আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/দয়া, সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা

উইকিসংকলন থেকে


দয়া, সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা

জোসেফ্ নামে এক কাফরি, বাববেডো নগরে, বাস করিতেন। তাঁহার কিছু অর্থ-সংস্থান ও সামান্যরূপ একটি দোকান ছিল। ঐ দোকানে ক্রয় বিক্রয় দ্বারা, তিনি যাহা পাইতেন, তাহাতে তাঁহার স্বচ্ছন্দে জীবিকানির্ব্বাহ হইত। জোসেফ্ অতি সজ্জন, ধর্ম্মশীল ও পরোপকারী ছিলেন। সেই নগরে অনেক দোকান ছিল; কিন্তু তাঁহার দোকান সর্বক্ষণ, খরিদদারগণে পরিপুর্ণ থাকিত, যদি কেহ কোনও দ্রব্য খুঁজিযা না পাইত, জোসেফ্ পরিশ্রম ও অনুসন্ধান করিয়া, সে দ্রব্যের যোগাড় করিযা দিতেন। বস্তুত, সচ্চরিত্র ও পরোপকারী বলিযা, তিনি সর্ব্ববিধ লোকের নিকট, সাতিশয আদিরণীয় ও মাননীয় ছিলেন।

 ১৮৮৫ খৃঃ অব্দে আগুন লাগিয়া, ঐ নগবের অধিকাংশ ভস্মসাৎ হইয়া যায, এবং অনেক অধিবাসীর সর্ব্বস্বান্ত হয়। জোসেফ্, যে অংশে বাস করিতেন, কেবল ঐ অংশে কোনও অনিষ্ট ঘটে নাই। যাহাদের সর্ব্বস্বান্ত লইয়াছিল, জোসেফ্ যথাশক্তি, তাহাদের সাহায্য করিতে লাগিলেন। তিনি প্রথম অবস্থায় কোনও পরিবারের নিকট উপকৃত হইয়াছিলেন। ঐ পরিবারেরও এক ব্যক্তির এই উপলক্ষে, সর্বস্বান্ত ঘটে। এ ব্যক্তি বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন ছিলেন, কিন্তু সাতিশয় দানশীলতা দ্বারা, অগ্নিদাহের পূর্ব্বেই, নিতান্ত নিঃস্ব হইযা পড়েন, পরে যে কিছু অবশিষ্ট ছিল, এই অগ্নিদাহে, সে সমস্তই নষ্ট হইয়া যায়। ইহার দুরবস্থা দর্শনে, জোসেফের অন্তঃকবণে নিরতিশয় দযার সঞ্চাব হইল। ইনি অতিশয় দানশীল ও পরোপকারী ছিলেন, এবং ইনি যে পরিবারের লোক, জোসেফ্ এক সমযে, ঐ পরিবাবের নিকট উপকার প্রাপ্ত হইযাছিলেন, এই দুই কাবণে, ঈদৃশ দুঃসমযে ইহার আনুকুল্য কবিবার নিমিত্ত, জোসেফেব নিতান্ত ইচ্ছা হইল।

 কিছু দিন পূর্ব্বে, এই ব্যক্তি খত লিখি দিয়া, জোসেফেব নিকট হইতে, ৬০০৲ ছয শত টাকা, ধার লইয়াছিলেন। জোসেফ্ ভাবিলেন, এ ব্যক্তির সর্ব্বস্বান্ত হইযাছে, তাহার উপর আবার ঋণদায়, কিরূপে এ ঋণের পবিশোধ করিবেন এই দুর্ভাবনায, ইহাকে অতিশয় অসুখে কালযাপন করিতে হইবে। এ অবস্থায়, ঋণ হইতে নিষ্কৃতি পাইলে, ইনি, অনেক অংশে নিশ্চিন্ত হইতে পারিবেন। এতএব, অদ্যই আমি ইঁহাকে ঋণ হইতে মুক্ত করিব। এরূপ করিলে, আমি এই পরিবারের নিকট যে উপকার প্রাপ্ত ইয়াছি, কিয়ৎ অংশে, তজ্জন্য কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শন করা হইবে।

