অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত (প্রথম খণ্ড)/পঞ্চম সর্গ
পঞ্চম সর্গ
পরমমূল্যবান ভোগ্যবস্তুর দ্বারা প্রলোভিত হইয়া শাক্যরাজপুত্র বিষাক্ত শরবিদ্ধ সিংহের হ্যায়, হৃদয়ে সুখ বা সন্তোষলাভ করিতে পারিলেন না॥১॥
তিনি বিচিত্র বাক্যালাপপটু, যোগ্য বন্ধু মন্ত্রিপুত্রগণের দ্বারা পরিবৃত হইয়া, শান্তিলাভের জন্ম ও বনভূমিদর্শনকামনায় নরেন্দ্রের অনুমতিক্রমে বহির্গমন করিলেন॥২॥
নবহিরণ্ময় খলীন (লাগামের অংশবিশেষ) ও কিঙ্কিণীযুক্ত কম্পমান চামরশোভিত, স্বর্ণালংকারভূষিত কন্থক নামক উৎকৃষ্ট অশ্বে আরোহণ করিয়া, তিনি ধ্বজোপরি কর্ণিকার পুষ্পের ন্যায় (শোভমান হইয়া) গমন করিলেন॥৩॥
ভূমির সৌন্দর্য ও বনশোভা দর্শন কামনায়, তিনি বনান্তভূমিতে গমন করিয়া, সলিলতরঙ্গের ন্যায় সীর (লাঙ্গল) মার্গের দ্বারা বিকারপ্রাপ্ত, এক কৃষ্যমাণ ভূমিখণ্ড দেখিতে পাইলেন॥৪॥
হলের দ্বারা ছিন্নভিন্ন, শষ্প ও দর্ভের দ্বারা আকীর্ণ, ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গাদি মৃত জীব সমাচ্ছন্ন, সেই ভূমি খণ্ড দেখিয়া, স্বজনবধে লোকে যেরূপ শোক করে, তিনিও সেইরূপ অতিশয় শোক করিতে লাগিলেন॥৫॥
বায়ু, রৌদ্র ও ধূলির দ্বারা বিকৃতবর্ণ কৃষকগণকে, এবং বহনশ্রমে বিবশ বৃষদিগকে দেখিয়া, আর্যশ্রেষ্ঠ সেই কুমার অত্যস্ত কৃপাপরবশ হইলেন॥৬॥
অনন্তর তিনি শোকাচ্ছন্ন হইয়া, তুরঙ্গপৃষ্ঠ হইতে অবতরণপূর্বক, ভূমিতে ধীরে ধীরে বিচরণ করিতে করিতে, জগতের জন্মমৃত্যুর চিন্তায় কাতর হইয়া বলিয়া উঠিলেন: “ইহা সত্যই শোচনীয়”॥৭॥
মনে মনে নির্জনতা আকাঙ্ক্ষা করিয়া, অনুগমনকারী সুহৃদ্গণকে নিবারণপূর্বক, বিজনে, চতুর্দিকে চঞ্চল ও রমণীয় পল্লবের দ্বারা সমাচ্ছন্ন, এক জম্বুবৃক্ষের মূলদেশে উপস্থিত -হইলেন॥৮॥
তিনি বৈদূর্যমণির হ্যায় শ্যামলতৃণান্বিত, পরিষ্কার, সেই ভূমিতলে উপবেশনপূর্বক, জগতের উৎপত্তি ও বিনাশের বিষয় চিন্তা করিতে করিতে, চিত্তের স্থিতিমার্গ অবলম্বন করিলেন॥৯॥
সদ্য চিত্তস্থিতি[১] (মনের স্থিরতা) লাভ করিয়া, বিষয়াকাঙ্ক্ষাদি ব্যাধি হইতে মুক্ত হইয়া, তিনি শান্ত, সবিতর্ক, সবিচার, অনাস্রব প্রথম ধ্যান[২] প্রাপ্ত হইলেন॥ ১০॥
অনন্তর, তিনি বিবেকজ, পরমপ্রীতিসুখকর চিত্তসমাধি প্রাপ্ত হইয়া, জগতের গতি হৃদয়ে সম্যক উপলব্ধি করিয়া, এইরূপ ধ্যান করিতে লাগিলেন॥১১॥
