অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায় : তিন

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন

অধ্যায়: তিন


সাধুসন্তদের অলৌকিক ক্ষমতা

ব্রহ্মচারী বাবা

ছেলেবেলা থেকেই কোনও সাধুসন্তর খবর পেলেই তাঁর কাছে দৌড়ােই, সত্যি তাঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে কী না জানার ইচ্ছেয়। সালটা বােধহয় ১৯৬৪। আমার কলেজের বন্ধু বরাহনগরের শশিভূষণ নিয়ােগী গার্ডেন লেনের গােরাচাঁদ দত্ত একদিন বলল, ওদের পারিবারিক গুরুদেব এক ব্রহ্মচারী বাবার অলৌকিক ক্ষমতার কথা। ওদের গুরুদেবের নাম আমি আগেই শুনেছি। এও শুনেছি, ওঁর লক্ষ লক্ষ শিষ্য-শিষ্যা। বাংলা তথা ভারতে এই ব্রহ্মচারী বাবার নাম ‘বালক ব্রহ্মচারী’ বলে খুবই পরিচিত।

 গােরা আমাকে একদিন বলল, “তুই তাে অলৌকিক ক্ষমতার মানুষ খুঁজছিস, আমি কিন্তু নিজের চোখে আমার গুরুদেবকে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে দেখেছি। বরানগরের স্কুলে একবার গুরুদেবের জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা হয়েছে। অনুষ্ঠান সন্ধেতে। কিন্তু, বিকেল থেকেই হাজার হাজার লােকের ভিড়। বরানগরেও ওঁর প্রচুর শিষ্য-শিষ্যা। আমরা স্থানীয় কিছু তরুণ শিষ্য ভলান্টিয়ার হয়ে অনুষ্ঠান যাতে সুন্দরভাবে হয় তার দেখাশােনা করছি। বিকেলবেলাতেই এক ভদ্রলােক দশ-বারাে বছরের ছেলের হাত ধরে এসে হাজির হলেন। উনি আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কখন আসবেন?

 বললাম, সন্ধে নাগাদ।

 ভদ্রলােক বললেন, তিনি এসেছেন বহুদূর থেকে। শুনেছেন বাবার অপার অলৌকিক ক্ষমতা। এও শুনেছেন, বাবার কাছে কেউ দীক্ষা নিতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে দীক্ষার জপ-মন্ত্র দিয়ে দেন। অনেক আশা করে তার দুই বােবা-কালা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। বাবাকে বলবেন, এদের দুটিকে দীক্ষা দিতে। দেখতে চান, কেমন করে বােবা-কালারা জপ-মন্ত্র শোনে।

 “ভদ্রলােক ও তাঁর ছেলে দুটিকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে ওদের আগমনের উদ্দেশ্য ভলান্টিয়ার, চেনা, মুখ-চেনা, অনেকের কাছেই বলেছিল গােরা। খবরটা দাবানলের মতােই ছড়িয়ে পড়েছিল। সব ভক্ত প্রচণ্ড ঔৎসুক্য ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন—কী হয়? কী হয়? সত্যিই কি বাবার দেওয়া জপ-মন্ত্র ওরা শুনতে পাবে?

 সন্ধের আগেই হাজার-হাজার শিষ্য-শিষ্যা ও ভক্তেরা বারবার ভদ্রলােক ও তার দুই ছেলেকে কৌতূহলের চোখে দেখে গেল।

 শেষ পর্যন্ত সেই শুভ মুহূর্তটি এল। গুরুদেবের চরণে প্রণাম জানিয়ে ভদ্রলােক তাঁর দুই ছেলেকে দীক্ষা দিতে অনুরােধ করলেন। গুরুদেব ছেলেদুটিকে একে একে কাছে টেনে নিয়ে জপ-মন্ত্র দিয়ে বললেন, শুনতে পেয়েছিস তাে?

 হাজার হাজার ভক্ত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন এরপর কী হয় দেখার জন্য। ছেলে দুটি পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, শুনতে পেয়েছি।

 ঘটনার আকস্মিকতায় ভক্তেরা হৃদয়াবেগ সংযত করতে পারলেন না। অনেকেরই দু’চোখ বেয়ে নেমে এলাে জলের ধারা। স্কুলের হল-ঘর গুরুদেবের জয়ধ্বনিতে ভরে গেল। ভদ্রলােক লুটিয়ে পড়লেন গুরুদেবের পায়ে।”


 গােরার কাছে এই ঘটনা শােনার পর একদিন ওর সঙ্গে গেলাম গুরুদেব-বালক ব্রহ্মচারীর দর্শনে। কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় তখন তিনি থাকতেন। একতলার একটা হলের মতাে বিরাট ঘরে প্রচুর ভক্ত অপেক্ষা করছিলেন। আমি আর গােরাও ওই ঘরেই বসলাম। শুনলাম, গুরুদেব দোতলায় দর্শন দেন। সময় হলে আমাদের সকলকেই ডাকা হবে। ওখানে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে আলাপ করে ফেললাম। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ভারত-বিখাত শিক্ষাবেত্তা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি ওঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নিজে দেখেছেন?”

 উত্তরে উনি যা বললেন, তা খুবই বিস্ময়কর। উনি একবার গুরুদেবের কাছে খিদে পেয়েছে বলাতে গুরুদেব বললেন, “দাঁড়া, তাের খাবার আনার ব্যবস্থা করছি।” গুরুদেব ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন, একটা আলাে হয়ে গেলেন। তারপর আলাের ভেতর থেকে ভেসে এলাে সােনার থালায় সাজানাে নানা রকমের মিষ্টি। কী তার স্বাদ! কী তার গন্ধ! অপূর্ব! জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এ ঘটনার সময় আপনার সঙ্গে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন?”

 “না, শুধু আমিই ছিলাম।”

 একসময়ে আমাদের ডাক পড়ল। সকলের সঙ্গে ওপরে গেলাম। তলার ঘরটার মতােই একটা বড় ঘরে সিল্কের গেরুয়া পরে একটা বাঘছালের উপর বসে আছেন গুরুদেব। চারিদিকে পেলমেট থেকে দীর্ঘ ভারী পরদা ঝুলছে। ঘরে মৃদু আলাে। দেখলাম ভক্তেরা এক এক করে তাঁর কাছে গিয়ে প্রণাম করে নিচে চলে যাচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি। কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন মিষ্টির প্যাকেট। কেউ কেউ শিশি বা বােতলে জল নিয়ে এসেছেন। ওই জলে গুরুদেবের পায়ের বুড়াে আঙুল ডুবিয়ে পবিত্র পাদোদক করে নিচ্ছেন।

 ব্রহ্মচারীবাবার এক সেবক যিনি সমস্ত ব্যাপারটা তদারক করছিলেন। তিনি একসময় আমাকে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বললেন। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম জানিয়ে ব্রহ্মচারীবাবাকে বললাম, “শ্রদ্ধার থেকেই প্রণাম আসে। আমার একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে আপনার অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গেই প্রণাম করব।” ব্রহ্মচারীবাবা ইশারায় ঘরের কোনায় দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়ালাম। শিষ্যদের প্রণাম শেষ হতে ব্রহ্মচারী আমার দিকে তাকালেন। আমার পাশে ছিল গােরা ও সেবক ভদ্রলােক। বালক ব্রহ্মচারী আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “তাের প্রশ্নটা কী?” মুখে একটা রহস্যের হাসি।

 বললাম, “আমি গতকাল সন্ধে সাতটার সময় কোথায় ছিলাম?”

 ব্রহ্মচারী এবার গােরাকে বললেন, “ও বুঝি তাের বন্ধু? তা, তুই নিচে গিয়ে বােস। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলব।”

 গােরা বেরিয়ে যেতেই সেবকটিকে বললেন, “তুই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যা। কেউ যেন আমার কাছে এখন না আসে।”

 সেবকটি চলে যেতে ব্রহ্মচারীবাবা আমার সঙ্গে নানা রকম গল্পসল্প করলেন। আমার বাড়ির খবরাখবর নিলেন। এরই মধ্যে এক সময় সেবকটি দরজা খুলে জানাল, “দুই ভদ্রলােক এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এসেছেন। মহিলাটির গল-ব্লাডারে স্টোন হয়েছে। আজই নার্সিংহােমে অপারেশন করার কথা। আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছেন।”

 ব্রহ্মচারী বললেন, “অপেক্ষা করতে বল, দেরি হবে।”

 আমরা আবার আমাদের গল্পে ফিরে গেলাম। সময় কাটতে লাগল, এক সময় আবার সেবকটি ঘরে ঢুকে বলল, “গুরুদেব পেশেন্ট যন্ত্রণায় ছটফট করছে। যদি অনুমতি করেন তাে—”

 বিরক্ত গুরুদেব বললেন, “যা নিয়ে আয়।”

 একটু পরেই দুই ভদ্রলােকের সাহায্যে সেবকটি এক মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মহিলাটির মুখের চেহারায় তীব্র যন্ত্রণার চাপ। মহিলাটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের ভঙ্গিতে গুরুদেবের পায়ের কাছে শুইয়ে দেওয়া হলাে। গুরুদেব সঙ্গে লােকদুটিকে বললেন, “তােরা নীচে গিয়ে বােস।” সেবকটিকে বললেন, “যা কুশিতে করে একটু জল নিয়ে আয়।”

 সেবক কুশিতে জল নিয়ে এলেন। তারপর তিনিও গুরুদেবের আদেশে বেরিয়ে গেলেন।

 ব্রহ্মচারী কুশিটি মহিলাটির পিঠের উপর বসিয়ে তিরিশ সেকেন্ডের মতাে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়লেন ও কুশির জলে বারকয়েক ফুল ছিঁড়ে পাপড়ি ছুঁড়লেন। তারপর আমাকে বললেন, “দেখ তাে, জলটা গরম হয়েছে কি না?”

 কুশির জলে হাত দিলাম, গরম। বললাম, “গরম হয়েছে।”

 ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “এবার কুশিটা পিঠ থেকে নামিয়ে ওকে তুলে দাঁড় করা।” করলাম। গুরুদেব আদেশ দিলেন, “এবার ওকে জোর করে দৌড় করা।”

বালক ব্রহ্মচারী

 তাই করলাম, মহিলাটি, “পারব না, পারব না,” করে ভেঙে পড়তে পড়তেও আমার জন্য দৌড়তে বাধ্য হলেন। এবং তারপর দৌড়ে গুরুদেবের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে বললেন, “বাবা, আমি ভাল হয়ে গেছি।”

 গুরুদেব হাসলেন। বললেন, “যা নার্সিংহােমে যেতে হবে না, বাড়ি ফিরে যা।”

 মহিলাটি নিজেই হেঁটে চলে গেলেন। ব্রহ্মচারী এবার আমাকে বললেন, “তুই মাঝে মাঝে এখানে এলে এমনি আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবি। এবার আমাতে বিশ্বাস জন্মেছে তাে তাের?”

 বললাম, “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। তা পেলেই আমার বিশ্বাস জন্মাবে।”

জাদুকররা যেমন দর্শকদের মধ্যে নিজেদের লােক রেখে
সাজানাে ঘটনা দেখিয়ে দর্শকদের অবাক করে
দেন, অনেক গুরুদেবই চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি
হলে এই ধরনের নানা রকমের সাজানাে
ঘটনার অবতারণা করেন।

 গুরুদেব যা দেখালেন সেটা সাজানাে ব্যাপার হতে পারে।

 কুশির জল মন্ত্র পড়ে গরম করার ঘটনাটির পিছনেও ধাপ্পাবাজি থাকা সম্ভব। ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “দেখ তাে কুশির জলটা গরম হয়েছে কিনা?” আমি দেখেছিলাম গরম। এমনও তাে হতে পারে, গরম জল এনেই রােগিণীর পিঠে রাখা হয়েছিল।

 ব্রহ্মচারীবাবা আমাকে বললেন, “যা, দরজাটা ভেজিয়ে দে। তাের সঙ্গে আর কিছু কথা আছে।”

 আদেশ পালন করলাম। ব্রহ্মচারীবাবা নিজেই উঠে গিয়ে দেওয়াল-আলমারি খুলে একটা রাইটিং প্যাড ও পেনসিল নিয়ে এলেন। প্যাড আর পেনসিলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “আমাকে না দেখিয়ে এতে লেখ, কাল সন্ধের সময় কোথায় ছিলি।”

 লিখলাম, মধ্যমগ্রামে; বিপুলদের বাড়িতে।

 ব্রহ্মচারীবাবা বললেন, “প্যাডের কাগজটা ছিঁড়ে তাের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখ।”

 ধরে রাখলাম, তবে শক্ত করে নয়, আলতাে করে। ব্রহ্মচারীবাবা আমার হাত থেকে প্যাডটা নিলেন। তারপর তাঁর মুখােমুখি আমাকে বসালেন। আমাকে চোখ বুজে এক মনে সমুদ্রে সূর্যোদয়ের দৃশ্য ভাবতে বললেন। আমি ভাবতে লাগলাম।

 আমার কপালটা কিছুক্ষণ ছুঁয়ে থেকে গুরুদেব বললেন, “দেখতে পাচ্ছি তুই গিয়েছিলি একটা গ্রাম-গ্রাম জায়গায়। জায়গাটা মধ্যমগ্রাম। বাড়িটাও দেখতে পাচ্ছি। ঠাণ্ডা, শান্ত, বড় সুন্দর পরিবেশ।”

 বললাম, “সত্যিই সুন্দর। মুলিবাঁশের দেওয়াল, মাটির মেঝে, টালির চাল, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা আর শান্ত পরিবেশ।”

 গুরুদেব বললেন, “হ্যাঁ, তাই দেখতে পাচ্ছি। একটা লাউ না কুমড়াে গাছ যেন ওদের বাঁশের দেওয়াল বেয়ে উঠেছে।”

 আরও অনেক কিছুই বলে গেলেন উনি। কিন্তু ততক্ষণে গােরার গুরুর দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে। কারণ, গতকাল সন্ধে ছ’টা থেকে আটটা পর্যন্ত ছিলাম কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। জাদুকররা অনেক সময় কার্বন পেস্টেড কাগজের প্যাডে দর্শকদের দিয়ে কোন কিছু লিখিয়ে তলার কাগজে কার্বনের ছাপে কী উঠেছে দেখে বলে দেন কী লেখা হয়েছিল। অনেক সময় সাধারণ প্যাডে হার্ড পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখিয়ে তলার পাতাটায় পেন্সিলের সীসের গুঁড়াে ঘষেও বলে দেওয়া হয়, কী লেখা হয়েছিল। আমি কফি হাউসে থেকেও ইচ্ছে করে লিখেছিলাম মধ্যমগ্রামে; বিপুলদের বাড়িতে। অলৌকিক ক্ষমতার বদলে কৌশলের আশ্রয় নিতে গেলে গুরুদেব ভুল করতে বাধ্য। আর ভুল করতে বাধ্য হলেনও। আমি সামান্য একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে বিপুলদের বাড়ির যে ধরনের বর্ণনা দিলাম গুরুদেবও সেই বর্ণনাতেই সায় দিয়ে গেলেন। অথচ বিপুলদের বাড়ি দস্তুরমতাে পেল্লাই পাকা বাড়ি।


বিখ্যাত মহারাজের শূন্যে ভাসা

 আমি তখন দমদম পার্ক-এ থাকি। ভারতবিখ্যাত এক সাধক মহারাজের শিষ্য ছিলেন আমার এক প্রতিবেশী। তাঁর কাছে অনেকদিনই তাঁর গুরুদেবের অনেক অলৌকিক কাহিনি শুনেছি। দেশে-বিদেশে সাধক-মহারাজের প্রচুর নাম, প্রচুর ভক্ত। তাই, বিভিন্ন ভক্তদের সন্তুষ্ট করতে কোন জায়গাতেই একনাগাড়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না। আমার প্রতিবেশী ভদ্রলােককে ধরলাম, এইবার মহারাজ কলকাতায় এলে তাঁকে দর্শনের ব্যবস্থা করে দেবেন। সেইসঙ্গে দয়া করে এমন ব্যবস্থা করে দেবেন যাতে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়।

 প্রতিবেশী জানতেন, আমি সাধু-সন্তদের কাছে যাই। তাই, ভক্তজন অনুমান করে আমাকে ভরসা দিলেন মহারাজ কলকাতায় এলেই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।

 একদিন বহু প্রতীক্ষিত সেই সুযােগ পেলাম। প্রতিবেশী ভদ্রলােকের সঙ্গে গেলাম সেই বিখ্যাত মহারাজ দর্শনে। গুরুদেব তাঁর কিছু নিকটতম শিষ্যদের নিয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ কলকাতারই এক প্রাসাদে। একদিন প্রতিবেশী বললেন, আজ আমাকে গুরুদেবের অলৌকিক ধ্যান দর্শন করাবেন। এই দৃশ্য সব শিষ্যরাও দেখার সুযােগ পান না। সেইদিক থেকে আমি মহাভাগ্যবান। ধ্যানের সময় মহারাজের শরীর মেঝে থেকে হাতখানেক উঁচুতে শূন্যে ভেসে থাকে।

 নির্দিষ্ট সময়ে ধ্যান-কক্ষের বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। কক্ষের দরজা তখনও বন্ধ। ভিতর থেকে ধূপের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে।

 একসময় প্রতীক্ষার অবসান হলাে; একজন শিষ্য কক্ষের ভারী দরজাটা একটু একটু করে খুলে দিলেন। আমাদের বারান্দার আলাে নিভে গেল। ভিতরটা জ্যোৎস্নার মতাে নরম আলােয় ভেসে যাচ্ছে। শান্তদর্শন গুরুদেব নিমীলিত চোখে পদ্মাসনে স্থির। তিনি বসে আছেন শূন্যে, মাটি থেকে প্রায় দেড় ফুট উঁচুতে। তাঁর পিছনে গাঢ় রঙের ভারী ভেলভেটের পরদা।

 বেরিয়ে এলাম চুপচাপ। অলৌকিক কিছুই দেখতে পেলাম না। ভারত বিখ্যাত মহারাজ যা দেখালেন, ম্যাজিকের পরিভাষায় তাকে বলে ‘ব্ল্যাক আর্ট’। গুরুদেবের পিছনের এই গাঢ় রঙের পরদাটাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল—

সাধক মহারাজের এই ধ্যানে শূন্যে ভেসে থাকার পিছনে কোন
অলৌকিকত্ব নেই। এটা স্রেফ ব্ল্যাক-আর্টের খেলা। এই ব্ল্যাকআর্ট-এর
সাহায্যে জাদুকরেরা কোনও রমণীকে শূন্যে
ভাসিয়ে রাখেন, হাতিকে করেন অদৃশ্য,
আবার শূন্য থেকে আমদানী
করেন জিপগাড়ি।

 ব্ল্যাক আর্টের আবিষ্কারক ম্যাক্স আউজিঙ্গার (Max Auzinger)। জার্মানির নাগরিক এই ভদ্রলােক পেশায় নাট্য পরিচালক। তাঁর ব্ল্যাক-আর্ট পদ্ধতি আবিষ্কারের কাহিনি দারুণ মজার।

 তাঁর পরিচালিত একটা নাটকের প্রথম অভিনয় রজনী। বিশেষ এক উত্তেজক দৃশ্য তখন অভিনীত হচ্ছে। পিতা অবাধ্য কন্যাকে একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। অন্ধকার ঘরটার ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে পরিচালক ম্যাক্স মঞ্চের

চ্যাং লিং সু ছদ্মনামের আড়ালে উইলিয়াম এলওয়ার্থ রবিনসন

তিন দিকের দেওয়াল কালো মখমলের পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। মেয়েটিকে উদ্ধার করতে ওপরের গবাক্ষ দিয়ে নেমে এলো এক টেলিফোন-কালো নিগ্রো ক্রীতদাস। নায়িকার এমন নাটকীয় মুক্তিক্ষণে দর্শকদের উত্তেজনায় ও হাততালিতে ফেটে পড়ার কথা। কিন্তু কই? দর্শকদের মধ্যে ঘটনায় কোনও প্রতিফলন তো নেই? ব্যাপারটা বুঝতে ম্যাক্স দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে এলেন দর্শকদের কাছে। এবার মঞ্চের দিকে তাকাতেই কারণটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। স্বল্পালোকিত মঞ্চে কালো নিগ্রো ক্রীতদাস কালো মখমলের পরদার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে, ওকে দেখাই যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্স-এর মাথায় এলো ব্ল্যাক-আর্টের মূল তত্ত্ব। গাঢ় রঙের পর্দা টাঙিয়ে সেই ধরনের গাঢ় রঙের যে কোন কিছু সামনে রাখলে তা দেখা যায় না। এই একই নিয়মে গাঢ় রঙের পর্দার সামনে গাঢ় রঙের একটা দেড়ফুট উঁচু আসনে বসে থাকা গুরুদেবকেও ভক্তরা শূন্যে ভাসমান দেখেন।

 প্রায় একই সঙ্গে ব্ল্যাক-আর্টের খেলা দর্শকদের সামনে হাজির করেন মার্কিন জাদুকর উইলিয়াম এলস্‌ওয়ার্থ রবিনসন (William ellsworth Robinson), যিনি চিনা ছদ্মবেশে চ্যাং লিং সু নামেই জাদুর জগতে পরিচিত এবং বরেণ্য হয়েছিলেন।

ব্ল্যাক আর্ট ছাড়া সাধিকার শূন্যে ভাসা

 শারদীয় পরিবর্তন ১৩৯১-তে (১৯৮৫ সাল) একটি প্রবন্ধে ব্ল্যাক-আর্টের সাহায্যে শূন্যে ভেসে থাকা সেই মহারাজের কাহিনিটি লিখেছিলাম। কলকাতারই জনৈকা ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু উষ্মার সঙ্গে পরিবর্তনে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে

ব্ল্যাক-আর্টের সাহায্যে শূন্যে ভেসে রয়েছে পিনাকী
তিনি উল্লেখ করেন যে, ভারত-বিখ্যাত এক সাধিকাকে তিনি নিজের চোখে ব্ল্যাক-আর্টের সাহায্য ছাড়াই শূন্যে ভেসে থাকতে দেখেছেন। সাধিকা ধ্যানে যখন শূন্যে ভেসে ছিলেন, তখন তাঁর পেছনে ছিলাে-নেহাতই সাদামাটা চুনকাম করা দেওয়াল। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন—এইক্ষেত্রে অলৌকিক তত্ত্বের বিরােধী প্রবীর ঘােষ কী উত্তর দেবেন?

 উত্তর আমি দিয়েছিলাম। এবং নিয়মমাফিক পত্র-লেখিকার চিঠি সমেত আমার উত্তর পরিবর্তন পত্রিকার অফিসে জমা দিয়েছিলাম। পত্র-লেখিকার চিঠি এবং আমার উত্তর, কোনওটাই প্রকাশিত হয়নি, তাই শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিকানা ও তাঁর লেখা চিঠিটি পুরােপুরি তুলে দিতে পারলাম না।

 প্রসঙ্গত জানাই, পরিবর্তনের ওই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। অভিনন্দন জানিয়ে অনেক চিঠি যেমন পেয়েছি, তেমনি অনেক চিঠি পেয়েছি যাতে পত্র-লেখক বা পত্র-লেখিকারা বিভিন্ন বইতে বা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অথবা নিজের চোখে দেখা নানা ধরনের অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করে আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ জানানাে প্রতিটি অলৌকিক ঘটনারই ব্যাখ্যা করে লিখিত উত্তর ও চিঠিপত্রগুলাে পরিবর্তনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু যে কোনও কারণে ওই চিঠিগুলাে ও তার উত্তর প্রকাশিত হয়নি। যাঁরা ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন এবং পাননি, তাঁরা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিলেন আমি ঘটনাগুলাে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম বলেই চিঠিগুলাে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৮৬-র জানুয়ারিতে এই গ্রন্থটির ১ম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে শূন্যে ভেসে থাকার বিভিন্ন কৌশল হাজির করেছিলাম। প্রতিটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা ছিল।

 আমরা আবার ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ফিরে যাই। তিনি দেখেছিলেন এক শূন্যে ভাসমান সাধিকার পেছনে ছিল সাদামাটা চুনকাম করা দেওয়াল।

যে পদ্ধতিতে ব্ল্যাক-আর্টের সাহায্য ছাড়া সাদা দেওয়াল পেছনে নিয়ে
সাধিকা শূন্যে ভেসে ছিলেন, সেই একই পদ্ধতিতে অনেক
জাদুকর সাদা স্ক্রিনের সামনেও অনেক
কিছু ভাসিয়ে রাখেন।

 পদ্ধতিটা আর কিছুই নয়, স্ক্রিনের পিছনে থেকে একটা ডাণ্ডা বেরিয়ে এসে শূন্যে ভাসাতে চাওয়া জিনিসটিকে স্টেজের প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে রাখে। ওই একই পদ্ধতিতে সাদা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা শক্ত ও সরু একটা লােহার পাতের মাথায় ছােট্ট একটা বসার মতাে জায়গা তৈরি করে নিয়ে অনেক সাধক-সাধিকাই ধ্যানে শূনাে ভাসার ‘অলৌকিক লীলা’ দেখান। ধ্যানে বসা শরীরের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় লােহার পাত। ফলে দর্শকরা মনে করেন সাধক-সাধিকা শূন্যে ভেসে রয়েছেন। ছােটদের জনপ্রিয় পত্রিকা আনন্দমেলার ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ সংখ্যায় ‘নিরালম্ববাবা ও আনন্দবাবু’ নামে এই ধরনের ব্ল্যাক-আর্ট ছাড়া শূন্যে ভেসে থাকার ঘটনাকে নির্ভর করে একটি গল্প লিখি।

 সাদা দেওয়ালে ভেসে থাকার ব্যাপারটা ছবি এঁকে বােঝাবার চেষ্টা করছি।

লাঠিতে হাতকে বিশ্রাম দিয়ে শূন্যে ভাসা

 চন্দননগর বা এর ধারে-কাছের কোন জায়গা থেকে কৌশিক মুখােপাধ্যায় নামে একজন পরিবর্তনের লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে, তিনি লিখেছিলেন, বেশ কিছু বছর আগে (সালটা আমার ঠিক মনে নেই) বারাণসীতে এক সন্ন্যাসীকে সামান্য একটা লাঠির ওপর হাতকে বিশ্রাম দিয়ে তাঁর শরীরকে শূন্যে তুলে রাখতে দেখেছিলেন। কৌশিকবাব কিছুটা ঝাঁজ মিশিয়ে লিখেছিলেন, প্রবীরবাবুর আন্তরিক সত্যনিষ্ঠা থাকলে যেন কিছুটা কষ্ট করে ওই স্থানে গিয়ে এই বিষয়ে অনুসন্ধান করেন, তা হলেই আমার কথার সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।

 কৌশিকবাবু সত্যিই যে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছেন সেই বিষয়ে আমার

কোনও সন্দেহ নেই। তাই অনুসন্ধানেরও প্রয়ােজন নেই।

 কাঠের লাঠিতে হাতকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য এলিয়ে রেখে সাধুবাবার শূন্যে ভেসে থাকা কৌশিকবাবু ঠিকই দেখেছেন। কিন্তু ঘটনাটার পেছনে যে লৌকিক বা বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে, সেই কারণটি জানা না থাকায় তিনি অলৌকিক বলেই ঘটনাটাকে মেনে নিয়েছেন।

বগলে ডান্ডা গুঁজে শূন্যে ভাসার কৌশল

 পাঠক-পাঠিকাদের প্রায় সকলেই বােধহয় ম্যাজিক দেখেছেন। আর অনেকেই দেখেছেন সেই জাদুর খেলা, যেখানে জাদুকর একটি মেয়েকে সম্মােহিত করে (আসল ব্যাপারটা অবশ্য পুরােপুরি অভিনয়) তিনটে সরু লােহার বর্শার ওপর শুইয়ে দেন; তারপর বর্শা দুটো সরিয়ে নেওয়ার পর মেয়েটি একটি মাত্র বর্শার

লাঠিতে ভর দিয়ে শূন্যের ভাসার কৌশল

ওপর ঘাড় পেতে বাকি দেহ শূন্যে ভাসিয়ে শুয়ে থাকে। অথবা দেখেছেন, জুনিয়র পি. সি. সরকারের ম্যাজিক, যাতে তিনি একটি খোঁড়া মেয়ের বগলে একটা কাঠের ডাণ্ডা গুঁজে দিয়ে তাকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখেন।

 সাধুবাবাজিরাও সেই একই নিয়মে একটি কাঠের দণ্ডের সাহায্য নিয়ে নিজের শরীরকে শূন্যে তুলে রাখেন।

জাদুকর যে মেয়েটিকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে চান, তার পােশাকের তলায় থাকে একটা ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি চওড়া ফুট দেড়েকের মতাে লম্বা শক্ত ধাতুর পাত। পাতটি প্রয়ােজন অনুসারে | o] লম্বা বা 0 3 এই ধরনের একটু বাঁকানাে হতে পারে। চামড়ার বা ক্যানভাসের তিন-চারটে বেল্ট দিয়ে ধাতুর পাতটি শরীরের সঙ্গে বাঁধা থাকে। পাতুটিতে প্রয়ােজনমতাে এক বা একাধিক ফুটো থাকে। যে ডাণ্ডার ওপর নির্ভর করে মেয়েটি শূন্যে ঝুলে থাকে, সেই ডাণ্ডার মাথাটা হয় একটু বিশেষ মাপের। দেখতে হবে ডাণ্ডার মাথাটা যেন মেয়েটির পােশক সমেত ওই ধাতুর পাতের ফুটোয় শক্ত ও আঁটোসাঁটোভাবে ঢােকে। মেয়েটির যা করণীয়, তা হলাে সম্মােহিত হওয়ার অভিনয় ও সরু পাতের ওপর ব্যালান্স রেখে শােয়া।

ডাণ্ডার ওপর হাত রেখে সাধুরা যেসব পদ্ধতিতে নিজেদের দেহকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখেন, তার কয়েকটা ছবি এখানে দিলাম। শূন্যে ভেসে থাকা বিষয়ে আগেই বিস্তৃত আলােচনা করে নেওয়ায় ছবিগুলাে দেখলে আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন সাধুদের ভেসে থাকার কৌশলগুলাে।

