বিষয়বস্তুতে চলুন

আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১০

উইকিসংকলন থেকে

১০

বঙ্গীয় যুবক-সম্প্রদায়ের

ভবিষ্যৎ জীবিকা-অর্জ্জন।[]

(সমস্যা)

 বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও উপাধিধারীর সংখ্যা দেখিয়া আমরা সময়ে সময়ে ভয় পাই। অবশ্য বাঙ্গালা দেশেই পাশ্চাত্য শিক্ষার উন্নতি বহুল পরিমাণ হইয়াছে। কিন্তু আট কোটি জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়, এমন কি হিসাবে নগণ্য বলা যায়। কিন্তু বাঙ্গালী জাতি বিদ্যা শিক্ষার জন্য যে প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করিতেছে তাহাতে বোধ হয় ক্রমশঃই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িতে থাকিবে। ইংলণ্ড, আমেরিকা, জার্ম্মেণী, জাপান প্রভৃতি দেশে আপামর সাধারণ মধ্যে যে প্রকার শিক্ষা বিস্তার হইয়াছে ও হইতেছে সে তুলনায় আমরা কোথায় পড়িয়া আছি তাহার স্থিরতাই হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ইতিমধ্যে এ প্রকার হাহাকার পড়িয়াছে কেন? প্রকৃত পক্ষে দেখিতে গেলে আমাদের বিদ্যাশিক্ষার অন্তরালে শিক্ষালাভ ব্যতীত আর একটী গূঢ় উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করিতেছে দেখিতে পাওয়া যায়। ইংরাজ রাজত্বের প্রারম্ভ হইতেই, এমন কি যখন নবাবী আমলে পার্শী স্বাজভাষা বলিয়া পরিগণিত হইত তখন হইতেই কেবল চাকুরী করা বা ওকালতি পেশা অবলম্বন করাই বাঙ্গালীর বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশ্য হইয়া রহিয়াছে। এ দেশে ইংরাজী শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য এই ছিল যে সহজে চাকরী জুটাইব। মহাত্ম| রাজনারায়ণ বসুর “সেকাল আর একালে” এ সম্বন্ধে অনেকগুলি কৌতুকাবহ কাহিনী আছে। একস্থানে তিনি বলিতেছেন,—“ইংরাজদের যে সকল সরকার থাকিত, তাহাদের ভাষা ও কথোপকথন আরো চমৎকার ছিল। একজন সাহেব তাঁহার সরকারের উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। সরকার বলিল—মাষ্টার ক্যান্ লিব, মাষ্টার ক্যান ডাই। (Master can live, master can die) অর্থাৎ মনিব আমাকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারেন, অথবা মারিয়া ফেলিতে পারেন। সাহেব, “What, master can die?” এই কথা বলিয়া সরকারকে মারিবার জন্য লাঠি উঠাইলেন। সরকারের তখন মনে পড়িল, “ডাই”—শব্দের অন্য অর্থ আছে, তখন “ষ্টাপ্ দেয়ার” (stop there) অর্থাৎ প্রহার করিতে লাঠি উঠাইও না, এই বলিয়া হাত উঁচু করিল, তৎপরে অঙ্গুলি দ্বারা আপনাকে দেখাইয়া বলিল, “ডাই মি” (Die me) অর্থাৎ আমাকে মারিয়া ফেলিতে পারেন “ইফ মাষ্টার ডাই, দেন আই ডাই, মাই কো ডাই, মাই ব্ল্যাক্ ষ্টোন্ ডাই, মাই ফোরটিন জেনারেশান ডাই।” “If master die, then I die, my cow die, my blackstone die, my fourteen generation die.” “যদ্যপি মনিব মারেন, তবে আমি মরিব আমার ‘কো’ অর্থাৎ গরু মরিবে, আমার ‘ব্ল্যাক্‌ষ্টোন্’ অর্থাৎ বাড়ীর শালগ্রাম ঠাকুর মরিবেন, আমার ‘ফোরটিন জেনারেশান’ অর্থাৎ চৌদ্দ পুরুষ মরিবে।” একবার রথের দিবস এক সরকার কামাই করে। পরদিন সে আসিলে, সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল কেন আইস নাই?” সরকার রথের ব্যাপার কিরূপে বুঝাইবে ভাবিয়া আকুল। শেষে বলিয়া উঠিল, “চর্চ্চ” (church)। রথের আকার গির্জার মত, তাই এই কথাটী বুঝাইবার পক্ষে বড় উপায় হইল। কিন্তু “চর্চ্চ” বলিলে ইটের গাঁথুনি বুঝায়, এ জন্য পরক্ষণেই বলা হইল, “উডেন্ চর্চ্চ” অর্থাৎ কাষ্ঠের গির্জা। তাহা হইলেও বুঝা গেল না; তখন তাহাকে আরে। ব্যাখ্যা করিতে হইল—“থি, ষ্টারিস্ হাই”। “Three stories high” “গাড আল্‌মাইটী সিট আপন” (God Almighty sit upon) অর্থাৎ জগন্নাথদেব বসিয়া আছেন, “লাং লাং রোপ” (Long long rope) “থৌজণ্ড মেন ক্যাচ” (Thousand men catch), “পুল, পুল, পুল” (Pull, pull, pull) “রনাওয়ে, রনাওয়ে” (Run away, Run away), “হরি হরি বোল হরি হরি বোল।”[]

