বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/পিতৃভক্তি ও পতিপরায়ণতা

উইকিসংকলন থেকে

পিতৃভক্তি ও পতিপরায়ণতা

পূর্ব্বকালে গ্রীস্ দেশের অন্তঃপাতী স্পার্টা নগরে লিয়নিডাস নামে রাজা ছিলেন। তিনি ঐ নগরের ক্লিযম্ব্রোটস্ নামক এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সহিত খিলোনিস্ নাম্নী সর্ব্বগুণসম্পন্ন স্বীয় তনয়ার বিবাহ দেন। খিলোনিস্, পিতা ও পতি উভয়ের প্রতি এরূপ ভক্তিমতী ও স্নেহশালিনী ছিলেন যে, আবশ্যক হইলে, তাঁহাদের জন্য অকাতরে প্রাণত্যাগ করিতে পারিতেন, এবং তাঁরাও উভযে, তদীয় প্রশংসনীয় গুণগ্রাম দর্শনে সাতিশয় প্রীত ছিলেন, এবং তাঁহাকে আপন আপন প্রাণ অপেক্ষা অধিক ভাল বাসিতেন।

 ক্লিয়ম্ব্রোটস্, শ্বশুরকে রাজ্যচ্যুত করিয়া, স্বয়ং রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইবার অভিলাষে, চক্রান্ত করিলেন। লিয়নিডাস্, চক্রান্তের সন্ধান পাইয়া, এবং জামাতার অভিসন্ধি কতদূর পর্য্যন্ত, তাহার নিশ্চিত সংবাদ জানিতে না পারিয়া, প্রাণবিনাশশঙ্কায় এক দেবালয়ের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। পূর্ব্বকালীন গ্রীকদিগের এই রীতি ছিল, যদি কোনও ব্যক্তি প্রাণভয়ে পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ কবিত, সে উৎকট অপরাধ করিলেও, যতক্ষণ দেবালয়ের সীমার মধ্যে থাকিত, তাঁহারা তাহার বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হইতেন না।

 খিলোনিস, পিতার এই অতর্কিত বিপৎপাতের বিষয় সবিশেষ অবগত হইযা, শোকে ম্রিয়মাণ হইলেন, এবং পতিসমীপে উপস্থিত হইযা কৃতাঞ্জলিপুটে বলিতে লাগিলেন, কেন তুমি এরূপ অপকর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছ, ইহাতে অধর্ম্ম, অপযশ ও পরিণামে নানা অনর্থ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। অতএব আমার কথা শুন, এ অধ্যবসায় হইতে বিরত হও। যদি তুমি আমার অনুরোধরক্ষা না কর, আমি তোমার সমক্ষে আত্মঘাতিনী হইব। আমি জীবিত থাকিয়া, পিতার দুরবস্থা দর্শন করিতে পারিব না।

 এই বলিয়া, পতির চরণে পতিত হইয়া, খিলোনিস্ অবিশ্রান্ত অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। ক্লিয়ম্ব্রোটস্, দুরাকাঙক্ষার আতিশয্যবশতঃ, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া বলিলেন, কেন তুমি আমায় বিরক্ত করিতেছ। তুমি আমার প্রেয়সী, আমি তোমায় প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসি, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমি তোমার অনুরোধরক্ষা করিতে পারিব না। তুমি স্ত্রীজাতি, রাজনীতির মর্ম্ম কি বুঝিবে, এরূপ বিষয়ে তোমাব হস্তার্পণ করা উচিত নহে। খিলোনিস্, এইরূপে হতাদর হইয়া, আপন আবাসগৃহে প্রতিগমন করিলেন, এবং পিতার নিমিত্ত নিতান্ত আকুলচিত্ত হইয়া, স্বামিসহবাসসুখে বিসর্জ্জন দিয়া, পিতৃসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। সেই অবস্থায় পিতাকে যত দূর সুখে ও স্বচ্ছন্দে রাখিতে পারা যায়, তিনি প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, তদীয় সন্নিধান, পরিচর্য্যা ও সান্ত্বনাবাদ দ্বারা, লিয়নিডাসের দুঃখ ও শোকের অনেক লাঘব হইযাছিল।

 কিয়ৎ দিন পরে, লিয়নিডাসের অবস্থার পরিবর্ত্ত হইল। তিনি পুনরায় রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। তদ্দর্শনে খিলোনিস্, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া পতিগৃহে প্রতিগমন করিলেন, এবং পতির অগোচরে ও অসম্মতিতে পিতৃসন্নিধানে গমন করিয়াছিলেন, তৎপ্রযুক্ত তাঁহার নিকট যে অপরাধিনী হইয়াছিলেন, তজ্জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করিলেন। তিনি, তদীয় বিনয় ও আত্মীয়বর্গের অনুরোধের বশীভূত হইয়া, অবশেষে তাহাঁর অপরাধ-মার্জ্জনা করিলেন।

