অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত (প্রথম খণ্ড)/দ্বিতীয় সর্গ
দ্বিতীয় সর্গ
আত্মজিৎ জন্মজরান্তগ আত্মজের জন্মদিন হইতে, সেই রাজা, অর্থ, গজ, অশ্ব এবং মিত্রগণের দ্বারা, জলস্রোতে স্রোতস্বিনীর ন্যায়, দিন দিন সমৃদ্ধ হইতে লাগিলেন॥১॥
তিনি তখন ধন ও রত্নের, সংস্কৃত ও অসংস্কৃত স্বর্ণের, নানা নিধি লাভ করিলেন। তাঁহার সেই ঐশ্বর্যরাশি মনোরথের পক্ষেও অতি ভার (কল্পনারও অতীত) হইল॥২॥
জগতে পদ্মের (দক্ষিণদিকস্থিত দিগ্গজ) ন্যায় শ্রেষ্ঠ হস্তিগণও, যাহাদিগকে মণ্ডলের (খেদার) মধ্যে আনয়ন করিতে অসমর্থ হইত, সেই মদোন্মত্ত হৈমবত (হিমালয়স্থ) গজসমূহও অনায়াসেই তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইল॥৩॥
বলের দ্বারা, মিত্রতার দ্বারা ও ধনের দ্বারা অধিগত অশ্বসমূহ, তাঁহার রাজধানী ক্ষুভিত করিয়া তুলিল। সেই অশ্বগণের কেহ কেহ নানা চিহ্নে চিহ্নিত, কেহ হৈমাভরণভূষিত-কেহ বা দীর্ঘকেশরযুক্ত॥৪॥
তাঁহার রাজ্যে, সুন্দর, পরিষ্কার, হৃষ্টপুষ্ট, মিষ্ট ও প্রভূত দুগ্ধবর্তী, পরিপুষ্টবৎসবতী বহু গাভীর আবির্ভাব হইল॥৫॥
শত্রুর সহিত তাঁহার মধ্যস্থতা হইল। সেই মধ্যস্থভাব ক্রমে সৌহার্দে পরিণত হইল, পরে সেই সৌহার্দ্যও দৃঢ় হইল।
আত্মপক্ষ ও সুহৃৎপক্ষ, তাঁহার মাত্র এই দুই পক্ষই বর্তমান রহিল—শত্রুপক্ষ বলিয়া অপর কোনো পক্ষ রহিল না॥৬॥
তৎকালে, সৌদামিনীকুণ্ডলমণ্ডিত আকাশে, দেবতা, অশনিপাত ও অশ্মবর্ষণ দোষ বিনা, মন্দ মন্দ বায়ু ও মন্দ মন্দ মেঘগর্জনের সহিত, তাঁহার রাজ্যে, যথাসময়ে যথাস্থানে, বারিবর্ষণ করিতে লাগিল॥৭॥॥
যথা ঋতুতে, কৃষিশ্রম ব্যতীতও, ফলবান্ শস্যসমূহ উৎপন্ন হইতে লাগিল; ওষধিগণও রস ও সারের সহিত অধিকতর বর্ধিত হইয়া উঠিল॥৮॥
যদিও প্রসবকাল, সংগ্রামে সৈন্যসংঘর্ষের মতই শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক, তথাপি সেই প্রসবকাল উপস্থিত হইলে গর্ভবতী নারীগণ, যথাকালে, সুস্থদেহে, নিরাময়ে, বিনাক্লেশে, প্রসব করিতে লাগিলেন॥৯॥
সন্ন্যাসী ব্যতীত অতি হীন অবস্থার লোকও অন্যের নিকট কিছু প্রার্থনা করিত না। এবং প্রার্থিত হইলে, অতি অল্পধনশালী আর্যও (ভদ্রলোক) কাহারও প্রতি বিমুখ হইতেন না॥ ১০॥
নহুষতনয় যযাতিসদৃশ, সেই রাজার রাজ্যে, কেহ বন্ধুবর্গের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করিত না। তাঁহার রাজ্যে কেহ অ-দাতা, অ-ব্রতশীল, অনৃতচারী বা হিংস্র ছিল না॥ ১১॥
সেই রাজ্যে ধর্মাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিগণ, স্বর্গকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াই যেন উদ্যান, দেবায়তন, আশ্রম, কূপ, প্রপা, পুষ্করিণী ও উপবনের প্রতিষ্ঠা করিতেন॥১২॥