 এই তো গেল ইংরাজ রাজত্বের প্রথম আমলের কথা। তাহার পর যখন ডেপুটী কালেক্টরী, মুন্সেফী প্রভৃতি পদের সৃষ্টি হইল ও সেক্রেটেরিয়টের অল্পাধিক বেতনের কেরাণীগিরির জন্ম হইল, তখন দশ পনরো বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিলাভের এক চরম উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইল শীঘ্র শীঘ্র পাশ করিয়া এই সকল পদলাভ করা। কাজেই আমাদের সমাজের এক সংস্কার জন্মিল যে ইংরাজী লেখাপড়া শিক্ষা করিলেই চাকুরী করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করা সহজ হইবে। কিন্তু একথা কেহ তলাইয়া দেখিল না যে অজস্র চাকুরীর সৃষ্টি কদিন চলিবে? আমাদের দেশে বহুকাল হইতেই একটী সারবান্ বচন চলিয়া আসিতেছে,—

“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ তদর্দ্ধং কৃষি কর্ম্মণি।
তদর্দ্ধং রাজসেবায়াং ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ॥

 নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার কলিকাত। অবরোধের পর ইংরাজদিগের সহিত যে সন্ধি স্থাপিত হয় তাহার অন্যান্য সর্ত্তের মধ্যে একটা সর্ত্ত এই ছিল যে সিরাজ ব্যবসায়ের ক্ষতিপূরণস্বরূপ শুধু আর্ম্মেণীয় বণিকদিগকে সাত লক্ষ টাকা দিবেন।[] ইহাতেই বুঝা যায় যে গোবিন্দপুর, সুতানুটী ও কলিকাতা এই তিন খানি গ্রাম ইজারা লইবার পর হইতে ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র কলিকাতায় বাণিজ্য ব্যাপার কি প্রকার বিপুল হইয়া উঠিয়াছিল। বলা বাহুল্য আর্ম্মেণীয়দের প্রাপ্ত সাত লক্ষ টাকা এখনকার ক্রয় বিক্রয়ের মূল্যানুসারে (purchase value) অন্ততঃপক্ষে পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার সমান হইবে। তাহার পর এই দেড় শত বৎসরের মধ্যে সমগ্র ভারতের আমদানী ও রপ্তানী একত্র করিলে প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকায় পরিণত হয়। এই বিশাল বাণিজ্য-ব্যাপারে কয় জন বাঙ্গালী সওদাগর সংশ্লিষ্ট আছেন? আমাদের দেশ হইতে যে সমস্ত শস্য সামগ্রী (কাঁচা মাল) রপ্তানী হয় তাহার সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র বাঙ্গালীর হাতে। কিন্তু তাহাও তেলী, তামলী, সাহা, গন্ধবণিক প্রভৃতি শ্রেণীর করায়ত্ত হইয়া রহিয়াছে। যদি এই সকল শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট শিক্ষার বিস্তার থাকিত তাহা হইলে আমাদের কিছুমাত্র ক্ষোভের কারণ থাকিত না। কিন্তু তাহা না থাকায় ইউরোপীয় বণিকগণ ব্যবসায় চালাইবার যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া থাকেন ইঁহারা তাহার কোনই খবর রাখেন না। সত্য বটে ইংরাজ আমলের প্রারম্ভে, এমন কি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাঙ্গালীর সহায়তা ব্যতীত ইউরোপীয় সওদাগরগণ (for want of local knowledge) তাহাদের কার্য্য-সিদ্ধি করিতে পারিতেন না; এই জন্যই রামদুলাল দে, মতিলাল শীল প্রভৃতি ক্রোড়পতি হইয়াছিলেন, এবং অপর অনেক অনেক বাঙ্গালী হৌসের মুৎসুদ্দি হইয়া বিপুল অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিয়াছিলেন। প্রায় সত্তর বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গালী যে বাণিজ্য ব্যাপারে শীর্ষস্থান অধিকার করিবে ইহার সূত্রপাত হইয়াছিল।[] কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ইহাদের উত্তরাধিকারীগণ প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হইয়া ভোগ-বিলাসে রত হইয়া ভবিষ্যতে বাণিজ্যব্যাপারে দাঁড়াইবার স্থান পাইলেন না। বাণিজ্য ও ব্যবসায় যেন বাঙ্গালীর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু বাঙ্গালীর অনুপযুক্ততার জন্য বাণিজ্য বসিয়া থাকিবার নয়; প্রকৃতি চিরদিনই শূন্যতার বিরোধী। (Nature abhors vacuum). বাঙ্গালীর বাণিজ্যে অনভিজ্ঞতা ও বাণিজ্যবিমুখতা দেখিয়া মাড়োয়ারী ও উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের লোকেরা বাণিজ্য ক্ষেত্রটী একেবারে দখল করিয়া বসিয়াছে। এই কারণেই ইউরোপীয়গণ, মাড়োয়ারীগণ বাঙ্গালার নগরে নগরে এমন কি গণ্ডগ্রামে পর্য্যন্ত নিজের ব্যবসাক্ষেত্র বিস্তৃত করিয়া ফেলিতেছে। বাণিজ্য দ্বারা কার্য্য-ক্ষেত্র কি প্রকার বিস্তার লাভ করে তাহার একটা মাত্র দৃষ্টান্ত দিতেছি। এই সাড়ে তিন শত কোটী টাকার পণ্য-দ্রব্য বহন করিবার জন্য কতশত বৃহদায়তন ষ্টীমার সমুদ্রবক্ষে বিরাজ করিতেছে। আবার এই সমস্ত ষ্টীমার চালাইবার জন্য কত সহস্র ও লক্ষ নাবিক, কাপ্তেন, ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত রহিয়াছে। আবার এই সমস্ত গড়িবার জন্য গ্লাসগো, লিভারপুল প্রভৃতি নগরে কত বৃহদায়তন ডক্ রহিয়াছে। আর সেখানে সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ মজুর এবং কত বিজ্ঞানবিৎ ইঞ্জিনিয়ার ইহার নক্মা (naval architecture) নির্ম্মাণের জন্য ব্যাপৃত রহিয়াছেন। আমরা যদি এই প্রকারে কর্ম্মোৎসাহ (spirit of enterprise) বাণিজ্য-পটুতা (commercial activity) না হারাইতাম তাহা হইলে আজ আমাদের নদীবক্ষে ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কত শত শত ষ্টীমার চালিত হইত তাহাতে কত বাঙ্গালী কাপ্তেন, ইঞ্জিনিয়রের জীবিকা-নির্ব্বাহ হইতে পারিত! অধিক কথা কি, আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এত বৎসর স্থাপিত হইয়াছে কিন্তু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ চাকুরী ব্যতীত আর কোনও উপজীবিকা খুঁজিয়া পান না। Vide J. G. Cumming’s Report on “Technical and Industrial Instruction in Bengal”, 1888-1908. Part I. of Special Report, page 12.