বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/অকুতোভয়তা

উইকিসংকলন থেকে

অকুতোভয়তা

ফরাসিদেশে দেশুলিয়র নামে এক সদ্বংশসম্ভূতা কামিনী ছিলেন। তিনি অসাধারণ কবিত্বশক্তি দ্বারা স্বদেশে বিলক্ষণ প্রতিপত্তিলাভ করেন এবং সর্ব্বপ্রকার লোকের নিকট সাতিশয় আদরণীয় হয়েন।

 একদা তিনি লুনিরেলের কৌণ্ট ও কৌণ্টেসের[] সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তাঁহাদের বাসস্থানে গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইলে, কৌণ্ট ও কৌণ্টেস্ তাঁহার সমুচিত সমাদর ও পরিচর্য্যা করিয়া বলিলেন, রাত্রিবাসের নিমিত্ত আপনি ইচ্ছানুসারে গৃহ মনোনীত করিয়া লউন, কিন্তু একটি গৃহ নির্দ্দিষ্ট করিয়া বলিলেন, কেবল এই গৃহে থাকিতে পাইবেন না, ইহাতে রাত্রিকালে ভূতের আবির্ভাব ও উপদ্রব হয়। কেবল আমরা উভয়ে ঐরূপ ভাবি, এরূপ নহে, এই বাটীতে যত লোক আছে, দেখিয়া শুনিয়া সকলেরই ঐরূপ সংস্কার জন্মিয়াছে। এই গৃহের মধ্যে বাত্রিতে প্রায় সর্ব্বদাই বিকট শব্দ ও গোলযোগ শুনিতে পাওয়া যায়। এজন্য কেহ সাহস করিয়া রাত্রিতে এই গৃহে প্রবেশ করিতে পারে না।

 এই কথা শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, দেশুলিয়র বলিলেন, অদ্য আমি এই গৃহেই রজনীযাপন করিব, এবং কি কারণে ঐরূপ শব্দ ও গোলযোগ হয়, পরীক্ষা করিয়া দেখিব। কৌণ্ট মহাশয় তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা শুনিয়া চকিত হইয়া উঠিলেন, এবং চমৎকৃত হইযা বলিলেন, আমবা কোনও ক্রমে আপনাকে এই ভয়ঙ্কর গৃহে বাত্রিবাস কবিতে দিব না। প্রভূত কৌতূহল বশতঃ এক্ষণে আপনকার এরূপ ইচ্ছা ও সাহস হইতেছে বটে, কিন্তু অকিঞ্চিৎকর কৌতূহল চরিতার্থ করিতে গিয় পরিণামে আপনকার অসুখ ও যন্ত্রণার সীমা থাকিবে না, অধিক কি, আপনকার প্রাণসংশয় পর্যন্ত ঘটিতে পারে। অতএব আমি কোনও মতে আপনার এই অসংসাহসিক অধ্যবসায়ের অনুমোদন করিতে পারিব না।

 এইরূপে তিনি অনেক বুঝাইলেন ও অনেক ভয় দেখাইলেন, কিন্তু দেশুলিয়র, কোনও ক্রমেই বিচলিত হইলেন না। কৌণ্টেস্ও তাঁহাকে অশেষ প্রকারে বুঝাইলেন ও বিস্তর বাদানুবাদ করিলেন, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। দেশুলিয়রের এই স্থির-সিদ্ধান্ত ছিল, লোকে সচরাচর যে ভূতের গল্প ও ভূতের উপদ্রবের বর্ণন করে, সে সকল নিরবচ্ছিন্ন ভ্রান্তিমূলক ও কুসংস্কারজনিত, দুর্ব্বলচিত্ত লোকেরাই তাদৃশ কল্পিত বিষয়ে বিশ্বাস করিয়া থাকে। এই সংস্কারবশতঃ, কিছুতেই তাঁহার সাহস সঙ্কুচিত বা ব্যতিক্রান্ত হইল না। তদ্দর্শনে কৌণ্ট ও কৌণ্টেস্ ভয়ে ও দুর্ভাবনায় অভিভূত হইযা, যথোচিত বিনয় করিলেন, ভর্ৎসনা করিলেন, দুঃখপ্রকাশ করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহাকে অবলম্বিত অধ্যবসায় হইতে বিরত করিতে পারিলেন না, অবশেষে, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন।

