রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম

উইকিসংকলন থেকে

রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম

শ্রীকান্তিচন্দ্র ঘোষ

প্রকাশক
শ্রী শচীন্দ্র লাল মিত্র
কমলা বুক ডিপো লিমিটেড
১৫, কলেজ স্কোয়ার কলিকাতা

মূল্য সাড়ে তিন টাকা

মুদ্রাকর
শ্রী রবীন্দ্র নাথ মিত্র
শ্রীপতি প্রেস
৩৮, নন্দকুমার চৌধুরী লেন, কলিকাতা

প্রকাশকের নিবেদন


 গত নয় বৎসরের মধ্যে শ্রীযুক্ত কান্তিচন্দ্র ঘোষের ‘রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ নামক ক্ষুদ্র পুস্তকখানির এতগুলি সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়াছে, যাহাতে মনে হয় বঙ্গদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন এমন কেহ নাই যিনি এই কবিতাগুলির সহিত পরিচিত নহেন।

 এতদিন পরে ইহার চিত্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হইল। ইহার জন্য পাঠক সাধারণের নিকট কোনও কৈফিয়ৎ দিবার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না, কেননা ইহা তাঁহাদেরই একান্ত আগ্রহ এবং সনির্ব্বন্ধ অনুরোধের ফল। তাঁহাদের নিকট এই চিত্রিত সংস্করণ আদৃত হইলে আমাদের যত্ন শ্রম এবং অর্থব্যয় সার্থক মনে করিব।

 এই সংস্করণে যে সকল চিত্র প্রকাশিত হইল, তাহার অধিকাংশ উদীয়মান শিল্পী শ্রীযুক্ত মনীষী দের অঙ্কিত। এ কার্য্যে তাঁহার উৎসাহ এবং প্রেরণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাকিগুলি শ্রীযুক্ত সিদ্ধেশ্বর মিত্র, শ্রীযুক্ত চঞ্চলকুমার বন্দোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের অঙ্কিত। ইঁহারা সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য। শেষোক্ত দুইজন ফরাসী দেশে তাঁহাদের শিল্পশিক্ষা সমাপ্ত করিয়াছেন। আশা করি এই চিত্রগুলি সাধারণের নিকট উপযুক্ত সমাদর লাভ করিবে।

 ‘বিচিত্রা’ সম্পাদক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁহার কলাভিজ্ঞা ভ্রাতুষ্পুত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা এই গ্রন্থ পরিকল্পন বিষয়ে গ্রন্থকারকে তথা আমাদিগকে অনেক বিষয়ে সাহায্য করিয়া কৃতার্থ করিয়াছেন। ইতি,

১লা আষাঢ়,  

শ্রী শচীন্দ্র লাল মিত্র
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কমলা বুক ডিপো লিঃ

১৩৩৬।

কুঞ্চিকা

ঈরাম—
আরব্য ও পারশ্যের মধ্যবর্ত্তী অধুনালুপ্ত নগরী—গোলাপের জন্য বিখ্যাত।
 
জাম্‌শিয়েদ্—
পৌরাণিক যুগের ইরাণী বাদশাহ—ঐশ্বর্য্য ও জাঁকজমকের জন্য খ্যাতনামা।
 
দায়ুদ—
পৌরাণিক বাদশাহ—তাঁহার সময়ে পহ্লভি ভাষার প্রচলন ছিল।
 
কৈকোবাদ, কৈখস্‌রু—পারসী বাদশাহ।
 
রূস্তম—
সোরাব-রূস্তম কাহিনী সকলেই জানেন।
 
হাতেমতাই—বদান্যতার জন্য বিখ্যাত।
 
মামুদশাহ—
ভারত-বিজয়ী মামুদ গজ্‌নি।
 
বহ্রাম—
বন্য গর্দ্দভ শিকারের জন্য বিখ্যাত।
 

—— দীর্ণ-হিয়া কোন্ সে রাজার রক্তে নাওয়া এই গোলাপ—
কার্ দেওয়া সে লাল্‌চে আভা, হৃদয়-ছ্যাঁচা শোণিত ছাপ।
ফুল-বাগিচায় ওই যে ফোটে রঙ্গের বাহার আশ্‌মানির—
কোন্ রূপসী সীমন্তিনীর আঁখির দিঠি করুণ, স্থির!——

