জননী/পাঁচ

উইকিসংকলন থেকে

পাঁচ

বকুলকে সঙ্গে করিয়া শীতল চলিয়া গিয়াছে।

 ফিরিয়া যদি সে না আসে, এ শাস্তি শ্যামা সত্যই জীবনে কখনো ভুলিবে না।

 মামা বলিল, অত ভাবছিস কেন বল দিকি শ্যামা, রাগের মাথায় গেছে, রাগ পড়লে ফিরে আসবে। সংসারী মানুষ চাকরি-বাকরি ছেড়ে যাবে কোথা? আর ও-মেয়ে সামলানো কি তার কম্মো? দু’দিনে হয়রাণ হয়ে ফিরতে পথ পাবে না।

 শ্যামা বলিল, কি কাণ্ড সে করে গেছে মামা, সেই জানে। কাল অসময়ে আপিস থেকে ফিরে আমায় হাজার টাকার নােট দিয়ে গেল। বললে, আপিস থেকে বােনাস দিয়েছে। কাল তাে বুঝতে পারিনি মামা, হঠাৎ অত টাকা বােনাস দিতে যাবে কেন, লাভের যা কমিশন পাবার সে তাে ও পায়?

 শ্যামার কিছু ভাল লাগে না, বুকের মধ্যে কি রকম করিতে থাকে, কিসে যেন চাপিয়া ধরিয়াছে বুকটা। কাজ করিয়া করিয়া এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে অন্যমনে কলের মত তাহা করিয়া ফেলা যায় তাই, না হইলে শ্যামা আজ শুইয়া থাকিত, সংসার হইত অচল। নটার সময় মিস্ত্রিরা কাজ করিতে আসিল, ঘর প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, আর সাত দিনের মধ্যে ঘর ব্যবহার করা চলিবে। বিধান খাইয়া স্কুলে গেল। মামাও সকাল সকাল খাইয়া, দেখি একটু খোঁজ করে, বলিয়া চলিয়া গেল। বাড়িতে রহিল শুধু শ্যামা আর তাহার দুই শিশুপুত্র, মণি ও ছােটখােকা,—যার নাম ফণীন্দ্র রাখা ঠিক হইয়াছে।

 দুপুর বেলা প্রেসের একজন কর্মচারীর সঙ্গে শীতলের মনিব কমলবাবু আসিলেন। রাণীকে দিয়া পরিচয় পাঠাইয়া শ্যামার সঙ্গে দরকারি কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছা জানাইলেন। তারপর নিজেই হাঁকিয়া শ্যামাকে শুনাইয়া বলিলেন, তিনি বুড়াে মানুষ, শীতলকে ছেলের মত মনে করিতেন, তাঁর সঙ্গে কথা কহিতে শ্যামার কোন লজ্জা নাই। লজ্জা শ্যামা এমনিই করিত না, ঘােমটা টানিয়া সে বাহিরের ঘরে গেল। রাণী সঙ্গে গিয়াছিল, কমলবাবু বলিলেন, তােমার ঝিকে যেতে বল মা।

 রাণী চলিয়া গেলে বলিলেন, শীতল ক’দিন বাড়ি আসেনি মা?

 শ্যামা বলিল, বুধবার আপিসে গেলেন, তারপর আর ফেরেন নি।

 ওইদিন একটার সময় শীতল যে বাড়ি ফিরিয়া তাহাকে টাকা দিয়া গিয়াছিল, শ্যামা সে কথা গােপন করিল।

 একবারও আসেনি, দু’এক ঘণ্টার জন্য?

 না।

 তােমায় টাকাকড়ি কিছু দিয়ে যায় নি?

 না।

 কমলবাবুর গলাটি বড় মিষ্টি, ঘােমটার ভিতর হইতে আড়চোখে চাহিয়া শ্যামা দেখিল মুখের ভাবও তাঁহার শান্ত, নিস্পৃহ। শ্যামা সাহস পাইয়া বলিল, কোন খবর না পেয়ে আমরা বড় ভাবনায় পড়েছি, আপনি যদি কিছু জানেন—

 কমলবাবু বলিলেন, না বাছা, আমরা কিছুই জানিনে। জানলে তোমায় শুধোতে আসব কেন?

 মনে হয় আর কিছু বুঝি তাহার বলিবার নাই, এইবার বিদায় হইবেন, কিন্তু কমলবাবু লােক বড় পাকা, কলিকাতায় ব্যবসা করিয়া খান। কথা না বলিয়া খানিকক্ষণ শ্যামাকে তিনি দেখেন, মনে যাদের পাপ থাকে এমনিভাবে দেখিলে তারা বড় অস্বস্তি বােধ করে, কাবু হইয়া আসে। তারপর তিনি একটা নিশ্বাস ফেলিয়া অকস্মাৎ ভগবানের নামােচ্চারণ করেন, বলেন, এটি শীতলের ছেলে বুঝি? বেশ ছেলেটি, কি বল বীরেন?—এসাে তাে বাবা আমার কাছে, এসাে। নাম বলত বাবা? বল ভয় কি? মণি? সােনামণি তুমি, না?মণিকে এই সব বলেন আর আড়চোখে কমলবাবু শ্যামার দিকে তাকান। শ্যামা কাবু হইয়া আসে। ভাবে, হাজার টাকার কথাটা স্বীকার করিয়া কমলবাবুর পা জড়াইয়া ধরিবে নাকি?