“ব্যাধি, জরা ও বিনাশধর্মী মদান্ধ পরম অজ্ঞ পুরুষগণ, স্বয়ং অসহায় হইয়াও যে জরাগ্রস্ত, আতুর এবং মৃতকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে, ইহা সত্যই শোচনীয়॥১২॥
“আমি স্বয়ং এইরূপ হইয়া যদি আমার হ্যায় স্বভাবসম্পন্ন অন্যকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করি, পরমধর্মদর্শী আমার তাহা অনুরূপও হইবে না এবং উপযুক্তও হইবে না” ॥১৩॥
জগতের ব্যাধি, জরা, বিপত্তি এই দোষসমূহ সম্যক দর্শন করিয়া, তাঁহার নিজের বল, যৌবন ও জীবন হইতে উৎপন্ন অহংকারমদ ক্ষণেকের মধ্যেই অন্তর্হিত হইল ॥১৪॥
তিনি হর্ষও অনুভব করিলেন না। অনুতাপও করিলেন না। তাঁহার সংশয়ও রহিল না, তন্দ্রা বা নিদ্রাও রহিল না। কামে তিনি আসক্ত হইলেন না। এবং কাহারও প্রতি দ্বেষ, অবজ্ঞা বা অবহেলা প্রকাশ করিলেন না ॥ ১৫॥
সেই মহাত্মার মধ্যে এইরূপ বিশুদ্ধ, নির্মল বুদ্ধি বর্ধিত হইল। তখন অন্য সকলের অদৃশ্য, ভিক্ষুবেশী এক পুরুষ তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইলেন ॥১৬॥
রাজপুত্র তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন; “আপনি কে।” তিনি বলিলেন; “হে নরপুঙ্গব, আমি জন্মমৃত্যুভীত শ্রমণ। মোক্ষনিমিত্ত প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছি॥১৭॥
“আমি আত্মীয় অনাত্মীয়ে সমবুদ্ধি, কামাসক্তিদোষ হইতে নিবৃত্ত, এই ক্ষয়ধর্মক জগতে মোক্ষলাভের আশায়, সেই অক্ষয় মঙ্গলপদের অনুসন্ধান করিতেছি॥১৮॥
“কখনো বৃক্ষমূলে, কখনো কোনো বিজনস্থানে, কখনো পর্বতে, কখনো বা অরণ্যে বাস করিয়া, নিরাকাঙ্ক্ষ সঙ্গিহীন আমি, যথাগত ভিক্ষা গ্রহণ করিয়া, পরমার্থের নিমিত্ত বিচরণ করিয়া থাকি”॥১৯॥
এই বলিয়া রাজপুত্রের দৃষ্টিগোচরেই তিনি আকাশে উত্থিত হইলেন। সেই (শ্রমণ-) আকৃতিধারী পুরুষ ছিলেন অপরের মনোভাববেত্তা এক দেবতা। রাজকুমারের স্মৃতি জাগ্রত করিবার জন্য তিনি সমাগত হইয়াছিলেন ॥২০॥
তিনি বিহঙ্গের ন্যায় গগনে উত্থিত হইলে, সেই পুরুষোত্তম আনন্দিত এবং বিস্মিত হইলেন। তিনি তখন তাঁহার নিকট হইতে ধর্মসংজ্ঞা উপলব্ধি করিয়া, গৃহত্যাগের (প্রব্রজ্যার) সংকল্প করিলেন॥২১॥
অনন্তর ইন্দ্রপ্রতিম এবং জিতেন্দ্রিয় কুমার, পুরপ্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক হইয়া, সেই উৎকৃষ্ট অশ্বে আরোহণ করিলেন। তিনি তাঁহার (অনুসরণকারী) অনুচরবর্গের বিষয় চিন্তা করিয়া, সেখান হইতেই (সোজা) নিজ আকাঙ্ক্ষিত (তপস্যার্থে) অরণ্যে গমন করিলেন না॥২২॥