ভূমিকা

 ফার্সি আমরা জানি নে, কিন্তু ও ভাষার বড় বড় কবিদের নাম আমাদের সকলেরই নিকট সুপরিচিত। হাফিজ ও সাদীর নাম ভদ্রসমাজে কে না জানে? ওমার খৈয়ামের নাম কিন্তু দু’দিন আগে এদেশে কেউ শোনে নি, এমন কি ফার্সিনবিশেরাও নয়। যদিচ এ যুগের সমজদারদের মতে তিনিই হচ্ছেন ইরানদেশের সব চাইতে বড় কবি।

 আজকের দিনে ওমার যে আমাদের একজন অতিপ্রিয় কবি হয়ে উঠেছেন, সে ইউরোপের প্রসাদে। ওমার প্রায় হাজার বছর আগে পারস্য দেশের নৈশাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তাঁর কবিত্বের খ্যাতি কালক্রমে বৃদ্ধি পাওয়া দূরে থাক্—সাহিত্যসমাজে তাঁর নাম পর্য্যন্ত লুপ্ত হয়ে এসেছিল। কিছুদিন পূর্ব্বে জনৈক ইংরাজ কবি ওমারকে আবিষ্কার করেন, এবং সেই সঙ্গে তাঁর কবিতা ইংরাজিতে অনুবাদ করে ইউরোপের চোখের সমুখে ধরে দেন।

 আকাশ-রাজ্যে একটি নূতন জ্যোতিষ্ক আবিষ্কৃত হলে বৈজ্ঞানিক সমাজ যেমন চঞ্চল ও উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, মনোরাজ্যে এই নব নক্ষত্রের আবিষ্কারে ইউরোপের কবি-সমাজ তেমনি চঞ্চল ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। ফলে এযুগে ইউরোপের এমন ভাষা নেই যাতে ওমারের একাধিক অনুবাদ নেই, ইউরোপের এমন সহর নেই যেখানে এই নবকাব্যরসের ঐকান্তিক চর্চ্চার জন্য একাধিক কাব্যগোষ্ঠী গঠিত হয়নি। এই নব নক্ষত্রের একটি নব উপাসক-সম্প্রদায়ও সে দেশে গড়ে উঠেছিল, শুনতে পাই গত যুদ্ধে সে সম্প্রদায় মারা গেছে। সে যাই হোক সেকালের এসিয়ার কবিতা একালের ইউরোপের হাতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে, এবং আমরাও তার অপূর্ব্ব রস দেখে চমৎকৃত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।

 এ কবিতার জন্ম হৃদয়ে নয়, মস্তিষ্কে। ওমার খৈয়াম ছিলেন একজন মহা পণ্ডিত। তিনি সারাজীবন চর্চ্চা করেছিলেন শুধু বিজ্ঞানের, কাব্যের নয়। অঙ্কশাস্ত্রে ও জ্যোতিষে তিনি সেকালের সর্ব্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত ছিলেন। তিনি এই জ্ঞান-চর্চ্চার অবসরে গুটিকয়েক চতুস্পদী রচনা করেন, এবং সেই চতুস্পদী কটিই তাঁর সমগ্র কাব্যগ্রন্থ। এত কম লিখে এত বড় কবি সম্ভবত এক ভর্ত্তৃহরি ছাড়া আর কেউ কখন হন নি। ভর্ত্তৃহরির সঙ্গে ওমারের আরও এক বিষয়ে সম্পূর্ণ মিল আছে। উভয়েই জ্ঞানমার্গের কবি, ভক্তিমার্গের নন।

 ওমারের সকল কবিতার ভিতর দিয়ে যা ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে মানুষের মনের চিরন্তন এবং সব চাইতে বড় প্রশ্ন:—

কোথায় ছিলাম, কেনই আসা, এই কথাটা জান্‌তে চাই
যাত্রা পুনঃ কোন্ লোকেতে?— * * ”

* * * *
এ প্রশ্নের জবাবে ওমার খৈয়াম বলেন:—

সব ক্ষণিকের, আসল ফাঁকি, সত্য মিথ্যা কিছুই নাই।”

