অনুসন্ধান/অনুসন্ধান
অনুসন্ধান
নারাণ মাস্টার সকালে উঠে স্ত্রীকে চা দিতে বললেন। স্ত্রী মনোরমা বললেন,—-চাও নেই, চিনিও নেই। দুধ তো দিয়ে যায় নি গোয়ালা। দু-মাস তাকে টাকা দেওয়া হয় নি। তুমি সংসারের কিছুই দেখ না। আমি কি করে একা সংসার চালাই?
বাইরে থেকে ছেলেরা বললে, বাড়ি আছেন স্যার? নারাণ মাস্টার হস্তদন্ত হয়ে স্ত্রীকে বলেন, একটু চা করে দাও যা হয় করে। ওরা সব এসে গেল।
মনোরমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, এলে কি হবে? শুধু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। তোমার হয়েছে তাই। কারো কাছে পিত্যেস নেই, ওদের পেছনে ভূতের মত খাটুনি। এর চেয়ে টুইশানি ধরলে তো কাজ হয়, দু-পয়সা আসে।
বাইরে একখানা চালাঘরে গ্রামের চাষাভুষোদের অনেকগুলো ছেলে জুটেছে। নারাণ মাস্টার তাদের কাউকে অক্ষর পরিচয় করান, কাউকে ভাঙা একটা গ্লোবে ভূগোল শেখান, একজনকে কবিতা পড়তে শেখান। একটি গরীব ছেলেকে বলেন,—কি খেয়ে এসেচিস্ সকালে? কিছু না? শোন, তোর কাকীমার কাছে গিয়ে বল দুটি মুড়ি দিতে। আমি বলে দিয়েচি যেন বলিস্ নে?
ছেলেটি ইতস্ততঃ করে। সে তার কাকীমাকে চেনে। সেখানে যেতে তার সাহসে কুলোয় না, তবু নারাণ মাস্টারের মনস্তুষ্টি করবার জন্যে পায়ে পায়ে অন্দরের দিকে এগোয় মনোরমা বসে ধান সিদ্ধ করচেন রান্নাঘরে। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ডাকতে সাহস হয় না। মনোরমা হঠাৎ এগিয়ে বলেন,—কে? বিষ্টু? কি রে?
—এই—এই—
—কি?
—মাস্টার মশায় বলে দিলেন, এই—মোরে দুটি মুড়ি দিতি!
—তা আর বলে দেবেন না কেন? তাঁর কি? কোথা থেকে কি জোটে তাঁর সেদিকে কতটুকু খেয়াল থাকে? যা মুড়ি নেই। বল্ গে যা——
নারাণ মাস্টার খেতে বসেচেন। বাড়ির পাশের এক গরীব গেরস্ত বাড়ির ছোটো ছেলে ওৎ পেতে থাকে, কখন তিনি খেতে বসবেন। যদি না আসে, নারাণ মাস্টার ডাকেন,—
আয় বিলু; আয়—
বিলু বলে—কি? হ্যাঁ?
সে ওই দুটো কথা বলতে শিখেচে।
হেঁটে স্কুলে যেতে হয় অনেকদূর। দেরি হয়ে যায়, পথে যেতে যেতে শোনেন স্কুলের ঘণ্টা বাজছে। সাত মিনিট লেট্। হেড মাস্টার নীরদ রায় বড় কড়া লোক, বয়স পঞ্চাশের ওপর, চোখে চশমা, লম্বা দোহারা চেহারা।
—এত দেরি হোলে রোজ রোজ চলবে না, নারাণবাবু —
নারাণবাবু অপ্রতিভ মুখে হাজিরা খাতাখানা টেনে নেন। কিন্তু আরও পাঁচ মিনিট পরে হেড মাস্টারের প্রিয়পাত্র সারদাবাবু এসে একগাল হেসে বলেন,—উঃ কি রোদ আজকে স্যার। গা যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে।
হেড মাস্টার বলেন,— আপনার মেয়ের বিয়ের ঠিক হোল হুগলীতেই? বলুন, বসুন—
—দুটো পান নিন স্যার।
একটি ছেলে ক্লাসের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। নাম ইন্দুভূষণ। সুন্দর চেহারা। নারাণবাবুকে এগিয়ে এসে ক্লাসে নিয়ে যায়। ক্লাসে ছেলেদের ভিড়। নারাণবাবুকে সবাই ভালবাসে। পছন্দ করে, ভয়ও করে। ক্লাস চুপ হয়ে যায়-একবার মৃদু ভৎসনায়। অঙ্ক কষান, বোর্ডে খড়ি দিয়ে।
ইন্দুভূষণ বলে-অঙ্ক কষার পরে সেই গল্পটা বলুন স্যার।
সব ছেলে সায় দেয়। নারাণবাবু বলেন, জানলাগুলো খুলে দাও, দেখো তো কেমন সুন্দর। মাঠ, গাছপালা ভগবানের তৈরি সুন্দর পৃথিবীকে চোখ ভরে দেখতে শেখো। শুধু বইয়ের পড়া পড়লে মানুষ হবে না। চোখের দৃষ্টি ফুটুক।
ইন্দুভূষণ বলে-ঐ দেখুন বাঁশঝাড়ের আকাশটা কেমন ময়ুর-কষ্টি রং। নদীর ওপারে কি রকম কাশফুল ফুটেচে। নারাণবাবুর মন আনন্দে ভরে ওঠে। এই একটি ছেলেকে তিনি অন্ততঃ দৃষ্টিদান করতে পারবেন হয় তো। ইন্দুভূষণ স্কুল ম্যাগাজিনের জন্যে লেখা-নিজের রচনা পড়ে শোনাচ্ছে, এমন সময়ে হেড মাস্টার দোরের বাইরে দাড়িয়ে কড়া নজরে এক চমক ক্লাস রুমের দিকে চাইলেন। ইন্দুভূষণের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। নারাণবাবু থতমত খেয়ে গেলেন।
পাশে অন্য একটি ক্লাস। হেড মাস্টারের প্রিয়পাত্র সারদাবাবু চেয়ারে বসে ঢুলছিলেন।
মনোরম স্বামীর জন্যে দাড়িয়ে আছেন অপেক্ষা করে। ও বেলা সত্যিই কিছু ছিল না খেতে দেবার। ভৎসনা সুরে কথা বলেচেন। দুপুরে সেই দুঃখ মনে বড় বেজেচে। একটু চা দিতেও পারেন নি।
নারাণ মাস্টার বলেন,—অত হাসি হাসি মুখ কেন? কি খেতে দিচ্ছ।
মনোরমা বলেন-হাত পা ধুয়ে নাও, এসো। স্বামীকে জল এগিয়ে দেন। পাখার বাতাস করেন। নারাণবাবু জিগ্যেস করেন-ননী আজ ইস্কুলে যায় নি কেন?
মনোরমা মিথ্যে করে বলেন-পেটের অসুখ হয়েছিল। কিন্তু তা নয়, ননীমাধব অত্যন্ত অবাধ্য প্রকৃতির ছেলে, এ বয়সে অনেক রকম ছিল চাতুরি শিখেচে। ভাদ্র মাসে বিলে জল বেড়েচে। সেখানে মাছ ধরতে গিয়েছে, পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের সঙ্গে।
স্বামীর জলখাবার ও চা দেন মনোরম। তালের বড় আর চা। গরম গরম বড়া ভাজেন, আর ভালো ভালো দেখে স্বামীর পাতে তুলে দেন।
বাইরে ছেলেরা এসে ডাকে—-বাড়ি আছেন স্যার? নারাণবাবু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
মনোরমা বলেন—বোসো বোসো। অত খাটলে শরীর থাকবে কেন? একটু বোসো। আর দু-খানা ভেজে দিই।
সেই ছোট ছেলেটি এসে টলতে টলতে নারাণবাবুর পাশে বসে যায়। ওর মুখে তুলে দিয়ে খাওয়ান।
নদীতীরে প্রতিদিন একটু করে বেড়াবার অভ্যেস আছে নারাণ মাস্টারের। ইন্দুভূষণ ও আরো দুটি ছেলেকে নিয়ে নক্ষত্র সংস্থান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্চেন আজ।
ইন্দুভূষণ বলচে, ভেনাস কোটা স্যার?