দুর্ভিক্ষ, ভয় ও রোগ হইতে মুক্ত হইয়া, প্রজাবর্গ, স্বর্গের ন্যায় সেই রাজ্যে, হৃষ্টচিত্তে বিচরণ করিত। পতি পত্নীর প্রতি, বা পত্নী পতির প্রতি ব্যভিচার করিত না॥১৩॥
রতিসুখলাভের জন্য কেহ ভালোবাসিত না। নিজ কামনাচরিতার্থের জন্য কেহ ধন রাখিত না। ধনের জন্য কেহ ধর্ম আচরণ করিত না। এবং ধর্মের জন্য কেহ জীবহিংসা করিত না॥১৪॥
প্রাচীনকালের অনরণ্য রাজার রাজ্যের ন্যায়, তাঁহার রাজ্যে চৌর্যাদি পাপসমূহ এবং অরিকুল লুপ্ত হইয়াছিল। তাঁহার রাষ্ট্র, পররাষ্ট্রের অধীনতা হইতে মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ ছিল। তথায় ক্ষেম ও সুভিক্ষ বিরাজ করিত॥১৫॥
জন্মে আদিত্যসুত মনুর ন্যায় সেই নৃপতির রাষ্ট্রে, বোধিসত্ত্বের হর্ষসঞ্চার হইল; পাপ বিদূরিত হইল; ধর্ম প্রজ্বলিত হইল; এবং কলুষের উপশম হইল॥ ১৬॥
রাজকুমারের জন্মে, সেই রাজকুলের এইরূপ সম্পদলাভ এবং সর্বার্থ-সিদ্ধি ঘটিল বলিয়া, নৃপতি পুত্রের ‘সর্বার্থ-সিদ্ধ’ এই নামকরণ করিলেন॥১৭॥
কিন্তু হায়! মায়াদেবী, পুত্রের দেবর্ষির ন্যায় বিরাট প্রভাব দর্শন করিয়া, হর্ষবেগ সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া, অমরত্বলাভের জন্য অমরায় প্রস্থান করিলেন॥১৮॥
তখন মাতার ন্যায় প্রভাবসম্পন্না, মাতৃস্বসা, দেবকুমারের ন্যায় সেই কুমারকে, পরমস্নেহে মাতৃনির্বিশেষে পুত্রবৎ পালন করিতে লাগিলেন॥১৯॥
উদয়াচলস্থ তরুণ তপনের ন্যায়, অনিলের দ্বারা সমীরিত অনলের ন্যায়, কুমার শুক্লপক্ষের শশিসদৃশ, ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণরূপে বৃদ্ধি পাইতে লাগিলেন॥২০॥
অতঃপর তাঁহার জন্য মহামূল্য চন্দন, ঔষধিপূর্ণা রত্নাবলী, মৃগযুক্ত কাঞ্চনরথ, বয়সানুরূপ অলংকার, হিরণ্ময় হস্তী, মৃগ ও অশ্ব, গোবৎসবাহিত রথ, এবং স্বর্ণ রৌপ্যের দ্বারা চিত্রিত পুত্তলিকাসমূহ, সুহৃদালয় হইতে আসিতে লাগিল॥২১-২২ ॥
এই সকল বয়োনুরূপ বিষয়োপচারের দ্বারা, এইরূপে সেবিত কুমার, বালক হইলেও, ধী, শ্রী, ধৃতি ও শুচিতায়, প্রাজ্ঞের ন্যায় প্রতিভাত হইলেন॥২৩॥
রাজকুমার কৌমার অতিক্রম করিয়া, যথাসময়ে উপনয়ন সংস্কার প্রাপ্ত হইয়া, বহুবর্ষগম্য স্বকুলানুরূপ বিদ্যা অল্প দিবসেই শিক্ষা করিলেন॥২৪॥
নৈঃশ্রেয়স (মুক্তি বা নির্বাণ) তাঁহার ভাবী লক্ষ্য, ইহা পূর্বে মহর্ষি অসিত হইতে শ্রবণ করিয়া— অরণ্যে প্রস্থান করিবেন, এই ভয়ে, শাক্যরাজ পুত্রকে ভোগে প্রবৃত্ত করাইলেন॥২৫॥
অনন্তর রাজা, স্থিরশীলান্বিত (স্থায়ীসদাচার সম্পন্ন) বংশ হইতে রূপবতী, লজ্জাশীলা, বিনীতা, বিশালযশঃসম্পন্না, যশোধরা নাম্নী সাধ্বী, বামারূপিণী লক্ষ্মী, কুমারকে প্রদান করিলেন॥২৬॥