আলেকজান্ডার হাইমবুর্গার (Alexander Heimburghar) নামে এক বিখ্যাত জাদুকর আমেরিকায় ১৮৪৫-৪৬ সাল নাগাদ একটা অদ্ভুত খেলা দেখিয়ে আলােড়নের ঝড় তুলেছিলেন। খেলাটা ছিল জাদুকরের এক সঙ্গী, একটা খাড়া ডাণ্ডার মাথায় শুধুমাত্র একটা হাতের কনুই ঠেকিয়ে শূন্যে ভেসে থাকত।

আলেকজান্ডারের লেখা থেকেই জানা যায়, তিনি এই খেলা দেখানাে শুরু করেন ভারত থেকে প্রকাশিত একটি বার্ষিকী পত্রিকায় এক ফকিরের অলৌকিক খেলার বর্ণনা পড়বার পর। ফকিরটি একটি বাঁশের লাঠি মাটিতে খাড়া রেখে লাঠির ওপর হাত ঠেকিয়ে তার এক সঙ্গীকে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখত।

অসাধারণ জাদুকর হ্যারি হুডিনি এক জাদু আলােচনায় বলেন, তিনি এই লাঠিতে ভর দিয়ে শুন্যে ভেসে থাকার খেলাটির কথা প্রথম জানতে পারেন টমাস ফ্রস্ট (Thomas Frost) নামের এক ইংরেজ লেখকের লেখা বই পড়ে। লেখক ১৮৩২ সালে মাদ্রাজের এক ব্রাহ্মণকে শূন্যে বসে থাকতে দেখেন। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে, একটা তক্তাজাতীয় কাঠের টুকরােতে চারটে পায়া লাগানাে ছিল। তক্তায় ছিল একটা ফুটো। ফুটোটা ছিল এই মাপের, যাতে একটা লাঠি ঢােকালে লাঠিটা শক্ত হয়ে তক্তার সঙ্গে আটকে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা লাঠির সঙ্গে লাগানাে থাকত আর একটা ছােট ডাণ্ডা। এটা থাকত মাটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে। ছােট ডাণ্ডাটায় বাহু রেখে শুন্যে ভেসে থাকতেন ব্রাহ্মণ।

১৮৪৮ সাল নাগাদ আধুনিক জাদুর জনক রবেয়ার উদাও তার
দু’বছরের ছেলে ইউজেনকে এই পদ্ধতিতে শূন্যে ভাসিয়ে

রেখে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে প্রচণ্ড বিস্ময়ের সৃষ্টি
করেছিলেন। একটা খাড়া লাঠিতে
কনুইটুকুর ভর দিয়ে শূন্যে
ভেসে থাকত ইউজেন।

 প্রায় একই সময়ে লন্ডনে এইভাবে শূন্যে ভাসিয়ে রাখার খেলাটি দেখিয়েছিলেন আর দু’জন জাদুকর। এঁরা হলেন কমপার্স হারম্যান ও হেনরি অন্ডারসন।

 শূন্যে ভাসিয়ে রাখার খেলাকে আর এক ধাপ উন্নত করলেন জাদুকর জন নেভিল ম্যাসকেলিন (John Nevil Maskelyne)। ১৮৬৭ সালে তিনি লন্ডনের এক জাদু-প্রদর্শনীতে তাঁর স্ত্রীকে সম্মােহিত করে (অভিনয়) একটা টেবিলের ওপর শুইয়ে দেন। তারপর, দর্শকরা সবিস্ময়ে দেখলেন, শ্রীমতী ম্যাসকেলিনের দেহটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে গেল। এই খেলাকে জাদুর ভাষায় বলা হয় ‘আগা’ (A. G. A.)। A. G. A.’র পুরাে কথাটা হল Anti Gravity Animation।

 এই খেলাটিকেই আরও নাটকীয় আরও সুন্দর করে দেখালেন হ্যারি কেলার (Harry Keller)। স্থান আমেরিকা। খেলাটির নাম দিলেন ‘Levitation of Princess Kamac’।

 শূনাে ভেসে থাকার খেলাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বেলজিয়ামের প্রখ্যাত জাদুকর সার্ভেস লে-রয় (Servais Le Roy)। আমি যতদূর জানি, এটাই

সাধুসন্তদের শূন্যে ভাসা

শূন্যে ভাসিয়ে রাখার সর্বশেষ উন্নততম পদ্ধতি। লে-রয় তাঁর দলের একটি মেয়েকে সম্মােহন করে (পুরােটাই অভিনয়) একটি উঁচু বেদিতে শুইয়ে দিতেন। মেয়েটিকে ঢেকে দেওয়া হতাে একটি রেশমি কাপড় দিয়ে। এক সময় মেয়েটির কাপড়ে ঢাকা শরীরটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠতে থাকত। তারপর, হঠাৎ দেখা যেত জাদুকরের হাতের টানে চাদরটা জাদুকরের হাতে চলে এসেছে। কিন্তু মেয়েটি কোথায়? বেমালুম অদৃশ্য। বর্তমানে অনেক জাদুকর-ই এই খেলাটি খুব আকর্ষণীয়ভাবে দেখিয়ে থাকেন।

লে-রয়ের এই খেলা যদি অসৎ কোন ব্যক্তি লােক-ঠকানাের
জন্য দেখায়, তবে অনেকেই তাকে অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে
করতে পারেন।

 লে বয় আসলে যা করতেন: জাদুকর তাঁর সহকারী মেয়েটিকে সম্মােহন করার অভিনয় করতাে। মেয়েটিও সম্মােহিত হওয়ার অভিনয় করতো। সম্মােহিত মেয়েটিকে সহকারীদের সাহায্যে একটা টেবিল বা বেঞ্চের ওপর শুইয়ে দেওয়া হয়। দু’জন সহকারী রেশমের কাপড় দিয়ে যখন মেয়েটির শরীর ঢেকে দেয়, তখন সামান্য সময়ের জন্য কাপড়টা এমনভাবে মেলে ধরে যাতে শুয়ে থাকা মেয়েটির দেহ কিছুক্ষণের জন্য দর্শকদের দৃষ্টির আড়ালে থাকে। এই অবসরে মেয়েটি পিছনের পর্দার আড়ালে সরে যায়। পাতলা রবারে হাওয়া ঢােকান একটি নকল মেয়েকে টেবিল বা বেঞ্চের ওপর তুলে দেওয়া হয়। সহকারী দু’জন ওই বেলুনের তৈরি মেয়েটিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। বেলুন-মেয়েটির গলায় ও পায়ে বাঁধা থাকে খুব সরু স্টীলের তার বা সিন্থেটিক সুতাে। তারের বা সুতাের মাথা দুটি ঢেকে দেওয়া কাপড় ভেদ করে তার দুটি উপরে উঠে থাকে। ঢেকে দেওয়ার পর জাদুকর সরু তার ধরে বিভিন্ন কায়দায় মেয়েটিকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখেন। কখনও জাদুকরের ইশারায় মেয়েটি উঁচুতে উঠে যায়, কখনও নীচে নেমে আসে। মঞ্চে গাঢ় নীল বা বেগুনী আলাে ফেলা হয়। ফলে, তিন-চার ফুট দুরের দর্শকদের পক্ষেও তারের অস্তিত্ব বােঝা সম্ভব হয় না।

 এরপর আসা যাক দেহটা অদৃশ্য করা প্রসঙ্গ। অদৃশ্য করার সময় জাদুকর বেলুনে পিন ফুটিয়ে দেন। বেলুন যায় ফেটে। সঙ্গে-সঙ্গে বেলুন মেয়েও হয়ে যায় অদৃশ্য। আর বেলুন ফাটার আওয়াজ ঢাকতে জাদুকরের বাজনাদারেরাই যথেষ্ট।


বেদে-বেদেনীদের শূন্যে ভাসা

 অনেকেই বােধহয় দেখেছেন রাস্তার পাশে, বাজার-হাটে, মাঠে-ময়দানে, খােলা জায়গায় একধরনের বেদে-সম্প্রদায়ের লােকেরা শূন্যে ভাসবার খেলা দেখায়। তবে ওরা দাবি করে—এটা ম্যাজিক নয়, অলৌকিক ঘটনা। সত্য সাঁই-এর ছােট একটা বাঁধানাে ছবি, দু-একটা হাড়, মড়ার খুলি ও ছােট্ট একটা টিনের বাক্সে কিছু তাবিজ সাজিয়ে সত্য সাঁই-এর অপার কৃপায় নানা ধরনের ‘অলৌকিক’ খেলা দেখায়।

 এই বেদে-সম্প্রদায় অবশ্য সবসময়ই লোেক ঠকানাের জন্য ওদের বিভিন্ন খেলাকেই অলৌকিক আখ্যা দিয়ে থাকে। যুক্তি দিয়ে খেলাগুলাের ব্যাখ্যা না পেলে দর্শকরা অনেক সময় ওদের কথায় বিশ্বাস করে ফেলেন এবং চটপট নগদ দামে অলৌকিক মাদুলিও কিনে ফেলেন। অনেকে না কিনলেও এইটুকু অন্তত বিশ্বাস করে ফেলেন, ওরা তন্ত্র-মন্ত্র ও তুক-তাকে সিদ্ধ মানুষ। অবশ্য এই বইটি লেখার পর লক্ষ কোটি মানুষ এখন কৌশলটি জেনেছেন।

 আমাকে অনেকেই অনেক সময় প্রশ্ন করেছেন, ব্ল্যাক-আর্ট, ঘরের দেওয়ালের সাহায্য বা কোন ডাণ্ডার সাহায্য ছাড়াই অনেক বেদে-সম্প্রদায়ের লােকেরা খােলা জায়গায় মানুষকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। এটা কী করে সম্ভব?

 আমি বলি, এটাও একটা লৌকিক খেলা। আরও অনেক অত্যাশ্চর্য ‘অলৌকিক’ ঘটনার মতােই এর পেছনেও রয়েছে অতি সাধারণ কৌশল। অথচ, আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও খেলাটি দেখে সাধারণ দর্শক কেন, অনেক বিশেষজ্ঞ জাদুকরকেও আশ্চর্য হতে দেখেছি। ঠিক কী ভাবে খেলাটা দর্শকদের কাছে হাজির কি হয় তার একটু বর্ণনা দিলে বােধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

খােলামাঠে শূন্যে ভাসানাে হচ্ছে

 }সত্য-সাঁই বা অন্য কোনও ঈশ্বরের কৃপায় অলৌকিক ক্ষমতাধর বেদে তার এক সহকারীকে মাটির ওপর শুইয়ে বিশাল এক চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দেয়। চাদরে থাকে একটা ফুটো, যা দিয়ে মাথাটা শুধু বেরিয়ে থাকে। তারপর ডমরু ও বাঁশি বাজিয়ে বেদেটি সহকারীটির চারপাশে ঘুরতে থাকে। একসময় মড়ার হাড় বা খুলি নিয়ে নানা মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। বেদেটির আহ্বানে ওর আরও দু’জন সহকারী বা দু’জন দর্শক (এরাও বেদেটিরই লােক) এগিয়ে এসে শুয়ে থাকা দেহটির মাথা ও পায়ের দিকে চাদরটা ধরে একটু নেড়ে দেয়। কী আশ্চর্য! সহকারীর চাদরে ঢাকা দেহ একটু একটু করে শূন্যে উঠতে থাকে এবং একসময় দেহটা শুন্যে দেড়-ফুটের মতাে উঁচুতে ভাসতে থাকে।

 ছবিটিতে দেখিয়েছি বেদেটির সহকারীর শরীর শূন্যে ভেসে রয়েছে, এবং ওর শরীর ঢেকে দেওয়া চাদরটা মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে রয়েছে।

শূন্যে ভেসে থাকার নেপথ্যে

 মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে থাকা চাদরের তলায় রয়েছে ভেসে আসল রহস্য। চাদরের তলায় সহকারী হকিস্টিক ও ওই ধরনের কোন লাঠির সাহায্য নিয়ে যা করে তা পরের ছবিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।

 এই ধরনের খেলা বসে এবং দাঁড়িয়ে দুভাবেই দেখানাে সম্ভব। দাঁড়িয়ে দেখালে উচ্চতা বাড়বে।

 এই প্রসঙ্গে একটি মজার অভিজ্ঞতার কথা না বলে পারছি না। একটি স্ব-ঘােষিত যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, সমাজ সচেতন মাসিক পত্রিকার (বর্তমানে উঠে গেছে) জনৈক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আমাকে অনুরােধ করলেন, তাঁদের পত্রিকার জন্য ‘শূন্যে ভাসার কৌশল’ নিয়ে একটা লেখা তৈরি করে দিতে। সম্পাদককে লেখাটি দিলাম। আমার এই বইতে এতক্ষণ শূন্যে ভাসার যে-সব কৌশলগুলাের সঙ্গে আপনারা পরিচিত হলেন, সেগুলােই লিখেছিলাম ওই লেখাটিতে। লেখাটি খুব শিগগিরই ফেরত পেলাম ওই পত্রিকারই সম্পাদকমণ্ডলীর আর এক সদস্যের হাত থেকে। তিনি জানালেন, “লেখাটা মনােনীত হয়নি। কেন মনােনীত হয়নি, তা ওপরের পাতাতেই লিখে দিয়েছি।”

 কারও লেখাই সবার কাছে গ্রহণযােগা হতে পারে না। আমার লেখা অমনােনীত হওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছুই ছিল না। কিন্তু আমার জন্য এক রাশ শঙ্কা ও বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছিল অমনােনীত লেখার প্রথম পৃষ্ঠাটি। তাতে লেখাটি প্রসঙ্গে সম্পাদকমণ্ডলীর তিনজনের স্বাক্ষরিত মন্তব্য রয়েছে।

 একজন লিখেছেন, “কৌশলগুলাে কতখানি নির্ভরযোেগ্য সে সন্দেহ থাকে।”

 দ্বিতীয় জনের মন্তব্য, “শূন্যে ভাসার technique গুলি convincing নয়। কাপড় ঢাকার কায়দাটাও ফাঁকিবাজিতে সারা হয়েছে।”

 তৃতীয় সম্পাদকের সিদ্ধান্তে ঘােষিত হয়েছে, “চাদর ঢাকার ব্যাপারটা ভুল describe করেছেন। sorry।”

 যুক্তিবাদী বলে স্ব-ঘােষিত মানুষগুলাের এমন যুক্তিহীন মনগড়া মন্তব্যে যতটা বিস্মিত হই, শঙ্কিত হই তার চেয়েও বেশি।

 তিন সম্পাদক শূন্যে ভাসার কৌশলগুলাে অসার, মিথ্যে বলে মন্তব্য করার আগে তাঁরা দু’টি পথের যে কোনও একটিকে বেছে নিতে পারতেন।

 এক: ‘হাতে-কলমে’ আমার বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখতে পারতেন, এগুলাে সত্যিই শূন্যে ভাসার কৌশল কি না?

 দুই: বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোনও প্রতিষ্ঠিত জাদুকরের কাছ থেকে মতামত নিতে পারতেন।

১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সংবাদ সম্মেলনে শূন্যে ভাসা

 দু’টির কোনও পথকেই গ্রহণ না করে এই ধরনের অন্ধ-বিশ্বাস মিশ্রিত সিদ্ধান্তে পৌঁছােনাে আর যাকেই শােভা পাক, কোনও যুক্তিবাদী বলে স্ব-বিজ্ঞাপিত মানুষদের শােভা পায় না।

 ১৯৮৬-র কলিকাতা পুস্তক মেলায় বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের সমিতি, বহু সহযােগী সংস্থা, বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাব ও যুক্তিবাদী সংগঠন অন্তত কয়েক হাজার অলৌকিক বিরােধী প্রদর্শনীতে আমার বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে চাদরে ঢেকে শূন্যে ভাসার ঘটনাটি দেখিয়ে স্ব-ঘােষিত তিন যুক্তিবাদী সম্পাদকের মন্তব্যের অসারতা এবং যুক্তিহীনতাকে প্রমাণ করে দিয়েছে।

 স্ব-ঘােষিত জ্যোতিষ সম্রাটদের মতাে করে ‘যুক্তিবাদী’ ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ ইত্যাদি কথাগুলাে নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে প্রচারের মাধ্যমে কিছু মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাদের কাছে যুক্তিবাদী সাজা যেতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের যুক্তিবাদী হওয়া যায় না। কারণ—

যুক্তিবাদী সাজা যায় না। শুধুমাত্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়েই
যুক্তিবাদী হতে হয়। যুক্তিবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব
দিতে হলে নিজেকে যুক্তিবাদী হতে হবে।
এর কোনও ব্যতিক্রম সম্ভব নয়।

 যুক্তিকে বাদ দেওয়া যুক্তিবাদী মানুষগুলাে যখন যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা সাজে, তখন শঙ্কিত হই। শঙ্কার কারণ, এঁদের যুক্তিহীন চিন্তাধারা, চিন্তার অস্বচ্ছতা, ঈর্ষাকাতরতা, মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে প্রবলতর ভূমিকা নেবে।

মন্ত্রে যজ্ঞের আগুন জ্বলে

 এবার যে ঘটনাটা বলছি, সেটা ঘটেছিল আমার স্কুল জীবনে। সালটা সম্ভবত ১৯৫৭। বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে আমরা তখন খড়্গপুরের বাসিন্দা। পড়ি কৃষ্ণলাল শিক্ষানিকেতনে। একদিন হঠাৎ খবর পেলাম, পাঁচবেডিয়া অঞ্চলের এক বাড়িতে খুব ভূতের উপদ্রব হচ্ছে। তার দিনকয়েক পরেই খবর পেলাম, বাড়ির মালিক ভূত তাড়াতে কোথা থেকে যেন এক বিখ্যাত তান্ত্রিককে নিয়ে এসেছেন। তারপরেই যে খবরটা পেলাম, সেটা ভূতের চেয়েও অদ্ভুত। তান্ত্রিক প্রতিদিনই যজ্ঞ করছেন এবং যজ্ঞের আগুন জ্বালছেন মন্ত্র দিয়ে, দেশলাই দিয়ে নয়।

 এমন এক অসাধারণ ঘটনা নিজের চোখে দেখতে পরদিনই স্কুল ছুটির পর দৌড়লাম। গিয়ে দেখি শয়ে শয়ে লােকের প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় ঠেলে যখন ভিতরে ঢোকার সুযােগ পেলাম, তখন দেখি যজ্ঞ চলছে। যজ্ঞের তান্ত্রিককে সেদিন অবাক চোখে দেখেছিলাম। তাকে কেমন দেখতে ছিল তা মনে নেই। তবে, এইটুকু মনে আছে, সেদিন তান্ত্রিক ছিল আমার চোখে ‘হিরাে’।

 পরের দিন পেটের ব্যথা বা ওই জাতীয় একটা কোনাে অজুহাতে স্কুলে গেলাম না। দুপুরে মা’কে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। সেদিন যজ্ঞ শুরু আগেই পৌঁছেছিলাম। ইঁট দিয়ে একটা বড়-সড় যজ্ঞের জায়গা করা হয়েছিল, তাতে সাজানাে ছিল অনেক কাঠ। পাশে স্তূপ করা ছিল প্রচুর কাঠ, পাটকাঠি, একধামা বেলপাতা ও একটা ঘিয়ের টিন। একসময় তান্ত্রিক এসে বসলেন। তাঁর সামনে ছিল একটা কানা উঁচু তামার বাটি। বাটিতে কয়েকটা পাটকাঠি রয়েছে। তান্ত্রিক আসনে বসে ‘মা, মা’ বলে বার কয়েক হুঙ্কার ছাড়লেন। তারপর বাটিটার ওপর ডান হাতের আঙুলগুলাে নিয়ে আরতি করার ভঙ্গিমায় নাড়তে লাগলেন।

 একসময় অবাক হয়ে দেখলাম, শূন্য তামার বাটিতে রাখা পাটকাঠি দপ করে জ্বলে উঠল। বিস্মিত ভক্তেরা তান্ত্রিকের জয়ধ্বনি করে উঠল। জয়ধ্বনির মধ্যেই তান্ত্রিকবাবাজি ওই জ্বলন্ত পাটকাঠি থেকে যজ্ঞের আগুন জ্বালালেন।

১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ যজ্ঞে আগুন জ্বালাচ্ছেন জ্যোতি মুখার্জি


 সেই দিনের সেই বিস্ময় আজ আর আমার মধ্যে নেই। সেদিনের হিরাে আজ আমার চোখে নেহাতই এক প্রবঞ্চক মাত্র। জানি ওই তান্ত্রিকও সেদিন বিজ্ঞানেরই সাহায্য নিয়ে আগুন সৃষ্টি করেছিল। সেদিন তান্ত্রিকের বাটিতে ছিল কিছুটা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। আর, তান্ত্রিকের ডান হাতের আংটির খাঁজে লুকোনাে ছিল গ্লিসারিন ভর্তি ড্রপার। হাত নাড়তে নাড়তে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কয়েক ফোঁটা গ্লিসারিন বাটিতে ফেলে দিয়েছিল। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট গ্লিসারিনের সংস্পর্শে এতে তাকে অক্সিডাইজডকরে ফেলেছিল। এই অক্সিডেশনের ফিজিক্যাল পরিবর্তন হিসেবে ওই রাসায়নিক উত্তাপ বেড়ে গিয়ে দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল।

ছােটবেলা থেকেই ঠাকুর-দেবতা ও সাধু-সন্ন্যাসীদের নানা অলৌকিক
ঘটনার কথা অনবরত পড়ে ও শুনে আমাদের মনের মধ্যে
একটা যুক্তিহীন অন্ধ বিশ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে। এই
মানসিকতার সুযােগ নিয়ে একদল প্রতারক
অলৌকিক ক্ষমতার নামে লৌকিক
জাদু দেখিয়ে ধর্মের নামে
ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

 খবরের কাগজগুলােতে অলৌকিক ক্ষমতার গপ্পো-কথা পড়েছি, ভূতের গপ্পো পড়েছি, টিভি-তে দেখেছি। বিভিন্ন মিডিয়ার হয়ে সে’সবের অনুসন্ধানে দেখেছি— প্রত্যেকটি মিথ্যে। ভাববাদীরা অবশ্য বলবেন, আমি যাদের নিয়ে লিখছি, তাদের বাইরেও আরও অনেক সাধু-সন্ন্যাসী এসেছিলেন বিশেষত ভারতবর্ষে। যাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। অতীতের ওই সব সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠা কাহিনি বা কল্পকাহিনির ব্যাখ্যা তথ্যের অভাবেই বর্তমানে অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। সত্যি বলে প্রমাণ করাও সম্ভব নয়।

বিজ্ঞান অলৌকিক বা অপ্রাকৃত কোনও ঘটনা বা রটনাতে বিশ্বাস
করে না। অলৌকিক কোনও কিছু ঘটেছিল এটা প্রমাণ
করার দায়িত্ব সাধু-সন্ন্যাসীদের বা তার ভক্তদের।
কোনও ক্ষেত্রেই তারা এই ধরনের কোনও
প্রমাণ দিতে সক্ষম হননি।


সত্য সাঁইবাবা

সত্য সাঁইবাবা ভারতের সবচেয়ে প্রচারিত অলৌকিক ক্ষমতাবান (?) ব্যক্তি। আর সব অবতারদের মতাে সাঁইবাবাও ভক্তদের মধ্যে রয়েছে সমাদের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই অবতারদের পক্ষে অতি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষ ভাবে এত বড়-বড় নামি-দামী লােকেরা যখন অমুকের শিষ্য, তখন অমুক সাধকের নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতা।

সাঁইবাবার অলৌকিক ঘড়ি-রহস্য।

 সাঁইবাবার এমনি এক বিশিষ্ট ভক্ত ডঃ এস. ভগবন্থম। ইনি ভারত সরকারের প্রাক্তন বিজ্ঞান উপদেষ্টা। ভগবন্থম জানালেন, তিনি অলৌকিককে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু সাঁইবাবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তাঁর আগেকার ধারণাই পালটে গেছে। নিজের চোখে সাঁইবাবার যে-সব অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখেছেন, তাতে অলৌকিকে বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। ভারতে এসে তিনি নিছক কৌতূহল মেটাতে সাঁইবাবার আশ্রমে তাঁকে দর্শন করতে আসেন। ভক্তদের মধ্যে ওই জাপানি ভদ্রলােকটিকে দেখতে পেয়ে সত্য সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটি ছােট পার্সেল তৈরি করে তাঁকে দেন। পার্সেলটি খুলে ভদ্রলােক হতবাক হয়ে যান। ভেতরে ছিল জাপানে রেখে আসা ঘড়ির মডেলটি। ঘড়ির সঙ্গে বাঁধা রেশমের ফিতে, সঙ্গে মডেলটির নতুন নাম লেখা লেবেলটিও রয়েছে। জাপানি ভদ্রলােকের সাঁইবাবার ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ গেল মিলিয়ে। এই ঘটনার পর থেকে তিনি সাঁইবাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠেন। জাপানে ফিরে তিনি আলমারি খুলে দেখেন ঘড়িটি নেই। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব যা বললেন তা আরও বিস্ময়কর। সচিব বললেন, ঝাঁকড়া চুলের দেবকান্তি একটি লােক একদিন হেঁটে অফিসে ঢুকলেন, তারপর আলমারি খুলে ঘড়িটি নিয়ে চলে গেলেন।

 অলৌকিকে অবিশ্বাসী ডঃ কোভুর ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার জন্য ডঃ ভগবন্থমকে চিঠি লিখে জাপানি ভক্তটির নাম ও ঠিকানা জানতে চান। একাধিকবার চিঠি লিখেও ডঃ কোভুর কোন উত্তর পাননি। শেষ পর্যন্ত ডঃ কোভুর শ্রীলঙ্কার জাপানি দূতাবাস থেকে সিকো ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার ঠিকানা সংগ্রহ করে ওই কোম্পানির প্রেসিডেন্টকে এই বিষয়ে আলােকপাত করতে অনুরােধ করে ৩০ অক্টোবর ১৯৭৩-এ একটি চিঠি লেখেন। সিকো ঘড়ির প্রস্তুতকারক সংস্থার ঠিকানা সংগ্রহ করে ওই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট শোজি হাট্টোরি এর উত্তরে যা জানান তা তুলে দিলাম।

 তাঁর কথায়—একবার জাপানের ‘সিকো’ ঘড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থার এক কর্তা ব্যক্তি ভারতে আসেন। আসার সময় তিনি অফিসের আলমারিতে রেখে এসেছিলেন একটি বিশেষ সিকো ঘড়ি।

ডঃ এ. টি. কোভুর

পামানকাড়া লেন
কলম্বাে—৬, শ্রীলঙ্কা

সিকো

কে হাট্টোরি অ্যাণ্ড কোং লিঃ
৫, কোয়াবাসি ২ কোমে,
চুওকু, টোকিও—১০৪

৮ নভেম্বর, ১৯৭৩

প্রিয় ডঃ কোভুর,

 আপনার ৩০ অক্টোবরের চিঠিটার জন্য ধন্যবাদ। অলৌকিক ক্ষমতার দাবি বিষয়ে আপনার গবেষণার আগ্রহের আমি প্রশংসা করি। আপনি চিঠিতে মিস্টার সাঁইবাবার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন, তাঁর সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানাতে পারছি না। আমার বা আমাদের কোনও পদস্থ কর্মীর সঙ্গে ওই ভদ্রলােকের পরিচয় ঘটেনি। আমি নিশ্চিত, যে ঘটনার কথা আপনি বলেছেন, তার কোনও ভিত্তি নেই। তাই সাধুসন্তদের অলৌকিক ক্ষমতা ওই ঘটনাকে ভিত্তি করে আপনি যেসব প্রশ্ন রেখেছেন, তার উত্তরে ‘না’ বলা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই।’'

আপনার একান্ত

কে,হাট্টোরি অ্যান্ড কোং লিঃ
স্বাক্ষর শোজি হাট্টোরি

প্রেসিডেন্ট

 চিঠির উত্তর পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না, সিকোর বড়-মেজ কোনও কর্তার সঙ্গে সাঁইবাবার এই ধরনের কোনও মুলাকাত হয়নি।

 উত্তরটি পাওয়ার পর ডঃ কোভুর আবার ডঃ ভগবন্থমকে চিঠি লিখে শোজি হাট্টোরির কাছ থেকে পাওয়া উত্তরটির কথা জানান। ডঃ কোভুর আরও জানতে চান ডঃ ভগবন্থম যে জাপানি ভক্তের কথা বলেছেন, তিনি কি অন্য কোনও ব্যক্তি? তাঁর নাম, ঠিকানা ও সিকো’তে কী পদে কাজ করেন জানান। এবারও ডঃ ভগবন্থম আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থাকেন। ডঃ ভগবন্থমের নীরবতা এবং ডঃ কোভুরের সত্যকে জানার প্রচেষ্টা এটাই প্রমাণ করে যে, সিকো ঘড়ির অলৌকিক ঘটনা নেহাতই মিথ্যে প্রচার।


'কেন এমন হয়।’

 অবতার বা অলৌকিক ক্ষমতা (?) অধিকারীদের পক্ষে জনপ্রিয় বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকাগুলো যেভাবে প্রচার চালায়, অবতারদের বিপক্ষে কেউ যুক্তির অবতারণা করলেও সেভাবে প্রচার চালানো হয় না। তার কারণগুলো হলো, (১) এখনও পাঠক-পাঠিকাদের বড় অংশই আবেগপ্রবণ, অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন। এই ধরনের পাঠক-পাঠিকাদের মনোরঞ্জনের পক্ষে এবং আবেগকে সুড়সুড়ি দেওয়ার পক্ষে অবতারদের কাহিনি যথেষ্ট কার্যকর। (২) জনপ্রিয় অবতারদের কাহিনি ছাপা হলে সেই অবতারদের শিষ্য-শিষ্যা ও ভক্তদের বড় অংশ পত্রিকাটির ‘রেগুলার’ পাঠক-পাঠিকা না হলেও সংখ্যাটি কিনবেন বা পড়বেন। (৩) অবতারদের কাছ থেকে পত্র-পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন বাবদ অথবা অন্যভাবে কিছু সুযোগ-সুবিধে পেয়ে থাকে। এক যোগীবাবা তো শুনি—টিভি পোগ্রাম পিছু দু-লাখ টাকা দেন। (৪) পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অনেক সময় নিজেরাই যুক্তিহীনতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এবং অবতারবাদে বিশ্বাসী ও অবতারবাদের পৃষ্ঠপোষক।