 কমলবাবু বলেন, বাবা কোথায় গেছে মণি? আপিস গেছে। বাবা খালি আপিস যায়, ভারি দুষ্টু তাে তােমার বাবা, কাল বাড়ি আসেনি বাবা? আসেনি? বড় পাজি বাবাটা, এলে মেরে দিও।—বাবা তবে তােমার বাড়ি এসেছিল কবে? আসেনি? একদিনও আসেনি? দিদিকে নিয়ে বাবা পালিয়ে গেছে?

 শ্যামা বলে, মেয়েকে নিয়ে বনগাঁ বােনের বাড়ি যাবেন বলেছিলেন, বােধ হয় তাই গেছেন।

 কমলবাবু বনগাঁয়ে রাখালের ঠিকানাটা লিখিয়া লইলেন, মণির সম্বন্ধে আর তাহার কোনরূপ মােহ দেখা গেল না। এবার কড়া সুরেই কথা বলিলেন। বলিলেন, স্বামী তােমার লোক ভাল নয় মা, সব জেনে শুনে তুমি ভান করছ কিনা আমরা জানিনে, তােমার স্বামী চোর,—সংসারে মানুষকে বিশ্বাস করে বরাবর ঠকেছি, তবু যে কেন তাকে বিশ্বাস করলাম! আমারি বোকামি, ভাবলাম, মাইনেতে কমিশনে মাসে দুশো আড়াইশ টাকা রোজগার করছে, সে কি আর সামান্য ক'হাজার টাকার জন্যে এমন কাজ করবে, মেশিন কেনার টাকাগুলো তাই দিলাম বিশ্বাস করে, তেমনি শিক্ষা আমায় দিয়েছে, চোরের স্বভাব যাবে কোথা? তোমায় বলে যাই বাছা, এ ইংরেজ রাজত্ব, ক'দিন লুকিয়ে থাকবে? পুলিসে এখনো খবর দিইনি, বোলো তোমার স্বামীকে, কালকের মধ্যে টাকাটা যদি ফিরিয়ে দেয় এবারের মত ক্ষমা করব, লোভে পড়ে কত ভাল লোক হঠাৎ অমন কাজ করে বসে, তাছাড়া এতকাল কাজ করে প্রেসের উন্নতি করেছে, পুলিসে টুলিসে দেবার আমার ইচ্ছা নেই,—বোলো এই কথা। কালকের দিনটা দেখে পরশু বাধ্য হয়েই পুলিসে খবর দিতে হবে।—কমলবাবু আবার শ্রান্তির একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সহসা ভগবানের নামোচ্চারণ করেন, বলেন, টাকাটা যদি তোমার কাছে দিয়ে গিয়ে থাকে?—

 শ্যামা নীরবে মাথা নাড়ে।

 বিকালে মামা বাড়ি ফিরিলে শ্যামা তাহাকে সব কথা খুলিয়া বলিল, বাইশ বছর আগেকার কথা তুলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, খুঁজে পেতে এক পাগলের হাতে আমায় সঁপে দিয়েছিলে মামা, সারাটা জীবন আমি জ্বলে পুড়ে মরেছি, কত দুঃখ কষ্ট সয়ে কত চেষ্টায় সুখের সংসার গড়ে তুলেছিলাম, এবার তাও সে ভেঙে খান খান করে দিয়ে গেল, যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে তো মারছেই, আমাদেরও উপায় নেই, না খেয়ে মরতে হবে এবার, ছেলে নিয়ে কি করব আমি এখন, কি করে ওদের মানুষ করব?

 বলিল, পালিয়ে পালিয়ে আর বেড়াবে ক'দিন, ধরা পড়বেই। মেয়েটার তখন কি উপায় হবে মামা, সঙ্গে থাকার জন্য ওকেও দেবে না তো জেল টেল?

 মামা বলিল, পাগল, ওইটুকু মেয়ের কখনো জেল হয়? শীতলকে যদি পুলিশে ধরেই, বকুলকে তারাই বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।

 সমস্ত বাড়িতে বিপদের ছায়া পড়িয়াছে, বিধান সব বুঝিতে পারে, মুখখানা তাহার শুকাইয়া বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। মণি কিছু বোঝে না, সেও অজানা ভয়ে স্তব্ধ হইয়া আছে। মিস্ত্রিরা বিদায় হইয়া যাওয়ার পর সকলের কাছে চারিদিক থমথম করিতে লাগিল। ছেলেদের খাইতে দেওয়া হইল না, উনানে আঁচ পড়িল না, সন্ধ্যার সময় একটা লণ্ঠন জ্বালিয়া দিয়া রাণী বাড়ি চলিয়া গেল। লণ্ঠনের সামনে বিপন্ন পরিবারটি ম্লান মুখে বসিয়া রহিল নীরবে, ছেলেরা ক্ষুধায় কাতর হইলে শ্যামা বাটিতে করিয়া তাহাদের সামনে কতগুলি মুড়ি দিয়া মুখ ঘুরাইয়া বসিল। তাহার সমস্ত সাধ আহ্লাদ আশা আনন্দ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, কত বড় ভবিষ্যতকে সে মনে মনে গড়িয়া রাখিয়াছিল, শ্যামা ভিন্ন কে তাহার খবর রাখে? পাগলের মত উদয়াস্ত সে খাটিয়া গিয়াছে, শীতল তো শুধু টাকা আনিয়া দিয়া খালাস, কোনদিন একটি পরামর্শ দেয় নাই, এতটুকু সাহায্য করিতে আসে নাই,—সংসার চালাইয়াছে সে, ছেলেমেয়ে মানুষ করিয়াছে সে, বাড়িতে ঘর তুলিতেছে সে, বিপদে আপদে বুক দিয়া পড়িয়া তাহার ভূমিকা বুকের নীড়কে বাঁচাইয়াছে সে। এবার কি হইবে? বিধবা হইলে বুঝিতে পারিত ভগবান মারিয়াছেন, উপায় নাই। বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মত অকারণে একি হইয়া গেল? একটু কলহের জন্য মারিয়া সর্বাঙ্গে কালশিরা ফেলিয়াও শীতলের সাধ মিটিল না, সুখের সংসারে আগুন ধরাইয়া দিয়া গেল?

