আমার বাল্যকথা/গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (মেজদাদা)

উইকিসংকলন থেকে

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (মেজদাদা)

 ও-বাড়ীর মেজদাদার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। তখন এ-বাড়ী ও-বাড়ীর কোন প্রভেদ ছিল না, আমরা তাঁকে আমাদের সহোদর ভাইয়ের মতন দেখতুম। তিনি ছিলেন মেজদাদা, আমি সেজদাদা বা সেজবাবু, আর বড়দাদা, এই তিনজনে সর্বদাই আমরা একত্রে থাকতুম, একসঙ্গে খেলা করতুম— আমরা এই trinity তিনে এক একে তিন। মেজদাদা আমাকে বড় ভালবাসতেন, আমিও তাঁর প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলুম। আমরা দুটিতে তেতালার ছাতে বসে গান করতুম, গল্প করতুম, কোজাগর পূর্ণিমায় হেসে খেলে বাগানে বেড়িয়ে রাত কাটাতুম। মেজদাদা গান বাজনা বড় ভালবাসতেন— তিনি নিজেও অনেক সঙ্গীত রচনা করেছেন— ব্রহ্মসঙ্গীত, জাতীয় সঙ্গীত, ইত্যাদি। “দীননাথ প্রেমসুধা দেহ হৃদে ঢালিয়ে” এ তাঁর গান। তিনি সব দিকে চৌকোষ ছিলেন—সামাজিকতা, লোকলৌকিকতা, বড়দাদার যে দিকটা অভাব ছিল, তিনি সেই সকল গুণে পূর্ণমাত্রায় ভূষিত ছিলেন।

 আমি বোম্বায়ে কার্যারম্ভ করবার কিছু পরে কলিকাতায় এক ‘স্বদেশী’ মেলা প্রবর্তিত হয়। বড়দাদা নবগোপাল মিত্রের সাহায্যে মেলার সূত্রপাত করেন, পরে মেজদাদা তাতে যোগদান করায় প্রকৃতপক্ষে তার শ্রীবৃদ্ধি সাধন হল। কলিকাতার প্রান্তবর্তী কোন একটি উদ্যানে বৎসরে বৎসরে তিন চারিদিন ধরে এই মেলা চলতো। সেখানে দেশী জিনিষের প্রদর্শনী, জাতীয় সঙ্গীত, বক্তৃতাদি বিবিধ উপায়ে লোকের দেশানুরাগ উদ্দীপ্ত করবার চেষ্টা করা হত। এই মেলা উপলক্ষে মেজদাদ। কতকগুলি জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেন আর সেই মেলাই আমার ভারত সঙ্গীতের জন্মদাতা—

মিলে সবে ভারত সন্তান
একতান মনপ্রাণ,
গাও ভারতেরি যশোগান।

 এদিকে সঙ্গীতাদি কলাবিদ্যায় যেমন তাঁর পারদর্শিতা ছিল, সে সময়কার সাহিত্যিকদের মধ্যেও তিনি অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁর প্রণীত “বিক্রমোর্বশী” নাটকের একটি সুন্দর অনুবাদ পাওয়া গিয়াছে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ এইটি উদ্ধার করে সাহিত্য সমাজে প্রচার করেছেন দেখে আমার অত্যন্ত আহ্লাদ হয়েছে। তাঁর লিখিত কতকগুলি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ছিল— আমি এক সময়ে তাঁর হাতের লেখা পুঁথি দেখেছি, আর তিনি আমাকে পত্রেও লিখেছিলেন যে ভারত ইতিহাসের এক পৃষ্ঠা লিখতে আরম্ভ করেছেন—মোগল সাম্রাজ্য মনে হচ্ছে;—আক্ষেপের বিষয় যে এ সব লেখা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, কোনই সন্ধান পাওয়া যায় না—‘কোন খানে লেশ, নাহি অবশেষ, সেদিনের কোন চিহ্ন।’

