আলোর ফুলকি/৮

উইকিসংকলন থেকে

স্বাসের মধ্যে থেকে ব্যাঙ আওয়াজ দিলে, “কর্তা, ঘরে আছেন? কর্তা।” সোনালি “ও মাগো ব্যাঙ।” বলে একলাফে একটা গাছের কোটরে গিয়ে লুকোল। ছ’-ছ’টা কোলাব্যাঙ এসে উপস্থিত। তার মধ্যে সব চেয়ে বড়ো ব্যাঙ এসে হাত নেড়ে কুঁকড়োকে বললে, “বনে চিন্তাশীল যাঁরা, তাঁদের হয়ে আমরা এসেছি ধন্যবাদ জানাতে গানের ওস্তাদ আপনাকে... ওর নাম কী, অনেক গানের আবিষ্কর্তাকে”, আর একজন থপ করে বললে, “জলের মতো সহজ গানের”, অমনি তৃতীয় ব্যাঙ থপ্‌ থপ্‌ করে বললে, “যত-সব ছোটো গানের”, অমনি অন্যে বললে, “মজার গানের।”

 পঞ্চম, ষষ্ঠ, তারাও থপ থপ ছপ ছপ করে এগিয়ে এসে বললে, “সব বড়ো বড়ো গানের. সব পবিত্র গানের।”

 ব্যাঙেদের কুঁকড়োর মোটেই ভালো লাগছিল না, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে তিনি তাদের বসতে বললেন। একটা মস্ত ব্যাঙের ছাতা টেবিলের মতো পাতা রয়েছে, তারি চারি দিকে সবাই বসলেন। সদালাপ চলল। ব্যাঙ বিনয় করে বললেন, তারা কিছুই নয়, অতি হীন। কুঁকড়ে বললেন, “কিন্তু বড়ো বড়ো চোখ দেখলেই বোঝা যায় তারা খুবই বুদ্ধিজিভি।” কোলাব্যাঙ দাড়িয়ে উঠে বললেন, “আমরা বনের মধ্যে একছত্রী সবাই,মোরগদের মধ্যে একমাত্র কুঁকড়োকে একদিন ভোজ দিতে মনস্থ করেছি। আপনার গান পৃথিবীকে আলোকিত,পুলকিত, চমকিত, সচকিত করেছে।” এক ব্যাঙ বললে, “সত্য আপনার গান...।” অন্য ব্যাঙ আকাশে চোখ তুলে বললে, “স্বর্গীয়।” “অথচ এই পৃথিবীরই।”— অন্য ব্যাঙ মাটিতে চোখ নামিয়ে বলে উঠল। সোনাব্যাঙ বললে, “স্বপনপাখির গান, সে কী তুচ্ছ আপনার গানের কাছে।”

 কুঁকড়ো বলে উঠলেন,“কী বললে। স্বপনপাখির গান.. তুচ্ছ?... একি সত্যি? না,তোমরা নিশ্চয় বাড়িয়ে বলছ।” কোলাব্যাঙ গম্ভীর স্বরে বললে, “স্বপনপাখির স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে, সত্যিকার গানে বনকে মাতিয়ে তুলে দেয়, এমন একজনের বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে। একটু অদলবদল না হলে আর পেরে ওঠা যাচ্ছে না।”

 কুঁকড়ো দাড়িয়ে উঠে বললেন, “সে কাজটা যদি আমার দ্বারা সম্ভব হয়, তবে আমি রাজি আছি।” সব ব্যাঙ ডেকে উঠল, একসঙ্গে কুঁকড়োর জয় দিয়ে, “কুক-ড়ো পাহাড়-ত-লির কুঁকড়ো-পা-হাড়—ত-লির।”

 সোনাব্যাঙ গলা ভারী করে বললে, “এইবার স্বপনের দফা রফা হল।” কুঁকড়ো শুধলেন, “দফা রফা কী রকম।” কিন্তু কে তাঁর কথা শোনে। গলা ফুলিয়ে গান ধরলে সব ব্যাঙ-কটা করতাল বাজিয়ে—

মেঘ হাকে, “গড় কর্‌, গড় কর্‌, গড় কর্‌।”
 বিষ্টি বলে, “টুপ টাপ, চুপ চাপ, ঝুপ ঝাপ।”
শিল বলে, “তড়-বড়, গড় কর, গড় কর।”