 মামা ঘন ঘন তামাক টানে। ঘন ঘন বলে, এমন উন্মাদ সংসারে থাকে? মামা বড় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। শ্যামা ও তাহার ছেলেদের ভারটা এবার মামার উপরেই পড়িব বৈকি? হায়, সে সন্ন্যাসী বিবাগী মানুষ, বাইশ বছর সংসারের সঙ্গে তাহার সম্পর্ক নাই, হতভাগাটা তাহাকে একি দুরবস্থায় ফেলিয়া গেল? বুড়ো বয়সে এই সবই তাহার অদৃষ্টে ছিল নাকি? মামা এই সব ভাবে, অরণ্যে প্রান্তরে জনপদে তাহার দীর্ঘ যাযাবর জীবনের স্মৃতি মনে আসে, একটা গেরুয়া কাপড় পর, গায়ে একটা গেরুয়া আলখাল্লা চাপাও, গলায় ঝুলাইয়া দাও কতগুলি রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিকের মালা, তারপর যেখানে খুসি যাও, আতিথ্য মিলিবে, অর্থ মিলিবে, ভক্তি মিলিবে, কত নারী দেহ দিয়া সেবা করিয়া পুণ্য অর্জন করিবে; ধার্মিকের অভাব কিসের? আজ ধনীর অতিথিশালায় শ্বেতপাথরের মেঝেতে খড়ম খটাখট করিয়া হাঁটা, কাল সম্মূখে অফুরন্ত পথ, ভূট্টা ক্ষেতের পাশ দিয়া গ্রামের ভিতর দিয়া, বনের নিবিড় ছায়া ভেদ করিয়া, পাহাড় ডিঙাইয়া মরুভূমির নিশ্চিহ্নতায়; সন্ধ্যায় গভীর ইঁদারার শীতল জল, সদ্য দোয়া ঈষদুষ্ণ দুধ, ঘিয়ে ভিজানো চাপাটি, আর সলজ্জ গ্রাম্য কন্যাদের প্রণাম—একজনকে বাছিয়া বেশি কথা বলা বেশি অনুগ্রহ দেখানো—কে বলিতে পার? মামা ভাবে, বুড়ো বয়সে দেশে ফিরিবার বাসনা তাহার কেন হইয়াছিল? আসিতে না আসিতে কি বিপদেই জড়াইয়া পড়িল। মুখে কিন্তু মামা অন্য কথা বলে বলে এমন উন্মাদ সংসারে থাকে? আমি এসেছিলাম বলে তো নইলে তুই স্ত্রীপুত্রকে কার কাছে ফেলে যেতি রে হতভাগা? একেবারে কাণ্ডজ্ঞান নেই? স্ত্রীপুত্রকে পরের ঘাড়ে ফেলে আপিসের টাকা চুরি করে মেয়ে নিয়ে তুই পালিয়ে গেলি?

 শ্যামাই শেষে বিরক্ত হইয়া বলে এখন আর ও কথা বলে লাভ কি হবে মামা? কি করতে হবে না হবে পরামর্শ করি এসো।

 অনেক বকম পরামর্শই তাহারা করে। মামা একবার প্রস্তাব করে যে শ্যামার কাছে কিছু যদি টাকা থাকে, হাজার দুই তিন, ওই টাকাটা কমলবাবুকে দিয়া এখনকার মত ঠাণ্ডা করা যায, পরে শীতল ফিরিয়া আসিলে যাহা হয় হইবে। শ্যামা বলে তাহার টাকা নাই, টাকা সে কোথায় পাইবে? তা ছাড়া শীতল যে ফিরিয়া আসিবে তার কি মানে আছে? তখন মামা বলে, বাড়িটা বিক্রি করিয়া কমলবাবুকে টাকাটা দিয়া দিলে কেমন হয়? শীতল তাহা হইলে পুলিসের হাত হইতে বাঁচে। শ্যামা বলে যে শীতল যদি ফাঁসিও যায় বাড়ি সে বিক্রয় করিতে দিবে না। এই কথা বলিয়া তাহার খেয়াল হয যে ইচ্ছা থাকিলেও বাড়ি সে বিক্রয় করিতে পারিবে না বাড়ি শীতলের নামে। শুনিয়া মামা একেবারে হতাশ হইয়া বলে যে তা হলেই সর্বনাশ, টাকাগুলি খবচ করিয়া শীতল ফিরিয়া আসিয়াই বাড়িটা বিক্রয় করিয়া নিশ্চয় কমলবাবুর টাকাটা দিয়া বাঁচিবার চেষ্টা করিবে। শ্যামাব মুখ শুকাইয়া যায় সে কাঁদিতে থাকে।

 পরামর্শ করিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারা যায় না, বেশির ভাগ আরো বেশি বেশি বিপদের সম্ভাবনাগুলি আবিষ্কৃত হইতে থাকে।

 শেষে মামা এক সময় বলে শ্যামা সর্বনাশ করেছিস। আপিসের টাকা থেকে শীতল তোকে দিয়ে যায় নি হাজার টাকা?

 শ্যামা বলে, একথা জিজ্ঞেস করছ কেন মামা?