জরামরণের ধ্বংসাকাঙ্ক্ষী সেই রাজকুমার, একাগ্রচিত্তে বনবাস সংকল্প স্থির করিয়া, বনভূমি হইতে গজরাজ যেমন মণ্ডলে (খেদাতে) প্রবেশ করে, সেইরূপ- নিজের অনিচ্ছায় পুনর্বার নগরে প্রবেশ করিলেন॥২৩॥
তাঁহাকে গৃহপ্রবেশ করিতে দেখিয়া প্রবেশপথে রাজকন্যা অঞ্জলিবদ্ধ হইয়া তাঁহাকে বলিলেন; “হে আয়তাক্ষ, যাহার পতি এইরূপ, সেই স্ত্রী অবশ্যই নির্বৃতা (আনন্দিতা—নির্বাণপ্রাপ্তা)”॥২৪॥
মহামেঘধ্বনির ন্যায় ধ্বনিবিশিষ্ট কুমার, সেই বাক্যধ্বনি শ্রবণ করিয়া পরম শান্তি লাভ করিলেন। 'নির্বৃত' এই শব্দ কর্ণগোচর হইলে তিনি নির্বাণপ্রাপ্তির উপায়ে মন দিলেন॥২৫॥
অনন্তর কাঞ্চনশৈলশৃঙ্গাকৃতি, গজবাহু, মেঘগম্ভীরনির্ঘোষী, ঋষভাক্ষ, অক্ষয়ধর্মরত, চন্দ্রানন, সিংহবিক্রম, রাজেন্দ্রনন্দন গৃহে প্রবেশ করিলেন॥২৬॥
ত্রিদিবে, দেবসভায়, সনৎকুমার যেরূপ দীপ্ত মঘবানের সমীপে গমন করেন, মৃগরাজগতি কুমার, সেইরূপ মন্ত্রিগণ পরিবৃত নৃপতির নিকট গমন করিলেন॥২৭॥
কুমার প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে বলিলেন; “হে নরদেব, আমার বিচ্ছেদ যখন নির্দিষ্ট- তখন আপনি আমাকে ভালোভাবেই অনুমতি দান করুন; আমি মোক্ষের জন্য পরিব্রাজক হইতে চাই”॥২৮॥
তাঁহার এই বাক্য শ্রবণে, রাজা গজাভিহত দ্রুমের ন্যায় কম্পিত হইলেন। তিনি তাঁহার কমলসদৃশ করপুটে কুমারকে গ্রহণ করিয়া বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন॥২৯॥
“তাত, তোমার এ বুদ্ধি ত্যাগ করো। এখন তোমার ধর্মাচরণের সময় নহে। প্রথম বয়সে চিত্ত যখন চঞ্চল থাকে, তখন ধর্মাচরণ বহু দোষের আকর বলিয়া কথিত আছে ॥৩০॥
“ইন্দ্রিয় যাহার ভোগে উৎসুক, ব্রতক্লেশ সহ্য করিবার সংকল্প যাহার দৃঢ় নহে, বিশেষত শুভাশুভ বিচার বিষয়ে যে অনভিজ্ঞ, সেই তরুণ পুরুষের চিত্ত, অরণ্য হইতে (সহজেই) প্রতিনিবৃত্ত হয় ॥৩১॥
“নিজ লক্ষ্যভূত তোমাতে লক্ষ্মী স্থাপনপূর্বক আমার ধর্মাচরণের সময় উপস্থিত হইয়াছে। হে দৃঢ়পরাক্রম (তুমি ক্ষত্রিয়), পরাক্রমের দ্বারাই তোমার ধর্ম লাভ হইবে। পরন্তু পিতাকে পরিত্যাগ করিলে, তোমার অধৰ্মই হইবে ॥৩২॥
“তোমার এই অভিপ্রায় ত্যাগ করো। তুমি গৃহস্থধর্মে রত হও। যৌবনের সুখসম্ভোগের পর, পুরুষের নিকট তপোবন- প্রবেশ রমণীয় হয়” ॥৩৩॥
রাজার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কুমার কলবিঙ্কের ন্যায় মধুর স্বরে উত্তর করিলেন; “হে রাজন, আপনি যদি এই চারিটি বিষয়ে আমার প্রতিভূ হন, তাহা হইলে আমি তপোবনে আশ্রয় লইব না ॥৩৪॥