নারাণ মাস্টার বলচেন—ওই বাঁশঝাড়ের মাথার ওপরে— ঐ দেখো।
-বেশ বড় নক্ষত্র—
—ওটিকে নক্ষত্র বলো না। ওটি গ্রহ। সৌর জগতের একটা গ্রহ। অন্য অন্য গ্রহগুলির নাম করো তো? তোরা দেখেচিস্ শুক্র গ্রহ?
—ঐ বাঁশ ঝাড়ের মাথায়?
হঠাৎ সেদিকে দেখা গেল ননীমাধব জলের ধারে ছিপ নিয়ে মাছ ধরছে ৷ বাপকে দেখে ননীমাধব ততক্ষণ ছিপ গুটিয়ে ফেলে। নারাণ মাস্টার দুঃখিত হন। বলেন —-তুই তো আজ ইস্কুলেও যাস নি—অথচ তোর দিদির বাড়ি গিয়েচিস্ শুনলাম বাড়িতে ৷
ননী চুপ করে রইল। নারাণ মাস্টারের মেয়ের বিয়ে হয়েচে পাশের গ্রামেই ৷
—তোর মার কাছে বলে এসেচিস্ দিদির বাড়ি যাচ্চি?
— হ্যাঁ।
—কেন মিথ্যে কথা বলতে গেলি? অমন আর কখনো বলবে না। মিথ্যে কথা কারো কাছে কখনো বলবে না। সত্য কথা বলবে, এতে যদি কোনো ক্ষতিও হয়, তাও ভালো। সর্বদা মনে রাখবে এটি। কেমন তো? আচ্ছা বাড়ি যাও ৷
বাড়িতে মনোরমা সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখিয়ে প্রণাম করলেন। পাশের বাড়ির গাঙ্গুলি-বৌ ও শুভদা ঠাকরুনের কাছে সংসারের দুঃখকষ্টের কথা বলেন। শুভদা এসেচেন তেল ধার নিতে। গরীব বিধবা। মনোরমা যেটুকু তেল আছে, তার বেশি অংশটা শুভদাকে ঢেলে দিলেন। স্বামীর কথা বলেন ওঁদের কাছে।
এমন লোক যদি দেখে থাকি কখনো পিসি। সংসারের দকে নজর নেই; কোনো দিকে নজর নেই। কি নিয়ে যে লোকটা থাকে দিনরাত! মেয়েটার ওই কষ্ট, তখুনি বলেছিলাম দোরের কাছে কুটুম্ব করতে নেই। দু-বেলা কথা শুনতে হবে, তখন তা শুনলেন না। এখন তাই হচ্ছে, যা বলেছিলাম।
শুভদা ঠাকরুন বললেন-শাশুড়ী খারাপ না হয় বুঝলাম। কিন্তু জামাই তো শুনেচি বড় ভালো ছেলে?
-ভালো হোলে কি হবে পিসি, মায়ের কাছে জুজু । মার সামনে কথা বলতে পারে ছেলে? উনি বলেন, মায়ের বাধ্য হয়েই থাকা ছেলের উচিত। বললাম যে, কোনোদিকে নজর নেই ওঁর-চাল নেই, তেল নেই, আজ বাদে কাল সকালে কি হবে ঠিক নেই— —কে শুনচে সে সব কথা। ছাত্রদের নিয়েই ব্যস্ত। কেউ এক পয়সা দেবে না, ভূতের ব্যাগার খেটেই খুসি। আচ্ছা, বলো তো পিসি, এ কি রকম কাণ্ড? নারাণ মাস্টার বাইরে থেকে হাঁক দেন এই সময়ে—একটা আলো ধরে। বাইরের দিকে বডড অন্ধকার।
মনোরমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন—হ্যাঁ, সাতটা লণ্ঠনে আলো জেলে তোমার জন্য বসে আছি যে! পিপে পিপে তেলের ব্যবস্থা ঘরে রেখেচ যে! এলে কোথেকে আমার মাথা কিনে, জিগ্যেস করি?
নারাণ মাস্টার লজ্জিত মুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হোঁচটি খান। মনোরমা বলেন—লাগলো নাকি? তোমার দেহটা এমনি করেই সাতখোয়ারে যাবে। দেখি কোথায় লাগলো?•••
মনোরম রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরি করচেন। ননীমাধব খিড়কী দোর দিয়ে চুপি চুপি ঢুকে বললে, মা, বাবা কোথায়?...বাটিতে কি?
—ওঁর জন্যে দুটো চিড়ে ভাজা করেচি ঘি দিয়ে। না খেয়ে খেটে খেটে ওঁর শরীরটা যে গেল! এই খানিক আগে এমন হোঁচট খেলেন যে পা ভেঙে যেতে যেতে রয়ে গেল। ও থেকে তোমাকে না। তোমার জন্য চালভাজা আছে— তেল মেখে দিচ্ছি। দিদির বাড়ি যাস নি?
—হু
—কেমন আছে সে? এতক্ষণ সেখানে ছিলি? কি খেতে দিলে?
—কিছুই না। ঘণ্টাকর্ণ। দাও চিঁড়েভাজা— দিদি ভালো আছে।
—না—না। এ ওঁর জন্যে ঘি দিয়ে ভাজা। তোকে এর পরে দেবো এখন। বোসো গে যাও।
নারাণ মাস্টার চিঁড়ে ভাজা খেতে খেতে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করেন।
মনোরমা বলেন—ননী এই এল অমলার শ্বশুর বাড়ি থেকে। অনেকক্ষণ ছিল সেখানে। অমলা ভাল আছে।
নারাণ মাস্টার স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন—কে বললে এ সব কথা?
—কেন ননী বললে, আবার কে বলবে। সে এই তো এল ওর দিদির বাড়ি থেকে। রান্নাঘরে বসে খাবার খাচ্ছে।
নারাণ মাস্টার একবার ভাবলেন স্ত্রীকে ছেলের গুণের কথা সব খুলে বলেন। তার উপদেশ সত্ত্বেও সে আবার তার মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলেচে। কিন্তু সরলা পত্নীর মুখের দিকে চেয়ে নারাণ মাস্টার কথা চেপে গেলেন।
বাইরে থেকে ছেলেরা ডাক দিলে-বাড়ি আছেন স্যার? ছেলেরা পড়তে এসেচে। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নারাণ মাস্টার। নারাণ মাস্টার স্কুলে গেলেন। হেড মাস্টার আজ আর কিছু বলেন না। ক্লাসে ক্লাসে ছেলেরা তাঁকে নিজের নিজের ক্লাসে পাবার জন্যে যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়। ইন্দু ভূষণের ক্লাশে নারাণ মাস্টার ঢোকেন। একটু পরে হেড মাস্টার এসে গম্ভীর ভাবে ক্লাসের বাইরে দাড়িয়ে জানিয়ে গেলেন, এ ক্লাসটা তঁর নয়। রুটিনটা দেখে ঢুকলেই তো হয়।
অঙ্ক কষাতে কষাতে কি করে এসে পড়ে সূর্যের কথা। সূর্য আছে বলে, জগতে রঙের খেলা অদ্ভূত—নারাণ মাস্টার বোঝান। তা থেকে নিউটনের কথা এসে পড়লো—জ্ঞান তপস্বী নিউটন।
বাইরে দাড়িয়ে হেড মাস্টার শোনেন। নারাণ মাস্টারের জনপ্রিয়তা হেড মাস্টারের চক্ষুশূল।
একটু পরে মাখনলাল সুর স্কুলে এসে ক্লাসে ক্লাসে বেড়াতে বেরুলেন। মাখনলাল সুর দু-তিনটি তেলের কলের মালিক। কালো, মোটাসোটা চেহারা, মুখখানাতে দাম্ভিকতা মাখানো। লেখাপড়া বিশেষ কিছু জানেন না, টাকার জোরে স্কুলের সেক্রেটারি হয়েচেন বলে শিক্ষকদের ওপর প্রভুত্ব একটু বেশি করেই খাটান।