—“The great attraction is the comparative certainty of subsequent official employment. Eight out of every ten students of the Engineering Department find employment under Government, and only one out of ten finds private employment. Mr. Heaton, the Principal, has remarked that this discloses in a startling manner the state of arrested industrial development in Bengal.” এই প্রকারে অন্তর্ব্বাণিজ্য আমাদের হাতছাড়া হইয়া যাওয়ায় আমরা কোটি কোটি টাকা হারাইতেছি। আবার এই সমস্ত ষ্টীমার নির্ম্মাণের জন্য কত mechanical engineerএর প্রয়োজন হইত? আশ্চর্য্যের বিষয় এই, আনুমানিক খ্রীষ্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীর রচিত (১৯২ অব্দে) মৃচ্ছকটিক নাটক পাঠে জানা যায় যে, ইহার নায়ক চারুদত্ত (ব্রাহ্মণ বণিক) ছিলেন। চীন পরিব্রাজক ফা হিয়ানের ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠে জানা যায় যখন তিনি ভারতবর্ষ ও সিংহল হইতে স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন তখন অনেক ব্রাহ্মণ বণিক তাঁহার সহযাত্রী ছিলেন। তাহার পর শ্রীমন্ত সওদাগরের কথা বাঙ্গালা দেশের ঘরে ঘরে প্রচলিত আছে। কিন্তু যেদিন হইতে সমুদ্র যাত্রা ও বিদেশ গমন বন্ধ হইল সেই দিন হইতেই আমরা বাণিজ্য-পটুতা (commercial activity) হারাইয়াছি। বর্ত্তমান সময়ে একবার বেলেঘাটায় গিয়া কি প্রকারের নৌকায় আমাদের অন্তর্ব্বাণিজ্য চালিত হয় আর একবার গঙ্গার ধারে জেটিতে যাইয়া বহির্ব্বাণিজ্য কিরূপে নির্ব্বাহিত হয় তাহা দেখিয়া তুলনায় সমালোচনা করিলে অনেক শিক্ষালাভ করিতে পারা যায়। একদিকে দেড়শত হইতে ‘হাজার মণি নৌকা’ অপরদিকে আট হাজার দশ হাজার হইতে পঞ্চাশ হাজার টন ভারবাহী বিরাট পোত দাঁড়াইয়া আছে। এ উভয়ের মধ্যে তুলনা অসম্ভব হইলেও, শিক্ষালাভ অসম্ভব নহে। প্রথমে সমুদ্রযাত্রা নিষেধ ও তাহার পর জাতিভেদরূপ মহা নিগড়ে যেদিন আমরা নিজেদের হাত-পা বাঁধিয়াছি সেদিন হইতে অনেক ব্যবসায় লোপ পাইয়াছে আর তাহার বিষময় ফল আমরা এখন ভোগ করিতেছি। যতদিন আমরা ইউরোপের সহিত সংঘর্ষণে আসি নাই ততদিন আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পল্লীসমাজ জাতিভেদের বিষময় ফল ভোগ করে নাই। এই পাশ্চাত্য সংঘর্ষণ এত শীঘ্র ঘটিয়াছে যে আমরা উহার ধাক্কা সামলাইয়া উঠিতে পারি নাই। পূর্ব্বে প্রত্যেকটী গ্রাম ক্ষুদ্র সাধারণ তন্ত্রের মত ছিল। প্রত্যেক গ্রামের কামার, কুমার, ধোবা, নাপিত, যজমান, যাজক স্ব স্ব বৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবিকা-নির্ব্বাহ করিয়াছে; কিন্তু এখন অনেক জনাকীর্ণ সহরের সৃষ্টি হইয়াছে সুতরাং সে নিয়ম ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গিয়াছে। এখন কলিকাতায় পয়সা দিলেও খাঁটি দুধ মিলে না, মাছ অগ্নিমূল্য ও দুষ্প্রাপ্য; বর্ষাকালে ধোবার বাড়ী কাপড় দিয়া তিন সপ্তাহ কখনো বা এক মাস হাঁ করিয়া পথ তাকাইয়া থাকিতে হয়। এই হাঁ করিয়া থাকিবার জন্য আমরাই দায়ী, কারণ যেমন অন্যান্য বিষয়ে তেমনি এ বিষয়ে আমরাই নিজেদের অকর্ম্মণ্য করিয়া রাখিয়াছি। পনরো টাকার নকলনবিশির জন্য সাহেবের বড় বাবু ও আফিসের পেয়াদার খোসামুদী করিয়া ছয় মাস কাটাইতে আমাদের লজ্জা বোধ হয় না কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রণালীতেই হৌক বা লোক রাখিয়া বস্ত্র ধৌত করিবার একটা কারবার (laundry) খুলিতে আমাদের সমুদয় সম্মান লোপ পায়। এমন কি আমরা এমনি অসহায় যে নিজেদের কাজটুকুও কোনমতে চালাইয়া লইতে পারি না। এখন বিলাতের মত বড় আয়োজনে (scaleএ) Dairy farming, আমেরিকার মত মৎস্যের চাষ (Pisciculture) শিখিয়া মৎস্য জন্মাইবার চেষ্টা দরকার; তাহার সঙ্গে আবার (laundry farming) কাপড় ধোলাই করিবার কারখানা থাকা চাই। কিন্তু এ সব ব্যাপারে বিদ্যাবুদ্ধি ও সংগঠনী শক্তির সহিত (powers of organisation) যৌথ কারবার খোলা দরকার। কিন্তু আমরা নিশ্চেষ্ট ও অকর্ম্মণ্য হইয়া বসিয়া আছি; সেই সাবেক গোয়ালা, ধোবা ও জেলের উপরেই নির্ভর রহিয়াছে। পদ্মায় অজস্র ইলিশ্ জন্মায় বটে কিন্তু জেলেদের কাছে দাদন দিয়া বরফাবৃত করিয়া রেলগাড়ী যোগে কলিকাতায় পৌঁছিয়া দিবার ভার বৈদেশিকের উপর নির্ভর করিয়া আমরা সুখে নিদ্রা যাইতেছি এবং ব্যবসায়ের মুনফা আমাদের হস্তচ্যুত হইয়া যাইতেছে। এই প্রকারে বাঙ্গালীর কার্য্যক্ষেত্রের পরিসর ক্রমশঃ গুটাইয়া আসিতেছে। যাহা কতক আমাদের জ্ঞাতসারে ও কতক অজ্ঞাতসারে একবার গুটাইতে আরম্ভ করিয়াছে তাহাকে যথাসময়ে ঠেকাইয়া রাখিবার চেষ্টা না করিলে পরে যে কেবল অনুশোচনা করিতে হইবে এ কথা বলাই বাহুল্য। দেখিতে সামান্য অথচ ফলে বৃহৎ এই যে ব্যাপারগুলি এ গুলি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় ইহা কোনমতেই বাঞ্ছনীয় নহে।

