বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/পিতৃভক্তি ও ভ্রাতৃবাৎসল্য

উইকিসংকলন থেকে

পিতৃভক্তি ও ভ্রাতৃবাৎসল্য

ইংলও দেশে গ্লেন্‌বিল্‌ নামে এক বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে স্বীয় সম্পত্তির অধিকারী করিবেন স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি শুনিতে পাইলেন এবং অবশেষে অবধারিত জানিতে পারিলেন, জ্যেষ্ঠ পুত্র দুশ্চরিত্র হইয়াছেন। তখন তিনি এই বিবেচনা করিলেন, এরূপ দুশ্চরিত্রকে বিষয়ের অধিকারী করা কোনও মতে উচিত হইতেছে না, করিলে, অল্প দিনের মধ্যে সমস্ত বিষয় নষ্ট হইবে। এজন্য তিনি স্থির করিলেন, কোনও আত্মীয় দ্বারা জ্যেষ্ঠ পুত্রকে একবার সতর্ক করা আবশ্যক। তদনুসারে এক আত্মীয় তদীয় জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বলিলেন, তোমার পিতা তোমায় সমস্ত বিষয়ের অধিকারী করিবেন মনস্থ করিয়াছিলেন। কিন্তু তোমার চরিত্রদোষ দর্শনে, এক্ষণে আর তাঁহার সেরূপ অভিপ্রায় নাই। যদি অল্প দিনের মধ্যে তোমার চরিত্রে সংশোধন না হয়, তাহা হইলে তিনি তোমায় বিষয়ের অধিকারী করিবেন না। অতএব যাহাতে তোমার চরিত্র অবিলম্বে সংশোধিত হয়, সে বিষয়ে বিশেষ সচেষ্ট ও যত্নবান্ হও, নতুবা বিষযপ্রাপ্তির আশায় বিসৰ্জ্জন দাও।

 এইরূপে সতর্ক করিলেও তাহার চবিত্রের সংশোধন হইল না। তখন গ্লেন্‌বিল্‌, কনিষ্ঠ পুত্রকে সমস্ত বিষয়ের অধিকারী করিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, পিতা তাঁহাকেই বিষয়ের অধিকারী করিবেন, চরিত্রের সংশোধন না হইলে, তিনি তাহা করিবেন না, ইহা কেবল ভয়প্রদর্শন মাত্র। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তিনি জানিতে পারিলেন, পিতা কনিষ্ঠ পুত্রকে সমস্ত বিষয়ের অধিকারী করিয়া গিয়াছেন। তখন তাঁহার অন্তঃকরণে যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ ও অনুতাপ উপস্থিত হইল। তিনি বিবেচনা করিতে লাগিলেন, যদি আমি অসৎপথবর্ত্তী না হইতাম, সমস্ত পৈতৃক ধনেব অধিকারী হইয়া পরম সুখে কালযাপন করিতে পারিতাম। পিতা আমায় সতর্ক করিয়াছিলেন, তথাপি আমার জ্ঞানের উদয় হইল না। আমি পিতৃধনে বঞ্চিত হইয়াছি, ইহাতে আর কাহারও দোষ নাই, আমারই সম্পূর্ণ দোষ। এইরূপে তাঁহার জ্ঞানের উদয় হওয়াতে, অল্প দিনের মধ্যেই তদীয় চরিত্র সম্পূর্ণরূপে সংশোধিত হইল।