বাদল ঝরে গড় করি,
জলে ভাসে মাঠ, ঘাট আর বাট,
এলো বাতাস এলোমেলো,
লাফ দিয়ে ঝড় এলো
ঘাড় ধ'রে ব’লে গেল, “কর গড় কর”...।

 কোলাব্যাঙ ধুয়ে ধরলেন,”কে তারে গড় করে। কে কারে গড় করে।”সোনাব্যাঙ চিতেন গাইলেন, “বাতাস তারে গড় করে, সবাই তারে গড় করে।” ফেরত গাইলে সব ব্যাঙ,“গড় কর, গড় কর। কর্ কর গড় কর। গড় কর, গড় কর।” কুঁকড়ো ব্যাঙেদের শুধালেন, “স্বপনপাখির গান কেমন।”

 ব্যাঙর বললে,“আমরা কেউ থাকি পাথর-চাপ, কেউ থাকি কুয়োর তলায়, আমাদের কানে কেমন ক’রে সে গান আসবে। তরে স্বপন আমরা দেখি বটে, শীতের ক’মাস চব্বিশ ঘণ্টাই। গেছোব্যাঙকে শোধালে হয়, সে স্বপন আর পাখি দুই দেখেছে।”

 কুঁকড়ো গেছোব্যাঙকে শুধালেন স্বপনপাখির গানের কথা।

 গেছে তার কটকটে আওয়াজে পাখির গানের নকল দেখিয়ে দিলে, “দম ফাটু দম ফাট। দুয়ো দুয়ো দুয়ো দুয়ো...।” নকলটা মোটেই আসলের মতো হল না, কিন্তু কুঁকড়ো ভাবলেন সত্যিই স্বপনপাখি এমনিই গায়, তিনি ব্যাঙদের বললেন, “আহা বেচারা পাখি যদি এই গান গেয়েই খুশি থাকে তো থাক-না। তার উপর উৎপাত ক’রে কী হবে। মশা মারতে কামান পাতবার কী দরকার।”

 ব্যাঙর বললে, “না মশয়, আপনার গান যেদিন শুনেছি, সেইদিনই বুঝেছি, কী বিস্ত্রী স্বপনপাখিটার গান। আপনার স্বর শুনলে আমাদের যেন ডানা গজিয়ে উঠে উড়তে ইচ্ছে হয়। আর তার গান, ছোঃ” ব’লে সব ব্যাঙগুলো হাচতে লাগল। তাঁর গান শুনে ব্যাঙর ডানা গজিয়ে সব উড়ে চলেছে এ ছবিটা মনে ক’রে কুঁকড়ে বেশ একটু আমোদ পেলেন। ব্যাঙর তার হাসি দেখে আরো জোরে ছাতা পিটতে লাগল, “জয় কুঁকড়ে, জয় কুঁকড়ো” বলে।

 সোনালি বেরিয়ে এসে বললে, “এত গোল কিসের।” কুঁকড়ো বললেন, “ব্যাঙর। আমায় ভোজের নিমন্ত্রণ করছে।” সোনালি অবাক হয়ে শুধলে, “তুমি যাবে নাকি ওদের ভোজেতে।” কুঁকড়ো বললেন, “আপত্তি কী। এরা সবাই বুদ্ধিজিভি। আমার গান এদের যদি ডান গজাবার কাজে লাগে, তবে কেন আমি এদের সে মুখ থেকে বঞ্চিত রাখি। তোমার স্বপনপাখির গান তো সে কাজটা করতে পারলে না, উলটে বরং বেচারাদের দম ফাটিয়ে দেবারই জোগাড় করেছে। শোনে-ন স্বপনপাখি ওদের কী গানই শুনিয়েছে।” কুঁকড়ো ব্যাঙেদের ইশারা করলেন, আর অমনি তারা সোনালিকে স্বপনপাখির গানের নকল দেখিয়ে দিলে, “দম ফাট, দম ফাটু, তুয়ো দুয়ো দুয়ো। দম ফাট ফাট, দম, দুয়ো দুয়ো।”

 “শুনলে তো।” কুঁকড়ো সোনালিকে বললেন। ঠিক সেই সময় বনের শিয়রে নিশুত রাতের আঁধার কাঁপিয়ে একটি স্বর এসে পৌছল, “পিয়ে।” কুঁকড়ো সেই মিষ্টি স্বর শুনে চমকে বললেন, “ও কে ডাকে?” কোলাব্যাঙ তাড়াতাড়ি ব’লে উঠল, “কেউ নয়, ওই সেই পাখিটা।”