বিভিন্ন ক্লাসে ঢুকে পরীক্ষা করেন। প্রথমে ক্ষেত্রবাবুর ক্লাস। ক্ষেত্রবাবু সসন্ত্রমে উঠে দাঁড়ান। বলেন, পড়িয়ে যান—আমি শুনি। বাংলা সাহিত্য পড়াচ্ছেন ক্ষেত্রবাবু। সুরমশায় বলেন, ও সব কি আর কবিতা? কবিতা ছিল সেকালে যদু মুখুয্যের। কুজ্বপৃষ্ঠ নুজদেহ উষ্ট্র সারি সারি, কি আশ্চর্য্য শোভাময় যাই বলিহারি ইত্যাদি। কৌটো খুলে পান খান ক্লাসের মধ্যেই।
তারপরে যদুবাবুর ক্লাস। ইতিহাস পড়াচ্ছেন যদুবাবু, মন দিয়ে শিবাজির জীবনী বর্ণনা করচেন ছেলেদের কাছে। মাখন সুর এক অবান্তর প্রশ্ন করে বসলেন—বলো দিকি, দাশুরায় পাঁচালি লিখেছিলেন কত সালে? মাস্টার বলে দাও না ওদের। দাশুরায়—আহা, আমন গান আর কেউ বাঁধতে পারবে না—
তারপরে নারাণবাবুর ক্লাস। নারাণবাবু মশগুল হয়ে গিয়েচেন অধ্যাপনায়; কিন্তু তিনি অঙ্ক ছেড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করচেন ক্লাসে। মাখন সুর ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন,—আপনি না অঙ্কের মাস্টার? আমি শুনেচি আপনি ক্লাসের পড়া না করিয়ে ছেলেদের কাছে বাজে গল্প করেন।
নারাণবাবু বললেন,—কথাটা উঠলো। কিনা, আবৃত্তি, সর্ব— শাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী, বিশেষতঃ কবিতার। তাই আবৃত্তির নিয়মটা ওদের—
—তা শেখাবার কোনো দরকার নেই। আপনি যে জন্যে আছেন, তাই করুন। আমি অনেকদিন থেকে এরকম শুনে আসচি, কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখলাম।
একটু পরে চাকরে এসে একটা শ্লিপ দিয়ে গেল। নারাণবাবুর তলব হয়েচে হেড মাস্টারের ঘরে।
নারাণবাবু পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দেখেন হেড মাস্টার অপ্রসন্ন ও বিরক্ত মুখে বসে। বললেন— আপনি কোনো কাজ করেন না ক্লাসে—ছেলেদের যা পড়ান তা সিলেবাসের বাইরে। সেকেণ্ড ক্লাসে এ্যালজেব্রা কতদূর করিয়েছেন দেখি এ বছর। মোটে সিম্পল ইকোয়েশন ধরাচ্ছেন? তা' হোলে কবে কোর্স শেষ করবেন আপনি? আপনাকে নিয়ে বড় মুশকিল হোল দেখচি। আপনার পুরোনো রোগ গেল না। সেই বাজে গল্প করা।
নারাণবাবু বললেন- আমি বাজে গল্প করি নে—ছেলেদের উদার দৃষ্টি যাতে খোলে তার চেষ্টা করি।
টেক্স্ট বইয়ের যে একটা জগৎ আছে—তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আপনাকে রাখা হয় নি এখানে? Know this school to be a machine for turning out matrioulates—আপনাকে আর কত শেখাবো বলুন—
যদুবাবু, ক্ষেত্রবাবু ও রাখালবাবু, নারাণবাবুকে জিগ্যেস করেন শিক্ষকদের বিশ্রাম ঘরে—ব্যাপারটা কি হয়েছিল নারাণবাবু? সব শুনে যদুবাবু খুব লাফঝাঁপ দেন।
—-আমি হোলে অমন হেড মাস্টারকে দেখিয়ে দিতাম। দু-কথা দিতাম শুনিয়ে আচ্ছা করে। সিলেবাস শেখাতে এসেচে?; সিলেবাস্? অন্ত্যজ কোথাকার। মুখের মত জবাব দিয়ে দিতাম আজ——
ক্ষেত্রবাবু বলেন-একটু আস্তে-আস্তে—
—কিসের আস্তে, ভয় করি নাকি? এ শর্মা কাউকে থোড়াই কেয়ার করে তা বলে দিচ্ছি।
স্কুলের চাপরাশি এসে ডাকলে—হেড মাস্টারবাবু যদুবাবুকে ডেকেচেন যদুবাবু হঠাৎ বাতাস বের হওয়া বেলুনের মত চুপসে গেলেন। হেড মাস্টারের ঘরে জড়িত পদে ঢুকে বললেন, আমাকে ডেকেছেন? —হ্যাঁ, আপনি শনিবার ফোর্থ ক্লাসের উইকলি পরীক্ষার নম্বর এখনো কেন দেন নি?
—আজ্ঞে—আজ্ঞে —-না, যদুবাবু! আজ ন'দিন হয়ে গেল——কাজে আপনার বড় গাফিলতি হচ্ছে। গতবারও এমনি করেছিলেন আপনি। এ রকম আর কখনো করবেন না আশা করি। ওতে ছেলেদের অসুবিধে হয়। বুঝলেন!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। স্যার আমার শরীরটা একটু খারাপ ছিল বলেই, নইলে এতদিন—
—আচ্ছা, এখন আসুন তবে।
শিক্ষকদের বিশ্রাম ঘরে ফিরে আসতেই অন্য সব মাস্টার আগ্রহে জিগ্যেস করেন—কর্তা কি জন্যে ডেকেছিলেন হে? যদুবাবু হাত-পা নেড়ে বলেন—দিয়ে এলুম শুনিয়ে দু-কথা। আমায় বলে কিনা ফোর্থ ক্লাসের খাতা ফেরত দিতে অত দেরি হোল কেন? আমি মুখের ওপর বলে এলাম মশাই, চল্লিশ টাকা মাইনেতে তো চলে না, আমাদের টুইশানি করে খেতে হয়। সময় পাই কখন যে খাতা সকাল সকাল দেখে দেবো? দিলাম শুনিয়ে।
—বললেন ওই কথা? -বলবো না? এ শর্মা থোড়াই কেয়ার করে। হি মাস্ট বি টোল্ড সাম হোম ট্রুথ্ পাশের বাড়িতে রেডিওতে গান হয়। ও যেন একটি অন্য জগৎ, রসের জগৎ। যে জগতের সঙ্গে শিক্ষকদের কোনো পরিচয় নেই। শিক্ষকেরা কান পেতে শোনেন ।
বেরিয়ে এসে সবাই একটা চায়ের দোকানে বসেন। ভাঙা পেয়ালায় চা খান। নারাণবাবুর অপমানে সবাই দুঃখিত। রাখালবাবু বলেন—যেদিন এদেশে শিক্ষকতার কাজ সম্মানিত বলে বিবেচিত হবে, সেদিন বুঝতে হবে জাতি হিসেবে আমরা জেগেছি। আজ আমাদের স্থান কোথায়, নারাণবাবুর ওপর মাখনবাবুর ব্যবহারেই বুঝে নেওয়া যাবে।
রাখালবাবু নারাণবাবুকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। বড় শ্রদ্ধা করেন তিনি তাঁর এই সরল অকপট উদার দৃষ্টিসম্পন্ন সহকর্মীটিকে। রাখালবাবু বিদেশী শিক্ষক, এখানে তাঁর বাসা। বাসাতে তাঁর স্ত্রী, তিনটি ছেলেমেয়ে ও ভাইঝি নিভা থাকে। নির্ভার বয়েস বছর আট নয়, ফ্রক পরা ফুটফুটে মেয়েটি। নারাণবাবু তাকে কাছে ডেকে আদর করেন। নারাণবাবুর মেয়ে অমলার শ্বশুর বাড়ি। অমলার শাশুড়ী তার ওপর অত্যন্ত কুব্যবহার করে। ছেলে সুকুমারের সঙ্গে অমলার দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। অমলা সেজেগুজে জানলায় বসে আছে—আজ স্বামী কলকাতা থেকে আসবে অনেকদিন পরে ৷