 অনন্তর দেশুলিয়র এক পরিচারিকা সমভিব্যাহারে শয়নাগারে প্রবেশ করিলেন, এবং পরিচ্ছদপরিহার পূর্ব্বক, পল্যঙ্কে আরোহণ করিয়া, পরিচারিকাকে বলিলেন, পল্যঙ্কের শিখরের দিকে একটি বড় বাতি জ্বালিয়া রাখ, এবং দৃঢ়রূপে দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া যাও। সে তাঁহার আদেশানুরূপ কার্য্যের সমাধা করিয়া প্রস্থান করিলে পর, তিনি শয়ন করিয়া কিয়ৎক্ষণ পুস্তক পাঠ করিলেন, এবং পাঠ করিতে করিতে নিদ্রাভিভূত হইলেন।

 কিঞ্চিৎ কাল পরে, বিকট শব্দ হইতে লাগিল। সেই শব্দে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। অবিলম্বে দ্বার উদ্ঘাটিত ও পদসঞ্চারধ্বনি আরব্ধ হইল। শ্রবণমাত্র, দেশুলিয়র স্থির করিলেন, বাটীর সকলে যাহাকে ভূত ভাবিয়া ভয় পাইতে থাকে, সে এই। পরে তিনি অবিচলিত চিত্তে ও অসঙ্কুচিত স্বরে, তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, তুমি যে হও না কেন, আমি তোমায় স্পষ্ট বলিতেছি, কিছুতেই ভয় পাই না, এবং এই বাটীর সকলের যে অমূলক ভয় ও সংস্কার জন্মিয়া আছে, আজ তাহার নিগূঢ় তত্ত্ব উদ্ভাবিত করিব বলিয়া, যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিযাছি, কোনও কারণে তাহা হইতে বিচলিত হইব না। যদি ভয় দেখাইয়া, আমায় তাহা হইতে বিরত করা তোমার অভিপ্রেত হয়, তুমি কদাচ কৃতকার্য্য হইতে পারিবে না। আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, শেষ পর্য্যন্ত না দেখিয়া, আমি ক্ষান্ত হইব না।

 দেশুলিয়র এই বলিয়া বিরত হইলেন, কিন্তু উত্তর পাইলেন না। তিনি পুনরায় সেইরূপ বলিলেন, তথাপি কোনও উত্তর পাইলেন না। পল্যঙ্কের অতি সন্নিকটে একটি কাঠের পরদা ছিল, উহা উলটিয়া মশারির উপর পতিত হওয়াতে, একটা বিকট শব্দ হইল। যাহাদের ভূতের ভয় আছে, এরূপ অবস্থায় ঐরূপ শব্দ শুনিলে ও ঘটনা দেখিলে, তাহাদের বুদ্ধিভ্রংশ ও চৈতন্যধ্বংস হয়, তাহার কিছুমাত্র সংশয় নাই। কিন্তু, দেশুলিয়রের মনে ভয় বা উদ্বেগের অণুমাত্র সঞ্চার হইল না। তাঁহার এই সন্দেহ হইল, বাটীর কোনও ভৃত্য আমায় ভয় দেখাইতে আসিয়াছে। যাহা হউক, তিনি সেই রাত্রিচরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে, কি জন্য এখানে আসিয়াছ, বল। তুমি কখনই এরূপে ভয়প্রদর্শন করিয়া, আমায় ব্যাকুল বা বিচলিত করিতে পারিবে না। সে কোনও উত্তর দিল না, প্রশান্তভাবে গৃহমধ্যে ভ্রমণ করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, সে জ্বলন্ত বাতির নিকটে উপস্থিত হইল। অবিলম্বে বৃহৎ বাতি ও বাতির প্রকাণ্ড আধার উলটিয়া পড়িল। ভয়ানক শব্দ ও গৃহ অন্ধকারময় হইল। তাহাতেও তিনি কিঞ্চিন্মাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না।