 আমাদের দেশে যাহাদের আমরা এখন “ভদ্রলোক” বলিয়া থাকি তাহাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন চাকুরী হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং এই চাকুরী জোগাড় করিবার একমাত্র উপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের “ছাপ” আদায় করা। সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে আসিয়া আঘাত করিতেছে। যদি বুঝিতাম যে বিদ্যাশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিলাভ করা একই কথা তাহা হইলে আমার কোনও আপত্তি ছিল না কিন্তু এই উপাধিলাভের প্রধান উদ্দেশ্য কেরাণিগিরি বা ওকালতিতে প্রবেশাধিকার লাভ, এ কথা প্রসঙ্গক্রমে পূর্ব্বেই বলা গিয়াছে। শতকরা নিরান্নব্বই জন লোক উপাধিলাভের পর সরস্বতী দেবীর নিকট হইতে চির বিদায় গ্রহণ করেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিরাট কারখানা বা সুরকির কলে পরিণত হইয়াছে। আমা-ঝামা ও ভাল পোড়ের ইট এক সঙ্গে পেষিত হইয়া সেই সুরকিতে পরিণত হয়। প্রতিভা (Genius)র স্ফূর্ত্তি হয় না। আজকাল দেখা যায় এক এক কলেজে বিশেষতঃ দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে সাড়ে চারি শত পাঁচ শত ছাত্র। অধ্যাপক ও ছাত্রের সহিত এখানে ব্যক্তিগত কোন সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়া অসম্ভব। কেবল টীকা টিপ্পনি গলাধঃকরণ করানো ও percentage রক্ষা করাই যেন বিদ্যাশিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বাস্তবিক এ বিষয়ে আলোচনা করিলে দেখা যায় যাঁহারা যৌবনকালে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ফার্কতনামা লইয়া বিদায় হইয়াছেন তাঁহাদের মধ্যেই প্রকৃত প্রস্তাবে অনেকের প্রতিভার বিকাশ দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। এখনি কয়েকটী নাম আমার মনে আসিতেছে। কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, নলিনবিহারি সরকার, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই সকল ক্ষণজন্মা পুরুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে যে প্রকার অসাধারণত্ব দেখাইয়াছেন, জিজ্ঞাসা করি কয়জন উপাধিধারী তাহা পারিয়াছেন? এস্থলে ইহা বুঝিতে হইবে না যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার বিরোধী; আমার বক্তব্য এই যে অন্যান্য সুসভ্য দেশের ন্যায় সকলেই মোটামুটি—যিনি যতদূর পারেন সকলেই স্কুলে বিদ্যাভ্যাস সমাপন করিয়া নানা ক্ষেত্রে, বিশেষতঃ বাণিজ্য ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইবেন। অবশ্য একেবারেই ভূঁইফোড় হইয়া রামদুলাল সরকার হইবেন এ কথা বলি না; কিন্তু মাড়োয়ারীদিগের ন্যায় শিক্ষানবিশ (apprentice) হইয়া বাণিজ্যক্ষেত্রে ঢুকিবেন। কারণ সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষানবিশির একটা মূল্য আছে। না-পড়িয়া পণ্ডিত হওয়ার মত ভয়ঙ্কর জিনিস আর কিছুই নাই। বিশেষতঃ ব্যবসায় ক্ষেত্রের উত্থান পতন অতি ভয়ানক; যে কাজ এত গভীর দায়িত্বপূর্ণ সে কাজে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে একটু শিক্ষার দরকার একথা বুঝাইয়া বলিবার দরকার করে না। অল্পদিনের মধ্যেই অনভিজ্ঞ লোকের ব্যবসায় চেষ্টা নিষ্ফল হইয়া যায়, তাহার দৃষ্টান্ত খুঁজিবার জন্য বেশি দূর যাইতে হইবে না। সুতরাং এ শিক্ষাকে কিছুতেই উপেক্ষার ভাবে দেখিতে বলিতে পারি না।

