আজকের আমেরিকা/আতলান্‌তিক সাগরের বুকে

উইকিসংকলন থেকে


আতলান্‌তিক সাগরের বুকে

 উত্তরে মেরু হতে শুরু করে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত আতলান্তিক সাগর বিস্তৃত। কেপটাউন হতে লণ্ডনে আমি জাহাজে করেই এসেছি কিন্তু তাতে আতলান্তিকের গন্ধ যেন পাইনি বলেই মনে হয়েছিল। এবার আমি খাঁটি আতলান্তিক সাগর পার হব। এই উদ্দীপনা যদিও আমার মন আমেরিকার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তবুও লণ্ডন নগর পরিত্যাগ করতে কি যেন একটা সংকট এসে দেখা দিচ্ছিল। এখানে বসে ইউরোপের তাজা সংবাদ যেমন পাওয়া যায় আমেরিকায় গেলে কি সেরূপ তাজা খবর পাব? ইউরোপ হবে রণাংগণ, ইউরোপই হবে ভবিষ্যতের মানব জাতির ইতিহাস গড়বার স্থান; সেই ভাংগা গড়ার দৃশ্য দেখব, না আমেরিকায় গিয়ে নতুন পৃথিবী দেখব তাই নিয়ে একটু চিন্তা করতে হয়েছিল। এদিকে জাহাজের টিকিট কেনা হয়ে গেছে, যদি তাই না হ’ত তবে হয়ত আমেরিকা যেতামই না।

 লণ্ডনে ভারতবাসীর যেমন সভা সমিতি হচ্ছিল, তেমনি গ্রীক, তুরুক, স্লাভ, ফ্রেন্‌চ, আরব, জু এসবের রেস্তোরাঁয়ও ভবিষ্যতের যুদ্ধ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছিল। আরব এবং জু একই টেবিলে বসে যখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করত, সে দৃশ্য দেখতেও আমার ভাল লাগত। আরব এবং জুতে যে প্রভেদ গড়ে উঠেছে তা বাস্তবিক তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সাময়িক ভাবে তৈরী করা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরব এবং ইহুদীতে যে মনোবিবাদ থাকবে না তার শুধু ইহাই প্রমাণ নয়, এসম্বন্ধে আরও দেখেছি আরও শুনেছি। এসব দেখবার জন্যই লণ্ডন তখনকার দিনে আমার কাছে বেশি আরামদায়ক ছিল।

 বিদেশী ব্যবসায়ী মহলেও যাওয়া-আসা করেছি। এদের মধ্যে তুরুক, বুলগার, শ্লাভ, মাঝারু, জার্মান, স্প্যানিস, ইটালিয়নো―অনেকের সংগে কথা বলেছি। প্যালেস্টাইনের ইহুদী এবং আরবদের একই রেস্তরাঁয় বসে খেতে দেখেছি। সকলের মুখে এক কথা,―এমন করে জীবন আর কয়দিন কাটবে। যেন সকলেই কিছু একটা পরিবর্তন চায়। পরিবর্তন কোন্ দিক দিয়ে কি প্রকারে আসে, তাই দেখবার জন্যে যেন সকলেই উৎসুক। মাঝে মাঝে দৈনিক ‘ডেলি ওয়ারকার্‌’ পাঠ করতাম। তার সম্পাদক আমাদের দেশের লোক। সেই সংবাদপত্রে কণ্টিনেণ্টের রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনা থাকত এবং ভারতের সংগে তার তুলনাও হত। শুনলাম, ভারতীয় ছাত্রেরা এই সংবাদপত্র পাঠ করতে ভয় পায়।

 লণ্ডন পরিত্যাগ করার দিন পুঁটলি পাঁটলা বেঁধে মিঃ দত্ত এবং গ্রীক সাথীটিকে সংগে নিয়ে ওয়াটারলু স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। প্রত্যেক গাড়িতে যাঁরা যাত্রী তাদের নাম লেখা ছিল। আমারও নাম লেখা ছিল। আমার কম্পার্টমেণ্টে দুজন প্রফেসর এবং একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, আমাকে নিয়ে চারজন। আমাদের দেশের তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ির কথা মনে হওয়ায় বড়ই দুঃখ হল। কম্পার্টমেণ্টে উঠে মনে হল সংবাদপত্রের কথা তাই সাথীদের সংবাদপত্র কিনে দিতে বললাম। সাথীরা সেদিন সকালের পাঁচখানা সংবাদপত্র কিনে আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিলেন। গাড়ি চলল সাউথ্‌হাম্‌টনের দিকে। গাড়ি কোথাও থামল না। আমি একাগ্রভাবে পথের দুদিকের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। পথের দুদিকের সৌন্দর্য আমাদের দেশের মতই। ফ্রান্‌সের সৌন্দর্য বোধে এবং ব্রিটেনের সৌন্দর্য বোধে অনেক প্রভেদ। ফ্রেন্‌চরা গাছের ডাল কাটে যখন গাছে নতুন পাতা গজায়। এরা শুকনা ডালও ভাংগে না। আমাদের দেশে অভাবে পড়ে অনেকে আজকাল হয়ত শুকনা ডাল ভাংগে কিন্তু পূর্বে তা করত না। এখানে ফ্রেন্‌চ রুচি এবং ব্রিটিশ রুচিতে অনেক পার্থক্য দেখা যায়।

 গাড়ি সাউথহামটনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি ইচ্ছা করেই সকলের শেষে নামলাম। আমি জানতাম কষ্ট আমার পথ আগলে বসে আছে। গাড়ি হতে নেমে জর্জিক জাহাজের দিকে অগ্রসর হলাম। পাশেই দাঁড়ানো নরম্যানডিও আমেরিকায় যাবে। জর্জিকে যারা যাবে, তারা জেঠির পথ ভিড় করে বন্ধ করেছে। আমার তাতে লাভই হল, আমি দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলাম। চীনা যুবকগণ নিজেদের দেশের সৈনিকের পোষাক পরে জাহাজে উঠছে, তারা চলেছে লড়তে জাপানীর সংগে। তাদের সকলের মুখেই হাসি। অন্যান্য জাতের লোকও বুক উঁচু করে পথে চলছে। শুধু আমারই মুখ ম্লান। আমি বোধহয় এতবড় ডক্‌টাতে একমাত্র ভারতবাসী ছিলাম।

 সকলে পাসপোর্ট দেখিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠল আমার বেলা কিন্তু অন্য রকমের ব্যবহার। আমার মুখ দেখেই পাসপোর্ট অফিসারের পিলে চমকে গেল। একজন অফিসার আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি গিয়ে একটা বেন্‌চে বসলাম এবং নানা কথা ভাবতে লাগলাম। ভাবছিলাম আজ হায়দরাবাদের নিজাম যদি আমার মত এখানে এই অবস্থায় পড়তেন, তা হলে তাঁর অবস্থা কেমন হত? অবশ্য জাহাজ আমাকে ফেলে যাবে না তা আমি ভাল করেই জানতাম। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “এ টিকিট কে আপনাকে বিক্রি করেছে?”

 “জাহাজ কোম্পানি।”

 “আমেরিকার ভিসা আছে?”

 “আছে।”

 “কৈ দেখি?”

 “এই দেখুন।”

 “বহু পুরাতন।”

 “তা পুরাতন বটে।”

 “সংগে কত টাকা আছে?”

 “এ কথা তো অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করেননি, আমার বেলায় কেন?”

