রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ইংলণ্ডের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ডিটেক্টিভ মিঃ ব্লেক প্রভাতে উঠিয়া চা পান করিতে করিতে একখানি প্রসিদ্ধ দৈনিক পত্রিকা খুলিলেন, হঠাৎ কয়েকটি স্থূল লাইনে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল; তিনি চায়ের পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়া রুদ্ধ নিশ্বাসে তাহা পাঠ করিলেন।

 দুই বার পাঠের পর তিনি তাঁহার অনুচর স্মিথকে বলিলেন, “ম্মিথ, এই টেলিগ্রামটা পড়িয়া দেখ; কিছু বুঝিতে পার কি না বলিও।”

 মিঃ ব্লেক স্মিথকে কাগজখানি দিলেন।—স্মিথ দেখিল, প্রথমেই বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে,—

সাল্‌ভেরিটায় ভীষণ কাণ্ড!

প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন ফেরার!!

দুই কোটী টাকার স্বর্ণমুদ্রা অদৃশ্য!

সামরিক আইন-প্রবর্ত্তনে সৈন্যগণ ক্ষিপ্তপ্রায়!

ইহার নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আছে,—

 “সাল্‌ভেরিটা হইতে যে টেলিগ্রাম পাওয়া গিয়াছে, তাহা পাঠে উক্ত সাধারণ-তন্ত্রের বর্ত্তমান বিভ্রাটের সংবাদ অবগত হইয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়াছি!

 “সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের সভাপতি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন গত পাঁচ বৎসর হইতে এই পদে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তিনি গতরাত্রে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়াছেন; তাঁহার এই আকস্মিক অন্তর্ধানের কোনও কারণ জানিতে পারা যায় নাই। কিরূপে কোথায় গিয়াছেন, তাহার পর্যন্ত সন্ধান হয় নাই!

 “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের সঙ্গে সঙ্গে দুই কোটী টাকার স্বর্ণমুদ্রা প্রাসাদ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে! বাক্সবন্দী টাকাগুলি প্রাসাদে তাঁহারই হেফাজাতে ছিল। ঘটনার দিন সন্ধ্যাকালে একখানি জাহাজে এই টাকা ইংলণ্ড হইতে সাল্‌ভেরিটায় নীত হয়। ইংলণ্ডের সুবিখ্যাত ব্যাঙ্কর্স মেসার্স ক্রিক, ফীল্ড এণ্ড কোং এই টাকা ঋণ দিয়াছিলেন।

 “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিপক্ষ দল রাষ্ট করিয়াছেন, প্রেসিডেণ্ট এই “বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করিবার জন্যই তাহা লইয়া গোপনে চম্পট দিয়াছেন! তাঁহারা বর্তমান মন্ত্রী-সমাজকে পদত্যাগ করিবার। জন্য নোটীশ দিয়াছেন।

 “সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের সমর বিভাগের কর্মচারীগণ কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহেন; তাহাদের ধারণা, দুষ্ট লোকের ষড়যন্ত্রে এই বিভ্রাট ঘটিয়াছে; তাঁহাদের এই অনুমান মিথ্যা বলিয়া মনে হয়, কারণ প্রেসিডেণ্টের অন্তর্ধানের পর প্রাসাদের রক্ষীগণকে রজ্জু বদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের সকলেরই মুখ বাঁধা ছিল!

 “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিপক্ষ দল বলিতেছেন, ইহা তাঁহারই ষড়যন্ত্রের ফল। রজ্জবদ্ধ প্রহরীরা বলিতেছে, যাহারা তাহাদিগকে বাঁধিয়া রাখিয়া টাকা লুঠ করিয়াছে, তাহাদের সকলেরই দেহে তাহাদের পরিচ্ছদের অনুরূপ পরিচ্ছদ ছিল। তাহারা ভিন্ন দেশের লোক কি সেই রাজ্যের অধিবাসী, তাহা কেহই নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে নাই।