 এবার আবার সেই স্বপনপাখির মিষ্টি সুর কুঁকড়োর কানে এল, যেন একটি-একটি আলোর ফোট— “পিয়ো, পিয়ে। পিয়ে।” কুঁকড়ো শুনতে লাগলেন। একি পাখির ডাক। না এ স্বপ্নের বীণায় ঘা পড়ছে! সোনাব্যাঙ কী বলতে আসছিল, কুঁকড়ো তাদের এক ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন। এইবার স্বপনপাখি গান ধরলে,

পিয়া।
আঁধার রাতের পিয়া, একলা রাতের পিয়া।
পিয়ো, ওগো পিয়ো। দিয়ে, দেখা দিয়ে।
আমায় দেখা দিয়ে, একলা দেখা দিয়ো।
আঁধার-করা ঘরে, জাগছি তোমার তরে,
অন্ধকারে পিয়ো, দিয়ে দেখা দিয়ো।

  দেখতে দেখতে চাদের আলো জলে স্থলে এসে পড়ল। নীল আলোর সাজে সেজে অন্ধকারের পিয়া যেন বনের আঁধার-করা বাসরঘরে এসে দাড়ালেন। স্বপনপাখি আনন্দে গেয়ে উঠল, “পিয়ে, সুধা পিয়ে, সুধা পিয়ো পিয়ো পিয়ো।”

 কুঁকড়ো বলে উঠলেন,’ছি ছি,ব্যাঙগুলোকে বিশ্বাস ক'রে কীভুলই করেছি। হায়, এ লজ্জা রাখব কোথায়, ওগো স্বপনপাখি।” মধুর সুরে স্বপনপাখির উত্তর এল, “দিনের পাখি তুমি নিভাক, সতেজ ডাক দাও, রাতের পাখি আমি আঁধারে ডাকি, ভয়ে ভয়ে মিনতি ক’রে। কিন্তু বন্ধু, তুমিও যাকে ডাক, আমিও তাকে ডাকি। ওরা যা বলে বলুক, তুমি আমি এক আলোরই দূত।”

 কুঁকড়ো বনের শিয়রে চেয়ে বললেন, “গেয়ে চলে, গেয়ে চলে রাত্রির স্বপন। আলোর দূত।”

 আবার স্বর উঠল আকাশ ছাপিয়ে তারার মধ্যে গিয়ে ঝংকার দিয়ে। বনের সবাই চাদের আলোয় বেরিয়ে দাড়াল সে সুর শুনে। গাছের তলায় আলো-ছায়া বিছানো, তারি উপরে হরিণ দাড়িয়ে শুনছে; কোটরের মধ্যে চাদের আলো পড়েছে, সেখান থেকে মুখ বাড়িয়ে বাচ্ছার সব শুনছে; বনের পোক-মাকড় পশু-পাখি সবার মনের কথা এক ক’রে নিয়ে স্বপনপাখি বনের শিয়রে গাইছে; জোনাকির ফুলকি, তারার প্রদীপ, চাদের আলোর মাঝে— নীল আকাশের চাদোয়ার তলায়। ব্যাঙের কড়া মুর থেকে আরম্ভ ক’রে ঝিঝির ঝিমে সুরটি পর্যন্ত সবই গান হয়ে এক তানে বাজছে যেন এই স্বপনপাখির মিষ্টি গলায়। কুঁকড়ো অবাক হয়ে বলে উঠলেন, “এ যে জগৎজোড়াগান, এর তো জুড়ি নেই। স্বপনপাখি কার কানে তুমি কী কথা বলে যাচ্ছ কে তা জানে।” অমনি কাঠবেরালি বললে, “আমনি শুনছি ছুটি হল, খেলা করো’।” খরগোস বললে, “আমি শুনছি শিশিরে-ভেজা সবুজ মাঠে চলো’” বনবেরাল বললে, “শুনছি চাদের আলো এল’” মাটি বললে, “বিষ্টির ফোটা পড়ছে যেন।” জোনাক বললে, “তারা আর তারা।” কুঁকড়ো তারার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমরা কী শুনছ আকাশের তারা।” তারা সব উত্তর করলে, “আমরা নয়নতারার নয়নতারা।”

 কাছে সোনাল-পাখি দাড়িয়ে ছিল, কুঁকড়ো তাকে শুধালেন, “আর তুমি কী শুনছ।” সে এক মনে শুনছিল, কোনো কথা কইলে না, কেবল “ও!” বলে নিশ্বাস ফেললে।

 কুঁকড়ো সোনালিকে বললেন, “যে যা ভালোবাসে স্বপনপাখি তাকে সেই গানই শুনিয়ে যায়। আমি কী শুনলেম জানো?—‘দিন এল, গান গাও। ভোর ভয়ি, ভোর ভয়ি...’”