 “আমার ইচ্ছা। এ জাহাজে হয়ত আপনার যাওয়া হবে না।”

 “আপনাদের অনুগ্রহ।”

 পাসপোর্ট এবং টিকিট নিয়ে অফিসারটি আর এক অফিসারের কাছে দৌড়াল। উভয়ে মিলে কোথায় টেলিফোন করল, তার পর ফিরে এসে বলল, “আপনি এই জাহাজেই যেতে পারেন।” আমি তাদের বললাম, “আপনারা যে আচরণ করেছেন, তা শিষ্টাচার নয়, তবু সেজন্য আপনাদের উপর আমার রাগ হয়নি। দোষ আমারই, কারণ আমি পরাধীন দেশের লোক।”

 অফিসার বলল, “পরাধীন জাতের মধ্যেও সিংহের জন্ম হয়―চলুন আপনার পিঠের ঝুলিটা এগিয়ে দিই।” এই কথা বলে সত্যিই লোকটি আমার ঝোলাটা নিয়ে আমার সংগে জাহাজের সিঁড়ি পর্যন্ত চলল। জাহাজে উঠে একটু শান্তি পেলাম এবং লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দিলাম।

 আমার কেবিনের নম্বর আমার জানা ছিল। দেখতে লাগলাম কোনদিকে সেই কেবিন। একজন লোক এসে আমাকে কেবিন দেখিয়ে দিল। পিঠ-ঝোলাটা সেখানে রেখে, টুপিটা খুলে, একটু বসলাম। বেশ আরাম বোধ হল। তারপর ভাবতে লাগলাম, আমার জীবনের, আমার

দেশের এবং আমার জাতের কথা। যতই ভাবছিলাম, ততই রাগ হচ্ছিল, বাইরে যাবার মোটেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। কেউ আমায় বিদায় দিতে আসেনি, কেউ আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসেও ছিল না, তবে কেন জাহাজের চারিদিকে ঘুরে বেড়ান।

 কেবিনেই হাত মুখ ধোয়ার গরম ও ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা ছিল। হাত মুখ ধুয়ে ভাবলাম, গিয়ে দেখি, হয়ত রাজা ষষ্ঠ জর্জ আমেরিকা থেকে ফিরে আসছেন। এই জেটিতেই তাঁর জাহাজ ভিড়বে। কেবিন হতে বার হবার পরই একজন লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম রামনাথ?” বললাম, “হ্যাঁ, কি দরকার?” সে বলল, “এই চিঠিটা আপনার বন্ধু হোর‍্যাসিও দিয়েছে, গ্রীক ভাষায় লিখেছে বলেই পড়ে শোনাতে এসেছি।”

 পত্রে ছিল, তিনি আমেরিকা যাবেন বলে আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রাখতে পারলেন না। কারণ শীঘ্রই ইউরোপে যুদ্ধ আরম্ভ হবে, তাই তিনি কন্‌টিনেণ্টে চলে যাচ্ছেন। যদি পারেন, তবে ভারতে গিয়ে কলিকাতার ঠিকানায় আমার সংগে দেখা করবেন। চিঠিতে এ কথাও ছিল যে, পত্রবাহকও গ্রীক,―লোক ভাল; তার সংগে আমি আলাপ করতে পারি। পত্রটা হাত থেকে নিয়ে দেখলাম, সেটা গ্রীক ভাষাতেই লেখা বটে এবং তারই সেই দস্তখত! আমরা দুজনে জাহাজের ডেকে গেলাম; দেখলাম রাজা জর্জকে অভ্যর্থনা করবার জন্য উপরে বিরাট আয়োজন চলছে। জাহাজ তখন ডক্‌ ছাড়েনি। আমি কাস্টম অফিসারের প্রসংগই শুরু করলাম। ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বললাম, দোষটা আমাদের জাতেরই; কারণ আমরা পরাধীন। ভদ্রলোক বললেন, “আপনাদের জাতের দোষ আর থাকবে না।” কথাটা আমার খুব ভাল লাগল।

 কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস লেগে কান দুটা অবশ হয়ে আসছিল। আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল মাঝে মাঝে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে মাথায় পড়ছিল। তবুও নাবিকের দল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল রাজাকে সম্মান দেখাতে। আমেরিকান, ইতালিয়ান, জার্মান সকলেই টুপি খুলে দাঁড়িয়েছিল। সকলেই বলছে, ওই বুঝি রাজার ক্রুজার আসছে। খালি চোখে দৃষ্টি বেশী দূর যায় না। এ আকাশ আমাদের দেশের আকাশ নয়। এ হল বেস্‌কে উপসাগরের আকাশের এক অংশ। কখন কিরূপ থাকে, তার কোনই ঠিক নাই। কখনও শান্ত, কখনও গম্ভীর, আর কখনও বা পাগল হয়ে মাতলামি শুরু করে। আকাশের নীচের সাগরও সেই রকমই। যার মায়া নাই, শুধু বিরাট তরংগমালা।

 কতক্ষণ পর একটা বড় ক্রুজার প্রবল বেগে আমাদেরই জাহাজের কাছ ঘেঁসে চলে গেল। তীর হতে কামান গর্জে উঠল। তারপর আর একখানা ক্রুজার, তারপর রাজার জাহাজ, তারপর আর একখানা ক্রুজার তীরের মত চলে গেল। আমাদের জাহাজের মাঝিমাল্লা নাবিক সকলেই নমস্কার জানাল। যাত্রীর দল নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। আমি দর্শকমাত্র। কাজেই আমার দিকে কেউ চেয়ে নেই বলেই আমি মনে করছিলাম কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, সকলে আমারই দিকে চেয়ে আছে। ভাবলাম যদি এটা কলকাতা হত, তবে আজ এত কাছে দাঁড়ানো ত দূরের কথা, হয়ত আমাকে ঘরে বন্ধ করে পুলিশ পাহারায় রাখা হ’ত। আমার জীবনে এরকম ব্যাপার ঘটেছে দুবার। কিন্তু এটা রাজার নিজের দেশে সেজন্যই আমার সে দুর্দশা ঘটেনি। আগামীকাল যে জাতের সংগে শত্রুতা শুরু হবে, সেই জার্মানও যেমন সহজভাবে রাজদর্শন করছে, রাজভক্ত বৃটিশ প্রজাও সেরূপ রাজদর্শন করছে। রাজার জাহাজ চলে গেল; উপকূলে কামানের গর্জন অনেকক্ষণ শোনা গেল; আমরা আপন আপন কেবিনে ফিরে এলাম। এবার দুপুরে খাবারের পালা। আমি যে টেবিলে বসেছিলাম, তাতে চারজন হাংগেরিয়ান এবং দুইজন হাংগেরীর ইহুদী বসেছিলেন। এরা কেউ ইংলিশ জানেন না। তারা কৃষক, আমেরিকায় বসবাস করতে যচ্ছেন। কৃষকের আদর সর্বত্র। তাই তাদের সামনে নানারূপ খাদ্যসম্ভার সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই গন্ধ আমার কাছে বেশ ভাল লাগছিল। বোধহয় কৃষকেরা খাদ্যসম্ভার উৎপাদন করেই সুখী, খাওয়ার দিকে তাদের তেমন মন নাই। তারা ফলমূল আমারই দিকে ঠেলে দিল। বুঝলাম, কৃষকের মন উদার। অন্যদের মতন কালা আদমীদের উপর তাদের ঘৃণা নাই। শেষের দিকে মনে হল কৃষকেরা যেন খেয়ে তৃপ্ত হয়নি। একটা কথা মনে হল। ওয়েটারকে ডেকে বললাম, “এদের এক গ্লাস করে বিয়ার দিলে ভাল হয়।” “তাই তো; আমারও তাই মনে হয়। তবে বিয়ার দিবার আমার অধিকার নাই।” আমি বললাম, “কথাটা যেন পারসার পর্যন্ত পৌঁছে।”