তখন অপূর্ব দেহের জ্যোতিতে জ্যোতিষ্মান, সনৎকুমারসদৃশ সেই রাজকুমার, শচীর সহিত সহস্রাক্ষের ন্যায়, শাক্যেন্দ্রবধূর সহিত অভিরমণ করিতে লাগিলেন॥২৭॥
কিরূপে কুমার কিঞ্চিৎমাত্রও মনঃক্ষোভকর বা প্রতিকূল কিছু দেখিতে না পান, ইহা চিন্তা করিয়া রাজা প্রাসাদের অভ্যন্তরে, জনগণের অগোচর এক বাসগৃহ, কুমারের জন্য নির্মাণ করিতে আদেশ দিলেন॥২৮॥
অনন্তর, শারদীয় অভ্রের ন্যায় শুভ্র, ভূমিতে অবতীর্ণ দিব্য দেবগৃহের ন্যায় সর্বঋতু-সুখকর সেই হর্ম্যে, স্ত্রীগণের উৎকৃষ্ট তূর্যধ্বনিসহ, কুমার বিহার করিতে লাগিলেন॥২৯॥
নারীগণের অঙ্গুলি-অভিহত বর্ণখচিত-কক্ষ-মৃদঙ্গের কলধ্বনি ও শ্রেষ্ঠ অপ্সরানৃত্যসম নৃত্যে, সেই বাসভবন কৈলাসের ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিল॥৩০॥
বাক্যালাপ, ললিতকলা, হাব, ভাব, ক্রীড়াপূর্ণ মাদকতা, মধুর হাস্য, ভ্রভঙ্গ ও কটাক্ষের দ্বারা, রমণীগণ তাঁহাকে আনন্দদান করিতে লাগিলেন॥৩১॥
অতঃপর কামকলাভিজ্ঞা রতিকর্কশা রমণীগণ কর্তৃক বন্দীকৃত রাজকুমার, বিমান (স্বর্গস্থ প্রাসাদ) অধিরূঢ় পুণ্যকর্মার ন্যায়, বিমান (স্বর্গীয় প্রাসাদ এবং সপ্ততল উচ্চ প্রাসাদ) হইতে ভূমিতে (পৃথিবীতে এবং মাটিতে) পদার্পণ করিলেন না॥৩২॥
নৃপতি কিন্তু পুত্রের উন্নতি কামনায় এবং তাঁহার (প্রাপ্য) ভাবী পুণ্যফলের দ্বারা অনুপ্রেরিত হইয়া, শমগুণেই রত হইলেন; পাপ হইতে নিবৃত্ত হইলেন; সংযম অভ্যাস করিলেন ও সাধুগণের সেবা করিতে লাগিলেন॥৩৩॥
তিনি অসংযত ব্যক্তির ন্যায় কামসুখে আসক্ত রহিলেন না। নারীর প্রতি তাঁহার অতিরিক্ত অনুরাগ রহিল না। ধৃতির দ্বারা তিনি চপল ইন্দ্রিয়াশ্বকে এবং গুণের দ্বারা বন্ধু ও পৌরবর্গকে জয় করিলেন॥৩৪॥
যে-বিদ্যা পরকে দুঃখ দেয়, তাহা তিনি শিক্ষা করিতেন না। যে-জ্ঞান কল্যাণকর তাহাই অধ্যয়ন করিতেন। যেরূপ নিজের প্রজার, সেইরূপ সমগ্র মানব জাতিরও তিনি শুভকামনা করিতেন॥৩৫॥
পুত্রের দীর্ঘায়ুর জন্য, তিনি সমুজ্জ্বল গ্রহ বৃহস্পতির অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে যথোচিত অর্চনা করিলেন। তিনি এক বৃহৎ হুতাশনে হব্য আহুতি দিলেন। দ্বিজগণকে কাঞ্চন ও গাভী প্রদান করিলেন॥৩৬॥
শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতার জন্য, তিনি তীর্থাম্বু ও গুণাম্বুর দ্বারা স্নাত হইলেন। এবং বেদোপদিষ্ট সোম ও হৃদয়স্থ শান্তিসুখ পান করিতে করিতে আত্মজকে রক্ষা করিতে লাগিলেন॥৩৭॥
তিনি প্রীতিকর বাক্য বলিতেন, অনর্থকর কিছু কহিতেন না। সত্য যাহা এবং যাহা অপ্রিয় নয় তাহাই তিনি উচ্চারণ করিতেন। যাহা প্রীতিকর অসত্য, বা নিষ্ঠুর সত্য, নিজ সংকোচ বা বিনয়বশতই তিনি তাহা বলিতে পারিতেন না॥৩৮॥