 প্রকৃত প্রস্তাবে বলিতে গেলে গত পাঁচ বৎসর হইতে আমাদের জাতীয় জাগরণের সূত্রপাত হইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা কল কারখানা স্থাপন ও নানা প্রকার ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইতে আরম্ভ করিয়াছি, কিন্তু কোনও দিকে তাদৃশ কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই বলিয়া হতাশ্বাস হইয়া পড়িতেছি এবং কেহ কেহ বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন যে বাঙ্গালী জাতির দ্বারা কিছু হইবে না; কিন্তু তাঁহারা অনেক সময়ে ভুলিয়া যান যে ইউরোপ যে আজ বাণিজ্যক্ষেত্রের সর্ব্ববাদিসম্মত নায়কত্ব লাভ করিয়াছে তাহা পাঁচশত বৎসর বা ততোধিক কালের বংশপরম্পরালব্ধ অভিজ্ঞতার ফল। আমরা তাহা এক দিনেই করিতে পারি নাই বলিয়া নিরাশ হইবার কোনও কারণ নাই। যে সময়ে বঙ্গদেশ রঘুনন্দনের শাসনে নিপীড়িত হইয়া জড়বৎ হইয়াছিল এবং সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হওয়ায় ভারতবুর্ষের বাহিরে যাতায়াত বন্ধ হইয়াছিল সেই সময়ে একবার ভিনিসের অবস্থা ও নৌ-বাণিজ্যের বিষয় পর্য্যালোচনা করিলে বিস্মিত হইতে হয়।[]