 তৎক্ষণাৎ পারসার এসে উপস্থিত হলেন। আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি? আমি তাঁকে হাংগেরীর কৃষকদের অসুবিধার কথা জানালাম। বললাম তাদের দেশে আমি অনেক দিন ছিলাম; তাই তাদের খাবার পদ্ধতি আমি জানি বলে কথাটা উত্থাপন করছি। তৎক্ষণাৎ এদের জন্য বিয়ার আনা হল। বিয়ার পেয়ে পেট ভরে রুটি আলু মাখন ও সামান্য মাংস চাষারা খেল। কাফে তারা খেল না। এমন কি অন্যান্য সুখাদ্যের দিকে চেয়েও দেখল না। তারা সুখী হয়েছে দেখে আমিও সুখী হলাম, খুব আত্মতৃপ্তি বোধ হল। কিন্তু নিজের দেশ হলে কি করতাম, তা বলতে পারি না। হয়তো চাষা বলে তাড়িয়েই দিতাম। এ দেশের চাষা আর আমাদের দেশের চাষার প্রভেদ অনেক। ওরা স্বাধীনতা বোঝে, আপনার জাতের সংবাদ রাখে। যে সকল চাষা রাজনীতি বোঝে তারাই হল জাতের মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের চাষারা সে রকম নয়, তারা শুধু সেবা করতে জানে, অপরের তাঁবেদারী করতে জানে, ঋণের দায়ে সর্বহারা হতে জানে। আমাদের দেশের চাষারা সংকটে পড়ল ভগবানকে অগতির গতি মনে করে, এদেশের চাষারা সংকটে পড়লে সকট-মুক্তির পথ নিজে খোঁজে।

 জাহাজের অভিজ্ঞতা অনেক বলেছি; পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে এই জাহাজে একটা নতুন ব্যাপার ঘটেছিল। শুনেছি কর্পূরতলার হিরোজার সেক্রেটারি পারসার হতে আরম্ভ করে সাধারণ নাবিকদের পর্যন্ত নাকি অর্থ বিতরণ করেছিলেন। অনেকে ভেবেছিলেন আমিও হয়ত সেইরকমই অর্থ বিতরণ করব। কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নি যে আমি একজন দরিদ্র ভারতবাসী। গুদামে আবদ্ধ আমার দ্বিচক্রযান কারও লক্ষ্যপথে আসেনি। এমন কি পারসার মহাশয় পর্যন্ত সেসব সংবাদ রাখতেন না। তাই বোধ হয় মাঝে মাঝে এসে শোনাতেন, অমুকে তাকে এত দিয়েছিল, অমুকের কাছ থেকে এত পেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, অভিপ্রায় এই যে, যেন আমিও তার কথা বিস্মৃত না হই। নানাভাবে একথা জানাতেও কসুর করেন নি যে, খুচরা পয়সার অভাব হবে না, ব্যাংকের চেক থাকলে তাও তিনি ভাংগিয়ে দিতে পারেন। আমি কোনও মহারাজার সেক্রেটারী হব বলেই ছিল বোধ হয় তার ধারণা। পূর্বোক্ত গ্রীক যাত্রীটি সময় সময় এসে আমার সংগে গল্প করতেন। তারই সামনে একদিন পারসার মহাশয়ের চেক ভাংগানির কথাটা উঠল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় পারসার মহাশয়কে জানিয়ে দিলেন যে আমি ভারতের একজন সামান্য লোক, আমার কাছ থেকে লম্বা চেক পাবার আশা বৃথা। লোকটি স্তব্ধ হয়ে গেল! একটা পুরা কেবিনে যার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে, কাপ্তেন এসে যাকে মাঝে মাঝে দর্শন দিয়ে যাচ্ছেন সেই লোক সামান্য হয় কি করে তা বোধ হয় তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। আমার সত্যিকার পরিচয় পেয়ে পারসার আর আমার ত্রিসীমানায় আসতেন না, কিন্তু কয়লাওয়ালা, তেলওয়ালা, বয়, কুক ওরা আমার কথা শোনবার জন্য, আমার সংগলাভ করবার জন্য প্রায়ই আমার দরজায় হানা দিত। কিন্তু আমি তাতে বিরক্ত না হয়ে সব সময়েই তাদের মনোবান্‌ছা পূর্ণ করবার চেষ্টা করতাম। হাজার হোক তারা মজুর। আমি পরাধীন দেশের লোক, দরিদ্র, এবং দলিত, তাই মজুর ও দলিতদের সংগে আমার বন্ধুত্ব হতে বেশী সময় লাগে নি। আমরা পরম আনন্দে দশদিন কাটিয়ে একদিন নিউইয়র্কের দরজার কাছে এসে পড়লাম।

 সেই দরজা লোহার। আঘাতেও সেই দরজা সহজে ভাংগে না। সেই দরজা মন্‌রো ডক্‌ট্রিনের (Monro Doctrine) শৃংখলে আবদ্ধ। তার চাবি ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে। তাঁরই ইচ্ছার উপর সেই লৌহ পিন্‌জরে প্রবেশের অধিকার নির্ভর করে। সেই লৌহদ্বার আমার সামনে আর দুদিন পরেই আসবে, দৈনিক জাহাজী সংবাদপত্র আমাকে সে কথা জানিয়ে দিল। এ সংবাদে অনেকেরই মন ভারাক্রান্ত হল। কেউ কেউ দেদার মদ খেতে শুরু করে দিল। আমি এ সব সুখ-দুঃখের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম মন্‌রো ডক্‌ট্রিনের কথা। যে আদর্শের অনুরোধেই মন্‌রো ডক্‌ট্রিনের প্রবর্তন হয়ে থাক না কেন, এর দোহাই দিয়ে এই জাতটার আর্থিক স্বার্থ সাধনই আমার চোখে পড়তে লাগল। মনকে বললাম,―মন ভাল করে যদি বুঝতে চাও তো চোখ বেশ করে খুলে রাখ।

 মানুষের মনে উদ্‌বিগ্নতা থাকলে তার চিন্তাধারা কমে যায় তাই সকল যাত্রীই ভাবছিল আমেরিকার দ্বার তাদের কাছে খুলবে কি? দুটো দিন আমার আরামেই কেটেছিল। আমার ঠিক বিশ্বাস ছিল, অন্তত কয়েক দিন ইমিগ্রেশন বিভাগের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতেই হবে। আমি হিন্দু বলে নয়, আমার চামড়া কালো বলে। এক শ্রেণীর আমেরিকান আছে, যারা হিন্দু শব্দটার উচ্চারণেই মোহিত হয়ে যায়। আমি কালো তাই ভাবছিলাম আমাকে হিন্দু বলে গ্রহণ করলেও বেঁচে যাই। কিন্তু তার সম্ভাবনা অতি অল্প। দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেল। আজই বিকালবেলা জাহাজ নিউইয়র্ক গিয়ে পৌঁছবে। আমি জাহাজের খালাসী থেকে পারসার এবং পারসার থেকে কাপ্তেন পর্যন্ত সকলের সংগে কথা কয়ে নিয়ে ডেকে গিয়ে বসলাম। উদেশ্য, নিউইয়র্ক নগরীর সামুদ্রিক ট্রাফিক দর্শন।

 অনেক জাহাজ বন্দর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার আমরা যেমন বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি তেমনি আরও অনেক জাহাজ বন্দরের দিকে আসছিল। হাতের ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম, দুই ঘণ্টার মধ্যে তেত্রিশটি জাহাজ বেরিয়ে গেল। আর যতদূর দৃষ্টি যায়, গুনে দেখলাম পঁয়তাল্লিশটা জাহাজ বন্দরের দিকে আসছিল। এত জাহাজের আনাগোনা পৃথিবীর অল্প বন্দরেই হয়। সাউথহামটন, ডোভার তথা লণ্ডন, সিংগাপুর, ইওকোহামা এবং হামবার্গে প্রায় এই রকম সামুদ্রিক ট্রাফিকের নমুনা দেখা যায় বললে দোষ হবে না। তবু মনে হল নিউইয়র্কের মত সমুদ্র ট্রাফিক আর কোথাও নাই। যাঁরা সঠিক হিসাব নিতে চান, তাঁরা নৌবিভাগের চার্ট দেখবেন। কলকাতার পোর্ট কমিশনারের দয়া না হলে বোম্বাইয়ে লিখলে নিশ্চয়ই চার্ট পাওয়া যাবে।