কার্যোদ্দেশে তাঁহার প্রিয় বা অপ্রিয় কেহ উপস্থিত হইলে, তিনি স্নেহ বা বিদ্বেষবশত কোনোরূপ পক্ষপাত করিতেন না। শুভ ন্যায় বিচারকেই তিনি অবলম্বন করিতেন। যাগযজ্ঞকেও তিনি ন্যায় বিচারের ন্যায় শ্রেষ্ঠ গণ্য করিতেন না॥৩৯॥
কেহ কিছু আশা করিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে, তিনি দানবারি দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাহার তৃষ্ণা নিবারণ করিতেন। বিনাযুদ্ধে, তাঁহার বৃত্ত (চরিত্র) রূপ পরশু দ্বারা, শত্রুগণের বর্ধিত দর্প চূর্ণ করিতেন॥ ৪০॥
এককে সংযত করিয়া তিনি সপ্তকে পালন করিতেন। সপ্তকেও পরিত্যাগ করিয়া পঞ্চকে রক্ষা করিতেন। ত্রিবর্গ লাভ করিয়া তিনি ত্রিবর্গ জ্ঞাত হইয়াছিলেন। দ্বিবর্গ জ্ঞাত হইয়া, দ্বিবর্গ ত্যাগ করিয়াছিলেন॥৪১॥[১]
দোষিগণ বধ্য নির্ধারিত হইলেও তিনি তাহাদিগকে বধ করিতেন না। অনুগ্র শাস্তির দ্বারা তিনি তাহাদের বদ্ধ করিয়া রাখিতেন। তাহাদের মুক্তিদানও তাঁহার নিকট কুনীতি বলিয়া গণ্য হইত ॥ ৪২ ॥
তিনি ঋষি-আচরিত পরম ব্রত পালন করিতেন। চিরপোষিত বৈরভাব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। গুণগন্ধান্বিত যশ লাভ করিয়াছিলেন। এবং চিত্ত মলিনকারী রঞ্জ (গুণ) পরিহার করিয়াছিলেন॥৪৩॥
প্রাপ্য রাজস্বের অধিক তিনি গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিতেন পরদ্রব্যে স্পৃহা করিতেন না। শত্রুপক্ষের অধর্মের বিষয় ব্যক্ত করিবার অভিলাষ তাঁহার ছিল না। হৃদয়ে দ্বেষ বা ক্ষোভ পোষণেরও তাঁহার ইচ্ছা হইত না॥৪৪॥
যোগে প্রবৃত্ত ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সমূহ যেমন তাঁহার শমাত্মক প্রসন্ন ও প্রশান্ত চিত্তের অনুরূপ আচরণ করে, সেইরূপ ভৃত্য ও পৌরবর্গ, এইরূপ কার্যে প্রবৃত্ত সেই ভূমিপতির অনুসরণ করিত॥৪৫॥
অতঃপর, চারুপয়োধরা, সুযশস্বিনী, যশোধরাতে শুদ্ধোদনপুত্রের রাহুল নামে রাহুশত্রুর (চন্দ্রের) ন্যায় আননবিশিষ্ট এক পুত্র জন্মগ্রহণ করিল॥৪৬॥
বংশ বৃদ্ধি হওয়ায়, পুত্রপ্রিয় নরপতি পরম প্রীত হইলেন। পুত্র হইলে তিনি যেমন আনন্দিত হইয়াছিলেন, পৌত্র হওয়ায় তিনি তেমনি আনন্দিত হইলেন॥৪৭॥
‘পুত্রের আমার আমারই ন্যায় পুত্রস্নেহ লাভ হইবে’ এই ভাবিয়া আনন্দিত পুত্রপ্রিয় নরপতি যেন স্বর্গারোহণে ইচ্ছুক হইয়াই, যথাকালে প্রসিদ্ধ (জাতকর্মাদি) বিধিসমূহ পালন করিলেন॥৪৮॥
সত্যযুগের যশস্বী রাজেন্দ্রগণের পথানুবর্তী সেই নৃপ, শুক্লবসন পরিত্যাগ না করিয়াই, তপশ্চরণ করিতে এবং হিংসারহিত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন॥৪৯॥