 কনিষ্ঠ সাতিশয় পিতৃভক্ত ও নিরতিশয় ভ্রাতৃবৎসল ছিলেন। জ্যেষ্ঠ, চবিত্রদোষবশতঃ পৈতৃক সম্পত্তিতে বঞ্চিত হইয়াছেন, এবং তজ্জন্য অতিশয় মনস্তাপ পাইয়াছেন, ইহা দেখিয়া, তিনি যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়াছিলেন, জ্যেষ্ঠ বঞ্চিত হওয়াতে, তিনি সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হইয়াছেন, ইহাতে কিছুমাত্র সুখী ও আহ্লাদিত হয়েন নাই। অনন্তর যখন দেখিলেন, জ্যেষ্ঠের চরিত্র সম্পূর্ণরূপে সংশোধিত হইয়াছে, তখন তাঁহার দুঃখের সীমা রহিল না। তিনি এই বিবেচনা করিতে লাগিলেন, যদি পিতার জীবদ্দশায় ইঁহাব চরিত্রের এরূপ সংশোধন হইত; অথবা পিতা এখন পর্য্যন্ত জীবিত থাকিতেন, এবং ইঁহার চরিত্র সংশোধিত হইয়াছে দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে তিনি নিঃসন্দেহ ইঁহাকে সমস্ত বিষয়ের অধিকারী করিতেন। ইঁহাকে সমস্ত বিষয়ে অধিকারী করা তাঁহাব নিতান্ত বাসনা ছিল। সেই চিরন্তন বাসনা পূর্ণ না হওয়াতে, তিনি নিরতিশয় দুঃখিত হৃদয়ে দেহত্যাগ করিয়াছেন, সে বিষয়ে অণুমাত্র সংশয় নাই। অতএব যাহাতে ইঁহাব মনোদুঃখ দূরীভূত ও পিতার মনস্কাম পূর্ণ হইতে পারে, এরূপ কোনও ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সর্ব্বতোভাবে উচিত ও আবশ্যক।

 এইরূপ আলোচনা করিয়া, একদিন কনিষ্ঠ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও কতিপয় আত্মীয়কে আহার করাইবার উদ্যোগ করিলেন। সকলের আহার সমাপ্ত হইলে, জ্যেষ্ঠের সম্মুখে একটি পাত্র স্থাপিত হইল। তিনি মনে করিলেন, আর কোনও আহারদ্রব্য উপস্থিত হইল। পাত্রের আবরণ অপসারিত করিয়া, তিনি তাহাতে আহারদ্রব্যের পবিবর্ত্তে একখানি কাগজ দেখিতে পাইলেন। উপস্থিত আত্মীয়বর্গ কৌতুহল-পরতস্ত্র হইয়া, ঐ কাগজখানি পড়িতে আরম্ভ করিলেন। পাঠ সমাপ্ত হইলে, সকলে সাতিশয় চমৎকৃত ও মোহিত হইয়া, আন্তরিক ভক্তি ও অনুরাগ সহকারে কনিষ্ঠকে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।

 ঐ কাগজখানি দানপত্র। উহার মর্ম্ম এই—পিতৃদেব আমার জ্যেষ্ঠকে স্বীয় সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী করিবেন, এই সংকল্প করিয়াছিলেন। জ্যেষ্ঠের চরিত্রদোষ দর্শনে অসন্তুষ্ট হইয়া, তিনি এক আত্মীয় দ্বারা তাঁহাকে জানাইলেন, চরিত্র সংশোধিত না হইলে, তিনি তাঁহাকে বিষয়ের অধিকারী করিবেন না। দুর্ভাগ্যক্রমে পিতৃদেবের জীবদ্দশায় তদীয় চরিত্র সংশোধিত হয় নাই। এজন্য তিনি মৃত্যুর পূর্ব্বে আমায় স্বীয় সম্পত্তির অধিকারী করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে জ্যেষ্ঠের চরিত্র সম্পূর্ণরূপে সংশোধিত হইয়াছে। যদি পিতৃদেব এখন পর্যন্ত জীবিত থাকিতেন, জ্যেষ্ঠকে সমস্ত বিষয়ের অধিকারী করিতেন, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। স্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে, পৈতৃক বিষয়ে বঞ্চিত হইয়া, জ্যেষ্ঠ মর্মান্তিক বেদনা পাইয়াছেন, এবং জনসমাজে নিরতিশয় অনাদরণীয় ও উপহাসাম্পদ হইয়াছেন। অতএব, পিতৃদেবের অভিপ্রায়সম্পাদন ও জ্যেষ্ঠের মনোবেদনা নিবারণের নিমিত্ত পিতৃদত্ত সমস্ত সম্পত্তি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, আহ্লাদিত চিত্তে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে দিলাম। অদ্য অবধি তিনি পৈতৃক সমস্ত সম্পত্তির সম্পূর্ণ অধিকারী হইলেন।

 সংসারে এরূপ নিঃস্পৃহ, এরূপ পিতৃভক্ত, এরূপ ভ্রাতৃবৎসল নিতান্ত বিরল।


সম্পূর্ণ