 “সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের প্রধান সেনাপতি এখন রাজ্যের কর্তৃত্ব-ভার গ্রহণ করিয়াছেন। সৈন্যগণের অপ্রতিহত আধিপত্য চলিতেছে। কাজকর্ম্ম সমস্তই বন্ধ।

 “দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যাকালে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন মন্ত্রণা-সভায় প্রস্তাব করিয়াছিলেন,সৈন্যগণের প্রাপ্য বেতন সমস্তই পরিশোধ করিতে হইবে, এবং তাহাদের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে। সভাস্থলে এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ না হইলেও বর্ত্তমান অর্থসঙ্কট-কালে এ প্রস্তাব জনসাধারণের অনুমোদিত হয় নাই; সুতরাং এই বিভ্রাটে প্রতি পক্ষের কোনও হাত নাই, সকলে ইহা মনে করিতে পারিতেছে না।

 “সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের লণ্ডনস্থ রাজদূত সিনর মেন্‌ডোজার কন্যার সহিত প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিবাহের প্রস্তার স্থির হইয়াছিল।

 ভবিষ্যতের গর্ভে কি রহস্য নিহিত আছে, তাহা জানিবার জন্য সকলেই উদ্‌গ্রীব হইয়া আছে।”

(পরবর্ত্তী সংবাদ।)

 “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনর অন্তর্ধান-সম্বন্ধে দুই একটি কথা জানিতে পারা গিয়াছে।

 “একজন জেলে সংবাদ দিয়াছে, সে পর দিন প্রত্যুষে সমুদ্র-তীরে মাছ ধরিতে গিয়া দুই খানি ফ্ল্যাটকে সমুদ্র-বক্ষস্থিত, একখানি জাহাজের দিকে যাইতে দেখিয়াছে। সেই স্থান পোর্টো কষ্টান্ত বন্দর হইতে প্রায় পনের মাইল দূরে অবস্থিত।  “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের প্রতিপক্ষগণ এই সংবাদ শুনিয়া বলিতেছেন, ইহা তাঁহারই খেলা। তিনি টাকাগুলি আত্মসাৎ করিয়া এই জাহাজে পলায়নের জন্য পূর্ব্ব হইতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন; এই ঘটনা তাহারই ষড়যন্ত্রের প্রধান প্রমাণ।

 “কার্যনির্ব্বাহক মন্ত্রীসমাজ পদ ত্যাগ করিয়াছেন। প্রতিপক্ষের দলপতি সিনর মার্টিনা অস্থায়ীভাবে সভাপতির পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন।

 “আমাদের রিপোর্টার সাল্‌ভেরিটার লণ্ডনস্থ রাজদূত-ভবনে সিনর মেন্‌ডোজার সহিত সাক্ষাতের জন্য গমন করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁহার সহিত সাক্ষাতের সুযোগ পান নাই।—মেসার্স ক্রিক্‌,ফিল্ড এণ্ড কোম্পানী এ সম্বন্ধে কোনও সংবাদ পাইয়াছেন কি না জিজ্ঞাসা করায় তাঁহারা বলিয়াছেন, বিশেষ সংবাদ তাঁহারা কিছুই বলিতে পারেন না।”

 স্মিথ সংবাদপত্র হইতে মুখ তুলিয়া মিঃ ব্লেককে বলিলেন, “আমার ত বোধ হইতেছে এ প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনেরই খেলা! দুই কোটী টাকার লোভ সামলাইতে না পারিয়া প্রেসিডেণ্ট টাকাগুলি লইয়া চম্পট দিয়াছে।”।

 মিঃ ব্লেক হাসিয়া বলিলেন, “তুমিও তাহাকে অপরাধী মনে এ করিতেছ?”।

 স্মিথ বলিল, “অন্যের পক্ষে কি এ ভাবে ভাণ্ডার লুঠ করা সম্ভব? আপনি কি মনে করেন?”

