বিষয়বস্তুতে চলুন

অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত (প্রথম খণ্ড)/তৃতীয় সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় সর্গ

 অতঃপর একদা তিনি পেলব শ্যামলতৃণাবৃত কোকিলকুজিতপাদপপূর্ণ পদ্ম প্রস্ফুটিতদীর্ঘিকাশোভিত গীতপ্রতিধ্বনিত কাননের বিষয় শ্রবণ করিলেন॥১॥

 তখন কামিনীগণের প্রিয় সেই পুরকাননসমূহের রমণীয়তার বিষয় শ্রবণ করিয়া, অন্তগৃহে অবরুদ্ধ নাগের ন্যায়, তিনি বহিঃপ্রয়াণের অভিলাষ করিলেন॥২॥

 অনন্তর নরপতি, পুত্রের অভিব্যক্ত মনোভাব অবগত হইয়া, নিজ স্নেহ ও ঐশ্বর্যের যোগ্য এবং পুত্রের বয়সানুরূপ বিহারযাত্রার আদেশ দিলেন॥৩॥

 সুকুমারচিত্ত কুমার যাহাতে উদ্বিগ্ন না হন, তাহা চিন্তা করিয়া, তিনি রাজমার্গে আর্ত ও ইতর ব্যক্তির চলাচল নিষেধ করিলেন ॥৪॥

 তিনি সুস্নিগ্ধ ব্যবহারের দ্বারা, অঙ্গহীন, বিকলেন্দ্রিয়, জরাগ্রস্ত, দুঃস্থ, আতুর আদি জনগণকে, রাজপথ হইতে নিবৃত্ত করিয়া, তাহার পরম শোভা সম্পাদন করিলেন॥৫॥

 রাজমার্গ শোভিত করা হইলে, অনুজ্ঞা প্রাপ্ত শ্রীমান কুমার, বিনীত অনুচরগণের সহিত, প্রাসাদতল হইতে যথাসময়ে অবতরণ করিয়া, নরপতি-সমীপে গমন করিলেন॥৬॥

 অতঃপর আগতাশ্রু নৃপতি, পুত্রের মস্তক আঘ্রাণ করিয়া এবং তাঁহাকে বহুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, মুখে “যাও” এইরূপ আদেশ দিলেন, কিন্তু স্নেহবশত অন্তরের সহিত বিদায় দিতে পারিলেন না॥ ৭॥

 অনস্তর কুমার, সুবর্ণ-অশ্বাভরণ-সজ্জিত, শান্ত-তুরঙ্গমচতুষ্টয়বাহিত, পৌরুষবান বিদ্বান পবিত্রাত্মা সারথিনিয়ন্ত্রিত হিরণ্ময় রথে আরোহণ করিলেন॥৮॥

 তারাগণের সহিত তারাধিপ চন্দ্র যেরূপ অন্তরীক্ষে প্রকাশিত হন, সেইরূপ কুমার তাঁহার অনুরূপ অনুচরবর্গের সহিত, চলৎপতাকা-বিশিষ্ট রাজমার্গে উপস্থিত হইলেন॥৯॥

 কৌতূহলে স্ফীততর নেত্রের ন্যায়, নীলোৎপলখণ্ডে আচ্ছাদিত রাজপথে, পৌরবর্গ কর্তৃক চতুর্দিক হইতে নিরীক্ষ্যমাণ হইয়া, তিনি ধীরে ধীরে গমন করিতে লাগিলেন॥১০॥

 তাঁহার সৌম্যভাবের জন্য কেহ তাঁহাকে প্রশংসা করিল। কেহ তাঁহার দীপ্তিবশত তাঁহাকে বন্দনা করিল এবং কেহ তাঁহার দাক্ষিণ্যহেতু ঐশ্বর্য ও দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করিল॥ ১১॥

 সম্ভ্রান্তগৃহ হইতে কুজগণ, কিরাত ও বামনসমূহ, এবং সাধারণ গৃহ হইতে নারীগণ, নির্গত হইয়া দেবতার শোভাযাত্রার ধ্বজসমূহের ন্যায় (অর্থাৎ দেবতার শোভাযাত্রায় ধ্বজসমূহকে লোকে যেমন প্রণাম করে), তাঁহাকে প্রণাম করিল॥ ১২॥

 “কুমার গমন করিতেছেন” প্রেষ্যজন হইতে এই বার্তা শ্রবণ করিয়া, নারীগণ গুরুজন হইতে অনুমতি লইয়া, তাঁহার দর্শনাভিলাষে হর্ম্যতলে গমন করিলেন॥১৩॥