 নাট্য অভিনয় বিষয়েও মেজদাদার বিশেষ উৎসাহ ছিল। আমি ইংলণ্ড থেকে ফিরে আসবার দুই বৎসর পরে ছুটী নিয়ে কলকাতায় এসে দেখি তাঁদের বাড়ীতে ‘নবনাটক’ অভিনয়ের প্রভূত আয়োজন হয়েছে—আমি সেই সমারোহের মধ্যে এসে পড়ি। রঙ্গমঞ্চে যবনিকার শিরোবেষ্টনী বিক্রমসভার নবরত্নের নামে অঙ্কিত—

ধন্বন্তরি ক্ষপণকামরসিংহ শঙ্কু
বেতালভট্ট ঘটকর্পর কালিদাসাঃ
খ্যাতো বরাহমিহিরো নৃপতেঃ সভায়াং
রত্নানি বৈ বররুচির্নব বিক্রমস্য।

 নবনাটকখানি রামনারায়ণ তর্করত্ন প্রণীত, বহুবিবাহপ্রথায় পারিবারিক দুঃখজ্বালা অশান্তি প্রকটন সূত্রে লোকশিক্ষা দেওয়া ঐ নাটকের উদ্দেশ্য। আমাদের বাড়ীর ছেলেরা আত্মীয় স্বজন বন্ধু সেই নাটকের পাত্রপাত্রী সেজেছিলেন। মেয়ের পার্ট অবিশ্যি পুরুষের নিতে হয়েছিল। আমার পিতা এই অভিনয়ের সংবাদ পেয়ে কালীগ্রাম হতে মেজদাদাকে লিখেছেন; (৪ মাঘ ১৭৮৮ শক, ১৬ই জানুয়ারী ১৮৬_।)।

 “তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে—সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে— কবিত্ব রসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্বে আমার সহৃদয় মধ্যমভায়ার উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল, তুমি তাহা সম্পন্ন করিলে। কিন্তু আমি স্নেহপূর্বক তোমাকে সাবধান করিতেছি, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়।”

 আমাদের বন্ধু অক্ষয় মজুমদার নাট্যের প্রধান নায়ক গবেশবাবু সেজেছিলেন—নাট্য অভিনয়ে সেই তাঁর প্রথম উদ্যম; পরে তিনি ঐ ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর আরো উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন—তাঁকে ছেড়ে আমাদের কোন অভিনয় সিদ্ধ হত না। হাস্যরসের অভিনয়ে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন।

 এই নবনাটক আর মানময়ী নামক একটি গীতিনাট্য সর্বপ্রথম আমাদের বাড়ীতে অভিনীত হয়। পরে অলীকবাবু, হঠাৎ নবাব প্রভৃতি আরো অনেকগুলি নাটকের অভিনয় হয়। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ আর ‘রাজা ও রাণী’ এই দুই নাট্য আমাদের বাড়ীর মেয়ে পুরুষ সকলে মিলে গড়ে তোলা গিয়েছিল।

 এক সময় ছিল যখন আমাদের বাড়ী আত্মীয় স্বজনে পূর্ণ ছিল। এ-বাড়ী ও-বাড়ীর সকলে আমরা একান্নপরিবারভুক্ত ছিলুম। ক্রমে পৃথক হয়ে পড়লুম। মেজদাদা ও আমাদের মধ্যে যখন বিভাগ হল আমার মনে ভারি বেদনা লেগেছিল। আমরা তেতলার বাড়ীতে ছিলাম—দোতালায় এসে পড়লুম। এই দোতালার বড়ীই আমাদের আদিম বসদ্বাটী, তেতালার বাড়ী নির্মাণ পরে হয়। বাড়ীর বাগান ভাগ হয়ে গেল, পুকুরটা বুঝি সাধারণ রইল। একদিন দেখি হাইকোর্টের একজন জজ এসে আমাদের বাড়ী তন্নতন্ন তদারক করে দেখে গেলেন, কি প্রণালীতে বিভাগ হবে তাই ঠিক করবার জন্যে। এই ছাড়াছাড়ি আমি অনেককাল ভুলতে পারিনি। ইংলণ্ড থেকে অনেক সময় দুঃখ করে মেজদাদাকে এই ধরণে পত্র লিখতুম। বাল্যকাল হতে আমরা একত্রে ছিলাম— তুমি ছিলে মেজদাদা আর এখনো পর্যন্ত আমার ছোটরা আমাকে সেজদাদা বলে ডাকে। আমাদের এক সঙ্গে ওঠাবসা, খ্যালাধূলা, আমোদ প্রমোদ, আমরা স্বপ্নেও ভাবি নাই যে আমাদের মধ্যে বিবাদ বিচ্ছেদ মতান্তর উপস্থিত হবে। কত কু-লোকের মন্ত্রণায় এক এক সময় এইরূপ সুখের সংসার ছারখার হয়ে যায়। যাহারা পরিবারের ভিতরে এইরূপ অশান্তির বীজ ছড়াইবার চেষ্টা করে তাহাদের মত দুর্মতি আর কে আছে? এক একবার দময়ন্তীর মত অভিশাপ দিবার ইচ্ছা হয়, যখন নলরাজ। তাঁহাকে অরণ্যে ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছেন—