“জীবন আমার মরণান্তক হইবে না। রোগ আমার স্বাস্থ্য- হরণ করিবে না। জরা যৌবনকে আকর্ষণ করিবে না। বিপত্তি আমার সম্পত্তি হরণ করিবে না” ॥৩৫॥
সেই দুর্লভ বিষয়ের কথা শ্রবণ করিয়া, শাক্যরাজ কহিলেন; “এই অতি কল্পনাময়ী মতি পরিত্যাগ করো। মনের গতি এইরূপ অসম্ভব হইলে সকলের পরিহাস্য হইতে হয়”॥৩৬॥
অনন্তর, মেরুপর্বতের ন্যায় দৃঢ় কুমার, পিতাকে বলিলেন;“যদি ইহা না হয়, তবে আমাকে নিবৃত্ত করা কর্তব্য নহে; বহ্নির দ্বারা দহ্যমান গৃহ হইতে, যে নিষ্ক্রান্ত হইতে চায়, তাহাকে নিবারণ করা উচিত নহে॥৩৭॥
“জগতে বিচ্ছেদ যখন ধ্রুব, তখন ধর্মের জন্য স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ স্বীকার বরণীয়। অকৃতার্থ, অতৃপ্ত থাকিতেই, শক্তিহীন অসহায় আমাকে, মৃত্যু হরণ করিবে”॥৩৮॥
ভূমিপত্তি, মোক্ষাকাঙ্ক্ষী পুত্রের সংকল্প শ্রবণ করিয়া, “সে আর (বাহিরে) যাইবে না”, এই বলিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করিয়া, তাঁহার জন্য সর্বোত্তম ভোগ্য বস্তুরও ব্যবস্থা করিলেন॥৩৯॥
সচিবগণ কর্তৃক শাস্ত্রানুসারে, সাদরে, সসম্মানে উপদিষ্ট হইয়া, এবং জনকের অশ্রুপাতের দ্বারা নিবৃত্ত হইয়া, কুমার বিষণ্ণ চিত্তে গৃহে প্রবেশ করিলেন॥৪০॥
চঞ্চল কুণ্ডল যাহাদের আনন স্পর্শ করিতেছে, ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসের দ্বারা যাহাদের পয়োধর কম্পিত হইতেছে, সেই মৃগশিশুর ন্যায় চকিতনয়না নারীগণের দ্বারা নিরীক্ষ্যমাণ হইয়া, কাঞ্চনপর্বতের ন্যায় দীপ্যমান, বরাঙ্গনাগণের হৃদয়-উন্মাদকর কুমার, আপনার বাক্য, স্পর্শ, রূপ ও গুণের দ্বারা, বরাঙ্গনাগণের শ্রবণ, অঙ্গ, লোচন ও জীবন হরণ করিলেন॥৪১-৪২॥
অনন্তর সেই দিবস অতিবাহিত হইলে, আত্মপ্রভার দ্বারা তমোনাশাকাঙ্ক্ষী উদয়কালীন সূর্য যেরূপ মেরু পর্বতে আরোহণ করে, সৌন্দর্যের দ্বারা সেইরূপ দীপ্যমান কুমার, স্বর্ণোজ্জ্বল দীপ্ত দীপবৃক্ষবিশিষ্ট প্রাসাদতলস্থ বাসগৃহে আরোহণ করিলেন। এবং অতি উত্তম কৃষ্ণ-অগুরুধূপপূর্ণ, হীরকখণ্ড-খচিত, শ্রেষ্ঠ কাঞ্চনাসনে উপবিষ্ট হইলেন॥৪৩-৪৪॥
চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র হিমালয়শৃঙ্গে, অপ্সরাগণ যেরূপ কুবেরপুত্রের সেবা করে, রাত্রে, সেইরূপ বরাঙ্গনাগণ, বাদিত্রসহ, ইন্দ্রকল্প নরোত্তম সেই কুমারের সেবার জন্য, সমীপে অপেক্ষা করিতে লাগিল॥৪৫॥