 শিথিল কাঞ্চী-বন্ধনের দ্বারা বাধাগ্রস্ত, সদ্য জাগ্রত হওয়ায় আকুল-লোচনা, কৌতূহলপূর্ণ। রমণীগণ, তাঁহার আগমন বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া, অলংকৃত হইয়া একত্রিত হইলেন॥১৪॥

 প্রাসাদসোপানতলে প্রতিধ্বনিত কাঞ্চীরব ও নুপুরনিঃস্বনের দ্বারা গৃহপক্ষিসমূহকে বিভ্রান্ত করিয়া, দ্রুতগমনের জন্য তাঁহারা পরস্পর পরস্পরকে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন॥১৫॥

 কোনো বরাঙ্গনা, কৌতূহলবশত দ্রুতগতি হইবার ইচ্ছা করিয়াও, পীন পয়োধর ও বিশাল শ্রোণিভারহেতু মন্থরগতি হইলেন॥১৬॥

 কোনো রমণী দ্রুতগমনে সমর্থ হইয়াও, গোপনে পরিহিত ভূষণসমূহ অতিশয় প্রকটিত হওয়ায় (অত্যন্ত চোখে পড়ায়), লজ্জাবশত তাহা আবৃত করিয়া, বেগসংবরণপূর্বক ধীরে ধীরে গমন করিলেন॥১৭॥

 পরস্পরের সংঘর্ষ হেতু জড়িত হইয়া, এবং সেই সংঘর্ষে কুণ্ডলসমূহ সংক্ষুভিত করিয়া, রমণীগণ, ভূষণনিক্বণে বাতায়নসমূহ অশান্ত করিয়া তুলিলেন ॥১৮॥

 বাতায়নবিনিঃসৃত, পরস্পরসংলগ্নকুণ্ডলরমণীমুখ-পঙ্কজশ্রেণী, হর্ম্যে বিরাজিত কমলরাজির ন্যায় শোভা ধারণ করিল॥১৯॥

 কৌতূহলে বাতায়নসমূহ উদ্ঘাটিত করিয়া, যুবতীগণ প্রাসাদ পূর্ণ করিয়া বিরাজ করিতে লাগিলেন। যুবতীপরিপূর্ণ বিমান (উচ্চপ্রাসাদ) সমূহে শোভান্বিত। সেই নগরী, অপ্সরাভূষিত বিমান (দেবগৃহ) পরিবৃত স্বর্গের ন্যায় প্রতিভাত হইল ॥২০॥

 বাতায়নের অল্পায়তনহেতু, বরাঙ্গনাগণের পরস্পর কপোলসংলগ্ন কুণ্ডলবিভূষিত আননসমূহ, পঙ্কজরচিত মালার ন্যায় শোভা পাইতেছিল॥২১॥

 রমণীগণ কুমারকে পথে যাইতে দেখিয়া, যেন ভূতলে অবতরণ করিতে উৎসুক হইলেন এবং পথস্থিত জনসমূহ তাঁহাকে দর্শন করিতে ঊর্ধ্বমুখ হইয়া, যেন স্বর্গারোহণে ইচ্ছুক হইলেন॥২২॥

 নারীগণ রূপৈশ্বর্যদীপ্ত রাজপুত্রকে দেখিয়া মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন— 'ইঁহার ভার্যা ধন্য।’ শুদ্ধ মনোভাব হইতেই তাঁহারা ইহা বলিলেন, কোনো মন্দ ভাব হইতে নহে॥২৩॥

 রূপে স্বয়ং পুষ্পকেতুর ন্যায়, আয়ত ও পীনবাহু এই রাজকুমার, ঐশ্বর্য পরিত্যাগ করিয়া ধর্মের আরাধনা করিবেন, এই ভাবিয়া তাঁহারা তাঁহার জন্য গৌরব বোধ করিলেন॥২৪॥

 শুচি ও সৌম্যবেশ পরিহিত, বিনীত পৌরজনে আকীর্ণ রাজপথ, সেই প্রথম দেখিয়া কুমার হৃষ্ট হইলেন। এবং নিজের যেন পুনর্জন্ম হইল— তাঁহার মনে কতকটা এইরূপ ভাবের উদয় হইল॥২৫॥

 পরন্তু, শুদ্ধাধিবাস দেবগণ সেই নগরকে স্বর্গের ন্যায় প্রহৃষ্ট দেখিয়া, রাজপুত্রের গৃহত্যাগের (প্রব্রজ্যার) অনুপ্রেরণার জন্য, এক জরাজীর্ণ মায়া-মানব সৃষ্টি করিলেন॥২৬॥