 মিঃ ব্রেক বলিলেন, “প্রথম দৃষ্টিতে এই রকমই বোধ হয় বটে; কিন্তু ভিতরের ব্যাপার কি, সন্ধান ব্যতীত কিরূপে তাহা নির্ণীত হইবে? তোমার বোধ হয় মনে আছে—কিছু দিন পূর্ব্বে পোর্টো কষ্টায় আমি বার্ণেস্‌ নামক একজন প্রকাও জালিয়াৎকে গ্রেপ্তার করিয়াছিলাম। স্থানটি আমার পরিচিত, সেই জন্যই সেখানকার ব্যাপার জানিবার জন্য আমার বড় কৌতুহল হইয়াছে।”

 স্মিথ বলিল, “কিন্তু পোর্টো কষ্টা বা সাল্‌ভেরিটা সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নাই; ইহার জ্ঞাতব্য বিবরণ আমাকে বলিবেন কি?”

 মিঃ ব্লেক উঠিয়া তাঁহার আফিস-ঘরে প্রবেশ করিলেন, এবং তাঁহার আলমারি হইতে নূতন ‘ডাইরেক্টরী’ বাহির করিয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিলেন; স্মিথ তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া রহিল।

 মিঃ ব্লেক একখানি পাতা খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন,“—সাল্‌ভেরিটা।—দক্ষিণ আমেরিকার একটি ক্ষুদ্র রাজ্য; জনসংখ্যা সাত লক্ষ। রাজধানী পোর্টো কষ্টা। পোটো কষ্টা সমুদ্র-তীরবর্ত্তী সুন্দর বন্দর। রাজ্যে সাধারণতন্ত্র শাসনপ্রণালী প্রবর্ত্তিত। একটি শাসন-পরিষদ লইয়া প্রেসিডেণ্ট এই রাজ্য শাসন করেন। বর্ত্তমান প্রেসিডেণ্টের নাম, জেম্‌স পিয়ারসন। পূর্ব্বে তিনি সৈন্যদলের প্রধান সেনা-পতির পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।”

 এই পর্য্যন্ত পাঠ করিয়া মিঃ ব্লেক অনাবশ্যক কয়েক ছত্র বাদ দিয়া পূনর্ব্বার পাঠ করিতে লাগিলেন, “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন কোন্ দেশ হইতে সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে উপস্থিত হন, তাহা সাধারণের অজ্ঞাত; পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে তিনি সর্ব্ব-প্রথম এই রাজ্যে পদার্পণ করেন। সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের লণ্ডনস্থ বর্ত্তমান রাজদূত সিনর মেন্‌ডোজার কন্যার সহিত প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিবাহের প্রস্তাব স্থির হইয়াছে।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন-সম্বন্ধে ইহাতে অন্য কোনও জ্ঞাতব্য কথা নাই।—এখন সিনর মেন্‌ডোজা সম্বন্ধে কি জানিতে পারা যায় দেখ।”  “মেন্‌ডোজা-জোস্‌;—সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের লণ্ডনস্থ রাজদূত। আবাদের কার্যে ইঁহার অসাধারণ অনুরাগ। ইঁহার সম্পত্তির মূল্য প্রায় পাঁচ কোটী টাকা। বয়স প্রায় ৬০ বৎসর। সংসারে এক কন্যা ভিন্ন অন্য কেহই নাই; পত্নীর পরলোক গমনের পর আর বিবাহ। করেন নাই। কন্যার বয়স এখন ২৫ বৎসর।”

 মিঃ ব্লেক ‘ডাইরেক্টরী’ বন্ধ করিয়া যথাস্থানে রাখিলেন, তাহার পর বাতায়নের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন।

 স্মিথ জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে নিরপরাধ মনে করিতেছেন? আমি ত কিছু ই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছি না।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “এখন এ সম্বন্ধে অনুমান করিয়া কিছুই বলা যায় না। যদি একবার সিনর মেন্‌ডোজার সহিত আমার সাক্ষাৎ! হইত তাহা হইলে,—সিঁড়িতে কাহার পদ শব্দ শুনিতেছি না? আমার বোধ হয় সিলর মেন্‌ডোজাই আমার সহিত দেখা করিতে আসিতে ছেন।—স্মিথ, দেখ দেখি আগন্তুক কে?”