সেই পরম দিব্য বাদিত্রের ন্যায় বাদিত্রধ্বনিতেও তিনি সন্তোষ বা আনন্দ লাভ করিতে পারিলেন না। কারণ সেই পুরুষোত্তমের পরমার্থমুখের জন্য অভিনিষ্ক্রমণ ইচ্ছা উপশমিত হয় নাই॥৪৬॥
অনস্তর তপোবরিষ্ঠ অকনিষ্ঠ[৩] দেবগণ তাঁহার অভিপ্রায় জানিয়া, যুগপৎ প্রমদাগণকে নিদ্রাভিভূত করিলেন ও তাহাদের অঙ্গবিক্ষেপ-প্রচেষ্টা বিকৃত করিলেন॥৪৭॥
কোনো নারী, অঙ্কগত, সুবর্ণপত্রচিত্রিত, প্রিয় বীণাকে যেন কুপিত হইয়া পরিত্যাগ করিয়া, চঞ্চল হস্তোপরি কপোল স্থাপনপূর্বক শয়ন করিল॥৪৮॥
করলগ্নবেণু, স্তনবিস্রস্তশুভ্রবাসপরিহিতা, শয়ানা অন্য এক নারী, ঋজুভ্রমরশ্রেণীসেবিত-সরোজশোভিতা ফেনলগ্ন-তটা, হাস্যময়ী তটিনীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল॥৪৯॥
কেহ বা দৃঢ়বদ্ধ উজ্জ্বল সুবর্ণ-অঙ্গদের দ্বারা শোভিত নবজাত কমলের অভ্যন্তরের ন্যায় কোমল বাহুর দ্বারা, মৃদঙ্গকে প্রিয়তমের ন্যায় আলিঙ্গন করিয়া নিদ্রিত হইল॥৫০॥
নবকনকভূষিতা, পীতবসন পরিহিতা, অন্য এক নারী, গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইয়া, গজভগ্ন কর্ণিকার শাখার ন্যায় নিপতিত হইল॥৫১॥
গবাক্ষপার্শ্ব অবলম্বনপূর্বক শয়ানা অন্য এক নারী, তাহার গাত্রযষ্টি চাপের ন্যায় নত করিয়া, চারুহার লম্বিত করিয়া, তোরণে রচিত কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল॥৫২॥
কাহারও বা মণিকুগুলের দ্বারা দষ্ট (মাঝে মাঝে মুছে যাওয়া) পত্রলেখাযুক্ত বিনত মুখকমল, পদ্মবনস্থিত কারণ্ডব পক্ষী কর্তৃক বিমর্দিত অর্ধবক্রনালবিশিষ্ট শতপত্রের ন্যায় প্রকাশ পাইতেছিল॥৫৩॥
স্তনভারে অবনতাঙ্গী কেহ কেহ যে-ভাবে উপবিষ্ট ছিল সেইভাবেই নিদ্রিত হইয়া, কনকবলয়ভূষিত ভুজপাশের দ্বারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়া বিরাজ করিতে লাগিল॥৫৪॥
অন্য এক নারী, সখীর ন্যায় বৃহৎ বীণাকে আলিঙ্গন করিয়া, সুবর্ণসূত্র (তার)-যুক্ত সেই বীণাকে চঞ্চল করিয়া, চঞ্চল কর্ণালংকারের দ্বারা মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করিয়া, নিদ্রিতাবস্থায় অবলুণ্ঠিত হইতে লাগিল (এপাশ ওপাশ করিতে লাগিল)॥৫৫॥
কোনো রমণী, ভুজাংশ দেশ হইতে স্খলিত, ঊরুদ্বয়ের মধ্যে পতিত, চারুবন্ধনযুক্ত পণবকে (একপ্রকার বাদিত্র) রতিবিলাসক্লান্ত কান্তের ন্যায় গ্রহণ করিয়া নিদ্রিত হইল ॥৫৬॥