 সাধারণ জনসমূহ হইতে পৃথগাকৃতি, জরাভিভূত সেই বৃদ্ধকে দেখিয়া, রাজকুমার অনিমেষনয়নে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন, এবং সারথিকে উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিলেন ॥২৭॥

 “হে সূত, শ্বেতকেশযুক্ত, ভ্রূদ্বারা আবৃত নেত্র, শিথিল ও আনত অঙ্গ, দত্তধারী এই ব্যক্তি কে। ইহার কি কোনোরূপ বিকৃতি হইয়াছে। না ইহার প্রকৃতিই এইরূপ। না দৈববশত ইহার এইরূপ আকৃতি হইয়াছে।”॥২৮॥

 কুমার এই প্রশ্ন করিলে, সারথি সেই অপ্রকাশ্য জরার বিষয় নৃপাত্মজকে নিবেদন করিলেন। দেবগণের দ্বারা বুদ্ধিভ্রংশ হইয়া, তিনি তাহাতে কোনো দোষ দর্শন করিলেন না॥২৯॥

 “ইহা রূপবিনাশক, বলহানিকর, শোকের আকর, সকল সন্তোষের অপহারক, স্মৃতিনাশক, ইন্দ্রিয়গণের রিপু- ইহার নাম জরা। এই জরার দ্বারাই এই ব্যক্তি জীর্ণ হইয়াছে॥৩০॥

 “শিশুকালে এই ব্যক্তিই স্তন্যপান করিত। পরে মাটিতে হামা দিয়া হাঁটিতে শিখিল। ক্রমে সুচারুদেহ যুবা হইল। তাহার পর এইরূপ জরাগ্রস্ত হইয়াছে”॥৩১॥

 এই কথা শুনিয়া রাজপুত্র কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া সারথিকে জিজ্ঞাসা করিলেন— “আমাকেও কি এইরূপ দোষগ্রস্ত হইতে হইবে।” তখন সারথি তাঁহাকে বলিলেন॥৩২॥

 “কালক্রমে বয়োবৃদ্ধি হইলে আয়ুষ্মানও যে এই অবস্থা প্রাপ্ত হইবেন তাহাতে সন্দেহ নাই। লোকে ইহাকে রূপবিনাশয়িত্রী জরা বলিয়া জানে, তথাপি ইহা বাঞ্ছাও করে”॥৩৩॥

 অনন্তর পূর্ব জন্মের সংস্কার দ্বারা শুদ্ধবুদ্ধি, বহুকল্পসঞ্চিত পুণ্যে পবিত্র সেই মহাত্মা, নিকটে ঘোর অশনিনির্ঘোষ হইলে গাভী যেরূপ ত্রস্ত হয়, জরার কথা শ্রবণ করিয়া সেইরূপ ত্রস্ত হইলেন ॥৩৪॥

 দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া, সেই জরাজীর্ণের প্রতি কম্পমান মস্তকে দৃষ্টিপাত করিয়া, পুনরায় সেই হর্ষপরিপ্লুত জনতাকে দর্শন করিয়া, তিনি উদ্বেগের সহিত কহিতে লাগিলেন॥৩৫॥

 “জরা এইরূপে স্মৃতি, রূপ ও পরাক্রম, নির্বিশেষে নষ্ট করে। লোকে এইরূপ জরাকে প্রত্যক্ষ দেখিতেছে, তথাপি কোনোরূপ উৎকণ্ঠিত হইতেছে না॥৩৬॥

 “এইরূপ অবস্থায় হে সুত, অশ্বদিগকে নিবর্তিত করিয়া, শীঘ্র গৃহে প্রত্যাবর্তন করো। চিত্তে যখন আমার এই জরাভয় বর্তমান, তখন আমি উদ্যানভূমিতে কিরূপে প্রীতিলাভ করিব” ॥৩৭॥

 প্রভুপুত্রের সেই আদেশে সারথি রথ প্রত্যাবর্তন করিলেন। কুমার এরূপ চিন্তাকুল চিত্তে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন যে সেই পরিপূর্ণ-প্রাসাদও তাঁহার শূন্য মনে হইল॥৩৮॥

 'জরা, জরা' এই কথা চিন্তা করিতে করিতে, সেখানেও তিনি শাস্তি না পাইয়া, নরেন্দ্রের অনুমতিক্রমে, পুনরায় পূর্বের ন্যায় বাহির হইলেন ॥৩৯॥

