বিষয়বস্তুতে চলুন

আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৫

উইকিসংকলন থেকে

জাতিভেদ

 অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রশান্ত মহলানবিশের কথা ইউনিভার্‌সিটি কমিশন রিপোর্টে আগ্রহাতিশয়ে উদ্ধৃত হয়েছে। অন্য কথা অবতারণা করবার আগে আপনাদের সম্মুখে তা থেকে দুই এক ছত্র পাঠ কর্‌ছি,—

 “In Bengal while our mind is highly imaginative and our intellect peculiarly subtle, our actual social life is wholly circumscribed by conventional custom and completely fettered by artificial rules. This divorce of our actual life from the life of our ideas has made us a race of neurasthenics. In addition it is destroying our intellectual power. At present we are too often content merely to imagine and almost never really to achieve. Our only hope lies in true university education. It must awaken in us a real sense of independence in both thought and action.”

 কমিশন বলেন বাঙালীর ছেলে দোটানায় পড়েছে; তার ঘরে একরকম, বাহিরে ঠিক তার উল্টা। বাস্তবিক শিক্ষিত বাঙালী যুবকের ঘরে এবং বাহিরে এত তফাৎ, তার চিন্তা ও কার্য্যে এত পার্থক্য, ভাবরাজ্যে ও কর্ম্মরাজ্যের ব্যবধান এরূপ সুপ্রশস্ত ও সুগভীর যে এই অসামঞ্জস্যের ফলে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও কর্ম্মশক্তি ক্রমে ক্ষয় পাচ্ছে। কলেজে জ্যোতির্ব্বিদ্যা অধ্যয়নকালে বাঙালী যুবক বুঝেন চন্দ্রের ছায়া-সম্পাতে সূর্য্যগ্রহণ ঘটে; এদিকে বাড়ীর ভিতর এসে দেখেন আয়ীমা, ঠাকুরমা, দিদিমা, হাঁড়ি ফেলে দিয়ে গঙ্গায় স্নান ক’রে, এসেছেন—কেন না সূর্য্যদেব রাহুগ্রস্ত হয়েছিলেন! আমাদের পুঁথিতে বিদ্যা একরূপ, আর সমাজগত ব্যবহার ভিন্নপ্রকার। এরূপ কপটতায় আমরা অতি অল্প বয়স থেকে অভ্যস্ত হয়ে আসছি ব’লে অন্তরকে ফাঁকি দিয়ে বাহিরের ঠাট বজায় রাখতে আমাদের তেমন ঠেকে না—দ্বিধাবোধ হয় না। বুদ্ধি দিয়ে আমরা যা গ্রহণ করি, সামাজিক ব্যাপারে তার প্রায় বিরুদ্ধাচরণই ক’রে থাকি। কিন্তু এরূপ বিরোধ আমাদের সর্ব্বপ্রকার উন্নতির পরিপন্থী। যুক্তি যা স্বীকার করে হৃদয় যা গ্রহণ করতে চায়, চিরাচরিত ও গতানুগতিকের চাপে সেই চিন্তা ও ভাবকে যদি আমরা জীবনযাত্রাকালে বধ ক’রে চলি তবে বাহিরের চলাফেরা বজায় থাকলেও অন্তরে আত্মহত্যাই ঘটে! আমি অন্যত্র এই একই কথা বলেছি যে মানসিক, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতির চেষ্টা একসঙ্গে হওয়া চাই! এর মধ্যে একটিকে চেপে অন্যগুলির কথা প্রচার করবার প্রয়াস বিফল হবে, তাতে জাতির কল্যাণ হবে না। কারণ জাতীয় উন্নতি অর্থে একটা বাঁধা-ধরা কিছু বুঝায় না,—বুঝায় সকল দিকে সর্ব্বপ্রকারে জাতীয় জীবনের অবাধ বিকাশ ও প্রসার।

 স্বীকার করতেই হবে যে জাতিভেদ প্রথার ভীষণ বদ্ধনে আমরা আড়ষ্ট হয়ে আছি, অধঃপাতে গেছি; এতই অধঃপাতে গেছি যে আবার ধর্ম্মের অজুহাতে, আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়ে আমরা এই প্রথাকে—বিশেষতঃ এই ছোঁয়াছুয়ি ব্যাপারটাকে—বিধিসঙ্গত ও বিজ্ঞানসম্মত ব’লে প্রমাণ না ক’রে আর ছাড়্‌ছি না। আমরা বলি “আমরা হিন্দু—আধ্যাত্মিক জাতি, ঘোরতর spiritual; আর য়ুরোপীয়েরা জড়বাদী, বড় material;—তবু caste কোথায় নেই মশাই—এই জাত মেনে চলা? ইংলণ্ড ও আমেরিকার ধনী কি দীন দরিদ্র প্লিবিয়ানের মেয়ে বিয়ে করেন, না তার সঙ্গে একসঙ্গে আহারাদি করতে সম্মত হন? তা যখন চলে না তখন আর আমাদের সঙ্গে তফাৎ রইল কোথায়?” Things which are equal to the same thing equal to oné another যুক্তি এমনই চমৎকার! বংশগত জাত আর অবস্থাগত জাত যে এক নয় তা এইটুকু বল্‌লেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে—বিশেষ বংশে জন্মগ্রহণের উপর কারো হাত নেই, কিন্তু অবস্থার পরিবর্ত্তন মানুষ চেষ্টার দ্বারা কর্‌তে পারে। দরিদ্র ধনী ও গুণী হয়ে উঠ্‌লেই য়ুরোপ আমেরিকায় তারা কুলীন হয়ে পড়ে; দরিদ্র অবস্থা থেকে ধনী হয়ে সার্ বা লর্ড উপাধি অনেকেই পেয়েছেন এবং তাঁরা সমাজে অভিজাতদের সমকক্ষ হতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের নীচু জাত হাজার তপস্যা কর্‌লেও এখন আর পূর্ব্বকালের মত উচ্চজাত ব’লে গণ্য হতে পারে কি?

 যাহোক এসব কথা ছেড়ে সমস্যাটিকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে; তুলনা ক’রে দেখ্‌তে হবে য়ুরোপের জাতিভেদ ও আমাদের দেশের জাতিভেদের মধ্যে বাস্তবিক কোন মূলগত পার্থক্য আছে কি না, এদেশের মত য়ুরোপে জাতিভেদ মানুষকে বংশের পর বংশ ধ’রে ক্রমাগত ঘৃণা ক’রে, পেষণ ক’রে, তাকে চেপে কোণঠাসা ক’রে চিরকালের জন্য হীন ক’রে রেখেছে কি না, তার আত্মসম্মান জ্ঞান প্রায় লুপ্ত ক’রে দিয়ে সর্ব্বপ্রকারে তাকে খর্ব্ব করেছে কি না, হৃদয়হীন ভাবে তার মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে কি না।

