অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: সাত
অধ্যায় সাত
সেঞ্চুরি—৬
সূচি :
১। কবিতা—৭ : হিটলার ও মুসোলিনী।
২। কবিতা—২১ : এইডস রোগ।
৩। কবিতা—৫ : এইডস রোগের ওষুধ।
৪। কবিতা—২৩ : ফরাসি বিপ্লব।
৫। কবিতা—৪৯ : স্বস্তিক চিহ্ন।

কবিতা—৭ (সেঃ—৬)
Norneigre & Dace, & l'isle Britannique,
Par les unis freres seront vexees :
Le chef Romain issue de sang Gallique,
Et les copies au forestz repoulsees.
অর্থ :
অবস্থার অবনতি হবে নরওয়ে, ডাসিয়া ও ব্রিটেনের,
এই দুই সম্মিলিত ভাইয়ের জন্য :
এই রোমান নেতা, যার জন্ম আসলে ফ্রান্সে,
বিপক্ষ সৈন্যদের পিছু হটিয়ে ঢুকিয়ে দেবেন অরণ্যে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : হিটলার ও মুসোলিনী
এরিকা চিটহ্যামে’র মতে, এখানে যে দুই ভাইয়ের কথা বলতে চাওয়া হয়েছে, বাস্তবে তাঁরা ভাই-ই নন। আসলে এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে হিটলার আর মুসোলিনী’র কথা। তাঁদের সম্মিলিত শক্তির জন্য যে সব জায়গার অবস্থার অবনতি হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল নরওয়ে, ডাসিয়া (রুমানিয়া) ও ব্রিটেন। আর চতুর্থ লাইনে যে ‘বিপক্ষ সৈন্যদের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে তাঁদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জন-আন্দোলন। সে আন্দোলনকে তাঁরা পিছু হটাতে পেরেছিলেন।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
এই ব্যাখ্যার সবচেয়ে বড় খুঁতই হচ্ছে তৃতীয় লাইনটা—“এই রোমান নেতা, যার জন্ম আসলে ফ্রান্সে”, যেটাকে সাবধানে এড়িয়ে গেছেন এরিকা। হিটলার বা মুসোলিনী, কেউই রোমান নেতা ছিলেন না, ফ্রান্সেও জন্মাননি। নস্ট্রাডামুস এই কবিতাতে স্পষ্টতই দুই ভাই, অর্থাৎ সহোদরের কথা বলতে চেয়েছেন। হিটলার-মুসোলিনী মোটেই ভাই ছিলেন না। এরিকা তাঁর ছলচাতুরির দ্বারা আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, এখানে 'ভাই' কথাটা ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু যুক্তিবাদী হিসেবে আমরা তা মেনে নিতে পারি না।
একইভাবে এরিকা আমাদের মধ্যে ‘বিপক্ষ সৈন্য’, আর ‘বিরোধী জন-আন্দোলন' শব্দের মানে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। ‘অরণ্য’টা তাহলে কী?—এ প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না।
অতএব, দেখা যাচ্ছে এ কবিতাতেও এরিকার ব্যাখ্যা মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি।
কবিতা—২১ (সেঃ—৬)
Quant ceux du polle artiq unis ensemble,
En Orient grand effrayeur & crainte :
Eslun nauveae, soustenu le grand tremble,
Rhodes, Bisance de sang Barbare taincte.
এর মানে :
যখন উত্তরমেরুর মানুষরা এক হবে,
তখন পূর্বে ছড়াবে ভয় আর বিভীষিকা :
নতুন একজন নির্বাচিত হবেন, তাকে সমর্থন
করবেন ভীতসন্ত্রস্ত আর এক ব্যক্তি,
রোডস ও বাইজানটিয়ামে ছড়িয়ে পড়বে ইতরদের রক্ত।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : এইডস রোগ
এরিকার নতুন বই “THE FINAL PROPHECIES OF NOSTRADAMUS”-এ তিনি লিখেছেন যে, এ কবিতা বলতে চাইছে 'এইডস' রোগের কথা। প্রথম দুটো লাইনের দ্বারা বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে এইড্স্ রোগের বিরুদ্ধে উত্তর মেরুর সমস্ত মানুষ একত্রিত হবেন; ‘এইডস'-এর বিভীষিকার ভয়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের ব্যাখ্যা নেই!
এরিকা আরও বলেছেন যে, এই কবিতাটির সঙ্গে এই সেঞ্চুরিরই কবিতা—৫ কে মিলিয়ে পড়তে হবে। কেননা কবিতা—৬এর সঙ্গে এই কবিতার বেশ মিল আছে। দেখা যাক কবিতা পাঁচ-এ কী বলা হয়েছে :
কবিতা—৫ (সেঃ—৬)
Si grand famine par unde pestifere,
Par pluie longue le long du polle arctique,
Samarobrin cent lieux de l’hemisphere,
Vivront sans loi exempt de pollitique.
