অদ্ভুত ফকির/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 গৌরীবাবু আরও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, কিন্তু আমি তাঁহাকে আর কোন উত্তর না দিয়া আবদুলের সহিত গৌরী বাবুর বৈঠকখানায় গমন করিলাম। গৌরী বাবুও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাইলেন।

 ক্রমে বেলা নয়টা বাজিল। আমি আর সময় নষ্ট না করিয়া আবদুলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “খাঁ সাহেব! ব্যাপার কিছু বুঝিতে পারিয়াছ? গৌরী বাবু দুইজনের উপর সন্দেহ করিয়াছেন। প্রথমতঃ তাঁহার ভূতপূর্ব্ব মনেজার, দ্বিতীয়তঃ তাঁহারই সহোদর ভ্রাতা। এই উভয়ের মধ্যে কেহ ফকিরকে হত্যা করিয়াছে, ইহাই গৌরীবাবুর ধারণা। তুমি কি বিবেচনা কর? এই উভয়ের মধ্যে তুমিই বা কাহাকে হত্যাকারী বলিয়া সাব্যস্ত কর।”

 আবদুল করযোড়ে সবিনয়ে উত্তর করিল, “হুজুর! আমি আপনার ক্রীতদাস বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। যখন আপনি এখানে উপস্থিত রহিয়াছেন, তখন আমি কোন ছার—আমার অনুমানেই বা আপনার কি সাহায্য হইবে। বিশেষতঃ আপনার সম্মুখে আমার মতামত প্রকাশ করা নিতান্ত বাতুলের কার্য্য। কিন্তু আমি যে হুজুরের কার্য্যে এই ত্রিশবৎসর কাল অতিবাহিত, করিলাম, তাহা কি সম্পূর্ণ বিফল হইবে? না, তাহা কখনও হইতে পারে না। সেই জন্য বলিতেছি যে, হুজুর কিছুদিন এখানে থাকিয়া এই বিষয় ভাল করিয়া লক্ষ্য করুন, তাহা হইলেই সমস্ত রহস্য ভেদ করিতে পারিবেন। আমিও নিশ্চিন্ত থাকিব না—প্রাণপণে হুজুরের সাহায্য করিব।”

 আবদুলের কথায় কর্ণপাত না করিয়া আমি বলিলাম, “খাঁ সাহেব। ভবিষ্যতে যেরূপে পার সাহায্য করিও, কিন্তু এখন আমার গোটা কতক প্রশ্নের উত্তর দাও।”

 এই বলিয়া যে লাঠীর দ্বারা সেই ফকিরকে হত্যা করা হইয়াছিল, সেই লাঠীগাছটী লইয়া আমি আবদুলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই লাঠীই কি ফকিরের হস্তে থাকিত?

 আবদুল কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া উত্তর করিল, “আজ্ঞা হাঁ হুজুর! এই লাঠীই সর্ব্বদা তাঁহার হাতে থাকিত। ইহা না লইয়া। তিনি তাঁহার কুটীর ত্যাগ করিতেন না।”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “বেশ কথা। দেখ দেখি, লাঠীগাছিটীতে শাণিতঅস্ত্র বসে কি না? আমিত উহাতে অনেক কষ্টে ছুরি দিয়া দাগ করিতে পারিয়াছি। লাঠীগাছটা বড়ই শক্ত। এরূপ কাঠ তুমি আর কোথাও দেখিয়াছ কি?”

 আবদুল অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “না হুজুর, এরূপ কাঠ পূর্ব্বে আর কখনও আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই।”

 আমি উত্তর করিলাম, “আমিও সেইরূপ ভাবিয়া ছিলাম। এই কাষ্ঠ এদেশীয় নহে। ইহাকে লোহা কাঠ বলে। লৌহের মত শক্ত বলিয়াই ইহার ঐ নাম। এ গাছ কেবল আণ্ডামান দ্বীপে পাওয়া যায়। খাঁ সাহেব! ইহা দ্বারা তুমি কিছু বুঝিতে পারিলে কি? যদি না পারিয়া থাক, শোন। আমার বোধ হয় গৌরী বাবুর সহোদর হরশঙ্কর-অণ্ডামান হইতে মুক্তিলাভ করিয়া এখানে আসিয়াছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এপর্য্যন্ত কেহই তাহাকে দেখিতে পায় নাই। কেন? যদি হরশঙ্কর সত্য সত্যই এদেশে আসিয়া থাকে, এবং যদি সে গৌরীশঙ্কর বা তাঁহার কোন আত্মীয় বা উপকারী বন্ধুকে হত্যা করিতেই মনস্থ করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে যে এই অঞ্চলে বারম্বার আসিবে তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ করা যায় না। সুযোগ সুবিধা না বুঝিয়া হরশঙ্কর কখনও এই ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না। হরশঙ্করকে যখন কেহই দেখিতে পায় নাই, তখন সে যে ফকিরের বেশেই এখানে আসিয়াছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। বিশেষতঃ হরশঙ্কর যখন এরূপ আশ্চর্য্য ছদ্মবেশ ধরিতে পারিত, যখন সে তাহার মুখ ও চক্ষের ভাব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্ত্তন করিতে গারিত, তখন তাহাকে কে হরশঙ্কর বলিয়া চিনিতে পারিবে।”

