আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/স্বপ্নসঞ্চরণ

উইকিসংকলন থেকে
স্বপ্নসঞ্চরণ

ইটালির অন্তঃপাতী পেডুয়া নগরে, সাইরিলো নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি স্বভাবতঃ সুশীল, সচ্চরিত্র, সরলহৃদয় ও ধর্ম্মপরায়ণ ছিলেন, কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় ইহার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবাপন্ন হইতেন। তিনি, নিদ্রিত অবস্থায়, শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেন, এবং বহুবিধ বিগর্হিত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতেন।

 যৎকালে সাইরিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহার অধ্যাপক, তাঁহাকে কতকগুলি প্রশ্ন দিয়া, উত্তর লিখিয়া আনিতে বলিয়া দিয়াছিলেন। সেই সকল প্রশ্নের উত্তর লিখিয়া, পর দিন যথাকালে বিদ্যালয়ে লইয়া যাওয়া অসাধ্য বিবেচনা করিয়া, তিনি যৎপরোনাস্তি উৎকণ্ঠিত হইলেন। না লইয়া গেলে, অধ্যাপক মহাশয়ের নিকট ভর্ৎসনা ও অবমাননা প্রাপ্ত হইবেন, এজন্য তাঁহার অতিশয় দুর্ভাবনা উপস্থিত হইল। সেই দুর্ভাবনা বশতঃ কিছু লিখিতে না পারিয়া, তিনি নিতান্ত বিষণ্ণ-মনে শয়ন করিলেন, কিন্তু, পরদিন প্রাতঃকালে, শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া দেখিলেন, তাঁহার টেবিলের উপর ঐ সমস্ত প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর লিখিত রহিয়াছে, আশ্চর্য্যের বিষয় এই, তৎসমুদয় তাঁহার স্বহস্তলিখিত।