 মামা বলে, কেন করছি তুই তাব কি বুঝবি পলিসে বাড়ি সার্চ করবে না? নোট টোট যদি দিয়ে গিয়ে থাকে তা বেরিয়ে পড়বে না? তোকে ধরে তখন যে টানাটানি করবে রে?

 শুনিয়া শ্যামার মুখ পাংশু হইয়া যায়, বলে, কি হবে মামা তবে?

 এবার মামা সুপরামর্শ দেয়, বলে, দে দে, আমায় এনে দে টাকাগুলো, দেখ দিকি কি সর্বনাশ করেছিলি? ওরে নোটের যে নম্বব থাকে, দেখা মাত্র ধরা পড়বে ও টাকা কমলবাবুর! ছি ছি, তোর একেবারে বুদ্ধি নেই শ্যামা, দে নোটগুলো আমি নিয়ে যাই, কলকাতায় মেসে হোটেলে ক’দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকিগে। আস্তে আস্তে পারি তো নোটগুলো বদলে ফেলব, নযত দু’এক বছর এখন লুকানো থাক, পরে একটি দুটি করে বার করলেই হবে।

 সেই রাত্রেই নোটের তাড়া লইয়া মামা চলিয়া গেল। শ্যামা বলিল, মাঝে মাঝে তুমি এলে কি ক্ষতি হবে মামা, পলিস তোমায় সন্দেহ করবে?

 মামা বলিল, আমায় কেন সন্দেহ করবে?—আসব শ্যামা, মাঝে মাঝে আমি আসব।

 রাত্রি প্রভাত হইল, শ্যামার ঘরের ছাদ পিটানোর শব্দে দিনটা মুখর হইয়া রহিল, দুদিন দুরাত্রি গেল পার হইয়া, না আসিল পুলিস, না আসিল মামা, না আসিল শীতল। শ্যামার চোখে জল পূরিয়া আসিতে লাগিল। কতকাল আগে তাহার বার দিনের ছেলেটি মরিয়া গিয়াছিল, তারপর আর তো কোন দিন সে ভয়ঙ্কর দুঃখ পায় নাই, ছোটখাট দুঃখ দুর্দশা যা আসিয়াছে স্মৃতিতে এতটুকু দাগ পর্যন্ত রাখিয়া যায় নাই, সুখ ও আনন্দের মধ্যে কোথায় মিশাইয়া গিয়াছে। জীবনে তাহার গতি ছিল, কোলাহল ছিল, আজ কি স্তব্ধতার মধ্যে সেই গতি রুদ্ধ হইয়া গেল দেখো। শ্যামা বসিয়া বসিয়া ভাবে। বকুল? কোথায় কি অবস্থায় মেয়েটা কি করিতেছে কে জানে। শীতলের সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় সময়ে হয় তো খাইতে পায় না, নরম বালিশ ছাড়া মেয়ে তাহার মাথায় দিতে পারিত না, কোথায় কি ভাবে পড়িয়া হয়ত এখন সে ঘুমায়, শীতল হয়ত বকে চুপি চুপি অভিমানিনী লুকাইয়া কাঁদে? বিষ্ণুপ্রিয়ার মেয়ের দেখাদেখি বকুলের কত বাবুয়ানি ছিল, ময়লা ফ্রকটি গায়ে দিত না, মুখে সর মাখিত, লাল ফিতা দিয়া তাহার চুল বাঁধিয়া দিতে হইত, আঁচলে এক ফোঁটা অগুরু দিবার জন্য মার পিছনে পিছনে আব্দার করিয়া ঘুরিত। কে এখন জামায় তাহার সাবান দিয়া দেয়? কে চুলের বিনুনি করে? বকুলের মুখে কত ধূলা না জানি লাগে, আঁচল দিয়া সে শুধু মুখটি মুছিয়া ফেলে, কে দিবে তাহাকে সফেদা, কে দিবে দুধের সর।

 দিন তিনেক পরে মামা আসিল। বলিল, সার্চ করে গেছে? করে নি? ব্যাপার তবে কিছু বোঝা গেল না শ্যামা, কি মতলব যেন করেছে কমলবাবু, আঁচ করে উঠতে পারছি না।

 শ্যামা বলিল, টাকাটার কোন ব্যবস্থা করে তুমি এসে থাকতে পার না মামা এখানে? এই পুলিস আসে, এই পুলিস আসে করে ভয়ে ভয়ে থাকি, এসে তারা কি করবে কি বলবে কে জানে, মার ধোর করে যদি জিনিসপত্র যদি নিয়ে চলে যায়?

 মামা একগাল হাসিয়া বলিল, থাকব বলেই তো টাকার ব্যবস্থা করে এলাম রে।

 কোথায় রেখেছ?