 জাহাজ ক্রমশই নিউইয়র্ক নগরীর কাছে আসতে লাগল। নানা দৃশ্য একটার পর একটা চোখে আসতে লাগল। কিন্তু এসব দৃশ্য আমার মনে তেমন দাগ কাটতে পারছিল না, আমি ভাবছিলাম এদেশে গিয়ে দেখতে হবে আমেরিকার ডিমক্র্যাটিক গবর্ণমেণ্টের স্বরূপ কি। বোধ হয় তখন বিকালের সাড়ে সাতটা, চারিদিক কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে আসছিল, দিনের আলো অতি অল্পই ছিল, দূরের বস্তু কমই দেখা যাচ্ছিল। এমন সময় জাহাজ ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির’ কাছে এসে গেল। অনেকেই দেখল, আমিও দেখলাম, কিন্তু সে মূর্তি কারও মনের উপর তেমন দাগ কেটেছে বলে মনে হল না কারণ সময়ের পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেদিন এই মূর্তি গড়া হয়েছিল সেদিন ইমিগ্রেসন বিভাগের অস্তিত্ব ছিল না।

 জাহাজ ধীরে ধীরে হাডসন নদীতে গিয়ে প্রবেশ করল। আমি ডেকে বসে নদীর দুই তীরের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম। বাস্তবিক সে দৃশ্য উপভোগ্য। বড় বড় বাড়িগুলির উপর মেঘমালা ঝুঁকে পড়েছে। বিজলি বাতির আলো তাতে পড়ে আঁধারে-আলোর সৃষ্টি করেছে। সেই আঁধারে আলো দেখবার মত। আজকের দিনটা যে আমাকে হাজতে বাস করতে হবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম বলেই নামবার জন্য তাড়াহুড়া করছিলাম না। একজন আমেরিকান আমাকে আকাশস্পর্শী বাড়িগুলির পরিচয় দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “ওই দেখুন ওয়ালস্‌ স্ট্রীট। ওয়ালস্‌ স্ট্রীটই পৃথিবীর সমুদয় ব্যবসায় এবং আমেরিকার পলিটিক্সের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করছে। বাঁদিকে পড়ল হারলাম, হারলামই হল আমেরিকার প্যারি।” কথা বলতে বলতেই জাহাজ কুলে এসে ভিড়ল। সিঁড়ি পাতা হল, ইমিগ্রেশন অফিসার এলেন, সমস্ত যাত্রীরা ডাক্তারের সামনে যেতে লাগল। যারা আমেরিকা প্রবেশের আদেশ পেল, তারা নিজেদের অনেক ভাগ্যবান মনে করল। শেষটায় আমাদের দুজনেরও ডাক পড়ল। আমেরিকান ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁর ডাক্তারী পরীক্ষা হল না, ডাক্তার শুধু, ‘গুডবাই’ বলেই তাঁকে বিদায় দিলেন। আমার ডাক্তারী পরীক্ষা হবার পর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে হাজির করা হল। অফিসার আমার পাসপোর্ট একদিকে রেখে দিয়ে বললেন, “এখানে বসুন, পরে দেখব।” এ যে ঘটবে তা আমার জানাই ছিল। আমি চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পাশে এসে জাহাজ লাগার জায়গাটা দেখতে লাগলাম।

 দুদিকে কাঠের দেওয়াল রয়েছে। এই দেওয়াল ডিংগিয়ে পার হওয়া সাধ্যাতীত। একদিকে নদী এবং একদিকে জাহাজ থেকে নামবার গেট। এই গেটে প্রবেশ করতে সকলেরই পাসের দরকার হয়। এমন কড়া ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের খালাসীরা যে কি করে জাহাজ থেকে পালিরে সাঁতার কেটে শহরে যায়, তা বলা শক্ত। এসব যখন দেখ্‌ছিলাম আর ভাবছিলাম তখন ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ডেকে বললেন, “একজন ইউরোপীয় মহিলা আপনার সংগে দেখা করতে চান, বসুন এখানে, এখনই তিনি আসবেন।” নূতন করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে চেয়ারে বসলাম।

 মিনিট পাঁচেক পরেই সেই ইউরোপীয় মহিলা এসে আমাকে সংবাদ দিলেন যে একজন হিন্দু মহিলা এখনই আসবেন আমার সংগে দেখা করতে, আমি যেন এখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করার সময় হঠাৎ মনে হল তিনি কমলা দেবী মুখার্জ্জি নন তো, উপেনবাবু যার কথা আমার কাছে লিখেছিলেন? এতে মনে একটা আশার সন্‌চার হল।

 মিনিট দশেক পরেই, পরনে শাড়ি, কপালে সিঁদুরের টিপ, পায়ে ভারতীয় স্যাণ্ডেল, একটী মহিলা আসতে লাগলেন। আমেরিকান, ইউরোপীয়ান সকলেই তাঁকে পথ ছেড়ে দিয়ে টুপি খুলে সম্মান জানাতে লাগল। তাঁর পথ পরিষ্কার, তাঁকে আর লোক ঠেলতে হল না। আমার কাছে আসা মাত্র আমিও দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে তাঁকে নমস্কার করলাম। আমরা যেমন করে ‘বন্দেমাতরম্‌’ গান গাইবার সময় দাঁড়াই বা ইংরেজেরা যেমন করে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গায়, ইমিগ্রেশন অফিসাররা ঠিক তেমনি করে সবাই একসংগে তাঁকে সম্মান দেখাতে দাঁড়ালেন।

 মহিলাটির এত সম্মানের কারণ প্রথমে ঠাহর করতে পারি নি। যাইহোক তিনি আমাকে বললেন যে, তিনি শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের চিঠি পেয়েছেন এবং আমাকে নিয়ে যাবার জন্যই এসেছেন। তিনি আরও বোধহয় কিছু বলতেন, কিন্তু একজন ইমিগ্রেশন অফিসার টেবিলের কাছ থেকে উঠে এসে তাঁকে ডাকলেন এবং আমার সংগে কোনও কথা বলতে নিষেধ করলেন। মহিলাটি যতক্ষণ না কোনও আসন গ্রহণ করলেন সব ইমিগ্রেশন অফিসারই ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কমলাদেবী মুখোপাধ্যায় আসন গ্রহণ করেই অফিসারের সংগে নানা কথা আরম্ভ করলেন। তারপর আমার কথা উঠল। কমলা দেবী বললেন, তিনি যে সাপ্তাহিক পত্রের লেখিকা, আমিও সেই সাপ্তাহিক পত্রে লিখে থাকি এবং সেই সুত্রেই আমার সংগে তাঁর পরিচয়। তারপর আর কি কথা হল তা আমি শুনতে পাই নি, কারণ আমাকে দূরে গিয়ে বসতে বলা হয়েছিল। শেষ কথা শুনলাম “ও, কে,” তারপরই পাসপোর্টে সিলমোহর পড়ল এবং অফিসাররা ‘ও, কে,” উচ্চারণ করে একসংগে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায় দিলেন। কমলাদেবী আমার হাত ধরে বার হয়ে পড়লেন। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।