 সোনালি মুখ টিপে হেসে মনে-মনে বললে, “ভোরের বড়ো দেরি নেই, তুমি না গাইলেও ভোর আজ আসে কি না দেখাব তোমায়।”

 কুঁকড়ো একেবারেমোহিত হয়ে গান শুনছিলেন; ভোর হচ্ছে,কিন্তু সেটা আজ তার খেয়ালই হল না; তিনি বলে উঠলেন, “ওগো স্বপনপাখি, তোমার এ গানের পরে আর কোন লজ্জায় আমি গাইব?” স্বপনপাখি বললে, “গান বন্ধ তো করতে পার না তুমি” কুঁকড়ো বললেন, “কিন্তু এর পরে সেই রগরগে আগুনের মতো রাঙা মুর কি কারো গাইতে ইচ্ছে হয়।” স্বপন উত্তর দিলে, “আমার গান আমারি মনে হয় যে, সময়ে সময়ে বড়ো বেশি নীল। আসল কথাটা কী জানো? যে মুরের স্বপ্ন তোমারো মনে, আমারো মনে জাগছে, সেটিকে সুরে বসাতে তোমারো সাধ্য হল না, আমারো ক্ষমতায় কুলোল না কোনোদিন। গানের পরে মন সে বলবেই, হল না হল না, তেমনটি হল না, এ কিছুই হল না।”

 কুঁকড়ো বললেন, “স্বরের পরশে ঘুম আসবে, তাকেই বলি গান।” স্বপন বললে, “গানের ডাকে জেগে উঠল, কাজে লাগল— তন্দ্রা ছেড়ে, তাকেই বলি গান।”

 কুঁকড়ো বললেন, “আমার গান কি কোনোদিন কারু চোখে এক ফোটা জল আনতে পারবে।”

 স্বপনপাখির উত্তর হল, “আর আমার গান কি কোনোদিন কিছু জাগিয়ে তুলবে। বন্ধু, দুঃখু নেই গেয়ে চলো, যেমন স্বর পেয়েছি, ভালো হোক, মন্দ হোক, গেয়ে যাই যতক্ষণ—”

 ‘দুম করে বন্দুকের শব্দ হল। একটা আগুনের হলকা বিছাতের মতো বনের শিয়রে চমকে উঠল। একটি ছোটো পাখি গাছের শিয়র থেকে কুঁকড়োর পায়ের কাছে ঝরা পাতার মতো ঝরে পড়ল।

 সোনালি চীৎকার করে উঠল, “স্বপনপাখি রে, স্বপনপাখি।” কুঁকড়ো ঘাড় হেঁট ক’রে বলে উঠলেন, “ওরে মানুষ কী নিষ্ঠুর। কী নির্দয়।” স্বপনপাখি তার দিকে কালো চোখ মেলে একটিবার চেয়ে দেখলে, তার পর একবার তার ডানা ফুটি কেঁপে উঠে স্থির হল। সকালের হাওয়া আগুনে-ঝলসানো রক্তমাখা একটি ছেড়া পালক আস্তে আস্তে উড়িয়ে নিয়ে চলল, বনের পথে পথে হুহু করে কেঁদে।

 হঠাৎ ওদিকের ঝোপঝাপগুলো মাড়িয়ে হোঁস ফোঁস করে হাপাতে হাপাতে জিম্মা হাজির। কুঁকড়ো তাকে দেখে বললেন, “জিন্ম, তুমি এখানে যে। শিকার পৌছে দিতে না কি।”

 জিন্মা ঘাড় হেঁট করে বললে, “এরা যে জোর করে আমায় শিকারে নিয়ে এল.।”

 কুঁকড়ো এতক্ষণ স্বপনপাখিটিকে আড়াল করে আগলে ছিলেন,এবার সরে দাড়িয়ে বললেন, “চেয়ে দেখো কাকে তারা মেরেছে।”

 জিম্মা ঘাড় নেড়ে বললে, “আহা যে গাছটি স্বরে ভরা দেখবে, সেই গাছেই কি আগে গুলি চালাবে রাক্ষসগুলো। আমি আবার এদের হুকুম মানব।”—ব’লে জিন্ম ঘুরে বসল। তার পর, মাটির মধ্যে সব কারা চলাফেরা করতে লাগল, আর দেখতে দেখতে স্বপনপাখিকে পৃথিবী যেন কোলের মধ্যে আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগলেন।