 তুই চিনবিনে, মস্ত জমিদার। নতুন কাপড়ের পুলিন্দে করে সিলমোহর এঁটে জমা দিয়েছি। বলেছি গাঁয়ে আমার বাড়ি ঘর আছে না, তার দলিলপত্র, ঘুরে ঘুরে বেড়াই, হারিয়ে টারিয়ে ফেলব। তোমার সিন্দুকে যদি রেখে দাও বাবা? বড় ভক্তি করে আমায়। বলে, যোগ তপস্যা সব ছেড়ে দিলেন, নইলে আপনি তো মহাপুরুষ ছিলেন, দীক্ষা নেব ভেবেছিলাম আপনার কাছে। জানিস মা, পিঠের ব্যথাটা আবার চাগিয়েছে, ব্যথায় কাল ঘুম হয় নি।

 রাণী একটু মালিশ করে দিক?—শ্যামা বলিল।

 দশ বার দিন কাটিয়া গেল। বিষ্ণুপ্রিয়া একদিন শ্যামাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিল। রাগারাগি করিয়া মেয়ে লইয়া শীতল চলিয়া গিয়াছে এই পর্যন্ত শ্যামা তাহাকে বলিয়াছে, টাকা চুরির কথাটা উল্লেখ করে নাই। বিষ্ণুপ্রিয়া সমবেদনা দেখাইয়াছে খুব। বলিয়াছে, ভেবে ভেবে রোগা হয়ে গেলে যে, ভেবো না, ফিরে আসবে। বাড়িঘর ছেড়ে ক দিন আর থাকবে পালিয়ে? তারপর ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিয়াছে, সংসার খরচের টাকাকড়ি রেখে গেছে তো? শ্যামা জবাবে বলিয়াছে, কি কুক্ষণে যে দোতালায় ঘর তোলা আরম্ভ করেছিলাম দিদি, যেখানে যা ছিল কুড়িয়ে পেতে সব ওতেই ঢেলেছি, কাল কুলি মিস্ত্রির মজুরি দেব কি করে ভগবান জানেন।—বলিয়া সজল চোখে সে নিশ্বাস ফেলিয়াছে। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়া খানিক্ষণ ভাবিয়াছে, ভ্রূ কুঁচকাইয়া একটু যেন বিবক্ত এবং রুষ্টও হইয়াছে। শেষে উঠিয়া গিয়া হাতের মুঠায় কি যেন আনিয়া শ্যামার আঁচলে বাঁধিয়া দিয়াছে। কি লজ্জা তখন এ দুটি জননীর: চোখ তুলিয়া কেহ আর কারো মুখের দিকে চাহিতে পারে নাই।

 বেশি কিছু নয়, পঁচিশটা টাকা। বাড়ি গিয়া শ্যামা ভাবিয়াছে, এ টাকা সে লইল কেমন করিয়া? কেন লইল? এখনি এমন কি অভাব তাহার হইয়াছে? ভবিষ্যতে আর কি তাহার সাহায্য দরকার হইবে না যে এখনি মাত্র পঁচিশটা টাকা লইয়া বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিরক্ত করিয়া রাখিল? তারপর শ্যামার মনে পড়িয়াছে টাকাটা সে নিজে চাহে নাই, বিষ্ণুপ্রিয়া যাচিয়া দিয়াছে। নেওয়াটা তবে বোধ হয় দোষের হয় নাই বেশি। বনগাঁয়ে মন্দাকে শ্যামা এক দিন একখানা চিঠি লিখিল, সেই যে রাখাল সাতশ টাকা লইয়াছিল তার জন্য তাগিদ দিয়া। সে যে কত বড় বিপদে পড়িয়াছে এক পাতায় তা লিখিয়া আরেকটা পাতা সে ভরিয়া দিল টাকা পাঠাইবার অনুরোধে। সব না পারুক, কিছু টাকা অন্তত রাখাল যেন ফেরত দেয়।—আমি কি যন্ত্রণায় আছি বুঝতে পারছ তো ঠাকুরঝি ভাই? আমার যখন ছিল তোমাদের দিইছি, এখন তোমরা আমায় না দিলে হাত পাতব কার কাছে? দিন সাতেক পরে মন্দার চিঠি আসিল। অশ্রু সজল এত কথা সে চিঠিতে ছিল যে চাপ দিলে বুঝি ফোঁটা ফোঁটা ঝরিয়া পড়িত। দাদা কোথায় গেল, কেন গেল, শ্যামা কেন আগে লেখে নাই, কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন কেন দেয় নাই, দেশে দেশে খোঁজ করিতে কেন লোক ছুটায় নাই, এমন করিয়া চলিয়া যাওয়ার সময় ছোট বোনটির কথা দাদার কি একবারও মনে পড়িল না? যাই হোক, সামনের রবিবার রাখাল কলিকাতা আসিতেছে, দাদাকে খোঁজ করার যা যা ব্যবস্থা দরকার সেই করিবে, শ্যামার কোন চিন্তা নাই। টাকার কথা মন্দা কিছু লেখে নাই।

 রবিবার সকালে রাখাল ভারি ব্যস্ত সমস্ত অবস্থায় আসিয়া পড়িল, যেন শীতলের পালানোর পর প্রায় একমাস কাটিয়া যায় নাই, যা কিছু ব্যবস্থা সে করিতে আসিয়াছে, এক ঘণ্টার মধ্যে সে সব না করিলেই নয়। বাড়িতে পা দিয়াই বলিল, কি বৃত্তান্ত সব বল তো বৌঠান।

 শ্যামা বলিল, বসুন, জিরোন, সব বলছি।

 জিরোব?—জিরোবার কি সময় আছে!