শাশুড়ী এসে বলেন—বলি, হ্যাঁগা বৌমা, বিকেলে ঝাঁট নেই, পাট নেই—দোরে জল দেওয়া নেই—অমন পটের বিবি সেজে জানলায় বসে রয়েছ কেন? সে গুড়ে বালি। সুকু আজ আসবে না চিঠি লিখেচে। তুমি উঠে গিয়ে ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে এসো আর এ বেলার ভাত চড়িয়ে দাও গে।
অমলা সলজ্জ মুখে উঠে গেল রান্নাঘরে। তার মন ভেঙে গিয়েছে। স্বামী সে কথা তো গতবার বলে যান নি? শাশুড়ী মিথ্যে কথা বলেছিলেন।
সন্ধ্যার ট্রেনে সুকুমার এল। অমলার জন্যে শাড়ি নিয়ে— নিজে আহলাদ করে দেখাতে গেল। মা কাপড়খানা ছিনিয়ে নেন ছেলের হাত থেকে। বলেন—এ আমার পাঁচীর সাধের সময় তাকে দেবো। বৌয়ের জন্যে আর রোজ রোজ কাপড় আনতে হবে না। যে গুণধর বৌ। সংসারের কুটোটুকু ছ-খানা করে উপকার নেই। সারা বিকেল সেজেগুজে ঠায় বসে রইল জানলায়। বলে, কোনো কাজ করতে পারবো না। যেমন হেজল দাগড়া তেমনি বদমাইস। হবে না? ছোট ঘরের মেয়ে যে! ওর বাবার নাম পাগলা মাস্টার।
অমলা আড়াল থেকে স্বামীকে দেখবার জন্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবার প্রতি অমন অপমানসূচক শব্দ প্রয়োগে সে আর স্থির থাকতে পারে না।
সামনে এসে বলে— বাবার নামে অমন যা তা বলবেন না আপনি। আমি কি করেচি না করেচি আপনাদের তা জানি নে, কিন্তু আমার বাবা যে কারো কোনো অনিষ্ট করেন নি বা করতে পারেন না এটা আমি ভালো করেই জানি।
শাশুড়ী ঠাকরুণ রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করলেন ৷ ছেলেকে দিব্যি দিলেন সে যেন ও বৌয়ের মুখদর্শন না করে। অনেকরাত্রি জেগে দু-জন দু-জানলায় বসে রইল।
সেদিন নারাণবাবু আহার করতে বসে বললেন—- এঁচড় কোথা থেকে পেলে? অসময়ে এঁচড়।
মনোরমা বললেন—আমি জানি নে, ননীমাধব কোথা থেকে এনেচে।
নারাণ মাস্টার বললেন—কোথা থেকে আনবে? এ নিশ্চয় অন্য কারো গাছ থেকে চুরি করে এনেচে। আমাদের নিজেদের গাছ নেই—কেই বা দেবে অসময়ে? বলি শোনো, চুরির জিনিস আমার পেটে সইবে না। আমার সংসারে কেউ খাবে না। ফেলে দাও সবটুকু ৷
মনোরমা অনেক যত্ন করে দরিদ্র সংসারে অসময়ের এঁচড় রেঁধেছিলেন। স্বামী খেতে ভালোবাসেন বলে তাঁর অত আগ্রহ। এই আগ্রহের জিনিসটা নির্মম ভাবে ফেলে দিতে তাঁর চোখে জল এল। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না মুখে। তিনি তাঁর স্বামীকে খুব ভাল ভাবেই চেনেন ৷ অনুনয় বিনয়ে এক্ষেত্রে কোনো ফল হবে না। অভিমান করে চুপ করে রইলেন।
মনোরমাকে বুঝিয়ে বললেন নারাণ মাস্টার। দেখো, ছেলেকে শুধু উপদেশ দিলে কাজ হবে না। “আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাই”—আমরা পিতামাতা, এই আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া দরকার। মুখে বলি, অথচ চুরির এঁচড় রেঁধে খাই—এতে ছেলেপিলে ভালো উপদেশ কখনো নেবে না। আমি জানি তোমার মনে কষ্ট হয়েচে, কিন্তু আমি যে পিতা, তুমি যে মা—আমরা যে শিক্ষক! নারাণ মাস্টারের ক্লাসে জানলা বন্ধ ছিল। তিনি ক্লাসে গিয়েই জানলা খুলে দিতে বলেন।
ছেলেদের বলেন—মনের জানলাও সব সময় ঐ রকম খুলে রাখতে হবে। দ্যাখো তো কেমন নীল আকাশ? চোখকে তৈরি করে৷ বাইরের সৌন্দর্য দেখতে। জীবনে মস্ত আনন্দ পাবে।
হেড মাস্টার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। একটু পরে ডেকে পাঠালেন।
-কেন ডেকেচেন স্যার?
-এদিকে আসুন, বসুন দয়া করে।
নারাণ মাস্টার বসেন। হেড মাস্টার বলেন—আপনাকে কথাটা বলি। আপনার অঙ্কের ফল অত্যন্ত খারাপ এবার। কাল পরীক্ষার নম্বর আনিয়েচি ইউনিভারসিটি থেকে। ছ-টা ফেল অঙ্কে। আপনি এদিকে দেখি ক্লাসে বসে আর্টের চর্চা করেন। সেজন্যে কি আপনাকে রাখা হয়েচে স্কুলে? কতবার না আপনাকে একথা আমি বলেচি? বড় দুঃখের বিষয় নারাণবাবু।
নারাণবাবু চুপ করে থাকেন। সাহস করে কিছু বলতে পারলেন না।
রাখালবাবু টিচার্স রুমে বসে সব কথা শুনে বলেন—ও, আর ওঁর সাবজেক্টে যে এগারটা ফেল! তার বুঝি কোনো কৈফিয়ত নেই? গরীবের ওপর যত জুলুম! বেশ।
বাজারে এসে সেই দোকানে মাস্টারেরা ভাঙা পেয়ালায় চা খান। সেখানে রাখালবাবু কথাটা তোলেন। স্কুল কমিটির অবিচার সম্বন্ধে কথাবার্তা হয়। একজন মাস্টার (যদুবাবু) বলেন শুধু টিউশনি করি সকাল থেকে পাঁচটা ৷ বিকেলে আরো পাঁচটা। তাতেও কি সংসার সুচারু রূপে চলে? একটি বড় মেয়ে ঘাড়ে। দেশের তরুণদের যাঁরা গড়ে তুলবেন, গোটা জাতিটিকেই তাঁরা গড়ে তুলচেন—তাঁদের দিকে কে তাকায়?
ভগ্নমনে যে খাঁর বাড়ি যান। সন্ধ্যা হয়ে আসে ৷
যদুবাবু বলেন—তোমরা যাও, আমি আবার গুণী মল্লিকের বাড়ি প্রাইভেট পড়াতে যাবো।
-খেলেন না কিছু? বাড়ি যাবেন না?
—বাড়ি গেলে সময় পাবো কখন? ওই কোনোদিন রাস্তায় খেতে খেতেই পথ চলি দু-এক পয়সার বিস্কুট কি মুড়ি। কোনোদিন তারও সময় হয় না। আমাদের আবার খাওয়া, তুমিও যেমন ভায়া! স্কুলে প্রাইজ বিতরণ উপলক্ষে সভা। সভায় নারাণ মাস্টারের ছাত্র ইন্দুভূষণ চমৎকার আবৃত্তি করলে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ডেকে জিগ্যেস করলেন। এমন আবৃত্তি শিখিয়েচে কে?
