পাতা:বিভূতি রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড).djvu/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী ক্ষেত্রবাবুর মনে যথেষ্ট দুঃখ ও সহানুভূতির উত্ৰেক হইল। নিজেকে তিনি ওই অবস্থায় ফেলিয়া দেখিলেন কল্পনায়। কিন্তু তিনি কী করিবেন । তাহার হাতে বাড়তি পয়সা এমন নাই, যাহা দিয়া তিনি এই দুঃস্থ বৃদ্ধ গ্রন্থকারকে সাহায্য করিতে পারেন। পরামর্শই বা তিনি কী দিবেন ? একমাত্র পরামর্শ হইতেছে পয়সাকড়ির পরামর্শ। কিন্তু কে এই বুদ্ধকে অর্থসাহায্য করিবে, সে কথাই বা তিনি কী করিয়া জানিবেন ? বাধ্য হইয়া দুঃখের সঙ্গে ক্ষেত্রবাবু সে কথা জানাইলেন। তাহার এ ক্ষেত্রে করিবার কিছু নাই। কোন পথই তিনি খুজিয়া বাহির করিতে পারিতেছেন না। . মুশকিল হইল যে,এইসময় রাখাল মিত্তিরের ছেলেটি ভাঙা পেয়ালায়চাআনিয়া ক্ষেত্রবাবুর হাতে দিল। রাখালবাবুর স্ত্রী শুনিয়াছেন, তাহার স্বামীর একজন বিশিষ্ট প্রতিপত্তিশালী বন্ধু আদিবেন। চিঠি লইয়া ছেলে তাহার কাছে থিয়াছে। তিনি আসিলে দুঃখের একটা কিনারা হইবেই। এখন সেই ভদ্রলোকটি আসিয়াছেন শুনিয়া গৃহিণী তাড়াতাড়ি যথাসাধ্য অতিথি-সংকার করিয়াছেন। গরীবের ধরে এই ভাঙা পেয়ালায় একটু চায়ের পিছনে যে কত ভরসা নির্ভরতা আবেদন নিহিত, ক্ষেত্রবাবু তাহ বুঝিলেন বলিয়াই চায়ের চুমুক যেন গলায় বাধিতেছিল। এখানে না আসিলেই হইত। পকেটে আছে মাত্র আট আনা পয়সা। তাই কি দিয়া যাইবেন । সে-ই বা কেমন দেখাইবে ! রাখালবাৰু স্বয়ং এ দ্বিধা ঘুচাইয়া দিলেন : তা হলে উঠবেন ? আচ্ছা, কিছু কি আপনার পকেটে আছে ? যা থাকে। বাড়ীতে খাওয়া হয় নি ও-বেলা থেকে—দুটো একটা টাকা— এমন বিপদে পড়ে গিয়েছি। ক্ষেত্রবাবু ছেলেটির হাতে একটা আট-আনি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। সমস্ত সন্ধ্যাটা যেন বিস্বাদ হইয়া গেল। সামনেই একটা ছোট পার্ক, ছেলেমেয়েরা দোলনায় দোল খাইতেছে, লাফালাফি করিতেছে, আনন্দকলরবমুখর পার্কের সবুজ ঘাসের উপর দুইএকটি অফিস-প্রত্যাগত কেরানী বসিয়া বিড়ি টানিতেছে, সোদালি ফুলের ঝাড় ছলিতেছে রেলিংয়ের ধারের গাছে, আলু-কবিলির চারি পাশে উৎসাহী অল্পবয়স্ক ক্রেতার ভিড় লাগিয়াছে। ক্ষেত্রবাৰু একখানা বেঞ্চের এক কোণে গিয়া বসিলেন। বেঞ্চির উপর দুইটি লোক বসিয়া ধরভাড়া আদায় করার অস্ববিধা সম্বন্ধে কথাবাৰ্ত্তা বলিতেছে। ক্ষেত্রবাৰু ভাবিলেন, রাখালুবাবুও র্তাহার মত স্কুলমাস্টার ছিলেন একদিন । আজ অক্ষম ৪ পীড়াগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তাই এই দুর্দশা। বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, টুইশানিও জোটে না আর। স্কুলমাস্টারের এই পরিণাম । বেশী দূর যাইতে হইব না, তাহাজের স্কুলেই রহিয়াছেন নারাণবাৰু—ডিন কুলে কেহ নাই, আজীবন পূতচরিত্র, আদর্শ শিক্ষক, কিন্তু স্কুলের চোর-কুঠুরির ঘরে নির্জন আত্মীয়হীন জীবন স্থাপন করিতেছেন আজ আঠারো বছর কি বাইশ বছর, কে খবর রাখে । আজ দি চাকুরি স্বায়ু, কাল আশ্র্যটকুও নাই। ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনৰ অবস্থায় ক্ষেত্রবাৰু টুইশানিতে চলিয়াছেন, কে পিছন হইতে বলিল, তার ভাল আছেন ।