 দুরে শিকারীদের শিটি পড়ল। জিন্ম কুঁকড়োকে চটুপটু গোলাবাড়িতে ফিরে যেতে ব’লে দৌড়ে চলে গেল শিকারীদের দিকে। এদিকে সোনালি কেবল দেখছিল কখন সকাল হয়। তার ভয় হচ্ছিল বুঝি কুঁকড়ো এইবার আকাশে চেয়ে দেখেন। কিন্তু কুঁকড়ো যেমন মাথাহেঁট ক’রে স্বপনপাখির জন্যে র্কাদছিলেন, সেই ভাবেই রইলেন। সোনালি আস্তে আস্তে তাঁর কাছে নিয়ে বললে,“এসো, আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদো।” কুঁকড়ো নিশ্বাস ফেলে সোনালির কাছে সরে গেলেন, সে ডানায় তাকে ঢেকে নিলে। তার পর সেই সোনার ডানার মধ্যে ঢেকে সোনালি কত ভালোবাসাই জানাতে লাগল, কত মিষ্টি কথা, কত মিনতি, কত ছল। আরও দিকে সকাল হতে থাকল, অন্ধকার ফিকে হয়ে এল, সব জিনিস স্পষ্ট হতে থাকল। কিন্তু তখনো সোনালি বলছে, “দেখছ আমি তোমায় কী ভালোবাসি।” তার পর হঠাৎ এক সময় ডানা সরিয়ে নিয়ে সোনালি বলে উঠল পালক ঝাড়া দিয়ে, “দেখেছ, কেমন সকাল এসেছে, তুমি না ডাকতেই।”

 কুঁকড়ো চমকে আকাশে চাইলেন। তার পর বুক ফেটে তার এমন স্বর উঠল যে তেমন কান্না কোনোদিন কেউ শোনে নি। তিনি যেন পাষাণের মতো স্থির হয়ে গেলেন; আর চোখের সামনে তাঁর সকালের আলো মেঘে আকাশে গাছে ছড়িয়ে পড়তে থাকল।

 সোনালি নিষ্ঠুরের মতো বললে, “শেওলাগুলো রাঙা হয়ে উঠল বলে।” “না, কখনো না।” বলে সেদিকে কুঁকড়ো ছুটে যাবেন, দেখতে দেখতে পাথরের গায়ে শেওলার উপরে সকালের আভা পড়ল আর সেগুলো আগুনের মতো লাল হয়ে গেল। সোনালি বললে, “ওই দেখো পূর্বদিকে।” কুঁকড়ো “না” বলে যেমন সেদিকে চাইলেন, অমনি সোনায় আকাশ ভরে উঠল। “এ কী। এ কী”—বলে কুঁকড়ো চোখ ঢাকলেন। সোনালি বললে, “পুর্বদিক কারু হুকুম মানে না, দেখলে তো?”

 কুঁকড়ো ঘাড় হেঁট করে বললেন, “সত্যিই বলেছ। মন সেও হুকুম মানে,কিন্তু পুবদিক, সে কারু নয়। আজ আমি বুঝেছি কেউ কারু নয়।”

 এই সময় জিম্মী ছুটতে ছুটতে এসে বললে, “গোলাবাড়িতে সবাই চাচ্ছে তোমাকে। পাহাড়তলি আর অন্ধকার করে রেখে না।” কুঁকড়ো জিন্মাকে বললেন, “হায়, এখনো তারা আমাকে আলোর জন্যে চাচ্ছে? আলো দেব আমি, এ কথা এখনো তারা বিশ্বাস করছে।” জিম্ম অবাক হয়ে রইল। কুঁকড়ো এ কী বলছেন। তার চোখে জল এল। সোনালি এবার সব অভিমান ছেড়েছুটে কুঁকড়োর কাছে গিয়ে বললে,“আকাশ আর আলোচুটোই কি আমার এই বুকের ভালোবাসার চেয়ে বড়ো? দেখে ওরা তো তোমায় চায় না, আর আমার বুক তোমায় চাচ্ছে।”

 কুঁকড়ো ভাঙা গলায় বললেন, “হা, ঠিক।” সোনালি বলে চলল, “আর অন্ধকার, সে কি আর অন্ধকার থাকে, যদি ছটি-প্রাণের ভালোবাসার আলো সেখানে—” কুঁকড়ো তাড়াতাড়ি “হাঁ” বলে সোনালির কাছ থেকে সরে দাড়িয়ে সপ্তম-সুরে চড়িয়ে ডাক দিলেন, “আলোর ফুল।”