সাঁইবাবার ছবিতে জ্যোতি

 অবতারবাদে বিশ্বাসী ও অবতারবাদের এমনই এক পৃষ্ঠপোষক ‘ব্লিৎস’ পত্রিকার সম্পাদক মিস্টার করঞ্জিয়া ২২.৩.৮১-র ‘সানডে’ পত্রিকার সংখ্যায় শ্রীকরঞ্জিয়া এক সাক্ষাৎকারে জানালেন, “সম্প্রতি যোগের মাধ্যমে আমি এর ভেতরে প্রবেশ করেছি। যোগ শুরু করার পর অনেক রহস্যময় অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এই যে আমরা দু’জনে এখানে বসে রয়েছি, আর আমাদের চারপাশে রয়েছে অনন্ত মহাজাগতিক শক্তি, অথচ আমরা জানি না কীভাবে একে কাজে লাগাব। এই সবই আমাকে ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সাঁইবাবার ভিতর এই মহাজাগতিক শক্তির কিছু বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেয়েছি।”

 শ্রীকরঞ্জিয়া সাঁইবাবার একটি ছবি দেখান। ক্যামেরায় তােলা ফোটোটিতে সাঁইবাবার চারপাশে একটা উজ্জ্বল আলােকচ্ছটা দেখা যায়। শ্রীকরঞ্জিয়া দাবি করেন, এই উজ্জ্বল আলােকচ্ছটা দেখা যায়। শ্রীকরঞ্জিয়া দাবি করেন, এই উজ্জ্বল আলােকচ্ছটা হলাে সাঁইবাবার শরীর থেকে নির্গত জ্যোতি। ফটোগ্রাফির কৌশলে

বিভূতি আনার কৌশল

যে কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদের ছবি থেকেই জ্যোতি বেরােতে দেখা যেতে পারে।

সাঁইবাবার বিভূতি

 সাঁইবাবার নামের সঙ্গে ‘বিভূতি’র ব্যাপারটা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, সাঁইবাবা বললেই তাঁর অলৌকিক বিভুতির কথাই আগে মনে পড়ে। সাঁইবাবা অলৌকিক প্রভাবে তাঁর শূন্য হাতে সুগন্ধি পবিত্র ছাই বা বিভূতির সৃষ্টি করে ভক্তদের বিতরণ করেন। বছরের পর বছর মন্ত্রমুগ্ধের মতাে ভক্তেরা দেখে আসছেন সাঁইবাবার বিভূতি সৃষ্টির অলৌকিকের লীলা।

 ১৯৮৪’র ১ মার্চ, ২ এপ্রিল, ২ মে ও ১ জুন সাঁইবাবাকে চারটে চিঠি দিই। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি চিঠিরও উত্তর পাইনি। আমার ইংরেজিতে লেখা প্রথম চিঠিটির বাংলা অনুবাদ এখানে দিলাম।

ভগবান শ্রী সত্যসাঁইবাবা

প্রশান্তিনিলায়ম

২৮৭ দমদম পার্ক

পুট্টাপাটি

কলকাতা—৫৫

জেলা—অনন্তপুর

পিন—৭০০ ০৫৫

অন্ধ্রপ্রদেশ

১.৩.১৯৮৪

প্রিয় সত্যসাঁইবাবা,

 ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যার বিচারে আপনিই সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়তম ধর্মগুরু। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সম্বন্ধে অনেক কিছু পড়েছি এবং আপনার কিছু ভক্তের কাছে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি। আপনার অলৌকিক খ্যাতি প্রধানত ‘বিভূতি’ সৃষ্টির জন্য। পড়েছি এবং শুনেছি যে, আপনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে শূন্যে হাত নেড়ে ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন এবং কৃপা করে কিছু কিছু ভাগ্যবান ভক্তদের তা দেন।

 আমি অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে জানতে অত্যন্ত আগ্রহী। অলৌকিক কোনও ঘটনা বা অলৌকিক ক্ষমতাবান কোনও ব্যক্তির বিষয় শুনলে আমি আমার যথাসাধ্য অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্যকে জানার চেষ্টা করি। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়েও আজ পর্যন্ত একটিও অলৌকিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ঘটনার সন্ধান পাইনি। আমার এই ধরনের সত্য জানার প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতােই আশা করি আপনিও স্বাগত জানাবেন; সেইসঙ্গে এ-ও আশা করি যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে অনুসন্ধানে আপনি আমার সঙ্গে সহযােগিতা করবেন। আপনার পােশাক ও শরীর পরীক্ষা করার পর আপনি আমাকে শূন্যে হাত নেড়ে, ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করে দেখালে আমি অবশ্যই মেনে নেব যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতা আছে এবং অলৌকিক বলে বাস্তবিকই কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে।

 আপনি যদি আমার চিঠির উত্তর না দেন, অথবা যদি আপনার বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজে আমার সঙ্গে সহযােগিতা না করেন, তবে অবশ্যই ধরে নেব যে, আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি অলৌকিক কাহিনিই মিথ্যে এবং আপনি ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন কৌশলের দ্বারা, অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা নয়।

শুভেচ্ছান্তে,

প্রবীর ঘােষ

 সাঁইবাবাকে লেখা পরের চিঠিগুলাের বয়ান একই ছিল। কোনও চিঠিরই উত্তর পাইনি।

 শূন্যে হাত নেড়ে ছাই বের করাটা ঠিকমতাে পরিবেশে তেমনভাবে দেখাতে পারলে অলৌকিক বলে মনে হতে পারে।


 ১৬.৪.৭৮ তারিখের ‘সানডে’ সাপ্তাহিকে জাদুকর পি. সি. সরকার জুনিয়র জানান তিনি সাঁইবাবার সামনে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে একটা রসগােল্লা নিয়ে আসেন। সাঁইবাবা এই ধরনের ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন।

 এর কতটা সত্যি, বা একটুও সত্যি আছে কী না—সন্দেহ আছে। কারণ, সাঁইবাবার আশ্রমের যা পরিকাঠামাে দেখেছি, তাতে এভাবে সাঁইবাবাকে তাঁরই আশ্রমে বে-আব্রু করা একেবারেই অসম্ভব।

 শূন্যে হাত ঘুরিয়ে রসগােল্লা নিয়ে আসা, এটা জাদুর ভাষায় ‘পামিং’। পামিং হল কিছু কৌশল, যেগুলাের সাহায্যে ছােটখাটো কোনও জিনিসকে হাতের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়। আমার ধারণা সাঁইবাবা তাঁর ‘পবিত্র ছাই’ পাম করে লুকিয়ে রাখেন না, কারণ প্রচুর ছাই ‘পাম’ করে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সাঁইবাবা যে পদ্ধতিতে ভক্তদের ‘পবিত্র ছাই’ বিতরণ করেন বলে আমার ধারণা আমি সেই একই পদ্ধতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের সামনে ছাই সৃষ্টি করেছি। প্রতিটি অত্যাশ্চর্য জাদুর মতােই এই খেলাটির কৌশল অতি সাধারণ।

 যে অবতার শূন্যে ডান হাত নেড়ে পবিত্র ছাই বের করতে চান তার ডাঁন বগলে বাঁধা থাকে রবারের বা নরম প্লাসস্টিক জাতীয় জিনিসের ছােটখাটো ব্লাডার। ব্লাডার ভর্তি করা থাকে সুগন্ধি ছাই। ব্লাডারের মুখ থেকে একটা সরু-নল হাত বেয়ে সােজা নেমে আসে হাতের কব্জির কাছ বরাবর। পােশাকের তলায় ঢাকা পড়ে যায় ব্লাডার ও-নল। এবার ছাই সৃষ্টি করার সময় ডান হাত দিয়ে বগলের তলায় বাঁধা ব্লাডারটায় প্রয়ােজনীয় চাপ দিলেই নল বেয়ে হাতের মুঠোয় চলে আসবে পবিত্র ছাই। বাঁ হাত দিয়েও ছাই বের করতে চান? বাঁ বগলেও একটা ছাই-ভর্তি ব্লাডার বুলিয়ে নিন। দেখলেন তাে, অবতার হওয়া কত সােজা!

 বােঝবার সুবিধের জন্য ছবি দেখুন।

 এই পদ্ধতি ছাড়াও বিভূতি সৃষ্টি সম্ভব। ছাইয়ের পাউডারে ভাতের পড় মিশিয়ে লাড্ডু বানিয়ে আলখাল্লার ভিতরের দিকে ‘জাদু চিমটে’র সাহায্যে ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে। জাদুর পরিভাষায় একে বলে ‘লেড’ নেওয়া। তারপর আলখাল্লার তলায় হাত ঢুকিয়ে হাতে লাড্ডু এনে গুঁড়াে করে বিলি করলেই হলাে। লাড্ডুতে সেন্ট মেশালে ‘সােনায় সােহাগা’।

শূন্য থেকে হার আনলেন ও হার মানলেন সাঁই

 ১৯৯৪-র ডিসেম্বরে বিবিসি’র প্রােডিউসর ইনচার্য রবার্ট ঈগল এলেন যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে তথ্যচিত্র তুলতে। সেই সময় সাঁইবাবার অলৌকিক ক্ষমতা ছবি-বন্দি করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা সাঁইবাবার আস্তানায় গিয়ে তাঁর বুজরুকি ফাঁস করতে রাজি কি না? বললাম রাজি। সে সাহস আমাদের আছে, আছে পরিকাঠামাে। তুমি যেদিন সাঁইয়ের আশ্রমে যাবে, তার সাত দিন আগে থেকেই আমাদের সমিতির কিছু ফুল-কন্টাক্ট ক্যারাটেতে এক্সপার্ট ছেলে-মেয়েকে ভক্ত সাজিয়ে পাঠাতে হবে। ওদের যাতায়াত থাকা খাওয়ার খরচ তােমার।


 রবার্ট জানিয়ে ছিলেন, কেন এই লড়াইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে? তােমাদের কোলকাতারই ম্যাজিসিয়ান পি. সি. সরকার জুনিয়র তাে একাই গিয়ে ভক্তদের সামনে ওর বুজরুকি ফাঁস করেছে?

বললাম,

সাঁইয়ের আস্তানায় পা রাখলেই তুমি বুঝতে পারবে, পি. সি. সরকারের
যে গল্পটা শুনেছ, সেটা কত অবাস্তব! ওখানে তিনজন ভক্ত পিছু
একজন করে ক্যারাটে এক্সপার্ট রাখা হয়। বেয়ারা ভক্তদের
হাড়-গােড় ভাঙতেই এদের রাখা হয়। তারপরও আছে
ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা। ওখানে
গেলাম, চ্যালেঞ্জ করলাম, সাঁই ভয়ে
পালালেন—এমনটা অসম্ভব।

 ওখানে অমনটা করলে টুকরাে টুকরাে করে কেটে ফেললেও হদিশ মিলবে না। চ্যালেঞ্জ করলে ধুন্ধুমার কাণ্ড একটা ঘটবেই। আমরা তৈরি। তুমি?

 সবশুনে পরিকল্পনা পাল্টালেন রবার্ট ঈগল। ঠিক হলাে, শুধু বুজরুকিটুকু ক্যামেরাবন্দি করে চুপচাপ চলে আসবেন। তবু আমাদের সমিতির সাহায্য নিলেন। গাইডের ভূমিকা নিল সমিতি।

 সাঁই তাে মহা আনন্দে রবার্টকে ছবি তুলতে দিলেন। বিবিসির প্রােডিউসর ইনচার্জ বলে কথা। পৃথিবী জোড়া প্রচারের প্রলােভন তাে চারটিখানি কথা নয়।

 সাঁইবাবাবা শূন্য থেকে একটা হার এনে দিলেন। সাঁইবাবার সত্যিকার অলৌকিক ক্ষমতা থাকলে তাে জানতেই পারতেন— গােপন ক্যামেরা বন্দি হয়ে গেছে তাঁর হাতসাফাই।

 রবার্ট ঈগলের ফিল্ম ‘গুরু বাস্টর্স’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায় পৃথিবী জুড়ে। এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্রে দেখানাে হয়েছে সাঁইবাবা কীভাবে একজনের হাত থেকে হারটা নিলেন হাতের মুঠোয়। এবং হারটা প্রকাশ্যে হাজির করে দাবি করলেন—শূন্য থেকে সৃষ্টি করলেন। চারবার ‘স্লো মােশনে’ সাঁইয়ের এই হাতসাফাই দেখানাে হয়েছে ফিল্মটিতে। হাতসাফাইকে অলৌকিক ক্ষমতা বলা যায় না। তবে হাতসাফাইকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে কেউ দাবি করলে তাকে প্রতারক বলা যায়।

সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জ: পেটে হবে মােহর!

 এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার বিচিত্র আমার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। রেজেস্ট্রি ডাকে চিঠিটি পাঠিয়েছেন শ্রীসত্যসাঁইবাবার চরণাশ্রিত ‘শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যাশনাল’-এর ভাইসচান্সেলারের সেক্রেটারি অগ্নিকা বসাক। প্যাডের কোনায় লেখা Ref. No. 710/88. 10th April 1988, চিঠিটি এখানে তুলে দিলাম:

মহাশয়,

 ৩০শে মার্চ ৫ই এপ্রিল ১৯৮৮-এর সংখ্যায় ‘পরিবর্তন’-এ আপনার (অ) লৌকিক অভিজ্ঞতার কথা পড়ে আমাদেরও অভিজ্ঞতা হল।

 আমাদের আশ্রমের উপাচার্য শ্রী বিভাস বসাকের নির্দেশক্রমে এক (অ) সত্য ঘটনা আপনাকে জানানাে যাইতেছে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা করা আপনার ইচ্ছাধীন।

 উনার কাছে শ্রীসত্যসাঁইবাবার সৃষ্টি করা কিছু বিভূতি (ছাই) আছে, যে কেউ রবিবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আসতে পারে পরীক্ষা করার জন্য। সম্পূর্ণ খালি পেটে আসতে হবে—সঙ্গে একজন মাত্র দর্শক বা সাক্ষি থাকতে পারে।

 বিভূতি জলে গুলে খাইয়ে দেওয়া হবে। সন্দেহ নিবারণের জন্য গােলা বিভূতির খানিকটা অংশ উনি নিজেই খেয়ে নেবেন। খাবার তিনদিন পরে কম করে ৬টি, বেশি ১১টি স্বর্ণমুদ্রা পাকস্থলী বা অন্ননালীর কোনও অংশে নিজেই সৃষ্টি হবে। চতুর্থ দিনে কোনও সুযােগ্য Surgen-কে দিয়ে operation করে বের করা যাবে, বা প্রত্যেকদিন পায়খানা পরীক্ষা করতে হবে ৩০ দিন পর্যন্ত। ঐ সময়ের মধ্যেই ২৫ নঃ পঃ আকৃতিতে স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যাবে।

 দক্ষিণা—৫০০৲। পশ্চিমবঙ্গ মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে স্বেচ্ছাদান করে রসিদ সঙ্গে আনতে হবে। বিভূতি খাওয়ানাে উপাচার্যের ইচ্ছাধীন। পত্রে আলাপ করে পরীক্ষার দিন ধার্য করতে পারেন। আপনি নিজে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলেই প্রচার করবেন, নতুবা নয়।

 চিঠিটা আমাদের সমিতির অনেকেই পড়ে সাঁইবাবার নামের সঙ্গে জড়িত এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে কোণঠাসা করার সুযােগ পেয়ে উত্তেজিত হলেন। তাঁরা চাইলেন, আমি বিভূতি খেয়ে ওঁদের বুজরুকির ভাণ্ডাফোড় করি। কিন্তু আমার মনে হল—আপাদদৃষ্টিতে উপাচার্যের চ্যালেঞ্জটা যতটা বােকাবােকা ও নিরীহ মনে হচ্ছে, বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত। এই নিরীহ চ্যালেঞ্জের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকমের বিপদজনক হয়ে ওঠার সমস্তরকম সম্ভাবনা।

 ‘শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যাশনাল’-এর উপাচার্যকে আগস্টের শেষ সপ্তাহে চিঠি পাঠিয়ে জানালাম—

 আপনি যে অলৌকিক একটি বিষয় নিয়ে আমাকে সত্যানুসন্ধানের সুযােগ দিচ্ছেন তা জন্য ধন্যবাদ। এই অলৌকিক ঘটনা প্রমাণিত হলে সাঁইবাবার অলৌকিক ক্ষমতাও প্রমাণিত হবে। কিন্তু পাশাপাশি এও সত্যি— আপনি ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার দায় বর্তাবে কেবলমাত্র আপনার উপর। আপনি কৃতকার্য হলে সাফল্যের ক্রিমটুকু খাবেন সাঁইবাবা?— এই ব্যাপারটা আমাদের পছন্দ নয়। আপনার ব্যর্থতার দায় সাঁইবাবা নেবেন কী না, জানতে উৎসুক হয়ে রইলাম। সাঁইবাবার নির্দেশমত বা জ্ঞাতসারেই এই চ্যালেঞ্জ আপনি করেছেন—এটা ধরে নিতেই পারি। কারণ তাঁকে না জানিয়ে তাঁর সম্মান নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানাের দুঃসাহস নিশ্চয়ই আপনার হত না। এমন অবস্থায় পরবর্তী পর্বে লিখিতভাবে জানিয়ে দেবেন, এই চ্যালেঞ্জ সাঁইবাবার নির্দেশ অনুসারে/জ্ঞাতসারে হচ্ছে কিনা?

 বিভূতিতে বিষ নেই—নিশ্চিত করতে খানিকটা বিভূতি খাবেন জানিয়েছেন। সন্দেহ নিরসনের জন্য আপনারা এই সৎ চেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কিন্তু তারপরও যুক্তির খাতিরে বলতেই হচ্ছে—এতে সন্দেহ নিরসন হয় না। কারণ প্রায় সমস্ত বিষেরই প্রতিষেধক বিজ্ঞানের জানা। যুক্তির খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই, আপনি বিভূতিতে বিষ মেশাবেন, তবে বিষটির প্রতিষেধক আপনার ব্যবহারের সুযোেগ পাচ্ছেন। আমি অজানা বিষ খেয়ে ফেললে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে। তিন দিনের মধ্যে আমি মারা গেলে পেটে সােনার টাকা তৈরি হওয়ার প্রশ্নই থাকবে না।

 এই মৃত্যুর জন্য আপনাকে দায়ী বলে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমি যে বিভূতি খেয়েই মারা গেছি—তার প্রমাণ কী? আমি যে মৃত্যুর আগে অন্য কিছু খাওয়ার সময় বিষ গ্রহণ করিনি, তার প্রমাণ কী? খাবারে বিষ মিশে যেতে পারে, কেউ শত্রুতা করে বিষ খাওয়াতে পারে, এমনকী নিজেই কোনও কারণে বিষ খেতে পারি।

 এই অবস্থায় আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলতে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখছি—

 ১) যে কোনও প্রাণীকে বিভূতি খাইয়েই যদি তিনদিন পরে পেটে সােনার টাকা তৈরি করে অলৌকিকত্ব প্রমাণ করা যায়, তবে আমাকে নিয়ে আর টানাটানি কেন? পরীক্ষার জন্য ছাগল-টাগল কিছুকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

 ২) ছাগলটিকে আগের রাতেই আপনার আশ্রমে নিয়ে আসবাে আমরা। উদ্দেশ্য বিভূতি খাওয়ার আগে পর্যন্ত ছাগলটি যে সম্পূর্ণ খালি পেটে আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত করা।

 ৩) সঙ্গে নিয়ে আসবাে পশ্চিমবঙ্গের মুখমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া ৫০০ টাকার রসিদ।

 ৪) ছাগলটিকে বিভূতি খাওয়াবার পর ছাগলটি আমাদের, আপনাদের ও ইচ্ছুক সাংবাদিকদের পাহারায় থাকবে। উদ্দেশ্য—আপনারা যাতে কোনওভাবে ছাগলটিকে স্বর্ণমুদ্রা খাওয়াতে না পারেন।

 ৫) ছাগলটিকে বটপাতা, কাঁঠালপাতা জাতীয় খাবার খাওয়ানাে হবে। খাবারের জোগান দেবেন আপনারা। উদ্দেশ্য যাতে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেলে আপনাদেরকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

 ৬) তিনদিন পর ছাগলটির পেটে এক্স-রে দেখা হবে সােনার টাকা তৈরি হয়েছে কি না। (তখন ‘চ্যালেঞ্জ মানি’ ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা।)

 ৭) টাকা তৈরি হলে সাঁইবিভূতির অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণিত হবে। আমি পরাজয় মেনে নিয়ে আপনার হাতে প্রণামী হিসেবে তুলে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা।

 ৮) ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এই অলৌকিকত্ব দেখার পর সঙ্গত কারণেই আর অলৌকিত্বের বিরােধিতা না করে সত্য-প্রচার করবে এবং আমাদের সমিতির সদস্যরা প্রত্যেকে সাঁইবাবার কাছে দীক্ষা নেবে।

 আপনার তরফ থেকে পেটে টাকা তৈরির বিষয়ে অন্য কোনও গভীর পরিকল্পনা না থাকলে, এবং বাস্তবিকই বিভূতির অলৌকিক ক্ষমতায় আপনি প্রত্যয়ী হলে আমার এই প্রস্তাবগুলাে নিশ্চয়ই গ্রহণ করবেন। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর আমরা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি প্রেস কনফারেন্স্ করে বিষয়টা সাংবাদিকদের জানাব। তারপর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমরা পরীক্ষার দিন ধার্য করে সাংবাদিকদেরও এই সত্যানুসন্ধানে অংশ নিতে আহ্বান জানাব।

 এই পরীক্ষায় আপনি কৃতকার্য হলে তা আমার পরাজয় হবে না; হবে সত্যকে খুঁজে পাওয়া।

 আপনার ইতিবাচক চিঠির প্রত্যাশায় রইলাম।

 উত্তর পেলাম সেপ্টেম্বরে। অগ্নিকা উপাচার্যের পক্ষে আমাকে জানালেন—

 আপনার অমানবিক চিঠিটি পেয়েছি। আপনি শুধু অমানবিকই নন, ভীতু। আপনি নিজে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে চাইছেন অবলা, নিরীহ একটি প্রাণীকে। একটি ছাগল বা মুরগির প্রাণ কি প্রাণ নয়? তাদের প্রাণ কি মানুষের প্রাণের চেয়ে কম মূল্যবান? আপনার ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আমাদের ব্যথিত করেছে।

 অলৌকিকতার প্রমাণ চাইতে হলে এর আপনাকেই বিভূতি খেতে হবে। আপনার কোনও পরিবর্তন চলবে না। আপনি এতে রাজি থাকলে প্রেস কনফারেন্স হাজির থাকতে আমরা রাজি।

 ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ রবিবার প্রেস কনফারেন্স করব ঠিক হল। প্রেস কনফারেন্স প্রেস ক্লাবে না করে ময়দান টেন্টে করব ঠিক করলাম। ময়দান টেন্টটা ডাঃ অরুণকুমার শীলের।

 ৯ ডিসেম্বর ‘আজকাল’-এ এবং ১০ ডিসেম্বর ‘গণশক্তি’-তে প্রকাশিত হল ১১ ডিসেম্বর ময়দানে হতে যাওয়া লড়াইয়ের খবর।

 এসে গেল ১১ ডিসেম্বর। The Telegraph পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তলায় চার কলম জুড়ে (পত্রিকার পরিভাষায় একে বলে anchor story, যা অতি গুরুত্বপুর্ণ) আমার ছবি ও প্রেস কনফারেন্সের খবরটি ছাপা হলাে। খবরটি শিরােনাম ছিল ‘Calcuttan to take on Satya Sai Baba’

 ১২ ডিসেম্বর The Telegraph পত্রিকায় আবার ৪ কলাম জুড়ে খবর। চ্যালেঞ্জে কেউ এল না। সব পত্রিকায় সেদিন খবরটি বেরিয়ে ছিল ছবি সমেত।

 ১১ ডিসেম্বর এসে গেল। সকাল হওয়ার আগেই তাঁবুতে জায়গা নিয়েছি। দুপুর থেকে তাঁবুর লনে পড়েছে কয়েকশ চেয়ার। বিকেলে প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই হাজির কয়েকশাে উৎসাহী জনতা। প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগেই প্রতিটি পত্র-পত্রিকা ও প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিরা টেন্ট ভরিয়েছেন। খবর শুনে এসেছেন দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক। চারটেতে প্রেস কনফারেন্স শুরু করার কথা। তাই শুরু হল। তবে তখনও উপাচার্য, তাঁর সচিব বা কোনও প্রতিনিধির দেখা নেই। মাইকে বারকয়েক আহ্বান জানানাে হল, তাঁরা থাকলে যেন এগিয়ে আসেন। এগিয়ে এলেন না। সাঁইবাবার বিভূতি লীলার মতই এও এক লীলা। নিজের বিভুতির গপ্পো প্রচার, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া এবং চ্যালেঞ্জ গৃহীত হওয়ার পর আপন খেয়ালে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। পুরাণের কুর্ম অবতার চরিত্রটি সাঁইবাবার সম্ভবত সবচেয়ে পছন্দসই। তাই সাঁই অবতারের মধ্যেও বিপদে খােলোসে মুখ লুকোবার প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

 বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন ‘যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা’ ১ম খণ্ড।

ছবি থেকে ছাই

 সত্য সাঁইবাবা সম্বন্ধে এও শুনেছি যে, অনেকের বাড়িতে রাখা সাঁইবাবার ছবি থেকে নাকি পবিত্র ছাই বা বিভূতি ঝরে পড়ে। গত শতকের আটের দশকে কালকাতায় জোর গুজব ছড়িয়ে ছিল যে অনেকের বাড়ির সাঁইবাবার ছবি থেকেই নাকি বিভূতি ঝরে পড়ছে। প্রতিটি মিথ্যে গুজবের মতােই এই ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁদের মুখেই এইসব গুজব শুনেছি তাঁদেরই চেপে ধরেছি। আমার জেরার উত্তরে প্রায় সকলেই জানিয়েছেন যে তাঁরা নজের চোখে বিভুতি ঝরে পড়তে দেখেনি। যাঁরা সত্যিই বাস্তবে ছবি থেকে বিভূতি পড়তে দেখেছেন, তাঁরা শতকরা হিসেবে সংখ্যায় খুবই কম। তাঁরা দেখেছেন ভক্তদের বাড়ির ছবি থেকে বিভুতি পড়তে বা ছবির তলায় বিভূতি জমা হয়ে থাকতে। এই বিভূতি বা ছাই সৃষ্টি হয়েছে দু’রকম ভাবে। (১) কোনও সাঁইবাবার ভক্ত অন্য সাঁই ভক্তদের চোখে নিজেকে বড় করে তােলার মানসিকতায় সাঁইবাবার ছবির নীচে নিজেই সুগন্ধি ছাই ছড়িয়ে রাখে। (২)

সাঁইবাবার ছবির কাচে যদি ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল মাখিয়ে ঘষে
দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল বাতাসের
সংস্পর্শে এলে গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে ছাইয়ের
মতাে ঝরে পড়তে থাকবে।

 ব্যাঙ্গালোের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সাঁইবাবার ওপর অনুসন্ধানের জন্য ১২ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় Saibaba Exposure

Committee। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার উপাচার্য ডঃ নরসিমাইয়া ছিলেন এই কমিটির উদ্যোক্তা। সাঁইবাবার সহযােগিতার অভাবে কমিটি শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে ব্যর্থ হন।

শূন্য থেকে হিরের আংটি

 মেয়েদের একটি বাংলা সাময়িক পত্রিকায় ১৯৮১ সালের জুলাই মাসের সংখ্যায় লেখা হয়েছিল সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটা হিরের আংটি সৃষ্টি করে নাকি পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দিয়েছিলেন। শূন্য থেকে হিরে সৃষ্টির ঘটনা একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে যে কোন জাদুকরই শূন্য থেকে হিরের আংটি এনে দিতে পারেন। আর এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেখালেই কি ওই জাদুকরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ধরে নেওয়া হবে?

