দেনা-পাওনা/ছাব্বিশ

উইকিসংকলন থেকে

ছাব্বিশ

 সকাল হইতে না হইতে চণ্ডীগড়ের সমস্ত ইতর-ভদ্র হাহাকার করিয়া আসিয়া পড়িল। শিরোমণি আসিলেন, রায়মহাশয় আসিলেন, তারাদাস আসিলেন এবং আরও অনেক ভদ্র ব্যক্তি―পোড়া শান্তিকুঞ্জের সব পুড়িল না, দৈবাৎ কিছু রক্ষা পাইল। এবং যাহা পুড়িল তাহার দাম কত এবং যাহা বাঁচিল তাহা সামান্য এবং অকিঞ্চিৎকর কিনা হত্যাদি তথ্য সবিস্তারে ও নিশ্চয় করিয়া আহরণ করিতে ছুটিয়া আসিলেন। এবং ইহা কেমন করিয়া হইল ও কে করিল? সকলের মাঝখানে এককড়ি নন্দী তুমল কাণ্ড করিতে লাগিল। সর্বনাশ যেন তাহারই হইয়া গিয়াছে। সে সর্বসমক্ষে ডাক ছাড়িয়া প্রকাশ করিল যে, এ কাজ সাগর সর্দারের। সেও তাহার জন-দুই সঙ্গীকে কেহ কেহ কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখিয়াছে। থানায় এত্তেলা পাঠানো হইয়াছে, পুলিশ আসিল বলিয়া। সমস্ত ভূমিজ-গোষ্ঠীকে যদি না সে এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাইতে পারে ত তাহার নাম এককড়ি নন্দী নয়―বৃথাই সে এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামী করিয়া মরিল।

 নির্বাপিতপ্রায় অগ্ন্যুত্তাপ হইতে একটু দূরে একটা বটবৃক্ষছায়াতলে সভা বসিয়াছিল! জীবানন্দ উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার মুখের উপর শ্রান্তির অবসন্নতা ছাড়া উদ্বেগ বা উত্তেজনা কিছুই ছিল না, একটু হাসিয়া কহিলেন, তা হলে তোমাকেও ত এদের সঙ্গে যেতে হয় এককড়ি। জমিদারের গোমস্তাগিরির কাজে তুমি যাদের ঘরে আগুন দিয়েচ, সে খবর ত আমি জানি। আগুন লাগাতে কেউ তাদের চোখে দখেনি, মিথ্যে সন্দেহের উপর পুলিশ যদি তাদের উপর অত্যাচার করে, সত্যি কাজের জন্য তোমাকেও তার ভাগ নিতে হবে।

 তাঁহার কথা শুনিয়া সকলেই অবাক হইল। এককড়ি প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া ছিল, পরে ইহাকে পরিহাসের আকৃতি দিতে শুষ্ক-হাস্যের সহিত বলিল, হুজুর মা-বাপ! আমাদের সাতপুরুষ হলো হুজুরের গোলাম। হুজুরের আদেশে শুধু জেল কন ফাঁসি যাওয়াও আমাদের অহঙ্কার।

 জীবানন্দ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আমাকে না জানিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া তামার উচিত হয়নি! যা পুড়েচে সে আর ফিরবে না, কিন্তু এর উপর যদি পলিশের জুঙ্গে জুটে নতুন হাঙ্গামা বাধিয়ে দু’ পয়সা উপরি রোজগারের চেষ্টা কর, তা হলে লাকসানের মাত্রা ঢের বেড়ে যাবে।

 অনেকই মুখ টিপিয়া হাসিল। এককড়ি জবাব দিতে পারিল না―ক্রোধে মুখ কালো করিয়া শুধু মনে মনে তাহার বংশলোপ কামনা করিল। নদীর দিকের চাকরদের ঘরগুলা বাঁচিয়াছিল, তাহারই দ্বিতলের গোটা-দুই ঘরে উপস্থিত মত বাস করিবার সঙ্কল্প জানাইয়া জীবানন্দ অভ্যাগত হিতাকাঙ্ক্ষীর দলটিকে বিদায় দিয়া কেবল তারাদাস ঠাকুরকেই কাল সকালে একবার দেখা করিতে আদেশ করিলেন।