 সোনালি অবাক হয়ে বললে, “গাইলে যে।”

 কুঁকড়ো বললেন, “এবার আমি নিজেকে নিজে ধমকে নিলেম। বারবার তিনবার আমি যা ভালোবাসি, তা করতে ভুলেছি।” সোনালি শুধলে, “কী ভালোবাস শুনি।”

 কুঁকড়ো গম্ভীর হয়ে বললেন, “কাজ,আমার যা কাজ তাই।” বলে কুঁকড়ো জিন্মাকে বললেন, “চলো, এগোও” “গিয়ে করবে কী।” সোনালি শুধলে। “আমার কাজ সোনালি।” “কিন্তু রাত্রি তো আর নেই।”

 কুঁকড়ো বললেন, “আছে, সব ঘুমন্ত চোখের পাতায়।”

 সোনালি হেসে বললে, “আজ থেকে ঘুম ভাঙানোই বুঝি ব্রত হল তোমার। কিন্তু যাই বল, সকাল তো হল তোমাকে ছেড়ে, তেমনি ঘুমও ভাঙবে তুমি না গেলেও।”  কুঁকড়ো বললেন, “দিমের চেয়েও বড়ো আলোর হুকুমে আমায় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সোনালি...।”

 সোনালি গাছের তলায় মরা স্বপনপাখিটি দেখিয়ে বললে, “এও যেমন আর গাইবে না, তেমনি তোমার মনের সুরটি কোনোদিন আর ফিরে আসবে না।” ঠিক এই সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে বনের শিয়রে স্বপনপাখি ডাক দিলে, “পিয়ো পিয়ো।” ঠিক সেই গাছটির উপর থেকে যার তলায় রাতের স্বপন এখনো পড়ে আছে ধুলোয়। কুঁকড়ো উপর দিকে চেয়ে শুনলেন যেন আকাশবাণী হল, “শেষ নেই, শেষ নেই, বনের স্বপন অফুর।”

 কুঁকড়ো আনন্দে বলে উঠলেন,”অফুর স্বর, অশেষ স্বপন।” সোনালি বললে, “তোমার বিশ্বাস কি এখনো অটল থাকবে। দেখছ না সূর্য উঠছেন।” কুঁকড়ো বললেন, “কাল যে গান গেয়েছি তারি রেশ আকাশে এতক্ষণ বাজছিল সোনালি।”

 এমন সময় পেচাগুলো চেচিয়ে গেল, “আজ কুঁকড়ো গায় নি, কী মজা।” “ওই শোনে, সোনালি,পেচার স্পষ্টই জানিয়ে গেল যে, আলো আজ দেওয়া হয় নি। তাই আনন্দ করছে তারা।” বলে কুঁকড়ো সোনালির কাছে গিয়ে বললেন, “সকাল আমিই আনি। শুধু তাই নয়, বাদলে যখন পাহাড়তলিতে দিনরাত ঘন কুয়াশা চেপে এসেছে, দিন এল কি না বোঝা যাচ্ছে না, সেই-সব দিন আমার সাড়া সূর্যের জায়গাটি নিয়ে সবাইকে জানায় ‘দিন এল, দিন এল রে, দিন এল’”

 সোনালি কী বলতে যাচ্ছিল,কুঁকড়ো তাকে বললেন,”শোনে।” সোনালি দেখলে, কুঁকড়ো যেন কতদূরে চেয়ে রয়েছেন, চোখে তার এক আশ্চর্য আলো খেলছে। কুঁকড়ো আস্তে আস্তে বললেন, যেন মনে-মনে, “দূর সূর্যলোকের পাখি আমি। তাই না আমি ডাক দিলে নীল আকাশ ছেয়ে জ্বলে ওঠে সন্ধ্যার অন্ধকারে রাত্রির গভীরে আলোর ফুলকি। আমার দেওয়া আলে। কোনোদিন কি নিভতে পারে। না আমার গান বন্ধ হতে পারে? কতদিন গাচ্ছি, কতদিন যে গাইব তার কি ঠিকানা আছে। যুগ যুগ ধরে এমনই চলবে...। আমার পর সে, তার পর সে গেয়ে চলবে— আমারি মতো অটল বিশ্বাসে। শেষে একদিন দেখা যাবে আকাশের নীল, তারায় তারায় এমনি ভরে উঠছে যে রাত আর কোথাও নেই, সব দিন হয়ে গেছে— আলোয় আলোময়।” সোনালি অমনি শুধলে, “কবে সেটা হবে শুনি।” “কোনো এক শুভদিনে।” ব'লে কুঁকড়ো চুপ করলেন।

