বাঙ্গলা ব্যাকরণ/বাক্য

উইকিসংকলন থেকে

বাক্য।

 পরস্পর সাপেক্ষ পদ সমূহকে বাক্য বলে। যথা; রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত বনে গমন করিয়াছিলেন।

 অন্ততঃ দুই পদের ন্যূনে বাক্য হয় না। একটি কর্ত্তৃপদ ও একটি ক্রিয়াপদের আবশ্যকতা করে[১]। অতএব কর্ত্তৃপদ ও ক্রিয়াপদ বাক্যের প্রধান অঙ্গ। যথা; শীত হইতেছে, তিনি যাইতেছেন ইত্যাদি।

 আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও আসত্তি অনুসারে পদ স্থাপন করিলেই বাক্যার্থ জ্ঞান জন্মে।

 তাৎপর্য্য গ্রহের নিমিত্ত এক পদের পর অপর পদগুলি ক্রমে ক্রমে শুনিতে যে ইচ্ছা জন্মে, তাহাকে আকাঙ্ক্ষা কহে। আকাাঙ্ক্ষা অনুসারে পদবিন্যাস ভিন্ন বাক্য হয় না। যথা; “আমি লেখনী দ্বারা” এই মাত্র বলিলেই “লিখিতেছি” এই ক্রিয়া শ্রবণের অভিলাষ জন্মে; অতএব ঐরূপ প্রয়োগ করিলেই বাক্য হইবে। কিন্তু “যাইতেছে” এই পদে শ্রোতার আকাঙ্ক্ষা নাই, সুতরাং তাদৃশ নিরাকাঙ্ক্ষ পদ প্রয়োগ করিলেও বাক্য হইবে না।

 অন্বয় কালে পদ সকলের অর্থে পরস্পর বাধা না থাকাকে যোগ্যতা কহে। যোগ্যতা অনুসারে পদবিন্যাস ভিন্ন বাক্যার্থ বোধ হয় না। যথা; “অগ্নি দ্বারা পাক করিতেছে” ইত্যাদি স্থলে অগ্নির পাকসাধনযোগ্যতা আছে বলিয়া উহাকে যেমন যোগবাক্য বলা যায়, “অগ্নিতে আর্দ্র হইতেছে” ইত্যাদি পদ সমূহকে তেমন যোগ্য বাক্য বলা যায় না; কেন না অগ্নির আর্দ্র করণে বাধা আছে। সুতরাং উহা উন্মত্ত প্রলাপের ন্যায়, প্রকৃত বাক্য মধ্যে পরিগণিত নহে[২]

 অর্থ বোধের সময় অনাসন্ন পদ দ্বারা অর্থ বোধের বিচ্ছেদ না হওয়াকে আসত্তি কহে। আসত্তি অনুসারে পদ স্থাপন করা উচিত[৩]। “আমার পুস্তক” এই স্থলে “আমার” এই পদের পরেই যাহার সহিত সম্বন্ধ সেই পুস্তক পদ তখনই প্রয়োগ করিতে হইবে। তাহা হইলে আসত্তি বশতঃ অর্থ প্রতীতির ব্যাঘাত জন্মিবে না। কিন্তু “হইতে আমি উচ্চ এক পড়িয়াছি বৃক্ষ ফল” এই স্থলে আসত্তি নাই বলিয়া অর্থ প্রতীতি হয় না। সুতরাং উহাকে বাক্য বলা যাইতে পারে না।

 উক্ত বাক্য সমুদায় প্রথমতঃ প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত। যথা; গদ্যময় ও পদময়।

 যে সমুদায় বাক্য ছন্দোবন্ধে বদ্ধ নহে, তাহাদিগকে গদ্যময় বাক্য কহে। যথা; অশ্ব দৌড়িতেছে, পশুগণ বিচরণ করিতেছে। ইত্যাদি।