শূন্য থেকে সৃষ্টির ক্ষমতা যদি থাকে তবে খোলামেলা
পরিবেশে একা স্কুটার কী একটা মােটর বা
বিমান সৃষ্টি করে উনি দেখান না।

 ব্ল্যাক-আর্টের দ্বারা জাদুকরেরা শূন্য থেকে হাতি বা জিপ-কার সৃষ্টি করেন। জাদুকরদের এই সৃষ্টির মধ্যে থাকে কৌশল। সাধু-বাবাজিদের সৃষ্টির মধ্যে এই ধরনের কোনও কৌশল থাকলে চলবে না। কোনও বাবাজি যদি শূন্য থেকে এই ধরনের বড়-সড় মানের কোন কিছু সত্যিই সৃষ্টি করতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই প্রমাণিত হবে অলৌকিক বলে কিছু আছে, এবং তাবৎ বিশ্বের যুক্তিবাদীরাও আর এইসব নিয়ে কচ্‌কচানির মধ্যে না গিয়ে অলৌকিক বলে কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে নেবে।


কৃষ্ণ অবতার কিট্টি

 সত্তরের দশকের গােড়ায় কর্নাটকের পাণ্ডবপুরে কৃষ্ণের অবতার হিসেবে উপস্থিত হয় বালক কিট্টি। বালকটির মা-বাবা ছাড়া সাঁইবাবাও ঘোষণা করেন, ও ভগবান সাঁই ও ভগবান কৃষ্ণের অবতার সাঁইকৃষ্ণ। ভক্তের ভিড়েরও অভাব হল না। শােনা গেল সাঁই-ভজনের সময় সাঁইকৃষ্ণ শূন্য থেকে পবিত্র সুগন্ধি ছাই তৈরি করে বিলি ভক্তদের মধ্যে। শূন্য থেকে কখনও কখনও সাঁইবাবার ছােট্ট ছবিও তৈরি করে ভক্তদের মধ্যে বিলি করে। ভক্তদের মধ্যে ডাক্তার বা ডক্টরেটেরও অভাব হল না। ব্যাঙ্গালােরের ডঃ জি, ভেঙ্কটরাও আবির্ভূত হলেন এই ধরনের এক ভক্ত প্রচারকারী হিসেবে।

 সাঁইকৃষ্ণের ঈশ্বর-ব্যবসা যখন জমজমাট, সেই সময় ১৯৭৬ সালে ১৫ জুলাই ব্যাঙ্গালাের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ এইচ নরসিমাইয়ার নেতৃত্বে এক অনুসন্ধানকারী দল হঠাৎই হাজির হন সাঁইকৃষ্ণের বাড়িতে। এই দলে ছিলেন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মনােরােগ বিশেষজ্ঞ, জাদুকর, আইনব্যবসায়ী প্রমুখ। দিনটি ছিল সাঁইকৃষ্ণের ভজনার বিশেষ দিন। এই দিনটিতে ভক্তদের সাঁইকৃষ্ণ পবিত্র বিভূতি বিলি করেন। যুক্তিবাদী এই দল ভক্তদের সামনেই সাঁইকৃষ্ণের পােশাকের আড়ালে লুকিয়ে রাখা সুগন্ধি ছাই বের করে দেন। সাঁইকৃষ্ণের এই বুজরুকি ধরা পড়ে যাওয়ার ওর জমজমাট ঈশ্বর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।

যে সাধকরা একই সময়ে একাধিক স্থানে হাজির ছিলেন

 ভারতের অতীত ও বর্তমানে গাদাগাদা অবতারদের সম্বন্ধে শােনা যায় যে, তাঁরা নাকি একই সঙ্গে একাধিক স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শুধু রামঠাকুর বা শ্যামাপদ লাহিড়ীই নন এ যুগের অনেকের সম্বন্ধেই এই ধরনের কথা শুনেছি। আদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাঠাকুরের শ্যালক পরেশ চক্রবর্তীর তান্ত্রিক হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন, একবার তাঁর এক ভক্তের জীবনের অন্তিম লগ্নে উপস্থিত থাকার জন্য ট্যাক্সিতে যাচ্ছিলেন। ট্যাক্সিতে সঙ্গী ছিলেন অসুস্থ ভক্তেরই আত্মীয়। কলকাতার বিখ্যাত যানজটে তাঁর ট্যাক্সি যায় আটকে। পরেশ চক্রবর্তী এই সময় আর একটি দেহ ধারণ করে ভক্তের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করতে তাঁর কাছে হাজির হয়ে দেখা দেন। পরে ট্যাক্সি যখন ভক্তের বাড়িতে পৌঁছয়, তখন সব শেষ। পরেশ চক্রবর্তীকে সেই মুহূর্তে আবার ঘরে ঢুকতে দেখে ভক্তের বাড়ির সকলেই অবাক হয়ে যান। আর বিস্মিত হন, যখন জানতে পারেন যে, যেই সময় তাঁরা রােগীর শিয়রে পরেশ চক্রবর্তীকে দেখেছেন সেই সময় বাস্তবিকপক্ষে তিনি ছিলেন ট্যাক্সিতে। জমাটি গল্প, সন্দেহ নেই!


 আমার ভায়রা পুলিন রায়চৌধুরী ছিলেন পেশায় শিক্ষক। তাঁর বড়দা তান্ত্রিক বলে পরিচিত। তাঁর কাছে শুনেছি, তিনি একবার বিশেষ কাজে ট্রেনে যেতে যেতে মনে পড়ে আজ তাঁর বাড়িতে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাইরে থেকে আসবেন। তিনি বাস্তবে ট্রেনে ভ্রমণ করতে থাকেন এবং আরও একটি দেহ ধারণ করে বন্ধুকে সঙ্গ দেন।

 আমি বলেছিলাম, “আপনি আমার সামনেই দু-জন হয়ে দেখান তাে।” তান্ত্রিক বাবাজি তারপর থেকে আমাকে এড়িয়ে চলেন।


 একই লােকের দু’জায়গায় হাজির হওয়া নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন জাদুকর আলেকজান্ডার হারম্যান-এর একটি সত্যি-গল্প শােনাই। হারম্যান দিন-গ্রেট ছিলেন খেয়ালি প্রকৃতির লােক। তিনি যখন যে শহরে জাদুর খেলা দেখিয়েছেন তখন সেই শহরের লােকেরা দেখেছেন তাঁর দুটো অস্তিত্ব। কখনও শহরের থিয়েটার হাল যে’সময় জাদুর খেলা দেখিয়ে কয়েকশাে লােককে অবাক করে দিয়েছেন, সেই একই সময়ে শহরের বাজারে কয়েকশাে লােক তাঁকে বাজার করতে দেখেছেন। আবার কখনও একই সঙ্গে তাঁকে দেখা যাচ্ছে হলে জাদুর খেলা দেখাতে এবং ঘােড়দৌড়ের মাঠে ঘােড়ার দৌড় দেখতাে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক শাে বা কয়েক হাজার লােক। এসব ক্ষেত্রে শেখানাে-পড়ানাে মিছে কথা সুযােগ নেই। অতএব সে কালের বহু লােকই বিশ্বাস করতেন, হারম্যানের অলৌকিক ক্ষমতা আছে।

 হারম্যানের কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল না। ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও উপযুক্ত সহকারী উইলিয়াম রবিনসন। পরবর্তীকালে এই রবিনসনই চ্যাং লিং সু ছদ্মনামে জাদুর জগতে এসে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুকর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

 অসাধারণ প্রতিভাধর দুই হারম্যান ও রবিনসনের শরীরের কাঠামাের সাদৃশ্যের সুযােগ নিয়ে তাঁরা স্টেজের বাইরেও আর এক খেলায় মেতে ছিলেন। রবিনসন নিখুঁত ছদ্মবেশে হারম্যান সেজে যখন খেলা দেখাতেন তখন হারম্যান হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। ফলে, অলৌকিক জাদুকর হিসেবে প্রচার ও পয়সা লুটেছিলেন হারম্যান ও তাঁর দল।

 একই মানুষের দু’জায়গায় উপস্থিতি সম্বন্ধে যেমন স্বেচ্ছাকৃতভাবে ভুল বােঝানাে সম্ভব, তেমনি আবার অনেক সময় প্রত্যক্ষদর্শীর দেখার ভুলেও এই ধরনের গুজবের সৃষ্টি হয়। কেউ সেই গুজবকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে পরিচিত হতে অসুবিধে কোথায়?

 আপনি কোনও লােককে আপনার পরিচিত লােক বলে কখনও ভুল করেছেন কি? আমার চেহারার সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে এমন ব্যক্তি বৃহত্তর কলকাতাতেই থাকেন। আমরা কলেজ জীবন থেকেই শুনে আসছি, আমাকে নাকি অমুক দিন দমদম স্টেশনে দেখা গেছে। যদিও সেদিন আমি সেখানে যাইনি। এই ধরনের ভুলের শিকার হয়েছি গত পঁচিশ বছরে বােধহয় বার তিরিশেক। দিলীপ সেন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলােক, থাকেন দমদমের চেতনা সিনেমা হলের পাশে। কর্মস্থল কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এককালে আনন্দবাজারে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দিলীপবাবুর ভাইয়ের বউ ও দিলীপবাবুর স্ত্রী একদিন আমার স্ত্রীকে বললেন, “প্রবীরবাবুকে কাল বিকেলে আর এক ভদ্রলােকের সঙ্গে রিকশা করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলাম। সিনেমায় যাচ্ছিলেন নাকি?”

 সেদিন সেইসময় আমি ও আমার স্ত্রী বাড়িতেই ছিলাম।

 আমার এক ভায়রা সুশােভন রায়চৌধুরী একদিন আমাদের বাড়ির কাছেই আমার স্ত্রীকে বলল, “প্রবীর অত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় দৌড়ল?”

 আমার স্ত্রী সীমা বলল, “ও তাে বাড়িতেই রয়েছে।”

 সুশােভন যথেষ্ট জোরের সঙ্গে বলল, “আমি এক্ষুনি দেখেছি ওকে ট্যাক্সি ধরতে।”

 সীমাও বলল, “আমিও এক্ষুনি বাড়ি থেকে আসছি।”

 দু’জনেই এসে হাজির হলাে আমি আছি কিনা দেখতে। আমি অবশ্য বাড়িতেই ছিলাম।

 এই ধরনের আরও অনেক ঘটনাই আমার জীবনে ঘটেছে। শুধু আমার জীবনেই বা বলি কেন?

 আমাদের এক সহকর্মী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য একদিন অফিসে এসে আমাকে বললেন, “তােমার বউকে দেখলাম মিনিবাসে। এক মিনিবাসেই এলাম।”

 আমি জানালাম, “সীমা এখন জামশেদপুরে। অন্য কাউকে দেখেছেন।”

 বিশ্বনাথদা বেশ কয়েকবার সীমাকে দেখেছেন, অতএব ভুল হওয়া উচিত নয়। বিশ্বনাথদা বললেন, “বিশ্বাস করাে, যাকে দেখেছি সে অবিকল সীমার মতাে দেখতে।”

 এই ধরনের ভুল আরও অনেকের জীবনেই হয়েছে। হয়তাে আপনার জীবনেও। যেসব সাধুদের একাধিক জায়গায় একই সময়ে দেখা গেছে, সেগুলাে যে এই ধরনের ভুল অথবা মিথ্যে প্রচার বা কৌশলমাত্র, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। আমার সামনে কোনও অলৌকিক ক্ষমতাধর যদি নিজেকে দু’জন হিসেবে উপস্থিত করতে পারে তবে আমার যুক্তিবাদী সব ধারণাই একান্ত মিথ্যে বলে স্বীকার করে নেব।

এটা সত্যিই দুঃখের যে, লেখাপড়া জানা লােকেদের বেশির
ভাগই অনেক অলৌকিক গাল-গল্পকেই যাচাই না
করে অথবা যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই
বিশ্বাস করে ফেলেন।


অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার তান্ত্রিক ও সন্ন্যাসীরা

আচার্য শ্রীমদ গৌরাঙ্গ ভারতী এবং পাগলাবাবা (বারাণসী) দু’জনেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে পরিচিত। দুজনেরই ভক্ত-সংখ্যা যথেষ্ট। দু’জনেরই নাম একসঙ্গে উল্লেখ করার কারণ দু’জনের অলৌকিক ক্ষমতা একই ধরনের। আমি শুনেছিলাম এঁরা যে-কোন প্রশ্নের উত্তর লিখিতভাবেই দিয়ে থাকেন, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে উত্তরগুলাে নাকি ঠিক হয়।

 আমি ১৯৮৫’র মার্চে গৌরাঙ্গ ভারতীর কাছে গিয়েছিলাম। কিঞ্চিৎ লিখিটিখি শুনে তিনি আমাকে কথা বলার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছিলেন এবং যথেষ্ট খাইয়েছিলেন। কথায় কথায় গৌরাঙ্গ ভারতী বলেন, তিনি বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে অদ্ভুত এক ধরনের অসুখে ভুগছেন। অসুখটা হল হেঁচকি। একনাগাড়ে হেঁচকি উঠতেই থাকে। এ-ও জানালেন কলকাতার তাবড় ডাক্তারদের সাহায্য নিয়েও আরােগ্যলাভ করতে পারেননি।

 আমি কিন্তু গৌরাঙ্গ ভক্তদের কাছে শুনেছি, তিনি বিভিন্ন ভক্তদের দুরারােগ্য রােগ ভাল করে দিয়েছেন। স্বভাবতই গৌরাঙ্গ ভারতীকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আপনার ওপর লেখা একটা বইতে পড়লাম আপনি শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরীমাতার বরপুত্র, বাক্-সিদ্ধ, অতীন্দ্রিয় ঐশী-শক্তির অধিকারী। আপনি নিজে যে কোন দুরারােগ্য রােগ যখন মায়ের কৃপায় সারাতে সক্ষম, তখন নিজের রােগ কেন সারাচ্ছেন না?”

 “পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেব কি নিজের ক্যানসার সারাতে পারতেন না? কিন্তু, তিনি মায়ের দেওয়া রােগ-ভােগকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন,” গৌরাঙ্গ ভারতী উত্তর দিয়েছিলেন।

 আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, “মায়ের দেওয়া রােগকে যদি মেনেই নিতে চান, তবে কেন রোগ সারাবার জন্য আধুনিক চিকিৎশাস্ত্রের সাহায্য নিচ্ছেন?”

 না; সঠিক উত্তর ওঁর কাছ থেকে আমি পাইনি। আমতা আমতা করেছিলেন। তবে যা পেয়েছিলাম তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি দিয়েছিলেন আমার প্রশ্নের সঠিক লিখিত উত্তর। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “আমি কি বিবাহিত?”

 একটা চোট রাইটিং-প্যাডে উত্তরটা লিখে গৌরাঙ্গ ভারতী তাঁর হাতের কলমটা নামিয়ে রেখে আমাকে বললেন, “আপনি কি বিয়ে করেছেন?”বললাম, “হ্যা, করেছি।”

 প্যাডটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেন গৌরাঙ্গ ভারতী। লেখাটা জ্বলজ্বল করছে ‘বিবাহিত’।

 আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন রাখলাম, “আমার প্রথম সন্তান ছেলে না মেয়ে?”

 এবারও উত্তর লিখে কলম নামিয়ে রেখে উনি আমাকে পালটা প্রশ্ন করলেন, “আপনার প্রথম সন্তান কি?”

 বললাম, “ছেলে”।

 “দেখুন তাে কি লিখেছি?” প্যাডটা আবার মেলে ধরলেন আমার সামনে। স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘ছেলে’।”

 দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও ছিল ঠিক। আমার অবাক হওয়া চোখমুখ দেখে গৌরাঙ্গ ভারতী আমাকে দুম্ করে ‘আপনি’ থেকে ‘তুই' সম্বােধন করলেন। বললেন, “কি, অবাক হচ্ছিস? এমনি অবাক আরও অনেকেই হয়েছে। বিজ্ঞানচার্য সতেন্দ্রনাথ বসু, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, সাংবাদিক তুষারকান্তি ঘােষ, চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, ভারত বিখ্যাত ডাক্তার আই এস রায়, ডাঃ সুনীল সেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ সেন, বিশ্বজয়ী সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর, কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শঙ্করপ্রসাদ মিত্র, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অমরেন্দ্রনাথ সেন, পশ্চিমবাংলা বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ বিজয়কুমার ব্যানার্জি, সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার, শৈলজানন্দ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র কতজনের আর নাম বলব। একটা বই আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুই বইটা পড়লে আরও অনেকের নাম দেখতে পাবি।”

 বললাম, “আগেই পড়েছি। হ্যা, বইয়ে অবশ্য এঁদের নাম দেখলাম।”

 “আর কিছু প্রশ্ন করবি?”

 বললাম, “বলুন তাে, আমার বাবা-মা দুজনেই বেঁচে?”

 “তাের ভবিষ্যৎ জানতে না চেয়ে তুই শুধুই দেখছি আমাকে পরীক্ষা করছিস। ভাল, এমনি বাজিয়ে নেওয়াই ভাল। রামকৃষ্ণের অনেক ভক্ত থাকা সত্ত্বেও বিবেকানন্দ কিন্তু ভক্তদের বিশ্বাসে আস্থা না রেখে নিজে রামকৃষ্ণের খাঁটিত্ব পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। আর তাইতেই তাে শেষ পর্যন্ত বিবেকানন্দই হয়ে উঠেছিলেন। রামকৃষ্ণের এক নম্বর ভক্ত। কোন কোন বিখ্যাত লােকেরা আমার ভক্ত তা দেখে-শুনেই যে তাের মাথা গুলিয়ে যায়নি এটা খুব ভালাে লক্ষণ। তুই যে খুব বড় হবি এটা তারই পূর্বাভাস। গৌরাঙ্গ ভারতী প্যাডে আমার প্রশ্নের উত্তর লিখে কলম সরিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তাের বাবা-মা দুজনেই বেঁচে?”

 বললাম, “দুজনেই মারা গেছেন!”

 গৌরাঙ্গ ভারতী প্যাডটা ধরলেন আমার সামনে। আমি যা বলেছি তাই লেখা রয়েছে।

 এবার আবার আমার অবাক হওয়ার পালা। কারণ উত্তরটা আমি এবার মিথ্যে করেই দিয়েছিলাম। বাস্তবে তখন আমার মা-বাবা দুজনেই জীবিত। বুঝলাম আমি যা উত্তর দেব তাই প্যাডে লেখা দেখতে পাব। সেই রাত বাড়ি ফিরেই আমি আমার ছেলে পিনাকী ও স্ত্রী সীমাকে বললাম, “তােমরা আমাকে এমন কিছু প্রশ্ন করাে যার উত্তর তােমরা জানাে। আমি লিখিতভাবে সঠিক উত্তর বলে দেব” শেষ পর্যন্ত সঠিক উত্তর লিখে দিলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে। পরের দিন আমাদের বাড়ির কাজের বউটিকে, অফিসের কয়েকজন সহকর্মীকে, আকাশবাণীর ডঃ অমিত চক্রবর্তীকে এই একই ধরনের প্রশ্নের সঠিক উত্তর লিখে দিয়ে চমকে দিলাম। তারপর অবশ্য মনােরােগ চিকিৎসক ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার হেডকোয়ার্টার সুবিমল দাশগুপ্তকে এক সামান্য

থট্‌-রিডিং-এর আসল রহস্য

কৌশলেই অবাক করে দিয়েছিলাম। মনে আছে, সুবিমলবাবু ও ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেম্বারে বসেই বলেছিলেন, বলুন তাে আমরা ক’ভাইবােন? আপনি যদি বলতে পারেন তাে বুঝব আপনার অলৌকিক ক্ষমতা আছে।

 ধীরেনদারই একটা প্যাডে সঠিক উত্তর লিখেছিলাম। তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিলেন এককালের কলকাতা পুলিশের গােয়েন্দা দপ্তরের সর্বময়কর্তা সুবিমলবাবু।

 আমার লেখা শেষ হতেই কলমটা সরিয়ে রেখে বলেছিলাম, “উত্তর লেখা হয়ে গেছে। এবার আপনি বলুন তাে, আপনারা ক’ ভাইবােন?”

 “আমি কেন বলব। আপনিই বলুন, “সুবিমলবাবু বলেছেন।

 “উত্তর তাে লেখা হয়েই গেছে। আর পরিবর্তন করার কোনও সুযােগ নেই। এবার শুধু দেখার পালা, সঠিক উত্তর দিতে পেরেছি কী না।”

 সুবিমলবাবু আমার যুক্তি মেনে নিয়ে উত্তর দিলেন, “ছয়।”

 প্যাডটা মেলে ধরলাম, তাতেও লেখা হয়েছে—ছয়।

 সুবিমল দাশগুপ্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অবাক কণ্ঠে বললেন, “আশ্চর্য তাে। আমার ক’জন ভাইবােন তা আপনার পক্ষে জানা অসম্ভব। সত্যি, আজ অদ্ভুত এক অলৌকিক-ক্ষমতা দেখলাম!”

 সুবিমলবাবুকে বললাম, “আপনি যেটাকে অলৌকিক বলে ভাবলেন, সেটা আদৌ কিন্তু কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে নেহাতই কৌশল।”

 “অসম্ভব। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন, এটা কৌশল?” সুবিমলবাবু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন আমাকে।

 কৌশলটা আরও অনেকের মতােই সুবিমলবাবুকেও শিখিয়ে দিলাম। প্যাডে সম্ভাব্য প্রতিটি উত্তরই লিখে রাখি। তারপর প্রশ্নকর্তার কাছ থেকেই উত্তর শুনে নিয়ে কাগজটা কায়দা মতাে ভাজ করে, এবং ডান বা বাঁ হাতের বুড়াে আঙুলের সাহায্যে উত্তর ছাড়া বাকি লেখাগুলাে ঢেকে দিই। ফলে সকলে শুধু উত্তরটাই দেখেন। গৌরাঙ্গ ভারতীর মতােই পাগলাবাবা বারাণসীর ভক্তদের মধ্যেও রয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত বহু ব্যক্তি।

 আরও অনেক অলৌকিক ক্ষমতাধরও (?) নিশ্চয়ই আছেন, যাঁরা লিখে উত্তর দিয়েই কাত করে দিচ্ছেন বহু জ্ঞানী-গুনীজনকে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই সুবিমল দাশগুপ্তের মতােই ঘটনার পেছনে নিজস্ব কোনও যুক্তি খাড়া করতে না পেরে ধরে নেন ঘটনাটা অলৌকিক।

সাধারণত আমরা যখন কোন অলৌকিক ঘটনা দেখি তখন সেই
ঘটনার পেছনে কোনও যুক্তি নিজেরা খাড়া করতে না পারলেই
ধরে নিই ঘটনাটা নিশ্চয়ই অলৌকিক। কখনই ভাবি না
যে, এই ঘটনার পেছনে অবশ্যই আমার অজানা
কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। এর কারণ
অহং বােধ। আমি কী আর
ভুল দেখেছি!

কামদেবপুরের ফকিরবাবা

প্রথম যৌবনে উত্তর ২৪ পরগনার কামদেবপুরের ফকির বাবার অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে একসময় যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়েছিলাম। শুনলাম ফকিরবাবা নাকি যে কোনও রােগীর রােগ সারিয়ে দিতে পারেন। চিত্রাভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের নাকি লিউকোমিয়া হয়েছিল। এ-দেশ ও বিদেশের প্রচুর চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সুচিত্রাকে রােগমুক্ত করতে পারেনি। ফকিরবাবার কথা শুনে শেষ ভরসা হিসেবে সুচিত্রা ছুটে এসেছিলেন কামদেবপুরে। ফকিরবাবা নাকি প্রমাণ করেছিলেন বিজ্ঞানের বাইরেও কিছু আছে। বাবার কৃপায় সুচিত্রা নাকি রােগমুক্ত হয়েছিলেন।

 শনি, মঙ্গলবার ফকিরবাবা তাঁর গুরুদেব গােরাচাঁদ পীরের সমাধির ওপর তৈরি একটা ঘরে বসেন। পীরের সমাধির ওপর বসে থাকলে ফকিরবাবার উপর গােরাচাঁদ পীরের ভর হয়। ঘরের দরজা থাকে বন্ধ। এক এক করে দর্শনার্থীদের নাম ডাকা হয়। দর্শনার্থী বন্ধ ঘরের বাইরে বসেন। ফকিরবাবা অ-দেখা মানুষটির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং সমস্যা সমাধানের উপায় সবই বলে দেন ভরের ঝোঁকে। সমস্যার সমাধান বা রােগমুক্তির ওষুধ নিতে প্রার্থীদের আবার আসতে হয় শুক্র ও রবিবার।

 ঠিক করলাম, ফকিরবাবার কাছে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যাব। ১৯৬৬-র এপ্রিলের এক শনিবার সকালে আমরা পাঁচ বন্ধুতে বেরিয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গী ছিল তপন, গােরা, দিলীপ ও সমীর। তপন ও গােরা তখন সরকারি চাকুরে। দিলীপ কস্টিং ও চাটার্ড পড়ছে। সমীর বাবার কনস্ট্রাকশন বিজনেস দেখছে। আমি স্নাতক হতে তৈরি হচ্ছি ও ছাত্র পড়াচ্ছি।

 বারাসাত থেকে ৮ কিলােমিটারের মতাে উত্তরে কামদেবপুরের ফকিরবাবার আস্তানা। পৌঁছে অবাক। সাতসকালে প্রায় মেলা বসে গেছে। বহু সহযাত্রীদের সঙ্গেই ইতিমধ্যে বাসেই আলাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বা রােগমুক্তির আশায় চলেছেন। অনেকে আমাদের পরিচয় ও আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন, বললাম।

 টাকা-পয়সা দিয়ে নাম লিখিয়ে এবার আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষার পালা। ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে, দোকানে দোকানে চা, কচুরি, জিলিপি খেয়ে আর ফকির বাবার কয়েকজন ভক্ত শিষ্যের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটালাম। ফকিরবাবার সম্বন্ধে অনেক খবরই পেলাম। ফকিরবাবা নাকি এই অলৌকিক ক্ষমতা পেয়েছেন তাঁর স্বপ্নে পাওয়া গুরুদেব গােরাচাঁদ পীরের কাছ থেকে। গােরাচাঁদ পীর দেহ রেখেছেন ৭০০ বছর আগে। আসল নাম ছিল পীর হজরত সৈয়দ আব্বাস আলী। গৌরবর্ণের সৌম্য দর্শন পীরটিকে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা নাকি ভালবেসে নাম দিয়েছিলেন গােরাচাঁদ।

 স্বপ্নাদেশ পেয়ে ফকির হবার আগে ফকিরবাবা সুর্য নামে পরিচিত ছিলেন। পুরাে নাম, সূর্যকুমার মাইতি। ব্যবসা ছিল দুধ বিক্রি করা ও কবিরাজি। সুর্য মাইতির বাবা প্রিয়নাথ ছিলেন কবিরাজ। ছেলে সূর্য ওষুধ তৈরিতে সাহায্য করতেন। বর্তমানে সূর্য মাইতি ওরফে ফকিরবাবার চার মেয়ে দুই ছেলে। ছেলেরা বাবাকে সাহায্য করছেন। কামদেবপুরের দোকানি-পশারিরাও ফকিরবাবার পরম ভক্ত। ফকিরবাবার অনেক অলৌকিক ঘটনার কথাই শুনলাম। ভরে ফকির বাবা ত্রিকালদর্শী হয়ে ওঠেন। তখন বন্ধ দরজার ওপাশে মানুষটি বসলেই বাবা তাঁর সব-কিছুই জানতে পারেন। এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না, সপ্তাহের চারটে দিন বাবার কল্যাণে কামদেবপুরের আশপাশের বহু মানুষ দোকান-পশার করে দু-পয়সা ঘরে তুলছে।

 কোনও কিছু চুরি গেলে বা হারিয়ে গেলে অবশ্য ফকিরবাবার কাছে এসে লাভ নেই। একটা সাইনবাের্ডে লেখাই আছে, চুরি বা হারানাের জন্য আসবেন না।

 দেখলাম, ভক্তদের কৃপায় বাবার অর্থের অভাব নেই। গাড়ি, বাড়ি সবই আছে।

 একসময় আমাদের ডাক পড়তে শুরু করল। আমার ডাক পড়তে ফকিরবাবার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, “আমি কি শিগগির কোনও চাকরি-বাকরি পাব বাবা?”

 বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, “না, চাকরি তাের হবে না। কাঁচা আনাজের যে ব্যবসা এখন করছিস, তাই আরও বেশ কিছু বছর করতে হবে।”

 ১৯৬৬-র মে মাসেই, অর্থাৎ ঠিক তার পরের মাসেই আমি স্টেট ব্যাঙ্কে যােগ দিই।

 কাঁচা-আনাজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক চিরকালই ক্রেতা হিসেবে। ফকিরবাবার এই ধরনের ভুল করার কারণ, আমাদের পাঁচ বন্ধুর পােশাক, কথাবার্তা, আলােচনা সবই ছিল মুদির দোকানি ও কাঁচা-আনাজের ব্যবসায়ীর মতাে। ফকিরবাবার খবর সংগ্রহকারীরা তাই আমাদের সঙ্গে আলাপ করে আমাদের নামের সঙ্গে যে পরিচয় ফকিরবাবাকে দিয়েছিল, ফকিরবাবা সেই পরিচয়কেই সত্যি বলে ধরে নিয়ে ছিলেন। তাই আমাদের পাঁচ বন্ধুর সমস্যা ও জীবিকা সম্পর্কেই পুরােপুরি ভুল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আগরতলার ফুলবাবা

১৯৮৬-র ২৮ ফেব্রুয়ারি। আগরতলা প্রেস ক্লাবের হলে একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরােনামের অলৌকিক বিরােধী এই প্রেস কনফারেন্সে যােগ দিতে আমি তিনদিন আগেই আগরতলা পৌছেই। সেখানে এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে প্রথম ফুলবাবার কথা বলেন। তাঁর কথামতো ত্রিপুরার সবচেয়ে ক্ষমতাবান অবতার এই ফুলবাবা। ইতিমধ্যে স্থানীয় তিনটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও কিছু সংগঠন এবং সেই সময়কার ত্রিপুরা বিধানসভার উপাধ্যক্ষ বিমল সিনহা ফুলবাবার বিপুল জনপ্রিয়তার কথা বলেছিলেন।

 শনি, মঙ্গলবার সকাল থেকেই ফুলবাবার আশ্রম ঘিরে বিশাল ভিড় জমে ওঠে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন রােগ মুক্তি আশায় ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের আশায়। কামদেবপুরের পীরের মতােই এখানেও দর্শনার্থীরা সকালে নাম লিখিয়ে

কামদেবপুরের ফকিরবাবা

অপেক্ষা করতে থাকেন। দুপুর থেকে দর্শনার্থীদের ডাক পড়তে থাকে। ফুলবাবাও ফকিরবাবার মতােই ভক্তদের নাম শুনেই বলে দিতে থাকেন কী সমস্যা নিয়ে তাঁরা এখানে এসেছেন। কাউকে হয়তাে বলেন, “কীরে, মায়ের অসুখ?” আবার কাউকে বলেন, “অফিসের কাজে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে, না রে?”

 অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় ফুলবাবা কৃপাপ্রার্থীদের মনের কথাই বলে দিয়েছেন। যাঁদেরটা মেলে তাঁরা ফুলবাবার এমন অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে মুগ্ধ হয়ে বাবার মহিমা প্রচারে নেমে পড়েন। স্বভাবতই বাবার জীবন্ত কিংবদন্তি হতে অসুবিধে হয় না।

 বাবাকে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখার ইচ্ছেয় ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি এক স্থানীয় সাংবাদিক পারিজাতকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম ফুলবাবার ডেরায়। যদিও সেদিন বৃহস্পতিবার, তবু ভিড়ের খামতি ছিল না। ফুলবাবা মন্দিরের সামনের চাতালেই বসেছিলেন। সাংবাদিক বন্ধুটি ফুলবাবাকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় করালেন। আমার পরিচয় দিলেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে। বাবাকে প্রণাম করলাম। বাবা আমার সারা শরীরে চোখ বােলালেন। আমার গলায় ও আঙুলে ছিল ঘণ্টা কয়েক আগে ধার করে পরা রুদ্রাক্ষের মালা ও প্রবালের আংটি। বাবা ও-দুটি দেখে নিশ্চিন্ত হলেন আমি নাস্তিক নই। বাবা আশীর্বাদ করে বসতে বললেন।

 ফুলবাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁর সম্পর্কে কিছুকিছু শুনলাম। বর্তমান বয়স ৫৬। আদি নিবাস বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। আগরতলায় চলে আসেন ২২/২৩ বছর আগে। সাধকজীবনের আগে নাম ছিল শান্তিকুমার দে। মহারাজ অদ্বৈতানন্দ পুরীর কাছে দীক্ষা। ফুলবাবার আশ্রমে রয়েছে ভুবনেশ্বরী দেবীর মূর্তি। মা ভুবনেশ্বরীই ফুলবাবার একমাত্র আরাধ্যা দেবী। মা ভুবনেশ্বরীর অপার কৃপার ফুলবাবা যে কোনও মানুষের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখতে পান। মায়ের কৃপাতেই মানুষের সমস্যার সমাধান করেন।

 শাক্ত হলেও ফুলবাবার কথায় ছিল বৈষ্ণবের পেলবতা। বাবার আদেশমতাে একজন ইতিমধ্যে রেকাবিতে প্রসাদি সন্দেশ নিয়ে এলেন। সন্দেশ আর জলপানের পর আমার সমস্যার কথা বললাম।—রােজগারপাতি মন্দ করছি না। একটা ফ্ল্যাটও কিনেছি। ঘর হলেও ভাগ্যে এখন ঘরণী জোটেনি। একটি মেয়েকে ভালবাসতাম। বছর তিনেক আগে ওর সঙ্গে আমার বিয়ের তারিখ ঠিক হলাে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ওর ক্যানসার ধরা পড়ল। মাস তিন-চারেকের মধ্যে বেচারা মারা পড়ল। এরপর আরও দু’জায়গায় বিয়ের কথা কিছুটা এগােলেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচিওর করেনি। যথেষ্ট বয়েসও হয়েছে।

 ফুলবাবা অভয় দিলেন। দুর্ভোগ দিন শেষ হয়েছে। এবার ভােগের দিন শুরু। আর তাই তাে মা ভুবনেশ্বরী আপনাকে আজকে টেনে এনেছেন। যাঁর সঙ্গে আপনার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তিনি সমস্ত দিক থেকেই ছিলেন আপনার উপযুক্ত। আপনারা দুজনেই দু’জনকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। যিনি দেওয়ার তিনিই তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনিই আবার দেবেন। আগামী ১৯৮৭-র আগস্টের মধ্যে আপনার বিয়ে হবে। ভাল বিয়ে।

 ফেরবার পথে সাংবাদিক বন্ধুটিকে দেখলাম ফুলবাবার ক্ষমতার দৌড় দেখে অবাক। আমার অবশ্য অবাক হওয়ার মতাে কিছু ছিল না। জানতাম, আমার বলা কথাগুলাে যে পুরােটাই গপ্পো, সেটুকু ধরার মতাে অলৌকিক ক্ষমতা আর সব অবতারদের মতােই ফুলবাবারও নেই। আমি বিবাহিত, একটি পুত্রের পিতা। ফ্ল্যাট কিনিনি। এবং প্রসঙ্গত জানাই ’৮৯-এর এই ডিসেম্বরেও আমার নতুন করে কোনও বিয়ে হয়নি। প্রেমিকার ক্যানসারে মৃত্যু? সেটাও নিছকই গপ্পো কথা।


 ২৮ ফেব্রুয়ারির প্রেস কনফারেন্সে বিভিন্ন আলােচনার মাঝে ফুলবাবার প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলাম, “আপনাদের অনেকের কাছেই ফুলবাবা জীবন্ত অলৌকিকতার প্রতীক। তাঁর কাছে আপনাদের কেউকেউ হয়ত ফুলবাবার কাছে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে হাজির হয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন, আপনার আসার উদ্দেশ্য ফুলবাবার অজানা নয়। আপনাদের কারও কারও একান্ত ব্যক্তিগত কিছু অতীত ঘটনাও ফুলবাবা বলে দিয়েছেন, এই অভিজ্ঞতাও বােধহয় এখানে উপস্থিত কারও কারও আছে।

 আপনারা নিশ্চয়ই ভেবেছেন—আমাকে তাে ফুলবাবা আগে থেকে চিনতেন না। তবে কি করে তিনি আমার আসার উদ্দেশ্য, অতীতের ঘটনা সবই ঠিক-ঠাক বলে দিলেন? শেষ পর্যন্ত আপনাদের যুক্তিতে এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে ধরে নিয়েছেন ফুলবাবা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।

 ত্রিপুরায় আমি নির্ভেজাল আগন্তুক। সদ্য দিন দুয়েক হলাে এসেছি। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে হাতে গােনা দু’চারজন ছাড়া সকলেই আমার অপরিচিত। অপরিচিত দর্শকদের কাছে অনুরােধ, আপনারা যারা নিজেদের অতীত আমার মুখে শুনতে আগ্রহী, হাত তুলুন। পরিচিতদের প্রতি অনুরােধ, আপনারা অনুগ্রহ করে হাত তুলবেন না। অবশ্য এই পরিচিতদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছে মাত্র দিন দু’য়েক। অতএব তাঁদের অতীতের খুঁটিনাটি জানার মতাে সময়-সুযােগ এখনও ঘটেনি।

 বিরাট সংখ্যক দর্শক হাত তুললেন। বললাম, আপনাদের সবার অতীত বলতে গেলে তাে রাত কাবার হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং আপনারাই ঠিক করুন, কার অতীত বলব। আপনারা যাঁরা হাত তুলেছেন, ব্যবস্থাপকরা আপনাদের প্রত্যেকের হাতে এক টুকরাে করে কাগজ তুলে দেবে। আপনারা তাতে নিজেদের নাম লিখে ফেলুন।”

 একটা ফাঁকা বাক্স দেখিয়ে বললাম, “আমি এই বাক্সটা নিয়ে আপনাদের কাছে যাচ্ছি। আপনাদের নাম লেখা কাগজের টুকরােগুলাে এই বাক্সতে ফেলুন।”

 তাই হল। এবার দর্শকদের অনুরােধ করলাম, “আপনাদের মধ্যে থেকে একজন কেউ আসুন, এবং চোখ বুজে এই নামগুলাে থেকে একটা নাম তুলে দিন।”

 একজন এলেন। নাম তুললেন। বললাম, “এবার নামটা পড়ে শােনান।”

 তিনি পড়লেন। বললাম, “যার নাম পড়া হলাে তিনি এবার উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে মাইক্রোফোনের একটা মাউথ-পিস্ ধরিয়ে দিলাম।

 বললাম, “আমি এবার আপনার অতীত সম্পর্কে বলতে শুরু করছি। মিললে হ্যাঁ বলবেন। না মিললে না।”

 আমি শুরু করলাম, “আপনি কি ১৯৭৩ সালে চাকরি পেয়েছেন?”

 —“হ্যাঁ।”

 —“বিয়ে’ ৮০তে।”

 —“হ্যাঁ।”

 —“৮২-তে পুত্রলাভ?”

 “হ্যাঁ”

 —“৮৪-তে প্রমােশন।”

 —৮৩-তে বাবা মারা যান।”

 —“হ্যাঁ।”

 —“আপনার তাে একটিই সন্তান।”

 —হ্যাঁ।”

 এমনি আরও অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলাম, আর প্রতিটির ক্ষেত্রেই উত্তর পেয়েছিলাম, “হ্যাঁ”।

 উপস্থিত দর্শকরা ঘটনার নাটকীয়তা দারুণ রকম উপভােগ করেছিলেন। টান-টান উত্তেজনায় তুমুল হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। দর্শকদের এই বিমূঢ় বিস্ময়ের পেছনে আমারও সেই কৌশলই ছিল, যা ফুলবাবা এবং কামদেবপুরের ফকিরবাবা প্রয়ােগ করে থাকেন।

 প্রেস ক্লাবের হলে এসে আমি দুতিনজনকে আমার লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করে নিয়ে দ্রুত তাঁদের সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করেছিলাম ব্যবস্থাপকদের সহায়তায়। তারপর সামান্য জাদু কৌশলের সাহায্যে আমার ইচ্ছে মতাে ব্যক্তিটির নাম তুলতে বাধ্য করেছিলাম। আর তারপরই ঘটিয়ে ফেললাম অসাধারণ অলৌকিক (?) ঘটনা।

অবতারদের নিজদেহে রোগ গ্রহণ

বহু বিখ্যাত ও অখ্যাত সাধু-সন্ন্যাসী বা জীবন্ত ভগবানের সম্বন্ধে শুনেছি, তাঁরা অনেক দুরারােগ্য রােগ সারাতে পারেন। এমনকী যে সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, এইসব সাধুজনেরা তাও আরােগ্য করতে সক্ষম। এই সব অবতারেরা যখন কঠিন রােগে আক্রান্ত হন, তখন শােনা যায় ভক্তের কঠিন রােগ গ্রহণ করার জন্যেই নাকি অবতারের এই অবস্থা।

 গৌরাঙ্গ ভারতী একটা অদ্ভুত রােগে দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। হেঁচকি রােগ। যখন-তখন অনবরত হেঁচকি ওঠে। তিনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন, অনেক বড়-বড় ডাক্তার দিয়ে নাকি চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কোনও ফল পাননি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি তাে ভক্তদের যে কোন রােগই সারিয়ে দেন বলে শুনেছি, তবে কেন নিজে ভুগছেন?”

 “রামকৃষ্ণ কী নিজের অসুখ সারাতে পারতেন না? তিনি কেন সারালেন না, কারণ একটাই। মা যখন রােগ-ভােগ দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই ভােগ করব। অন্যের হয়ে মায়ের কাছে বলার জন্য ওকালতনামা নিয়েছি। নিজের কিছু চাওয়ার জন্য নয়,” বলেছিলেন গৌরাঙ্গ ভারতী।

 ওই ধরনের সুন্দর পাশকাটানাে জবাব যেমন অনেকে দেন তেমনি সাঁইবাবা বা অনুকুলচন্দ্র ঠাকুরের মতাে অনেকের সম্বন্ধেই ভক্তরা দাবি করেন—এঁদের অসুস্থতার কারণ ভক্তের রােগ গ্রহণ। সাঁইবাবার একবার অ্যাপেণ্ডিসাইটিস অপারেশন করা হয়। ভক্তরা অনেকেই বিশ্বাস করেন, এক ভক্তের রােগগ্রস্ত অ্যাপেণ্ডিক্সের সঙ্গে নিজের সুস্থ অ্যাপেণ্ডিক্সের অদল-বদল করে নিয়েছিলেন সাঁইবাবা। হায় অন্ধ বিশ্বাস!

 তাঁরা ভেবে নিলেন অলৌকিক ক্ষমতায় বিনা অস্ত্রোপচারেই অ্যাপেণ্ডিক্স বদল হয়ে গেল। যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এতাে বড় একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারলেন, তিনি নিজের অ্যাপেণ্ডিক্সের সামান্য প্রদাহটুকু বন্ধ করতে পারলেন না, এটাই আমাকে আরও বেশি আশ্চর্য করেছে।

যিনি অন্যের রােগ সারাতে পারেন, তিনি কেন নিজের রােগ সারাতে
পারেন না? ভক্তদের মনের এই প্রশ্ন ও সংশয়ের নিরসনের
জন্যই বাবাজিদের এই সব রােগ গ্রহণের মতাে
গালগল্পের আশ্রয় নিতে হয়।

 এর পরেও অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন, অমুক সাধুর দেওয়া ওষুধে তাঁর অসুখ সেরেছে। আমি বলি, নিশ্চয়ই সারতে পারে। সাধু বলে কী তাঁর চিকিৎসা করার মত জ্ঞান থাকতে নেই? এর মধ্যে অলৌকিকত্ব কোথায়?

বিশ্বাসে অসুখ সারে

অনেক সময় ওষুধ ছাড়াই এই সব অবতারেরা অনেক রােগ নিরাময় করেন। অনেক সময় ওষুধ ছাড়াও রােগ কমে। সেইসব রােগ কমার কারণ অলৌকিকত্ব নয়। কারণ অনেক অসুখ আপনা-আপনি সারে। শরীরের রােগ প্রতিহত করার ক্ষমতায় সারে। এই অবসরে একটি ঘটনা বলি ১৯৮৭-র মে মাসের এক সন্ধ্যায় কলকাতার থেকে প্রকাশিত একটু সুপরিচিত পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক এক সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং জনৈক ভদ্রলােক।

 চিকিৎসক জানালেন বছর আড়াই আগে সম্পাদকের স্ত্রী ডান উরুতে একটা ফোড়া হয়েছিল। ছােট অস্ত্রোপচার, প্রয়ােজনীয় ইঞ্জেকশন ও ওষুধে ফোঁড়ার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। কিন্তু এরপর ওই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থান নিয়ে শুরু হয় এক নতুন সমস্যা। মাঝে-মাঝেই উরুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত ও তার আশপাশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কখনও ব্যথার তীব্রতায় রােগিণী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে যেসব চিকিৎসকদের দেখান হয়েছে ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই কলকাতার শীর্ষস্থানীয়। ব্যথার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এঁরা খুঁজে পাননি। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, এক্স-রে ছবি ও রিপোর্ট সবই দেখালেন আমাকে।

 আমি পেশায় মানসিক চিকিৎসক না হলে মাঝে-মধ্যে এই ধরনের কিছু সমস্যা নিয়ে কেউ কেউ আমার কাছে হাজির হন। কাউন্সিলিং করি বা পরামর্শ দেই। রােগিণীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে উরুর শুকনাে ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললাম, “একবার খড়্গপুরে থাকতে দেখেছিলাম একটি লােকের হাতের বিষ-ফোড়া সেপটিক হয়ে, পরবর্তীকালে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, সামান্য ফোড়া থেকেও এই ধরনের ঘটনাও ঘটে।”

 রােগিণী বললেন, “আমি নিজেই এই ধরনের একটা ঘটনার সাক্ষী। মেয়েটির হাতে বিষফোড়া জাতীয় কিছু একটা হয়েছিল। ফোড়াটা শুকিয়ে যাওয়ার পরও শুকনাে ক্ষতের আশেপাশে ব্যথা হতাে। একসময় জানা গেল, ব্যাথার কারণ গ্যাংগ্রিন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাঁধ থেকে হাত বাদ দিতে হয়।”

 যা জানতে গ্যাংগ্রিনের গল্পের অবতারণা করেছিলাম তা আমার জানা হয়ে গেছে। এটা এখন আমার কাছে দিনের মতােই স্পষ্ট যে, সম্পাদকের স্ত্রী ফোঁড়া হওয়ার পর থেকেই গ্যাংগ্রিন স্মৃতি তাঁর মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই ফোড়া থেকেই আবার গ্যাংগ্রিন হবে না তাে? এই প্রতিনিয়ত আতঙ্ক থেকেই একসময় ভাবতে শুরু করেন, “ফোড়া তাে শুকিয়ে গেল, কিন্তু মাঝে-মধ্যেই যেন শুকনাে ক্ষতের আশেপাশে ব্যথা অনুভব করছি? আমারও আবার গ্যাংগ্রিন হল না তাে? সেই লােকটার মতােই একটা অসহ্য কষ্টময় জীবন বহন করতে হবে না তাে?”

 এমনি করেই যত দুশ্চিন্তা বেড়েছে, ততই ব্যথাও বেড়েছে। বিশ্বাস থেকে যে ব্যথার শুরু, তাকে শেষ করতে হবে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই। |

 আমি আরও একবার উরুর শুকনাে ক্ষত গভীরভাবে পরীক্ষা করে এবং শরীরের আর কোথায় কোথায় কেমনভাবে ব্যথাটা ছড়াচ্ছে, ব্যথার অনুভূতিটা কী ধরনের ইত্যাদি প্রশ্ন রেখে গম্ভীর মুখ একটা নিপাট মিথ্যে কথা বললাম, “একটা কঠিন সত্যকে না জানিয়ে পারছি না, আপনারও সম্ভবত গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে একটু একটু করে।”

 আমার কথা শুনে রােগিণী মােটেই দুঃখিত হলেন না। বরং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “আপনিই আমার অসুখের সঠিক কারণ ধরতে পেরেছেন।”

 আমি আশ্বাস দিলাম, “আমি অবশ্য নিশ্চিত নই, তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, আমার অনুমান ঠিক কি না। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে আপনার কর্তাটিকে একটু কষ্ট করতে হবে। বিদেশ থেকে ওষুধ-পত্তর আনাবার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখবেন, তারপর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”


 রােগ সৃষ্টি ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবােধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের শরীরে বহুরােগের উৎপত্তি হয় ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকে। আমাদের মানসিক ভারসাম্য নির্ভর করে সামাজিক পরিবেশের ওপর। সমাজ জীবনে অনিশ্চয়তা, প্রতিযােগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধর্মোন্মাদনা, জাত-পাতের লড়াই ইত্যাদি যত বাড়ছে দেহ-মনজনিত অসুখ বা Psycho-somatic disorder তত বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে বলে এই সময় তাঁদের অনেকে দেহ-মনজনিত অসুখের শিকার হয়ে পড়েন।

 মানসিক কারণে যে-সব অসুখ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথার ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, স্পন্ডালাইটিস আরথ্রাইট্রিস, বুক ধড়ফড়, পেটের গােলমাল, পেটের আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি অবসাদ ইত্যাদি। মানসিক কারণে শারীরিক অসুখের ক্ষেত্রে ঔষধি-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইনজেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়ােগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। এই ধরনের বিশ্বাস-নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘প্লাসিবাে’ (placebo) চিকিৎসা পদ্ধতি। Placebo কথার অর্থ “I will please.” বাংলায় অনুবাদ করে বলতে পারি, “আমি খুশি করব।” ভাবানুবাদ করে বলতে পারি আমি “আরােগ্য করব।”

 রােগিণীর পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে জানলাম, কোনও পরীক্ষাতেই রােগের কোনও কারণ ধরা পরেনি। ডাক্তারদের অনুমান ব্যথার কারণ সম্পূর্ণ মানসিক। রােগিণীর মনে সন্দেহের পথ ধরে একসময় বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে তাঁর উরুর ফোঁড়া সারেনি, বরং আপাত শুকনাে ফোঁড়ার মধ্যে রয়েছে গ্যাংগ্রিনের বিষ। রােগিণীর বিশ্বাসবােধকে কাজে লাগিয়ে কেমনভাবে প্ল্যাসিবাে চিকিৎসা চালাতে হবে সে বিষয়ে একটা পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম।

 এই ঘটনার কয়েক দিন পরে রােগিণীর পারিবারিক ডাক্তার সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া উরুর ফোড়ার ওপর নানা রকম পরীক্ষা চালিয়ে একটা মেশিনের সাহায্যে রেখা-চিত্র তৈরি করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে আবার রেখা-চিত্র তােলা হলাে। দুবারের রেখা-চিত্রেই রেখার প্রচণ্ড রকমের ওঠা-নামা লক্ষ্য করে স্থির সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেন, গ্যাংগ্রিনের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। নিউ ইয়র্কে খবর পাঠিয়ে দ্রুত আনানাে হলাে এমনই চোরা গ্যাংগ্রিনের অব্যর্থ ইন্‌জেকশন। সপ্তাহে দুটি করে ইনজেকশন ও দু’বার করে রেখাচিত্র গ্রহণ চলল তিন সপ্তাহ। প্রতিবার রেখা-চিত্রেই দেখা যেতে লাগল রেখার ওঠা-নামা আগের বারের চেয়ে কম। ওষুধের দারুণ গুণে ডাক্তার যেমন অবাক হচ্ছিলেন, তেমন রােগিণীও। প্রতিবার ইজেকশনেই ব্যথা লক্ষণীয়ভাবে কমছে। তিন সপ্তাহ পরে দেখা গেল রেখা আর আঁকা-বাঁকা নেই, সরল। রােগিণীও এই প্রথম অনুভব করলেন, বাস্তবিকই একটুও ব্যথা নেই। অথচ মজাটা হলাে এই যে, বিদেশী দামী ইন্‌জেশনের নামে তিন সপ্তাহ ধরে রােগীণীকে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ ডিসটিলড্ ওয়াটার।

 পঞ্চম সপ্তাহে ‘আজকাল’ পত্রিকার রবিবারের ক্রোড়পত্র একটা আমার প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। শিরােনাম ‘বিশ্বাসে অসুখ সারে’! মহিলার ঘটনাটির উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করেছিলাম।


 বছর পনেরাে আগের ঘটনা। আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে দমদমের ‘শান্তিসদন’ নার্সিং হােমে ভর্তি হন। ওই সময় শান্তি সদনের অন্যতম কর্ণধার অতীন রায়ের সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তিনি সেই সময় অতি সম্প্রতি আসা এক রোগিণীর কেস হিস্ট্রি শোনালেন। মাঝে মাঝেই রোগিণীর পেটে ও তার আশেপাশে ব্যথা হত। আশ্চর্য ব্যাপার হল, প্রতিবারই ব্যথাটা পেটের বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করত। এই দিকে আর এক সমস্যা হল, নানা পরীক্ষা করেও ব্যথার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তার রোগিণীকে একটা ক্যাপসুল দিয়ে বললেন, এটা খান, ব্যথা সেরে যাবে। ক্যাপসুল খাওয়ার পর রোগিণীকে একটা ক্যাপসুল দিয়ে বললেন, এটা খান, ব্যথা সেরে যাবে। ক্যাপসুল খাওয়ার পর রোগিণীর ব্যথার কিছুটা উপশম হল। অথচ ক্যাপসুলটা ছিল নেহাতই ভিটামিনের। ব্যথা কিন্তু বারো ঘণ্টা পরে আবার ফিরে এলো।

 আবার ভিটামিন ক্যাপসুল দেওয়া হলো। এবারও উপশম হল সাময়িক। এভাবে

আর কতবার চালানো যায়। ডাক্তারবাবু শেষ পর্যন্ত রোগিণীকে জানালেন, যে বিশেষ ইন্‌জেকশনটা এই ব্যথায় সবেচেয়ে কার্যকর সেটি বহু কষ্টে তিনি জোগাড় করেছেন। এবার ব্যথা চিরকালের মতাে সেরে যাবেই।

 ডাক্তারবাবু ইনজেকশনের নামে ডিসটিলড ওয়াটার পুশ করলেন। রােগিণীর ব্যথাও পুরােপুরি সেরে গেল।


 কয়েক বছর কুড়ি আগেও কলকাতা জেনারেল পােস্টে অফিসের আশপাশে এক গৌরকান্তি, দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ তান্ত্রিক ঘুরে বেড়াতেন। গলায় মালা (যতদুর মনে পড়ছে রুদ্রাক্ষের)। মালার লকেট হিসেবে ছিল একটি ছােট্ট রুপাের খাঁড়া। বৃদ্ধকে ঘিরে সব সময়ই অফিস-পাড়ার মানুষগুলাের ভিড় লেগেই থাকত। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল তান্ত্রিকবাবার অলৌকিক শক্তি সাহায্য নিয়ে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করে দেখেছি এঁদের অসুখগুলাে সাধারণত অম্বলের ব্যথা, হাঁপানি, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, বুক ধড়ফড় অর্শ, বাত ইত্যাদি।

 সাধুবাবা রোগীর ব্যথার জায়গায় লকেটের খাঁড়া বুলিয়ে জোরে জোরে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে বলতেন, “ব্যথা কমেছে না?”

 রােগী ধন্দে পড়ে যেতেন। সত্যিই ব্যথা কমেছে কী কমেনি, বেশ কিছুক্ষণ বােঝার চেষ্টা করে প্রায় সকলেই বলতেন, “কমেছে মনে হচ্ছে।”

 এই আরােগ্য লাভের পিছনে তান্ত্রিকটির কোনও অলৌকিক ক্ষমতা কাজ করত না, কাজ করত তান্ত্রিকটির অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি রােগীদের অন্ধ বিশ্বাস।


 এবারের ঘটনাটা আমার শােনা। বলেছিলেন প্রখ্যাত স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিশ্বনাথ রায়। ডাঃ রায়ের সার্জারির অধ্যাপক ছিলেন ডাঃ অমর মুখার্জি। তাঁর কাছে চিকিৎসিত হতে আসেন এক মহিলা। মহিলাটির একান্ত বিশ্বাস, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এর আগে কয়েকজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন পেটে ব্যথার কারণ গলস্টোন নয়। চিকিৎসকদের এই ব্যাখ্যায় মহিলা আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

 ডাঃ মুখার্জি মহিলার গল-ব্লাডারের এক্স-রে করালেন। দেখা গেল কোনও স্টোন নেই। তবু ডাঃ মুখার্জি তাঁর ছাত্রদের শিখিয়ে দিলেন রােগিণীকে বলতে, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এক্স-রে-তে দুটো স্টোন দেখা গেছে। অপারেশন করে স্টোন দুটো বার করে দিলেই ব্যথার উপশম হবে।

 রােগিণীকে জানানাে হলাে অমুক দিন অপারেশন হবে। নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে পেটের চামড়া চর্বিস্তর পর্যন্ত কাটলেন এবং আবার সেলাই করে দিলেন। ও.টি. স্টাফের হাতে ছােট্ট দুটো রঙিন পাথর দিয়ে ডাঃ মুখার্জি বললেন, রােগিণী জ্ঞান ফেরার পর স্টোন দেখাতে চাইলে পাথর দুটো দেখিয়ে বলবেন, এ-দুটো ও পিত্তথলি থেকেই বেরিয়েছে।

 রােগিণী কয়েকদিন হাসপাতালেই ছিলেন। সেলাই কেটেছিলেন ডাঃ রায়। রােগিণী হৃষ্ঠচিত্তে রঙিন পাথর দুটো নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। যে ক-দিন হাসপাতালে ছিলেন সে ক-দিন গলব্লাডারের কোনও ব্যথা অনুভব করেননি। অথচ আশ্চর্য, সাজানাে অপারেশনের আগে প্রতিদিনই নাকি রােগিণী গলব্লাডার প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতেন।

 এবার যে ঘটনাটি বলছি, তা শুনেছিলাম চিকিৎসক এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির একসময়ের সভাপতি ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জি কাছে। ঘটনাস্থল জামশেদপুর। ডাঃ মুখার্জি তখন জামশেদপুরের বাসিন্দা। নায়িকা তরুণী, সুন্দরী, বিধবা। ডাঃ মুখার্জির কাছে তরুণীটিকে নিয়ে আসেন তাঁরই এক আত্মীয়া। তরুণীটির বিশ্বাস তিনি মা হতে চলেছেন। মাসিক বন্ধ আছে মাস তিনেক। ডাঃ মুখার্জির আগেও অন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মাতৃত্বের কোনও চিহ্ন নেই। ডাক্তারের স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে মেয়েটির পরিবারের আর সকলে বিশ্বাস স্থাপন করলেও, মেয়েটি কিন্তু তাঁর পূর্ব বিশ্বাস থেকে নড়েননি। তাঁর এখনও দৃঢ় বিশ্বাস, মা হতে চলেছেন। এবং মা হলে তাঁর সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে। ইতিমধ্যে সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

 পূর্ব ইতিহাস জানার পর ডাঃ মুখার্জি পরীক্ষা করে মেয়েটিকে জানালেন, “আপনার ধারণাই সত্যি। আপনি মা হতে চলেছেন। যদি অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে অব্যাহতি চান নিশ্চয়ই তা পেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে অ্যাবরশন করতে হবে।

 মেয়েটি এককথায় অপারেশনে রাজি হয়ে গেলেন। সাজানাে অ্যাবরেশন শেষে জ্ঞান ফিরতে রােগিণীকে দেখানাে হলাে অন্য এক রােগিণীর দু’মাসের ফিটাস ট্রেতে রক্তসহ সাজিয়ে।

 মেয়েটি সুখ ও স্বস্তি মেশানাে নিশ্বাস ছাড়লেন। পরবর্তীকালে মেয়েটি তাঁর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক জীবন ফিরে পেয়েছিলেন।


 অনেক পুরনাে বা chronic রােগ আছে যেসব রােগের প্রকোপ বিভিন্ন সময় কমে-বাড়ে। যেমন গেঁটে বাত, অর্শ, হাঁপানি, অম্বল। আবার হাঁপানি, অম্বলের মতাে কিছু পুরনাে রােগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে সেরে যায়। অলৌকিক বাবাদের কাছে কৃপা প্রার্থনার পরই এই ধরনের অসুখ বিশ্বাসে বা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুটা কমলে বা সেরে গেল অলৌকিক বাবার মাহাত্ম্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

 পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন চীফ সেক্রেটারি অমিয় সেন একবার আমাকে বলেছিলেন, “মাকর্সবাদে বিশ্বাসী হলেও আমি কিন্তু অলৌকিক শক্তিকে অস্বীকার করতে পারি না। দীঘার কাছের এক মন্দিরে আমি একা অলৌকিক ক্ষমতাবান পুরােহিতের দেখা পেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী গেঁটেবাতে পায়ে ও কোমরে মাঝে-মাঝে খুব কষ্ট পান। একবার দীঘায় বেড়াতে গিয়ে ওই পুরােহিতের খবর পাই। শুনলাম উনি অনেকের অসুখ-টসুখ ভাল করে দিয়েছেন। এক সন্ধ্যায় আমার স্বামী-স্ত্রীতে গেলাম মন্দিরে। পুজো দিলাম। সন্ধ্যারতির পর পুরােহিতকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য জানালাম। পুরােহিত বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে আমার স্ত্রীর কোমর ও পায়ে হত বুলিয়ে দিলেন। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, “কি, এখন ব্যথা কমেছে না?” অবাক হয়ে গেলাম আমার স্ত্রী জবাব শুনে। ও নিজের শরীরটা নাড়া-চাড়া করে বলল, “হ্যাঁ, ব্যথা অনেক কমেছে।” এইসব অতি-মানুষের হয়তাে কোনও দিনই আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হাজির হবেন না। কিন্তু এদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর তা অস্বীকার করব কী ভাবে?”