 সোনালি বললে, “আমাদের এই বনটিকে ভুলো না যেন সেদিন।” কুঁকড়ো বললেন, “কোনোদিন ভুলব না। এইখানেই জানলেম যে, এক স্বপন ভেঙে যায়, আর-এক স্বপন এসে দেখা দেয়, স্বপনের সঙ্গে নিজেও ভেঙে পড়া নয় কিন্তু জেগে ওঠা, নতুন আলোয় নতুন আশা নিয়ে।” সোনালি বুঝলে কুঁকড়ো আর থাকেন না, সে হতাশ হয়ে অভিমানে বলে উঠল,“যাও যাও, সেই খোপের মধ্যে রোজ সন্ধেবেলা ঘুম দিয়ে, নিজের অন্দরমহলে মই বেয়ে উঠে।”

 কুঁকড়ো উত্তর দিলেন, “ডানা খুলে উড়তে বনের পাখিরা শিখিয়েছে যে”

 “যাও, সেই ঝুড়ির মধ্যে মুরগি-গিন্নি এতক্ষণ কাঁদছে।”

 কুঁকড়ো বললেন, “মা আমায় দেখে কী খুশিই হবেন।”

 জিম্মা বললে, “আর বলবেন পুরোনো চাল ভাতে বেড়েছে রে।” ব'লে কুকুর ঠিক মুরগি-গিন্নির আওয়াজটা নকল করলে। কুঁকড়ো জিম্মাকে বললেন, “চলো যাওয়া যাক। আর কেন?”

 সোনালি যেন সে কথা শুনেও শুনলে না। সে দেখাতে চায় কুঁকড়ো গেলে তার একটুও কষ্ট হবে না। কিন্তু আপনা হতেই তার চোখদুটি জলে ভরে এল। কুঁকড়ো তা দেখলেন, তাঁরও মন একটু উদাস হল। শেষে কুঁকড়ো জিম্মাকে সোনালির কাছে দু-একদিন থাকতে বললেন। জিম্মা অনেক দুঃখু সয়েছে, সে সোনালিকে বোঝাবার জন্যে কিছুদিন বনে থাকাই স্থির করলে। কুঁকড়ো বিদায় নিয়ে এবার সত্যিই চললেন, সোনালি আর থাকতে পারলে না, ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বললে, “আমাকেও সঙ্গে নাও।” কুঁকড়ো তার মুখে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “আলোর ছোটো বোন হয়ে থাকতে পারবে কি” “কখনো না।” ব’লে সোনালি সরে দাঁড়াল। “তবে আসি।” ব’লে কুঁকড়ো এগোলেন। সোনালি রেগে বললে, “আমি তোমায় একটুও ভালোবাসিনে।” কুঁকড়ো তখন মাঝ-পথে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন,“কিন্তু আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি, কেবল ভাবছি আমার দিনগুলির সঙ্গে যদি তুমি মিলতে পারতে।” বলতে-বলতে কুঁকড়ো বনের আড়ালে বেরিয়ে গেলেন। সোনালি রাগ-ভরে ব’লে উঠল, “যেমন আমাকে ঠেলে গেলেন, তেমনি পড়েন পাখ্‌মারের পাল্লায় তো ডানাদুটি কেটে ছেড়ে দেয়।”

 জিম্মা চুপটি ক’রে বসে সোনালির রকম-সকম দেখছে, এমন সময় কাঠঠোকরা নিজের কোটর থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে ব’লে উঠল, “পাখ্‌মারটা কুঁকড়োকে তাগ করছে যে। কী বিপদ।” পেচার অমনি গাছের উপর থেকে দুয়ো দিয়ে বললে, “বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে, কুঁকড়োর এবারে কর্ম কাবার।” খরগোসগুলো গড় থেকে ছুটে বেরিয়ে এল, একটা বাচ্ছা কান খাড়া ক’রে দেখে বললে, “পাখ্‌মার বন্দুকটা মুচড়ে ভাঙলে যে।” আর একজন অমনি ব’লে উঠল, “না রে, গুলি ভরছে, দেখছিস না?”