 একটু সবিস্তারে আলোচনা করা যাক্। মনে রাখ্‌বেন আজকালকার এই “জাতিভেদ” কথাটা আমরা সৃষ্টি করেছি, এটা পুরাতন নয়, পুরাতন সংস্কৃত গ্রন্থে এর উল্লেখ মাত্র নেই। সে সকল পুস্তকে বর্ণভেদ বর্ণাশ্রম প্রভৃতির কথা দেখা যায়। গীতায় আছে—“চাতুর্ব্বণ্যম্ ময়া সৃষ্টম্ গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।” আমাদের দেশে বহুপূর্ব্বে আর্য্য ও অনার্য্য এই দুই শ্রেণীর লোক ছিল। ঋগ্বেদসংহিতা পড়্‌লে তাদের আচার ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। ইন্দ্র বরুণ প্রভৃতি তখন আর্য্যদের দেবতা ছিলেন। আর্য্যেরা প্রার্থনা কর্‌তেন,— “হে ইন্দ্র, হে বরুণ, তোমাদের প্রচুর সোমরস প্রদান করেছি, পান ক’রে প্রসন্ন হও—এবং কৃষ্ণকায় অনার্য্য দস্যু বধ কর।” অনার্য্যেরা কৃষ্ণকায় ও কদাচারী ছিল। আর্য্যেরা ছিল সভ্য এবং গৌরবণ। এদেশে তখন জাতিভেদের মূলে ছিল বর্ণভেদ। আর্য্যেরা যখন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে উত্তর-ভারতের নদীবহুল সমতলক্ষেত্রে ক্রমে বসতিবিস্তার কর্‌তে লাগ্‌ল, তখন কৃষ্ণকায় আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধ্‌ল এবং পরাজিত হ’য়ে তারা একে একে পর্ব্বতে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ কর্‌লে। ভীল, কোল, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতিরা তাদের বংশধর। আমেরিকা দেশেও এইরূপ ঘটনা ঘটেছে। পরাক্রান্ত য়ুরোপীয় জাতির সংঘর্ষণে ও আওতায় রেড ইণ্ডিয়ান প্রভৃতি হীনজাতি টিক্‌তে না পেরে, বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা কর্‌বার চেষ্টা করেছে।

 যে দেশে বর্ণভেদ ছাড়া জাতিভেদের অন্য কোন ভিত্তি ছিল না, সে দেশে এই হাজার রকম জন্মগত জাতির উৎপত্তি কিরূপে হ’ল? নানা জাতিতে বিভক্ত বর্ত্তমান হিন্দু সমাজটিকে বিধাতা ঠিক এইরূপে তৈরী ক’রে শৃঙ্খল দিয়ে বেঁধে দ্যুলোক থেকে ভূলোকে নামিয়ে দিয়েছেন, অথবা এই ভূলোকেই এইরূপ জাতিভেদের সৃষ্টি হয়েছে? যে হিন্দু সমাজে আদৌ জাতিভেদ ছিল না সেই সমাজ ক্রমে “স্পৃশ্য” “অস্পৃশ্য” নানাজাতিতে বিভক্ত হ’য়ে পড়েছে! জাতিভেদের এই অভিব্যক্তি বা ক্রমবিকাশ একটু আলোচনা কর্‌তে হবে।

 ম্যাক্‌সমূলার প্রথম সমগ্র ঋক্‌বেদ প্রকাশিত করেন। তারপর রমেশ দত্ত বেদের বাংলা অনুবাদ করেছেন। সুতরাং সংস্কৃতবিশারদ না হলেও বেদের কথা এখন অনায়াসেই জান্‌তে পারা যায়। বেবর প্রভৃতি পণ্ডিতগণ বেদের নানাপ্রকার আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে— “Caste is not a Vedic institution” “ঋগ্বেদের যুগে জাতিভেদ ছিল না। আবার বৈদিক যুগের খাওয়া-ছোঁওয়ার বাছবিচার সম্বন্ধে একটা কথা শুনুন, অতিথি সৎকারের জন্য তখন গৃহস্থের বাড়ীতে গরু মারা হ’ত, এই জন্যে অতিথির আর একটি নাম ছিল “গোঘ্ন”। স্বর্গীয় রাজেন্দ্রলাল মিত্র অনেক পুরাতন কথা সংগ্রহ ক’রে “Beef eating in Ancient India” নামক এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সুতরাং স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এখনকার খাদ্যাখাদ্য বিচার, স্পর্শদোষে খাদ্যদ্রব্য অপবিত্র হবার ব্যবস্থা, এসব বেদে শ্রুতিতে কোথাও দেখা যায় না। এমন কি ভবভূতির সময়ও গোমাংস ভক্ষণ বিলক্ষণ প্রচলিত ছিল। মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে মহর্ষি বশিষ্ঠ অতিথি হ’লে ‘জেন আঅদেষু বসিঠ্ ঠমিস্‌সেসু বচ্ছদরী বিসসিদা’—বাছুর নিহত হ’ল এবং ‘তেন পরাবড়িদেণ জ্জেব সা বরাইআ কল্লাণিআ মড়মড়াইদা’—তিনি এসেই সেই হতভাগ্য বাছুরের অস্থিমাংস মড়মড় শব্দে চর্ব্বণ ক’রে ফেলেন; কেননা ‘সমাংসো মধুপর্ক ইতি আম্নায়ং বহুমন্যমানাঃ শ্রোত্রিয়ার্য়াভ্যাগতার বৎসতরীং মহোক্ষং বা মহাজং বা নির্বপন্তি গৃহমেধিনঃ, তং হি ধর্মসূত্রকারাঃ সমামনন্তি’—মাংস সহিত মধুপর্ক দান কর্‌বে এই বেদবাক্যের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ক’রে গৃহস্থগণ অতিথিরূপে সমাগত বেদাধ্যায়ী বিপ্র বা রাজন্যের অভ্যর্থনার জন্য বাছুর ষাঁড় বা রামছাগল প্রদান ক’রে থাকেন—ধর্ম্মসূত্রকারগণ এই রীতিকে ধর্ম্ম ব’লে বিধান দিয়েছেন।—(ভবভূতির উত্তররামচরিত, ৪র্থ অঙ্ক)।

 আমরা বলি হিন্দু হ’য়ে বেদের মত অগ্রাহ্য করে এমন কেউ নেই! কিন্তু বেদবিরোধী বিধিব্যবস্থার চাপে ধর্ম্ম যে দেশ ছেড়ে পালাবার উপক্রম করেছেন তা আমরা বুঝেও বুঝ্‌তে পারি না। শ্রুতি ও স্মৃতি যেখানে পরস্পর বিসম্বাদী সেখানে বিরোধ মীমাংসায় স্মৃতি ছেড়ে দিয়ে শ্রুতির কথাই গ্রাহ্য। কিন্তু আমাদের এমনি দশা হ’য়ে পড়েছে যে আমরা বরং সত্য ও শ্রুতি পরিত্যাগ কর্‌ব তবুও স্মৃতির অদ্ভুত বিধান ও লোকাচারের কঙ্কালরাশি কিছুতেই ছাড়্‌তে পার্‌ব না। বিচার ও যুক্তির বশবর্তী হ’য়ে কোন হৃদয়বান্ ব্যক্তি যদি অর্থহীন নির্ম্মম বিধি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন তবে সমাজ অমনি রক্ত আঁখি হ’য়ে তার কড়া শাসনের জন্যে “একঘরের মস্ত বন্দোবস্ত” কর্‌তে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠবেন। বড় দুঃখেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন—“ওই যে পশুবৎ হাড়ি ডোম প্রভৃতি বাড়ীর চারিদিকে ঘুর্‌ছে, ওদের জন্যে,—ওই অধঃপতিত, দরিদ্র পদদলিত গরীবদের জন্যে—তোমরা হাজার হাজার সাধু ব্রাহ্মণ কি করেছ? খালি বল্‌ছ ছুঁয়োনা আমায় ছুঁয়োনা! এমন সনাতন ধর্ম্মকে কি ক’রে ফেলেছ? এখন ধর্ম্ম কোথায়? খালি ছুঁৎমার্গ—আমায় ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা!”—কিন্তু বৈদিকযুগে এই ছুঁৎমার্গের অস্তিত্বই ছিল না; তখন ছিল শুধু বর্ণভেদ।

 অনার্য্যেরা ছিল কৃষ্ণকায়, কিম্ভূতকিমাকার। তাহাদের ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে সুজলা সুফলা দেশে বাস কর্‌ল গৌরবর্ণ আর্য্যেরা। অনার্য্যের সহিত সংমিশ্রণ যাতে না হয় তার জন্য আর্য্যেরা সাবধানতা অবলম্বন করেছিল;—উভয়ের মধ্যে বৈবাহিক ক্রিয়া তাই তখন প্রায়ই প্রচলিত ছিল না। আর্য্যেরা ছিল শ্রেয়,— অনার্য্যেরা নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হ’ত। প্রাচীনকালে অন্য অনেক দেশেই এইরূপ ব্যবস্থা ছিল। পুরাতন বাইবেল অনুসারে ইহুদীরা ছিল ভগবানের সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় জাতি; আর জেন্‌টাইলারা ছিল নিকৃষ্ট, অধম, অস্পৃশ্য—শিয়াল কুকুরের সামিল। মিশর দেশের পুরাতন জাতির মধ্যেও এরূপ ভেদ ছিল। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের আগে জাপান দেশের সামুরাই বা ক্ষত্রিয়গণ অন্যান্য জাতিকে হীন ব’লে ঘৃণা কর্‌ত—শিল্পী বা ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে আসা লজ্জাকর ব’লে বিবেচনা করত। জাপানের চিন্তাশীল নেতৃবর্গ ইচ্ছা ক’রে চেষ্টা ক’রে ব’লে বুঝিয়ে, ব্যষ্টির বিকাশের প্রধান অন্তরায় এই জাতিভেদ প্রথাকে সমাজ থেকে রহিত ক’রে দিয়েছেন। কিন্তু যে দেশের যেরূপ আকারেই থাক না কেন, আমাদের দেশের মত এমন সর্ব্বনাশকারী জাতিভেদ পৃথিবীর কোথাও নেই, কখনও ছিল কি না সন্দেহ! আমাদের দেশে জাতিভেদের পাষাণ-স্তূপে নির্ম্মাতা এমন উগ্র হ’য়ে প্রকট হয়েছে যে তার নিঃশ্বাসে উৎকট ঘৃণার গরল অহরহ বাহির হচ্ছে, তার চাপে পতিত জনসঙ্ঘ দলিত ও মথিত হ’য়ে নিতান্ত অসহায়ের মত একপাশে প’ড়ে রয়েছে।

 সর্ব্বপ্রকার বিভেদ ভুলে গিয়ে আপামর সাধারণের কল্যাণকামনায় বুদ্ধ যখন নূতন সত্যের প্রচার আরম্ভ কর্‌লেন—সেই প্লাবনের যুগে ব্রাহ্মণাধিকার তিরোহিত হ’য়ে ভারতবর্ষে সব একাকার হ’য়ে গেল। সেই ভাববন্যা হতে যে যুগের উদ্ভব হ’ল ভারতবর্ষের সে এক শ্রেষ্ঠ যুগ। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বিষ্ঠা ও বিজ্ঞান সর্ব্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত হ’ল; মগধ সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত হ’য়ে মহারাজ অশোকের সময় দেশবাসীকে এক নূতন জীবনের আস্বাদ প্রদান কর্‌লে। সে জীবনে জাতিভেদ একপ্রকার বিলুপ্ত হ’য়ে গেল; বিবাহাদির স্বচ্ছন্দ আদানপ্রদানে বিভিন্ন জাতি মিলে মিশে এক হয়ে গেল। বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণের আরও কতকগুলি স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বাঙ্গালীর মুখাবয়ব ও শরীরগঠন দেখে তাকে কোনমতে খাঁটি আর্য্যসন্তান ব’লে মেনে নিতে পারা যায় না। মণিপুর, কোচবিহার, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজবংশ খাঁটি আর্য্যবংশ ব’লে পরিচিত হ’তে চান। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দিয়ে কুলজী তৈয়ারী ক’রে আপন আপন বংশের ধারাকে টেনে টেনে কেউ সূর্য্য কেউ চন্দ্র কেউ বা শুক্র কেউ বা শিব পর্য্যন্ত নিয়ে যান। কিন্তু মুখের উপর যে ছাপটা স্পষ্ট হ’য়ে আছে—তাতে তাঁদের চেহারায় মঙ্গোলীয় সংমিশ্রণ বেমালুম ধরা প’ড়ে যায়। তারপর শক ও হিন্দু মিলে যে রাজপুত ও জাঠ প্রভৃতি ক্ষত্রিয় বংশের উদ্ভব হয়েছে এ কথা ইতিহাসসম্মত।

 বাংলাদেশে ১১০০।১২০০ বৎসর ধ’রে বৌদ্ধাধিকার ছিল। বিক্রমপুরে ও তার নিকট স্থানে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে বৌদ্ধযুগের বাংলার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এই সুদীর্ঘকাল ধ’রে নানাজাতির যখন অবাধ সংমিশ্রণ হ’য়ে এসেছে, যখন জাত আর আছে কোথায়? খাঁটি আর্য্যরক্ত অনেক অনুসন্ধান কর্‌লেও মিল্‌বে না। এ সম্বন্ধে কতকগুলি কথা “সমাজসংস্কার সমস্যায়” বলেছি, এখানে তার পুনরুল্লেখ নিস্প্রয়োজন (“সমাজসংস্কার সমস্যা” ১০২—৬ পৃঃ)। বৌদ্ধপ্লাবনে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুধর্ম্ম এমন আশ্চর্য্যভাবে নিঃশেষ ও লোপপ্রাপ্ত হয়েছিল যে আদিশূরের সময় বেদবিধি অনুসারে যজ্ঞ সম্পন্ন কর্‌বার উপযুক্ত ব্রাহ্মণ চেষ্টা ক’রেও একজনও পাওয়া যায়নি। তাই রাজা কান্যকুব্জ থেকে মাত্র পাঁচজন সুব্রাহ্মণ নিয়ে এসে বাংলায় বসবাস করিয়েছিলেন। এঁরা পাঁচজনে বঙ্গদেশী কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং বাংলার নব্যব্রাহ্মণের খাঁটিত্ব কোথায়? আর এক আশ্চর্য্য কথা এই যে মাত্র পাঁচজনের বংশ বরাবর সোজাসুজি চ’লে এসে নব্যবাংলায় এই ১৩ লক্ষ ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হ’ল! নানা জাতির মেলামেশা অনেকদিন ধরেই হয়েছে—এই আমাদের প্রতিপাদ্য,—তাই এসব ঘটনার উল্লেখ কর্‌ছি। রিস্‌লি প্রভৃতি নৃতত্ত্ববিদের মতে অনেক নূতন নূতন অনার্য্যজাতি হিন্দুসমাজের পার্শ্বে বসবাস কর্‌তে কর্‌তে ক্রমে হিন্দু হ’য়ে গেছে। পাঁচ ছয় শত বৎসর পূর্ব্বে আসামে অহোম নামে এক রাজবংশ ছিল। তাঁরা প্রথমে ছিলেন মঙ্গোলীয়; তাঁদের আদিবাসভূমি ছিল শ্যামদেশ। কিন্তু ক্রমে ক্রমে হিন্দুর আচার ব্যবহার গ্রহণ ক’রে তাঁরা অবশেষে হিন্দু এবং ক্ষত্রিয় ব’লে পরিচিত হলেন। সুতরাং দেখুন আমরা যে জাতি জাতি বলে চীৎকার ক’রে থাকি এবং কারও স্পর্শে কারও বা জলগ্রহণে জাত গেল ভেবে প্রমাদ গণি, তার মূলে প্রকৃত সত্যপদার্থ কিছু আছে অথবা তার ভিত্তি একটা প্রকাণ্ড কুসংস্কারের উপর—যা কোন কালেই যুক্তি বা বিচারসহ নহে?

 তারপর আমাদের এই বাংলাদেশের কৌলিন্য প্রথার কথা ধরা যাক। বল্লালসেনের সময় এই প্রথার প্রচার হয়। নবধা কুললক্ষণম্—কুলীন হ’তে হ’লে আচার বিনয় বিদ্যা প্রভৃতি নয়টি সৎগুণের অধিকারী হ’তে হয়। গুণের উপর কৌলিন্যের প্রতিষ্ঠা হ’লেও এই মর্য্যাদার অধিকারী হলেন একমাত্র ব্রাহ্মণেরা; যেন গুণরাশি ব্রাহ্মণেরই একচেটে, আর ব্রাহ্মণেতর সকল জাতিই একবারে নির্গুণ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, গুণ কি বাস্তবিকই বংশপরম্পরাগত হয় অথবা বিদ্যাশিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির উপর গুণের বিকাশ যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভর করে? কথাটা এতই সোজা যে স্কুলের ছোট ছেলেও অনায়াসে বুঝ্‌তে পারে। প্রতিভাশালী ব্যক্তির পুত্র হ’লেই কি প্রতিভার অধিকারী হ’তে হবে? সেক্ষপীয়রের বা মিল্টনের বংশে তাঁদের মত প্রতিভাশালী ব্যক্তি আর জন্মগ্রহণ করেছেন কি? পৃথিবীতে বরং ঠিক এর উল্টাই দেখা যায়। প্রকৃতির কেমন আশ্চর্য্য খেয়াল যে প্রতিভাশালী ব্যক্তির বংশে সেরূপ গুণান্বিত পুরুষ আর প্রায় জন্মায় না। আর প্রতিভার কথা ছেড়ে দিলেও যিনি প্রকৃত প্রস্তাবে গুণী কুলীন, তাঁর সন্তান যে মাতৃগর্ভ থেকে নয়টি গুণ নিয়ে ভূমিষ্ঠ হবে এমন সম্ভাবনা একটুও নেই। কুলীনের ছেলে নামে “কুলীন” হ’তে পারে, কিন্তু মনে রাখ্‌তে হবে কাঁটাগাছ উর্ব্বরক্ষেত্রেও জন্মায়! সুতরাং অপরকে হীন ও অবনত ক’রে রেখে আর এরকম একটা অন্যায় গণ্ডী টেনে আপনার জাত বাঁচিয়ে চল্‌বার মূলে কি যে সৎ উদ্দেশ্য বর্ত্তমান আছে তা দেবতা হয়ত বুঝ্‌লেও বুঝ্‌তে পারেন, কিন্তু মানুষের বুদ্ধির তা অগম্য! আবার শুনুন আশ্চর্য ব্যাপার! ঘটকপ্রবর দেবীবর বামুনদের মধ্যে মেল বাঁধ্‌লেন—বংশের দোষ দেখে দেখে একরকম দোষীদের একত্র ক’রে ক’রে; ফলে একই জাতি থেকে আবার বহু প্র-পরা-উপজাতির সৃষ্টি হ’ল। সমাজবিধি হ’ল এই যে মেলে মেলে বিবাহ দিতে হবে, মেলান্তরে বিবাহকার্য্য সম্পন্ন কর্‌লে একবারে কৌলিন্য-বিচ্যুতি,—অর্থাৎ মেলগত দোষকে বংশে কায়েমি করে না তুলে সমাজে হীন হ’তে হবে। “অঘরে” মেয়ে দিলে কুল যাবে। সুতরাং কন্যাকে “সঘরে” অর্থাৎ নিজের গণ্ডীবদ্ধ মেলের ভিতর পাত্রস্থ করাটাই কুলীন পিতার বাঞ্ছিত হ’য়ে দাঁড়াল। কিন্তু ফল হ’ল বড় বিষময়। পাত্রের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় “কুলীনের কুলরক্ষা করাই কুলীনের ধর্ম্ম” হ'য়ে উঠ্‌ল। আর ব্রাহ্মণের ছেলে কদাপি ধর্ম্মপালনে পরাঙ্মুখ নন! তাই পূর্ণ উদ্যমে কেউ ৬০, কেউ ৭০, কেউবা ৮০টি পর্য্যন্ত বিবাহ ক’রে বস্‌লেন এবং পাকা খাতায় বিবাহের ‘লিষ্টি’ ক’রে রেখে দিলেন। এসব “নিশার স্বপন সম ভাবিছ অলীক?” কিন্তু তা নয়, অনেক ভুক্তভোগী বৃদ্ধ এখনও বেঁচে আছেন। এসকল কথা বল্‌বার একমাত্র কারণ এই যে, গুণ কখন বংশগত হয় না এবং অন্যান্য অবিচারের গণ্ডী টেনে যারা আপনার দেশবাসীকে নির্ম্মমভাবে পরস্পর থেকে তফাৎ ক’রে দেয় তাদের জীবন সকলদিকেই সঙ্কুচিত হ’য়ে আসে উচ্চ আদর্শ বা সংসঙ্কল্পের কথা তারা প্রায় ভুলে যায়।

 অপরকে হীন অন্ত্যজ নীচ ছোটলোক ব’লে ঘৃণা কর্‌বার অধিকার আমাদের কোথায়? আভিজাত্যহীন তথাকথিত নীচজাতির গৃহে কি পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ পুরুষ জন্ম গ্রহণ করেন নি? পৃথিবীতে যাঁরা ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠাতা, ধর্ম্মজগতে যাঁরা একটা মহাপ্লাবন বহিয়ে দিয়েছিলেন, সেই নব মহাত্মাদের অনেকেই আভিজাত্যমণ্ডিত ছিলেন না। যীশু ছুতোরের ছেলে! ভক্তবীর কবীরের জন্ম নীচ জোলার ঘরে। ভক্তমালে রুহিদাস প্রভৃতি অনেক সাধুর বর্ণনা আছে যাঁরা হীন বংশে জন্মলাভ করেছেন। মান্দ্রাজে হীনবংশোদ্ভব অনেক তামিল সাধু ছিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে অনেক পীর ছিলেন যাঁদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে মন্দির ও দর্‌গা নির্ম্মিত হয়েছে এবং উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণগণ যাঁদের দেবজ্ঞানে পূজা করেছেন। বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বামুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন নি। বশিষ্ঠ, নারদ, ব্যাস প্রভৃতি দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ উচ্চবংশোদ্ভূত নন—কেউ বা দাসীপুত্র, কেউ বা বেশ্যাপুত্র। সকল দেশেই এরূপ হয়েছে, মহাপুরুষগণ সকল দেশেই সমাজের সকল রকম স্তরে আবির্ভূত হয়েছেন। সুতরাং কেন এই কপটাচার? কেন এই ঘৃণা ও নির্ম্মমতা? কেন মানুষের মুখদর্শনে পাপ, তার ছায়াস্পর্শে প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা?

 অত্যাচারী রাজা প্রথম চার্ল্‌সের রাজত্বকালে ইংলণ্ডের প্রজাশক্তি রাজার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে। এই অন্তর্বিপ্লবের ইতিহাস (Buckle’s History of Civilization) পাঠ কর্‌লে তৎকালীন ইংলণ্ডীয় সমাজের নীচ ও উচ্চজাতি সম্বন্ধে একটা বড় কথা জানা যায়। কথাটা এই যে যতদিন প্রজাশক্তিকে চালিত কর্‌বার জন্যে উচ্চবংশজাত ব্যক্তিকে সেনাপতি নির্ব্বাচিত করা হয়েছিল ততদিন প্রজাপক্ষ জয় লাভ করেনি। তারপর যখন জনসাধারণের মধ্য থেকে যুদ্ধনেতার আবির্ভাব হ’ল, তখন রাজার দল পরাজিত হ’ল জনসাধারণের চেষ্টা জয়শ্রীমণ্ডিত হ’য়ে উঠল। নেপোলিয়ন তাঁর ভগ্নী কারোলিনাকে মুরা নায়ক যোদ্ধার হাতে সম্প্রদান করেন; তিনি সরাইওয়ালার (inn keeper) পুত্র ছিলেন। নেপোলিয়নের নিকট পুরুষকার আভিজাত্যের একমাত্র নিদর্শন ছিল। তিনি কি সৈনিক বিভাগে, কি শাসন বিভাগে যোগ্যতা ও গুণ অনুসন্ধান ক’রে সমাজের যে কোন স্তর হতে লোকদের উন্নীত কর্‌তেন।

 নেপোলিয়নের কার্য্যনীতির একটা বিশেষ অঙ্গ এই ছিল যে তিনি বরাবর গুণেরই আদর কর্‌তেন; যথার্থ গুণী, তা সে সমাজের যে স্তর থেকেই আসুক না কেন, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে সামরিক রাজনৈতিক প্রভৃতি সকল বিভাগে দায়িত্বপূর্ণ পদ প্রাপ্ত হ’ত। কর্ম্মতৎপরতার ফলস্বরূপ লোকের পদোন্নতি লাভ হ’ত! তার কোন্ কুলে জন্ম সে পরিচয় কেউ নিত না। ক্রম্‌ওয়েল মদ প্রস্তুত করতেন। তিনি যে সকল সেনানায়ক নিযুক্ত করতেন তার মধ্যে অনেকেই “নীচ” বংশোদ্ভূত। কেউ বা মুদি, কেউ বা ফেরিওয়ালা, কেউ বা পরিচারক, কেউ বা ভিক্ষান্নপালিত, কেউ বা চামার, কেউ বা মুচি, কেউ বা “জুতি সেলাই”! বাক্‌ল্ বলছেন “the highest prizes being open to all men, provided they displayed the requisite capacity” এই “জুতি সেলাই” বলতে আর একটি কথা মনে পড়্‌ল। শ্রীরামপুরের মিশনারীদের অগ্রণী বিখ্যাত উইলিয়ম কেরীও এই ব্যবসায়ী ছিলেন। অর্থাৎ আমার প্রতিপাদ্য এই যে জাতিভেদরূপ বিষময় প্রথার এই ফল দাঁড়িয়েছে যে আমাদের দেশে যারা হীন শ্রেণীর তারা এমন পদদলিত, অবমানিত, ঘৃণিত, লাঞ্ছিত, অবজ্ঞাত, যে কোন সুযোগে তাদের প্রতিভা বিকশিত হবার ও ভদ্রশ্রেণীস্থ হবার উপায় নেই।

 সুতরাং বর্ত্তমান য়ুরোপ বা আমেরিকায় জাতিভেদ আছে, অতএব আমাদের দেশেও জাতিভেদ কোন ক্ষতির কারণ হ’তে পারে না— এই ব’লে চীৎকার ক’রে যাঁরা পুরাতনের কঙ্কাল এখনও আঁক্‌ড়ে ধরে রাখ্‌তে চান, তাঁরা একবার যুক্তিহকারে বিবেচনা ক’রে বুঝে দেখ্‌বেন যে পাশ্চাত্য দেশে আভিজাত্যের সম্মান এদেশের মত একটা নিছক পাগলামি নয়। তাঁতি, জোলা, গাড়োয়ানের ঘর থেকে এদেশে কজন বড়লোক হবার সুযোগ পেয়েছে? এদেশে যদি তেলির ঘরে জন্ম হ’ল ত মানুষ চিরকাল তেলিই রয়ে গেল,—সে যত গুণের গুণী হোক না কেন সমাজে খানিকটা হেঁট হ’য়ে থাকতেই হবে, গুণ থাক্‌লেও সমুচিত আদর সে কখন পাবে না। শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ আজ লর্ড হয়েছেন বিলাতী আভিজাত্যের নিয়মে, কিন্তু আমাদের দেশে যিনি কুলীন বামুন হ’য়ে না জন্মেছেন তিনি আর তা হ’তে পারবেন না। লর্ড রবার্ট্‌স্ জীবনের প্রারম্ভে ছিলেন সামান্য সৈনিক; কিন্তু সামরিক বিভাগে অসাধারণ গুণপনার পরিচয় দিয়ে শেষে সমাজে শ্রেষ্ঠ আভিজাত্য লাভ করিয়াছিলেন। লর্ড কিচ্‌নারও তাই। এরূপ আরও অনেকের নাম করা যেতে পারে যাঁরা বিদ্যাবিজ্ঞানে, ব্যবসাবাণিজ্যে, কৃষিশিল্পে সর্ব্বপ্রকার কর্ম্মক্ষেত্রে গুণের পরিচয় দিয়ে, অসাধারণত্ব দেখিয়ে, সামান্য থেকে বড় হয়ে উঠেছেন এবং পাশ্চাত্য সমাজ তাঁদের বড় ব’লে, শ্রেষ্ঠ ব’লে, গুণান্বিত ব’লে আদর ক’রে বরণ ক’রে নিয়েছে। ইংলণ্ডে চাষার ছেলে, মুদীর ছেলে, অক্‌স্‌ফোর্ড বা কেম্‌ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বৎসর অধ্যয়ন ক’রে অভিজাত শ্রেণীর সকলপ্রকার রীতিনীতি আচার ব্যবহারের সহিত পরিচিত হয়। এইরূপ লেখাপড়া শিখে গুণী হ’য়ে সে পুরাদস্তুর Gentleman হয়। আমেরিকায় প্রজাশক্তির চূড়ান্ত উন্মেষ হয়েছে; তাই সেখানে দেখা যায় সামান্য কুটীরে জন্মগ্রহণ ক’রে সমাজের সর্ব্বনিম্নস্তর থেকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠস্তরে উঠেছিলেন রাষ্ট্রনায়ক মহামতি গারফিল্ড। সে দেশে আজ যে মুটে মজুর খান্‌সামার কাজ করছে, কাল সে বিদ্যার্জ্জনের জন্যে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। কেউ বা যে-কলেজে চিম্‌নী পরিষ্কারের কাজ করে সেই কলেজেই আবার পড়্‌ছে। তার সহপাঠী ক্রোড়পতির সন্তান যদি তাকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করে তবে সেই ধনী সন্তানকে নানাপ্রকার লজ্জা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। সেখানে আজ যে কাঠ কাটে আর একদিন সে দেশের রাষ্ট্রনায়ক (President) হবার আশা রাখতে পারে। সুতরাং এমন বড় কুলীন সেখানে কে আছে যে তাঁকে কন্যাদান করবে না? আমি এখানে পাশ্চাত্য সমাজ-নীতির বিচার করছি না, আমার প্রতিপাদ্য এই যে পাশ্চাত্যদেশের জাতিভেদ ও ভারতবর্ষের জাতিভেদের মধ্যে তফাৎ অনেক। আমাদের দেশে জাতিভেদপ্রথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে মানুষকে মানুষ ব’লে স্বীকার করেনি; আপন ভাইকে পর ক’রে দিয়েছে; তার মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে; সে তুচ্ছ ঘৃণ্য, সে অযোগ্য ও জঘন্য, এই কথাই প্রচার ক’রে এসেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যদেশের জাতিভেদ মানুষে মানুষে ব্যবধানের এমন অনুল্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর তুলে দেয়নি, মানুষের উন্নতি ও বিকাশের পথে এমন অন্তরায় হয়নি।

 বাংলাদেশের লোকসংখ্যা এখন সাড়ে চার কোটী। তার মধ্যে ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য মিলে মোট ২৩ লক্ষ মাত্র। সমস্ত লোকসংখ্যার তুলনায় এঁরা কজন? সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। কিন্তু লেখাপড়া জ্ঞানের অনুশীলন এবং সামাজিক রাজনৈতিক প্রভৃতি নানাবিষয়ের আলোচনা এদের মধ্যেই অনেক পরিমাণে সীমাবদ্ধ। অন্যান্য সকল জাতি প্রায় এসব বিষয়ে এঁদের বহু পশ্চাতে প’ড়ে আছেন। এক্ষণে আপন শিক্ষা দীক্ষা, অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও জ্ঞানান্বেষণের ধারাকে দিন দিন পুষ্ট ও প্রবল ক’রে তুলে যদি সমগ্র জাতিকে বেঁচে থাকতে হয় তবে প্রকৃত কর্ম্মীর আবির্ভাব ২৩ লক্ষ উঁচু জাতের মধ্য হ’তে অধিক সংখ্যক হবে অথবা যাদের আমরা নীচজ়াত আখ্যা দিয়ে দূরে ঠেলে রেখে দিয়েছি সেই চার কোটিরও অধিক জনসংঙ্ঘ অধিক সংখ্যক কাজের লোক উৎপন্ন ক’রে সমাজকে পুষ্ট কর্‌বে? সকল দেশে সমাজের সর্ব্বপ্রকার স্তর হতে প্রতিভার বিকাশ হয়েছে। সুতরাং এই দুর্দ্দিনে আজ একবার আমাদের ভেবে দেখা উচিত যে এই বিরাট জনসঙ্ঘকে নিকৃষ্ট ব’লে অবজ্ঞা ক’রে আমরা কত উৎকৃষ্ট জিনিষের অপচয় কর্‌ছি, সামাজিক অত্যাচারে ও শিক্ষাদীক্ষার অভাবে আমাদের কতটা শক্তি বিকাশলাভ না ক’রে লোকচক্ষুর আড়ালে মুস্‌ড়ে পড়ছে। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে হচ্ছে। বাঙালীর আজ সামরিক বিভাগে প্রবেশের পথ কতকটা উন্মুক্ত হয়েছে; ক্রমে আরও উন্মুক্ত হবে। বাঙ্গালী সেনা নিয়ে যে সৈন্যদল গঠিত হবে তাতে কি শুধু উচ্চজাতিরই লোক থাকবে অথবা সমাজের সকল স্তর থেকে সুস্থ ও সবলদেহ লোক সংগ্রহ ক’রে সেই সৈন্যদলকে পরিপুষ্ট কর্‌তে হবে? বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা অর্দ্ধেক; তাদের মধ্যে জাতিভেদ নেই, সুতরাং তাদের কথা এখন বাদ দিলাম। কিন্তু বিভিন্নজাতির হিন্দুসেনা যখন কোন, অভিযানে বাহির হবে তখন বামুন রাঁধুনীর অভাব হ’লে কি তারা যে-যার হাঁড়ি মাথায় ক’রে কুচকাওয়াজ কর্‌বে? আজকাল ট্রেঞ্চ অর্থাৎ খাদের মধ্যে আত্মগোপন ক’রে যুদ্ধ করতে হয়; সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখ্‌লেই শত্রুর গুলিতে বিদ্ধ হ’তে হবে। সুতরাং শাণ্ডিল্য, বাৎসায়ন বা ভরদ্বাজ—এঁদের মধ্যে কার বংশধর ট্রেঞ্চে খাবার জুগিয়ে দিয়ে গেল তার আবিষ্কার কর্‌বার চেষ্টা কর্‌লে সে খাবার কখনও মুখে তুল্‌তে হবে না। আজ এই বিজ্ঞানপ্লাবনের যুগে সকল দেশে সকল সমাজের অবস্থা এরূপ পরিবর্ত্তিত হয়েছে যে পৃথিবীতে বেঁচে থাক্‌তে হ’লে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন ক’রে ব্যবস্থার পরিবর্ত্তনও আমাদের পক্ষে অনিবার্য্য হয়ে পড়েছে। এই সামঞ্জস্যস্থাপনের চেষ্টায় যে যে পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাদ দিতে হবে তার মধ্যে জাতিভেদের কঠোর নির্ম্মমতা প্রথম এবং প্রধান!

 জাতিভেদের বজ্রকঠোর বন্ধন বাংলা দেশে তবু ত অনেকটা শিথিল হয়েছে। বাংলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যের পরই নবশাখজাতি সমাজে স্থান পেয়েছেন এবং তাঁদের জল “চল” হয়েছে। সামাজিক অবস্থার পরিবর্ত্তনে, ও শিক্ষাদীক্ষার গুণে অন্য অন্য অনেক জাতি বাংলাদেশে ক্রমে ক্রমে মুখ তুলে দাঁড়াচ্ছেন এবং এক “অচলায়তনে”র নিতান্ত গোঁড়া বামুন ছাড়া আর কেউই তাঁদের ঘৃণা ক’রে দূরে ঠেলে দিচ্ছে না। কিন্তু মান্দ্রাজে জাতিভেদের শাসন এখনও বড় ভয়ানক। সেখানে আয়ার ও আয়েঙ্গারগণ ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণেতর সকল জাতিই নীচ ও অস্পৃশ্য। নবশাখ প্রভৃতি যেসব জাতি বাঙালী হিন্দুসমাজে একটা মাঝামাঝি স্থান অধিকার ক’রে আছেন মান্দ্রাজী হিন্দুসমাজে সেরূপ কিছু নেই। মান্দ্রাজে পেরিয়া নামে এক সম্প্রদায় আছে, তাদের অবস্থা বড়ই হীন। তারা বংশের পর বংশ ধরে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্য্যন্ত মাথা হেঁট ক’রেই থাকে, তাদের ছায়া স্পর্শ করলে ব্রাহ্মণকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, এতই তারা অভিশপ্ত ও অপবিত্র! স্বর্গগত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় তামিল দেশ ভ্রমণকালে এক সম্প্রদায় লোক দেখেছিলেন; তারা দূর থেকে চীৎকার কর্‌তে কর্‌তে আসে—“মহাশয় স’রে যান আমি অধম যাচ্ছি।” পাছে তার ছায়াস্পর্শে ব্রাহ্মণের পবিত্রতা উড়ে যায়—তাই এই ব্যবস্থা। আবার কোন হতভাগ্যের গলায় ঘণ্টা বাঁধা আছে, চল্‌তে গেলেই ঘণ্টা বাজে আর সেই শব্দ শুনে শুচি ব্রাহ্মণ অশুচিতার আগমন-বার্ত্তা জান্‌তে পেরে ছুটে পালান। আবার এইসকল নীচজাতের নাম শুন্‌লে আশ্চর্য্য হ’য়ে যেতে হয়। সেখানে বামুনদের নাম রামস্বামী, কুমারস্বামী; কিন্তু এইসব অন্ত্যজবংশীয়দের নাম হবে সাপ, ব্যাঙ, পিপ্‌ড়ে কেঁচো, ছুঁচো! কি ভয়ানক ব্যাপার! বাংলার হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, মুদ্দফরাস ওদের চেয়ে খুব ভালো আছে—তাদের আরো ভালো, আরো বড় ক’রে তুল্‌তে হবে—গুণবান্ শীলবান্ হলে তাঁরাও ব্রাহ্মণের সম্মান পাবার অধিকারী এ কথা মনে রাখ্‌তে হবে।

 আমরা যে কারণে ইংরেজের নিকট রাজনৈতিক অধিকারের দাবী কর্‌ছি, নীচজাতি ব’লে যাদের ঘৃণা করি তারাও ঠিক সেই কারণেই সামাজিক অধিকার দাবী কর্‌ছে। বাংলা দেশে জাতিভেদের কঠোরতা কম; তবুও এখানে নমঃশূদ্র ও পোদ প্রভৃতি জাতি লেখাপড়া শিখে সামাজিক অত্যাচারের কারণে উঁচুজাতের উপর খড়্গহস্ত হ’য়ে উঠ্‌ছেন। মান্দ্রাজের ডাক্তার নায়ার অব্রাহ্মণ সমাজের মুখপাত্র স্বরূপে একটি দল বেঁধে গেছেন। সেই দল এংগ্লো-ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে কতকটা এক হয়ে আমাদের রাজনৈতিক অধিকারের পথে বাধা দিচ্ছেন। বাংলা দেশে নমঃশূদ্রের মধ্যেও এরূপ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। এঁরা বল্‌ছেন—নূতন শাসন সংস্কারে অব্রাহ্মণদের স্বত্ব রক্ষার জন্য যদি গোড়া থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা না হয়— তবে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে নূতন সুখ সুবিধার সব অধিকারই ক্রমে ব্রাহ্মণগণ একচেটে ক’রে নেবে। তা ছাড়া আমাদের মুসলমান ভ্রাতারা লোকসংখ্যা হিসাবে অর্দ্ধেক ব’লে communal representation সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধি বাগিয়ে নিচ্ছেন। এই সকল মতামতের ভালমন্দ আলোচনা কর্‌বার জন্য আমি একটা কথাও বল্‌ছি না। আমি বল্‌তে চাই এই যে এদিকেও আমাদের সামাজিক সঙ্কীর্ণতা ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে। যে অধিকারটুকু ইংরেজ আমাদের দিতে চায় আমাদেরই দেশবাসী আজ তাতে আপত্তি তুল্‌ছে,—কেন না আমরা অনেক কাল ধ’রে তাদের ঘৃণা করেছি এবং এখনও কর্‌ছি; তাই তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে।

 জাতির গঠন ও বিকাশে এই জাতিভেদ অনেক পরিমাণে বাধা দিয়েছে। পরস্পরের মধ্যে বিবাহের আদানপ্রদান নেই; তার উপর “ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা” এই রব কর্‌তে কর্‌তে সকলেই এক-একটা গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হ’য়ে পড়েছে। হিন্দুমুসলমান ত বরাবরই আলাদা হ’য়ে আছে। এ অবস্থায় কবি ভাবের আবেগে ব’লে থাক্‌তে পারেন “একবার তোরা জাতিভেদ ভুলে” ইত্যাদি। কিন্তু এতদিনের বন্ধন এককথায় খ’সে পড়্‌বে কি? আমার লিখিত “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস” (History of Hindu Chemistry) নামক পুস্তকের “বিজ্ঞান ও শিল্পের অবনতি” (Decline of Science) শীর্ষক অধ্যায়ে আমি জাতি সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলেছি। চরক ও সুশ্রুত দেশীয় চিকিৎসা প্রণালীর দুখানি মহাগ্রন্থ। এতে অবস্থা-বিশেষে এমন কি গোমাংস খাবারও কথা আছে। সুশ্রুতে শবব্যবচ্ছেদের রীতিমত ব্যবস্থা ছিল; কিন্তু মনু মহাশয় বলেন শবস্পর্শ হ’লে জাতিচ্যুত হ’তে হবে। সুতরাং ব্যবস্থা হ’য়ে গেল শবব্যবচ্ছেদের স্থানে অতঃপর লাউ ব্যবচ্ছেদ হবে; অর্থাৎ লাউ কেটে মনুষ্য-শরীরের শিরা-উপশিরা প্রভৃতির সংস্থান জানতে হবে। ব্যবস্থাটা কতকটা সেই কলাগাছ বিয়ে কর্‌বার মত নয় কি? জাতিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে এমনি ক’রে যখন স্বাধীন চিন্তার গলা টিপে মারা হ’ল, তখন ৬৪ কলাবিদ্যা লোককে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন ক’রে অন্তর্হিত হ’য়ে গেল। বিজ্ঞানের যা কিছু রইল—তা Surgeon পরামাণিক, Botanist বেদে আর Metallurgist ভীল কোল সাঁওতালের হাতে। আঙুলের নৈপুণ্যে ঢাকাই মস্‌লিন অতি সুক্ষ্ম হ’ল বটে, কিন্তু মস্তিষ্কের দৌড় ওই “পাত্রাধার তৈল” বা “তৈলাধার পাত্রের” বেশী আর গেল না। বুদ্ধি জড় ও আড়ষ্ট হ’য়ে উঠ্‌ল। তাই পর্য্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের দ্বারা বস্তুর অস্তিত্ব বিচার ক’রে ঘটনাপরম্পরার কার্য্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা লুপ্ত হ’ল। সামাজিক অত্যাচারের ফলে সাধারণ লোক অস্পৃশ্য ও মূর্খ হ’য়ে পশুত্বে নেমে গেল। ওদিকে আর্করাইট (Arkwright) নাপিত ছিলেন, ক্ষৌরকর্ম্মের দ্বারা জীবিকা অর্জ্জন করিতেন—কিন্তু স্বীয় অসাধারণ প্রতিভাবলে আবিষ্কার ক’রে বস্ত্রবয়ন-কলে যুগান্তর উপস্থিত করেন। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি আমাদের দেশে কোন্ নাপিত এ প্রকার কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম? তাই এদের মধ্য থেকে জেমস্‌ওয়াট বা আর্করাইটের উদ্ভব অসম্ভব হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে স্বাধীন চিন্তা ও কর্ম্মশক্তি লুপ্ত হ’য়ে গিয়ে বিদ্যা ও বিজ্ঞানচর্চ্চার যে শোচনীয় অবস্থা হয়েছে তার জন্য জাতিভেদ বড় কম দায়ী নয়।

 প্রেসিডেণ্ট উইল্‌সন তাঁর New Freedom নামক পুস্তকের এক স্থানে আমেরিকার বিশেষত্ব সম্বন্ধে বল্‌ছেন যে সে দেশের রাস্তার মুটে পর্য্যন্ত রাষ্ট্রনায়ক হবার আশা পোষণ কর্‌তে পারে; কে দেশের নেতা হবে এবং কোন্ কুলে তার জন্ম হবে যুক্তরাজ্যে একথা কেউ নিশ্চিত ক’রে বলতে পারে না। সুবিধা ও সুযোগ জনসাধারণের সকলের কাছে সমানভাবে উন্মুক্ত; সুতরাং সমাজের যে কোন স্তর থেকে সেখানে দেশনায়কের উদ্ভব হ’তে পারে। প্রেসিডেণ্ট উইলসন আরও বলেন যে সমাজের চিন্তা ও কর্ম্মশক্তি পুষ্ট হয় নিম্নস্তরের লোকের দ্বারা। জনসাধারণের মধ্য হইতেই যথার্থ শিক্ষিত ও গুণসম্পন্ন লোক উদ্ভূত হ’য়ে দেশের ভাব ও কর্ম্মের ধারাকে নানা অবদান পরম্পরায় বিচিত্র ক’রে তোলে। এই ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যে সমাজের উচ্চস্তরের মুষ্টিমেয় লোকের সামর্থ্য যথেষ্ট নয়। সমাজদেহের শারীরিক মানসিক ও নৈতিক—সকল প্রকার পুষ্টির উপাদান জনসাধারণের মধ্যে যেরূপ প্রচুর পরিমাণে বর্ত্তমান আছে, উচ্চস্তরের অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে সেরূপ থাকা কখনও সম্ভব নয়। সুতরাং জাতির দোহাই দিয়ে সেই বিপুল জনসঙ্ঘকে পদদলিত ক’রে আমরা জাতিগঠনে যে কত বাধার সৃষ্টি করেছি তা বর্ণনা অপেক্ষা কল্পনারই অধিগম্য। বর্ত্তমানে আমাদের শাসন-সংস্কারের দাবীকে ইংরেজ মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোকের চীৎকার ব’লে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জনসাধারণ যখন একবার এই দাবী করবে তখন কেউ তাকে আট্‌কাতে পারে কি? পৃথিবী জুড়ে জনসাধারণের যুগ এসেছে। আমাদেরও এই যুগকে আনন্দ ও উৎসাহের সহিত বরণ ক’রে নিতে হবে। আপনার দেশভাইকে অস্পৃশ্য ব’লে আর দূরে রাখলে চলবে না।

 এখন আমরা সভ্যজগতে সকল জাতির সঙ্গে এক আসরে বসতে চাই; পৃথিবীর জাতিসঙ্ঘে (League of Nations) স্থান পেতে চাই। কিন্তু অন্যে আমাদের কি চক্ষে দেখে আজ তা তোমাদের ভেবে দেখতে হবে: বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র আমেরিকা প্রভৃতি সভ্যদেশে ভারতবর্ষের যোগ্য প্রতিনিধি ব’লে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সে আরম্ভ মাত্র—কোকিলের প্রথম গান বসন্তের আগমনবার্ত্তা ঘোষণা করে মাত্র। দারিদ্র্য ও সামাজিক অত্যাচার প্রভৃতি নানা দোষের জন্য আজও আমরা অস্ত্র জাতির অশ্রদ্ধার পাত্র হ’য়ে আছি। আমাদের অন্তর সমৃদ্ধ হ’য়ে অদূর ভবিষ্যতে নানাকর্ম্মে বৈচিত্র্যে বিকাশলাভ করবে না কি? দেশীয় রাজ্যের একজন সুপ্রসিদ্ধ রাজনীতিজ্ঞ সার টি মাধব রাও হিন্দু সমাজের বৈষম্যকে লক্ষ্য ক’রে বড় দুঃখে বলেছেন—এই সব বৈষম্য ও তজ্জনিত ক্লেশ আমরা আপন হাতে সৃষ্টি ক’রে আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি। সুতরাং সভ্যভাবে চেষ্টা করলে এর প্রতিবিধানও আমাদের আপনারই হাতে!—আমাদের যুক্তি নেই, বিচার নেই, কুফলপ্রসু অতি তুচ্ছ লোকাচারকে আমরা মনু, রঘুনন্দন প্রভৃতি দোহাই দিয়ে সাগ্রহে আঁকড়ে থাকি। “কেন” ব’লে কেউ যদি প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ জবাব দিই—“কি আশ্চর্য্য! ও যে চিরকাল হ'য়ে আস্‌ছে গো!” আমরা বিলাতী বিস্কুট খাবো, বরফ দিয়ে সোডা লেমনেড খাবো, কিন্তু জাতিবিশেষের কেউ যদি হাতে ক’রে এক গ্লাস জল দেয় অথবা আমাদের চৌকাঠ মাড়ায় তাহলে অমনি চীৎকার—“জাত গেল, হাঁড়ি ফেল, স্নান কর!” অদ্ভুত ব্যাপার! তারই ফলে আমরা ব্রাহ্মণ-শূদ্র মিলে সকল জাতিটাই বিদেশের অগ্রসর জাতিদের কাছে হেয় অস্পৃশ্য অপাংক্তেয় হয়ে আছি। যতকাল নিজেদের স্বভাব শোধন না করব, ততকাল এমনি থাক্‌তে হবে। সুতরাং সাধু সাবধান!