—নারাণ মাস্টার।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নাম মিঃ কান্ওয়ার। পাঞ্জাবী। কেম্ব্রিজের গ্রাজুয়েট। নারাণ মাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওঁর বাড়ি আসেন। পথে মাখন সুর কি একটা কথা বলতে গেলেন খোসামুদের ভাবে হাত জোড় করে—স্যার, আমাদের অয়েল মিলের লাইসেন্সটার বিষয় একবার—
মিঃ কান্ওয়ার বিরক্তির সুরে বললেন —- আভি নেই—নট নাউ—কাম এ্যাণ্ড সি মি ইন্ মাই অফিস্-—
মিঃ কান্ওয়ারকে নারাণ মাস্টার পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য বোঝান। - জ্যোৎস্না রাত্রি। মিঃ কান্ওয়ার বলেন —- মিঃ গাঙ্গুলি, আপনি একজন আইডিয়াল টিচার—আপনি আমাকেও Rural Bengal-এর রূপটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন-আমি আপনাকে মনে রাখবো-
মনোরমা ভাঙা পেয়ালায় ছ-জনকে চা দেন।
মাখন সুরের বাড়িতে ক্রিয়াকাণ্ড। সব মাস্টার ভূতের মত খাটচেন ৷ কেউ অভ্যর্থনা করচেন, কেউ রান্নার তদারক করচেন।
নারাণ মাস্টারকে মাখনবাবু বলেচেন চা দেওয়া পরিদর্শন করতে। সার্কেল অফিসার মিঃ সুধীন বসুকে চা নিজের হাতে দিতে বলেন। নারাণবাবু চা দিতে গেলে তরুণ মিঃ বসু উঠে চায়ের কাপ নিয়ে বলেন—-স্যার আপনি কেন? রাখুন, রাখুন
—আমায় চিনতে পারলেন? আমি সুধীন। আপনার ছাত্র।
নারাণ মাস্টার বলেন—কোন্ বছর পাস করেছিলে বাপু, এসো এসো, দীর্ঘজীবী হও। মনে তো হচ্ছে না।
—-মানিকদের ব্যাচ, উনিশশো ত্রিশ সালে ম্যাট্রিক পাস করি স্যার। আপনি আমার গুরু ৷
—বেশ, বেশ বেঁচে থাকো বাবা, আজকাল তুমি কি আমাদের সার্কেল অফিসার?
—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।
—আমাদের বাগদি পাড়ায় একটা টিউবওয়েল করে দিতে পারো বাবা? খালের নোংরা জল খেয়ে সব কলেরায় মরচে। আমার দুটি ছাত্র মারা গিয়েচে। ওরা গরীব, তোমাদের সামনে অভাব অভিযোগ জানাতে পারে না। এই কাজটি তোমার গুরু-দক্ষিণা হবে বাবা, যখন গুরু বলে ডাকলে তখন বলি। ছেলেটি খাতা বের করে বললে-গ্রামের নাম আর পাড়াটা বলুন স্যার। টুকে নি। আজকাল ভালো কাজ করবো বললেও করা যায় না, আপনি পণ্ডিত লোক, আপনাকে কি বোঝাবো! বিদেশী শাসন চলেচে শোষণের জন্যে, প্রজার মঙ্গলের জন্যে নয়। গভর্ণমেন্টের কাজে ঢুকে সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝচি—আচ্ছা স্যার প্রণাম। পায়ের ধুলো দিন আর একবার।
ছেলেটি বিদায় নিতে উদ্যত হোলে মাখন সুর হাত কচলাতে কচলাতে তার পেছন পেছন খানিক দূর গেলেন।
আরো খানিকক্ষণ খেটে বেলা গেলে নারাণ মাস্টার অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি চলে গেলেন। কেউ জিগ্যেসও করলে না তিনি খেয়েচেন কিনা ৷
মাখন সুর যারার আগে কেবল বললেন—নারাণবাবু, কাল একটু সকাল সকাল আসবেন, ভাল চণ্ডীর গানের আসর হবে কিনা। থানার বড় দারোগাবাবু আসবেন খবর দিয়েচেন।
* * * ছ বছর পরে।
রাখালবাবুর বাড়ি তাঁর স্ত্রীর কলেরা। নারাণ মাস্টার ছাত্রদল নিয়ে সেবা করচেন। ছেলেদের মধ্যে ইন্দুভূষণই পরিচালক। সবাই ব্যস্ত, কেউ জল গরম করছে, কেউ ডাক্তার বাবুর হাতে সাবান দিয়ে জল ঢেলে দিচ্ছে। রাখাল মাস্টারের মেয়ে প্রীতি ইন্দুভূষণকে সাহায্য করে। কৃতজ্ঞতায় প্রীতির তরুণ হৃদয় কানায় কানায় ভরা। রাখালবাবুর স্ত্রী রাত্রে মারা গেলেন। প্রীতিকে ইন্দু বোঝায়। এর আগেও ইন্দুর সঙ্গে প্রীতির দেখা হয়েছে দু-একবার। নারাণ মাস্টার রাখালবাবুর বাসায় খবরের কাগজ আনতে পাঠাতেন, প্রীতিই কাগজখানা ইন্দুভূষণের হাতে দিত।
কৃতজ্ঞতা প্রেমে পরিণত হোল ক্রমশঃ। মাতৃবিয়োগের পর শোকাচ্ছন্ন দিনগুলিতে ইন্দুভূষণ সান্ত্বনা দিত ওকে। রাখাল মাস্টার বাড়ি থাকতেন না। দু-জনে প্রেম গড়ে উঠলো। ইন্দুভূষণ ম্যাট্রিক পাস করে তখন কলেজের ছাত্র। কিন্তু নারাণবাবুর বাড়িতে সে নিয়মিত আসে।
মনোরমা বয়স ও দারিদ্র্যের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েচেন। ছেলে অবাধ্য, লেখাপড়া করলে না, দু-বার ম্যাট্রিক ফেল করেচে। মাকে এসে বলেচে, মা একটা কলের গান কিনবো, টাকা দাও। মা বললেন—কি করে বলিস এসব কথা ননী? ওঁর বয়স হয়েচে, সংসারের জন্যে ওঁর এখন চিন্তা এসে পড়েচে, আগে তো গায়ে আঁচড় লাগাতে দিতাম না। এখন ভালো করে একবাটি দুধ খেতে দিতে পারি নে। তোকে কলের গান কেনবার টাকা কোথা থেকে দেব।
ছেলে মার সঙ্গে ঝগড়া করে—সমান উত্তর করে। অবশেষে বাবার পায়ের শব্দ পেয়ে খিড়কি দোর দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়।
নারাণ মাস্টার ঢুকে স্ত্রীকে চোখ মুছতে দেখে বলেন কি হোল, চোখে কি? তিনি তো সংসারের কিছু খবর রাখেন না। স্ত্রী বলেন—চোখে কি হয়েছে, সব সময় জল পড়চে।
ওঁর মেয়ে আবার চিঠি দিয়েচে। মনোরমা বলেন সে কথা স্বামীকে। ওকে একবার দেখে এসো না গো! ওদিকে তো যাও। নারাণ মাস্টারের মনটা কেমন করে ওঠে। পাশের গ্রামে যাবার সময় ওর শ্বশুর বাড়ির সামনে দিয়ে যান। মেয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। জামাইয়ের সঙ্গে দেখা। জামাই বলে, আসুন বাড়িতে। নারাণবাবু বলেন—সময় নেই, যাবো না, অমলাকে বুঝিও।
বাড়ি এলে মনোরমা বলেন,—হ্যাঁগা, তুমি গিয়েছিলে?
নারাণবাবু বলেন—হ্যাঁ, খুব যত্ন করলে। অমলার শাশুড়ী নিজে এসে কত কথা বললে। জল খাওয়ালে।
প্রীতি ও ইন্দুভূষণের শেষ দেখা। প্রীতির বিয়ে অন্য স্থানে স্থির হয়েচে। প্রীতির অভিভাবকদের হাত এতে সম্পুর্ণ; বেচারী প্রীতি নিরুপায়া, সে শুধু জানাতে এসেচে গোপনে ইন্দুভূষণকে। বাড়ির পিছনে এক জামতলায় দু-জনে এসে দাঁড়িয়েচে। প্রীতি বললে—আমি কি করবো ইন্দু-দা, আমি কি করতে পারি? আমি তোমার সঙ্গে পালাতে পারি, কিন্তু বাবা তাতে মরে যাবেন। তা করতে পারবো না।
প্রীতির বিবাহের পরদিনই সকালে উঠে মনোরমা দেখলেন ছেলে ননীমাধব ঘরের দোর খুলে রেখে মায়ের বাক্স ভেঙে তিনশো টাকা ও বাবার সাবেক আমলের ঘড়িটি নিয়ে কোথায় পালিয়ে গেছে। একখানা চিঠি খুঁজে পাওয়া গেল, তাতে সে লিখেছে, বৃহত্তর জগতের আহ্বানে আজ সে বাড়ি ছেড়ে চললো, বাবা-মা যেন কিছু মনে না করেন।
নারাণ মাস্টার স্ত্রীকে বোঝান।
মনোরমা বলেন—হ্যাঁগা, তুমি যাও, ওকে এনে দাও।
—যাবো, ভেবো না।
—হ্যাঁগা, সে কোথায় গেল?