 জিম্মার দিকে সোনালি, সোনালির দিকে জিম্মা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। জিম্মী, বললে, “ওরা কি কুঁকড়োর ওপরেও গুলি চালাবে।”

 সোনালি বললে, “না। সোনালির দেখা যদি পায়,তবে সেইদিকেই বন্দুক ওঠাবে।” ব’লে সোনালি চলল। জিম্মা পথ আগলে বললে, “কোথায় যাও সোনালি।” “আমার যেটুকু করবার সেই কাজটুকু করতে।” ব’লে বন্দুকের মুখে সোনালি উড়ে পড়তে চলল।

 কাঠঠোকরা চেচিয়ে উঠল, “ফাঁদ। ফাঁদ। ফাদটা বঁচিয়ে সোনালি।” কিন্তু তার আগেই সোনালিকে দড়ির ফাঁদ নাগপাশের মতে জড়িয়ে ফেলেছে। “তারা তাঁকে প্রাণে মারবে।” ব’লে সোনালি ধুলোর উপরে সোনার পাখা লুটিয়ে কাদতে লাগল। তার সব অভিমান চুর হয়ে গিয়ে কান্নার সুরে মিনতি করতে লাগল কেবলি সকালের কাছে, “হিমে সব ভিজিয়ে দাও, বারুদ না জলুক, ভিজে ঘাসে শিকারীর পা পিছলে যাক অন্য দিকে। ওগো সকালের আলো, তুমি তোমার পাখিকে রক্ষে করো, যে-পাখি আঁধার দূর করে, আকাশের বাজকে ফিরিয়ে দেয়, সবার উপর থেকে। ওগো স্বপনপাখি, তুমি গেয়ে ওঠে, চুলে পড়ক দুরন্ত মানুষের চোখের পাতা, স্বপ্নের রাজ্যে সে ঘুমিয়ে থাক তার মৃত্যুবাণের পাশাপাশি।”

 স্বপনপাখি গেয়ে উঠল বন মাতিয়ে করুণ মুরে, “পিয়-পিয়, ও গোলাপের পিয়, ও আমাদের পিয়।” সোনালি দুখানি ডানা ধুলোর উপরে রেখে বললে, “আলো তোমার পাখিকে বাঁচাও, তার সঙ্গে সেই গোলাবাড়িতেই আমি চিরদিন থাকব, আর কোনোদিন অভিমান করব না তার উপরে।” আমনি সোনালি দেখলে আলো হতে আরম্ভ হল, চারি দিকে পাখিরা গেয়ে উঠল, আকাশ ক্রমে নীল হতে থাকল, বনের ঘুম আস্তে আস্তে ভাঙতে লাগল।

 সোনালি মাটিতে মাথামুইয়ে বললে, “আলোর অপমান, আলোর দূতের অপমান আর আমি করব না। হে আলোর আলো, আমায় ক্ষমা করে, তাঁকে বাঁচাও” ‘দুম’ ক'রে ওধারে বন্দুক ছুটল, বনের সমস্তটা যেন রী-রী ক’রে শিউরে উঠল, তার পর কুঁকড়োর সাড়া এল, “আলোর ফুলকি।”

 “তাগ ফসকেছে। গুলি ফসকেছে।”—পেঁচাটা কেঁদে উঠল। আর অমনি দিকে দিকে পাখি সব “জয় জীব। জয় জীব।” বলে কুঁকড়োর জয় দিয়ে উঠল। কোকিল উলু উলু দিয়ে বলতে লাগল, “শুভদিন এল— শুভদিন।” দেখতে দেখতে চারি দিক আলোময় হয়ে উঠল। সেই সময় বনের মধ্যে পায়ের শব্দ উঠল। সোনালি চোখ বুজে চুপ করে শুনতে লাগল, পায়ের ধ্বনি আস্তে আস্তে তালে তালে পড়ছে এক, দুই, তিন। কার ঠাণ্ডা হাতের যেন পরশ পেয়ে সোনালি চোখ খুলে দেখলে, পলাতক। কুঁকড়োকে বুকের কাছে ধ’রে কুঁকড়োর মনিব। সোনালি পালাবার চেষ্টাও করলে না; কুঁকড়োর পাশে গেরেপ্তার হয়ে গোলাবাড়িতে চলল। বসন্ত বাউরি পাহাড়তলি মাতিয়ে সুর ধরলে, “কথা কও, বউ কথা কও, কোথা যাও। বউ কোথা যাও। কথা কও, বউ কথা কও।”