নৃপশ্রী ও তপঃশ্রী দ্বারা জাজ্বল্যমান, কুল, বৃত্তি ও ধী দ্বারা দীপ্ত, সেই পুণ্যকর্মা পুরুষ, যেন সহস্রাংশু সূর্যের ন্যায় তেজঃসৃষ্টি কামনা করিলেন ৫০॥
স্থিতশ্রী নরপতি,পুত্রের দীর্ঘায়ু কামনায়,স্বায়ম্ভুব সামবেদীয় সূক্ত শ্রদ্ধাসহকারে জপ করিতে লাগিলেন। আদিকালে প্রজাসৃজনেচ্ছু প্রজাপতির ন্যায়, তিনি বহু দুষ্কর কর্ম করিতে লাগিলেন॥৫১॥
তিনি শস্ত্র ত্যাগ করিয়া শাস্ত্র আলোচনা করিতেন। তিনি শমপরায়ণ ছিলেন এবং নিয়ম পালন করিতেন। জিতেন্দ্রিয় যতির ন্যায় তিনি বিষয়ের ভজনা করিতেন না। সমস্ত বিষয়কে (রাজ্যকে) তিনি পিতার ন্যায় দর্শন (তত্ত্বাবধান) করিতেন॥৫২॥
তিনি পুত্রের জন্য রাজ্য, কুলের জন্য পুত্র ও যশের জন্য কুলকে রক্ষা করিতেন। তিনি স্বর্গের জন্য যশ, আত্মার জন্য স্বর্গ, ও ধর্মের জন্যই আত্মস্থিতি আকাঙ্ক্ষা করিতেন॥৫৩॥
আমার পুত্র তাঁহার পুত্রমুখ দর্শন করিয়াছেন—এখন তিনি বনে যাইবেন না— এইরূপ আকাঙ্ক্ষা করিয়া, শাক্যরাজ, সজ্জনের দ্বারা অনুষ্ঠিত ও শ্রুতিসিদ্ধ বিবিধ ধর্ম আচরণ করিতে লাগিলেন॥৫৪॥
জগতে মহীপালগণ আত্মশ্রিত রাজশ্রীর রক্ষণাভিলাষে পুত্রগণকে (কামাসক্তি হইতে) রক্ষা করেন। কিন্তু সেই নরপতি,ধর্মাকাঙ্ক্ষী হইয়াও পুত্রকে ধর্ম হইতে বিরত করিয়া কামোপভোগে প্রবৃত্ত করাইলেন॥৫৫॥
অনুপমসত্ত্ব, বিষয়সুখরসজ্ঞ বোধিসত্ত্বগণ পুত্র উৎপন্ন হইলেই বনে গমন করিতেন। কিন্তু পূর্বসঞ্চিত শুভকর্ম যুক্ত এই বোধিসত্ত্বের কুশলমূল[২] অঙ্কুরিত হইলেও, বোধিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিষয় ভোগে রত রইলেন॥৫৬॥
- ↑ তিনি এককে অর্থাৎ মনকে সংযত করিয়াছিলেন। সপ্তকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের সপ্ত অঙ্গকে (স্বামী, অমাত্য, সুহৃদ, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ, বল) রক্ষা করিয়াছিলেন। রাজার সপ্ত দোষ (দ্যুতক্রীড়া, মদ্যপান, মৃগয়াসক্তি, মৈথুনাসক্তি ইত্যাদি) পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।
পঞ্চ বায়ু (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান) রক্ষা করিয়াছিলেন। ধর্ম অর্থ কাম (ত্রিবর্গ) লাভ করিয়াছিলেন। (কৃষি, বাণিজ্য, দুর্গ, সৈন্য প্রভৃতি অষ্টবিধ বিষয়ের) ত্রিবর্গ অর্থাৎ তিন অবস্থা [বৃদ্ধি, ক্ষয় ও স্থান (যাহার বৃদ্ধিও নাই ক্ষয়ও নাই)] অবগত হইয়াছিলেন। চিৎ ও জড় এই দ্বিবর্গকে জানিয়াছিলেন এবং সুখ ও দুঃখ এই দ্বিবর্গকে ত্যাগ করিয়াছিলেন। - ↑ কুশলমূল—ক্রোধহীনতা, লোভহীনতা ও মোহহীনতাকে বৌদ্ধ শাস্ত্রে কুশলমূল বলা হয়। ইহা হইতেই সমস্ত কুশলকর্মের উৎপত্তি হয় বলিয়া ইহারা কুশলমূল।