 জামাতা যে অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, লিয়নিডাস্ তাহা বিস্মৃত হইতে পারিলেন না, সুতরাং তিনি বৈরনির্য্যাতনে উদ্‌যুক্ত হইলেন। তখন ক্লিয়ম্ব্রোটস্‌কে প্রাণবিনাশশঙ্কায়, দেবালয়ের আশ্রয় লইতে হইল। তদ্দর্শনে খিলোনিস, শোকাকুল হইয়া, দুই শিশুসন্তান সমভিব্যাহারে লইয়া পতিসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন, এবং সমদুঃখভাগিনী হইয়া দিনযাপন করিতে লাগিলেন।

 কতিপয় দিবস অতীত হইলে, লিয়নিডাস কিয়ৎসংখ্যক সৈন্য সমভিব্যাহারে লইয়া, সেই দেবালযের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, দেখিলেন, তাঁহার তনয়া ধূলিধূসরিত কলেবরে স্বামীর পার্শ্বদেশে আসীন হইযা, বিষন্নবদনে রোদন কবিতেছেন, দুটি শিশু সন্তান, জননীর বিষাদ ও রোদন দর্শনে নিতান্ত আকুল হইয়া, বিরসবদনে ও নিস্পন্দনয়নে তাঁহার মুখনিরীক্ষণ করিয়া রহিয়াছে।

 যতগুলি লোক সেই স্থলে উপস্থিত ছিলেন, এই শোচনীয় ব্যাপার দর্শনে, সকলেরই হৃদয় দ্রবীভূত হইল, অনেকেরই নয়ন হইতে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল, এবং সকলেই রাজকন্যার পতিপরায়ণতাগুণের একশেষ দর্শনে মোহিত হইয়া, মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদপ্রদান করিতে লাগিলেন। লিয়নিডাস, জামাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, অরে দুরাত্মন, আমি যে তোকে কন্যাদান করিয়াছিলাম, তাহাতেই শ্লাঘাজ্ঞান করিয়া, তোর চরিতার্থ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তুই এমন দুরাশয় যে, দুর্বুদ্ধির অধীন হইয়া আমার নির্বাসনে ও রাজ্যাপহরণে উদ্যত হইয়াছিলি। এক্ষণে তোরে তাহার প্রতিফল প্রদান করিব।

 ক্লিয়ম্ব্রোটস বাস্তবিক অপরাধী। শ্বশুরের তিরস্কারবাক্যশ্রবণে, অধোবদনে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, উত্তরপ্রদান করিতে পারিলেন না।

 অনন্তর লিয়নিডাস, স্বীয় তনয়াকে সম্বোধন ও সস্নেহ সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, বৎসে, তুমি আমার আবাসে চল, এ নরাধমের নিমিত্ত শোকাকুল হইয়া বিলাপ, পরিতাপ ও ক্লেশভোগ করিতেছ কেন? তখন খিলোনিস্ বলিলেন, তাত, আপনি আমায় যে শোকে আকুল দেখিতেছেন, আমার স্বামীর দুরবস্থাই তাহাব আদিকারণ নহে। ইতঃপূর্ব্বে আপনার যে বিপদ ঘটিয়াছিল, সেই অবধি উহার সূত্রপাত হইযাছে, এবং সেই অবধি এ পর্য্যন্ত আমার সহচর হইয়া রহিয়াছে। আপনি বিপক্ষ জয় করিয়া, পুনরায় বাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, ইহা আমার পক্ষে মহোৎসবের এক প্রধান কারণ বটে, কিন্তু আপনি আমায় যাহার হস্তে সমর্পিত কবিয়াছেন, এবং যাঁহাব সহচরী হইয়া আমায় যাবজ্জীবন কালহরণ কবিতে হইবে, যখন সে ব্যক্তি আপনার কোপদৃষ্টিতে পতিত হইয়াছেন, এবং অবশেষে তাঁহার কি অবস্থা ঘটিবে তাহার স্থিরতা নাই, তখন আমি কিরূপে উৎসবে কালহরণ করিতে পারি? যদি আমার প্রতি আপনার স্নেহ থাকে, এবং আমারে চিরদুঃখিনী করা অভিপ্রেত না হয়, কৃপা করিয়া উঁহার অপরাধ মার্জ্জনা করুন।