 স্মিথ সিঁড়ির দিকে ধাবিত হইল। মিঃ ব্লেক চেয়ারে বসিয়া চুরুট টানিতে লাগিলেন।

 স্মিথ ব্যগ্রভাবে, ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আপনার অনুমান সত্য, সিনর মেন্‌ডোজাই আসিয়াছে। তাঁহাকে এখানে লইয়া আসিব কি?”

 মিঃ ব্লেক সম্মতিসূচক মাথা নাড়িলেন। অল্পক্ষণ পরে সিনর ডোজ। স্মিথের সঙ্গে সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন।

 সিনর মেন্‌ডোজা খর্ব্বকায়, তাঁহার ‘দাড়ি গোঁফ পাকা; মুখ মলিন, চক্ষুতে মানসিক উদ্বেগ প্রতিফলিত।  মিঃ ব্লেক উঠিয়া সহাস্যে বলিলেন, “আসুন, সিনর মেন্‌ডোজা! আপনার মুখ দেখিয়া বুঝিতেছি, আপনি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে নির্দ্দোষ মনে করিতেছেন; আপনার বিশ্বাস, কাহারও ষড়যন্ত্রে এই বিভ্রাট ঘটিয়াছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার কি, অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া তাহা বলা যায় না।”

 সিনর মেন্‌ডোজা একখানি চেয়ারে ঝুপ্‌ করিয়া বসিয়া পড়িলেন, তাহার পর সবিস্ময়ে বলিলেন, “আপনার কথা শুনিয়া আমি যে। অবাক্ হইলাম! আপনি কিরূপে বুঝিলেন প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের ব্যাপার সম্বন্ধে আলোচনা করিতেই আপনার নিকট আসিয়াছি? আর তাহাকে যে নিরপরাধ বলিয়া আমার বিশ্বাস, আপনার এ ধারণাই বা কিরূপে হইল?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “ইহাতে বিস্ময়ের কারণ নাই। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন গত পাঁচ বৎসর হইতে সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত ছিলেন; সেখানে তাঁহার মান সম্ভ্রম, ক্ষমতা প্রতিপত্তি অসাধারণ; মানুষের যাহা আকাঙ্ক্ষা, তাঁহার সে আকংখাপূর্ণ হইয়াছে; আপনার কন্যার সহিত তাহার পরিণয়-সম্বন্ধও স্থির হইয়াছে। আপনার একমাত্র কন্যা আপনার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হইবেন। এ অবস্থায় কোন্ গুপ্ত সঙ্কল্প বশবর্তী হইয়া প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন টাকা চুরী করিয়া পলাইবেন?

 “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন যথেচ্ছাভাবে এই টাকা খরচ করিতে পারিবে এই টাকার জন্য কি কেহ এমন প্রভুত্ব, সম্মান, প্রতিপত্তি, ভবিষ্যতের আশা বিসর্জ্জন দিতে সম্মত হয়? সকল আশা ভরসা, সুখ সুবিধা ক্ষমতা প্রতিপত্তি, ত্যাগ করিয়া অবজ্ঞাত কলঙ্কিত নির্ব্বাসিত জীবন যাপনে কি কাহারও প্রবৃত্তি হয়?—না, প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন টাকা চুরী করেন নাই। স্বেচ্ছায় তিনি দেশত্যাগী হন নাই।

 “তাহার পর কথা,—আপনি অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন; যদি আপনি মিঃ পিয়ারসনকে অপরাধী মনে করিতেন, তাহা হইলে কি গোপনে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন? না, আপনি নিশ্চয়ই ইউরোপের সকল রাজধানীর পুলিসের সাহায্য প্রার্থনা করিতেন। হয় ত ইতিমধ্যেই সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের গবমেণ্ট ইউরোপের ও আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশে এ সংবাদ দিয়াছেন। কিন্তু আপনি মনে করিয়াছেন, ভিতরে কোনও পূঢ় রহস্য আছে, প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে টাকা সমেত কেহ বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে;—তাই আপনি আমার সাহায্য লাভের আশায় আসিয়াছেন। আপনি বুঝিতে পারিয়াছেন, সাধারণ পুলিশের সাধ্য নাই—এই রহস্য ভেদ করে।”