বিশালাক্ষী ও সুন্দর ভ্রূবিশিষ্টা হইলেও, চক্ষু নিমীলিত করায়, কেহ কেহ সূর্যাস্তকালীন পদ্মকোশসংকুচিত পদ্মঝাড়ের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিল॥৫৭॥
কেহ বা গজভগ্না নারীপ্রতিমূর্তিসম শয়ানা রহিয়াছে। তাহার আকুল কেশরাশি শিথিল হইয়া পড়িয়াছে; ভূষণ ও বসনপ্রান্ত জঘন দেশ হইতে স্রস্ত হইয়া গিয়াছে এবং কণ্ঠহার বিচ্ছিন্ন হইয়াছে॥৫৮॥
কোনো তরুণী, ধীর ও রূপগুণসম্পন্না হইলেও, অবশ হইয়া লজ্জাহীনার হ্যায় নাসিকা গর্জন এবং হস্তবিক্ষেপ করিয়া বিকৃত-ভাবে জৃম্ভন করিতে লাগিল॥৫৯॥
প্রসুপ্তা, সংজ্ঞাহীনা, অন্য এক রমণী, মাল্যভূষণ পরিত্যাগ করিয়া, বসনগ্রন্থি শিথিল করিয়া, অক্ষিযুগলের শ্বেতাংশ উন্মীলিত করিয়া, নিষ্পন্দনেত্রে, মৃতার হ্যায় শোভাহীন হইল॥৬০॥
বিবৃতবদনা, পরিপূর্ণযৌবনা, কোনো নারীর মুখ হইতে লালা নিঃসৃত হইতেছিল এবং তাহার গুহ্যাংশসমূহ প্রকাশিত হইয়াছিল। তাহার কোনো শোভাই ছিল না। শরীর বিকৃত, করিয়া, মদমত্তার ন্যায় সে শয়ন করিয়াছিল॥৬১॥
নিজ নিজ প্রকৃতি ও কুলানুরূপ, বিবিধ প্রকারে শয়নকরিয়া, প্রমদাসমূহ পবনের দ্বারা নত ও ভগ্ন কমলরাজিশোভিত সরোবরসদৃশ রূপ ধারণ করিল ॥৬২॥
চারুসর্বাঙ্গী, মধুরভাষিণী হইলেও অশান্ত-অঙ্গবিক্ষেপযুতা, বিকৃতশয়ানা, সেই যুবতীদিগকে দেখিয়া রাজপুত্র ঘৃণাবোধ করিলেন॥৬৩॥
“জীবলোকে নারীগণের প্রকৃতি এইরূপ অশুচি ও বিকৃত। বসন ও ভূষণের দ্বারাই বঞ্চিত হইয়া পুরুষ স্ত্রীলোকে অনুরক্ত হয়॥৬৪॥
“পুরুষ যদি নারীগণের এইরূপ প্রকৃতি, ও এইরূপ নিদ্রাজনিত বিকৃতি বিবেচনা করে, তবে নিশ্চয়ই তাহার প্রমাদ বর্ধিত হইবে না স্ত্রীলোকের গুণকল্পনায় অভিভূত হইয়াই পুরুষ অনুরক্ত হয়”॥৬৫॥
ইহার পর সুযোগ বুঝিয়া, রাত্রিতে তাঁহার নিষ্ক্রমণের আকাঙ্ক্ষা হইল। দেবগণ তাঁহার মনোভাব জ্ঞাত হইয়া ভবনের দ্বার উদ্ঘাটিত রাখিলেন॥৬৬॥
শয়ানা সেই যুবতীগণের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করিয়া, তিনি হর্ম্যপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলেন।এবং তাহার পর নির্বিশঙ্কচিত্তে বহির্গৃহে বিনির্গত হইলেন॥৬৭॥
তিনি অশ্বানুচর দ্রুতগামী ছন্দককে জাগরিত করিয়া বলিলেন; “কন্থক নামক অশ্বকে দ্রুত আনয়ন করো। অমৃত প্রাপ্তির জন্য এই স্থান হইতে আমার গমনাভিলাষ জাগ্রত হইয়াছে ॥৬৮॥
“আজ হৃদয়ে আমার যে-সন্তোষ উৎপন্ন হইয়াছে, আমার সংকল্প যেরূপ দৃঢ় হইয়াছে, বিজনেও আজ আমি নিজেকে যেরূপ সহায়সম্পন্ন মনে করিতেছি, তাহাতে নিশ্চয়ই অভীষ্টবস্তু আমার সম্মুখীন হইয়াছে॥৬৯॥