 কন্যার এই প্রার্থনা শুনিয়া, লিয়নিডাস বলিলেন, বৎসে, আমি তোমায় আপন প্রাণ অপেক্ষা অধিক ভালবাসি, এবং তোমার অনুরোধে সকল কর্ম্ম করিতে পারি। কিন্তু, এই দুরাত্মা আমার যেরূপ বিদ্রোহাচরণে উদ্যত হইয়াছিল, তাহাতে আমি কখনও উহার উপর অক্রোধ হইতে পারি না। বোধহয়, উহার শোণিত দর্শন না করিলে আমার কোপশান্তি হইবে না। তখন খিলোনিস্ বলিলেন, তাত, আপনি ইহা স্থির সিদ্ধান্ত জানিবেন, আমি জীবিত থাকিয়া, কখনই উঁহার প্রাণদণ্ড দেখিতে পারিব না। যখন উঁহার প্রাণবধ অবধারিত জানিতে পারিব, তখন অগ্রে আমি আত্মঘাতিনী হইব। যাহা হউক, যখন উনি আপনার বিদ্রোহাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, আমি উঁহাকে অতিশয় দুরাচার ও অধার্ম্মিক বোধ করিযাছিলাম। কিন্তু, এখন আমি উঁহারে আর সেরূপ বোধ করিতেছি না, কারণ, আমি স্পষ্ট দেখিতেছি, রাজ্যভোগ মনুষ্যের এত প্রার্থনীয় বিষয় যে, তাহার জন্য ধর্ম্মাধর্ম্মবোধ, উচিতানুচিতবিবেচনা ও হিতাহিতবিবেক থাকে না। আপনি যে রাজ্যভোগের নিমিত্ত তনয়াকে অনাথা ও চিরদুঃখিনী করিতে উদ্যত হইয়াছেন, উনিও সেই রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, তাদৃশ অসদাচরণে দুষিত হইয়াছিলেন।

 এই বলিয়া, খিলোনিস্ কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, অনন্তর বাষ্পাকুললোচনে কাতরবচনে সম্বোধন করিয়া, পিতাকে বলিতে লাগিলেন, তাত, আমি বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, আমার মত হতভাগা ও পাপীয়সী ভূমণ্ডলে আর নাই। পিতা ও পতির নিকট যেরূপ অবমানিত হইলাম, তাহাতে আর আমার প্রাণধারণে কোনও ফল নাই। পিতা ও পতি উভয়েই যাহার প্রতি সমান বিগুণ, তাহার প্রাণধারণ বৃথা, এই দণ্ডে প্রাণবিয়োগ হইলে, আমার সকল যন্ত্রণার শেষ হয়। এই বলিয়া, স্বামীর গলদেশে হস্তাৰ্পণ করিযা খিলোনিস্ অনর্গল অশ্রুবিসৰ্জ্জন করিতে লাগিলেন।

 লিয়নিডাস্, পূর্ব্বাপর সমস্ত শ্রবণ ও অবলোকন পূর্ব্বক, কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, অনন্তর সন্নিহিত আত্মীয়বর্গের সহিত পরামর্শ করিয়া, ক্লিয়ম্ব্রোটসকে বলিলেন, অবে দুরাত্মন, আমি কেবল কন্যার অনুবোধে তোর প্রাণবধে ক্ষান্ত হইলাম। কিন্তু, তোকে আর আমার অধিকারে থাকিতে দিব না। আমি আদেশ দিতেছি, তুই এই দণ্ডে স্পার্টা হইতে প্রস্থান কর্। অনন্তব তিনি তনয়াকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, বৎসে, আমি কেবল তোমার অনুরোধে এই নরাধমের প্রাণবধ করিলাম না। এক্ষণে শোক পরিত্যাগ করিয়া আমার সঙ্গে আবাসে আইস, তোমায় উহার সমভিব্যাহারিণী হইতে হইবে না। এ বিষয়ে আমি তোমার প্রতি যেরূপ স্নেহ ও দয়া প্রদর্শিত করিলাম, তাহাতে তোমার আমায় পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া উচিত নহে।

 লিয়নিডাসের অনুরোধ ফলদায়ক হইল না। ক্লিয়ম্ব্রোটস্ উত্থিত ও দণ্ডায়মান হইলে, খিলোনিস্ জ্যেষ্ঠ সন্তানটিকে তাঁহার হস্তে দিলেন, এবং কনিষ্ঠটিকে স্বয়ং ক্রোড়ে লইয়া, পিতার চরণবন্দনাপূর্ব্বক পতিসমভিব্যাহারে নির্বাসনে প্রস্থান করিলেন।