 তারাদাস কহিল, কাল রাত্রে ষোড়শী চলে গেছে―

 আমি খবর পেয়েচি।

 গোটাকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্চে না―

 তা হলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।

 এই অগ্নিদাহের সম্বন্ধে অচিরকালমধ্যে মুখে মুখে নানা কথা প্রচলিত হইয়া গেল। জমিদার সে রাত্রে গৃহে ছিলেন না, ইহা লইয়া অধিক আলোচনা অনেকের কাছেই নিষ্প্রয়োজন মনে হইল, কিন্তু ষোড়শী ভৈরবীর যাওয়ার সহিত যে ইহার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে এবং এ কাজ যাহারা করিয়াছে জানিয়া-বুঝিয়াও যে জমিদার তাহাকে অব্যাহতি দিলেন এই কথা লইয়া অনুমান ও সংশয়-প্রকাশের অবধি রহিল না। এককড়ির ফাঁদের মধ্যে জীবানন্দ পা দিল না দেখিয়া ইঁহার বিষয় বুদ্ধির প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িল, কিন্তু নিজের জন্য তিনি অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। ষোড়শীকে তাড়ানোর কাজে তিনিও একজন পাণ্ডা এবং জমিদারের গৃহ যাহারা ভস্মীভূত করিয়া দিল তাহারা আশেপাশেই কোথাও অবস্থিতি করিতেছে, এই কথা স্মরণ করিয়া বিছানার মধ্যে তাঁহার সর্ব শরীর ঘর্মাপ্লুত হইয়া উঠিল। পাহারার জনা চারিদিকে লোক মোতায়েন করিয়াও তিনি সারারাত্রি বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আর শুধু কি কেবল বাড়ি! তাঁহার অনেক ধানের গোলা অনেক খড়ের মাড়, শস্যসঞ্চয়ের বিপুল ব্যবস্থা―এই সকল রক্ষা করিতে তাঁহাকে অনুক্ষণ সতর্ক থাকিতে হইবে। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগিল―তবুও অতগুলো যা হোক করিয়া কাটিয়াছে, কিন্তু ইতিমধ্যে এমন একটা কাণ্ড ঘটিল যাহাতে ভাবিয়া পার হইবার আর পথ রহিল না। আদালতের পরওয়ানা আসিয়া পৌঁছিল, ভূমিজ ও অন্যানা প্রজারা একযোগে জমিদার ও তাহার নামে নালিশ রুজু করিয়াছে। যে জমিটা তাঁহারা একত্রে আকের চাষ ও গুড়ের কারখানা করিতে মাদ্রাজী সাহেবকে বিক্রি করিয়াছিলেন, তাহাই বাতিল ও নাকচ করিবার আবেদন। খবর আসিয়াছে কোর্টের প্রস্তাবে ও ইঙ্গিতে কলেক্টর সাহেব স্বয়ং সরজমিনে আসিয়া তদন্ত করিয়া যাইবেন। অনেক টাকার ব্যাপার, অতএব এককড়ির সহযোগে অনেক ঢেরা-সই করিয়াছেন, অনেক বন্ধকী তমসুক ও কর্জার খত প্রস্তুত করিয়াছেন―একের বিষয় অপরকে বিক্রয় করিবার যতপ্রকার গলিঘুঁজি আছে অতিক্রম করিয়াছেন―সেই সব মনশ্চক্ষে উপলব্ধি করিয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিন্তু ইহার চেয়েও একটা বড় কথা এই যে, এই-সকল হীন, মূর্খ, মৃতকল্প চাষীর দল এত বড় সাহস পাইল কি করিয়া যে, গ্রামের মধ্যে বাস করিয়াও এই দুর্দান্ত জীবানন্দ চৌধুরী ও জনার্দন রায়ের নামে নালিশ করিয়া বসিল! জীবনের অধিকাংশ কাল যাহারা পেট ভরিয়া খাইতে পায় না, শীতের রাত্রে যাহারা বসিয়া কাটায়, মারীর দিনে যাহারা কুকুর-বেড়ালের মত মরে, আবাদের দিনে একমুষ্টি বীজের জন্য যাহারা ওই দরজার বাহিরে পড়িয়া হত্যা দেয়, তাহারা আদালতে দাঁড়াইবার টাকা পাইল কাহার কাছে। এ দুর্মতি তাহাদের কে দিল? সে কি এই সোজা কথাটা ইহাদের বলিয়া দিতে পারিল না যে, কেবল জেলা আদালতেই নয়, হাইকোর্ট বলিয়াও একটা ব্যাপারও আছে, যেখানে জীবানন্দজনার্দনকে ডিঙ্গাইয়া সাগর সর্দার কখনও জয়ী হইতে পারে না। ইংরেজের বিচারালয় ধনীর জন্য তৈরি, দরিদ্রের জন্য নয়―তাঁহার অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে, ব্যারিস্টার জামাই আছে, বিশ্বস্ত উকিল-মোক্তার আছে এবং আরও কত কি সুযোগ-সুবিধা আছে―এই সকল আপনাকে আপনি বলিয়া জনার্দন শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু সুবিধা বিশেষ হইল না। কারণ, এ ত শুধু টাকাকড়ি, জমিজমা, কেনা-বেচাই নয়, এতদুপলক্ষে যে-সকল অসামান্য কার্যগুলা সম্পন্ন করাইয়াছেন, তাহার ফলস্বরূপ ফৌজদারী দণ্ডবিধির কেতাবের পাতায় পাতায় যে-সকল কঠিন বাক্য লিপিবদ্ধ করা আছে, তাহাদের নিষ্ঠুর চেহারা আড়ালে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে অত্যন্ত ভয় দেখাইতে লাগিল।