 যে সমুদায় বাক্য ছন্দোবন্ধে বদ্ধ, তাহাদিগকে পদ্যময় বাক্য বলে। যথা—

“আজ্ঞা দিল কৃষ্ণচন্দ্র ধরণীঈশ্বর।
রচিল ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর।”

ইত্যাদি।

 বাক্য ত্রিবিধ। যথা; সম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ ও অসমাপিত।

 যে বাক্য প্রয়োগ করিলে সমুদয় অর্থ বুঝা যায়, আর বাক্যন্তর শ্রবণের আকাঙ্ক্ষা থাকে না, তাহাকে সম্পূর্ণ বাক্য বলে। যথা; গান করিতেছে, অগ্নি জ্বলিতেছে ইত্যাদি।

 যে বাক্য প্রয়োগ করিলে সমুদয় অর্থ জ্ঞান হয় না, বাক্যান্তর শ্রবণের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহাকে অসম্পূর্ণ বাক্য বলে। যথা; “যখন বলিতেছিলে, যেই শুনিলাম,” ইত্যাদি বাক্যের পরেই যথাক্রমে “সে সময় আমি উপস্থিত ছিলাম, অমনি ক্রোধ জন্মিল” ইত্যাদি বাক্যান্তর না বলিলে বক্তার মনোগত ভাবের শেষ হয় না এবং শ্রোতারও সম্পূর্ণ অর্থগ্রহ হয় না। সুতরাং উহাদিগের এক একটিকে অসম্পূর্ণ বাক্য বলে।

 যে বাক্য অসমাপিকা ক্রিয়ার অন্তর্গত, তাহাকে অসমাপিত বাক্য বলে। যথা; তিনি যাইয়া, মাধব ভোজন করিলে, ইত্যাদি।

 অসম্পূর্ণ ও অসমাপিত বাক্যকে বাক্যাংশও বলে। আর যখন তাহারা বাকান্তরের সহিত মিলিয় সমগ্র তাৎপর্য প্রকাশ করে, তখন তাহাদিগকে সংযুক্ত বাক্য বলে। বাক্যাংশ, যথা; যদি তিনি যান। সংযুক্ত বাক্য, যথা; যে দিন আমি কলিকাতায় ছিলাম, সে দিন বড় বৃষ্টি হইয়াছিল।

 উক্ত সমুদায় বাক্যকে ক্ষুদ্র বাক্য বলে। উক্তরূপ কতকগুলি ক্ষুদ্রবাক্য যদি এক ক্রিয়ার অন্তর্গত হয়, তবে তাহাকে মহাবাক্য বলে। মহাবাক্য, যথা; “দেখিলেন, ঐ সরসীর তীরে হংস, বক, চক্রবাক প্রভৃতি নানাবিধ জলচর পক্ষিগণ কলরব করিতেছে; মধুকরেরা মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া গুন্ গুন্ ধ্বনি করত ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে; প্রফুল্ল কমল সমূহের সৌরভে চতুর্দ্দিক্ আমোদিত হইতেছে” ইত্যাদি।

 বাক্যের অর্থ তিন প্রকার। যথা; শক্যার্থ, লক্ষ্যার্থ, ও ব্যঙ্গ্যার্থ।

 শক্যার্থ।—যে পদ প্রয়োগ করিলে যে অর্থের প্রতীতি হয়, তাহাতেই সেই পদের শক্তি। ঐ শক্তিমূলক অর্থকে শক্যার্থ বলে। যথা; “লেখনী” এই পদ প্রয়োগ করিলে কলমকে বুঝায়, সুতরাং লেখনী পদের শক্যার্থ কলম।