 সিনর মেন্‌ডোজা বলিলেন, “আপনার অনুমান যথার্থ। আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা আপনি আমাকে দেখিবামাত্র চট্‌ করিয়া, আমার মনের ভাব বুঝিয়া ফেলিয়াছেন। অন্য কোনও লোক ইহা পারিত কি না সন্দেহ। আপনার ক্ষমতা সম্বন্ধে পূর্ব্বাপর যে সকল গল্প শুনিয়াছি, তাহা হইতে কুঝিয়াছি আপনি অসাধারণ ব্যক্তি; সেই জন্যই আপনার সাহায্য লাভের আশায় আসিয়াছি। পিয়ারসন নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ নিরপরাধ, তিনি টাকা চুরী করিয়া পলায়ন করেন নাই। মানুষ অভাবে পড়িয়া চুরী করে লোভে পড়িয়া চুরী করে; তিনি কি জন্য এ টাকা চুরী করিবেন?—পিয়ারসনের নিরুদ্দেশের কথা শুনিয়া আমার প্রাণাধিকা কন্যা শয্যা গ্রহণ করিয়াছে; ‘তাহার মুখ দেখিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। মিঃ ব্লেক, আপনি আমার কন্যাকে বাঁচান। তাহার কাতরতা আমার অসহ্য”।

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “মিঃ পিয়ারসন যে নিরপরাধ, এ টাকায় তিনি লোভ করেন নাই, ইহা আপনার অনুমান মাত্র।—কিন্তু মনে করুন, আমি আপনার অনুমানে বিশ্বাস করিলাম না, আপনি মিঃ পিয়ারসনের সপক্ষে কোনও অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেন?”

 সিনর মেন্‌ডোজা বলিলেন, “হাঁ পারি বৈ কি? কিন্তু আমি আপনাকে যাহা বলিব, তাহা অতি গুপ্ত কথা; এ কথা অন্য কাহারও জানা নাই। আপনি শুনিয়া বিস্মিত হইবেন, মিঃ পিয়ারসন সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে যে ভূ-সম্পত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন,তাহারই মূল্য প্রায় দুই কোটী টাকা! এই সম্পত্তি আমার বেনামীতে আছে। তিনি এই সম্পত্তির কোন খোঁজ-খবরও লইতেন না,—পাছে গুপ্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে; পাছে তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁহার উপর দুর্ণামের আরোপ করে। এই সম্পত্তির উপর আমার সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার হস্তগত হইবার আশা ছিল; আমার কন্যার সহিত তাহার বিবাহ হইলে, আমার যাহা কিছু আছে সকলই ত আমার সেই জামাতার। মিঃ ব্লেক, আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন, দুই কোটী টাকার লোভে কোন্ মূর্খ এ সকলের আশা ত্যাগ করিবে?”

 সিনর মেন্‌ডোজা মুহূর্তকাল নিস্তব্ধ করিয়া পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, “মিঃ ব্লেক, এই সকল কারণেই বলিতেছি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন নিরপরাধ। আমার বিশ্বাস, তাঁহার শত্রুদল চক্রান্ত করিয়া এই খেলা খেলিয়াছে; টাকাগুলি আত্মসাৎ করিয়া, তাঁহাকে বোধ হয় সাল্‌ভেরিটার পাহাড়ের মধ্যে কোনও স্থানে ‘গুম্’ করিয়া রাখিয়াছে। আপনি তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিবার ভার না লইলে অন্যের ইহা অসাধ্য। এজন্য আপনার যত টাকার আবশ্যক,আপনি তাহা পাইবেন; কি বাবদে কত টাকা খরচ হইল, তাহার হিসাবও আপনাকে দিতে হইবে না। আপনি যদি তাহার নির্দ্দোষিত প্রতিপন্ন করিয়া আমার, কন্যার উদ্বেগ দূর করিতে সমর্থ হন, তাহা হইলে আপনার পরিশ্রমের উপযুক্ত পুরস্কার প্রদানে কুণ্ঠিত হইব না। আপনি এই তদন্তের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিতে অসম্মত হইবেন না; আমার এ অনুরোধ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।”

