পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একুশ

 শ্বশুর-জামাতা একত্রে আহারে বসিয়াছিলেন। শাশুড়ীঠাকুরানী দধি ও মিষ্টান্ন আনিতে স্থানান্তরে গেলে রায়মহাশয় কহিলেন, ষোড়শীর সঙ্গে তোমার দেখা হলো নির্মল?

 নির্মল মুখ না তুলিয়াই কহিল, আজ্ঞে হাঁ।

 কি বলে সে?

 এরূপ একটা সাধারণ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। সে ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিসের সম্বন্ধে?

 মন্দিরের সম্বন্ধে। বেটী ভৈরবীগিরি ছাড়বে, না চণ্ডীগড়ের নাম পর্যন্ত ডোবাবে? দেশের লোক ত আর বাইরের দশজনের কাছে মুখ দেখাতে পারে না এমনি হয়ে উঠেছে।

 নির্মল চুপ করিয়া রহিল। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীদিগের বিরুদ্ধে এ অপবাদ আবহমানকাল প্রচলিত আছে, এবং সেজন্যে গ্রামের কেহ কোনদিন লজ্জায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে বলিয়া প্রবাদ নাই। স্বয়ং চণ্ডীমাতাও কখনো আপত্তি করিয়াছেন বলিয়া লোকে জানে না। ইহাদের রীতিনীতি, আচার-অনাচার সমস্তই সে শুনিয়া গিয়াছিল বলিয়া এ সম্বন্ধে মন তাহার নিরপেক্ষভাবেই ছিল। বিশেষতঃ ষোড়শীর অপবাদ সে বিশ্বাস করে নাই, সতরাং ইহা মিথ্যে প্রমাণিত হইলেই সে খুশী হইত; কিন্তু এই প্রমাণকে তাহার ভৈরবী-পদের একমাত্র দাবী বলিয়া সে একদিনও গ্রাহ্য করে নাই! তাহার শ্বশুরের ইঙ্গিত নূতনও নয়, ভীষণও নয়, অথচ এই কয়টা কথাতেই অকস্মাৎ আজ তাহার মন যখন চমকিয়া সজাগ হইয়া উঠিল, তখন নিজের মনের বিক্ষিপ্ততা অনুভব করিয়া সে যথার্থই আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহাকে নিস্তব্ধ দেখিয়া রায়মহাশয় পুনশ্চ কহিলেন, কি বল হে?

 নির্ভুল ও সময়োপযোগী উত্তর দিবার সময় ও অবস্থা নির্মলের ছিল না, সে শুধু পূর্ব কথারই পুনরুক্তি করিয়া কহিল, ভৈরবীদের দুর্নাম ত চিরদিনই আছে।

 রায়মহাশয় অস্বীকার করিলেন না, বলিলেন, আছে। কিন্তু দুর্নাম জিনিসটা ত মন্দ, চিরকালের দোহাই দিয়েও মন্দটাকে চিরকাল চালানো চলে না। কি বল?

 কিন্তু সে যে মন্দ এ কি নিশ্চিত প্রমাণিত হয়ে গেছে?

 রায়মহাশয় অসংশয়ে কহিলেন, গেছে।

 নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কি করে গেল? নিশ্চয়-প্রমাণ কে দিলে?

 রায়মহাশয় বলিলেন, যে দিয়েচে সে আজও দেবে। সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যেয়ো,

১২৩