 আমি বলেছিলাম, “যতদূর জানি আপনার স্ত্রীর বাতের ব্যথা এখনও আছে।”

 আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্রাক্তন চীফ সেক্রেটারী জবাব দিয়েছিলেন, “পুরােহিত অবশ্য আরও কয়েকবার ঝেড়ে দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। কাজের তাগিদে আর যাওয়া হয়নি। ত্রুটিটা আমাদেরই।”

 এই সাময়িক আরােগ্যের কারণ পুরােহিতের প্রতি রােগিণীর বিশ্বাস, পুরােহিতের অলৌকিক কোনও ক্ষমতা নয়। অথবা, পুরনাে রােগের নিয়ম অনুসারেই স্বাভাবিকভাবেই সেইসময় গেঁটেবাতের প্রকোপ কিছুটা কম ছিল।


 অর্শ রােগীদের অনেকেরই হাতের আঙুলে শােভিত হয় আড়াই প্যাঁচের একটা রুপাের তারের আংটি। যাঁরা এই আংটি পরেন, তাঁদের কাছে কোনও অর্শ রােগী আংটি ধারণ করে নিরাময় চাইলে সাধারণভাবে আড়াই-প্যাঁচি আংটির ধারক তাঁর আংটির তারের ছােট্ট একটা টুকরাে কেটে দেন। ওই টুকরাে স্যাঁকরাকে দিয়ে আড়াই-প্যাঁচ আংটি তৈরি করে ধারণ করেন। ধারণ করার পর অর্শ রােগ সত্যিই কি সারে? আমি দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে ২০০ জানের উপর একটা অনুসন্ধান চালিয়েছিলাম। সাধারণত যাদের হাতেই আড়াই-প্যাঁচ আংটি দেখেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি, আংটি পরে কতটা উপকৃত হয়েছেন। শতকরা ৩০ ভাগের মতাে ধারণকারী জানিয়েছেন, আংটি পরে উপকৃত হয়েছেন। শতকরা ৪৫ ভাগের মতাে জানিয়েছেন, আংটির গুণ আছে কি না, এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসার মতাে কিছু বােঝেননি। বাকি ২৫ ভাগ জানিয়েছেন, কিছুই কাজ হয়নি। অর্শ অনেক সময় স্বাভাবিক নিয়মেই প্রাকৃতিক সারে। যাঁদের সেরেছে, তাঁরা প্রাকৃতিক নিয়মকেই আংটির অলৌকিক নিয়ম বলে ভুল করেছেন।


 এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯৮৮-র ২৯ জুলাই সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে আনন্দবাজার পত্রিকায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে লেখা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিটা এখানে তুলে দিচ্ছি।

“প্রীতিভাজনেষু জ্যোতিবাবু,

 আনন্দবাজার পত্রিকায় পড়লাম আপনি স্পন্ডিলাইটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। আমি স্পন্ডিলাইটিসে অনেকদিন ধরে ভুগেছি। তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ প্রতুল মুখার্জী আমাকে একটা বালা দেন যার মধ্যে হাই ইলেকট্রিসিটি ভোল্ট পাশ করানো হয়েছে। সেটা পরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হই। আমি আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যেই একটি তামার বালা পাঠাব, আশা করি সেটা পরে আপনি উপকার পাবেন।

 আপনার দ্রুত নিরাময় কামনা করি, আমি এখন আরামবাগে আছি।

 পুনঃসম্ভবপর হলে সাইকেলে অন্তত দৈনিক আধঘন্টা চাপবেন। আপনি বোধহয় জানেন, আমি সাইকেলে চেপে ভাল ফল পেয়েছি।

 স্বাঃ প্রফুল্লচন্দ্র সেন

 ২৮.৭.৮৮

 পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্লচন্দ্র সেন জানান, তামার বালা পরেছিলেন ১৯৭৯ সালে। শ্রীসেনের কথায়, “স্পন্ডালাইটিস হয়েছিল। ডঃ নীলকান্ত ঘোষাল দেখছিলেন। কিছুই হল না। কিন্তু যেই তামার বালা ব্যবহার করলাম, প্রথম ৭ দিনে ব্যথা কমে গেল। পরের ১৫ দিনে গলা থেকে কলার খুলে ফেললাম।”

 এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর নাকি তামার বালা বিক্রি খুব বেড়ে গিয়েছিল শহর কলকাতায়। প্রফুল্লচন্দ্র সেনের বক্তব্য এবং জ্যোতি বসুকে লেখা চিঠি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষদের মধ্যে নয়, বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে শরীরের ওপর ধাতুর প্রভাব কতখানি অথবা বাস্তবিকই পরভাব আছে কি না, বহু প্রশ্নের ও পত্রের মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের জানিয়েছি, ‘শরীরের উপর ধাতুর প্রভাব আছে’, এটা সম্পূর্ণ অলীক ধারণা।


‘আর্থ’ না করে আমার বালা পরে জীবনধারণ করার চিন্তা
বাস্তবসম্মত নয়। তামাকে ‘আর্থ’ হওয়া থেকে বাঁচাতে
বালাধারণকারীকে তবে পৃথিবীর ছোঁয়া থেকে
নিজেকে সরিয়ে রেখে জীবন ধারণ করতে
হয়। কারণ, বালাধারণকারী পৃথিবীর
সংস্পর্শে এলেই বালার তামা
‘আর্থ’ হয়ে যাবে।

 আরও একটি বৈজ্ঞানিক সত্য এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা প্রয়ােজন, বিদ্যুৎ-প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তামার মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি থাকে না।

 মানবদেহে অল্প পরিমাণে বিভিন্ন মৌলিক দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে এবং নানা ধরনের অসুখের চিকিৎসাতে মৌলিক দ্রব্যের ব্যবহার সুবিদিত। গর্ভবতীদের রক্তস্বল্পতার জন্য LIvOGEN CAPSULE বা ঐ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে সংশােধিত অবস্থায় রয়েছে লৌহ। প্রস্রাব সংক্রান্ত অসুখের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে MERCUREAL DIURETIC (DIAMOx) দেওয়া হয়, যার মধ্যে সংশােধিত অবস্থায় পারদ রয়েছে। একধরনের বাতের চিকিৎসায় অনেক সময় MYOCRISIN দেওয়া হয়, যার মধ্যে সংশােধিত অবস্থায় সােনা রয়েছে।

 যখন রােগিণীকে LIvOGEN CAPSULE বা ঐ জাতীয় ওষুধ দেওয়ার প্রয়ােজন তখন পরিবর্তে রােগিণীকে এক কুইন্টাল লােহার ওপর শুইয়ে রাখলেও ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, মৌল দ্রব্য বা ধাতু শরীরে ধারণ করলে তা কখনই শােষিত হয়ে দেহে প্রবেশ করে না।

 উপরের দুটি স্তবকে যা লিখেছি তা আমার ব্যক্তি-বিশ্বাসের কথা নয়, বিজ্ঞানের সত্য।

 এরপর যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেবে, তা হলে প্রফুল্লচন্দ্র কি তবে মিথ্যে কথা বলেছিলেন? যদিও আমরা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে শিখেছি সমাজশীর্ষ মানুষরাও মিথ্যাশ্রয়ী হন তবু তামার বালা পরে প্রফুল্লচন্দ্রের স্পন্ডালাইটিস আরােগ্যের মধ্যে কোনও অবাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি না।

 আমার এই কথার মধ্যে অনেকেই নিশ্চয়ই পরস্পর বিরােধিতা খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা এতক্ষণে প্লাসিবাে চিকিৎসা পদ্ধতির বিষয়টি বুঝে নিয়েছেন, তাদের কাছে নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে প্রফুল্লচন্দ্রের রােগমুক্তির ক্ষেত্রে তামা বা বিদ্যুৎশক্তির কোনও বৈশিষ্ট্য বা গুণই কাজ করেনি, কাজ করেছিল তামা, বিদ্যুৎশক্তি এবং সম্ভবত ডঃ প্রতুল মুখার্জির প্রতি প্রফুল্লচন্দ্রের একান্ত বিশ্বাস।


 অ্যাকুপ্রেসার স্যান্ডেলের কথা ব্যাপক বিজ্ঞাপনের দৌলতে অনেকেরই জানা। সর্বরােগহর এক অসাধারণ স্যান্ডেল। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মাত্র দু’বার হাঁটলেই নাকি নার্ভে সঞ্জীবনীশক্তির সঞ্চার হয়, দূর হয় হরেক রকমের অসুখ, হজমশক্তির দারুণ রকমের উন্নতি হয়। রােগমুক্তির এমন সহজ-সরল উপায়ে অনেকেই আকর্ষিত হচ্ছেন। কিনেও ফেলছেন। ব্যবহারের পর অনেকের নাকি অনেক অসুখ-বিসুখ সেরেও যাচ্ছে। অথচ বাস্তব সত্য হলাে এই যে, যাঁরা আরােগ্য লাভ করছেন, তাঁদের আরােগ্যের পিছনে স্যান্ডেলের কোনও গুণ বা বৈশিষ্ট্য সামান্যতম কাজ করেনি, কাজ করেছে স্যান্ডেলের প্রতি রােগীদের অন্ধবিশ্বাস।

 ডাঃ বিরল মল্লিক বিখ্যাত স্ত্রী রােগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁকেও দেখেছি রক্তচাপ কন্ট্রোলে রাখতে মাগনেটিক বেল্ট পরতে। এসব যে ফালতু ব্যাপার তা বুঝিয়ে ছিলাম নানা যুক্তি ও তত্ত্ব দিয়ে। তারপর ডাঃ মল্লিক বেল্ট ছেড়েছিলেন।

 এবারের ঘটনার নায়ক ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং। নায়িকা তাঁর প্রেমিকা এলিজাবেথ। এলিজাবেথ ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এলিজাবেথের পরিবারের সকলের না-পছন্দ মানুষ ছিলেন রবার্ট ব্রাউনিং। রবার্ট ব্রাউনিং পরিকল্পনা করেছিলেন এলিজাবেথ নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলে দু’জনে বিয়ে করবেন। এলিজাবেথের বাড়ি ছেড়ে বেরোন ছিল একটা সমস্যা। কারণ শিরদাঁড়ার প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি ছিলেন শয্যাশায়ী। ব্রাউনিং-এর উৎসাহ এলিজাবেথকে রোগ জয় করতে সক্ষম করেছিল। এলিজাবেথ শিরদাঁড়ার ব্যথা ভুলে বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকে বাইরে এসেছিলেন এবং রবার্ট ব্রাউনিংকে বিয়ে করেছিলেন।


 সালটা সম্ভবত ১৯৮৪। সে সময়কার বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’র মালিক ব্রজ মণ্ডলের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। হোটেলে পৌছতেই রাত দশটা পার হয়ে গেল। এগারোটায় খাবারের পাট চুকানোর পর প্রকাশক বন্ধুটির খেয়াল হলো সঙ্গে ঘুমের বড়ি নেই। অথচ প্রতি রাতেই ঘুম আনে ঘুমের বড়ি। বেচারা অস্থির ও অসহায় হয়ে পড়লেন। “কী হবে প্রবীর? এত রাতে কোনও ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া অসম্ভব। তোমার কাছে কোনও ঘুমের ওষুধ আছে?” বললাম, “আমারও তোমার মতোই ঘুম নিয়ে সমস্যা। অতএব সমাধানের ব্যবস্থা সব সময়ই সঙ্গে রাখি। শোবার আগেই ওষুধ পেয়ে যাবে।”

 শুতে যাওয়ার আগে প্রকাশকের হাতে একটা ভিটামিন ক্যাপসুল দিয়ে আমিও একটা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্যাপসুলটা নেড়ে-চেড়ে দেখে প্রকাশক বললেন, “এটা আবার কী ধরনের ওষুধ? ক্যাপসুলে ঘুমের ওষুধ? নাম কী?”

 একটা কাল্পনিক নাম বলে বললাম, “ইউ. এস. এ’র ওষুধ।” কলকাতার এক সুপরিচিত চিকিৎসকের নাম বলে বললাম, “আমার হার্টের পক্ষে এই ঘুমের ওষুধই সবচেয়ে সুইটেবল বলে প্রতি তিন মাসে একশোটা ক্যাপসুলের একটা করে ফাইল এনে দেন। যে চিকিৎসকের নাম বলেছিলাম তিনি যে আমাকে খুবই স্নেহ করেন সেটা প্রকাশক বন্ধুটির জানা থাকায় আমার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন ঘুম হলো?”

 “ফাইন। আমাকেও মাঝে-মধ্যে এক ফাইল করে দিও।”

 প্রকাশকের বিশ্বাস হেতু এ ক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধহীন ক্যাপসুলই ঘুম আনতে সক্ষম হয়েছিল।


 গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার কথা। আমার কাছে এসেছিলেন এক চিকিৎসক বন্ধু এক বিচিত্র সমস্যা নিয়ে। বন্ধুটি একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে এক রোগিণী ভর্তি হয়েছেন। তাঁকে নিয়েই সমস্যা। তিনি মাঝে মাঝে অনুভব করেন গলায় কিছু আটকে রয়েছে। এইসময় তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়। এক্স-রেও করা হয়েছে, কিছু মেলেনি। দেহ-মনজনিত অসুখ বলেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে রোগিণী তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন বলে আমি মনে করি, সেটা জানতেই আসা।

 পরের দিনই নার্সিংহোমে রোগিণীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন বন্ধুটি। নানা ধরনের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে রোগিণী তাঁর উপসর্গের কারণ হিসেবে কী ভাবছেন, এইটুকু জানতে চাইছিলাম। জানতেও পারলাম। চিকিৎসক বন্ধুটিকে জানালাম, রোগিণীর ধারণা তাঁর পেটে একটা বিশাল ক্রিমি আছে। সেটাই মাঝে-মাঝে গলায় এসে হাজির হয়। অতএব রোগিণীকে আরোগ্য করতে চাইলে একটা বড় ফিতে ক্রিমি যোগাড় করে তারপর সেটাকে রোগিণীর শরীর থেকে বার করা হয়েছে এই বিশ্বাসটুকু রোগিণীর মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পারলে আশা করি তাঁর এই সাইকো-সোমটিক ডিস্অর্ডার ঠিক হয়ে যাবে।

 কয়েক দিন পরে বন্ধুটি আমাকে ফোনে খবর দিলেন রোগিণীর গলা থেকে পেট পর্যন্ত এক্স-রে করে তাঁকে জানানো হয়েছিল একটা বিশাল ফিতে ক্রিমির অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। অপারেশন করে ক্রিমিটাকে বের করা প্রয়োজন। তারপর পেটে অপারেশনের নামে হালকা ছুরি চালিয়ে রোগিণীর জ্ঞান ফেরার পর তাঁকে ক্রিমিটা দেখানো হয়েছে। এরপর চারদিন রোগিণী নার্সিংহোমে ছিলেন। গলার কোনও উপসর্গ নেই। রোগিণীও খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছেন ডাক্তার বন্ধুটিকে।


 বিশ্বাসবোধকে যে শুধুমাত্র চিকিৎসকেরাই কাজে লাগান, তা নয়। অনেক তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরেরাও বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় ঘটিয়ে অলৌকিক ‘ইমেজ’ বজায় রাখেন অথবা বর্ধিত করেন।

 সত্তর ও আশির দশকে কলকাতার ‘ফুঁ বাবা’ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার গোবিন্দপুর অঞ্চলের ‘ডাব বাবা’ তো জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছিলেন। এঁরা দু’জনেই সর্বরোগহর হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন।

ফুঁ-বাবা

 ফুঁ-বাবার আবির্ভাব গত শতকের সাতের দশকে। তিনি কলকাতা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ওঁর কাছে তেল নিয়ে যেতে হতো। বাবাজি তেলে ফুঁ দিয়ে দিতেন। সেই ফুঁ দেওয়া তেল রোগানুসারে মালিশ করলে বা খেলে ফুৎকারে নাকি রোগ উড়ে যেত। প্রচুর প্রত্যক্ষদর্শী এবং ফলভোগকারীও পাওয়া যেতে লাগল। ভিড়ও বাড়তে লাগল দ্রুত। ভিড় এমন একটা পর্যায়ে পৌছল, যা সামাল দেওয়া একা ফুঁ-বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হল। গুরুদাস পার্কে কৃপাপ্রার্থীদের জন্য গণ্ডায় গণ্ডায় অ্যামপ্লিফায়ারের ব্যবস্থা হল। হাজার হাজার কৃপাপ্রার্থী তেলের পাত্রের মুখ খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, ফুঁ-বাবা অ্যামপ্লিফায়ারের মাধ্যমে ফুঁ দিতে লাগলেন।

 ফু-বাবার মঞ্চে একজন চলার শক্তিহীন মানুষকে তুললেন কয়েকজন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ফুঁ বাবার কৃপায় চলার শক্তি ফিরে পেলেন রােগী। এমন বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা দেখে সাধারণ মানুষ যখন মুগ্ধ, বিহ্বল, উত্তেজিত, ফুঁ-বাবার জয়ধ্বনিতে মুখরিত এমনি সময় আর এক রােগীকে নিয়ে মঞ্চে উঠে এলেন কিছু তরুণ। এই রােগীটিও চলার শক্তি হারিয়েছেন। তরুণদের অনুরােধ ফুঁ-বাবা অবহেলায় উপেক্ষা করলেন। অনুরােধের সুরে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল ক্ষোভ। মঞ্চে আবির্ভূত হল বাবার অসুরবাহিনী। অসুরবাহিনীর আসুরিক শক্তিতে তরুণরা রক্তাক্ত হলেন বটে, কিন্তু ওই রক্তেই জন্ম নিল জনজাগরণ। গণপ্রহার থেকে বাঁচতে ফুঁ-বাবা ও তাঁর বাহিনী পালানােকেই এই ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বেছে নিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলাে না। পুলিশ ফুঁ-বাবাকে গ্রেপ্তার করার পর আবিষ্কৃত হল আর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফুঁ-বাবা এক দাগী ফেরারী আসামী।

ডাব-বাবা

১৯৮৮-র শুরুতেই ডাব-বাবার মাহাত্ম্য লােকের মুখে মুখে হু-হু করে ছড়িয়ে

আদি ডাব বাবা
পড়তে থাকে। মে-জুনে ডাব-বাবা পত্র-পত্রিকার শিরােনামে এলেন। প্রতিদিন লাখাে লাখাে রােগী দূর-দূরান্ত থেকে এসে হাজির হতে থাকে ডাব-বাবার কৃপায় রােগমুক্তির আশায়।

 দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছােট স্টেশন গােবিন্দপুর। সেখান থেকে তিন কিলােমিটারের মতাে পথ বড়গাছিয়া। এখানে বিদ্যুতের খুঁটি চোখে পড়ে না। এমনই এক ছােট্ট গ্রামে গাছের ছায়ায় চাটাইবেড়া ঘিরে মাথায় টালির চাল নিয়ে গড়ে উঠেছিল বনবিবির মন্দির। জানুয়ারির শুরুতে সুরথ মণ্ডল নাকি বনবিবির কাছ থেকে স্বপ্নে ওষুধ পায়। সুরথ ধর্মে রােমান ক্যাথলিক। তবু বাংলার হাওয়ায় হিন্দু পরিবেশে থাকতে থাকতে সুরথদের পরিবারের মেয়েদের কপালে ও সিঁথিতে উঠেছে সিদুর। সুরথের কর্মস্থল কলকাতার বসুমতী পত্রিকা। পত্রিকার ছাপাখানায় কাজের পাশাপাশি গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারও। সুরথ ভক্তদের ডাবের জলে বনবিবির চরণামৃত মিশিয়ে দিতেন। সেই ডাবের জল খেয়েই নাকি রােগীরা সব রােগ-বালাই

নতুন ডাব বাবা

থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বনবিবির প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই পুজোও চলছিল। আর চরণামৃতও ভক্তরাও পান করেছিলেন। এতদিন কেন বনবিবির চরণামৃতে রােগ সারছিল না? নিশ্চয়ই এটা হককথার এক কথা। কিন্তু এরও উত্তর আছে—এতদিন ঠিকমত চরণামৃত শুদ্ধ মনে বিশেষ প্রণালীতে তৈরি হচ্ছিল না। অর্থাৎ চরণামৃত তৈরির আসল ফর্মুলাটা ছিল মানুষের অজানা। বনবিবি একদিন স্বপ্নে ফর্মুলাটা সুরথবাবুকে জানানােতে মুশকিল আসান হল। সুরথবাবু ফর্মুলা মাফিক চরণামৃত বানান, ভক্তদের দেন, আর টপাটপ অসুখ সারে।

 আশ্চর্য ডাবের জলের কথা দ্রুত ছড়াতে লাগল। লােক মুখে মুখে সুরথ হয়ে গেলেন ‘ডাব-বাবা’। যে ভিড় শুরু হয়েছিল ৩৪ জন দিয়ে মার্চের শেষে সেই ভিড়ই দাঁড়াল ৩/৪ হাজারে। শনি-মঙ্গল বাদে হপ্তার অন্য দিনগুলাে ডাব-বাবা কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে ভক্তদের ডাবের জলে স্বপ্নে দেখা নির্দেশমতাে তৈরি বনবিবির চরণামৃত মিশিয়ে দিচ্ছিলেন। টাকাটা-সিকেটা প্রণামীও পড়ছিল। দিনের শেষে দু-তিন হাজার হয়ে যাচ্ছিল। রােগীরা নাকি আশ্চর্য ফল পাচ্ছিলেন। দু-মাসের মধ্যেই মন্দিরের দেওয়াল পাকা হয়েছে। গ্রামের জনা দশেক উদ্যোগী মানুষ নিয়ে একটা মন্দির কমিটি হয়েছে। কিন্তু কোথা দিয়ে কী হলাে, মন্দির কমিটির সঙ্গে সুরথের প্রণামী নিয়ে একটা গােলমাল লেগে গেল। সুরথ উধাও হলেন।

 ডাব-বাবা স্বয়ং নিরুদ্দেশ। স্বপ্ন দেখার মালিকটি নিখোঁজ। স্বপ্নাদ্য চরণামৃত তৈরির ফর্মুলা আর কারও জানা না থাকলেও মন্দির কমিটি স্বপ্নাদ্য ওষুধ দেওয়া বন্ধ করলেন না। ফির হপ্তায় রােগীর ভিড় বেড়েই চলল। মে-জুনে প্রতিদিন রােগীর সংখ্যা দৈনিক লাখ ছাড়াতে লাগল। লাখাে লাখাে রােগী জানতেও পারল না ওষুধ দাতা ডাব-বাবা স্বয়ং নিরুদ্দেশ। আগের দিন রাত থেকেই লাইন পড়তে লাগল। এলাে লাইন ম্যানেজ করার ভলেন্টিয়ার, জেনারেটার, মাইক। গজিয়ে উঠল পান, বিড়ি, সিগারেট, চা ও খাবারের দোকান। রিকশার সংখ্যা বাড়ল কুড়ি গুণ। এলাে ট্যাক্সি, এলাে অটো। ডাবের দাম চড়ল। ডাব কাটার ফিস হলাে দশ পয়সা। ধারাল দা চালিয়ে ধাঁ করে ডাবের মুণ্ডু কেটে ফিস নেবার অধিকার পেল শুধু সওয়া-শ’ ভলেন্টিয়ার। ওদের চেহারা ও হাবভাব দেখে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, নিজেদের স্বার্থরক্ষায় দা-গুলাে ডাব ছেড়ে মানুষের মুণ্ডুতে নামার জনােও তৈরি।

 খবরটা কিছুদিন ধরেই কানে আসছিল। জুনের শুরুতেই হাজির হলাম ‘বসুমতী’ পত্রিকা দপ্তরে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দেখা পেলাম সুরথ মণ্ডলের। সুরথবাবুর কথায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, বনবিবি মন্দিরের কমিটির ভয়ে পত্রিকা অফিসের বাইরে পা রাখতেও ভরসা পান না। ভয় খুন হওয়ার। বেশ কিছু পত্রিকা প্রতিনিধি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন। কারও সঙ্গেই দেখা করেননি। একটাই ভয়, বেফাঁস কিছু বললে এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নকল ডাব-বাবারা জানে মারতে পারে। আর তেমন পরিস্থিতি এলে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে ওই সাংবাদিকরা এগিয়ে আসবেন, এমন ভরসা করেন না সুরথ। আমার কাছে সুরথ প্রথমেই যে অভিযোেগ করলেন, তা হলাে, “যারা এখন ডাববাবা সেজে স্বপ্নাদ্য ওষুধ দিচ্ছে তারা সব ঠগ, ডাকাত। স্রেফ লােক ঠকাচ্ছে। স্বপ্ন দেখলাম আমি। আমি না জানানাে সত্ত্বেও ওরা ওষুধ তৈরি করছে কি করে? থানায় খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, ওদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযােগ আছে। পয়সা রােজগারের ধান্দায় ওরা প্রচার করছে বনবিবির চরণামৃত মেশানাে ভাবের জল খেলে কান-কটকট থেকে ক্যানসার সবই নাকি সারে। অথচ আমাকে মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়েছিলেন, চরণামৃতসহ ডাবজল পানে দুটি মাত্র অসুখ সারবে। হাঁপানি ও পেটের অসুখ।

 বুঝলাম, বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কী কী অসুখ সারানাে যায়, সে বিষয়ে সুরথবাবু কিঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল।

 প্রচুর কথা বলিয়ে, এক সময় জানতে পারলাম চরণামৃত তৈরি করতেন গরম জল, ডাবের জল, দুধ, সন্দেশ, বাতাসা ও কর্পূর মিশিয়ে।


 এর কয়েকদিন পর গিয়েছিলাম বনবিবির থানে। দেখে এটুকু বুঝেছিলাম, এখন আসল ডাব-বাবা স্বয়ং ফিরে এসে—‘সব ঝুট হ্যায়’, বলে চ্যাঁচালেও বিশ্বাসে আচ্ছন্ন মানুষগুলাে তাতে কান দেবে না।

 ডাবে চরণামৃত মিশিয়ে দিচ্ছিলেন বিজয় মণ্ডলের নেতৃত্বে কিছু তরুণ। কথা হলাে বিজয় মণ্ডল, মন্দির কমিটির সম্পাদক হারাণ নস্কর ও কিছু খালি গা তেজী তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে।

 জিজ্ঞেস করলাম, “বনবিবি স্বপ্নে ওষুধ বাতলে দিয়েছিলেন সুরথ মণ্ডলকে। তিনি তাে আপনাদেরই ভায়েই নাকি উধাও। আপনারা তাে স্বপ্ন দেখেননি। তা হলে ওষুধ দিচ্ছেন কি করে?”

 হারাণ নস্কর জবাব দিলেন, “সুরথ মণ্ডল আমাদের ভয়ে গাঁ ছাড়া, এসব দুষ্ট লোকেদের মিথ্যে প্রচার। আসলে ঈর্ষা করা মানুষের সংখ্যাতো কম নয়, তারাই ওসব রটাচ্ছে। সুরথ একটু ভিতু আর নির্ঝঞাট মানুষ। এত ভিড়, এত মানুষজন সামলে সকাল থেকে রাত মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার মতাে মন কি সবার আছে? সুরথেরও ছিল না। সুরথ পালাল। তবে লােকটা ভাল ছিল। যাওয়ার আগে বিজয় মণ্ডলকে শিখিয়ে দিয়েছিল বনবিবির চরণামৃত তৈরির পদ্ধতি।

 বললাম, “সুরথবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি অবশ্য অন্য কথা বললেন। উনি নাকি কাউকেই স্বপ্নাদ্য ওষুধ তৈরির পদ্ধতি বলে জানি।”

 বিজয় মণ্ডল একটু উত্তেজিত হলেন। চড়া গলায় বললেন, “ও সব বাজে কথা।”

 হারাণ নস্কর পােড় খাওয়া মানুষ। এক গাল হেসে বললেন, “সুরথ না বললেই বা কি হয়েছে? বনবিবি তো সুরথের একার সম্পত্তি নয়। বনবিবি এখন আমাদের অনেককেই স্বপ্ন দিচ্ছেন।”

 ডাব-বাবার দাবি মতো রোগীরা সত্যিই রোগমুক্ত হচ্ছেন কী না, জানার জন্য ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটি যৌথ উদ্যোগে একটি তথ্য সংগ্রহ অভিযান চালান। আমরা ৫০ জন রোগীর ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে ছিলাম। ৬ জন জানিয়েছিলেন ৩ বার জল খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। ১১ জন জানালেন—অনেকটা ভাল আছেন। ৩৩ জন জানালেন—ফল পাইনি।

 যে ৬ জন পুরোপুরি ও ১১ জন আংশিকভাবে রোগমুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন, সেই ১৭(৬ + ১১) জনের মধ্যে ১৪ জন সেই সব অসুখে ভুগছিলেন, যেসব অসুখ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সারানো সম্ভব। একজন জানিয়েছিলেন তাঁর ক্যানসার হয়েছিল। বর্তমানে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমাদের তরফ থেকে প্রশ্ন ছিল—আপনার যে ক্যানসারই হয়েছিল তা জানলেন কী করে? কত দিন আগে ক্যানসার ধরা পড়ে?

 উত্তর ছিল—ডাক্তার বলেছিলেন, মাস ছয়েক আগে।

 প্রশ্ন—কোন ডাক্তার, নাম কী? ঠিকানা কী?

 উত্তর—কোন ডাক্তার অত মনে নেই।

 প্রশ্ন—সে কী? এত বড় রোগ হল, ডাক্তার দেখিয়েছেন নিশ্চয়ই অনেক বার। আর ডাক্তারের নামটাই ভুলে গেলেন? ডাক্তারবাবু কি কোনও জায়গায় আপনাকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন—এই যেমন চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল বা ঠাকুরপুকুর ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার?

 উত্তর-ঠাকুরপুকুর পাঠিয়েছিলেন।

 প্রশ্ন-সেখানকার কোনও প্রেসক্রিপশন আছে কি?