 এইরূপ অঘটনঘটনা দর্শনে, তিনি যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াপন্ন হইলেন, এবং যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনপূর্ব্বক, স্বীয় অধ্যাপক মহাশয়ের নিকট, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। তিনি শুনিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। এই অদ্ভুত ব্যাপারের সবিশেষ পরীক্ষা করিবার মানসে, সেদিন তিনি তাঁহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক ও অধিক দুরূহ প্রশ্নের উত্তর লিখিয়া আনিতে আদেশ দিলেন, এবং এই অভূতপূর্ব্ব ব্যাপারের নিগূঢ় তত্ত্ব অবধারিত করিবার অভিপ্রায়ে, সে দিবস রজনীযোগে, প্রচ্ছন্নভাবে, তদীয় আবাসগৃহের সন্নিধানে অবস্থিতি করিলেন। সাইরিলো, শয়নগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক, নিদ্রাগত হইলেন, কিন্তু, দুই তিন দণ্ড পরেই, প্রগাঢ়নিদ্রাবস্থায় শয্যা হইতে উঠিলেন, প্রদীপ জ্বালিয়া পড়িতে ও লিখিতে বসিলেন, এবং অনধিক সময়ের মধ্যেই, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লিখিয়া, সমাপন করিলেন। তদ্দর্শনে যারপরনাই চমৎকৃত হইয়া, অধ্যাপক মহাশয় স্বীয় আবাসগৃহে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।  যৌবনকাল উত্তীর্ণ হইলে, সাইরিলো সতত সাতিশয় বিষণ্ণচিত্ত ও সর্ব্ববিষয়ে নিতান্ত নিরুৎসাহ হইয়া উঠিলেন, সাংসারিক কোনও বিষয়ে তাঁহার আর অনুরাগমাত্র রহিল না। অবশেষে, সংসারাশ্রমে বিসর্জ্জন দিয়া, তিনি এক ধর্ম্মাশ্রমে প্রবিষ্ট হইলেন। তথায় তিনি স্বয়ং ধর্ম্মচিন্তা, অপেক্ষাকৃত অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে ধর্ম্মবিষয়ে উপদেশদান ও অশেষবিধ কঠোর ব্রতের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই, তিনি সর্ব্বাংশে বিশুদ্ধহৃদয়, সদাচারপূত ও উত্তম ধর্ম্মোপদেশক বলিয়া বিলক্ষণ প্রতিপত্তি লাভ করিলেন। কিন্তু, তাঁহার এই প্রতিপত্তি দীর্ঘকালস্থায়িনী হইল না। দিবাভাগে, যে সকল সদনুষ্ঠান দ্বারা, সাধু বলিয়া গণনীয় ও সকলের আদরণীয় হইতেন, রজনীযোগে, স্বপ্নসঞ্চরণকালীন জঘন্য আচরণ দ্বারা, সে সমুদয় তিরোহিত হইয়া যাইত। তিনি, প্রায় প্রত্যহ, নিদ্রিত অবস্থায় শয্যাপরিত্যাগ করিয়া, অন্যান্য গৃহে প্রবেশ করিতেন, এবং পরুষ ও অশ্লীল ভাষার উচ্চারণ করিতে থাকিতেন। ক্রমে ক্রমে, আশ্রমবাসী ব্যক্তিমাত্রেই তাঁহার এই অদ্ভুত আচরণের বিষয় অবগত হইলেন। ধর্ম্মাশ্রমবাসীদিগের পক্ষে, এইরূপে গৃহে গৃহে প্রবেশ ও অপভাষাপ্রয়োগ নিরতিশয় দোষাবহ, সুতরাং, তাহার নিবারণের উপায় করা অতি আবশ্যক। কিন্তু, ধর্ম্মাশ্রমের নিয়মাবলীর বহির্ভূত বলিয়া, তাঁহাকে রজনীযোগে গৃহমধ্যে রুদ্ধ করিয়া রাখা বিহিত বোধ হইল না, সুতরাং, তিনি, প্রতি রাত্রিতেই, ঐরূপ কুৎসিত কাণ্ড করিতে লাগিলেন।  একদিন দৃষ্ট হইল, সাইরিলো স্বীয় গৃহে কেদারায় বসিয়া, নিদ্রা যাইতেছেন। তিনি, দুই তিন দণ্ড স্থিরভাবে থাকিয়া, যেন কাহারও সহিত কথোপকথন করিতেছেন, এই ভাবে অবস্থিত হইলেন, এবং উচ্চৈঃস্বরে হাস্য ও অবজ্ঞাসূচক অঙ্গুলিধ্বনি করিতে লাগিলেন, অনন্তর, যেন আর কেহ তাঁহার নিকটে দাঁড়াইয়া আছে, এই মনে করিয়া, ঐ দিকে মুখ ফিরাইয়া, তাহার নিকট হইতে নস্য গ্রহণমানসে, অঙ্গুলিবিস্তার করিলেন, কিন্তু তাহা না পাইয়া, যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, স্বীয় নস্যধানী বহিষ্কৃত করিলেন, তাহাতে কিছুমাত্র নস্য না থাকাতে, অঙ্গুলি দ্বারা তাহার অভ্যন্তরভাগ খুঁটরাইয়া কিঞ্চিৎ গ্রহণ করিলেন, এবং চারি দিকে দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া, পাছে কেহ উহা লয়, এই আশঙ্কায়, সাবধানে স্বীয় বসনমধ্যে লুকাইয়া রাখিলেন। এইরূপে, কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে অবস্থিত হইয়া, তিনি অকস্মাৎ সাতিশয় কুপিত হইয়া উঠিলেন, এবং ক্রোধভরে অশেষবিধ জঘন্য শপথ ও অভিশাপবাক্যের উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার ধর্ম্মভ্রাতৃবর্গ, এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত, কৌতুক দেখিতেছিলেন, এক্ষণে ঐ সকল কুৎসাপূর্ণ বাক্য শ্রবণে বিরক্ত হইয়া, স্ব স্ব আবাসগৃহে প্রতিগমন করিলেন।

 আর এক দিন, তিনি, স্বপ্নাবেশে শয্যাপরিত্যাগ করিয়া, উপাসনাগৃহে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং তত্রত্য তৈজস দ্রব্যসমূহের অপহরণমানসে, তৎসমুদয়ের অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। দৈবযোগে, ঐ সমস্ত দ্রব্য, পরিষ্কৃত করিয়া আনিবার নিমিত্ত, স্থানা ন্তরে প্রেরিত হইয়াছিল, সুতরাং, তাঁহার অভিপ্রায় সম্পন্ন হইয়া উঠিল না। এজন্য, তিনি ক্রোধে অন্ধ হইলেন, এবং রিক্তহস্তে প্রতিনিবৃত্ত হইতে অনিচ্ছু হইয়া, সেই গৃহস্থিত কতিপয় পরিচ্ছদ লইলেন, এবং সর্ব্বতঃ সশঙ্ক দৃষ্টিপাত করিতে করিতে, স্বীয় গৃহে প্রবেশ পূর্ব্বক সেই সমস্ত অপহৃত বস্তু শয্যাতলে লুকাইয়া রাখিয়া, পুনরায় শয়ন করিলেন। যে সকল ব্যক্তি তাঁহার এই কুৎসিত কার্য্য দেখিতেছিলেন, তাঁহারা, তিনি পরদিন প্রাতঃকালে কিরূপ আচরণ করেন, ইহা জানিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুকচিত্তে রজনীযাপন করিলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, সাইরিলোর নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি, শয্যার মধ্যস্থল সাতিশয় উন্নত দেখিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইলেন, এবং কি কারণে সেরূপ হইয়াছে, তাহার কারণানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া, কতিপয় পরিচ্ছদ তথায় স্থাপিত দেখিয়া, পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর, কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, তিনি, আকুলচিত্তে, ধর্ম্মভ্রাতাদিগের নিকট সবিশেষ সমস্ত নির্দ্দিষ্ট করিয়া বলিলেন, এই সমস্ত পরিচ্ছদ কিরূপে আমার শয্যাতলে নিহিত হইল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তাঁহারা বলিলেন, তুমি স্বয়ং এই কাণ্ড করিয়াছ। তিনি শুনিয়া কি পর্য্যন্ত শোকাকুল ও অনুতাপানলে দগ্ধ হইলেন, তাহা বলিতে পারা যায় না।