 এ কথা রাষ্ট্র হইতে যে অবশিষ্ট নাই, সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রায়মহাশয় তাহা জানিতেন, তাই দিনের বেলাটা কোনমতে কাটাইয়া রাতের অন্ধকারে এককড়িকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং জমিদার-সরকার হইতে ইহার কিরূপে বিহিত হইতেছে জিজ্ঞাসা করিলেন।

 এককড়ি কহিল, হুজুরের কাছে ত এখনও পেশ করাও হয়নি।

 জনার্দন রাগ করিয়া কহিলেন, করনি ত কর গে। বড়ো বয়সে কি শেষে ফাটক খাটবো নাকি?

 তাঁহার শঙ্কা ও ব্যাকুলতার এককড়ি হাসিয়া বলিল, ভয় কি রায়মশাই, ফাটক খাটতে হয় ত আমিই খাটবো, আপনাদের যেতে দেব না। কিন্তু গরীবের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন, ভুলবেন না।

 জনার্দন খুশী হইয়া কহিলেন, সে ত জানি এককড়ি, তুমি থাকতে ভয় নেই, তুমি যা বোঝো উকিলের বাবাও তা বোঝে না, কিন্তু জানো ত সব? কে সাহেব নাকি নিজে তদারকে আসচে―ব্যাটা মহা বদমাশ। কিন্তু ভেতরের খবর কিছু জানো? কে ব্যাটাদের বুদ্ধি দিলে বল ত? টাকা কে যোগালে?

 এককড়ি অসঙ্কোচে ষোড়শীর নাম করিয়া বলিল, টাকা যোগালেন মা চণ্ডী, আর কে? তাতেই ত তাড়াতাড়ি আড়ালে সরে গেল।

 ছুঁড়ী আছে কোথায় বল ত?