 মন্দার কাছে চিঠিতে শ্যামা শীতলের তহবিল তছরূপের বিষয়ে কিছু লেখে নাই, রাখালকে বলিতে হইল। রাখাল বলিল, শীতল বাবু এমন কাজ করবেন, এ যে বিশ্বাস হতে চায় না বৌঠান! রাগ করে চলে যাওয়া,—হ্যাঁ সেটা সম্ভব, মানুষটা রাগী, কিন্তু—

 অনেক কথাই হইল, কতক অর্থহীন, কতক অবান্তর, কতক নিছক ব্যক্তিগত সমালোচনা ও মন্তব্য। আসল কথাটা আর ওঠেই না। শ্যামা রাখালের কথা তুলিবার অপেক্ষা করে, রাখাল ভাবে শ্যামাই কথাটা পাড়ুক; সারাটা সকাল তাহারা ঝোপের এদিক ওদিক লাঠি পিটাইল, ঝোপ হইতে বাঘ বাহির হইবে না, পেখম-তোলা ময়ূর বাহির হইবে, সকাল বেলা সেটা আব ঠাহর করা গেল না। বাড়িতে অতিথি আসিয়াছে, শ্যামা রাঁধিতে গেল, রাখাল গল্প জুড়িল মামার সঙ্গে। শ্যামা ভাবিল, কি আশ্চর্য পরিবর্তন আসে মানুষের জীবনে? খোলা মাঠে কি ভাবে হিংস্র শ্বাপদ-ভরা জঙ্গল গড়িয়া ওঠে কয়েকটা বছরে? মুখোমুখি বসিয়া আজ রাখালের মন ও তাহার মনের মুখ দেখাদেখি নাই: দুজনের খোলা মনে যে জঙ্গল গিজ গিজ করিতেছে, তারি মধ্যে দুজনে লুকোচুরি খেলিতেছে। না, ঠিক এভাবে শ্যামা ভাবে নাই, অমন কল্পনা তাহার কোথায়? সে সোজাসুজি সাধারণ ভাবেই ভাবিল যে রাখাল কি স্বার্থপর হইয়া উঠিয়াছে! জঙ্গলের রূপকটা তাহার অনুভূতি।

 হ্যাঁ, মানুষ বদলায়। বদলায় না বাড়িঘর, বদলায় না জগৎ। এমনি শীতকালে একদিন রাত্রে বারান্দায় শীতলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় শীতে তাহাকে কাঁপিতে দেখিয়া রাখাল নিজের গায়ের আলোয়ান গায়ে জড়াইয়া দিয়াছিল, হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া বলিয়াছিল, বৌঠান তুমি শোও, আমি দরজা খুলে দেব। শ্যামার সব মনে আছে, সে সব ভুলিবার কথা নয়। রাখাল তাকে যেন দামি পুতুল মনে করিত, এতটুকু আঘাত লাগিলে সে যেন ভাঙ্গিয়া যাইবে এমনি যত্ন ছিল রাখালের। অসুখ হইলে কপালে হাত বুলানোর আর তো কেহ ছিল না তাহার রাখাল ছাড়া।

 টাকার কথাটা দুপুরে উঠিয়া পড়িল। রাখাল মাথা নিচু করিয়া বলিল, জান তো বৌঠান আমার রোজগার? পঁচানব্বই টাকা মাইনে পাই, দুটো সংসার, ছেলেমেয়ে, কোন মাসে খরচ চলে কোন মাসে ধার হয়। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছি, এখনো একটা বাকি। তারও বয়স হল দু এক বছরে মধ্যে তার বিয়ে না দিলেও চলবে না। এখন কি করে তোমার টাকা দিই বৌঠান?—তোমার অবস্থা বুঝি আমার অবস্থা বুঝে দেখো।

 সুতরাং তাহাদের কলহ বাধিয়া গেল খানিক পরেই। এমন শীতের দিনে জলে হাত ভিজাইয়া ঠাণ্ডা করিয়া হঠাৎ পরস্পরের গায়ে দিয়া এক দিন যাহারা হাসাহাসি করিত টাকার জন্য তাহাদের কলহ? একি আশ্চর্য কথা যে সেদিনের স্মৃতি তাহারা ভুলিয়া গেল সংসারের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে, যে ইতিহাস স্মরণ করা মাত্র দুদিন আগেও যাহারা অবাস্তব স্বপ্ন দেখিতে পারিত? শ্যামা কড়া কড়া অপমানজনক কথা বলিল সেই সাত শত টাকার উল্লেখ করিয়া রাখালকে সে একবকম জুয়াচোর প্রতিপন্ন করিয়া দিল। রাখাল জবাবে বলিল শ্যামা যদি মনে করিয়া থাকে নিজের হকের ধন ছাড়া শীতলের কাছে কোন দিন সে একটি পয়সা নিয়াছে শীতল জেল হইতে ফিরিলে শ্যামা যেন আর একবার তাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখে। শ্যামা বলিল, হকের ধন কিসে? রাখাল বলিল শ্যামা তার কি জানিবে? মন্দার বিবাহ দিবার সময় শীতল যে জুয়াচুরি করিয়াছিল রাখাল বলিয়াই সেদিন তাহার জাত বাঁচাইয়াছিল আর কেহ হইলে বিবাহসভা হইতে উঠিয়া যাইত: শীতল অর্ধেক গয়না দেয় নাই, পণের টাকা দেয় নাই একটি পয়সা। তারপর সেই গোড়ার দিকে প্রেসের কি সব কিনিবার জন্য ভুলাইয়া সে যে রাখালের পাঁচশত টাকা লইয়া এক পয়সা কোনদিন ফেরত দেয় নাই শ্যামা কি তা জানে? সংসারে কে কেমন লোক জানিতে রাখালের আর বাকি নাই।

 এই সব কথার আদান প্রদান করিবার পর দুজনে বড় বিষণ্ণ হইয়া রহিল। রাখাল বিদায় হইল বিকালে।

 শ্যামা বলিল, ঠাকুরজামাই! ভাবনায় চিন্তায় মাথা আমার খারাপ হয়ে গেছে, রাগের সময় দুটো মন্দ কথা বলেছি বলে আপনিও আমায় এই বিপদের মধ্যে ফেলে চললেন?