—ভেবো না।
—তাকে এনে দেবে?
—হ্যাঁ এনে দেবো।
এমন একদিনে নারাণবাবুর চাকরি গেল। এর মস্ত কারণ একজন দেশসেবকের মৃত্যুতে নারাণবাবু ছেলেদের নিয়ে গাছতলায় দাঁড়িয়ে সভা করেছিলেন।
ছেলেদের বিদায় অভিনন্দন হোল গাছতলাতেই। নারাণবাবু গ্রহণ করলেন। হেড মাস্টার ও মাখন সুর স্কুল গৃহে উক্ত অভিনন্দনের অনুষ্ঠান করতে দিতে রাজি হোলেন না। বিদায়ের সময় নারাণবাবুর মর্মস্পর্শী বাণীতে সকলের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।
নারাণবাবু অভিনন্দন-পত্র হাতে হেঁটে আসচেন, মাখন সুর পাশ দিয়ে ফিটন গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন।
গ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের সভা। মাখন সুর এলে সবাই দাঁড়িয়ে উঠলো—অথচ নারাণবাবু যে বেঞ্চিতে বসে, সেই বেঞ্চিতে বসে সাধারণ লোকে বিড়ি খাচ্চে। পেছনের বেঞ্চিতে বসে আছেন নারাণবাবু, জায়গা না পেয়ে। মাখন সুরের বক্তৃতা শুনচেন।
মাখন সুর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বর হবেন, জনসাধারণের ভোট চান। বক্তৃতায় তিনি বলচেন, তিনি আজ অনেকদিন ধরে দেশের সেবক ও ভৃত্য তা সকলেই জানেন। স্কুল ও সরকারী দাতব্য চিকিৎসালয় নিয়ে তিনি কি রকম প্রাণপাত পরিশ্রম করেচেন, তা যে সার্থক হয়েছে—এতেই তিনি ধন্য। অন্য কোনো প্রতিদান তিনি চান না, কেবল দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা ছাড়া ইত্যাদি। খুব চটপট হাততালি পড়চে।
বাইরে এসে নারাণবাবু বিড়ি টানতে টানতে অন্যমনস্ক ভাবে পথ চলেন। লোকের কাছে বলেন—চমৎকার লোক মাখনবাবু। কেমন চমৎকার বক্তৃতা দিলে। দেশের মধ্যে অমন লোক আর নেই। বড় ভদ্র লোক।
এক জায়গায় বসে ছেলের কথা ভাবেন। পরের ছেলে মানুষ করেচেন অথচ নিজের ছেলের কিছুই করতে পারলেন না। চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠলো। ছেলেটা হয়তো পথে ভিক্ষে করচে। হয়তো অনাহারে কষ্ট পাচ্চে। চোখের জল মুছলেন চাদরের খুঁটে।
মনোরমা বৈকালে অন্যমনস্ক ভাবে একলা বসে বাড়িতে। স্ত্রীর চেহারা দেখে নারাণবাবুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পতিব্রতা স্ত্রী বাইরে কিছু প্রকাশ করে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার সমস্ত অন্তর পুড়ে উঠেচে আজ নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের জন্যে।
পেছন থেকে নারাণবাবু স্ত্রীর শোকাচ্ছন্ন বিষাদ মলিন মূর্তি দেখেন।
তাঁকে আসতে দেখে মনোরমা ধড়মড় করে উঠে বলেন—ওমা, কখন এলে তুমি? আমি টের পাই নি।
—এই তো এলাম। লেবুর আচার করবে বলে লেবুর সন্ধানে গিয়েছিলাম।
—সত্যি তাই নাকি? পেলে?
মনোরমা কৃত্রিম উৎসাহের সঙ্গে বলেন—দাঁড়াও তোমার মুখ শুকিয়ে গিয়েচে, দুটো মুড়ি মেখে দিই।
নারাণ মাস্টার বলেন—বোসো বোসো। একটু গল্প করো। খেটে খেটেই গেলে।
মিনতিভরা সুরে মনোরমা বলেন—হ্যাঁগা, ননীর কোনো সন্ধান পেলে?
ইন্দুভূষণ একটা ঘাটে একদিন বসে আছে, সেখানে বিখ্যাত সিনেমা অভিনেত্রী সুরমার সঙ্গে তার আলাপ হয়। সুরমা ও তার দলবল পল্লীগ্রামের দৃশ্য তুলতে এসেছিল। ওর সাহায্য চাইলে। সেই সূত্রে সুরমার সঙ্গে প্রথম আলাপ।
সুরমা ওকে কলকাতায় গিয়ে দেখা করতে বললে বারবার—আসবেন তো? ঠিক বলুন?—বালিগঞ্জের একটা ঠিকানা দিলে। সেখানে ইন্দুভূষণ দেখা করতে গেল এবং প্রথম পদার্পণের দিনই সুরমার জালে আবদ্ধ হোল। সুরমা সুন্দরী সুগায়িকা; ইন্দুভূষণ তরুণ ও সুদর্শন। দু-জনই দু-জনের প্রতি আকৃষ্ট হোল। সুরমা বার বার আসতে বললে ওকে, জানলায় দাঁড়িয়ে রইল।
বাড়ি এসে ইন্দুভূষণ মনমরা, উদাস হয়ে রইল। সুরমার চিঠি এল—একবার অতি শীঘ্র যেতে বলেচে।
সে গেল আবার। সুরমা ওকে খুব আদর আপ্যায়ন করলে। নিজের হাতের তৈরি সন্দেশ খাওয়ায়। গান শোনায়। শেষে সুরমা বলে—অনেক রাত হয়েচে, কোথায় যাবেন আজ? এখানেই থাকুন। কোনো অসুবিধে হবে না। দু-জনে সারারাত গল্প করি আসুন। সত্যি কথা বলতে কি আপনাকে বড় ভাল লাগে।
ইন্দুভূষণ রইল না। সুরমা বার বার বলে দিলে—সামনের শনিবারে আমার জন্মদিন। নেমন্তন্ন রইলো আপনার। কথা দিন আসবেন?
গেল ইন্দুভূষণ জন্মদিনের উৎসবে। গান, আহার-বিহার। আরো কয়েকটি অভিনেত্রী নিমন্ত্রিতা। তারা ওদের দু-জনের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে অভ্যর্থনা করে। সেদিন সুরমা ইন্দুভূষণকে বাড়ি যেতে দেয় না। ছাদে বসে দু-জনে গল্প করে।
সুরমা ও ইন্দুভূষণ মোটরে যায়, নারাণ মাস্টার পথ দিয়ে যান। তিনি কলকাতায় এসেছিলেন ছেলের সন্ধানে, মনোরমার মিনতিতে। সারাদিন নানাস্থানে ঘুরেচেন সন্ধান করে, কোথাও সন্ধান পান নি। সামান্য পয়সা হাতে, পেট ভরে জলখাবারও খেতে পারেন নি। ভবানীপুরে বকুল বাগান রোডের মোড়ে গাড়িখানা হঠাৎ বেগে সামনে এসে দাঁড়ালো। নারাণ মাস্টার থমকে দাঁড়ালেন। কাদাজল জমেছিল রাস্তার এক জায়গায়, ছিটকে তাঁর গায়ে লাগলো। নারাণবাবু চেয়ে দেখলেন ইন্দুভূষণ ও একটি সুবেশা তরুণী গাড়িতে বসে। পাশের একটি লোক বলে উঠলো—রগড় দেখলেন মশাই? চিনেচেন তো?
নারাণ মাস্টার পাড়াগাঁয়ে মানুষ। তিনি কি করে চিনবেন।
—চিনলেন না? সুরমা দেবী?
—সে কে?
—কোথায় বাড়ি আপনার? সুরমা দেবী বিখ্যাত চিত্রতারকা—নামও শোনেন নি? এঃ আপনার কাপড়খানা একেবারে নষ্ট করে দিয়েচে যে!