 এই বলিয়া আমি গৌরীবাবুর দিকে ফিরিলাম। দেখিলাম, তিনি আমার কথায় শিহরিয়া উঠিলেন। তখন আমি তাঁহাকে বলিলাম, “গৌরীবাবু! আপনি আমার কথায় চমকিত হইতেছেন? আশ্চর্য্য নহে। কিন্তু আপনার এই ভয়ানক শত্রু এতকাল আপনারই আশ্রয়ে ছদ্মবেশে বাস করিতেছিল। যদি আপনার ম্যানেজার তাহাকে খুন করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে বাস্তবিকই আপনার উপকার করিয়াছে,—অপকার করে নাই। ইহা আমার অনুমান মাত্র; আমি এখন ঠিক করিয়া কোন কথা বলিতে পারিতেছি না।”

 আমার কথা শুনিয়া খাঁ সাহেব অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইল। সে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। গৌরীবাবুর মুখ বিবর্ণ ও পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হুজুর! তাহা কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে। হরশঙ্কর আমার যমজ ভাই। আমার আকৃতির সহিত তাহার আকৃতির কোন প্রভেদ নাই। আমরা উভয়েই দেখি এক রূপ। ফকিরের চক্ষু ও মুখ হরশঙ্করের মত নহে। আপনি স্বয়ং ফকিরের চক্ষু ও মুখ দেখিয়াছেন; তাহারা কখনও আমার মত নহে।”

 আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “লোকে—সাধারণে সেইরূপই মনে করিবে বটে। কিন্তু আমি যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ফকির সামান্য লোক নহে। সে অনেক প্রকার ছদ্মবেশ ধারণ করিতে পারিত।”

 গৌরী বাবু কোন উত্তর করিলেন না দেখিয়া আমি বলিতে লাগিলাম, “এই দুই পাত্রে যে দুই প্রকার তরল পদার্থ দেখিতেছেন, উহাদ্বারাই সে আপনার সর্ব্বাঙ্গ রঞ্জিত করিত। আর চক্ষু ও মুখের ভাব পরিবর্ত্তন করা বিশেষ গুরুতর বা কঠিন কার্য্য নহে। এখন যদি আমার অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে হরশঙ্করকে কে হত্যা করিল? হরশঙ্করকে এই পৃথিবী হইতে সরাইয়া কাহার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল?”

 আমার কথা শুনিয়া আবদুল বলিয়া উঠিল, “কিন্তু গৌরীশঙ্করকে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্দোষী বলিয়া বোধ হয়। হরশঙ্কর গৌশঙ্করেরই শত্রু, সেই উহাকে হত্যা করিতে পারিত কিন্তু যতদুর আমি জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে গৌরীশঙ্করকে সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী বলিয়াই বোধ হইতেছে।”

 বাধা দিয়া আমি বলিলাম, “আমারও মত সেইরূপ। গৌরীশঙ্কর যে হরশঙ্করকে হত্যা করে নাই, তাহা আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতে পারিয়াছি।”

 গৌরীশঙ্কর আমার শেষ কথা শুনিয়া বিশেষ আনন্দিত হইলেন। বলিলেন, “হুজুর একজন বিশেষ বিচক্ষণ ব্যক্তি। ইনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য।”

 আমি তখন গম্ভীর ভাবে হেডকনষ্টেবলের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “খাঁ সাহেব। এখনই এই হরশঙ্করকে গ্রেপ্তার কর। এই হরশঙ্করই গৌরীশঙ্করকে হত্যা করিয়াছে। এতক্ষণ যাহাকে আমরা গৌরীশঙ্কর বলিয়া ভাবিয়াছিলাম, তিনি বাস্তবিক গৌরীশঙ্কর নহেন—হরশঙ্কর। ফকিরকে হত্যা করে নাই, ফকিরই গৌরীশঙ্করকে হত্যা করিয়াছে। এই হরশঙ্করকে এখনই গ্রেপ্তার কর।”

 হৱশঙ্কর আমার কথায় আমাকে আক্রমণ করিতে চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু আমি পুর্ব্ব হইতেই সাবধান ছিলাম। যেমন সে আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল, আমি অমনি দুই হস্তে তাহার দুটা হাত এরূপে ধরিয়া ফেলিলাম যে, সে কোনরূপে বাধা দিতে পারিল না। ইত্যবসরে আমার আর দুইজন কনষ্টেবল তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হইল এবং হরশঙ্করের হস্তে হাতকড়ি পরাইয়া দিল।