 রাখাল বলিল, না না, সে কি কথা বৌঠান, রাগ কেন করব? তুমিও দুটো কথা বলেছ, আমিও দুটো কথা বলেছি, ওইখানেই ত মিটে গেছে—রাগারাগির কি আছে?

 শ্যামা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, আপনারাই এখন আমার বল ভরসা, আপনারা না দেখলে কে আমায় দেখবে? ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি ভেসে যাব ঠাকুরজামাই।

 বড়দিনের ছুটিতে আবার আসব বৌঠান।—রাখাল বলিল।

 গতবার বড়দিনের ছুটিতে সে আসিয়াছিল—এবারও আসিবে বলিয়া গেল। রাখাল? সেই রাখাল? একদিন সে ছিল তাহার বন্ধুর চেয়েও বড়?

 শীতের হ্রস্ব দিনগুলি শ্যামার কাছে দীর্ঘ হইয়া উঠিয়াছে, দীর্ঘ রাত্রিগুলি হইয়াছে অন্তহীন। শীতলের বিছানা খালি, বকুলের বিছানা খালি। কি ভঙ্গি করিয়া মেয়েটা শুইত ফুলের মত দেখাইত না তাহাকে? গায়ে লেপ থাকিত না, শীতে মেয়েটা কুণ্ডলী পাকাইয়া যাইত, শুইতে আসিয়া রোজ শ্যামা তাহার গায়ে লেপ তুলিয়া দিত। গভীর রাত্রে শূন্য দৃষ্টিতে শূন্য শয্যার দিকে চাহিয়া শ্যামা জাগিয়া থাকে, চোখ দিয়া জল পড়ে। আর তো মেয়ে নাই শ্যামার, ওই একটি মেয়ে ছিল। আর কী সে মেয়ে? শ্যামার এই ছোট বাড়িতে অতটুকু মেয়ের প্রাণ যেন আঁটিত না, ও যেন ছিল আলো। ঘরের চারিদিক উজ্জ্বল করিয়া জানালা দিয়া বাহিরে ছড়াইয়া পড়িত। সে অত প্রচুর ছিল বলিয়া শ্যামা বুঝি তাকে তেমন আদর করিত না? বকুল, ও বকুল, কোথায় গেলি তুই বকুল?

 একদিন রাত্রে কে যেন পথের দিকের জানালায় টোকা দিতে লাগিল। শ্যামা জানালার খড়খড়ি ফাঁক করিয়া বলিল, কে?

 মৃদুস্বরে উত্তর আসিল, আমি শ্যামা আমি, দরজা খোলো।

 জানালা খুলিয়া শ্যামা দেখিল, শীতল একা নয়, সঙ্গে বকুল আছে। দরজা খুলিয়া ওদের সে ভিতরে আনিল, বকুলকে আনিল কোলে করিয়া। বকুলের গায়ে একটা আলোয়ান জড়ানো, এই শীতে কি আলোয়ানে কিছু হয়, শ্যামার কোলে বকুল থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। শ্যামার মনে হইল মেয়ে যেন তাহার হাল্কা হইয়া গিয়াছে। ঘরে আসিয়া আলোতে বকুলের মুখ দেখিয়া শ্যামা শিহরিয়া উঠিল, ঠোঁট ফাটিয়া, গাল ফাটিয়া, মরা চামড়া উঠিয়া কি হইয়া গিয়াছে বকুলের মুখ? শ্যামা কথা কহিল না, লেপ কাঁথা যা হাতের কাছে পাইল তাই দিয়া জড়াইয়া মেয়েকে কোলে করিয়া বসিল, গায়ের গরমে একটু তো গরম পাইবে?

 বকুল তো এমন হইয়াছে, শীতল? মাথায় মুখে সে কম্ফর্টার জড়াইয়া আসিয়াছিল, সেটা খুলিয়া ফেলিতে শ্যামা দেখিল তার চেহারা তেমনি আছে, পুলিসের তাড়ায় পথে বিপথে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। গায়ে তাহার দামি নূতন গরম কোট, চাদরটাও নূতন। না, শীতলের কিছু হয় নাই। মেয়েটার অদৃষ্টে দুঃখ ছিল, সেই শুধু আধ-মরা হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।

 ওর জ্বর হয়েছিল।—শীতল বলিল।

 জ্বর? তাই বটে, অসুখ না হইলে মেয়ে কেন এত রোগা হইয়া যাইবে? শ্যামা শীতলের মুখের দিকে চাহিল, চোখ দিয়া তাহার জল গড়াইয়া পড়িল, ধরা গলায় বলিল, জন্মে থেকে ওর একদিনের জন্যে গা গরম হয় নি।