 অনন্তর দেবগণও পুনরায় ব্যাধি-পরিপূর্ণদেহ এক পুরুষ সৃষ্টি করিলেন। শুদ্ধোদনসুত তাহাকে দেখিয়া, তাহার প্রতি দৃষ্টি নিবেশপূর্বক সারথিকে প্রশ্ন করিলেন॥৪০॥

 “স্থুলোদর, শ্লথস্কন্ধ, শিথিলবাহু, কৃশ ও পাণ্ডুগাত্র, এ ব্যক্তি কে। প্রতি শ্বাস প্রশ্বাসে ইহার দেহ কম্পিত হইতেছে। অন্য এক ব্যক্তিকে আশ্রয় করিয়া, এ করুণ স্বরে 'মা মা' এই কাতরধ্বনি উচ্চারণ করিতেছে”॥৪১॥

 তখন সারথি কহিলেন, “হে সৌম্য, ধাতুপ্রকোপ হইতে উৎপন্ন, রোগ নামক সুমহান অনর্থ, ইহাতে পরিপূর্ণরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই ব্যক্তি পূর্বে শক্তিমান ছিল। আজ রোগ ইহাকে পরাধীন করিয়াছে” ॥৪২॥

 সেই ব্যক্তিকে অনুকম্পার সহিত নিরীক্ষণ করিতে করিতে, রাজপুত্র পুনরায় সারথিকে প্রশ্ন করিলেন, “এই দোষ কি কেবল ইহাতেই জন্মিয়াছে, না সমস্ত জনগণের মধ্যেই এই রোগভয় সাধারণ”॥৪৩॥

 অনস্তর সারথি বলিলেন: “হে কুমার, এই দোষ সাধারণ। এই রোগের দ্বারা পরিপীড়িত হইয়াও ব্যাধিক্লিষ্ট জনগণ আনন্দ অনুভব করে”॥৪৪॥

 ইহা শুনিয়া বিষণ্ণমনা সেই কুমার, জলতরঙ্গে প্রতিবিম্বিত শশীর ন্যায় কম্পিত হইলেন। করুণার্দ্রচিত্তে কথঞ্চিৎ মৃদুস্বরে তিনি কহিলেন॥৪৫॥

 “মানবের এইরূপ রোগব্যসন প্রত্যক্ষ করিয়াও লোক নিশ্চিন্ত থাকে। হায়, মানুষের অজ্ঞান কী বিস্তীর্ণ। ইহারা রোগভয় হইতে মুক্ত না হইয়াও আনন্দিত হয়॥৪৬॥

 “হে সূত। বহির্গমনে নিবৃত্ত হও। নরেন্দ্রভবনেই রথ লইয়া চলো। এই রোগভয়ের কথা শুনিয়া, আমোদপ্রমোদ হইতে প্রত্যাহৃত হইয়া, চিত্ত যেন আমার সংকুচিত হইয়া যাইতেছে”॥৪৭॥

 অনন্তর প্রত্যাগত রাজকুমার, চিন্তামগ্ন হইয়া, বিষণ্নমনে গৃহে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে এইরূপ দ্বিতীয়বার সংনিবৃত্ত দেখিয়া, নরপতি ইহার কারণ অনুসন্ধান করিলেন॥৪৮॥

 কুমারের প্রত্যাবর্তনের কারণ শুনিয়া, রাজা নিজেকে পুত্র-পরিত্যক্ত বলিয়াই মনে করিলেন। যাহাদের উপর মার্গ পরিষ্কারের ভার ছিল, তাহাদের উপর তিনি ক্রুদ্ধ হইলেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ হইয়াও কোনো উগ্রদণ্ড বিধান করিলেন না॥৪৯॥

 মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ অস্থির, চঞ্চল, সুতরাং যদি ভোগাসক্ত হইয়া ইনি আমাদের ত্যাগ না করেন— এইরূপ আশা করিয়া, রাজা পুত্রের জন্য পুনরায় সর্বপ্রকার ভোগ্যবস্তুর বিশেষরূপ ব্যবস্থা করিলেন॥৫০॥

 কিন্তু যখন দেখিলেন কুমার অন্তঃপুরে, শব্দাদি ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রীতিলাভ করিতে পারিলেন না, তখন রাজা তাঁহার বহির্যাত্রার আদেশ দিলেন। তিনি মনে ভাবিলেন এই নূতনত্বে তাঁহার মানসিক ভাবের পরিবর্তন ঘটিবে॥৫১॥