 উত্তর—না সে সব কোথায় হারিয়ে-টারিয়ে গেছে।

 প্রশ্ন—এই মাস-দুয়েকের মধ্যেই সব হারিয়ে ফেললেন? কী করে জানলেন আপনার ক্যানসার সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছে।

 উত্তর—ডাক্তারবাবু দেখে বললেন।

 প্রশ্ন—এই যে বললেন কোন ডাক্তার অত মনে নেই।

 উত্তর—না, না। ডাক্তারবাবু মানে ঠাকুরপুকুরের ডাক্তারবাবু।

 এই রোগীর ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা আছে। প্রথম ও জোরালো সম্ভাবনা হলো, রোগীটি একজন প্রতারক ও ডাব-বাবার প্রচারক। দ্বিতীয়টি হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যেই ক্যানসার মুক্ত হয়েছে, ডাবের জলে নয়। ক্যানসার প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে বহুক্ষেত্রেই আরোগ্য সম্ভব।

 একজন জানিয়েছিলেন তাঁর গলব্লাডারে স্টোন হয়েছিল। ডাব-বাবার কৃপায় এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনিও তাঁর অসুখের সমর্থনে কোনও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখাতে সক্ষম হননি। অতএব এরও ডাববাবার একজন বেতনভুক প্রচারক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 একজন জানিয়েছিলেন তাঁর বােবা ভাই দুদিন ডাবের জল খেয়েই এখন কষ্ট করে হলেও কিছু কিছু কথা বলতে পারছে। ভাইয়ের জন্যেই আজ শেষবারের জন্য ডাবের জল নিতে এসেছেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের জীবনের এই অলৌকিক ঘটনার কথা অনেককেই বলছিলেন। শ্রোতারা অবাক বিস্ময়ে কথাগুলাে শুনছিলেন। আমরা ভদ্রলােকের ঠিকানা নিলাম। এবং পরবর্তীকালে ঠিকানাটার খোঁজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম—ও একটি আস্ত ছােটলােক। কারণ ঠিকানাটাই ছিল মিথ্যে।

 ডাব-বাবার বিশাল প্রচার ও জন-আবেগকে প্রতিহত করতে দুটি কাজ করেছিলাম। (এক) ওই অঞ্চল ও তার আশে-পাশে আরও কয়েকজন ডাব-বাবা খাড়া করে দিয়েছিলাম। ফলে সব ডাব-বাবার প্রতিই বিশ্বাসে চিড় ধরেছিল ভক্তদের। (দুই) ডাব-বাবার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার। একাধিক ডাব-বাবা বাজারে এসে পড়ায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ‘চোর-জোচ্চোর’ বলে গাল পাড়ছিল এবং ওদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণসংগঠন এগিয়ে আসার ফলে ডাব-বাবার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছিল। ফলে ডাব-বাবা বা তাঁর অসুর চেলাদের পিছু হটতে হয়েছিল। কারবার গােটাতে হয়েছিল। অন্য ডাব-বাবারা ছিল আমাদেরই সৃষ্টি। কাজ ফুরােতেই তারও ভ্যানিশ।

ডাইনি সম্রাজ্ঞী ইপ্সিতা

এই প্রসঙ্গে আর একজনের কথা না বললে বােধহয় কিছুটা অবিচার হয়। তিনি হলেন ডাইনী সম্রাজ্ঞী ইপ্সিতা রায় চক্রবর্তী। ১৯৮৭-৮৮ ঈপ্সিতাকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী পত্র-পত্রিকা বিশাল বিশাল কভারেজ দিয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল—ঈপ্সিতা যে কোনও রােগীকেই রােগমুক্ত করতে পারেন। তবে কোন রােগীকে রােগ মুক্ত করবেন সেটা তিনিই ঠিক করেন।

 ঈপ্সিতার সঙ্গে আমার একটা মােলাকাত হয়েছিল এবং সেই সাক্ষাৎকারটা ঈপ্সিতার পক্ষে মােটেই সুখের ছিল না। এই প্রসঙ্গে বিস্তৃতভাবে আলােচনা করব ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে। শুধু এটক এখানে বলে রাখি, ঈপ্সিতা সেইসব রােগীদের রােগমুক্ত করার দায়িত্বই শুধু নিতেন, যাঁদের রােগ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে আরােগ্য করা সম্ভব।

 ঈপ্সিতাকে প্রথম খােলামেলা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম ১২ আগস্ট ১৯৮৮ ‘আজকাল’ পত্রিকার পাতায়। জানিয়েছিলাম, “ঈপ্সিতা কি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে আমার হাজির করা পাঁচজন রােগীকে সুস্থ করে তুলতে রাজি আছেন? তিনি জিতলে আমি দেব পঞ্চাশ হাজার টাকার প্রণামী, সেইসঙ্গে থাকব চিরকাল তাঁর গোলাম হয়ে।”

ডাইনি সম্রাজ্ঞী ইপ্সিতা

 ১৯৮৮-র ১১ ডিসেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনেও আমাদের সমিতির তরফ থেকে ঈপ্সিতাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দেওয়ার জন্যে হাজির হতে। রোগী দেব। রোগমুক্তি ঘটাবার জন্যে দেব ছয় মাস সময়। কিন্তু আমাদের সমিতির আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ঈপ্সিতা সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হওয়ার ধৃষ্টতা দেখাননি। দেখালে তাঁর বুজরুকি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়ত।

বকনা গরুর অলৌকিক দুধ ও মেহেবুব আলি

 উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মহকুমা শহর বনগাঁর গা ছুঁয়ে ঘাটবাওড় গ্রাম। হাজি-বাড়ি গ্রামের সম্ভ্রম জাগানো সচ্ছল পরিবার। এই পরিবারেই মানুষ মেহেবুব আলি। বয়স তিরিশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। স্বল্প উচ্চতার মাঝারি চেহারার মানুষটির ঝকঝকে দুটি চোখ বুদ্ধির সাক্ষ্য বহন করছে।

 ১৯৮৯-এর মে মাস নাগাদ দাবানলের মতো একটা খবর দ্রুত আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল—মেহেবুব আলির বকনা (স্ত্রী বাছুর) দুধ দিচ্ছে। যে কোন একটি রোগ আরোগ্যের প্রার্থনা নিয়ে পরস্পর তিনদিন ওই দুধ খেলে রােগটি আশ্চর্যজনকভাবে সেরে যাচ্ছে।

 শুরু হল ভিড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্রোতের মতাে মানুষ আসতে লাগলেন দূর-দূরান্ত থেকে। এমন কী বাংলাদেশ থেকেও। লরি, টেম্পাের গাদা লেগে গেল। পরপর তিনদিন অলৌকিক দুধ খেয়ে রােগ মুক্তি তীব্র আকাঙ্ক্ষা

অলৌকিক বকনা

নিয়ে নারী-পুরুষ সকলেই রাত কাটাতে লাগলেন খােলা আকাশের নীচে। কারণ অনেকেই এতদূর থেকে আসেন, যেখান থেকে পরপর তিনদিন যাওয়া আসা অসম্ভব বা কষ্টসাধ্য। দুধ দেওয়া বন্ধ থাকে শুক্রবার ও বাংলা মাসের ১৪ তারিখ। দুধ খাওয়ার নিয়ম হলাে, দুধ কোথাও নিয়ে যাওয়া চলবে না, ওখানেই খেতে হবে। অর্থাৎ রােগীকে স্বয়ং আসতে হবে।

 এতগুলাে মানুষ থাকছেন, প্রাকৃতিক কাজ সারছেন, পরিবেশ দূষণ রােধে এগিয়ে এলাে স্থানীয় ক্লাব নজরুল ক্রীড়া চক্র। বিনিময়ে মানুষগুলাের কাছ থেকে আদায় করতে লাগলাে ২০ পয়সা করে। মেহেবুব আলির সঙ্গে ক্রীড়া চক্রের এই নিয়ে মন কষাকষি। ফলে পুলিশের হস্তক্ষেপ। ক্রীড়া চক্র ২০ পয়সা কমিয়ে ১০ পয়সা করল।

 মেহেবুব আলি রােগীদের দুধ দেন নস্যির চামচের এক চামচ করে। বিনিময়ে কোনও পয়সা দাবি করেন না। ভালবেসে শ্রদ্ধার সঙ্গে যে যা দেন তাই নেন।

 ‘বনগাঁ সায়েন্স ক্লাব’ তখন ছিল যুক্তিবাদী সমিতির সহযােগী সংস্থা। ক্লাবের কিছু সদস্য এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালান। অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব রিপাের্ট আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাতে জানতে পারি—প্রতিদিন পাঁচ-ছ’হাজার মানুষ আসছেন রােগমুক্তির আশায়। দৈনিক প্রণামী পড়ছে চার-পাঁচ হাজার টাকা। এত মানুষের ভিড়ে ও রাত কাটাবার ফলে মল-মুত্র ত্যাগের জন্য পরিবেশ দূষণ

মেহেবুব আলী ও লেখক

হচ্ছে। রাতে মাথা গোঁজার ভাল ব্যবস্থার অভাব ও আগতদের রক্ষার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় মহিলাদের শ্লীলতাহানি ঘটছে বলে বেশ কিছু অভিযােগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং থানাকে এই বিষয় দুটি জানায় নজরুল ক্রীড়াচক্র। কোনও সহযােগিতাই নাকি এই দুই সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। গড়ে ওঠা খাবারের দোকানগুলাে চড়া দাম নিচ্ছে। একইভাবে, যােগাযােগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার * সুযােগ নিয়ে মানুষগুলাের কাছ থেকে মােটা টাকা আদায় করছে লরি, টেম্পাে ও রিকশা। প্রতিটি লরি ও টেম্পােতেও নাকি থাকে মেহবুব আলির এজেন্ট। এরা লরি, টেম্পাের ভাড়া থেকে কমিশন আদায় করছে। আগে হাজার দুয়েক লােককে দুধ বিতরণ করতেই দুধ শেষ হয়ে যেত। এখন যত লােকই আসুক দুধ শেষ হয় না। সবার সামনেই দুধ দোয়া হয় বটে, তবে দোয়া দুধ ঘরের ভিতরে চলে যায়। দফায় দফায় ভেতর থেকে দুধ আসে।

 বনগাঁ সায়েন্স ক্লাবের সদস্যরা একাধিকবার চেষ্টা করেছিলেন গরুর ছবি তুলতে। ব্যর্থ হয়েছেন | ছবি তােলা নিষিদ্ধ। মেহেবুব আলি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নজর এড়িয়ে গােপনে ছবি তােলা অসম্ভব। পরীক্ষার জন্য দুধ সংগ্রহ করতে রােগী সেজে একাধিকবার হাজির হয়েছেন সাইন্স ক্লাবের সভ্য-সভ্যারা। মেহেবুব ও তার সাঙ্গাতদের দৃষ্টি এড়িয়ে হাতের তালুতে ঢালা দুধ কোনওভাবে নিয়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

 জুন মাসের মাঝামাঝি মেহেবুব বিশেষ রােগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু করলেন। বিনিময়ে নিতে লাগলেন মাত্র দশ টাকা। সেইসঙ্গে প্রচার চলতে লাগল গরুটি কামধেনু'। এই মত নাকি মেহবুবের নয়। তারকেশ্বর থেকে গরুটিকে দেখতে আসা কিছু পণ্ডিত ব্রাহ্মণই বিদায়কালে নাকি এই মত প্রকাশ করে গেছেন। মেহেবুবের কাছে।

 যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে গিয়েছিলাম মেহেবুব আলির কাছে। অবশ্যই পরিচয় গােপন রেখে। চতুর মেহেবুবের আস্থা ভাজন করতে পুরেপুরি সক্ষম হয়েছিলাম। ফলে অনেক কিছুই জেনেছিলাম। পেয়েছিলাম অলৌকিক দুধে রােগমুক্ত হওয়া মানুষদের ঠিকানা। মেহেবুবের কথায়—১৯ এপ্রিল রাতে নামাজ পরে ইফতার করে শুয়েছি। রাতে স্বপ্ন দেখলাম, ফুরফুরার দাদা পীর সাহেব বলেছেন, কাল থেকে অ্যান্টনীর দুধ হবে। এই দুধ যে পরম বিশ্বাসে রােগ সারার প্রার্থনা নিয়ে পরপর তিনদিন খাবে, তারই অসুখ সেরে যাবে। তবে সব অসুখ নয়। একটা মাত্র অসুখ সারার প্রার্থনা নিয়ে খেতে হবে। দুধ নসির চামচের এক চামচ খেলেই হবে।

 স্বপ্নের পর ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নকে স্বপ্ন বলেই ভাবলাম। কী করে বিশ্বাস করি ২২ মাস বয়সের বকনা অ্যান্টনি গর্ভ না হতেই দুধ দেবে? অ্যান্টনি জার্সি বকনা। ভেবেছিলাম ওকে কুরবানি দেব। সকাল না হতেই কিছুটা অবিশ্বাস্য ও কিছুটা কৌতুহল নিয়ে অ্যান্টনির বাঁটে হাত দিলাম। অবাক কাণ্ড। অ্যান্টনি দেড় সেরের মতাে দুধ দিল।

 দিন দুয়েক পর থেকে সাহস করে দাদা পীর সাহেবের নির্দেশ মতাে রােগীদের দুধ বিতরণ শুরু করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম তিনদিন দুধ খেয়ে যােবা কথা বলতে লাগল। প্যারালাইসিস রােগী উঠে বসল। সাহস পেলাম। পীর সাহেবের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমার কাপড়ের দোকান বন্ধ করে মানুষের সেবায় নিজেকে লাগিয়ে দিলাম। মেহেবুব আমাকে দুধ খেতে দিয়েছিলেন। একটা শিশিতে পরম যত্নে কিছুটা দুধও দিয়ে দিয়েছিলেন। ছবি তােলায়ও কোনও আপত্তি করেননি।

 বনগাঁ সায়েন্স ক্লাব ও নজরুল ক্রীড়া চক্রের সাহায্যে আমরা আগত ভক্তদের কাছে তথ্য হাজির করে বােঝাতে চেষ্টা করেছিলাম,

কোনও গরুর হরমােনের ভারসাম্য হীনতার জন্য বাচ্চা না হলেও
কোনও গরুর পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে দুধ দেওয়া সম্ভব।
ল্যাকটোজেনিক হরমােন ইনজেক্ট করেও বকনার।
বাঁটে দুধ আনা সম্ভব। এমন যদি হয়, গরুটা

গর্ভবতী হয়েছিল এবং কোনও কারণে
গর্ভ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে
ক্ষেত্রেও এমনি ঘটা সম্ভব।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পশু চিকিৎসা বিভাগের রােগ অনুসন্ধান আধিকারিক ডাঃ পরিতােষকুমার বিশ্বাস আমাদের এই বিষয়ে তথ্যগুলাে জানিয়েছিলেন |

 ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি বর্গা সায়েন্স ক্লাব ও কমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ঠাকুরনগর শাখা ৪৫ জন রােগীর উপর অনুসন্ধান চালান। ৬ জন জানান সম্পূর্ণ সেরে গেছেন। ৫ জন জানান মােটামুটি ভাল আছেন। ৩৪ জন জানান রােগ একটু কমেনি, বরং অনেকের বেড়েছে |

 ডাব-বাবার তুলনায় মেহেবুব আলির রােগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ ব্যাপক যুক্তিবাদী প্রচারের ফলে বেশিরভাগ রােগীর ক্ষেত্রে অলৌকিক দুধ (?) বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি।

বাবা তারক ভােলার মন্দির ও শ্রীশ্রীবাসুদেব


আজ থেকে প্রায় ৪২ বছর আগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী প্রয়াত হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর দুই ছেলের জমিতে বাবা তারকনাথের আদেশক্রমে (?) মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগ্রহ পাথরের। সাধারণের কাছে প্রচলিত এটি খুঁইফোড় শিব’। সেবাইত বাসুদেব দাস। লন্ড্রিতে কাজ করতেন। বর্তমানে অবতার। ছােটবেলা থেকেই নাকি তারকনাথকে দেখছেন, তারকনাথের সঙ্গে খেলেছেন। রােগীদের পরপর চার সপ্তাহ প্রতি সােমবারে মন্দিরে গিয়ে নিজের রােগের কথা জানাতে হয়। ভােলাবাবার আদেশমতাে বাসুদেব ওষুধ দেন। ওষুধ বলতে বাবার স্নানজল, ফুল-বেলপাতা ইত্যাদি রয়েছে।

 মন্দিরে রােগমুক্ত রােগীদের নাম-ঠিকানা ঝােলান রয়েছে। যত বড় রােগই হােক না কেন সব রােগেই মুশকিল আসান হয়। জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা ‘আলােকপাত’-এর পাতায় রঙিন ছবিসহ অলৌকিক তারক ভােলার কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার পর বাবার রমরমা বেড়েছে।

ওঁ
নূতন তীর্থ তার ভােলার মন্দির
আশ্চর্য পুরুষ শ্রীশ্রীবাসুদেব।

যুগে যুগে—এ যুগেও নিজের জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে শত শত মুমূর্ষ মানুষকে মুক্তি দিয়ে যাও তাই তােমাকে আমি চিরকাল মাথায় করে রাখি।

আর ভক্তের অন্তরে ধ্বনিত হয় যে কথা—

বহু যুগ থেকে তুমি আজও আছ সাথে সাথে আস যাও, কর খেলা সবই থাকে হৃদয়ে গাঁথা। তবুও যখন তুমি করগাে খেলা কারাে সাধ্য কি তােমায় ধরা? জীবের তরে যাতনা সহে আপন জীবন বিলায়ে দিয়ে শাস্তি আন বহু প্রাণে, তাই কত মানুষ ছুটে আসে ভালবেসে তােমার টানে, ধন্য তারা তােমার নামে।

 আমাদের ঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমস্ত মানুষকে জানাই নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। হে মুমূর্ষ-পীড়িত ব্যাধিগ্রস্থ মানুষ এই তীর্থ ও সেবাইত আপনাদের সেবায় সর্বদাই ব্যস্ত।'

তারকভােলার মন্দির

 মন্দিরে ঝােলানাে নাম ঠিকানা ধরে আটজন রােগীর সঙ্গে যােগাযােগ করে আমাদের সমিতি। দেখে রিঙ্কা মজুমদারের শ্বেতী সারেনি। মাধবী মজুমদারের জীবনে স্টোভ বাস্ট করে দৃষ্টি হারাবার ঘটনাই ঘটেনি। শ্যামাপদ দত্তের মানসিক ভারসাম্যের অভাব এখনও আছে। চন্দন দাস ক্যানসারের আক্রমণ থেকে মুক্ত হয়নি। সনকা পালের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে তার বাস্তব কোনও অস্তিত্ব নেই। সুদীপ দাস মৃগীরােগ থেকে মুক্ত হতে এখনও বাবার স্নানজল ও চিকিৎসকের নির্দেশমতাে ওষুধ দুটোই গ্রহণ করে চলেছেন। ওষুধ বন্ধ করে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। সেক্ষেত্রে অসুস্থতা বেড়েছে। রুমা ঘােষ নাকি জলের ভুলে হাত ও পায়ের অসাড়তার শিকার হন। বাবা পঞ্চানন ঘােষ বলতে পারেননি কত বছর হল অসুখ হয়েছিল। কোন চিকিৎসক চিকিৎসা করেছিলেন। দেখাতে পারেননি চিকিৎসকের কোনও নির্দেশ-পত্র। আর একটি তথ্য এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সেবাইত বাসুদেব সম্পর্কে রুমার নাকি কাকা। সাবিত্রী পাল অশ্রুমুক্ত হয়েছেন। বাবা কিছু গাছ-গাছালি দিয়েছিলেন। অর্শ অনেক সময় নিজে থেকেই রক্তপাত বন্ধ রাখে। এ বিষয়ে আগেই আলােচনা করেছি। এছাড়া আরও একটি সম্ভাবনা রয়ে গেছে—বাবা অলৌকিক কিছুর পরিবর্তে আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রয়োেগ করেছিলেন।

 গিয়েছিলাম নূতন তীর্থ—তারক ভােলার মন্দির ও আশ্চর্য পুরুষ শ্রীশ্রীবাসুদেবের দর্শন লাভের আশায়। দিনটা ৭ জানুয়ারি ১৯৯০। দর্শনার্থীদের গাড়ির ভিড় দেখে বুঝলাম বিজ্ঞাপনের খরচটা চুড়ান্তভাবেই সার্থক হয়েছে।

 বাবার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করতে আশ্চর্য পুরুষের এক আশ্চর্য চামচা প্রথম বাধা দিলেন। পুলিশি জেরা চালিয়ে গেলেন। এতকিছুর পরও আশ্চর্য পুরুষের দর্শন মিলল না। পরিবর্তে চামচা যা বললেন, তার সারমর্ম—আমি যদি প্রবীর ঘােষ হই তাে ...। এরপর যে সব নােংরা কথা বললেন সেগুলাে ছাপার অযােগ্য।

 রাগের কারণটা বােঝার চেষ্টা করলাম। তবে কি আমাদের পােস্টাল ডিপার্টমেন্টের কর্মধারায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে? ৫ তারিখে রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠান চিঠিটা কি ইতিমধ্যেই শ্রীশ্রীবাসুদেবের কাছে পৌছে গেছে? আমার ছােট্ট চিঠিটায় বাসুদেবকে অপমান করার মতাে একটি কথাও লিখেছি বলে তাে বরং ছিল তাঁকে প্রণামী দেওয়ার অঙ্গীকার। পুরাে চিঠিটাই তুলে দিচ্ছি পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ন্যায়-বিচার পাবার আশায়।

৫.১.১৯৯০

শ্রীশ্রী বাসুদেব সেবাইত,
বাবা তারক ভােলার মন্দির
৩৮, প্রামাণিক ঘাট রােড
কলকাতা-৭০০ ০৩৬

 বাবা তারক ভােলার কৃপায় ও আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় কৃপাপ্রার্থী প্রতিটি রােগী রােগমুক্ত হয়েছেন বলে বৃহু প্রচার শুনেছি ও পড়েছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও লােকমুখে আপনার প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের অথবা তাঁদের প্রিয়জনদের রােগমুক্তি কামনায় আপনার কাছে আসছেন। আমিও আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার খবরে আকৃষ্ট।

 অলৌকিক কোনও ঘটনা বা অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনও ব্যক্তির কথা শুনলে আমি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রকৃত সত্য জানতে সত্যানুসন্ধান চালিয়ে থাকি। এই ধরনের সত্যকে জানার প্রচেষ্টাকে একজন সৎ মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই আপনি স্বাগত জানাবেন।

 আপনার দাবির বিষয়ে একটি সত্যানুসন্ধান চালাতে আপনার কাছে পাঁচজন রােগীকে হাজির করতে চাই। আপনি ছ’মাসের মধ্যে রােগীদের রােগমুক্ত করতে পারলে আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা এবং বাবা তার ভােলার মাহাত্ম্য অবশ্যই স্বীকার করে নেব ও প্রণামী হিসেবে আপনাকে দেবাে ৫০ হাজার টাকা।

 আগামী সাত দিনের মধ্যে আপনি চিঠির উত্তর না দিলে অথবা অনুসন্ধানের কাজে সহযােগিতা না করলে অবশ্যই ধরে নেবাে আপনি মিথ্যাচারী ও বুজরুক।

শুভেচ্ছা সহ-
প্রবীর ঘােষ

 এমনি আরও বহু বহু অবতারের রােগমুক্তির ক্ষমতার উপর সমীক্ষা চালিয়েছি আমরা। প্রতিটি ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করলেও একটা মােটা-সােটা বই হয়ে যাবে। এইসব সমীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি—

যাঁরা বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতায় বা স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের সাহায্যে
যে কোনও রােগ সারাবার দাবিদার, তারা প্রত্যেকেই হয়
বুজরুক, নয় পাগল। অবতারদের সকলকেই ঠগ।
ও ধান্দাবাজ বলতে পারি না। এঁদের
অনেকেই ঈশ্বর সম্বন্ধে জম্মগত
ভাবে নানা ভ্রান্ত ধারণার
শিকার।

 এই যুগেই বেশ কিছু অবতারদের দেখতে পাচ্ছি, যারা নানা রকম সেবামুলক কর্মসুচির মুখােশ এঁটে চুড়ান্তভাবে মানুষ ঠকিয়ে অর্থ রােজগারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম-ব্যবসায়ে আজ তারা একদিকে যেমন বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছে, তেমনি ভক্ত রাজনৈতিক নেতাদের ও উঁচু সমাজের লােকদের কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠেছে সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতার অধিকারী।

যােগে বৃষ্টি আনলেন শিববাল যােগী

১৯৮৫-র মে-জুনে আর এক ভারতীয় যােগী পত্র-পত্রিকায় যথেষ্ট আলােড়ন তুললেন। শিববাল যােগী। শিববাল যােগীর দাবি, তিনি যােগের দ্বারা প্রকৃতিকে (বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি ঘটনা) নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তারই সবচেয়ে বড় প্রমাণ তিনি রাখলেন ৩০ মে বাঙ্গালােরে। যােগের দ্বারা বৃষ্টি নামালেন। ঘটনাটার দিকে এবার একটু ফিরে তাকানাে যাক।

 বাঙ্গালাের শহরে জল সরবরাহ করা হয় শহরের কাছাকাছি থিপাগাণ্ডানাহালি জলাশয় থেকে। বৃষ্টিপাতের অভাবে জলাশয়ের জল খুবই কমে গিয়েছিল। বাঙ্গালাের ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সিউয়্যারজ বাের্ড (Bangalore Water Supply and Sewerage Board) কর্তৃপক্ষের মতে বৃষ্টি না হলে সঞ্চিত জলে আর মাত্র ১৫ দিনের মতাে জল সরবরাহ সম্ভব। শেষ পর্যন্ত মুশকিল আসানের জন্য বােড কর্তৃপক্ষ বিবাল যােগীকে অলৌকিক ক্ষমতাবলে বৃষ্টি আনার জন্য লিখিতভাবে আমন্ত্রণ জানান।

 ২৮ মে বাঙ্গালােরের এক দৈনিক সংবাদপত্রে প্রথম খবরটি প্রকাশিত হয়। অতএব ৩০ মে জলাশয়ের কাছে অনুষ্ঠিত শিবলাল যােগীর বৃষ্টি আনার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উৎসুক দর্শকের অভাব হয়নি। অনুষ্ঠানে শিববাল যােগী এলেন শুভ্র ধুতি পরে, বিদেশি গাড়িতে সওয়ার হয়ে। যােগী ধ্যানে বসলেন, সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল ভক্ত-শিষ্যদের ভজন গান ও নাচ। কয়েকজন শিষ্য জলন্ত কপূর জিভে রেখে

শিববাল যােগী

আরতি করেন। শিষ্যদের এই অলৌকিক কাজকর্ম দেখে দর্শকরা তুমুল জয়ধ্বনি দিলেন। ঘন্টা তিনেক ধ্যানের পর দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে যােগীর ধ্যান ভাঙল। এরপর যােগী ভক্তদের প্রণাম নিলেন, বিনিময়ে দিলেন বিভূতি। যে-সব বিশিষ্ট ভক্তেরা পরম বিশ্বাসে ভক্তিভরে যােগীর পদধূলি নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্ধ্রের প্রাক্তন মন্ত্রী ও লােকসভার সদস্যা শ্রীমতী লক্ষ্মীকানথাম্মা, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর প্রমুখ অনেকেই।

 শিববাল যােগী ঘােষণা করেছিলেন, একমাসের মধ্যে জলাশয়টি ভর্তি হয়ে যাবে। খবরে আরও প্রকাশ, সে-দিনই বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৫ মিলিমিটার।

 পরবর্তীকালে অনেক পত্র-পত্রিকাতেই সংবাদটি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। এবার একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি সেই সঙ্গে আরও কয়েকটা খবর আপনাদের পরিবেশন করছি।

 ২৮ মে বাঙ্গাললারের যে দৈনিক সংবাদপত্রটিতে শিববাল যােগী দুদিন অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা বৃষ্টি নামাবেন বলে খবর সংবরাহ করেছিলেন, সেই পত্রিকাটির আবহাওয়া বার্তায় বলা হয়েছিল, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু কয়েক দিনের মধ্যেই কর্নাটকে এসে পৌছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আবহাওয়া বার্তাতেই আরও বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে কোচিনে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। দীর্ঘ তাপদাহের পর ২৭ তারিখে বাঙ্গালােরে কিছু বৃষ্টি হয়েছে, যদিও এই বৃষ্টি ঠিক বর্ষার আগমনবার্তা নয়। অর্থাৎ এই বৃষ্টি মৌসুমী বায়ুর ফলে হয়নি।

আগুন খাচ্ছেন অনিন্দিতা

 বাঙ্গালাের আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে যে সময়ে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত অবশ্যম্ভাবী, সেই সময়টিতে বৃষ্টি নামাকে কী করে শিববাল যােগীর অলৌকিক কাজ নয়। আমি নিজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় জিভে জ্বলন্ত কপুর রেখে দেখিয়েছি। কপূরের আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে বলে সাধারণ মানুষের চোখে ঘটনাটা রহস্যময় ও অলৌকিক বলে মনে হয়। কপূর একটি volatole বা উদ্বায়ী বস্তু। অতিমাত্রায় জুলনশীল। ফলে অতি দ্রুত জ্বলে শেষ হয়ে যায়। আগুনের তাপ জিভে ততটা অনুভূত হয় না। জিভ ভাল করে লালা দিয়ে ভিজিয়ে নিলে কয়েক মুহূর্তের জন্য জ্বলন্ত কপূরের তাপ আদৌ অসহ্য নয়। এই খেলা দেখাতে যে বিষয়ে খুবই সচেতন থাকা প্রয়ােজন তা হলাে, কপূরের আগুন যেন গলায় না প্রবেশ করে। প্রবেশ করলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। খেলাটা কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব বা অলৌকিক নয়। আমরা বিভিন্ন অলৌকিক বিরােধী অনুষ্ঠানে জিভে কৰ্পর জ্বেলে দেখাই।

চন্দননগরে সাধুর মৃতাকে প্রাণ-দান

১৯৮৩'র ২৫ মে যুগান্তর’ দৈনিক পত্রিকায় এক সন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতাবলে মৃতকে বাঁচানাের বিবরণ প্রকাশিত হলাে। বিবরণে বলা হয়েছিল, চন্দনগরে রাস্তার ধারের একটা বেলগাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসী। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এক পুরুষের মৃতদেহ। সঙ্গে চলেছিলেন মৃতের স্ত্রী। বেলগাছের কাছে এসে রমণীটি ধনুক থেকে বেরিয়ে আসা তীরের মতােই আছড়ে পড়েন সন্ন্যাসীর পায়ে, সন্ন্যাসীকে রমণী অনুরােধ করেন, “আমার স্বামীকে বাঁচান। ওঁর জ্ঞাতি শত্রুরা ওঁকে বিষয় খাইয়ে মেরে ফেলেছে। ওঁকে না হলে আমি বাঁচব না।” কান্নায় ভেঙে পড়েন রমণী। |