 এককড়ি কহিল, কাছাকাছি কোথাও লুকিয়েচে—জানতে একদিন পাবই।

 জনার্দন ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, খবরটা নিয়ো। হাঙ্গামাটা কেটে থাক, তারপরে।

 এককড়ি নন্দী সেদিন এইখানে আহারাদি করিয়া অনেক রাত্রে বাড়ি গেল। অভিমান করিয়া বলিল, সেদিন সাগর সর্দারের প্রসঙ্গে আপনারা সবাই তাঁর মন যাগিয়ে মুখে টিপে হাসলেন, কিন্তু পালিশের কাছে সেদিন খবরটি দিয়ে রাখলে আজ এ বিপদ আপনাদের ঘটতো না।

 জনার্দন সলজ্জে ত্রুটি স্বীকার করিলেন। এককড়ি তখন প্রভুর সম্বন্ধে বিশেষ একটি সংবাদ তাঁহার গোচর করিয়া কহিল, মদ খেয়ে বরঞ্চ ছিল ভাল, এখন কথা বলাই ভার! কলিক্‌ লেগেই আছে―এতকালের অভ্যাস, হয়ত আর বেশীদিন নয়।

 এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, এটা সত্যি যে খায় না। সূর্যদেব পশ্চিমে ওঠাও সহজ―কিন্তু কি জানেন রায়মশাই, ভয়ানক একগুঁয়ে লোক―সেদিন সারাদিনের যন্ত্রণায় রাত্রে হাত-পা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এলো, ডাক্তারবাবু ভয় পেয়ে বললেন, আমার কথা রেখে অন্ততঃ এক-চামচে খান―হার্ট ফেল করতে পারে―বাবুর কিছু ভয়ই হলো না। একটু হেসে বললেন, এতকালের মধ্যে ও-বেচারা কখ্‌খনো ফেল করেনি, সমানে চলেছে, আজ যদি একদিন করেই ফেলে ত আর দোষ দেব না, কিন্তু আমি জীবনভোরই ফেল করে আসচি, আজ অন্ততঃ একটা দিনও আমাকে পাশ করতে দিন। কেউ খাওয়াতে পারলে না।

 বল কি!

 এককড়ি কহিল, খেয়াল চেপেছে বাড়ি মেরামত থাক, ওই টাকায় মাঠের মাঝখানে এক সাঁকো, আর রূপসী বিলের উত্তরধারে একটা মস্ত বাঁধ তুলতে হবে। ইঞ্জিনিয়রবাবু এসেছিলেন, হিসেব করে বললেন, ও টাকায় দশখানা বাড়ি মেরামত হতে পারে। তার একভাগ এদিকে দিয়ে বাড়িটা রক্ষা করুন; কিন্তু কিছুতেই না। দেওয়ানজী বাপের বয়সী বুড়োমানুষ, বললেন, জমিদারি বাঁধা পড়বে যে! বাবু বললেন, প্রজারা সব বছর বছর খাজনা যোগাচ্চে আর মরচে। তাদের জমি বাঁচাবার জন্যে যদি জমিদারি বাঁধা পড়ে ত পড়ুক না। ও শোধ করা যাবে।

 রায়মশায় চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিলেন, মাথা-খারাপ-টারাপ হয়নি ত?

 ইহার দিন-দুই পরে খবর লইয়া যখন জনার্দন জানিতে পারিলেন, এককড়ি আজও সে কথা হুজুরে পেশ করে নাই, তখন তিনি বিচলিত হইয়া উঠিলেন। অপদার্থ ও ভীতু বলিয়া মনে মনে তাহাকে তিরস্কার করিলেন এবং রাত্রে সুনিদ্রা হইল না। সায়েব হঠাৎ যদি একদিন এত্তেলা পাঠাইয়া সরজমিনে আসিয়া পড়ে ত বিপদের অবধি থাকিবে না। সকল দিকে প্রস্তুত না থাকিলে কি যে ঘটিতে পারে বলা যায় না। স্থির করিলেন, পরদিন দেখা করিয়া নিজেই সকল কথা নিবেদন করিবেন―পরের উপর নির্ভর করিয়া সময় নষ্ট করিলে মরিতে হইবে।