 পুত্রের মনোভাব জ্ঞাত হইয়া, তিনি স্নেহবশত কামাসক্তি দোষের বিষয় চিন্তা না করিয়া, সকলকলাভিজ্ঞ যোগ্য বরাঙ্গনাদের তথায় গমন করিতে আজ্ঞা করিলেন॥৫২॥

 অতঃপর রাজা, রাজমার্গকে বিশেষভাবে পরীক্ষিত ও অলংকৃত করিয়া, রথ ও সারথি পরিবর্তনপূর্বক, কুমারের বহির্গমনের আদেশ দিলেন॥৫৩॥

 রাজপুত্র পথে বাহির হইলে, দেবগণ এক মৃতদেহ সৃষ্টি করিলেন। পথে বাহিত সেই মৃতদেহ, কুমার ও সারথি ভিন্ন অন্য কেহ দেখিতে পাইল না॥৫৪॥

 তখন রাজকুমার সারথিকে জিজ্ঞাসা করিলেন — “চারিজন বাহকের দ্বারা বাহিত এই ব্যক্তি কে। ইহাকে শোকার্ত জনগণ অনুসরণ করিতেছে। এই পুরুষ সুভুষিত, তথাপি সকলে ইহার জন্য ক্রন্দন করিতেছে”॥৫৫॥

 অর্থবিৎ সেই সারথি, শুদ্ধাত্মা শুদ্ধাধিবাস দেবগণের দ্বারা অভিভূতচিত্ত হইয়া, প্রভুর নিকটে সেই গোপনীয় তত্ত্ব প্রকাশ করিলেন॥৫৬॥

 “বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও গুণ বিযুক্ত, সুপ্ত, সংজ্ঞাহীন, তৃণকাষ্ঠবৎ এই ব্যক্তিকে তাহার প্রিয় ব্যক্তিগণ এতদিন যত্নের সহিত বর্ধন ও রক্ষা করিয়া এখন পরিত্যাগ করিতেছে॥৫৭॥

 সারথির এই বাক্য শ্রবণে, তিনি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— “কেবল এই ব্যক্তিরই অবস্থা এইরূপ, না সকল মানবেরই এই পরিণাম।”॥৫৮॥

 তখন সারথি বলিলেন - “সকল সৃষ্ট জীবেরই পরিণাম এইরূপ। ইহলোকে, হীন, মধ্য, মহাত্মা, সকলেরই নিয়ত বিনাশ হয়”॥৫৯॥

 স্বভাবত ধীর হইলেও, কুমার মৃত্যুর কথা শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ বিষণ্ণ হইয়া পড়িলেন। তিনি রথদণ্ডোপরি স্কন্ধ স্থাপনপূর্বক গভীরস্বরে বলিলেন॥৬০॥

 “জীবগণের ইহাই চরমগতি। তথাপি লোকে ভয় ত্যাগ করিয়া আমোদ প্রমোদ করিতে থাকে। যাহারা এই পথে থাকিয়াও উদ্বিগ্ন না হইয়া সুস্থ থাকে, আমার মনে হয় তাহাদের হৃদয় অতিশয় কঠিন॥৬১॥


 "অতএব, হে সূত, রথ নিবর্তিত করো। এই দেশ কাল আমাদের বিহার ভূমিতে গমনের উপযুক্ত নহে। অন্তকালে বিনাশ জানিয়াও কোন্ সচেতন ব্যক্তি, বিপদের সময় প্রমত্ত থাকিবে”॥৬২॥

 রাজকুমার এইরূপ বলিলেও, সারথি রথ প্রত্যাবর্তন না করিয়া, রাজাদেশে শোভান্বিত পদ্মখণ্ড-বনে গমন করিলেন॥৬৩॥

 অনন্তর তাঁহারা বিমানযুক্ত, কমলপূর্ণ চারু দীর্ঘিকা-শোভিত, কুসুমিতবালপাদপবিরাজিত, ইতস্ততভ্রাম্যমান, প্রসন্ন, প্রমত্ত, পিককূলপরিবৃত, নন্দনকাননসম সেই কানন দর্শন করিলেন॥৬৪॥

 অনন্তর সুন্দরী অপ্সরা পরিবৃত, অলকায় আনীত নবব্রতধারী মুনির ন্যায়, বিঘ্নকাতর রাজকুমার, বরাঙ্গনাকুলপূর্ণ সেই উপবনে বলপূর্বক নীত হইলেন॥৬৫॥