ’য়েছিলো, সেদিন ব্রহ্মপুত্রের জলে স্নানটাও তেম্‌নি পঙ্কিল। তা হোক্, এবার আমার ভাগ্য আমাকে ঘাড়ে ধ’রে পুণ্যতীর্থোদকে স্নান করিয়ে দিলেন। কোথায় রাত্রি যাপন ক’র্‌তে হবে তারি সন্ধানে আমাদের মোটারে চ’ড়ে গৌহাটি সহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া গেল। কিছু দূরে গিয়ে দেখি, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ ন যযৌ ন তস্থো। বোঝা গেল, আমাদের ভাগ্যদেবতা বিনা অনুমতিতে আমাদের এ গাড়িতেও চ’ড়ে ব’সেচেন, তিনিই আমাদের কলের প্রতি কটাক্ষপাত ক’র্‌তেই সে বিকল হ’য়েচে। অনেক যত্নে যখন তাকে একটা মোটরগাড়ির কারখানায় নিয়ে যাওয়া গেল তখন সূর্য্যদেব অস্তমিত। কারখানার লোকেরা ব’ল্‌লে, “আজ কিছু করা অসম্ভব, কাল চেষ্টা দেখা যাবে।” আমরা জিজ্ঞাসা ক’র্‌লুম, “রাত্রে আশ্রয় পাই কোথায়?” তারা ব’ল্‌লে, “ডাকবাংলায়।”

 ডাকবাংলায় গিয়ে দেখি, সেখানে লোকের ভিড়— একটিমাত্র ছোটো ঘর খালি, তাতে আমাদের পাঁচজনকে পুর্‌লে পঞ্চত্ব সুনিশ্চিত। সেখান থেকে সন্ধান ক’রে অবশেষে গোয়ালন্দগামী ষ্টীমার-ঘাটে একটা জাহাজে আশ্রয় নেওয়া গেল। সেখানে প্রায় সমস্ত রাত বৌমা এবং কমলের ঘোরতর কাশি আর হাঁপানি। রাতটা এই রকম দুঃখে কাট্‌লো। পরদিনে প্রভাতে আকাশে ঘন মেঘ ক’রে বৃষ্টি হ’তে লাগ্‌লো। কথা আছে সকাল সাড়ে সাতটার সময় মোটর-কোম্পানীর একটি মোটরগাড়ি এসে আমাদের বহন ক’রে পাহাড়ে নিয়ে যাবে; সে-গাড়িখানা আর-একজন আর-এক জায়গায় নিয়ে যাবে ব’লে ঠিক ক’রে রেখেছিলো। সেখানা না পেলে দুঃখ আরো নিবিড়তর হবে—তাই রথী গিয়ে নানা লোকের কাছে নানা কাকুতি মিনতি করে সেটা ঠিক ক’রে এসেচেন। ভাড়া লাগ্‌বে একশো পঁচিশ টাকা—আমাদের সেই হাতী-কেনার চেয়ে বেশি। যা হোক্, পৌনে আটটার সময় গাড়ি এলো —তখন বৃষ্টি থেমেচে। গাড়ি তো বায়ু বেগে চ’ল্‌লো, কিছুদূর গিয়ে দেখি, একখানা বড়ো মোটরের মালগাড়ি ভগ্ন অবস্থায় পথপার্শ্বে নিশ্চল হ’য়ে আছে। পূর্ব্বদিনে আমাদের জিনিসপত্র এবং সাধুচরণকে নিয়ে এই গাড়ি রওনা হ’য়েছিলো; এই পর্য্যন্ত এসে তিনি স্তব্ধ হ’য়েচেন। জিনিস তা’র মধ্যেই আছে, সাধু ভাগ্যক্রমে একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ি পেয়ে চ’লে গেছে। জিনিস রইলো প’ড়ে, আমরা এগিয়ে চ’ল্‌লুম। বিদেশে, বিশেষত শীতের দেশে, জিনিসে-মানুষে বিচ্ছেদ সুখকর নয়। সইতে হ’লো। যা হোক্, শিলং-পাহাড়ে এসে দেখি, পাহাড়টা ঠিক আছে; আমাদের গ্রহবৈগুণ্যে বাঁকেনি, চোরেনি, ন’ড়ে যায়নি। আমাদের জিওগ্রাফিতে তা’র যেখানে স্থান ঠিক সেই জায়গাটিতে সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দেখে আশ্চর্য্য বোধ হ’লো, এখনো পাহাড়টা ঠিক আছে; তাই তোমাকে চিঠি লিখ্‌চি কিন্তু আর বেশি লিখ্‌লে ডাক পাওয়া যাবে না। অতএব ইতি—কৃষ্ণা তৃতীয়, ১৩২৬।