 সন্ন্যাসী বলেন, “বাঁচানাের আমি কে? ঈশ্বরের কৃপা থাকলে আর তােমার সতীত্বের জোর থাকলে বাঁচবে। আমার দেওয়া এই বিভূতি শরীরে ও মুখে ছড়িয়ে দাও।”

 পরম বিশ্বাসে সাধুর আদেশ পালন করাতে মৃত উঠে দাঁড়ায়।

 বিবরণের মােটামুটি এই মােদ্দা কথা শুনে আমি স্বভাবতই সন্ন্যাসীর দর্শনলাভের তীব্র বাসনায় চন্দননগরের স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলে এই সন্ন্যাসীর বিষয়ে জানতে চাই। যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান চালিয়েও এই ধরনের কোনও সন্ন্যাসী বা প্রাণ ফিরে পাওয়া মৃত ও তার পরিবারের কারও সন্ধান পাইনি। এমন একটা চমকপ্রদ অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র একজন সাংবাদিক ছাড়া স্থানীয় কেউই জানতে পারলেন না, এটাই আমার কাছে আরও বেশি চমকপ্রদ ঘটনা বলে মনে হয়েছে। পত্রিকায় এই সংবাদ পরিবেশনে আরও কয়েকটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছি। ঘটনাটি ঘটার তারিখের কোনও উল্লেখ ছিল না। ছিল না মুতের নাম ঠিকানা। বিংশ শতাব্দীর এমন একটা বিস্ময়কর ঘটনাকে এমন ত্রুটিপূর্ণভাবে, হেলাফেলার সঙ্গে পরিবেশন করা হলাে কেন? কেন খবরের সঙ্গে নবজীবন পাওয়া লােকটির, তার স্ত্রীর ও সন্ন্যাসীর ছবি এবং ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যত জনের সম্ভব ইন্টারভিউ ছাপা হল না? মৃতের জীবনদানের ঘটনা কি এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা খবর নয়? একমাত্র পত্রিকা হিসেবে এমন ‘স্কুপ নিউজ’ পেয়েও যুগান্তরের এমন গা-ছাড়া ভাবই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের উদ্রেক করে। আমি এই বিষয়ে আরও বিশদভাবে আলােকপাতের জন্য যুগান্তর চিঠিপত্র বিভাগে একটি চিঠি দিই। এই চিঠি লেখার পেছনে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ঘটনার সত্যতা যাচাই করার সুযােগ লাভ। আমার সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে, মিথ্যে খবর ছেপে ছিল শুধু এই উদ্দেশ্যে যে—পাবলিক খাবে ভালাে।

ভগবান শ্রীসদানন্দ দেবঠাকুর

অশ্বিনী দত্ত রােড, কলকাতা-২৮-এ গড়ে উঠেছে ‘আনন্দধাম’, ভগবান শ্রীসদানন্দ দেবঠাকুরের আশ্রম। ভক্ত শিষ্য-শিষ্যারা বাবাকে অবতার জ্ঞানে নয়, দেব জ্ঞানেই পুজো করেন। সদানন্দের কথায়—“আমি ব্রহ্ম, আমি শক্তি। নাম কর, নাম কর, আমায় পাবি। তােরা যেখানেই যাঁকে পূজা করিস না কেন জানবি তা—আমাতেই অর্পণ হয়।”

 ভক্তদের প্রতি সদানন্দের বরাভয়—“তুই আমার নাম নে,—তাের সকল পাপ ধ্বংস করব আমি... তাের বাঞ্ছা পূরণ করব আমি। আমাকে ডাকতে থাক। ডাকতে ডাকতে সুগন্ধ হয়ে তাের মনকে দেব মজিয়ে, জ্যোতিঃ রূপে হবে প্রকাশ, রূপ হয়ে দর্শন, ভাব হয়ে করব আলিঙ্গন, বিভাের হয়ে ঢলে পড়বি আমারই কোলে। তখন শুধু আনন্দ-আনন্দ-সদানন্দ।

 পত্র-পত্রিকায় ছবিসহ শ্রীসদানন্দের বিজ্ঞাপন কিছুদিন ধরেই চোখে পড়ছিল। বিজ্ঞাপনগুলােতে অলৌকিক সিদ্ধপুরুষ’, ‘প্রিয়দর্শন দেবপুরুষ' ইত্যাদি বিশেষণ শ্রীসদানন্দের উপর বর্ষিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলােতে বলা হয়েছে শ্রীসদানন্দ কৃপা করলে রােগমুক্তি, সৌভাগ্যলাভ ও অসাধ্যসাধন হয়।

 দেবপুরুষটির দর্শনে হাজির হলাম ‘আনন্দধামে। সময় ১৯৮৭-র ২৮ জুলাইয়ের সন্ধ্যা। প্রতীক্ষাকক্ষে আরও অনেকের মতাে আমাকে নাম পাঠিয়ে কিছুক্ষণ বসতে হল। দেওয়ালের নানা লেখা পড়ে ও ‘পুরমপুরুষ শ্রীসদানন্দ লীলা মাহাত্ম: (প্রথম খণ্ড)'র পাতা উল্টে সময় কাটালাম। দেওয়ালে উম্মাদ রােগ, হিস্টিরিয়া-সহ বহু রােগ ভাল করে দেওয়ার গ্যারান্টির কথা বড় বড় রঙিন হরফে লিপিবদ্ধ। যে লেখাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করল সেটা হল, বন্ধারমণীকে মাতৃত্ব দানের গ্যারান্টি। লীলা মাহাত্মাও খুব আকর্ষণীয় বই। বইটিতে জনৈকা শ্রীমতী লক্ষ্মী ঘােষ জানিয়েছেন, এক হিস্টিরিয়া রােগীকে শুধু একটি তাগা বেঁধে বাবাঠাকুর দু-দিনে তাকে ভাল করেছিলেন।

 লক্ষ্মীদেবীর এক আত্মীয় বহু বছর ধরে প্যারালিসিস রােগে ভুগছিলেন। সর্বাঙ্গ অসাড়। হাসপাতালে যখন মৃত্যুর দিন গুনছেন সেই সময় লক্ষ্মীদেবী রােগীর স্ত্রীকে পরামর্শ দেন বাবাঠাকুরের শরণাপন্ন হতে। বাবাঠাকুর দিলেন আশীর্বাদী ফুল-বেলপাতা। বলে দিলেন, এই ফুল-বেলপাতা রােগীর শরীরে বুলিয়ে দিও। অবাক কাণ্ড, কয়েক দিনের মধ্যেই রােগী রােগমুক্ত হলেন।

 জনৈক পঙ্কজ হাজরা জানিয়েছেন, একরাতে আসন্ন প্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন হাসপাতালে। সঙ্গী করেছিলেন শুধু তার নাম। পথ চলছেন আর ব্যাকুল হয়ে ডাকছেন, ‘গুরু তুমি দৃষ্টি রাখাে।' হঠাৎ পথের মাঝেই দর্শন পেলেন ইষ্টদেব সদানন্দের।

 রেণুকা সমাজদার জানিয়েছেন, এক ফাল্গুনী গভীর রাতে হঠাৎ সমস্ত ঘর আলােকিত হয়ে গেল। রেণুকা দেখতে পেলেন সেই আলাের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীসদানন্দ। প্রাণ-মন আনন্দে ভরে উঠল। বিস্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল। শ্রীসদানন্দ হঠাৎ রূপ পরিবর্তন করলেন। হয়ে গেলেন মা কালী। এরপরও বহুদিন সময়ে-অসময়ে অপার করুণা বর্ষণ করে দেখা দিয়েছেন কখনাে কৃষ্ণ, কখনাে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু রূপে, কখনাে বা কালী রূপে।

 একই ভাবে লক্ষ্মী ঘােষ তীব্র আকুতি নিয়ে যখনই ঠাকুরের দর্শন চেয়েছেন, তখনই শ্রীসদানন্দ আবির্ভূত হয়েছেন। এই সদানন্দই কখনাে দর্শন দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে, কখনাে বিষ্ণু রূপে, কখনও বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর রূপ নিয়ে।

 জনৈক পার্থ কুণ্ডু চৌধুরী একদিন ঘরে বসে তারকেশ্বরের বিগ্রহকে মনেমনে স্মরণ করে কল্পনায় রূপ গড়ে প্রণাম জানাচ্ছেন। পরম বিস্ময়ে দেখলেন, তারকেশ্বর বিগ্রহের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঠাকুর শ্রীসদানন্দ স্বয়ং। এমনতর আরও অনেক অত্যাশ্চর্য অলৌকিক ঘটনা আরও অনেকের জবানিতেই প্রকাশিত হয়েছে।

 এক সময়ে ভিতরে যাওয়ার ডাক পেলাম। শ্রীসদানন্দ একটা খাটে বসে। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মধ্যে। মেদহীন চেহারা। গায়ের রঙ সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় কিছুটা ফর্সা। চুল প্রায় ঘাড়ে এসে পড়েছে।

 বাবাঠাকুরকে পরিচয় দিলাম ‘আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে। নাম বললাম পুলক ঘােষ। সদানন্দ আমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক প্রশ্ন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের পত্রিকায় তাে প্রবীর ঘােষও লেখেন, ওঁকে চেনেন? উত্তর দিলাম, প্রবীরবাবুর লেখার সঙ্গে সামান্য পরিচয় আছে, কিন্তু প্রবীরবাবুর সঙ্গে নয়। বাবাঠাকুর বললেন, আপনার ছবি-টবি কোনও বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে? আপনাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে। বললাম, না, আমার ছবি প্রকাশিত হওয়ার মতাে নামী-দামি মানুষ এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। তবে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়, কোথাও দেখে থাকতেই পারেন।

 না, সাক্ষাৎকার নেবার চেষ্টা করিনি। নিজের সমস্যা নিয়ে এসেছি— জানিয়েছিলাম। তবে জানিয়েছিলাম শ্রীসদানন্দের বিষয়ে পত্রিকার পাতায় সুন্দর একটা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। এই ইচ্ছের কথা বলা সত্ত্বেও সদানন্দ তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। বরং জানতে চাইলেন, আপনি যে সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে এসেছেন, আপনার কি অলৌকিক বিষয়ে বিশ্বাস আছে?

 বললাম, আছে বলেই তাে আসা। তবে কথা হল, আসল মানুষটি খুঁজে পাওয়াই কঠিন।

 আপনি গ্রহের ফল, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করেন? শ্রীসদানন্দ জিজ্ঞেস করলেন।

 সদানন্দের কথায় খেয়াল হলাে আজ প্রচণ্ড তাড়াহুড়ােয় হাতে বা আঙুলে তাবিজ বা গ্রহরত্নের আংটি পরে আসা হয়নি। অবস্থাটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম। বললাম, একসময় গ্রহরত্নের আংটি পড়তাম। বছরখানেক হলাে আংটি ছেড়েছি। সেও এক দক্ষিণ ভারতীয় সাধুর আদেশে। তিনি বলেছিলেন জন্মকুণ্ডলীর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন শিব-শক্তি, ভাগ্যে যা ঠিক করা আছে তা পাল্টাতে পারেন একমাত্র শিব-শক্তি, পাথর-টাথর নয়। ওঁরই নির্দেশে পাথর বিদায় দিয়ে

মন্ত্রে নাকি গর্ভবতী করেন শ্রীসদানন্দ ঠাকুর

শিব-শক্তির উপাসক হয়েছি।  কী পাথরের আংটি ছিল আপনার? জিজ্ঞেস করলেন সদানন্দ।

 একটা ছিল মুক্তো, একটা হিরে। বললাম আমি।

 হিরে আর মুক্তো কত রতি করে ছিল? আবার প্রশ্ন করলেন সদানন্দ।

 বলালাম হিরে আধ রতির মতাে, মুক্তো সাড়ে ন’রতি। সে-দিন আরও কিছু এটা-সেটা প্রশ্ন করে আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। একটা ঠিকানাও বললাম। বাবাঠাকুর ঠিকানাটা ডায়রিতে টুকে নিয়ে সাতদিন পরে আসতে বললেন। জানালেন সে-দিনই আমার সমস্যার কথা শুনবেন এবং সমাধানের উপায় বাতলাবেন।

 সাত দিন পরে আবার গেলাম। এবার আমার সঙ্গী চিত্র-সাংবাদিক গােপাল দেবনাথ। আজও বাবা সতর্কতার সঙ্গেই কথা শুরু করলেন। এটা-সেটা নিয়ে গল্প-গাছার পর হঠাই বললেন, আপনি তাে এখন স্টোন-টোন-এ বিশ্বাস করেন। স্টোনগুলাে কী করলেন?

 বললাম, কিছুই করিনি, লকারে আছে।

 বাবাঠাকুর মৃদু হাসলেন। বললেন, এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। যে জিনিস প্রয়ােজনে আসে না সে জিনিস ধরে রেখে লাভ কী? তারচেয়ে বিক্রি করে দিন। আপনারও পয়সা আসবে, অন্যেরও কাজে লাগবে। আংটিটা যেন কী স্টোনের ছিল?

 বললাম, একটা নয় দুটো আংটি ছিল। একটা হিরের, একটা মুক্তোর।

 কেমন ওজন ছিল ওগুলাের।

 হিরেটা আধ রতির মতাে, মুক্তোটা সাড়ে-ন’ রতির।

 আমার উত্তর শুনে বাবাঠাকুর স্বস্তি পেলেন। তার টান-টান কথাবার্তা এবার সাবলীল হল।

 প্রথম দিনের সাক্ষাতে সদানন্দ আমাকে কী কী প্রশ্ন করেছিলেন এবং তার কী কী উত্তর দিয়েছিলাম প্রতিটি স্মৃতিতে ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল বাবাঠাকুর আমাকে প্রবীর ঘােষ বলেই সন্দেহ করছেন। তাই এমন কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন এবং নিশ্চিত ছিলেন, উত্তরকর্তা প্রবীর ঘােষ হলে যেগুলাের মিথ্যে উত্তর দেব। হঠাৎ করে প্রশ্নের জবাব দিতে মিথ্যে বলতে বাধ্য হলে, স্বাভাবিক নিয়মে উত্তরদাতা দ্রুত ভুলে যান কী কী প্রশ্নের উত্তরে কী কী মিথ্যে বলেছিলেন।

 সদানন্দর কাছে আমার সমস্যাগুলাে মেলে ধরলাম। পাশাপাশি শুনছিলাম তার কথা। স্নাতক। ম্যাজিক শিখেছেন। মনােবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনাে করেছেন। অভিনয় করেছেন। সদানন্দের কথায়, যাদের ভগবান বলি, তারা আমাদেরই মত রক্তমাংসের শরীর নিয়ে এসেছিলেন। নিজের শক্তিকে জানতে পেরে তারা ভগবান হয়ে গেছেন। সদানন্দও একইভাবে ভগবান। ভক্তদের লেখাগুলাে প্রসঙ্গে জানালেন, কোনও অতিরঞ্জন নেই। দু-পাতা বিজ্ঞান পড়া মানুষদের বেশির ভাগই পাশ্চাত্য সভ্যতার মােহে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে। অথচ তারা জানে না পাশ্চাত্য দেশগুলােই প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের পুঁথি-পত্র ঘেঁটে আবার নতুন করে উদ্ধার করছে পৃথিবী কাপানাে অনেক বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে। ভারত অলৌকিক, অবতার ও ঋষিদের পুণ্য-ক্ষেত্র।

 আলােচনার প্রসঙ্গকে টেনে আনলাম সদানন্দের একটি বিশেষ দাবির দিকে। বললাম, আপনি জানিয়েছেন মন্ত্রশক্তিতে ইচ্ছুক রমণীকে আপনি মাতৃত্ব দানে সক্ষম। এই মন্ত্র আপনি কোথা থেকে পেলেন?

 আমার প্রশ্নের উত্তরে সদানন্দ আবার ঋষিদেরই টেনে আনলেন। জানালেন, আড়াই-তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্ত্রের স্রষ্টা ভারতের প্রাচীন ঋষি। তাদের কাছ থেকেই শিষ্য পরম্পরায় এই মন্ত্র এসেছে আমার কাছে।

 পুলক ঘােষ পরিচয়ের আমি সদানন্দের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে ফুলবাবার কাছে যে গল্প ফেঁদেছিলাম, সেটাই ফাদলাম—আজ পর্যন্ত ঘরণী জোটার গল্প। ভগবান সদানন্দ আমার কাহিনিকে সত্য বলে ধরে নিয়ে আবারও প্রমাণ করলেন তিনি সাধারণ মানুষ মাত্র।

 ভরসা দিলেন এবার শিগগির বিয়ে হবে। বাবাকে নিয়ে সমস্যার কথা বললাম। বললাম, এমন কাজ করি, যখন-তখন যেখানে-সেখানে দৌড়তে হয়। বাড়িতে থাকেন তখন বৃদ্ধা মা ও বৃদ্ধ বাবা। বাবা হাঁপানি-রােগী। মাঝে-মাঝে রাত-দুপুরে এখন-তখন অবস্থা হয়। ডাক্তার, অক্সিজেন—বৃদ্ধা মায়ের পক্ষে চাপ সামলানাে মাঝে-মাঝে অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাবাকে কি সুস্থ করা সম্ভব নয়?

 সদানন্দ শান্ত গলায় বললেন, এই ধরনের অবস্থাই চলবে। '৯০ সাল পর্যন্ত বাঁচবেন।

 ছদ্ম-পরিচয়ের আমি তখনই জানাতে পারলাম না আমার বাবা বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। আর, হাঁপানি কেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কোনও দিনই তেমন অসুখ-বিসুখে ভােগেননি। বরং বলা চলে খুবই নীরােগ স্বাস্থ্যের, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা মানুষ ছিলেন।

 সদানন্দের দাবি প্রমাণের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৯ একটি চিঠি দিই। চিঠিটি এখানে তুলে দিলাম।

২৬.১২.৮৯

শ্রীসদানন্দ দেবাঠাকুর
“আনন্দধারা”
৭ অশ্বিনী দত্ত রােড,
কলকাতা-৭০০ ০২৮

মহাশয়,

 বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনার ভক্তদের দেওয়া কিছু বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছে। বিজ্ঞাপনগুলােতে আপনাকে অলৌকিক সিদ্ধ-পুরুষ’, ‘দেবপুরুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বছর দু-আড়াই আগে একাধিক সন্ধ্যায় আপনার আশ্রম থেকে প্রকাশিত দু-একটি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারই একটি—‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীসদানন্দ লীলা মাহাত্ম পড়ে জানলাম আপনার ভক্তরা অনেকেই আপনাকে শ্রীকৃষ্ণ, কালী, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, বিষ্ণু, তারকেশ্বর ইত্যাদি হতে দেখেছেন। বহু রােগী আপনার অলৌকিক ক্ষমতায় রােগ মুক্ত হয়েছেন। বইটিতে আপনি জানিয়েছেন, “তােরা যেখানেই যাঁকে পুজো করিস না কেন জানবি তা—আমাতেই অর্পণ হয়।”

 আপনার একটি কথায় বড়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন, মা হতে ইচ্ছুক রমণীকে আপনি মন্ত্র বলে মাতৃত্ব দিতে পারেন। এও জানিয়েছেন, আড়াই তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্ত্রের স্রষ্টা ভারতের প্রাচীন ঋষিরা। তাদের কাছ থেকেই শিষ্য পরম্পরায় এই মন্ত্র এসেছে আপনার কাছে।

 আমার বিভ্রান্তির কারণ, আপনিই যখন ঈশ্বর তখন যা খুশি করার ক্ষমতা তাে আপনারই হাতে। ইচ্ছুক রমণীকে গর্ভবতী করতে আপনার আবার মন্ত্রের প্রয়ােজন?

 অলৌকিক কোনও কিছুর অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণিত হয়নি, অথচ, অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার বহু। আমি একজন সত্যানুস্কানী। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি, অলৌকিক ক্ষমতার দাবিগুলি ছিল একান্তই অসার। আমার সত্যানুসন্ধানের প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতাে আপনিও স্বাগত জানাবেন আশা রাখি। সেই সঙ্গে এও আশা রাখি, আপনার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে অনুসন্ধানে আপনি আমার সঙ্গে সমস্ত রকমের সহযােগিতা করবেন।

 আপনার কাছে হাজির করতে চাই পাঁচজন রােগী ও তিনজন মা হতে ইচ্ছুক অথচ অক্ষম রমণীকে। রােগীদের এক বছরের মধ্যে রােগমুক্ত করে ও ইচ্ছুক রমণীদের মাতৃত্ব দান করে আপনার ক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারলে আমি এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ আপনার অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করে নেব এবং আপনাকে প্রণামী হিসেবে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে আমাদের সমিতি ভবিষ্যতে সমস্ত রকম অলৌকিক বিরােধী কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে।

 আগামী দশ দিনের মধ্যে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যােগাযােগ করে অনুসন্ধান বিষয়ে সহযােগিতা না করলে অবশ্যই ধরে নেব আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি কাহিনি এবং আপনার দাবি পুরােপুরি মিথ্যা।

 আশা রাখি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষে আমার এই চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করবেন।

 শুভেচ্ছা সহ

 প্রবীর ঘােষ  সুনিশ্চিতভাবে জানি, ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ধৃষ্টতা দেখালে সদানন্দ দেবাঠাকুরের দেবত্বর গ্যাস বেলুন ফেঁসে যাবেই।

 ১২ জানুয়ারি ১৯৯০। চিঠিটা ফেরত দিয়ে গেল ডাক বিভাগ। শ্রীসদানন্দ চিঠিটা নিতে রাজি হননি। হায় জীবন্ত ভগবান, স্বর্গের দেবতা, মর্তের তুচ্ছ এক মানুষকে এত ভয়!


আগুনে হাঁটার অলৌকিক ঘটনা।

খুদাবক্স এমনই এক ভারতীয় ফকির যিনি বিলেতের মাটিতে এক অলৌকিক ঘটনায় সেখানে আলােড়ন সৃষ্টি করছিলেন। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৩৫ সালের ৯ ও ১৭ সেপ্টেম্বর লন্ডনে। জ্বলন্ত কাঠকয়লার আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেন খুদাবক্স। ইংরেজরা স্তম্ভিত হলাে ভারতীয় ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে। পূর্ব ঘঘাষিত এই আগুনে হাঁটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা খুদাবক্সের পা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, পায়ে কোনও কিছুর প্রলেপ লাগানাে নেই। পা ছিল শুকনাে। পায়ের চেটোর তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিক। হাঁটা শেষ করার ১০ সেকেন্ড পরও তাঁর চেটোর তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিক। খুদাবক্সের পায়ের একটা নখে ১/২ বর্গ ইঞ্চি মাপের একটা লিউকোপ্লাস্টার লাগানাে ছিল। আগুনে হাঁটার পর সেটাও ছিল প্রায় অক্ষত। ১২ ফুট লম্বা ৬ ফুট চওড়া এবং ৮ ইঞ্চি গভীর অগ্নিকুণ্ডটা পার হতে খুদাবক্সের সময় লেগেছিল মােট ৫ সেকেন্ড। চারটি মাত্র পদক্ষেপে তিনি অগ্নিকুণ্ড পার হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বার করলেন, প্রতি পদক্ষেপে আগুনের সঙ্গে পায়ের সংযােগ হয়েছিল মাত্র ১ সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য। ফলে পা কোন সময়ই ভালমতাে জ্বলন্ত আগুনের স্পর্শে আসতে পারেনি। লন্ডনে হৈ-হৈ ফেলে দিয়েছিলেন খুদবক্স।

 আমাদের মা-ঠাকুমাদের অনেককেই দেখেছি জ্বলন্ত উনুন থেকে কোনও জ্বলন্ত কাঁচা-কয়লা’ কে চট করে দু’আঙুলে ধরে উনুন থেকে নামাতে। এতাে দ্রুত তারা কাজটা করেন যে, কয়লার তাপ ওই সামান্য সময়ের মধ্যে ভালমতাে হাতের সংস্পর্শে আসতে পারে না। গ্রামেও অনেককে দেখেছি, খালি হাতে জ্বলন্ত কাঠকয়লা তুলে হুঁকোর কলকেতে বসিয়ে দিচ্ছে। ওরা হাতের তেলােয় জ্বলন্ত কাঠকয়লা বেশিক্ষণ রাখে না বলে ফোসকা পড়ে না।

 ঝাড়খণ্ডের রাঁচি জেলায় গ্রীষ্মকালে আদিবাসীদের এক উৎসব পালিত হয়। নাম, মণ্ডপরব। এই উপলক্ষে আগুনে হাঁটা অনুষ্ঠিত হয়। ওরা এই আগুনে হাঁটাকে বলে ‘ফুলকুন্দনা', অর্থাৎ ফুলের উপর লাফানাে। আট-দশ হাত লম্বা দু'হাত চওড়া ও আধ হাত গভীর কাঠকয়লার আগুন জ্বালানাে হয়। পুরােহিত ওই অগ্নিকুণ্ডে মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে দেন। আদিবাসীদের বিশ্বাস এই মন্ত্রপাঠের সঙ্গে-সঙ্গে দেবী পার্বতী আগুনের ওপর ফুলের মতাে সুন্দর আঁচল বিছিয়ে দেন। এইবার কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে ওই আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে পায়ে ফোসকা পড়বে। আদিবাসী ভক্তেরা পুকুরে স্নান করে ভিজে শরীরে নেচে-নেচে আগুনের ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে গােটা তিনেক পদক্ষেপেও হেঁটে যায়। আশ্চর্যের বিষয় (?) তাদের পায়ে ফোসকা পড়ে না। এই অলৌকিক ঘটনা দেখতে বিশাল ভিড় হয়। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এই অলৌকিক ঘটনার পেছনে রয়েছে পুরােহিতের অলৌকিক ক্ষমতা ও ভক্তদের ঈশ্বর-বিশ্বাস।

কার্সিয়াং শাখার জনৈকা সদস্যা

 বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ প্রয়াত শ্রীনির্মলকুমার বসু কয়েকজন সহযােগী নিয়ে ঘটনাটা দেখতে হাজির হন। শ্রীবসু লক্ষ্য করেন অগ্নিকুণ্ড পার হতে ভক্তদের মােট সময় লাগছে ৮ সেকেন্ডের মতাে। পা'দুটি এক সেকেন্ডেরও অনেক কম সময়ের জন্য আগুনের স্পর্শ পাচ্ছে। না, কারও পায়েই ফোসকা পড়ছে না।

 শ্রীবসুর এক সহযােগী দ্রুত আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, পারেননি। পায়ে ফোসকা পড়েছিল। শ্রীবসুর আর এক সহযােগী ভক্তদের মতাে স্নান করে ভেজা শরীরে, ভেজা পায়ে জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে দ্রুত হেঁটে যান। তার পায়ে কোনও রকম ফোসকা পড়েনি। তার দুটি কারণ হলাে (১) ভেজা পায়ে কিছু নরম মাটির প্রলেপ পড়েছিল। (২) দ্রুত পদক্ষেপের দরুন মুহূর্তের জন্য পা আগুনের স্পর্শ পেয়েছিল।

১৯৯৩-তে বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে আন্ত্রিকে গণমৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

 উজ্জয়িনী জেলার তাজপুর গ্রামেও প্রতি বছর অলৌকিক আগুনে-হাঁটা অনুষ্ঠিত হয়। তাজপুরের এই আগুনে-হাঁটা ধর্মানুষ্ঠানে যারা হাঁটে তারা নাকি ভৈরবের উপাসক। হাঁটতে গিয়ে কারাে পা পুড়লে ধরে নেওয়া হয়, অপবিত্র মনের দরুনই এমনটা হয়েছে।

 বুলগেরিয়ার এক সমুদ্রবন্দর বার্গাস (Burgus)। বার্গাসের ৩০ কিলােমিটার দূরে একটি গ্রাম পানিচারাে (Panitcharewo)। এই গ্রামের নেস্টিনারি (Nestinari) নামে একটি সম্প্রদায় প্রতি পছর ৩ জুন বাইজানটাইন সম্রাট কনস্টানটাইন ও সাম্রাজ্ঞী হেলেনাকে স্মরণ করে এক আগুনে-হাঁটা উৎসব পালন করে। জনসমাগমও হয় প্রচুর।

 জাপান, মালয়, ফিজি, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড ও স্পেনেও আগুনে-হাঁটা বা অগ্নি-উৎসবের প্রচলন রয়েছে।

আগুনে-হাঁটা একটি কৌশল মাত্র। এই কৌশলের জন্য প্রয়ােজন
ক্ষিপ্রতা ও তাপ-সহন শক্তি, অন্ধ-ভক্তি ও বিশ্বাস
ভক্তদের মস্তিষ্কের সেই সব স্নায়ুকে নিষ্ক্রিয়
রাখে যা পায়ের তাপের খবর
পৌছে দেয়।

 ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ আমাদের বহু সহযােগী সংস্থা, বিজ্ঞান ক্লাব ও যুক্তিবাদী সংগঠন আজ পর্যন্ত আনুমানিক হাজার-হাজার অনুষ্ঠানে জ্বলন্ত লাল টকটকে কাঠের আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে দেখিয়েছে। এমন অসাধারণ দুর্লভ দৃশ দেখেছেন অন্তত কয়েক লক্ষ মানুষ। প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দর্শকদের মধ্যে অনেকেই আগুনে হাঁটায় অংশ নিয়েছেন এবং শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ ক্ষেত্রেই দর্শকদের পা আগুনে দগ্ধ হয়নি।

 সাধারণত ১০ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট চওড়া একটি আয়তক্ষেত্র তৈরি করা হয় ইট বিছিয়ে। গনগনে কাঠ কয়লার আঁচে যখন সাধারণ মানুষগুলাে ছ'ফুট দূরে দাঁড়িয়েও প্রচণ্ড তাপে ঝলসাতে থাকে, তখনই “যুক্তিবাদী জিন্দাবাদ” ধ্বনির মধ্য দিয়ে জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে দীপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে থাকে যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মীরা। বহু মানুষের সােচ্চার ধ্বনি ও আমাদের সহযােগীদের হাঁটতে দেখে দর্শকরাও অনুপ্রাণিত হন। আমাদের আহ্বানে তারাও এগিয়ে আসেন এই একান্ত বিশ্বাস নিয়ে—ওদের যখন পােড়েনি, আমারও পা পুড়বে না। এই মানসিক শক্তির সঙ্গে দ্রুত চলার ছন্দ যখনই যুক্ত হয়, তখনই আর পা পােড়ে না।