“লজ্জা ও নম্রতা পরিত্যাগ করিয়া, যুবতীগণ যে-ভাবে আমার সম্মুখে নিদ্রিত হইল, যে-ভাবে কপাট স্বয়ং উন্মুক্ত হইল, তাহাতে নিশ্চয়ই আমার এই নিষ্ক্রমণের সময় আসিয়াছে”॥৭০॥
রাজ-আজ্ঞার অভিপ্রায় অবগত হইয়াও, চিত্তে পরের দ্বারা প্রবর্তিত হইয়াই যেন সেই অশ্বরক্ষক প্রভুর আজ্ঞা স্বীকার পূর্বক, অশ্ব আনয়নের সংকল্প করিল॥৭১॥
অনন্তর হেমখলীনের দ্বারা পূর্ণবক্ত্র, লঘু শয্যাস্তরণের দ্বারা আবৃতপৃষ্ঠ, বল, তেজ, বেগ ও ক্ষিপ্রতা সমন্বিত, সেই অশ্বকে সে প্রভুর নিকট আনয়ন করিল॥৭২॥
সেই অশ্বের পৃষ্ঠাস্থি (ত্রিক), নিতম্ব (পুচ্ছমূল), এবং জঙ্ঘার নিম্নাংশ (পার্ফি) দীর্ঘ; লোম, পুচ্ছ ও কর্ণ ক্ষুদ্র এবং শাস্ত; পৃষ্ঠ, কুক্ষি ও পার্শ্ব কোথাও উন্নত, কোথাও অবনত এবং প্রোথ (অশ্বের নাসিকাগ্র), ললাট, কটি ও বক্ষ প্রশস্ত ছিল॥৭৩॥
বিশালবক্ষ কুমার তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া, কমলপ্রতিম হস্তের দ্বারা তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া সৈন্যগণমধ্যে প্রবেশ কামী সৈনিকের ন্যায় মধুর বাক্যে তাহাকে আজ্ঞা করিলেন॥৭৪॥
“তোমাতে আরোহণ করিয়া নরপতি বহুবার শত্রুগণকে সমরে নিরস্ত করিয়াছেন। হে তুরগশ্রেষ্ঠ, যাহাতে আমিও অমৃতপদ লাভ করিতে পারি, তাহার ব্যবস্থা করো॥৭৫॥
“সংগ্রামে, ভোগসুখে, বা ধনার্জনে সহায় অতিশয় সুলভ। ধর্মসংশয়ে বা আপদে পতিত পুরুষের সহায় অত্যন্ত দুর্লভ॥৭৬॥
“আমি অন্তরে প্রত্যক্ষ অনুভব করিতেছি—যাহারা ইহলোকে কলুষকর্মে বা ধর্মসংশয়ে সহায় হয়, তাহারা নিশ্চয়ই তাহার অংশ ভোগ করে॥৭৭॥
“এখান হইতে আমার এই ধর্ম যুক্ত নিষ্ক্রমণ জগতের হিতের · জন্য; ইহা অবগত হইয়া, হে তুরগোত্তম, নিজের ও জগতের হিতের জন্য, বেগ ও বিক্রমের সহিত প্রস্থান করো” ॥৭৮॥
বনগমনাকাঙ্ক্ষী, অগ্নিসম দ্যুতিমান, উন্নতদেহ সেই নরোত্তম, লোকে সুহৃদকে যেরূপ কর্তব্যকর্মে অনুশাসন করে, সেইরূপ সেই শুভ্র তুরগশ্রেষ্ঠকে অনুশাসন করিয়া, সূর্য যেরূপ শারদ মেঘমালায় আরোহণ করে, সেইরূপ তাহাতে আরোহণ করিলেন॥৭৯॥
অনস্তর নিশীথকালে প্রচণ্ড শব্দকর ও পরিঞ্জনবোধকর ধ্বনি পরিহার করিয়া, হনুরব ও হ্রেষাধ্বনিশূন্য সেই সদশ্ব ভয়বিমুক্ত পদক্ষেপে গমন করিতে লাগিল॥৮০॥
নতদেহ যক্ষগণ কনকবলয়ভূষিতপ্রকোষ্ঠ, কমলপ্রতিম করাগ্রের দ্বারা যেন (সেই অশ্বের) চরণতলে কমল বর্ষণ করত, সেই অশ্বের খুর (মাটি হইতে ঊর্ধ্বে) ধারণ করিয়া, চকিত গতিতে চলিতে লাগিল॥৮১॥