অপাপচেতসং পাপো য এবং কৃতবান্ নলং
তস্মাদ্ দুঃখতরং প্রাপ্য জীবত্বসুখজীবিকাং।

 “অপাপচিত্ত নলকে যে পাপাত্মা এইরূপ কার্যে প্রবৃত্ত করিল, সে তদধিক দুঃখতর জীবিকা পাইয়া জীবনধারণ করুক।”

 বিলেত থেকে ফিরে এসে বোম্বাই যাবার পর মেজদাদার সঙ্গে বড় আমার দেখা শুনো হত না কিন্তু আমাদের পত্র-ব্যবহার বন্ধ হয় নাই। ইংলণ্ড বোম্বাই আমি যেখানেই থাকি তাঁকে চিঠি লিখতুম আর তাঁর কাছ থেকেও স্নেহপূর্ণ পত্র পেতুম। ছুটিতে কলকাতায় এলে অবিশ্যি আমাদের ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ হত। একবার আমি বাতরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দেড় বৎসরের ব্যামোর ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলুম। সেই বাতে অনেক দিন শয্যাগত ছিলুম, তখন মেজদাদা সর্বদাই আমাকে দেখতে আসতেন, আদর যত্ন করতেন, গল্পসল্পে আমার মনোরঞ্জন করতেন। আমার একটি আরামের চৌকি ছিল তার চারিদিকে বন্ধুবান্ধববেরা ঘিরে বসতেন, ঠিক যেন একটি দরবার বসেছে। আমার মনে হত ব্যামোর ভিতরেও যদি এত আরাম পাওয়া যায়, তাহলে ব্যামোয় পড়াতে আপত্তি কি?

O Pain! where is thy sting?

 মেজদাদার অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়। যে তাঁকে ভাল করে জানত সেই তাঁর গুণে মুগ্ধ হত, তাঁর কেমন একটি আকর্ষণী শক্তি ছিল। অনেকে তাঁর উপর অনেক আশা ভরসা স্থাপিত করেছিলেন। ছোটকাকার তাঁর উপর কিরূপ স্নেহ মমতা ছিল তা আমরা তাঁর পত্রে দেখতে পাই। মেজদাদার বিদ্যাশিক্ষার পাছে কিছুমাত্র অযত্ন হয় এই তাঁর ভাবনা। তিনি একপত্রে বলেছিলেন— “মানুষের মন রত্নখনি বিশেষ। সেই রত্নটিকে নিয়ে মেজে ঘসে উজ্জ্বল করলে তবে তা মূল্যবান্ হয়—মনের উপর শিক্ষার কার্যও ঐরূপ।” ভবিষ্যতে গণেন্দ্রনাথ আমাদের গৃহস্বামী হয়ে পরিবারের কল্যাণসাধনে নিযুক্ত থাকবেন এই আশায় তিনি আশ্বস্ত ছিলেন; কিন্তু হায়! তাঁর সে আশা পূর্ণ হল না। যাঁরা ভাল লোক দেবতারা শীঘ্রই তাঁদের আপনাদের কাছে ডেকে নিয়ে যান, তাই তাঁর পিতার মৃত্যুর অনতিকাল পরে তিনিও অকস্মাৎ আমাদের সকলকে ছেড়ে পুণ্যলোকে চলে গেলেন।

 Requiescat in peace! তাঁর আত্মার শান্তি হোক!