পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৩৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

প্রকৃতির পরিচয় প্রদান করে নাই। সুসভ্য ইংরেজ! আজ তোমরা মুসলমান রাজত্বের নিন্দা করিয়া, জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া থাক; কিন্তু তোমাদের সেই পূর্বকালীন বণিগ-রাজত্ব যাহার ভিত্তিতে স্থাপিত, তাহা মনে করিতে গেলে ভয় ও লজ্জায় হৃদয় অবনত হইয়া পড়ে এবং আমাদিগেরও শত ধিক্কার যে, দেবীসিংহের জাতি বলিয়া আজিও আমাদিগকে পরিচয় দিতে হইতেছে।

 ভারতের ভাগ্য-পরীক্ষাস্থল সুপ্রসিদ্ধ পাণিপথ-ক্ষেত্রে দেবীসিংহের পূর্ব-নিবাস। তারাচাঁদসিংহ নামক দেবীসিংহের এক পূর্বপুরুষ হইতে, তাহাদের বংশের ধারাবাহিক বিবরণ অবগত হওয়া যায়। ইঁহারা জাতিতে আগরওয়ালা বৈশ্য; ব্যবসায়বাণিজ্য ইহাদের জীবিকার উপলক্ষ ছিল। তারার্চাঁদের পৌত্র অজিতসিংহ মোগল রাজত্বকালে রায় উপাধি লাভ করেন। অজিতসিংহের জোষ্ঠপুত্র অমরসিংহের চারি পুত্র হয়; কনিষ্ঠ দেওয়ালীসিংহ হইতে দেবীসিংহের উৎপত্তি; দেবীসিংহ দেওয়ালীর দ্বিতীয় পুত্র। জ্যেষ্ঠের নাম তুলসীরামসিংহ ও কনিষ্ঠের নাম বাহাদুরসিংহ।

 যৎকালে মুর্শিদাবাদ আপন গৌরবপ্রভায় মোগল-সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লীনগরীকেও লজ্জা প্রদান করিয়াছিল, ব্যবসায়বাণিজ্যে মুর্শিদাবাদ ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান স্থান অধিকার করিয়া বসে, সেই সময়ে দেবী সুদূর পাণিপথ হইতে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। বলা বাহুল্য, ব্যবসায়কার্যে উন্নতিসাধন তাহার আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আসিয়া দেখিলেন যে, ইউরোপীয় ও দেশীয় বণিগগণে মুর্শিদাবাদের চারিদিক পরিপূর্ণ,-অনন্তমুখ বাণিজ্যস্রোত অবিরাম গতিতে প্রবাহিত হইতেছে। দেবী সেই বিরাট প্রবাহে আপনার জীবনস্রোত মিশাইতে ইচ্ছা করিলেন; কিন্তু সে স্রোত প্রবলবেগে বহিতে পারিল না; ব্যবসায়কার্যে তাহার সুবিধা হইল না। ভিন্ন ভিন্ন জাতির অশেষ প্রকার উদ্যম, চেষ্টা অতিক্রম করা, তাহার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কৃতকার্য হইতে না পারায়, ক্রমে ক্রমে তাহার ব্যবসায়ের ক্ষতি হইতে লাগিল। তখন অগত্যা তিনি ব্যবসায়ের আশা পরিত্যাগ করিয়া কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে লাগিলেন। বাঙ্গলার রাজধানীতে কর্মের অভাব কোথায়? তৎকালে যে একটু বিশেষভাবে চেষ্টা করিয়াছে, ভাগ্যলক্ষী তাহারই প্রতি প্রসন্ন হইয়াছেন। তাহারই কৃপাদৃষ্টিতে দেবীসিংহের ভবিষ্যৎ ক্রমশঃ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠে।

 যে সময়ে দেবীসিংহ কর্মের চেষ্টায় ফিরিতেছিলেন, সে সময়ে মুসলমান রাজত্বের অবসান ও ইংরেজরাজত্বের সূত্রপাত হইয়াছে। সিরাজউদ্দৌলা, মীরজাফর, মীর কাসেমের নাম বিস্মৃতিগর্ভে ডুবিতে আরম্ভ করিয়াছে। কোম্পানীর রাজ্যগ্রহণলালসা বলবতী হওয়ায় তাহার নামমাত্র বাদশাহ শাহ আমলের নিকট হইতে বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী গ্রহণ করিলেন। নজমউদ্দৌলা নামেমাত্র নাজিম থাকিয়া, ইংরেজ কোম্পানীর বৃত্তিভোগী হইয়া দাঁড়াইলেন। ক্লাইসাহেব মহানন্দে রাজস্বসংগ্রহের চেষ্টা করতে লাগিলেন। তাঁহার মনে হইল যে, দেশীয়গণ ব্যতীত বিদেশীগণের দ্বারা বাঙ্গলা রাজস্ব আদায়ের সুবিধা নাই; তাই তিনি মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় দুই জন