 এই স্থির করিযা, জোসেফ্ ঐ ব্যক্তির নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং যথোচিত বিনয় ও সম্মান সহকারে, সম্ভাষণ করিযা, বলিলেন, মহাশয, এই অগ্নিদাহে আপনকাব যে ভয়ানক অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা দেখিয়া, আমার অন্তঃকবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখ উপস্থিত হইযাছে, এবং, এই সময়ে আমি আপনকাব পরিবারের নিকট যে উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাও আমার অন্তুকরণে সর্ব্বক্ষণ জাগরূক রহিয়াছে। আর আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি, আপনকাব যে ঋণ আছে, কি রূপে তাহার পরিশোধ কবিবেন, এই দুর্ভাবনায়, অত্যন্ত অসুখে কালযাপন করিতে হইবে। আমার নিকটে আপনকার যে ঋণ আছে, সে জন্য আর আপনকার চিন্তিত হইবার প্রয়োজন নাই। আমি, আহলাদিত চিত্তে, আপনাকে ঋণমুক্ত করিতেছি? বিপদাপন্ন ব্যক্তিব সাহায্য করা মনুষ্যমাত্রের আবশ্যকর্তব্য, বিশেষতঃ আমি আপনাদের নিকট যথেষ্ট উপকৃত হইয়াছি, তজ্জন্য, কার্য্য দ্বারা কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শন করা, আমার পক্ষে সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক। আমি আপনকার এ অবস্থায়, কিঞ্চিৎ অংশেও যে, সাহায্য করিতে পারিলাম, ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের অবসর পাইলাম, তাহাই, আমি প্রচুর লাভ মনে করিতেছি। আপনাকার নিকট হইতে প্রাপ্য, টাকা পাইলে, আমি যত আহলাদিত হইতাম, আপনাকে নিষ্কৃতি দিয়া, আমি তদপেক্ষা সহস্রগুণে অধিক আহলাদিত হইলাম। এক্ষণে, আপনকার নিকট, বিনয়বচনে আমার প্রার্থনা এই, আম দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে, যদি কখনও আপনকার এরূপ কোনও প্রযোজন উপস্থিত হয, অনুগ্রহপূর্ব্বক জানাইলে, আমি চবিতার্থ হইব।

 এইরূপ বলিযা, জোসেফ্ তাঁহার লিখিত খতখানি সন্নিহিত জ্বলন্ত অনলে নিক্ষিপ্ত কবিলেন। জোসেফেব দয়া ও সৌজন্য দর্শনে চমৎকৃত হইযা, তিনি তাঁহাকে ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎ দিন পরে, এই ব্যক্তি, অল্প বেতনে, কোনও কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন, এবং তাহাতেই কোনও রূপে, দিনপাত কবিতে লাগিলেন। সচ্ছল অবস্থায, তিনি অনেকের আনুকূল্য কবিতেন, এবং আত্মীয়, স্বজন প্রভৃতিকে মধ্যে মধ্যে আহার করাইতেন। আয়ের খৰ্বতা বশতঃ এক্ষণে সেরূপে চলা তাঁহার ক্ষমতার বহির্ভূত; কিন্তু এরূপ কবিতে না পারিলে, তাঁহার অসুখের সীমা থাকিত না। আত্মীযেরা, অথবা অন্যবিধ লোকে, তাঁহার আলয়ে আহার করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, তিনি অস্বীকার করিতে পারিতেন না, তাঁহারা উপস্থিত হইলে, তদীয় ভৃত্য, জোসেফের নিকটে গিয়া, এই বৃত্তান্ত জানাইত। জোসেফ্ তৎক্ষণাৎ আবশ্যক আহারসামগ্রী পাঠাইযা দিতেন। এইরূপ, তাঁহার যখন যাহা অবশ্যক হইত, জোসেফ, আহলাদিতচিত্তে, তাহার সমাধান কবি দিতেন।