 ওমার যে সেকালের মুসলমান সমাজে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, এবং একালের ইউরোপীয় সমাজে আদৃত হয়েছেন, তার কারণ তাঁর এই জবাব। যাঁরা মুসলমান ধর্ম্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে এ মত শুধু অগ্রাহ্য নয়—একেবারে অসহ্য; কেননা এ কথা ধর্ম্ম মাত্রেরই মূলে কুঠারাঘাত করে। অপর পক্ষে এ বাণী মেনে নেবার জন্য এ যুগের ইউরোপের মন সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ইউরোপের মন একান্ত বিজ্ঞান-চর্চ্চার ফলে, খ্রীষ্টধর্ম্মের উপর তার প্রাচীন বিশ্বাস হারিয়ে বসেছিল, কিন্তু তার পরিবর্ত্তে কোনও নূতন বিশ্বাস খুঁজে পায় নি। সুতরাং ওমারের কবিতায় বর্ত্তমান ইউরোপ তার নিজের মনের ছবিই দেখতে পেয়েছিল। এই হচ্ছে প্রথম কারণ, যার দরুণ ওমারের বাণী ইউরোপের মনকে এতটা চঞ্চল করে তুলেছিল।

 এস্থলে কেউ বলতে পারেন যে “Vanity of vanities—all is vanity” এসিয়ার এই প্রাচীন বাণী ত দু’হাজার বৎসর পূর্ব্বে ইউরোপের কানে পৌঁচেছিল। বাইবেলের একটা পুরো অধ্যায়ে (Ecclesiastes) ত ঐ কথাটারই বিস্তার করা হয়েছে, প্রচার করা হয়েছে; অতএব ওমারের বাণীর ভিতর কি এমন নূতনত্ব আছে যাতে করে সে বাণী ইউরোপের মনকে অনেকটা পেয়ে বসেছে?

 নূতনত্ব এই যে—ওমারের মতে, যে প্রশ্ন মানুষে চিরদিন করে আসছে, বিশ্ব কোন দিনই তার উত্তর দেয় না, কেননা দিতে পারে না। তাঁর চোখে এই সত্য ধরা পড়েছিল যে, এ বিশ্বের অন্তরে হৃদয় নেই, মন নেই, এ জগৎ অন্ধ নিয়তির অধীন, সুতরাং তার ভিতর-বাহির দুই সমান অর্থহীন, সমান মিছা। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে—

ঊর্দ্ধে অধে, ভিতর বাহির, দেখ্‌ছো যা সব মিথ্যা ফাঁক,
ক্ষণিক এ সব ছায়ার বাজী, পুতুল-নাচের ব্যর্থ জাঁক।”

* * * *
সদ্য ফলের আশায় মোরা মরছি খেটে রাত্রিদিন,

মরণ পারের ভাবনা ভেবে আঁখির পাতা পলকহীন;
মৃত্যু-আঁধার মিনার হ’তে মুয়েজ্জিনের কণ্ঠ পাই—
মূর্খ তোরা, কাম্য তোদের হেথায় হোথায় কোথাও নাই।”

 অপরপক্ষে আমাদের দেশের রাজকবি ভর্ত্তৃহরির মত জেরুজিলামের রাজকবিরও মুখে “Vanity of vanities—all is vanity”, এ বাক্যের অর্থ “জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য”। অর্থাৎ সংস্কৃত ও ইহুদি কবি দুইজনেই এই বিশ্বের অন্তরে এমন একটি সার সত্য, এমন একটি নিত্য বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন, যেখানে মানুষের মন দাঁড়াবার স্থান পায়, এবং যার সাক্ষাৎকার লাভ করলে মানুষ চির শান্তি চির আনন্দ লাভ করে। ওমার খৈয়ামের মতে, ও হচ্ছে মানুষের মন-ভোলানো কথা—আসল সত্য এই যে, জগৎও মিথ্যা, ব্রহ্মও মিথ্যা। পূর্ব্বোক্ত রাজকবিরা মানুষের চোখের সুমুখে একটী অসীম আশার মূর্ত্তি খাড়া করেছিলেন, ওমার খৈয়াম করেছেন অনন্ত নৈরাশ্যের। ওমারের বাণী আমাদের মনকে জাগিয়ে তোলে, কেননা এ যুগে আমরা কেউ জোর করে বলতে পারি নে যে, আমরা সৃষ্টির গোড়ার কথা আর শেষ কথা জানিই জানি।


 এতক্ষণ ধরে ওমারের দর্শনের পরিচয় দিলুম এই কারণে যে, এই দর্শনের জমির উপরই তাঁর কবিতার ফুল ফুটে উঠেছে। যাঁদের মতে “জগৎ মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য”, তাঁরা আমাদের উপদেশ দেন—

মায়াময়মিদং অখিলং হিত্বা
প্রবিশাশু ব্রহ্মপদং বিদিত্বা।”

 ওমারের মতে কিন্তু “মায়াময়মিদং অখিলং” হচ্ছে একমাত্র সত্য—অবশ্য সার সত্য নয়, অসার সত্য। তিনি তাই উপদেশ দিয়েছেন—

