পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ষোড়শী কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ করিল না; শান্তস্বরে বলিল, সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু! আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।

 নির্মল বিস্মিত হইয়া কহিল, এই কথা নিজের মুখে বলতে চান? সে যে স্বীকার করার সমান হবে।

 ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।

 নির্মল সসঙ্কোচে কহিল, ওরা যে বলে―

 কারা বলে?

 অনেকেই বলে সে সময়ে আপনি―

 কোন্‌ সময়ে?

 নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অভ্যস্ত সঙ্কোচ সবলে দমন করিয়া বলিল, সেই ম্যাজিস্ট্রেট আসার দিনে। তখন আপনার কোলের উপরেই নাকি―

 ষোড়শী একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নাই―যদি দেখে থাকে, তা সত্যি, জমিদারের মাথা আমিই কোলে করে বসেছিলাম।

 নির্মল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে কহিল, তার পরে?

 ষোড়শী শান্ত মুখখানি হাসির আভাসে একটু উজ্জ্বল করিয়া বলিল, তার পরে? দিন কেটে যাচ্চে! কিন্তু কিছুতেই আর মন বসাতে পারিনে! সবই যেন মিথ্যা বলে ঠেকে।

 কি মিথ্যে?

 সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই―

 তবু ভৈরবীর আসন চাই?

 চাই বৈ কি। আর আপনি যদি বলেন, চাই না―

 না, না, আমি কিছুই বলিনে। এই বলিয়া নির্মল তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, বেলা হয়ে যাচ্চে―এখন আমি চললাম।

 ষোড়শী সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আমারও মন্দিরের কাজ আছে। কিন্তু আবার কখন দেখা হবে?

 নির্মল অনিশ্চিত অস্ফুটকণ্ঠে কি একটা কহিল, ভাল শোনা গেল না। ষোড়শী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ভাল কথা, সন্ধ্যার পর আজই ত আমাকে নিয়ে মন্দিরে একটা হাঙ্গামা আছে, আসবেন?

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া বাহির হইয়া গেল। ষোড়শী মুচকিয়া একটু হাসিল, তার পরে কুটীরের দ্বারে শিকল তুলিয়া দিয়া মন্দিরের অভিমুখে বহির্গত হইল।

১২২