নারাণবাবু চিনতে পারলেন। সরল মানুষ, জিনিসটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে গেলেন। একজন চিত্র অভিনেত্রীর সঙ্গে ইন্দুভূষণ কি করচে? ও কি কোনো ফিল্ম কোম্পানীতে কাজ নিল নাকি? কিন্তু তাঁর ছাত্র, অমন যত্নে গড়ে তোলা ছাত্র শেষে একটি অভিনেত্রীর সঙ্গে বেড়াবে এ ভাবে?
ইন্দুভূষণ চিনতে পেরেছিল নারাণ মাস্টারকে। সে চমকে উঠে, তার পর থেকে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
সুরমা বললে—আচ্ছা, হাজরার মোড়ে সেই যে এক পাড়াগেঁয়ে বুড়ো লোক আমাদের মোটরের সামনে পড়লো—ওমা, কি কাদাই লেগে গেল ওর গায়ে। ভাবলেও হাসি পায়—ব্রেক কষেছিল সময়ে। তাই খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছে, তার পর থেকেই তুমি অমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলে কেন? আর ভাল করে কথা কইচ না? চেন নাকি ও বুড়োকে?
ইন্দুভূষণ চুপ করে থেকে বললে—আচ্ছা, তোমার আবার যত কথা। ইয়ে, আমি তোমার সঙ্গে এখন আর যাবো না সুরমা।
—কেন?
—আমায় একটু নামিয়ে দাও। একটু কাজ আছে।
—কোথায় যাবে?
—সে বলবো এখন। তুমি যাও আমি নামি।
অনেকক্ষণ ধরে খুঁজলে ইন্দুভূষণ নারাণ মাস্টারকে। এদিক ওদিক। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে একটা পার্কে এসে ক্লান্ত হয়ে বসলো। নিজেকে কোথায় যেন অপরাধী বলে মনে হোতে লাগলো—নিজের কাছেই নিজেকে। না, সে সুরমার কাছে আর যাবে না। বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে যাবে আজই।
এইখানে একটু পরে প্রীতি ওকে দেখতে পেলে সামনের জানলা থেকে। সেটা প্রীতিদের বাসা। একটি ছোট ছেলে এসে ওকে ডাকলে। ইন্দুভূষণ দ্বিধাজড়িত পদে অপরিচিত দ্বারদেশে গিয়ে দাঁড়াতেই দোর খুলে দাঁড়ালো প্রীতি হাসিমুখে।
—ইন্দু-দা।
—প্রীতি!
—এসো বাড়ির মধ্যে। কবে কলকাতায় এলে? কি করচো আজকাল? তুমি এসো বাড়ির মধ্যে।
—বাড়িতে আর কে আছেন?
—কেউ নেই। কেবল এক ননদ ও বৃদ্ধা খুড়শাশুড়ী। উনিও আসবেন এখুনি। তুমি এসো ইন্দু-দা।
—আমি যাবো না প্রীতি। একটু বিশেষ ব্যস্ত আছি। অন্য সময়ে এসে দেখা করবো।
—তা হবে না। এক পেয়ালা চা অন্ততঃ খেয়ে যেতেই হবে।
এই প্রীতিকে ভুলতেই সে সুরমার ফাঁদে পা দিয়েছিল। সেই প্রীতি আজ তার সামনে।
গ্রামের সম্বন্ধে অনেক কথা হোল। তারপর ইন্দুভূষণ বিদায় নিলে।
নিয়েই সোজা সুরমার ওখানে গিয়ে উঠলো সে।
মনোরমা ছেলের জন্যে ভেবে ভেবে শয্যা গ্রহণ করেচেন। নারাণ মাস্টার বাড়ি এলে তিনি উঠে স্বামীকে জল দেন হাত-পা ধোবার। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চা এনে চা করে খাওয়ান—কারণ ঘরে কিছুই নেই। মূর্তিমান দারিদ্র্য সংসারের প্রতি রন্ধ্রে তার পাশ বিস্তার করেচে। চাকরি নেই নারাণবাবুর। প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডের সব টাকা আদায় হয় নি।
মনোরমা করুণ মিনতির সুরে বলেন—হাঁগো, ননীর কোনো সন্ধান পেলে? নারাণবাবু কি জবাব দেবেন। কোনো সন্ধানই মেলে নি। সে কথা বলতেও কষ্ট হয়।
নারানবাবু কাছে বসে স্ত্রীকে বোঝান। ভগবানের নাম করো। সংসারে সব দুঃখ কষ্টকে যে জয় করতে পারে, সেই তো যথার্থ মানুষ। সংসার পরীক্ষার স্থল। এই মনে করে চলবে যে আমাদের সত্যকার স্বাধীনতাকে কেউ হরণ করতে পারে না।
হাতে পয়সা নেই। স্কুলে প্রভিডেণ্ট ফণ্ডের টাকা বাকি। স্কুলে যান নারাণবাবু। ছেলেরা সবাই ক্লাস থেকে বার হয়ে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে, উল্লাস প্রদর্শন করে। হেড মাস্টার সদয় ব্যবহার করেন। চেয়ারে বসিয়ে বলেন—আপনি শুনলাম কলকাতায় গিয়েছিলেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—ছেলেটির কোনো সন্ধান পেলেন?
—না।
—শুনলাম আপনার স্ত্রী অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছেন? আহা, তা তো হোতেই পারেন। I Offer my sympathy Naran Babu—কিন্তু কি করবেন বলুন। সবই তাঁর ইচ্ছা।
হেড মাস্টারের কথায় মাখন সুরের সঙ্গে দেখা করেন।
মাখন সুর বৈঠকখানায় বসে আছেন মো-সাহেব নিয়ে। নারাণবাবুকে তাঁরা বসতেও বলেন না। তিনি গিয়ে নমস্কার করে দাঁড়িয়েই থাকেন।
মাখনবাবু বললেন—এই যে আসুন মাস্টার মশাই—ভাল আছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। এক রকম চলে যাচ্চে।
—তারপরে কি মনে করে?
—আমার সেই প্রভিডেণ্ট ফণ্ডের টাকাটা অনেক দিন হয়ে গেল। সংসারে এখন বড় অভাব। টাকাটা আমার দেওয়ার ব্যবস্থা করুন দয়া করে।
—নিশ্চয়ই, সে টাকা দিতে হবে বই কি। আপনার ওপর স্কুল-লাইব্রেরির ভার ছিল, তার অনেকগুলো বই পাওয়া যাচ্ছে না। সেগুলো আপনি মীমাংসা করে দিয়ে টাকা নিয়ে যান।
—সে কি কথা? এতদিন তো হেড মাস্টার কিছু বলেন নি? আর আমার ওপর লাইব্রেরির চার্জও ছিল না। সে ছিল ক্ষেত্রবাবুর ওপর। আপনি হেড মাস্টারের সার্কুলার দেখবেন।
—আচ্ছা এখন যান। আমি বড় ব্যস্ত।
—আমার হাত খালি। বাড়িতে স্ত্রী অসুস্থ। ছেলেটিকে সন্ধান করতে গিয়ে খরচপত্র হয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বড্ড উপকার হোত এই সময় টাকাটা পেলে।
—সবই বুঝলাম। কিন্তু আমিও তো বেনিয়মে বেহিসেবে টাকা দিতে পারি নে? আমার এখন সময় নেই। এখন যান আপনি।
বাড়ি ফিরে এলেন নারাণ মাস্টার।
মনোরমার শরীর খারাপ। তার জন্যে কিছু ফল নিয়ে আসতে পারলেন না। এক দোকানে জোড়া সন্দেশ বিক্রি হচ্চে, চার আনা জোড়া, মনোরমা এসব খেতে পান না, গরীবের ঘরের স্ত্রী। বড় ইচ্ছে হোল ঐ জোড়া সন্দেশ একখানা নেবেন। কিন্তু পয়সায় না কুলোনোতে, শুধু হাতে চলে আসেন।
মনোরমা আগে আগে এসে আগ্রহপূর্ণ ভাবে বাজারের থলি খুলে দেখতেন—জিগ্যেস করতেন—কি আনলে দেখি? আজ তিনি নিরুৎসাহ, মনমরা উদাস। নারাণবাবু দেখে ব্যথিত হয়ে ওঠেন।
বাইরে ছেলেরা এসে ঠিক ডাকে প্রতিদিনের মত। এখন আবার অন্য ছেলেদের নক্ষত্র বোঝান। ভাবেন ইন্দুভূষণের গাড়ির চাকায় সেদিন কাদা ছিটকে লাগার দৃশ্য, সঙ্গে অভিনেত্রী শ্রেণীর একটি মেয়ে। দুঃখ হয় তাঁর।
সুরমাকে নক্ষত্র চেনাচ্ছে ইন্দুভূষণ। ছাদের ওপর অন্ধকার। তারা ভরা আকাশ।
সুরমা বললে—এই সব শিখে কি হবে? তার চেয়ে চলো—
জানো আমার এক মাস্টার মশাই ছিলেন। তিনি আমার ছেলেবেলায় আমায় এসব চিনিয়ে ছিলেন। তিনি বলতেন, মানুযের দৃষ্টি যত প্রসারতা লাভ করবে, ততই সে অমরত্বের সম্মুখীন হবে। মানুষ বড় কিসে? এই বৃহতের সন্ধান—ভূমার সন্ধান সে পেয়েছে বলে—আমার গুরুর এই উপদেশ।
—তোমার গুরু কে? কোথায় থাকেন?