 শীতল কি তাহা জানে না? এ তাহাকে অনর্থক লজ্জা দেওয়া। শ্যামা এবার তাহার প্রতিকারহীন অপকীর্তির কথা তুলুক, তাহা হইলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন তাহার সফল হয়। পরস্পরের দিকে চাহিয়া তাহারা যেন শত্রুতার পরিমাপ করিতে লাগিল। শ্যামার কি করিয়াছে শীতল? প্রেসের টাকা যদি সে চুরি করিয়া থাকে, সেজন্য জেলে যাইবে সে: সে স্বাধীন মানুষ নয়? শ্যামার তো সে কোন ক্ষতি করে নাই। বরং বাইশ বছর মাসে মাসে ওকে সে টাকা আনিয়া দিয়াছে। এবার যদি সে ছুটিই নেয়, কি বলিবার আছে শ্যামার? এমনি সব কথা ভাবিতে গিয়া শীতলের বুঝি চোখ পড়িল ঘুমন্ত ছেলে দুটির দিকে, মণি আর ছোট খোকা, যার নাম ফণীন্দ্র, বকুলের গায়ে জড়ানোর জন্য ওদের গা হইতে লেপটা শ্যামা ছিনাইয়া লইয়াছে। ওদের দেখিয়া শুধু নয়, কবে শীতল ভুলিতে পারিয়াছিল তার চেয়ে পরাধীন কেহ নাই, সৃষ্টিতত্ত্বের সে গোলাম, জেলে যাওয়ার, মরিয়া যাওয়ার অধিকার তাহার নাই? সে পাগল বলিয়াই না এ কথা ভুলিয়া গিয়াছিল? জানালা বন্ধ ঘরে শীতের স্তব্ধ রাত্রি, এই ঘরে দায়ে পড়া স্নেহ মমতার সঙ্গে সুখশান্তির বিরাট সমন্বয়টা দিনে আসিলে বোঝা যাইত না। এই ঘরে এমনি শীতের রাত্রে লেপ মুড়ি দিয়া সে কতকাল ঘুমাইয়াছে। তুচ্ছ তুলার তোষকে, তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম। তেমনি ভাবে আর সে কোন দিন এখানে ঘুমাইতে পারিবে না। তুচ্ছ তুলার তোষকে তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম আজ কত দুর্লভ।

 ধীরে ধীরে তাহারা কথা বলিতে লাগিল, দুজনের মাঝে যেন দুস্তর ব্যবধান। একজন কথা বলিলে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করিয়া আরেকজনের কাছে পৌঁছিতে যেন সময় লাগে।

 শ্যামা বলিল, টাকা কি সব খরচ করে ফেলেছ?

 শীতল বলিল, না, দুচার শ বোধ হয় গেছে মোটে।

 শ্যামা বলিল, তাহলে কালকেই তুমি যাও কমলবাবুর হাতে পায়ে ধরে পড় গিয়ে, টাকা ফিরে পেলে তিনি বোধ হয় আর গোলমাল করবেন না।

 শীতল বলিল, যদি করেন গোলমাল? তাহলে টাকাও যাবে, জেলও খাটব। তার চেয়ে আমার পালানোই ভাল। তোমায় যে টাকা দিয়ে গেছি তাইতেই এখন চলবে। আমি পশ্চিমে চলে যাই, সেখানে দোকান টোকান দিয়ে যা করে হোক রোজগারের একটা পথ করে নিতে পারব। মাঝে মাঝে দেশে এসে এমনি রাত দুপুরে তোমার সঙ্গে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে যাব। তারপর দু’চার বছর কেটে গেলে বাড়িটা বিক্রি করে তোমরা এদিক ওদিক কিছু দিন ঘুরে ফিরে আমি যেখানে থাকব সেইখানে চলে যাবে। ছ’ হাজার টাকার তো মামলা, কে আর অতদিন মনে করে রাখবে। কমলবাবুও ভুলে যাবে, পুলিসেও খোঁজটোঁজ আর নেবে না।

 শ্যামা বলিল, বাড়ি বিক্রি করব কি করে? বাড়ি তো তোমার নামে।

 এতক্ষণে শীতল একটু হাসিল, বলিল, সে আমি তোমায় কবে দান করে দিয়েছি, খুকি হবার সময় আমার একবার অসুখ হয়েছিল না?— সেইবার। আমার বাড়ি হলে কমলবাবু এতক্ষণ বাড়ি বিক্রি করে টাকা আদায় করে নিত।

 শ্যামার মনে হয় শীতলকে সে চিনিতে পারে নাই। মাথায় একটু ছিট আছে, ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ যা তা করিয়া বসে, কিন্তু বুকখানা স্নেহ মমতায় ভরপুর।

 ঘণ্টা দুই পরে সাব ইনসপেক্টর রজনী ধর আসিলেন। ভারি অমায়িক লোক। হাসিয়া বলিলেন, না মশাই না, দেশে দেশে আপনাকে আমরা খুঁজে বেড়াইনি, যত বোকা ভাবেন আমাদের অত বোকা আমরা নই, বি-এ এম-এটা আমরাও তো পাশ করি? আপনার বাড়িটাতে শুধু একটু নজর রেখেছিলাম—আমি নই, আমি মশায় থানায় ঘুমোচ্ছিলাম—অন্য লোক। আপনি একদিন আসবেন তা জানতাম,—সবাই আসে, স্ত্রী পরিবারের মায়া বড় মায়া মশায়। টাকাগুলো আছে নাকি পকেটে? দেখি একবার হাতড়ে। না থাকে তো নেই, টাকার চেয়ে আপনাকেই আমাদের দরকার বেশি। আপনাকে পাওয়া আর দু’শোটি টাকা পাওয়া সমান কিনা। জানেন না বুঝি? আপনার জন্যে কমলবাবু যে দু’শো টাকা পুরস্কার জমা দিয়েছেন।—নইলে এই শীতের রাত্রে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেও আপনার সঙ্গে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা কই?

 শ্যামার কান্না, ছেলেমেয়ের কান্না, সর্বসমেত পাঁচটি প্রাণীর কান্নার মধ্যে শীতলকে লইয়া সাব ইনসপেক্টর চলিয়া গেল।

 মামা বলিল, কাঁদিসনে শ্যামা, কাল জামিনে খালাস করে আনব। তারপর চুপি চুপি বলিল, কি মুখ্য দেখলি? টাকাগুলো পকেটে করে নিয়ে এসেছে! নিজেও গেলি টাকাও গেল, —গেল ত?