 আজকাল দেখা যায় শিল্প বাণিজ্য শিখিবার জন্য শত শত বাঙ্গালী যুবক ইউরোপ জাপান আমেরিকায় ছুটিতেছেন। তাঁহারা শিক্ষিতব্য বিষয়ে যতদূর পারেন জ্ঞানলাভ করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া হতাশ হইয়া বেড়াইতেছেন। তুমি বস্ত্ররঞ্জনই (dyeing) শেখ, বৈদ্যুতিক পূর্ত্তকার্য্যই (electrical engineering) শেখ, কি কোন বিশেষ রাসায়নিক শ্রমশিল্পই (chemical industry) শেখ, যতদিন আমাদের দেশের লোক সেই সমস্ত ব্যাপারে (enterprise) প্রবৃত্ত না হইবে ততদিন এই বিদেশলব্ধ শিক্ষা কার্য্যকরী ও ফলবতী হইতে পারিবে না ও এই সকল লোকের কাজে লাগিবার কোন উপায়ই হইবে না। এমন কি স্বয়ং বিশ্বকর্ম্মাও যদি স্বর্গ হইতে আমাদের কল কারখানা নির্ম্মাণ করিবার জন্য অবতীর্ণ হ’ন তাহা হইলেও তিনি হার মানিয়া পলাইবেন। বঙ্গদেশে যত কল কারখানা, বলিতে গেলে সবই বৈদেশিকের হস্তে; তাঁহারা যে স্বজাতির মধ্য হইতে উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি নির্ব্বাচন করিয়া লইবেন ইহাতো সহজ কথা। আমরা গতানুগতিক হইলে চলিবে না।