কুমারের গমনকালে গুরুপরিঘকপাট-সংবৃত যে-পুরদ্বারসমূহ, দ্বিরদেরাও সহজে অবারিত করিতে পারিত না, তাহা স্বয়ং নিঃশব্দে উন্মুক্ত হইয়া গেল॥৮২॥
অবিচলিতসংকল্প সেই কুমার, স্নেহাসক্ত পিতা, বালকপুত্র, অনুরক্ত প্রজাবর্গ, ও অনুত্তমা লক্ষ্মী, নিরাকাঙ্ক্ষভাবে পরিত্যাগ করিয়া, পিতৃনগর হইতে বহির্গত হইলেন॥৮৩॥
অনন্তর বিকচপঙ্কজসম বিশালাক্ষ কুমার সেই নগর অবলোকন করিয়া সিংহনাদ করিয়া উঠিলেন, “জন্মমৃত্যুর পরপার না দেখিয়া, আর এই কপিল নামধারী নগরে প্রবেশ করিব না”॥৮৪॥
তাঁহার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া, ধনপতি কুবেরের পারিষদবর্গ আনন্দ করিতে লাগিলেন; এবং প্রমুদিতমনা দেবগণ তাঁহার অভিপ্রায়-সিদ্ধি কামনা করিলেন॥৮৫॥
বহ্নিসম দীপ্তদেহধারী অন্য দিবৌকসগণ তাঁহার অভিপ্রায়. অতিশয় দুষ্কর জানিয়া, সেই হিমাবৃত পথে, মেঘবিবর হইতে নিঃসৃত চন্দ্রকিরণ সম আলোকরাশি প্রকটিত করিলেন॥৮৬॥
ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবাসদৃশ সেই অশ্ব, চিত্তে যেন অনুপ্রেরণালাভ করিয়া ধাবিত হইল। অন্তরীক্ষে যখন অরুণরাগ দেখা দিল, এবং তারকাগণ যখন সেই অরুণরাগে রঞ্জিত হইতে লাগিল, তখন কুমার বহুযোজন পথ অতিক্রম করিয়াছেন॥৮৭॥
- ↑ ১। বৌদ্ধশাস্ত্রে “চিত্তস্থিতি” নামক এক প্রকার সমাধির উল্লেখ আছে।
- ↑ ২। অনাস্রব— আস্রবহীন। আশ্রব—১। কাম ২। ভব (পুনর্জন্মাকাঙ্ক্ষা) ৩। দৃষ্টি (মিথ্যাবৃষ্টি) ৪। অবিদ্যা।
প্রথম ধ্যান-বৌদ্ধশাস্ত্রে নয় প্রকার ধ্যানের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইহার -মধ্যে চারিটি (যথা, প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান, চতুর্থ ধ্যান) রূপধ্যান। চারিটি অরূপধ্যান। নবমটি হইতেছে ধ্যানের সর্বশেষ অবস্থা, যখন সর্বপ্রকার চেতনা ও অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে নিরুদ্ধ হয়। ধ্যানের এই অবস্থায়, মৃতদেহের সহিত ধ্যানীর দেহের প্রায় কোনো প্রভেদই থাকে না। মৃতের সহিত এই ধ্যানপ্রবিষ্ট ব্যক্তির প্রভেদ মাত্র এই টুকু যে দেহ তাঁহার উষ্ণ থাকে প্রাণ বহির্গত হয় না এবং ইন্দ্রিয়গণ নষ্ট হয় না। - ↑ রূপলোকের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। শুদ্ধাধিবাস শ্রেণীর মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ।