বিষয়বস্তুতে চলুন

আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৭

উইকিসংকলন থেকে

১৭

জাতিভেদ ও তাহার

প্রায়শ্চিত্ত[]

 আজ যে প্রসঙ্গের অবতারণা করিতেছি, সে সম্বন্ধে ক্রমান্বয়ে দশ বার দিন নানাদিক হইতে বলিলেও তাহার সম্যক্ আলোচনা শেষ হয় না। জাতিভেদ রূপ মহাপাপ ভারতবর্ষকে অধঃপতনের পথে কিরূপে চালিত করিয়াছে তাহার আলোচনা নানাদিক্ হইতে করা যাইতে পারে। আমি এস্থলে তাহার মাত্র দুই একটি দিক্ সম্বন্ধে কিছু বলিব। সম্প্রতি ভারতবর্ষে অন্যূন ৫০ হাজার মাইল (প্রায় পৃথিবীর পরিধির দ্বিগুণ) আমাকে পরিভ্রমণ করিতে হইয়াছে, নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত অনেক কার্য্যে—দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক প্রকার অনুষ্ঠানে—যাইয়া অনেক শ্রেণীর লোকের সঙ্গে মিশিতে হইয়াছে। তাহার ফলে যেটুকু অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে বুঝিয়াছি যে জাতিভেদ দেশের যে কি সর্ব্বনাশ করিয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।

 আর্য্যেরা যখন এদেশে আসিয়াছিলেন সেই বেদের যুগে জাতিভেদের অস্তিত্বও এদেশে ছিল না। জাতিভেদের কথা সংস্কৃতে নাই। ইহা Caste system-এর বাঙলা তর্জ্জমা। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘বর্ণভেদ’, ‘বর্ণসঙ্কর’ প্রভৃতি কথা আছে বটে। আদিশূরের সময়ে বেদবিহিত ক্রিয়াকলাপ লোপ হওয়ায়, তিনি কান্যকুব্জ হইতে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বাঙ্গালাদেশে আনয়ন করেন, এইরূপ প্রবাদ আছে। সেই পঞ্চ ব্রাহ্মণ হইতে বর্ত্তমান কুলীন ব্রাহ্মণের উৎপত্তি। বলা বাহুল্য যে, সেই ব্রাহ্মণগণ তাঁহাদের পত্নীগণকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন কিনা তাহা জানা নাই। তৎপরে বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্ত্তন করিয়া বঙ্গের তথাকথিত উচ্চজাতিগুলির মধ্যেও উপজাতির সৃষ্টি করেন এবং তখন আমাদের দেশে জাতিভেদের ভিত্তি সুদৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়। এখন আমরা আমাদের চতুর্দ্দিকে নানা প্রকার “জাতি” দেখিতে পাই, বাঙালাদেশের ৩৬ জাতির কথা সকলেই অভিজ্ঞাত। কিন্তু হিসাব করিয়া দেখিলে এই সংখ্যা ৬০।৭০ এরও অধিক। অথচ এতগুলি জাতির মধ্যে জাতি ও বর্ণ অনুসারে কোন বৈষম্য নাই! নৃতত্ত্বের দিক্ (ethnologically) দিয়া দেখিতে গেলে একজন নমঃশূদ্র ও একজন ব্রাহ্মণের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য বুঝিতে পারা যাইবে না। এক সময়ে বাঙালাদেশে বৌদ্ধমত অত্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল—প্রায় হাজার বৎসর ধরিয়া বাঙালাদেশে বৌদ্ধ প্রভাব বর্ত্তমান ছিল; তৎকালে জাতিভেদের বাঁধন শিথিল হইয়া পড়ে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জাতিভেদ আবার তাহার সমস্ত কঠোরতা লইয়া ফিরিয়া আসে।

 বর্ত্তমানে বাঙালাদেশে শতকরা ৫০ জনেরও অধিক মুসলমান। অথচ এই মুসলমানদিগের মধ্যে শতকরা ৯৯ জন লোকের শরীরে হিন্দুর রক্ত। আজ যে বাংলাদেশের এই শতকরা ৫০ জনেরও অধিক মুসলমান—ইহার কারণ হিন্দু সমাজের কঠোরতা। জাতিভেদের কঠোর বন্ধনে, হিন্দু সমাজকে আমরা সঙ্ঘবদ্ধ করিতে যাইয়া তাহাকে কেবল পঙ্গুই করিয়াছি। এই শতকরা ৯৯ জন মুসলমান—যাহাদের রক্ত হিন্দু ও ভাষা বাংলা—তাহারা আমাদেরই অত্যাচারে জর্জ্জরিত হইয়া ইসলামের উদার বক্ষে আশ্রয় লইয়াছে। মুসলমান সমাজ মানুষকে চিরদিনই মানুষ বলিয়া স্বীকার করে। যেদিন ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করা গেল সেইদিন বাদশাহ, ফকীর এক মস্‌জিদে উপাসনা করিতে অধিকারী হইল। হেয়, অবজ্ঞাত হইয়া কাহাকেও থাকিতে হয় না। সুশিক্ষা প্রাপ্ত হইলে ফকীরের পুত্রের ওম্‌রাহের দুহিতার পাণিগ্রহণেও কোন বাধা নাই। আমাদের দেশে গ্রামের পর গ্রাম ইস্‌লামের এই উদার আহ্বানে ধর্ম্মত্যাগী হইয়াছিল। প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্ব্বে চৈতন্যদেব ধর্ম্মজগতে নূতন যুগ আনয়ন করিলেন। প্রেম ও ভক্তির যে বার্ত্তা লইয়া তিনি আসিলেন, তাহাতে কোন ভেদের কথা ছিল না। “চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠো হরিভক্তিপরায়ণঃ”। তাই দলে দলে লোক বৈষ্ণব ধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিল। ফলে, বর্ত্তমানে আমরা দেখিতে পাই তথাকথিত নিম্নজাতিরা প্রায় সকলেই বৈষ্ণব। চৈতন্য যদি আবির্ভূত না হইতেন, তাহা হইলে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ এই ২৬ লক্ষ বাদে বোধ হয় সমস্ত দেশই মুসলমান হইয়া যাইত। এতবড় হিন্দু সমাজের এই ২৬ লক্ষ কতটুকু অংশ? হিন্দু সমাজের এই বৃহত্তর অবজ্ঞাত অংশ তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মধ্যে আমরা বেশী খ্যাতনামা ব্যক্তি যে দেখিতে পাই না, তাহার কারণ কোন সুযোগ বা সুবিধা ইহাদিগকে আমরা কখনো দিই নাই। কৃষ্ণদাস পাল ও মহেন্দ্রলাল সরকার প্রভৃতি ২।১ জন স্মরণীয় ব্যক্তির অবশ্য নামোল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু সমগ্র সমাজের তুলনায় ইহা ধর্ত্তব্যই নহে। হিন্দু সমাজ এই নিম্নশ্রেণীর উন্নতির পথ বন্ধ করিয়াই রাখিয়াছে—ফলে সমাজের বৃহৎ অংশই আজ সমস্ত জাতিকে পিছনে টানিয়া রাখিয়াছে। জাতীয় আন্দোলন আজ দেশের প্রধান আন্দোলন, কিন্তু এই আন্দোলনের সীমা কতটুকু পৌঁছিয়াছে? আমাদের দেশে জাতীয়তা মুষ্টিমেয় শিক্ষিত তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই জাগরণের প্রবাহে অনুন্নত তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকেরা কোথায়? শিক্ষার অভাবে তাহারা ইহার প্রকৃত স্বরূপটি কিছুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে না। শিক্ষিত তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর সহিত তাহাদের সামাজিক বা হৃদয়ের কোন যোগাযোগ না থাকায় জাতীয় আন্দোলনে আমরা তাহাদের সহানুভূতি পাইতেছি না। শিক্ষা ও দীক্ষা (Culture) মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ—ইহার বিস্তার না হইলে এইরূপ জাতীয় আন্দোলনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

 ইংলণ্ড প্রভৃতি পাশ্চাত্য দেশে লোকে কৃতী ও বিত্তশালী হইলে তাহাদের আয়ের একটি অংশ দেশের ও গণের কাজে নিয়োজিত করেন। এই প্রকার দান করা এখন সর্ব্বসাধারণ নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিলাতি কাগজে Wills & Bequests নামে একটি স্তম্ভ থাকে, তাহাতে এই প্রকার মৃত্যুকালীন দান উল্লিখিত হয়। যদি কোন অর্থবান মৃত্যুকালে বা জীবদ্দশায় তাঁহার অর্থের কিয়দংশ দেশের কাজের জন্য না দান করিয়া যান তাহা হইলে জনসাধারণে তাহাকে হেয় জ্ঞান করে। কাজেই সামাজিক কল্যাণকর অনুষ্ঠান বিলাতে সাধিত করিবার জন্য কখনো অর্থাভাব হয় না। Guy’s Hospital প্রভৃতি জগৎবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলি এইরূপ স্বেচ্ছাকৃত দানের উপর নির্ভর করে। শিক্ষা, সমাজসেবা, দেশসেবা প্রভৃতির নানা আয়োজন এই প্রকার লব্ধ অর্থের দ্বারা চালিত। দেশে সমস্ত স্তরের লোকের মধ্যে এক অঙ্গাঙ্গীভূত যোগই এই প্রকার দানশীলতাকে অনুপ্রেরিত করে। আর এদেশে? আমাদের মাত্র শতকরা ৬।৭ জন শিক্ষিত অর্থাৎ বর্ণজ্ঞানবিশিষ্ট। কোন প্রকারে নাম দস্তখত করিতে পারিলেই আদম সুমারীর হিসাবে শিক্ষিত বলিয়া ধরা হয়। ভারতবাসী অশিক্ষায় ও কুসংস্কারে মগ্ন। দেশ ম্যালেরিয়া, অন্নকষ্ট, জলকষ্ট, বন্যা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি নানাবিধ দুর্ভাগ্যে পীড়িত। তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিকাংশই চাকুরীজীবী। জমিদারবর্গ প্রজার রক্ত শোষণ করিয়া সহরে বাস এবং অর্থের অপব্যয় করেন। দান করিবার মতো অর্থ তাঁহাদের কাজেই নাই। অনুন্নত শ্রেণীর নিকট হইতে দেশের মঙ্গলকর কার্য্যে কোন সাড়া পাওয়া যায় না। জাতিভেদের প্রায়শ্চিত্তই এইখানে। আর শিক্ষিত ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ আমাদের, Shakespeare, Milton মুখস্থ করা Culture (কর্ষণ) মাড়োয়ারীর আড়তে বা সদাগরী আফিসে কেবল কলমপেশাতেই পর্য্যবসিত হয়। দান করিবার মতো অর্থ আমাদের কোথায়? পূর্ব্ববঙ্গে অনেক সাহা ও তিলি-জাতীয় ধনী ব্যবসায়ীর বাস। আমাদের চিরকাল তাহাদের একদিকে কোণ ঠাসা করিয়া রাখিবার ফল এই হইয়াছে যে, তাহাদের আমাদের কোন চিন্তাধারার সঙ্গে যোগ নাই। পূর্ব্ববঙ্গে আমাদেরই কয়জন Research Scholar অর্থাৎ গবেষণারত ছাত্র কার্য্যে ব্রতী হইয়াছেন। ইঁহারা নগ্নপদে ২০।২৫ মাইল পর্য্যটন করিয়াও ধনীব্যক্তিদিগের নিকট হইতে ৫৲ টাকাও সাহায্য পান না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই সমস্ত ধনী ব্যক্তিরই নিকট যদি কোন বাবাজীর শুভাগমন হয়, তখন সেই ব্যক্তি প্রভুর আদেশে গললগ্নীকৃতবাসে “একসের গাঁজা মাঙাইতে ও হাজার লোক খিলাইতে” কোন প্রকার দ্বিধা করে না।

 দুর্ভিক্ষ, বন্যা প্রভৃতিতে মাড়োয়ারীদের নিকট হইতে তবুও কিছু সহানুভূতি পাওয়া যায়। কেননা জীবে দয়া তাহাদের ধর্ম্মের অঙ্গ। কিন্তু দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি বিপৎপাত ভিন্ন যখন দেশের Constructive (গঠনশীল) কোন কাজ করিবার দরকার হয় তখন আর কোন উৎসাহ আসে না। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে নাগপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদান উপলক্ষে গমন করিয়া স্যর বিপিনকৃষ্ণের নিকট শুনিয়াছিলাম তত্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করিয়া বিশেষ কোন ফললাভ করা যায় নাই। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনতিদূরে এক ধনী মাড়োয়ারী এক মর্ম্মরনির্ম্মিত পান্থশালা বা ধর্ম্মশালার স্থাপনা করিতেছেন। ব্যয় অন্যূন ৮।১০ লক্ষ হইবে! পূর্ব্বে যখন রেলপথের সৃষ্টি হয় নাই তখন না হয় এই প্রকার পান্থনিবাসের সার্থকতা ছিল, কিন্তু বর্ত্তমান কালে ইহার সেরূপ প্রয়োজনীয়তা কোথায়? পরলোকগত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পূর্ব্ববঙ্গের কোন প্রসিদ্ধ তিলিজাতীয় ধনীর গৃহে অর্থ সংগ্রহে গমন করিয়াছিলেন। অনেক কথা ও সময় ব্যয়ের পর সেই কোটীপতি দেশসেবায় ১০৲ টাকা দান করিতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন! ইহা কি আমাদেরই পাপের ফলে নহে? জাতিকে নানা দিক দিয়া উঠিতে হইবে। নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থ নৈতিক কোন দিকেই পশ্চাতে পড়িয়া থাকিলে চলিবে না।

 জাতিভেদের লৌহশৃঙ্খল আমাদিগকে পাষাণ-মন্দিরে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। বাল্যকালে দেখিয়াছি যেখানে এখন কৃষ্ণদাস পালের মূর্ত্তি সেইখানে পাদোদক-পিয়াসিগণ ভিড় করিতেন। এই শতকরা ৯৫ জনকে পায়ের নীচে রাখিয়া ব্রাহ্মণই আজ অধঃপতিত হইয়াছেন। নিজেদের কর্ত্তৃত্ব বজায় রাখিবার জন্য অন্যের বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা নষ্ট করিয়া যে দেশের সর্ব্বনাশ হইয়াছে তাহারই ফল আজ সমস্ত দেশকে ভোগ করিতে হইতেছে।

 আজ বাঙালীর অর্থ মাড়োয়ারী লইতেছে। যদিচ এই মাড়োয়ারীগণ ৩।৪ পুরুষ এদেশে বাস করিতেছে তথাপি তাহারা মাড়োয়ারীই রহিয়া যাইতেছে। আমাদের সমাজের সঙ্গে মিশ্রিত হইবার কোন উপায় নাই। কাজেই বাঙলাদেশের কোন লাভ হইতেছে না! ইংলণ্ডে বিদেশের লোক আসিয়া ইতিহাসের নানা সময়ে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে। দু’এক পুরুষ’ পরে এই সমস্ত বিদেশীই ইংরাজ হইয়া গিয়াছে। আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ কায়স্থেরা বিক্রমপুর যাইয়া বসবাস আরম্ভ করিলেন; ব্রাহ্মণেরা কুলীন শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইলেন, কিন্তু কায়স্থেরা হইলেন বঙ্গজ। তাঁহাদের সঙ্গে রাঢ়ীয় কায়স্থগণের আদান-প্রদান বন্ধ হ‍ইল। আর ওদিকে ইটালী হইতে নির্য্যাতিত হইয়া ও ফ্রান্স হইতে নিপীড়িত Huguenotগণ ইংলণ্ডে আসিয়া আশ্রয় লাভ করিলেন। Lambard Streetএ বিখ্যাত Bank-গুলি এইরূপ ঔপনিবেশিক বিদেশিগণ দ্বারাই স্থাপিত হইল। পশমের (Wool) কাজে পারদর্শী কারিগরগণ আসিয়া ইংলণ্ডে উলের ব্যবসার সূত্রপাত করিলেন। বিভিন্ন দেশের লোকদিগকে আশ্রয় দিয়া ও নিজের অঙ্গে টানিয়া লইয়া ইংরাজ আজ এত বড় সমৃদ্ধিশালী জাতি। তাহার নানা ব্যবসায়ের সূত্রপাত হইয়াছে এইরূপ বিভিন্নদেশীয়দের দ্বারা। আজ সমগ্র ইংলণ্ডবাসী এক বিরাট পরিবার। নানাদেশের লোকের নানাগুণ ইংরাজ চরিত্রে তাই স্থানলাভ করিতে পারিয়াছে। আমাদের দেশে যে সকল উদ্যমী অ-বাঙালী আসিতেছেন, তাঁহারা পুরুষানুক্রমে এখানে বাস করিয়াও অ-বাঙ্গালীই রহিয়া যাইতেছেন। সুতরাং আমাদের racial type কিছুমাত্র পরিবর্ত্তিত বা উন্নত হইতেছে না।

 আমাদের ভরসাস্থল ২৬ লক্ষ ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য বলিতে সকলেই শিক্ষিত এরূপ বোঝা উচিত নহে। ব্রাহ্মণের মধ্যে, আবার কত রকম আছে। কেহ ভিখারী, কেহ পূজারি, কেহ রাঁধুনি, গলদেশে উপবীত্ ও হস্তে একটি শীতলা বা ঐরূপ কিছু থাকিলেই যখন উদরান্নের সংস্থান হয়, তখন অনেক যে গণ্ডমূর্খ জুটিবে তাহার আর বিচিত্র কি! প্রায় হাজার বৎসর পূর্ব্বের একটি উদ্ভট শ্লোক হইতে বুঝা যাইবে এ অবস্থা যে শুধু আজ হইয়াছে তাহা নয়। পুরোহিত বাক্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলা হইয়াছে—পুরীষস্য ‘পু’, রোষষ্য—‘রো’, হিংসয়োঃ—‘হি’, তস্করস্য‘ত’।

 সেদিন রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন “জাতিভেদই শ্রদ্ধানন্দের হত্যার জন্য মুখ্য ও গৌণভাবে দায়ী”—কোন কোন সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ হইয়াছে। যাঁহারা একটু চিন্তা করিবেন, তাঁহারা দেখিবেন ইহা কতদূর সত্য। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের রক্তে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত সম্যক্‌রূপে হইবে কি?

 জাতিবিভাগ অনুসারে মানুষের গুণ ও কর্ম্মবিভাগ করা যায় না। কারণ গুণ বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয় না। তাহা হইলে “গুণকর্ম্মবিভাগশঃ”—এ উক্তির সার্থকতা কোথায়? ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে বর্ণাশ্রমধর্ম্ম নাই। Defoe কসাইপুত্র ছিলেন। Bunyan স্বয়ং পিতল-কাঁসার ঝালাই করিয়া জীবিকা অর্জ্জন করিতেন। William Carey এদেশে সেকালের একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তিনি এদেশে আসেন “মিশনারী” হইয়া। বিদেশী ও বিজাতি হইয়া তিনি হইলেন বাংলা গদ্য-সাহিত্যের অগ্রদূত। বাল্যকালে তিনি পাদুকা মেরামতের কার্য্য করিতেন। একবার Fort William Collegeএর সান্ধ্যভোজনে তাঁহার নিমন্ত্রণ হয়। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের কেহ Lord Wellesleyর কানে কানে বলেন, “Carey! Was he not a shoe-maker?” Carey ইহা শুনিতে পাইয়া বলেন, “Sir, you do injustice to me, I was not a shoe-maker, but a cobbler” অর্থাৎ আমি “জুতি-সেলাই” ছিলাম।

 Duke, Robert of Normandy একদিন মৃগয়ায় বাহির হইয়া এক স্রোতস্বতীর তীরে চাষার কন্যা Priscillaকে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া তাঁহার পাণিগ্রহণ করেন। ইঁহারই গর্ভে William, the Conquerorএর জন্ম হয়। জগদ্বরেণ্য রাসায়নিক জীবাণু-বিদ্যার জন্মদাতা Pasteur ছিলেন চর্ম্মকারের পুত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক Carlyle ("Master of terse vigorous style”) রাজমিস্ত্রি-পুত্র ছিলেন। ইঁহার পিতা শেষ জীবনে কৃষিকার্য্য করিতেন। ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক Michael Faraday; ইঁহার সম্বন্ধে বলা হয় “Faraday is electricity and electricity is Faraday.”—Dynamo বর্ত্তমান সভ্যভার একটি স্তম্ভ বিশেষ, ইঁহারই আবিষ্কার। ইঁহার পিতা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্যবসায়ে কর্ম্মকার ছিলেন। Napoleonএর সহিত যুদ্ধের সময় লণ্ডনে খুব অন্নকষ্ট হয়, কারণ, বাহির হইতে কোন খাদ্যের আমদানী হইতে পারিত না। উপরন্তু তাঁহার পিতা বড় দরিদ্র ছিলেন। সপ্তাহে ভিক্ষাস্বরূপ (dole) একখণ্ড রুটি ও জল ব্যতীত তাঁহার আর কিছুই আহারের জুটিত না! বাল্যকালে তাঁহাকে এক দপ্তরীর দোকানে কর্ম্ম করিতে হয়।

 Smilesএর “Lives of British Engineers” গ্রন্থে দেখা যায় Metcalf, Telford, প্রভৃতি England এর প্রসিদ্ধ engineers অনেকেই দরিদ্রের সন্তান। তাঁহারা, আরো আশ্চর্য্যের বিষয়, প্রায় সুকলেই পল্লীবাসী,—অথচ অধ্যবসায়বলে উত্তরকালে এত প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। ইহা ঐ দেশে সম্ভব, কেননা সমাজ ব্যক্তিত্বের উপর পাষাণ চাপাইয়া মনের স্বাধীন ও স্বাভাবিক বিকাশকে পঙ্গু করে না। আমাদের দেশের ন্যায় সেখানে শূদ্রের বেদ উচ্চারণে “জিহ্বাচ্ছেদন” বা শ্রবণে তপ্ত তৈল কর্ণবিবরে প্রদান করিবার কোন বিধি ছিল না।

 আমরা স্বেচ্ছানির্ম্মিত নিগড়ে নিজেরাই আবদ্ধ হইয়াছি। হিন্দু সমাজ এক বিশাল সাগর বিশেষ,—ইহার প্রত্যেকটি জাতি এক একটি দ্বীপ, একের সহিত অন্যের কোন সম্পর্ক নাই। কাজেই বিভিন্ন শ্রেণীর,ভিতর আন্তরিকতার একান্ত অভাব। ব্রাহ্মণই সুধু দেবমন্দিরে প্রবেশ করিতে অধিকারী, কায়স্থ প্রাঙ্গণ হইতে দর্শন করিবে, শূভ্র অস্পৃশ্যকে মন্দিরের শতহস্ত দূর হইতেই দেবতার কৃপা লাভ করিতে হইবে। অথচ আমরাই বলি সর্ব্বভূতেষু নারায়ণঃ! উচ্চশিক্ষিত যাঁহারা তাঁহারাও কি এ সমস্ত বুঝিয়াও বুঝিতে চাহেন না? মানুষে মানুষে এই প্রকার ভেদের প্রাচীর তুলিলে আন্তরিকতা কোথা হইতে আসিবে?

 বাঙ্‌লায় হিন্দু-মুসলমান, মাদ্রাজে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমস্যা অতি দারুণ। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্য্যন্ত আমরা কেবলই দেশের চারিদিকে ক্ষুদ্র বৃহৎ নানা সমস্যা দেখিতে পাইব। দেশাত্মবোধ কিছুতেই জাগ্রত হইতে পারিবে না।

 জাতিভেদের পাপের ফলে হিন্দু আজ মরণোন্মুখ। বাংলায় সমস্যা উঠিয়াছে—হিন্দু বাঁচিবে না মরিবে? একটি জাতি কতদূর অধঃপতিত হইলে তাহার মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন উঠে? হিন্দু সমাজের ললাটে যে মৃত্যুর কাল ছায়া ঘনাইয়া আসিয়াছে ইহা আমাদের বহুযুগসঞ্চিত পাপের,অবশ্যম্ভাবী ফল। মানবের আত্মাকে অপমান করিয়া আজ ভারত অপমানিত।

“হে ভারত—যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাদের সমান।”

তাই আমরা আজ সমাজের এই বৃহৎ অংশকে অস্পৃশ্য করিয়া নিজেরাই জগতের নিকট অস্পৃশ্য হইয়া গিয়াছি। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করিয়া বিরাট মানব-সমাজের দরবারে উন্নতমস্তকে আমাদের প্রবেশ করিবার অধিকার নাই।

  1. ভবানীপুর ব্রাহ্ম সমাজে প্রদত্ত বক্তৃতার সারাংশ। শ্রীমান্ জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়, পি এইচ্ ডি ও প্রফুল্ল কুমার বসু, এম্ এস. সি কর্ত্তৃক অনুদিত।