 উপসংহারে শুধু এই কথাই বলিতে চাই যে এই ভীষণ প্রতিযোগিতার দিনে আমাদের যুবকগণ বসিয়া থাকিলে অথবা নির্জীবভাবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ ফেল গণনা করিলে চলিবে না। দেশে ছোট বড় অনেক চাকুরে লোক আছে তাহাদের বংশ বৃদ্ধি করা কখনও যুবকদের জীবনের লক্ষ্য হইতে পারে না। এ আশা, এ মায়া ত্যাগ করিতেই হইবে। একটী সবল, জীবন্ত যুবক সমাজের দরকার হইয়াছে।[] গণ্ডীছাড়া স্বাধীন শিক্ষা লাভের জন্য উৎসুক, কর্ম্মোৎসাহে চির নবীন যুবক সম্প্রদায় চাই; তাহারাই এ দেশকে নূতন করিয়া গড়িবে, নূতন মহিমায় মহিমান্বিত করিয়া তুলিবে। বঙ্গীয় যুবকসমাজের সম্মুখে এক বিষম সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে। এই সমস্যার সমাধান যদি তাঁহাদের দ্বারা সম্ভবপর না হয় তাহা হইলে ভবিষ্যৎ বড় অন্ধকারময়। যদি এ প্রবন্ধে আমি কোথাও কঠোর কথা ব্যবহার করিয়া থাকি তবে তাহা ক্ষোভের বশবর্ত্তী হইয়াই করিয়াছি, আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই, থাকিতেও পারে না। যেমন নব রবিকিরণে উদ্ভাসিত তরুণ কিশলয়ের শোভা মনোমুগ্ধকর হইলেও আপনাকে বড় করিয়া তুলিবার তাহার একটা ক্ষমতা নাই তেমনি আমাদের দেশের যুবকবৃন্দের দুর্ব্বল স্বাস্থ্যের স্নিগ্ধ হাস্য দেখিয়া আমার একদিকে সহানুভূতি ও অন্যদিকে গভীর দুঃখ হয়। বিধাতার সৃষ্ট একটা জাতির পরিণাম কি এতই ভয়ানক হইবে? এমনি করিয়া কি দিন দিন নিশ্চেষ্টতা ও উৎসাহবিহীনতা বঙ্গের যুবকদিগকে গ্রাস করিতে থাকিবে? তাহা কখনই হইতে পারে না। তাঁহাদের জড়তা ত্যাগ করিতেই হইবে; তাঁহাদের উঠিয়া বসিয়া নূতন পন্থা অবলম্বন করিতেই হইবে। এ পথ ছাড়া আর কোনও পথ নাই। এ পথ অবলম্বন করিতে না পারিলে কেবল অনাহারে এতটা মস্তিষ্কশক্তিসম্পন্ন বাঙ্গালীজাতি লয় প্রাপ্ত হইবে।