অর্থাৎ :
মস্ত দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে প্লেগ রোগের পর,
ছড়াবে গোটা উত্তর মেরুতে,
সামারোর্বিন, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে একশো লীগ[১] দূরে
তারা আইনমান্য করবে না, অবসর নেবে রাজনীতি থেকে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : এইডস রোগের ওষুধ
চিটহ্যাম মনে করেন, এই কবিতাতে এইডস রোগের ওষুধের হদিশ দেওয়া আছে। তাঁর মতে, নস্ট্রাডামুস যাকে প্লেগ রোগ বলেছেন, সেটা আসলে এইডস। এইডস ছড়াবে গোটা উত্তর মেরুতে।
তৃতীয় লাইনে যে ‘সামারোবিন'-এর কথা বলা হয়েছে, সেইটাই হয়তো এইডস-এর ওষুধের নাম। এবং এই ওষুধ হয়তো তৈরি হবে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে দূরে, কোনো মহাকাশে ভাসমান ল্যাবরেটরিতে।
চতুর্থ লাইনের ব্যাখ্যা নেই।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ (কবিতা—২১, এবং ৫ এর) :
এরিকা এইডস’-এর ওপরই এত জোর দিলেন কেন বুঝলাম না। কবিতা—২১-এ তো কোথাও কোনো রোগ ছড়াবার কথা লেখা নেই? কবিতা—৫-এ প্লেগ রোগের উল্লেখ আছে; কিন্তু প্লেগ আর এইডস-এ তো আসমান-জমিন ফারাক! এরিকা তাঁর বইতে সময়োপযোগী তথ্য ঢোকানোর ইচ্ছায় এই ‘প্লেগ’কে ‘এইডস’ বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাহলে কবিতা—২১-এর তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের ব্যাখ্যা কী? কবিতা—৫-এর চতুর্থ লাইনের ব্যাখ্যা কী?
সত্যি বলতে কি, কবিতা—২১-এর সঙ্গে এইডস-এর কোনো যোগাযোগই খুঁজে পাচ্ছি না। আপনারা কবিতাটা আবার পড়ে দেখুন তো, কোনো যোগাযোগ পান কি না এইডস’-এর সঙ্গে?
কবিতা—৫-এর ‘প্লেগ’ ও ‘এইডস’ নিয়ে এইমাত্র আলোচনা করেছি। আর তৃতীয় লাইনটার সত্যতা যেহেতু এখনও যাচাই করার সময় আসেনি, সেহেতু আমরা অপেক্ষায় রইলাম। দেখা যাক, এইডস-এর ওষুধের নাম ‘সামারোর্বিন’ হয় নাকি, এবং তা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিনশো মাইল দূরে কোনও মহাকাশে-ভাসমান গবেষণাগারে আবিষ্কৃত হয় নাকি?
কবিতা—২৩ (সেঃ—৬)
D’esprit de regne munismes descriees,
Et seront peuples esmuez contre leur Roi:
Paix faict nouveau, sainctes loix empirees,
Rapis one fut en si tres dur arroi.
এর মানে দাঁড়ায় :
সরকারী প্রতিরোধ পড়বে ভেঙে,
দেশের মানুষ খেপে উঠবে রাজার বিরুদ্ধে :
নতুন করে শান্তি আসার পর আইনকানুন হয়ে যাবে আরও খারাপ,
রাপিসে আগে কখনও এমন অশান্তি ঘটেনি।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : ফরাসি বিপ্লব
চার লাইনের ছোট্ট ব্যাখ্যায় এরিকা ঘোষণা করেছেন যে, এই কবিতাতে ফরাসি-বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, প্রথম তিনটে লাইন ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। চতুর্থ লাইনে ‘রাপিস' বলে নস্ট্রাডামুস সম্ভবত ‘প্যারিস’, অর্থাৎ ফ্রান্সের নাম বলতে চেয়েছিলেন।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
খেয়াল করলেই দেখবেন, কবিতাটা এমনভাবে লেখা যে, এটা বহুদেশের বহু ঘটনার সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া যায়। অর্থাৎ কবিতাটা খুবই সার্বজনীন, ইংলিশে যাকে বলে ‘Very general’, কেননা, যে ঘটনা কবিতাতে বর্ণনা করা হয়েছে, এমন ঘটনা ইতিহাসে বহু ঘটে। নস্ট্রাডামুসের সময়েও ঘটত, এখনও ঘটে। রাজার বিরুদ্ধে প্রজার বিদ্রোহ; এমন উদাহরণ এত বেশি যে, বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তবু এরিকা কবিতাটার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট ঘটনা (এক্ষেত্রে ফরাসি-বিপ্লব)-র সঙ্গে জুড়ে দিলেন। প্রমাণ করার জন্য বোঝালেন যে, ‘রাপিস’ মানে আসলে ‘প্যারিস’। কেন তা হবে? নস্ট্রাডামুস নিজে ফ্রান্সে থাকতেন। ফ্রান্সকে বোঝাতে হলে ‘ফ্রান্স’ই লিখতেন। ‘রাপিস’ লিখতে যাবেন কেন? অতএব এরিকার যুক্তিটা ঠিক মানতে পারলাম না।
তৃতীয় লাইনের আলাদা করে ব্যাখ্যা করেননি এরিকা। জানতে ইচ্ছে হয়, তৃতীয় লাইনের ব্যাখ্যা কী, কেননা তৃতীয় লাইনটা কিন্তু ফরাসি-বিপ্লবের যুক্তিকে সমর্থন করছে না।
কবিতা—৪৯ (সেঃ—৬)
De la partie de Mammer grand Pontife,
Subjugera les confins du Danude :
Chasser les croix par fer raffe ne riffe,
Capitfz, or, bagues plus de cent mille rubes.