 সকালে একশত আটবার দুর্গানাম জপ করিলেন, শ্রীশ্রীচণ্ডীমাতার নাম লাল কালি দিয়া কাগজের উপরে লিখিয়া কাজটা পাকা করিয়া লইলেন এবং হাঁচি, টিকটিকি, শূন্যকুম্ভ প্রভৃতি সর্বপ্রকার বিপত্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া মোটা দেখিয়া জন-চারেক লোক সঙ্গে করিয়া জমিদারের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। কিন্তু অধিক দূরে অগ্রসর হইতে হইল না, জন পাঁচ-ছয় লোক ছুটিয়া আসিয়া যে খবর দিল, তাহা যেমন অপ্রীতিকর, তেমনি অপ্রত্যাশিত। বেশী নয়, কাঠা-দশেক পরিমাণ বড় রাস্তার উপরেই একটা জায়গা কিছুকাল হইতে রায়মহাশয় দখল করিয়া ঘিরিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, দোকান-ঘরটা এইখানে সরাইয়া আনিবেন। সম্পত্তি চণ্ডীর এবং এই লইয়া ষোড়শীর সহিত তাঁহার বাদানুবাদও হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পরাক্রান্ত জনার্দন রায়কে সে বাধা দিতে পারে নাই। এ সম্বন্ধে তাঁহার কি একটা দলিলও ছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেরা তাহা বিশ্বাস করিত না। আজ সকালে এইটাই তাহার বেদখল করা হইয়াছে। জনার্দন ধীরে ধীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, অনেকেই হাজির আছেন। শিরোমণি, তারাদাস, গগন চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজন তাঁহার দলভুক্ত ভদ্রব্যক্তিদের সমক্ষে জীবানন্দ চৌধুরী নিজে হুকুম দিয়া এবং নিজের লোক দিয়া তাঁহার বেড়া ভাঙ্গাইয়া মন্দির-সংলগ্ন ভূখণ্ডের অন্তর্গত করিয়া দিয়াছেন। কেহই প্রতিবাদ করিতে ভরসা করে নাই।

 জনার্দন দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া সবিনয়ে কহিলেন, এ-সব করার আগে হুজুর ত আমাকে একটা খবর পাঠাতে পারতেন?

 জীবানন্দ হাসিয়া কহিলেন, তাতে অনর্থক দেরি হতো বৈ ত নয়, খবর আপনার কাছে পৌঁছবেই জানি।

 জনার্দন বলিলেন, খবর পৌঁছেচে, কিন্তু একটা দিন আগে পৌঁছলে মামলা-মকদ্দমাটা হয়ত বাধত না।

 জীবানন্দ তেমনি হাসিমুখে কহিলেন, এতেও ত বাধা উচিত নয় রায়মশাই। ভৈরবীদের হাতে দেবীর অনেক সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে, আবার সেগুলো হাতবদল হওয়া দরকার।

 জনার্দন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া কহিলেন, তার চেয়ে আর সুখের কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই, সমস্ত গ্রামখানিই নাকি একদিন মা চণ্ডীর ছিল, এখন কিন্তু―খোঁচাটা সকলেই উপভোগ করিলেন। শিরোমণি ঠাকুর ত জনার্দন রায়ের বুদ্ধি ও বাক-চাতুর্যে উল্লসিত হইয়া উঠিলেন।

 জীবানন্দের মুখের চেহারায় কোনরূপ পরিবর্তন লক্ষিত হইল না। বলিলেন, তার ত্রুটি হবে না রায়মশাই। মা চণ্ডীর সমস্ত দলিল-পত্র, নক্‌শা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু ছিল আমি কলকাতায় এ্যাটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েচি। কিন্তু আপনারা আমার সহায় থাকবেন।