 অবশেষে, সেই রাত্রিচর পল্যঙ্কের পাদদেশে উপস্থিত হইল। তখনও দেশুলিয়রের অন্তঃকরণে অণুমাত্র ভয়সঞ্চার হইল না। ভাল হইল, তুমি কি পদার্থ, এখনই আমি অনায়াসে তাহার নির্ণয় করিতে পারিব, এই বলিয়া গাত্রোত্থান পূর্ব্বক, পল্যঙ্কের পাদদেশে হস্তপ্রসারণ করিয়া, তিনি তাহার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার দুই কর মখমলের ন্যায় কোমল দুই কর্ণে সংলগ্ন হইল। তিনি বলপূর্বক সেই দুই কর্ণ ধরিলেন, এবং যাবৎ রাত্রিশেষ ও সূর্য্যোদয় না হয়, ছাড়িবেন না স্থির করিলেন, কিন্তু কাহার কর্ণ ধরিলেন, কিছুই অবধারণ করিতে পারিলেন না। এই ভাবে অবস্থিত হইয়া, তিনি রজনীর অবশিষ্ট ভাগ অতিবাহিত করিলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, এই অদ্ভুত ব্যাপারের স্বরূপনির্ণয় হইল। ঐ বাটীতে এক বৃহৎ কুকুর ছিল। দেশুলিয়র দেখিলেন, ঐ কুক্কুরের কর্ণ ধরিয়া আছেন। ভয়ঙ্কর ভৌতিক ব্যাপারের এইরূপে পর্য্যবসান হওয়াতে, তিনি উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিতে লাগিলেন, অনন্তর সেই কুকুরের কর্ণপরিত্যাগ পূর্ব্বক, নিশ্চিন্ত হইয়া শয়ন করিয়া রহিলেন।

 এদিকে, কৌণ্ট ও কৌণ্টেস্, শয়নাগারে প্রবেশ করিয়া, যৎপরোনাস্তি উদ্বেগ ও দুর্ভাবনায় রজনীযাপন করিলেন, একবারও নয়ন মুদ্রিত করিতে পারিলেন না। তাঁহারা এই বিষয়ের যত আন্দোলন করিতে লাগিলেন, উত্তরোত্তর ততই ব্যাকুল হইতে লাগিলেন। অবশেষে, তাঁহারা এই সিদ্ধান্ত করিলেন, আমরা প্রাতঃকালে উঠিয়া, দেশুলিয়রেব প্রাণত্যাগ হইয়াছে, অবধারিত দেখিতে পাইব। রজনী অবসন্ন হইবামাত্র, তাঁহারা শয়নাগার হইতে বহির্গত হইয়া, বিষণ্ন বদনে অবসন্ন গমনে ভূতাবিষ্ট গৃহের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন, সাহস করিয়া, সহসা সেই গৃহে প্রবেশ করিতে পারিলেন না। কিয়ৎক্ষণ পরে প্রবেশ করিয়াও, কথা কহিতে তাঁহাদের সাহস হইল না। রাত্রিতে কি সর্ব্বনাশ ঘটিয়াছে, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, স্তব্ধ ও হতবুদ্ধি হইয়া উভয়ে দণ্ডায়মান রহিলেন।