অনুবাদ করলে দাঁড়ায় :
মহান পোপ, বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে,
দখল নেবেন দানিয়ুব নদীর তীর
ক্রসের দায়িত্ব পেয়েছিলেন যেমন— তেমনভাবে,
পাবেন বন্দী, সোনা-গয়না, এবং একশোরও বেশি চুনি।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : স্বস্তিক-চিহ্ন
অবাক হয়ে যাচ্ছেন? ভাবছেন -এ কি রে বাবা? এই কবিতাতে আবার স্বস্তিক-চিহ্নের কথা কোথায়? আমিও তাই ভেবেছিলাম। এরিকা চিটহ্যাম কিন্তু মনে করেন যে, নস্ট্রাডামুস এ কবিতাতে হিটলার ও তাঁর স্বস্তিক চিহ্নেরই কথা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
ব্যাখ্যাতে পোপ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। থুড়ি, আছে। শুধু এইটুকুই বলা আছে যে, পোপ-এর স্থানটা এই কবিতাতে পরিষ্কার নয়।
এরিকা বলেছেন যে, হিটলারের বাহিনী দানিয়ুবের তীর দিয়ে গেছেন। তাঁরা ইহুদি বন্দিদের কাছ থেকে অনেক সোনা-গয়না কেড়েও নিয়েছিলেন। তৃতীয় লাইনটা একটু বুঝে নিতে হবে। ‘যেমন—তেমনভাবে’ কথাটা বলা হয়েছে কবিতার তৃতীয় লাইনে (raffe ne riffe)। ‘যেমন — তেমনভাবে’র আধুনিক ইংরেজি করলে বলা যায় ‘by hook or by crook’। এখানে ‘crook’ শব্দটা একটু পাল্টে দিলে হয় crooked, অর্থাৎ ‘বাঁকা’। এই লাইনেই আবার ‘ক্রস’ কথাটাও আছে। দুটো শব্দ যদি আমরা জুড়ে দিই, তাহলে পাই—বাঁকানো ক্রস। ক্রস হল + এইরকম। আর স্বস্তিক চিহ্ন হল এইরকম। অর্থাৎ বাঁকানো ক্রসই হল স্বস্তিক চিহ্ন। —এই ছিল শ্রীমতী চিটহ্যামের ব্যাখ্যা।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
কবিতাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে নস্ট্রাডামুস এমন কোনো পোপের ভবিষ্যদ্বাণী করতে চেয়েছিলেন, যিনি নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নানা অমানবিক কাজকর্ম করবেন। কিন্তু এমনটি আজ পর্যন্ত ঘটেনি। তাই এরিকা কবিতাটাকে মেলাবার চেষ্টা করেছেন অন্য ঘটনার সঙ্গে। হিটলার, তাঁর নাৎসিবাহিনী ও স্বস্তিক চিহ্ন, সে ব্যাখ্যা পড়ে আমারই মাথা ঝিমঝিম করেছে। এরিকার মনোবলের প্রশংসা করতেই হয়। বলতেই হয়, মগজধোলাইয়ের চেষ্টায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর চেষ্টার ঘাটতি নেই। ঘাটতি যতটুকুর, তা হল যুক্তির।
কিন্তু না, তৃতীয় লাইনের ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ করে আর আপনাদের বিরক্ত করব না। ওর বিশ্লেষণ আপনারাই করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
এরিকা কোন্ সেঞ্চুরির ক’টি করে কবিতা ব্যাখ্যা করেছেন
সেঞ্চুরি এক — ৭৪টি কবিতা
সেঞ্চুরি দুই — ৬৫টি কবিতা
সেঞ্চুরি তিন — ৬৮টি কবিতা
সেঞ্চুরি চার — ৫১টি কবিতা
সেঞ্চুরি পাঁচ — ৬১টি কবিতা
সেঞ্চুরি ছয় — ৪৬টি কবিতা
সেঞ্চুরি সাত — ১৯টি কবিতা
সেঞ্চুরি আট — ৫১টি কবিতা
সেঞ্চুরি নয় — ৩৭টি কবিতা
সেঞ্চুরি দশ — ৪৮টি কবিতা
অর্থাৎ এরিকা ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র ৫৫% কবিতা।
- ↑ লীগ : দূরত্বের মাপবিশেষ (প্রায় ৩ মাইল)