এক লহমা সময় আছে সর্ব্বনাশের মধ্যে তোর,
ভোগ-সায়রে ডুব দিয়ে কর্ একটা নিমেষ নেশায় ভোর।”

 বলা বাহুল্য ওমারের মুখে এ কথা হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাণী। এ জীবনের যখন কোন অর্থ নেই, তখন যা ইন্দ্রিয়গোচর আর যা অনিত্য তাকেই বুকে টেনে নিয়ে আসা যাক, তাকেই উপভোগ করা যাক। ওমারের পূর্ব্বেও অনেকে মানুষকে এই উপদেশ দিয়েছেন কিন্তু তাঁদের কথার সঙ্গে ওমারের কথার অনেকটা প্রভেদ আছে। যাঁরা বলতেন “eat, drink and be merry, for to-morrow we die”, তাঁরা বিশ্ব-সমস্যার দিকে একেবারেই পিঠ ফিরিয়েছিলেন। আর প্রাচীন গ্রীসের Epicurean-র যা-কিছু ইন্দ্রিয়-গোচর তাকেই সন্তুষ্টচিত্তে গ্রাহ্য করে নিয়ে ইন্দ্রিয় সুখের চর্চ্চাটা একটি সুকুমার বিদ্যা করে তুলে নিয়েছিলেন। এস্থলে বলা আবশ্যক যে, তাঁরা ইন্দ্রিয় অর্থে বহিরিন্দ্রয় ও মানসেন্দ্রিয় দুই বুঝতেন। তাঁরা ছিলেন শান্তিতে, কিন্তু ওমারের হৃদয়-মন চির অশান্ত। ব্রহ্মজিজ্ঞাসা যে ব্যর্থ—এ সত্য ওমার সন্তুষ্ট মনে মেনে নিতে পারেন নি, এর বিরুদ্ধে তাঁর সকল মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতার ভিতর দিয়ে বিশ্বের বিরুদ্ধে মানবাত্মার এই বিদ্রোহ, উপহাস ও বিদ্রূপের আকারে ফুটে বেরিয়েছে, কিন্তু তাঁর সকল হাসিঠাট্টার অন্তরে একটা প্রচ্ছন্ন কাতরতা আছে, এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব। ওমার খৈয়ামের কবিতা যে আমাদের এতটা মুগ্ধ করে তার প্রধান কারণ, তিনি দার্শনিক হলেও কবি, এবং চমৎকার কবি। দর্শন তাঁর হাতে জ্যামিতির প্রতিজ্ঞার আকার ধারণ করেনি, ফুলের মত ফুটে উঠেছে। এবং সে ফুল যেমন হাল্‌কা, যেমন ফুরফুরে, তেমনি সুন্দর, তেমনি রঙীন। এর প্রতিটি হচ্ছে ইরানদেশের গোলাপ,—এ গোলাপের রঙের সম্বন্ধে ওমার জিজ্ঞাসা করেছেন—

“কার্ দেওয়া সে লাল্‌চে আভা, হৃদয়-ছ্যাঁচা শোণিত-ছাপ”—

 উত্তর অবশ্য—ওমার! তোমার। অথচ এই রক্তে-নাওয়া গোলাপগুলির মুখে একটি সহাস্য don’t care ভাব আছে। আর তাদের বুকে আছে একাধারে অমৃত ও হলাহলের মিশ্রগন্ধ—এক কথায় মদিরগন্ধ। ওমারের কবিতার রস ফুলের আসব, সে রস পান করলে মানুষের মনে গোলাপী নেশা ধরে, সে অবস্থায় আমাদের মন থেকে ইহলোক পরলোক সকল লোকের ভাবনাচিন্তা আপনা হতে ঝরে পড়ে।

 শ্রীযুক্ত কান্তিচন্দ্র ঘোষ এই মন-মাতানো কাজ ভোলানো কবিতাগুলি বাঙলা করে বাঙালী পাঠক সমাজের হাতে ধরে দিচ্ছেন; আশা করি সেগুলি সকলের আদরের ও আনন্দের সামগ্রী হবে, কেননা এ অনুবাদের ভিতর যত্ন আছে, পরিশ্রম আছে, নৈপুণ্য আছে, প্রাণ আছে। ওমার খৈয়ামের এত স্বচ্ছন্দ ও স-লীল অনুবাদ আমি বাঙলা ভাষায় ইতিপূর্ব্বে কখনো দেখিনি।