 তাঁহাদিগকে সমাগত দেখিয়া, দেশুলিয়র মশারির অভ্যন্তর হইতে বিনির্গমন পূর্ব্বক, প্রাতঃকর্ত্তব্য নমস্কারসম্ভাষণাদি করিয়া, সহাস্য মুখে তাঁহাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। তাঁহাকে জীবিত, অক্ষতশরীর ও প্রফুল্লচিত্ত দেখিয়া, তাঁহাদের কলেবরে প্রাণসঞ্চার হইল। রাত্রিতে যার পর যে ঘটনা হইয়াছিল, তিনি তৎসমুদয়ের অবিকল বর্ণন করিতে লাগিলেন। শুনিতে শুনিতে, তাঁহাদের হৃৎকম্প হইতে লাগিল। অবশেষে, দেশুলিয়র কৌণ্ট মহাশয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, এ বিষয়ে আপনকার বিলক্ষণ ভ্রম জন্মিয়া আছে, এবং প্রশ্রয় দেওয়াতে, সেই ভ্রম, ক্রমে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে। আর আপনকার ঈদৃশ অমূলক কুসংস্কার থাকা উচিত নহে। আপনারা যাহাকে ভূত বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছেন, ঐ দেখুন, সে শুইয়া রহিয়াছে। এই বলিয়া অঙ্গুলিনির্দেশ পূর্ব্বক, তিনি ঐ কুক্কুর দেখাইয়া দিলেন, এবং হাস্যমুখে রাত্রিবৃত্তান্তের শেষ ভাগের বর্ণনা করিলেন।

 সবিশেষ সমস্ত শ্রবণগোচর করিয়া, তাঁহারা স্ত্রী-পুরুষে চমৎকৃত হইলেন। অনন্তর, দেশুলিয়র পুনরায় কৌণ্টকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ভবাদৃশ ব্যক্তির ঈদৃশ কুসংস্কারের বশীভূত হওয়া উচিত নহে। দেখুন, এই অমূলক কুসংস্কারের দোষে, আপনাদের অন্তঃকরণে কত শঙ্কা জন্মিয়াছিল। গত রাত্রিতে আমার কি বিপদ ঘটে, এই দুর্ভাবনায় আপনারা কত অসুখে কালযাপন করিয়াছেন, বলিতে পারি না। লোকে যে সকল ব্যাপারের প্রকৃত কারণে নির্ণয় করিতে না পারে, উহাদিগকে অলৌকিক ঘটনা জ্ঞান করিয়া থাকে। তৎপরে তিনি দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন, এবং প্রত্যহ চাবি দিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখে, অথচ, কুকুর কিরূপে দ্বার খুলিয়া গৃহে প্রবেশ করে, এই সংশয়চ্ছেদন করিবার নিমিত্ত, ঘরের পরীক্ষা করিতে লাগিলেন, অবিলম্বে দেখিতে পাইলেন, তাহার কল প্রভৃতি এত শিথিল হইয়া গিয়াছিল যে, কিছু বলপূর্ব্বক ধাক্কা মারিলেই, কপাট খুলিয়া যায়।

 এইরূপে গৃহপ্রবেশ অনাআসসাধ্য হওয়াতে, কুক্কুর প্রত্যহ অধিক রাত্রিতে সেই গৃহে প্রবেশ করিত, কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া, পল্যঙ্কে আরোহণ পূর্ব্বক, তদুপরি নিদ্রা যাইত, এবং রাত্রিশেষে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া স্বস্থানে গিয়া অবস্থিতি করিত। সে রাত্রিতেও পল্যঙ্কে আরোহণ করিবার অভিপ্রায়ে, উহার পাদদেশে গমন করিয়াছিল, বোধ হয়, দেশুলিয়র বলপূর্ব্বক কর্ণে ধরিয়া না রাখিলে, তদুপরি আরোহণ করিত।

 যাহা হউক, কৌণ্ট ও কৌণ্টেস্, এইরূপে ভৌতিক বৃত্তান্তের সিদ্ধান্ত হওয়াতে, অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন, এবং দেশুলিয়রের সাহস, বুদ্ধিকৌশল ও অকুতোভয় দর্শনে চমৎকৃত হইয়া, মুক্তকণ্ঠে তাঁহাকে শত শত সাধুবাদপ্রদান করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, তিনি স্ত্রীলোক হইয়া সাহস ও অকুতোভয়তার যেরূপ পরিচয় দিয়াছেন, পুরুষ জাতির মধ্যেও, সচরাচর সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না।


  1. কৌণ্ট - ফ্রান্স প্রভৃতি য়ুরোপীয় জনপদে সম্ভ্রান্ত লোকদিগের পদবীবিশেষ। কৌণ্টের সহধর্ম্মিণীর পদবী কৌণ্টেস্‌।