 আমার লগেজ পরীক্ষা করা হল, তারপর আমরা একটা বড় পথে এসে পড়লাম; পথটি দেখবার মতই। ছত্রপতি শিবাজী যেমন দিল্লী প্রবেশের সময় এদিকে সেদিকে বড় তাকান নি, আমিও তেমনি কোনও দিকে না তাকিয়ে একটি ট্যাক্সি ডেকে সাইকেলটা তাতে বোঝাই করে কমলাদেবী মুখোপাধ্যায়কে ভাল করে বসিয়ে ৪২নং স্ট্রীটের ওয়াই. এম. সি. এ-এর দিকে রওনা হলাম। লণ্ডনের জাহাজের এজেণ্টও আমাকে নিতে এসেছিলেন। তিনিই ওয়াই. এম. সি. এ-এর ম্যানেজারের কাছে আমার আগমনী নিবেদন করলেন। ম্যানেজার নীচে এসে আমার মুখ দেখেই বললেন, “বড়ই দুঃখের সংগে জানাতে হচ্ছে, আমাদের এখানে একজন লোক রাখবারও স্থান নাই।” আমি বুঝলাম ব্যাপারখানা কি। তৎক্ষণাৎ কমলাদেবীকে বললাম, আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এখন আমার থাকার স্থান আমিই খুঁজে বার করব। অতএব যদি অনুমতি দেন ত আপনাকে গিয়ে রেখে আসি।”

 আমার অপমানে তিনিও বোধ হয় অপমান বোধ করেছিলেন। তাই অপমানের বোঝা আর বইতে না চেয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লেন এবং বললেন, যেখানেই থাকি না কেন কাল সকালে যেন তার কাছে ফোন করি।

 অপমান লাঘব করবার জন্যই বোধহয় কমলাদেবী বললেন, “আপনার বাইসাইকেল নিয়ে এখানে আসা ভাল হয়নি। অন্য একজন বাংগালী ভূপর্যটক এসেছিলেন, তার সঙ্গে এ বালাই ছিল না।” আমি বললাম, “এই নিয়েই আমি পথ চলি এবং আমেরিকায় এই নিয়েই চলাফেরা করব। যাক এটার জন্য ভাবতে হবে না।”

 তিনি চলে যাওয়াতে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম। তারপর অন্য একটা ওয়াই. এম. সি. এ.-তে গেলাম, এবং সেখানেও সেই ‘স্থানাভাব’। সাদা চামড়ার ওয়াই. এম. সি. এ-তে স্থানলাভের আশা সুদূরপরাহত বুঝে হারলামের দিকে রওনা হলাম এবং নিগ্রোদের ওয়াই. এম. সি. এ-তে স্থান পেলাম।

 রুমের ভাড়া এবং ট্যাক্সির মজুরি দিয়ে নিকটস্থ একটি নিগ্রো হোটেলে খেতে গেলাম। খাওয়া শেষ করে দু সেণ্টের একখানা সংবাদপত্র কিনে বোধহয় নবম তলায় অবস্থিত একটি রুমে এসে দরজা খুলেই মনে হল এটা ওয়াই. এম. সি. এ-ই বটে। তবে হাতে টাকা প্রচুর রয়েছে, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করা কর্তব্য। ভিতর থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে এই গভীর রাত্রে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র পাঠ করতে আরম্ভ করলাম। অনেকক্ষণ সংবাদপত্র পাঠ করে রাত্রি তিনটার সময় ঘুমালাম। সকালে আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে যখন বাইরের দিকে তাকালাম তখন দেখলাম অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। ১৩৫নং স্ট্রীটের পশ্চিম দিকে ওয়াই এম. সি. এ অবস্থিত। রাস্তার দুদিকে বড় বড় বাড়ি তবে বাড়িগুলির অবস্থান আমাদের দেশের বাড়ির মত এলোমেলো ভাবে নয়। ‘ব্লক’ করে বাড়ি সাজান। তা সে নিগ্রো পল্লীই হোক আর সাদা চামড়াদের পল্লীই হোক। এই পৃথিবীতে জার্মানী আর আমেরিকা ছাড়া কোথাও এরূপ ‘ব্লক’ প্রথায় বাড়ী তৈরী হয় নি। তবে রুশিয়ায় এ নিয়মটি প্রবর্তিত হবে বলে মনে হয়। ব্লক পদ্ধতিতে বাড়ী করলে পিচ দেওয়া বড় পথকে খুঁড়তে হয় না, যেমন আমাদের কলকাতায় হয়ে থাকে। ব্লক প্রথায় বাড়ি করা হয় বলে, জল, গ্যাস বিজলি বাতি প্রভৃতি এমন সুন্দরভাবে রাখা হয় যে, তার সংগে পথের সম্পর্কই থাকে না। সবই পেভমেটের নীচে চলেছে।

 দাঁড়িয়ে হাঁ করে পথের দু পাশের বাড়িগুলি দেখতে লাগলাম। দেখলাম প্রত্যেকটি বাড়ির জানালা বন্ধ। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না কে কোথায় বাস করছে। পথে স্রোতের মত মোটরকার, মোটরলরি, ট্যাক্সি এবং বাস চলছে। একটু দূরেই এলিভেটারে বাড়ির উপর দিয়ে গাড়ি চলছে। কতক্ষণ এমনভাবে চেয়ে ছিলাম তার ঠিক ছিল না। শুধু চেয়ে থাকতেই ইচ্ছা হচ্ছিল। আকাশে গাড়ি, মাটিতে গাড়ি, মাটির নীচে গাড়ি। এমন দেশ পৃথিবীতে মাত্র একটাই। আমেরিকা ছাড়া কোথাও আজ পর্যন্ত এলিভেটর সিস্টেমে ট্রাম চলার প্রথা প্রবর্তিত হয়নি।

 দেখার নেশা একটু যখন মিটল তখন আবার স্নান করলাম। তারপর নীচে নেমে পথের নাম, বাড়ীর নম্বর, স্ট্রীটের নম্বর নোট বুকে লিখে নিয়ে একটু কাফি খাবার ইচ্ছায় সোজা হাঁটতে লাগলাম। একটি কাফির দোকানো গেলাম তাতে দু’জন নিগ্রো এবং তিনজন আমেরিকান বসে কাফি খাচ্ছিল আর নানারকম আলোচনা করছিল। এদের দর্শন-ঘেঁষা কথাবার্তা শুনে মনে হল যেন আমি কোন সন্ন্যাসীর আখড়ায় বসে আছি। এরা যে দর্শনের কথা নিয়ে আলোচনা করছিল, ইচ্ছা করলেই তাতে মুখ পাততে পারতাম কিন্তু এরূপ করা মহা অন্যায় এবং আমরা যেমন সবজান্তার জাত তাদের সংগে তা চলবে না। বাজে কথা তারা মোটেই বলছিল না। প্রত্যেকটি কথার পেছনে মুক্তি ছিল এবং তারা হাউমাউ করে চিৎকারও করছিল না। কতক্ষণ পরই হয়ত আমি আমেরিকানদের নিগ্রোঘৃণা সম্বন্ধে গাল দিব, কিন্তু এখানে তা পারব না কারণ এখানে সাদা এবং কালো উভয়ে নিয়ে এমনই এক দর্শনের কথা বলছিল যা আমার আছে নতুন ছিল এবং তাতে ভাববারও বিষয় ছিল। তাই শুধু কাফি খেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বেরিয়ে এলাম।

 পথে যাবার সময় একজন জামাইকাবাসী নিগ্রো রমণীর সংগে সাক্ষাৎ হয়। রমণীটি সুন্দরী এবং ডাক্তার। অপরিচিত মুখ দেখেই রমণী আমাকে পথ হারিয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি পথ হারাইনি তাঁকে জানালাম। তবে বলতে বাধ্য হলাম গত রাত্রে ওয়াই. এম. সি. এ-তে ঘুমিয়ে আরাম পাইনি, যদি কম ভাড়ায় একটি সাজসরঞ্জাম বিশিষ্ট রুম পাই এবং তা পেতে যদি তিনি আমাকে সাহায্য করেন তবে বড়ই বাধিত হব। তাঁরই সাহায্যে অন্য আর একজন জামাইকাবাসীর বাড়িতে একখানা রুম সপ্তাহে আড়াই ডলারে ঠিক করলাম। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সে রুম। বাড়িওয়ালী বললেন, ভারতীয় খাবার তিনি রেঁধে দিতে পারবেন। জামাইকাবাসী নিগ্রোরা আপনাদের নিগ্রো বলে পরিচয় দেয় না, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান বলে পরিচয় দেয়। তাদের মতে ফিলিপাইন, জাভা আর ভারতবাসীরা ইস্ট ইণ্ডিয়ান। আমেরিকানরা আমাদের হিন্দু বলে, হিন্দু মুসলমান প্রশ্ন এখানে নাই। তবে ব্রিটিশের প্রচার বিভাগের ফলে অনেক ব্রিটিশ-পরিচালিত সংবাদপত্র সেই ভ্রম আজকাল সংশোধন করে দিচ্ছে। মিঃ সওকত আলি এবং একজন মাদ্রাজী পাদরী সেই ভুল সংশোধন করতেই বোধ হয় সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু পেরে উঠেন নি। ভারতবাসীর হিতাকাংখীর অভাব নাই, বোধ হয় আমেরিকায় আমাদের ইণ্ডিয়ান না বানিয়ে ছাড়া হবে না। সুখের বিষয় কি দুঃখের বিষয় বলতে পারি না, ক্যালিফোরনিয়াতে আমাদের দেশের পাঠানরা নিজেদের ইণ্ডিয়ান বলে কখনও পরিচয় দেয় না―তারা সদাসর্বদা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে ভালবাসে এবং এরিয়ান্‌ বলে গর্ব অনুভব করে। এরিয়ান এবং ননএরিয়ান কথা নিয়ে বাংগালী মুসলমান ও পাঠানদের মাঝে অনেক সময় পিস্তলবাজীও হয়ে থাকে। পাঠানরা বাংগালীদের―সে যে ধর্মেরই হোক―এরিয়ান বলে স্বীকার করে না।

 আমি যে রুম ভাড়া করেছিলাম তার সংগে রান্না করবারও বন্দোবস্ত ছিল। রান্না করবার বাসন চাইলেই পাওয়া যায় এবং গ্যাস যত ইচ্ছা ব্যবহার করা যায়। সেজন্য অতিরিক্ত খরচ দিতে হয় না। রুম ভাড়ার সংগে গ্যাস, লাইট, বাথ, রান্নার বাসন, সপ্তাহে একবার বিছানার চাদর পরিবর্তন এবং দৈনিক একখানা করে ধোয়া নতুন তোয়ালে পাওয়া যায়। এরূপ ঘরের ভাড়া আমেরিকার পূর্বদিকে সপ্তাহে সাড়ে তিন ডলার, উত্তর দিকে তিন ডলার, মধ্যে চার ডলার, পশ্চিম দিকে আড়াই ডলার থেকে পাঁচ ডলার, দক্ষিণ দিকে এক ডলার থেকে তিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঘরের আসবাব দু’খানা চেয়ার, দুটা টেবিল, একটা ইজিচেয়ার। পোষাক টাংগিয়ে রাখবার জন্য পাশে একটা ছোট রুমও পাওয়া যায়। রান্নার বাসন টেবিলের ড্রয়ারে রাখবার বন্দোবস্ত আছে। এই জন্যই দুটা টেবিলের ব্যবস্থা।

 বিকালে সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠে একাকী বেড়াতে বের হলাম। দুটা ব্লক পার হয়ে মাউণ্ট মরিস পার্ক। তাতেই বেড়াতে লাগলাম আর এলিভেটরগুলি কেমন হুস হুস করে যাওয়া আসা করছে তাই দেখতে লাগলাম। ৮নং অ্যাভিনিউএর উপর এলিভেটর আছে এবং তারই নীচ দিয়ে আমাকে উক্ত পার্কে আসতে হয়েছিল।

 এলিভেটরগুলির দিকে আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম। মহানগরে যেমন মাটির নীচে রেল পথের দরকার, উপরেও ঠিক সেই রকম দরকার। এলিভেটর না হলে মহানগরের পথে চলা দায় হয়ে উঠে। নিউইয়র্ক নগর এই দায়ে পড়েছিল বলেই দায়মুক্ত হবার পথ খুঁজে নিয়েছে। পৃথিবীর লোক হাঁ করে চেয়ে দেখছে এত টাকা কি করে খরচ করতে পারে। মানুষই যে টাকা তৈরি করে এ কথা মানুষ বুঝে না। মজুরীই হল টাকা। মজুরী ছেড়ে দিলে টাকার অস্তিত্ব থাকে না।

 পার্ক হতে ফিরবার সময় বিকালের কয়েকখানা সংবাদপত্র নিয়ে এলাম। নিউইয়র্ক নগরে দৈনিক সংবাদপত্রের দাম দুই সেণ্ট এবং তিন সেণ্ট করে হয়। সাপ্তাহিক, মাসিক, এসকল পত্রিকা ছাড়াও অনেক সংবাদপত্র আছে যাতে বিজ্ঞাপন থাকে না। যেমন ডেলী ওয়ার্কার, পিপুল্‌ ওয়ার্ল্ড যাতে পয়সা দিয়ে কেউ বিজ্ঞাপন দিতে পারে না। তাদের বিষয় নিয়েই বিনা পয়সায় বিগ্‌গাপন থাকে, সেজন্য প্রত্যেক দিন চাঁদা উঠছে এবং কোন জেলার লোক কত চাঁদা দিবে তাও নির্ধারিত হয়ে থাকে। আমেরিকার প্রগতিশীল যুবক যুবতী সেই পত্রিকাগুলির গ্রাহক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও ঐ সংবাদপত্রগুলির প্রবেশ নিষেধ, তবুও ঐ সংবাদপত্রগুলিই যুবক যুবতীর আশা আকাংখা ও আদর্শের প্রতীক।

 আমেরিকায় যারা এসব সংবাদ রাখে, তাদের বলা হয় “পারসেনটেজ’। আমেরিকার এই “পারসেনটেজ” পার্টির লোক রোজই বাড়ছে তাই আজ রুজভেল্ট চিৎকার করেও অনেক কাজে অনেকের সাড়া পান না এবং পাবেন বলে বোধও হয় না। এরা ওৎ পেতে বসে আছে সুযোগ পেলেই আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করবে বলে। এই হল আমার ধারণা। কমিউনিস্টি দলের লোককেই উপহাস করে পারসেনটেজ বলা হয়।

 ভাবছিলাম আজ রাত্রে বাইরে যাব না। পকেটে একতাড়া নোট রয়েছে। ভয় হল যদি নিউইয়র্কের গুণ্ডার পাল্লায় পড়ি, তবে পথে বসতে হবে। হঠাৎ মনে হল অতীত দিনের স্মৃতি, যেদিন পৃথিবী পর্যটনে বের হয়েছিলাম সেদিন পকেটে একটি পয়সাও ছিল না। আজ টাকা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, চুলায় যাক টাকা, আমেরিকাকে আমার দেখতেই হবে। আমি দেশেও ফকির, বিদেশেও ফকির হলে অভিজ্ঞতা ভাল হবে। তখন রাত প্রায় এগারটা। বের হয়ে পড়লাম পথে।

 বিজলি বাতির আলোয় হারলামের প্রশস্ত পথগুলি আলোকিত। ব্রডওয়েতে বেড়াতে হলে এই শীতেও ঘাম বের হয়, বিজলি বাতির উত্তাপে। দূর হতে মনে হয় যেন আগুন লেগেছে। পন্‌চম অ্যাভেনিউ এবং একশত দশ স্ট্রীট ইস্ট যেখানে মিলেছে সেখানে দাঁড়ালাম সেণ্টাল পার্কের কাছে। আলোকোজ্জ্বল সুন্দর পথ, তারই উপর অগণিত মোটর গাড়ি ও বাস চলছে। যারা ‘জ্যয় রাইড’ করতে বের হয়েছে দোতলা বাসে, তাদের হাসির ফোয়ারার উচ্চ কলরবে আকাশ মুখরিত। কাছেই বড় বড় হোটেলে মদের বোতলের ছিপি খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সুন্দরী তরুণীর কলহাস্য আনন্দের সৃষ্টি করছে। যুবক যুবতী আপন মনে পথ চলেছে এবং সারাদিনের পরিশ্রমের অবসাদ দূর করছে। তারা কখনও ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে লাইট রিফ্রেশমেণ্ট খেয়েই বের হয়ে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তটিকে যেন তারা আনন্দে ভরিয়ে তুলছে। কাছেই একটা সিনেমা গৃহে নাচ চলছে। আমেরিকায় একদিকে চলেছে ঐশ্বর্যভোগের আয়োজন আর এক দিকে রয়েছে নিরন্ন বেকার ও ক্ষুধিতের ব্যর্থ জীবনের করুণ দৃশ্য। কিন্তু ঐ যে দৃশ্য আমার সামনে, তা দেখে মনে হয় না আমি আমেরিকার কোথাও ভ্রমণ করছি মনে হয় শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বসে আছি। শ্রদ্ধানন্দ পার্কের চারিদিকে সর্বহারা দল বাস করে তার সংবাদ কেউ রাখে না। যাঁরা সেই সংবাদ রাখেন তাঁরা আসুন আমার আমেরিকায় বর্ণিত স্থানে। দেখবেন এখানেও সর্বহারার দল নতমুখে বসে আছে। কেউ সারাদিনে এক টুকরা রুটি খেয়েছে, আর কেউ অভুক্ত অবস্থায়ই পথের দিকে চেয়ে বসে আছে। আমেরিকার ব্যাংকে প্রচুর স্বর্ণ আছে, বাগানে ফল আছে, মাঠে প্রচুর গম আছে, নদীতে জল আছে, দোকানে কাপড় জুতা সবই আছে কিন্তু ঐ ভিখারীদের কিছুই নাই। পরনে ছেঁড়া ট্রাউজার, গায়ে ছেঁড়া কোট, কারও গায়ে শার্ট আছে, কারও গায়ে তাও নেই! নেকটাই কিন্তু তবুও ঝুলছে।

 আনন্দের লীলাভূমি, টাকার আড়ত নিউইয়র্ক-এ এসে রাত্রি দুটা পর্যন্ত পথে হেঁটে বেড়ালাম। কেউ আমাকে লক্ষ্য করেনি, সকলেই ব্যস্ত। এত বড় নগরে কে কার সন্ধান রাখে? তাতে আমি আনন্দিতই হলাম। আমার আকৃতি অনেকটা নিগ্রোদের মত। নিজের পরিচয় কারও কাছে দিলাম না আর পরিচয় দিবার প্রয়োজনও ছিল না। হাতে টাকা আছে, পেট ভরে খাবারের বন্দোবস্ত আছে, এবং আমেরিকার সুখ-দুঃখের সংবাদ নেবার মত ক্ষমতা আছে। আমি যদি অপরিচিত হয়ে বেড়াই তবে দুঃখ করার কি আছে? একটি পুরান কথা মনে পড়ে গেল। আমার গ্রামের একটি লোকের সংগে একবার কলকাতায় দেখা হয়। তার পরনে মাত্র একখানা ধুতি, গায়ে একটা গেন্‌জি আর ট্যাঁকে কতগুলি পয়সা। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এভাবে ঘুরে বেড়াবার কারণ কি। গ্রামে তো কখনো এভাবে থাকতে দেখিনি। লোকটি বলেছিল, “কলকাতা দেখতে এসেছি, দেখে চলে যাব। জাঁকজমক করে চোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাভ কি?” আমিও নিউইয়র্কে প্রায় দু’সপ্তাহ সেইভাবেই কাটিয়ে ছিলাম। তাতে দিন কেটেছিল ভালই। কেমন করে ভালভাবে দিন কেটেছিল তার একটা দৃষ্টান্ত দিলাম।

 হারলামে নিগ্রোরাই থাকে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ওয়ার্ল্ড-ফেয়ারের তরফ থেকে নানারূপ প্রচার চলছিল। সেখানে রুশিয়ারও একটি প্যাভেলিয়ন খোলা হয়েছিল। সেই প্যাভেলিয়নটি দেখার জন্যই তথায় গিয়েছিলাম। রুশিয়ার প্যাভেলিয়ন দেখবার জন্য লোক আগ্রহান্বিত ছিল। সেখানে নিগ্রোদের কাছে সস্তা দরে খাদ্য বিক্রয় করা হ’ত কারণ নিগ্রোরা আমেরিকানদের মত মোটা মজুরী পেত না। যে সকল খাদ্য আমেরিকানদের কাছে পন্‌চাশ সেণ্টে বিক্রি হত সেই


হাডসন নদীর মোহনায় স্বাধীনতার মূর্ত্তি।

খাবারের জন্যই নিগ্রোদের কাছ থেকে পনর সেণ্ট নেওয়া হ’ত। আমি সে সুযোগ পরিত্যাগ করিনি। রুশিয়ার প্রদর্শনীতে গিয়ে সর্বপ্রথমই খাবারের ঘরে গিয়ে খেতে বসলাম। এমন সুস্বাদু দই, ঘোল, ক্রিম, সিদ্ধ করা সবজী স্লাভ জাত ছাড়া আর কেউ তৈরী করতে পারে না। রুশ দেশীয় যুবতীরা সেই সুখাদ্য থালায় করে নির্যাতিত লোকের সামনে এনে রাখছিল। তারা ভাংগা ইংলিশে কথা বলছিল। যখন তারা কথা বলছিল তখন তাদের গালভরা হাসি দেখে অনেক নিগ্রোই আনন্দে আটখানা হয়ে পড়ছিল। তাদের কার্যপদ্ধতিও অন্য রকমের। যেন কলের পুতুলের মত কাজ করে যাচ্ছিল। যুবতীরা শুধু খাবার দিয়েই কাজের শেষ করছিল না। যাদের নেকটাই অসাবধানবশত স্থানভ্রষ্ট হচ্ছিল, যুবতীগণ তা যথাস্থানে বেঁধে দিচ্ছিল। খাবার শেষ হয়ে যাবার পর যখন নিগ্রোরা চলে যাচ্ছিল তখন সেই সুন্দরী মেয়েরা তাদের কোট প্যাণ্ট ব্রুস দিয়ে ঝেড়ে দিচ্ছিল।

 যে-ই রুশিয়ার প্রদর্শনীতে যাচ্ছিল সে-ই হাসিমুখে একটা তৃপ্তির ভাব নিয়ে বের হয়ে আসছিল। সেই তৃপ্তির সংগে যে ভাবধারা নিয়ে আসছিল তা আমেরিকার পুঁজিবাদীদের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। নিগ্রোরা প্রকাশ্যেই বলছিল আমেরিকাতে কবে রুশদেশের মত সোভিয়েট স্থাপন হবে। সোভিয়েট রুশের নতুন কর্মপদ্ধতি দেখে প্রত্যেকের মনেই নবজাগরণের প্রেরণা আসছিল। এসব কারণেই বোধহয় সোভিয়েট রুশিয়ার প্রদর্শনীতে এত ভিড় হ’ত।

 অনেক দরিদ্র শ্বেতকায়কে তথায় গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা কি ভাবছিল তা আমার বলার ক্ষমতা নাই সত্য, কিন্তু যখনই ইংলিশ ভাষায় দক্ষ রুশ গাইডগণ এসব ধ্যানস্থ আমেরিকানদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলত, তোমাদেরও কাজ করার ক্ষমতা আছে, কাজ কর, দেখবে তোমাদের দেশেও সোভিয়েট রুশের মত কিছু গড়ে উঠেছে তখন তাদেরও মনে চাঞ্চল্য এসে দেখা দিত।