শ্রীপ্রমথ নাথ চৌধুরী—

ওঁ

কল্যাণীয়েষু—

 বাংলা ছন্দে তুমি ওমর খৈয়ামের যে তর্জ্জমা করেছ তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পূর্ব্বেই আমি দেখেচি। এ-রকম কবিতা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার ছাঁচে ঢেলে দেওয়া কঠিন। কারণ এর প্রধান জিনিষটা বস্তু নয়, গতি। ফিট্‌জ্‌জেরাল্‌ড্‌ও তাই ঠিকমত তর্জ্জমা করেন নি—মূলের ভাবটা নিয়ে সেটাকে নূতন করে সৃষ্টি করেচেন। ভাল কবিতা মাত্রকেই তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার।

 তোমার তর্জ্জমা পড়ে আমার একটা কথা বিশেষ করে মনে উঠেচে। সে হচ্ছে এই যে বাংলা কাব্যভাষার শক্তি এখন এত বেড়ে উঠেচে যে, অন্য ভাষার কাব্যের লীলা অংশও এ-ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। মূল কাব্যের এই রস-লীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধূর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তপুরে আস্‌তে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্চে। ইতি—২৯ শ্রাবণ, ১৩২৬।

—— কোন্ বিরহের তীব্র সুরা পান করিলে কবি?
পেয়ালা মাঝে জাগ্‌ল কাহার দীপ্ত মুখের ছবি!
ছন্দেতে কার্ পায়ের নূপুর বাজ্‌ল তালে তালে—
কণ্ঠটী কার্ জড়িয়ে এল তোমার সুরের জালে!——

কবি-প্রশস্তি

কোন্ বিরহের তীব্র সুরা পান করিলে কবি?
পেয়ালা মাঝে জাগ্‌ল কাহার দীপ্ত মুখের ছবি!
ছন্দেতে কার্ পায়ের নূপুর বাজ্‌ল তালে তালে—
কণ্ঠটী কার্ জড়িয়ে এল তোমার সুরের জালে!

নিমেষটীরে ধন্য ক’রে গাইলে তুমি গাথা,
নিমেষ তরে ভুলিয়ে দিলে বিশ্ব মনের ব্যথা।
একটী নিমেষ—মরুর মাঝে একটী জলের ধারা,
একটী নিমেষ—অন্ধকারে উজল সন্ধ্যা তারা।

চাইলে না তো বিত্ত কোনো বিশ্ব সভার মাঝে—
কোন্ গরবীর কণ্ঠমালা শিরে তোমার রাজে!
নৈশপুরের কোন্ দেবী সে যার রূপেরি ছটা
উজল্ ক’রে রাখলে আয়ুর দীর্ঘ বরষ ক’টা।

গোলাপ বনের মাঝখানেতে ছোট্ট কুটীর খানি,
উদাস হাওয়ায় মিশ্‌ত যেথায় স্রোতস্বিনীর বাণী,
সেই খানেতে তোমার রচা হৃদয়-ছ্যাঁচা গান
তুল্‌লে কাহার কণ্ঠ বীণায় তীব্র করুণ তান!

রাজসভাতে ব’স্‌তে তুমি সবার শেষে আসি’—
বাদসাজাদীর মুখের ’পরে খেল্‌ত নাকি হাসি!
চিকের পারে কাঁকনটী তার বাজ্‌ত মধুর বোলে,
অলক্‌-খসা ফুলটী এসে পড়্‌ত নাকি কোলে?

  

কোন্ সাহারায় রাত্রি শেষে গাঁথ্‌ছ তারার মালা?
নিজের বোনা তাঁবুর মাঝে জাগে সে কোন্ বালা?
পেয়ালা হাতে কাট্‌বে রাতি? সুর্‌মা-পরা আঁখি
পিয়াস-আকুল পথ্-চাওয়া তার সফল হবে নাকি!

আস্‌বে না কো ঝড়ের সাথে সর্ব্ব-নাশের দায়—
শেষ প্রহরের জের্‌টা টেনে ব্যগ্র-ত্বরিৎ পায়?
মিলন-তৃষা উঠ্‌বে জ্ব’লে বিদ্যুতেরি সনে,
রক্ত বুকের উঠ্‌বে নেচে নিবিড় আলিঙ্গনে!

পাগল-করা চুম্বনে তার ওড়্‌না রবে মুখে!
কাঁচল খানি টুট্‌বে নাকো তুষার-সাদা বুকে!
অন্তরেতে ঝড়ের খেলা, বাইরে পড়ে বাজ—
শিথিল তনু, নীবির বাঁধন—আকুল পেশোয়াজ!