  1. ১৩১৭ সালের কার্ত্তিক মাসের “মানসী” হইতে পুনর্মুদ্রিত।
  2. সেকাল আর একাল—২৫—২৭ পৃঃ
  3. “For the effects plundered from the Armenian inhabitants of Calcutta, I will give the sum of seven lacks of rupees.” [Vide Stewart’s History of Bengal. Appendix, page XX, Article No. VII.]
  4. “Biswanath Matilal, lately the Dewan of the Salt Golas, began life with eight Rupees a month, and is generally understood to have amassed twelve or fifteen lakhs of Rupees before he was required to relinquish his office. The father of Babu Ashutosh Deb, the founder of that wealthy family, served a native master at five rupees a month, before he became a clerk in the late firm of Fairlie Ferguson & Co, in whose employ, and also in that of the American Merchants—who named one of their ships after him Ramdulal Deb, he accumulated a colossal fortune. The present Dictator in the money market, the Rothschild of Calcutta, Muti Babu, began his career with the humble salary of ten Rupees a month.
    (Vide The Indian Mirror, Aug. 14, 1910.)
  5. “It is not easy to realise what Venice must have looked like with this teeming life along her quays and streets, when the pulse of the commercial world beat fullest at Rialto; but there stand forth, to assure us of its splendour, the enthusiastic descriptions of Frate Faber, Pietro Casola, above all of Francesco Petrarch, who bursts into panegyric. From my windows on the Riva degli Schiavoni”, he says, I see vessels as large as my house with masts taller than is towers. They sail to all parts of the world, and brave a thqusand dangers. They carry wine to England, honey to the Scythians; saffron, oil, linen to Assyria, Armenia, Persia and Arabia; wood to Egypt and Greece; then return laden with merchandise to be distributed all over Europe. Where the sea ends, their sailors quit the ships and travel on to trade with India and China; they cross the Caucasus and the Ganges, and reach the Eastern Ocean.” Vide The Venetian Republic, page 81.
  6. “ভগবান প্রকৃতিগত বৈচিত্র দিয়া মনুষ্য সৃজন করিয়াছেন তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। প্রবীণ-পসারওয়ালা উকীল ভাবেন তাঁহার পুত্ত্র যতশীঘ্র পারে বি. এল, পাশ দিতে পারিলে “বাঁধা ঘর” ও মক্কেলদিগের নিকট তাহাকে পরিচিত করিয়া অবসর গ্রহণ করিবেন। কিন্তু দুর্ভাগা পুত্ত্রের মতি গতি ও রুচি অন্যদিকে। পিতা জোর করিয়া তাহাকে আইন পাশ করাইবেন। এই প্রকার কত tragedy আমি জানি বলা যায় না।