 লক্ষ্যার্থ।—যে পদে যে অর্থ প্রতীতি হয়, তাৎপর্য্য সিদ্ধি হয় না বলিয়া তাহা পরিত্যাগ পূর্ব্বক যদি তৎ সন্নিহিত কোন পদার্থ গ্রহণ করা যায়, তবে তাহাকে লক্ষণা কহে। লক্ষণামূলক অর্থকে লক্ষ্যার্থ কহে। যথা; “দুর্ভিক্ষে উড়িষ্যা উচ্ছিন্ন হইয়াছে” এখানে উড়িষ্যা দেশের উচ্ছেদ অসঙ্গত বলিয়া লক্ষ্যার্থ দ্বারা উড়িষ্যাবাসী লোককে বুঝাইল।

 ব্যঙ্গ্যার্থ।—শক্তি বা লক্ষণা দ্বারা অর্থ অজ্ঞান হইলে পর যে শক্তি দ্বারা তাৎপর্য্যার্থ প্রতীতি হয়, তাহার নাম ব্যঞ্জনা। ব্যঞ্জনামূলক অর্থই ব্যঙ্গ্যার্থ। যথা; “ভাল তুমি যে উপকার করিয়াছে, ঐরূপ করিয়া চিরদিন সুখে থাক”। এখানে শব্দার্থ জ্ঞানানন্তর এইরূপ একটি অর্থ প্রতীতি হইতেছে যে তুমি বড় অপকার করিয়াছি, তোমার কখন ভাল হইবে না। ইহাকেই ব্যঙ্গ্যার্থ বলে। যে কাব্যে অধিক ব্যঙ্গ্যার্থ থাকে, তাহাই উত্তম।

 রসাত্মক বাক্যের নাম কাব্য। যাহার বৃত্তান্ত অবলম্বন করিয়া কাব্য রচিত হয়, তাহকে নায়ক বলে। প্রায়ই নায়কের নামানুসারে, কাব্যের নাম করণ হয়। যেমন টেলিমেকস্ নামক নায়ককে অবলম্বন করিয়া যে বাক্য রচিত, তাহার নাম টেলিমেকস্ ইত্যাদি। কখন কখন বর্ণনীয় বিষয় অনুসারেও কাব্যের নাম করণ হয়। যথা; কুলীন কুলসর্বস্ব ইত্যাদি।

 কাব্যের মধ্যে এক এক রস প্রধান থাকে। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য রসও বর্ণিত হয়। যে কাব্যে যে রস প্রধান তাহাকে সেই রসাত্মক কাব্য বলে। যথা; কাদম্বরী কাব্যে শৃঙ্গার বীর বিস্ময়াদি নানা গুণীভূত রস সত্ত্বেও কারুণ্য রস প্রধান বলিয়া উহা করুণ রসত্মক কাব্য।

 কাব্য প্রথমতঃ প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত। যথা; দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্য কাব্য।

 দৃশ্যকাব্য।—যে কাব্য শুনা যায়, অথবা রঙ্গভূমিতে যাহার অভিনয় দেখা যায়, তাহাকে দৃশ্যকাব্য বলে। দৃশ্যকাব্যই নাটক। যথা; কুলীন কুলসর্ব্বস্ব, বিধবাবিবাহ ইত্যাদি।

 নাটক উর্দ্ধসঙ্খ্যায় দশ পরিচ্ছেদে বিভক্ত হয়। ঐ পরিচ্ছেদের নাম অঙ্ক। নাটক জাত্যুক্ত গদ্যময় ভাষায় রচিত হয়। তাহার মধ্যে মধ্যে পদ্যও থাকে।

 শ্রব্যকাব্য।—যাহার কেবল শ্রবণ হয় তাহাকে শ্রব্যকাব্য বলে। যথা; রামায়ণ, বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। শ্রব্য কাব্য প্রধান তিন ভাগে বিভক্ত। যথা; গদ্যময়, পদ্যময় ও গদ্যপদ্যময়।