ওমর কবি! ওমর কবি! সেই নিমেষের নেশা
নিশ্বাসেরি মতই আজও বিশ্ব প্রাণে মেশা!
আজিও সে নিমেষটুকু পাগল হাওয়ার মত
মিলন রাতের গোপন কপাট খুলিয়ে দেখায় কত!

চুম্বনাকুল ঠোঁটের কাঁপন, বিদায়-চোখে চাওয়া,
দুই বিরহের মধ্যে মিলন নিবিড় ঘন পাওয়া,
সজল দুটী মেঘের মাঝে বিদ্যুতেরি হাসি—
নিমেষটী সেই বিশ্বে ফোটায় সত্যে পরকাশি!

  

—— বৃথাই খোঁজা? বন্ধু, তোমার পেয়ালাটুকুর মাঝে,
তন্বী সাকীর কটাক্ষেতে বিরল মধুর সাঁঝে—
কিছুই কি নাই? জীবন-সুরা অশ্রু দিয়ে মেশা?
প্রণয়-মিলন—আর কিছু নয়—মুহুর্ত্তেকের নেশা?——

সুখের তুমি নও তো শুধু আপন-ভোলা কবি,
ভাগ্য দেবীর হাতের আঁকা শোনিত্-রাঙ্গা ছবি
হৃদয়-পটে ফেল্‌লে ছায়া সত্য আভাষ মত—
জ্ঞানের আলো ফুটলো না তো পুঁথির মধ্যে যত!

ব্যাকুল হৃদি বৃথাই ঘুরে শান্তি কোথা মাগি,
চিরন্তণী প্রশ্ন রহে বিশ্বমনে জাগি;—
চিতার পারে, গোরের মাঝে—চক্রপাণির ডাকে
জীবন সে কি দিচ্ছে সাড়া মৃত্যু দুয়ার ফাঁকে!

কোথায় আলো? জ্ঞানের ভাতি অন্ধকারে ঘেরা,
ভাগ্যদেবীর রুদ্ধ দুয়ার—রিক্ত হাতে ফেরা;
বৃথাই শুধু হস্ত জুড়ে আকাশ পানে চাওয়া—
আছেন তিনি? থাকুন তিনি—বিফল তাঁরে পাওয়া

বৃথাই খোঁজা? বন্ধু, তোমার পেয়ালাটুকুর মাঝে,
তন্বী সাকীর কটাক্ষেতে বিরল মধুর সাঁঝে—
কিছুই কি নাই? জীবন-সুরা অশ্রু দিয়ে মেশা?
প্রণয় মিলন—আর কিছু নয়—মুহুর্ত্তেকের নেশা?

মর‍্মি মনের হুতাশ বহে বিশ্বে চিরতরে—
শান্তিবারি কোথায় সে কার্ পেয়ালা হ’তে ঝরে!
তীব্র ফেনিল কামের সুরা—প্রেমের নাহি দিশা—
ভণ্ডামিতে বিশ্ব মেটায় ক্ষুদ্র প্রাণের তৃষা!


হাজার বছর পরে সে এক বাংলা দেশের কবি,
নিজের মাঝে দেখ্‌ছে তোমার দুঃখ সুখের ছবি,
বেহেস্তে কি জাহান্নমে, শূন্যে, যেথায় থাকো—
অর্ঘ্য রচা তাহার আজি ব্যর্থ হবে নাকো!

শ্রীকান্তিচন্দ্র ঘোষ

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

পরিচ্ছেদ 
 পৃষ্ঠা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 ১০
 ১০
 ১১
 ১১
 ১২
 ১২
 ১৩
 ১৩
 ১৪
 ১৪
 ১৫
 ১৫
 ১৬
 ১৬
 ১৭
 ১৭
 ১৮
 ১৮
 ১৯
 ১৯
 ২০
 ২০
 ২১
 ২১
 ২২
 ২২
 ২৩
 ২৩
 ২৪
 ২৪
 ২৫
 ২৫
 ২৬
 ২৬
 ২৭
 ২৭
 ২৮
 ২৮
 ২৯
 ২৯
 ৩০
 ৩০
 ৩১
 ৩১
 ৩২
 ৩২
 ৩৩
 ৩৩
 ৩৪
 ৩৪
 ৩৫
 ৩৫
 ৩৬
 ৩৬
 ৩৭
 ৩৭
 ৩৮
 ৩৮

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।