পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করবেন! মনে নেই সেই অন্তুর বোনের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা নিয়ে কি কাণ্ডই না দিনকতক করে বেড়ালেন! তা ছাড়া, ছুঁড়ি এদিকে যাই করে থাক, শোকে, দুঃখে, আপদে-বিপদে, গরীব-দুঃখীর এমন মা-বাপও গ্রামে কেউ নেই। যখনি যে কাজেই, ডাকো, মুখে হাসিটি যেন লেগে আছে, না বলতে জানে না।

 কর্তা খুশি হইলেন না, বলিলেন, হুঁ, সব ভৈরবীই ও-সব করে থাকে।

 গৃহিণী বলিলেন, সব? কেন, মাতঙ্গিনীঠাকরুনকে কি আমি চোখে দেখিনি নাকি?

 দেখে থাকলেও ভুলে গেছো।

 গৃহিণী রাগ করিয়া জবাব দিলেন, ভুলিনি কিছুই। আজও তাঁর কাছে একশ’ টাকা পাই―না বলে উড়িয়ে দিলেন। ষোড়শী কখনো কাউকে ঠকিয়ে খায়নি, মিছে কথাও বলেনি।

 কর্তা অত্যন্ত অপ্রসন্ন হইয়া কহিলেন, না―যধিষ্ঠির! এই বলিয়া তিনি আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

 গৃহিণী জামাতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি ত ভাবি এ’র কল্যাণেই নাতির মুখ আমরা দেখতে পেলাম। না বাবা, যে যাই বলুক, ঠক-জোচ্চোর সে মেয়ে নয়। তাইতো যখন শুনতে পেলাম ঠাকুরের পূজো করাটি সে ছেড়ে দিয়েচে, তখনি সন্দেহ হলো এ আবার কি। নইলে কারও কথায় আমি সহজে বিশ্বাস করিনি।

 কর্তা চৌকাঠের বাহিরে পা বাড়াইয়াছিলেন, কান খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, বলি তার কল্যাণে ত নাতি পেলে কিন্তু নাতির কল্যাণে মানসপুজোটি তিনি কেন অস্বীকার করলেন একবার ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারো না? বলিয়া তিনি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।

 নির্মলের খাওয়া শেষ হইয়াছিল, সেও উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, ষোড়শীর ওপর থেকে দেখচি মায়ের ভক্তি আজও একেবারে যায়নি।

 না বাবা, মিছে কথা কেন বলব, তার মুখখানি মনে হইলেই আমার যেন কান্না পায়। এঁরা সকলে মিলে কেন যে তার বিপক্ষে এত লেগেছেন আমি ভেবেই পাইনে।

 নির্মল একটুখানি মৃদু হাসিয়া কর্তার খোঁচার অনুসরণ করিয়া কহিল, কিন্তু মা, তার মন্ত্রতন্ত্রের বিদ্যের কথাটাও একটু ভেবো―

 শাশুড়ী কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, দাসী আসিয়া ঘরের আড়ালে দাঁড়াইয়া কহিল, কে একজন জামাইবাবকে ডাকতে এসেচে―বাবু খবর দিতে বললেন।

 নির্মল হাতমুখ ধুইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এবং সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যে বৈঠক বসিবে তাহার আলোচনা শুরু হইয়া গেছে। শিরোমণিমহাশয়ের আজ অমাবস্যার উপবাস, তিনি নির্মলকে ডাকিয়া আশীর্বাদ করিলেন, এবং বাবাজীকে হঠাৎ চিনিতে পারেন নাই, বলিয়া নিজের বৃদ্ধত্বের প্রতি দোষারোপ করিলেন। যে লোকটা থামের পাশে দাঁড়াইয়া ছিল সে নমস্কার করিয়া জানাইল যে, ভৈরবীঠাকরুন অপেক্ষা করিয়া আছেন, তাঁর সহিত বিশেষ কথা আছে।

১২৬