 যাহার আদ্যোপান্ত গদ্যে রচিত, তাহাকে গদ্যময় কাব্য বলে। যথা; কাদম্বরী, টেলিমেকস্ ইত্যাদি। আর যাহা কেবল পদ্যে বিরচিত, তাহার নাম পদ্যময় কাব্য। যথা: অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি। যাহাতে গদ্য ও পদ্য দুই আছে, তাহাকে গদ্যপদ্যময় কাব্য বলে। যথা; সুধীরঞ্জন প্রভৃতি।

 ঐ গদ্যপদ্যময় কাব্যের প্রকারভেদে পৃথক্ পৃথক্ নাম হইয়া থাকে[৪]। যথা; মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য, কোষকাব্য, চম্পুকাব্য, গীতকাব্য ও উপাখ্যান ইত্যাদি।

 মহাকাব্য।—কোন দেবতা বা বিখ্যাত রাজা কিংবা ব্যক্তির বৃত্তান্ত লইয়া যে অতিবিস্তৃত কাব্য বিরচিত হয়, তাহার নাম মহাকাব্য। যথা; রামায়ণ ইত্যাদি। কোন কোন মহা-কাব্য সর্গ বা পরিচ্ছেদ দ্বারা বিভক্ত থাকে।

 খণ্ডকাব্য।—মহাকাব্য অপেক্ষা অল্পায়ত ক্ষুদ্রকাব্যকে খণ্ড-কাব্য বলে। খণ্ডকাব্য মহাকাব্যের ন্যায় নানা বিষয়িণী বর্ণনায় পরিপূর্ণ থাকে। যথা; ঋতুসংহার, মেঘদূত প্রভৃতি।

 কোষ কাব্য।—এক প্রসঙ্গের কতকগুলি পরস্পর অসম্বদ্ধ শ্লোককে কোষকাব্য কহে।

 চম্পূকাব্য।—গদ্য পদ্যময় কাব্যকে চম্পূকাব্য বলে। যথা; সুধীরঞ্জন ইত্যাদি।

 গীতকাব্য।—স্বরে গ্রথিত কবিতাকে গীতকাব্য বলে। যথা; পদাবলী প্রভৃতি।

 উপাখ্যান।—পশ্বাদির ইতিবৃত্ত অবলম্বন করিয়া বিরচিত গ্রন্থকে উপাখ্যান কহে। যথা; পশ্বাবলী, প্রাণিবৃত্তান্ত ইত্যাদি।

 বঙ্গভাষায় মহাকাব্য ভিন্ন অন্য প্রকার কাব্য বিরল। যাহা আছে, তাহাও তাদৃশ উৎকৃষ্ট নহে।

  1. কখন কখন এক মাত্র পদেও বাক্য হইয়াছে দেখা যায়। কিন্তু তখন সেখানে কর্ত্তা বা ক্রিয়া দুয়ের এক উহ্য থাকে। যথা; এ কর্ম্ম কে করিল? এই প্রশ্নে “আমি” এই মাত্র বলিলেই আমি করিয়াছি এই অর্থ বোধ হয়। এবং “যাইবে” এই মাত্র পদ দ্বারা তুমি যাইবে এই অর্থ প্রতীতি হয়, সুতরাং আমি ও যাইবে এই দুইটি পদও এক এক বাক্য হইয়াছে।
  2. পরীহাসাদি স্থলে কখন কখন অযোগ্য বাক্য দ্বারাও অর্থ প্রতীতি হইয়া থাকে।
  3. কখন কখন পদ্যময় বাক্যে অনাসন্ন পদ দ্বারাও বা বাক্যার্থ জ্ঞান জন্মিয়া থাকে। যথা; “পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম” ইত্যাদি।
  4. সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা পদ্যময় কাব্যকেই মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য, কোষকাব্য এই কয় ভাগে বিভক্ত করেন। আর গদ্যময় কাব্যকে কথা ও আখ্যায়িকা এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন। কিন্তু বঙ্গভাষায় কাব্য ঐরূপে বিভাগ করা সঙ্গত হয় না বলিয়া উপেক্ষিত হইল।