 এক সম্পত্তিশালিনী ধর্ম্মপরায়ণা নারী এই ধর্ম্মাশ্রমের যথেষ্ট আনুকূল্য করিতেন। তিনি মৃত্যুকালে এই প্রার্থনা ও এই অভিলাষ প্রকাশ করিয়া যান, যেন্‌ তাঁহার কলেবর ঐ ধর্ম্মাশ্রমের কোনও স্থানে সমাহিত হয়। তদনুসারে, তাঁহার কলেবর তথায় নীত, এবং তদীয় মহামূল্য পরিচ্ছদ ও সমস্ত আভরণের সহিত, মহাসমারোহে সমাহিত হইল। উল্লিখিত ব্যাপারের সমাধানসময়ে আশ্রমস্থ ধর্ম্মভ্রাতৃবর্গ সমবেত হইয়া, যৎপরোনাস্তি শোকপ্রকাশ ও সেই নারীর পারলৌকিকমঙ্গলকামনায় জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। এই সময়ে সাইরিলো যেরূপ অকৃত্রিম শোক, পরিতাপ ও মঙ্গলকামনা করিয়াছিলেন, বোধ হয় আর কেহই সেরূপ করিতে পারেন নাই।

 পরদিন প্রাতঃকালে, আশ্রমবাসীরা অবলোকন করিলেন, সেই নারীর সমাধিস্থান উদ্ঘাটিত হইয়াছে, তদীয় কলেবর সর্ব্বাংশে বিকলিত হইয়াছে, যে সকল অঙ্গুলিতে অঙ্গুরীয় ছিল, তৎসমুদয় ছিন্ন ও মহামূল্য পরিচ্ছদ অপহৃত হইয়াছে। এই অতিবিগর্হিত ধর্ম্মবহির্ভুত ব্যাপার দর্শনে সকলেই সাতিশয় শোকাকুল ও বিস্ময়াপন্ন হইলেন, এবং যে নরাধম দ্বারা এই জঘন্য কাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছিল, সকলেই তাহাকে লক্ষ্য করিয়া, একবাক্য হইয়া, যথোচিত তিরস্কার করিতে লাগিলেন। এই বিষয়ে সাইরিলো সর্ব্বাপেক্ষায় সমধিক ক্ষুব্ধ ও শোকাকুল হইয়াছিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি আপন আবাসগৃহে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং স্বীয় শয্যাতলে বস্তুবিশেষের অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইয়া দেখিলেন, ঐ নারীর পরিচ্ছদ, অলঙ্কার প্রভৃতি সমস্ত বস্তু সেই স্থানে স্থাপিত আছে। তখন, গত রজনীতে তিনিই ঐ সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন করিয়াছেন, ইহা বুঝিতে পারিয়া, সাইরিলো শোকে ও পরিতাপে ম্রিয়মাণ হইলেন। অতি বিষম অনুতাপানলে তাঁহার হৃদয় দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। তিনি ক্ষণবিলম্ব ব্যতিরেকে, ধর্ম্মভ্রাতৃবর্গকে সমবেত করিয়া, গলদশ্রুলোচনে, শোকাকুল বচনে, সমস্ত বর্ণন করিলেন। অনন্তর, সকলে একমতাবলম্বী হইয়া তাঁহার সম্মতিগ্রহণ পূর্ব্বক, তাঁহাকে আশ্রমান্তরে প্রেরিত করিলেন। তত্রত্য প্রধান ব্যক্তির এরূপ ক্ষমতা ছিল, তিনি আবশ্যক বোধ করিলে, কোনও ব্যক্তিকে গৃহবিশেষে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারেন। এই আশ্রমে সাইরিলো রজনীযোগে এক গৃহে রুদ্ধ থাকিতেন, সুতরাং, স্বপ্নাবেশে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, যথেচ্ছাচারণ করিতে পারিতেন না।