 শিরোমণি জয়ধ্বনি করিলেন; কিন্তু কথাটা সত্য হইলে কোথাকার জল কোথায় গিয়া মরিবে চিন্তা করিয়া ক্রোধে ও শঙ্কায় জনার্দনের মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু ইহার চেয়েও ঢের বড় বিপদ তাঁহার মাথার পরে ঝুলিতেছে স্মরণ করিয়া আজিকার মত তিনি আত্মসংবরণ করিয়া গৃহে ফিরিলেন। যে উদ্দেশ্যে বাটীর বাহির হইয়াছিলেন তাহা ব্যর্থ হইল। পথে চলিতে চলিতে তাঁহার মনে হইল, আমার নাহয় দু-একশ’ বিঘা টান ধরিতে পারে, কিন্তু নিজে যে সমস্ত চণ্ডীগড় গিলিয়া বসিয়াছেন তাহার কি? সুতরাং কথাটা যে নেহাত বাজে, নিছক ধোঁকা দিবার জন্যই বলা এ বিষয়ে আর সন্দেহ রইল না। বাড়ি ঢুকিয়া তামাকের জন্য একটা হুঙ্কার ছাড়িয়া বসিবার ঘরে পা দিয়াই কিন্তু তিনি চমকিয়া গেলেন। একধারে লুকাইয়া বসিয়া এককড়ি। তাহার মুখ শুষ্ক, চেহারা ম্লান―কি হে, তুমি যে হঠাৎ এখানে? তোমার পাগল মনিব ত ওদিকে লাঠালাঠি বাধিয়েচেন।

 এককড়ি কহিল, জানি। আর সেই পাগলের কাছেই এখনি একবার আমাদের ছুটতে হবে।

 জনার্দন ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন বল ত?

 এককড়ি কহিল, ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে জুগিয়েছে জানতে পারলাম না; কিন্তু এটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।

 জনার্দনের মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। লোকটার একগুঁয়েমির যে ভয়ানক ইতিহাস সেদিন শুনাইয়াছিলেন তাহা স্মরণ হইল। তাঁহার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল―এ কি লঙ্কাকাণ্ড করবে নাকি শেষে!

 সাজা তামাক তাঁহার পুড়িতে লাগিল, স্নানের জল ঠাণ্ডা হইতে লাগিল, জনার্দন ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন। জীবানন্দ তখন মন্দিরের একটা ভাঙ্গা খিলান পরীক্ষা করিতেছিলেন এবং তারাদাস অদূরে দাঁড়াইয়া তাঁহার প্রশ্নের জবাব দিতেছিল জনার্দন একেবারে সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, হুজুর। সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।

 জীবানন্দ প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না কিসের ব্যাপার, কিন্তু তাহার অস্বাভাবিক ব্যাকুলতা এবং প্রাঙ্গণের একধারে এককড়ি নন্দীকে দেখিতে পাইয়া কাল রাত্রের কথা স্মরণ হইল। বলিলেন, কিন্তু উপায় কি রায়মশাই? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না সে সস্তায় কিনেচে―তাছাড়া তার বিস্তর ক্ষতিও হবে। সুতরাং মকদ্দমা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।

 জনার্দন আকুল হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাদের পথ?

 জীবানন্দ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।

 তাঁহার শান্তকণ্ঠ ও নির্বিকার মুখের ভাব দেখিয়া জনার্দন নিজেকে আর সামলাইতে পারিলেন না। মরিয়া হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়―জেল খাটতে হবে। এবং আমরা একা নয়, আপনিও হয়ত বাদ যাবেন না।

 জীবানন্দ একটুখানি হাসিলেন, বলিলেন, তাই বা কি করা যাবে রায়মশাই? সখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, তখন তার ফল খেতেই হবে বৈ কি।

 জনার্দন আর জবাব দিলেন না। ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেলেন। এককড়ি সব কথা বোধ হয় শুনিতে পায় নাই, সে দ্রুতপদে কাছে আসিতেই তাহাকে চীৎকার করিয়া বলিলেন, এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি, আমার নির্মলকে একটা টেলিগ্রাফ করে দাও―সে একবার এসে পড়ুক।