 মিঃ ব্লেক হঠাৎ কোনও উত্তর না দিয়া নত মস্তকে চিন্তা করিতে। লাগিলেন; তাঁহার পর মুখ তুলিয়া বলিলেন, “আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম, এই ব্যাপারের তদন্তভার আমি স্বয়ং গ্রহণ করিব; এই অদ্ভুত রহস্যভেদের জন্য আমার বড় আগ্রহ হইয়াছে। আজই আমি এখান হইতে যাত্রা করিব।”

 সিনর মেন্‌ডোজা হর্ষ-বিগলিত স্বরে বলিলেন,“মিঃ ব্লেক, আপনার কথা শুনিয়া যে কত দূর আনন্দিত ও আশ্বস্ত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না; আপনি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপাতত আপনাকে কত টাকা দিতে হইবে বলুন, আমি তাহা অবিলম্বে আপনার নিকট পাঠাইয়া দিব। আপনি আমার প্রার্থনা অগ্রাহ্য করিবেন না ভাবিয়া আমি ইতিপূর্ব্বেই লড কার্ড বাইয়ের সর্ব্বাপেক্ষা দ্রুত গামী জাহাজখানি অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভাঁড়া লইয়াছি; এই জাহাজেই আপনি সাল্‌ভেরিটায় যাত্রা করিতে পারেন। আপনি যে মুহূর্তে ইচ্ছা করিবেন, সেই মুহূর্তেই যাহাতে জাহাজ ছাড়িভেরে, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া আসিয়াছি

 মিঃ ব্লেক বলিলেন,“আপনার তৎপরতা প্রশংসনীয়। আমি সর্ব্বপ্রথমে সাল্‌ভেরিটায় যাত্রা করিব কি না তাহা শীঘ্রই স্থির করিব; যদি যাই,  তবে সাধারণ পথে না পথে না গিয়া, যে পথ দিয়া অতি শীঘ্র সেখানে যাওয়া যায়—সেই পথেই যাইব। কিন্তু আপনাকে একটা অনুরোধ আছে; আপনি আমার কাছে আসিয়াছিলেন, এবং আমি এই ব্যাপরের তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছি, ইহা আপনি কাহাকেও বলিবেন না। এমন কি, এ কথা আপনার কন্যার নিকটে ও গোপন করিবেন। যদি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন সত্যই নিরপরাধ হন, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তাঁহার শত্রুপক্ষ অত্যন্ত পরাক্রান্ত, এবং তাহাদের ষড়যন্ত্র দারুণ রহস্য-জালে আচ্ছন্ন; সুতরাং আমাকে অতি সাবধানে—অতি গোপনে তদন্তে প্রবৃত্ত হইতে হইবে।”

 সিনর মেন্‌ডোজা বলিলেন, “আপনি সঙ্গত কথাই বলিয়াছেন; আপনি আমাকে যাহা করিতে বলিবেন, আমি তাহাই করিব। এ সকল কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিব না। মন্ত্রগুপ্তি যে কার্য্যসিদ্ধির প্রধান সহায়, এ কথা আমাদের ন্যায় রাজনীতিজ্ঞের সুবিদিত।”

 মিঃ ব্লেক গাত্রোখান করিয়া বলিলেন,“উত্তম; আপনাকে অতঃপর কোনও কথা জানাইতে হইলে, আমার সহকারী স্মিথের দ্বারা আপনাকে সংবাদ দিব।”

 সিনর মেন্‌ডোজা বলিলেন, “আমি এখন বিদায় লইলাম। পরমেশ্বর আপনার চেষ্টা সফল করুন;এই সাফল্যের উপর আমার কন্যার জীবনের সকল সুখ শান্তি নির্ভর করিতেছে।”

 সিনর মেন্‌ডোজা অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত মনে মিঃ ব্লেকের গৃহ হইতে প্রস্থান করিলেন।