—তুমি তাঁকে দেখেচ।
—দেখেচি কোথায়?
—সে বলবো না।
—একদিন তাঁকে এখানে আনবে?
—আসবেন না তিনি। জীবনে বৃহতের সন্ধান তিনিই আমায় দিয়েছিলেন, এতদিন তত বুঝতে পারি নি। কিন্তু আজকাল যেন বেশি করে বুঝচি সুরমা।
সুরমার বিলাসিনী পল্লবগ্রাহী মন এ উক্তির গভীরত্ব বুঝতে পারলে না।
সে বললে—চলো নিচে যাই—তোমাকে গান শোনাই। ঠাণ্ডা লাগচে। মাঝে মাঝে তোমার মুখ গম্ভীর দেখি কেন বলো তো। তোমার কি অভাব এখানে? কোনো অসুবিধার মধ্যে কি আমি রেখেচি তোমাকে? চলো!
সুরমার গানে কথায় ইন্দুভূষণ জীবনের গভীর তত্ত্ব আবার বিস্মৃত হোল।
মনোরমা শয্যাগত। পুত্রের বিচ্ছেদশোক-কাতরা মাতাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নারাণবাবু নিজেই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ঠিক সেই সময় টেলিগ্রাম এল আলিপুরের জেল হাজত থেকে। তাঁর ছেলে ননীমাধব চুরির চার্জে অভিযুক্ত হয়ে আলিপুরে আছে।
স্ত্রীকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নারাণ মাস্টার চলেন আলিপুরের দিকে। মনে পড়লো তাঁর একটি পুরনো গান—
কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া
বাহির হনু তিমির রাতে
তরণীখানি বাহিয়া
অরুণ আজি উঠেছে
অশোক আজি ফুটেছে
না যদি উঠে, না যদি ফুটে
তবুও আমি চলিব ছুটে
তোমার মুখে চাহিয়া।
আলিপুরের জেল হাজতে ছেলের সঙ্গে দেখা হোল। ওখানে গিয়ে শুনলেন তার ছ-মাস জেলের আদেশ হয়েচে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলে সবাই। নারাণ মাস্টার গিয়ে দেখেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর পূর্ব পরিচিত মিঃ কান্ওয়ার!
খুব খাতির করলেন তিনি। বললেন, তিনি জানেন না যে আসামী তাঁর ছেলে। খুব বিস্ময় প্রকাশ করলেন এ কথা শুনে। কেন এমন হোল?
নারাণ মাস্টার চুপ করে থাকেন। পরে নারাণবাবু সব বললেন।
দুঃখ করে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন—আমি জানি, এরকমই হয়। পণ্ডিতের বংশে পণ্ডিত ও সৎ ছেলে জন্মগ্রহণ করলে তো পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যেতো।
আচ্ছা আমি চলি, বললেন নারাণবাবু।
মিঃ কান্ওয়ার বললেন—আপনি আমাকে Rural Bengal চিনিয়েছিলেন। প্রকৃত বাংলা দেশ কি তা আমাকে চিনিয়েছিলেন আপনি। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আমি যদি জানতাম আসামী আপনার ছেলে, তাহোলে ওকে কনভিকশন দিতাম না। বড়ই দুঃখিত আমি যে আমার অজ্ঞাতসারে আপনার ছেলের জেল হোল। আমার বাসায় যাবেন না! আমার স্ত্রী আপনাকে দেখলে বড় খুসী হবেন।
—এখন আমার সময় হবে না মিঃ কান্ওয়ার। আমার স্ত্রী পুত্রের শোকে শয্যাগত। একা ফেলে রেখে এসেচি। আমায় আজই ফিরতে হবে।
—Really, I am so sorry। আপনার মত ভাল লোকেরা সংসারে কষ্ট ভোগ করে কেন বলতে পারেন মিঃ গাঙ্গুলী? আপনি তো একজন দার্শনিক।
—কর্মফল।
—আমার কি মনে হয় জানেন, বেশি দুঃখ সহনের মধ্যে প্রভিডেন্স আপনাদের শেষ মালিন্যটুকু পুড়িয়ে খাঁটি নিষ্পাপ করে নিচ্ছেন। গেটের ফাউস্টের সেই লাইন স্মরণ করুন—একদিন আসবেন, আপনার সঙ্গে বসে আমার বাংলোতে কথাবার্তা বলা যাবে। Good bye।
নারাণবাবু বাড়ি এলেন।
মনোরমা সাগ্রহে জিগ্যেস করেন—হ্যাঁ গা, ছেলে কেমন আছে? তাকে দেখলে?
—দেখলাম ভালো আছে—
—তাকে আনলে না কেন? ঠিক বলো—তোমার মুখ দেখে আমার ভালো মনে হচ্চে না—সে আছে তো?
—নিশ্চয়ই আছে—আমার কথা বিশ্বাস কর।
—হ্যাঁগো, তবে তাকে আনলে না কেন? আমার বুকের এইখানটাতে হাত দিয়ে দ্যাখো। আমি থাকতে পারচি নে।
নারাণবাবু কিন্তু মুখ বুজে শুয়ে পড়ে থাকেন।
অসুস্থ স্ত্রীকে নারাণবাবু সত্যকথা বলতে পারেন না। নিজে সেবা করেন স্ত্রীর। স্ত্রী সেই অবস্থায় উঠে নিজে চা করে দিতে যান স্বামীকে। নারাণবাবু বাধা দেন।
একখানি চিঠি এল, ছেলে জেলের মধ্যে মনের ঘৃণায় আত্মহত্যা করেচে।
মিঃ কান্ওয়ার দুঃখ করে পত্র লিখেচেন।
নারাণবাবু গেলেন, পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিলেন। মুখাগ্নি করলেন।
বাড়ি ফিরে এলে মনোরমা ব্যস্তভাবে বলেন—ওগো, খোকা আমার কাছে রাত্রে এসেছিল। তুমি কোথায় গিয়েছিলে? বলো না? সত্যি করে বলো না? কথা বলো না কেন? কি হয়েছে? প্রায় মিনতির সুরে বলেন—হ্যাঁগা বলো না আমায়? বলো না সে কেমন আছে?
নারাণবাবু রোগশয্যাগত স্ত্রীকে নিজে বার্লি করে খাওয়ান।
—দাঁড়াও, আমি নিজে উঠে তোমায় চা করে দি—
—উঠো না। উঠো না। শুয়ে থাকো।
—হ্যাঁগা, ননী কেমন আছে? খোকা কেমন আছে? বলো না—
—ভালো আছে। তার চিঠি পেয়েচি। সে বাড়ি আসবে। এই দ্যাখো চিঠি। কান্ওয়ারের ইংরিজি চিঠিখানা নারাণ মাস্টার স্ত্রীর সামনে মেলে ধরেন।
সন্ধ্যা হয়ে এল।
বাইরে থেকে ছেলেরা এসে হাঁক দেয়—স্যার, বাড়ি আছেন?
নারাণবাবু স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে ছেলে পড়াতে যান বাইরে কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, তিনি একদল গ্রাম্য বালকদের মধ্যে বসে ভূগোল ব্যাখ্যা করচেন—
পৃথিবীর এক ভাগ স্থল, তিন ভাগ জল—