 সোভিয়েট প্রদর্শনীতে বড় বড় চিত্রপট এবং কিউরিয়োর কোনরূপ জাঁকজমক ছিল না। প্রদর্শনীটাকে দূর হতে যেন একটা বিরাট কিছু দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে হ’ত। বাড়িটার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে মাটির তৈরী একটা প্রকাণ্ড মানুষের মূর্তি। তার ডান হাতে একটা জলন্ত মশাল। মূর্তিটির মুখ এমনি ভাবে গঠন করা হয়েছে যে দেখলে মনে হয় যেন সেই মাটির মানুষ বলতে চাচ্ছে―“গরিবের দল এবং সর্বহারাগণ, আর ভুলে থাকিস না, ভিক্ষা করে আর কোন দরকার নাই, এবার তোদের পাওনা বুঝে নে।”

 সোভিয়েট প্রদর্শনীতে সিনেমারও আয়োজন ছিল। রুশ দেশের সিনেমার সংগে অন্য কোন দেশের সিনেমার মোটেই মিল নাই বললে কোন দোষ হয় না। রুশ সিনেমায় পুরাতন ঐতিহাসিক ঘটনার উপর সত্যের দীপ্তি ফুটে উঠছিল। কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করা হচ্ছিল না। সিনেমায় দেখান হচ্ছিল, জারের আমলে এক টুকরা রুটির জন্য পুত্রকন্যার সামনে কি করে মাতা তার শরীর বিক্রয় করছেন আর কেমন নিঃসংকোচে পুঁজিবাদীর দল সেই মাতার প্রতি কুব্যবহার করছে; যুবক যুবতীরা অন্নচিন্তা করে অকালে কিরূপে বার্ধক্য পেয়েছে। সে সব করুণ দৃশ্য অনেকক্ষণ দেখবার মত পাষাণ মন অনেকেরই ছিল না। অনেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠছিল আর জারের নামে নানারূপ কটূক্তি বর্ষণ করছিল। ইহুদী এবং যারা অখৃষ্টান তাদের প্রতি কত অত্যাচার চলছিল তার দৃশ্যও দেখান হ’ত, কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে কেউ কাঁদত না শুধু গম্ভীর হয়ে ভাবত। আমিও ভাবতাম। ভাববার বিষয়ই বটে।

 কাছেই ইটালীয়ানদের প্রদর্শনী। নিগ্রোরা সেই প্রদর্শনীতে যেত এবং দেখত। তারা বুঝতে চেষ্টা করত কোন শক্তির প্রভাবে সিনিয়র মুসলিনী সম্রাট হাইলে সেলাসীকে রাজ্য ছাড়া করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রদর্শনী দেখে তারা সে বিষয়ের কোন সন্ধানই পেত না। সেখানে গিয়ে তারাও দেখত আমিও দেখতাম। এই প্রদর্শনীটি হল একটি ঠকের আড্ডা। নীচের তলার প্রবেশ দ্বারে লেখা রয়েছে “বিনামূল্যে এখানে ইটালীতে প্রস্তুত নানারূপ জিনিষ বিতরণ করা হয়।” কথাটা মোটেই অন্যায় নয়। প্রত্যেক দেশেই অনেক জিনিষের নমুনা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম এখানেও সেরূপই কিছু হবে, কিন্তু প্রবেশ করে দেখি এখানে সেরূপ কিছু নয়। যে জিনিষ বাজারে দশ সেণ্ট করে বিক্রি হয় সেরূপ জিনিসের দাম এখানে পচিশ সেণ্ট করে লেখা রয়েছে। আমি তা দেখে জিনিসও কিনিনি কাউকে গালিও দেইনি, কিন্তু নিগ্রোরা সেখানে গিয়ে যখনই দেখেছে এটা টাকা রোজগারের একটা ফাঁদমাত্র, তখনই তারা রাগ করে মুখ হতে থুথু ফেলে প্রদর্শনী হতে বের হয়ে এসেছে।

 ইটালী দেশের প্রদর্শনীর বাড়িটার উপর একটি স্ত্রীমূর্তি। মূর্তিটির গড়ন বেশ সুন্দর। তারই পাশ দিয়ে একটি কৃত্রিম জলস্রোত বয়ে আসছে, যেন গংগা গোমুখী হতে নীচে নেমে আসছে। বাইরে সৌন্দর্যের বেশ সমাবেশ করা হয়েছে আর ভিতরে করা হয়েছে ঠকাবার সুবন্দোবস্ত। এটা আমি অথবা নিগ্রোরাই শুধু অনুভব করেনি। প্রদর্শনী দেখতে যারাই এসেছিল তারাই বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিল; এটা একটা ঠকের আড্ডা।

 দক্ষিণ আমেরিকাতে আমি যাইনি। সেখানের রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধেও আমার কোন সংবাদ জানা ছিল না, তবে যে সকল দক্ষিণ আমেরিকাবাসী রেড ইণ্ডিয়ান প্রদর্শনী দেখতে এসেছিল তারা ইটালীয়ান প্রদর্শনীর প্রতি বড়ই খারাপ মত পোষণ করছিল। ইটালীয়ান মিশনারীরা তাদের দেশেও নাকি বেশ অন্যায় আচরণ করছিল এবং বাইবেল পরিত্যাগ করে তারা নাকি মুসলিনী প্রবর্তিত ফেসিজম্‌ গ্রহণ করে তাই প্রচার করছিল। মেকসিকো এবং ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে সসিয়েলিজমের অনেক প্রচার হওয়ার ফলে সেই দেশগুলিতে পুঁজিবাদীদের সমূহ ক্ষতি হয়েছে এই সংবাদটি আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছিলাম। এদুটি দেশের লোকই আবার প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিল বেশির ভাগ। তারাই ইটালীয়ানদের প্রদর্শনী দেখে নানারূপ খারাপ মন্তব্য করছিল। প্রত্যেক প্রদর্শনীর দরজার সামনে একটা প্রকাণ্ড বই ছিল। সে বইটিতে যার যা ইচ্ছা মন্তব্য লিখতে পারত। অনেকেই ইটালীয় প্রদর্শনীর বইএও নানারূপ মন্তব্য লিখেছিল। সেইসব মন্তব্য পাঠ করেই আমার উপরোক্ত ধারণা হয়েছিল। আমি যা লিখেছিলাম তা অতি অকেজো, কারণ আমি বিদেশে গিয়ে যখনই কোন বই-এ মন্তব্য লেখতাম তখন বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা ব্যবহার করতাম না। যদিও অপরের পক্ষে তা অকেজো, আমার পক্ষে কিন্তু তা বড়ই দরকারী হয়ে পড়ত। আমার লেখা দেখে অনেকে আমার পেছন নিত এবং জিজ্ঞাসা করত আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। যদি ইংলিশে মন্তব্য লেখতাম তবে হয়ত কেউ আমার দিকে চেয়েও দেখত না। বিশ্বমেলাতে অনেকদিনই গিয়েছি এবং অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু তা হল মেলা সংক্রান্ত বিষয়। এ বিষয় নিয়ে এখন আর বেশি বলা উচিত হবে না। আমি বিশ্বমেলা দেখবার জন্য সেখানে যাইনি আমি গিয়েছিলাম কালো লোকের প্রতি সোভিয়েটদের কিরূপ ব্যবহার তাই জানতে।

 আজ ভারতের কথা আমেরিকার অল্প লোকই চিন্তা করে। যে সকল বকধার্মিক আমেরিকায় হিন্দুয়ানীর কথা বলে দুপয়সা করে খান তারা ভাল করেই অবগত আছেন তাদের অবস্থা আমেরিকায় কিরূপ? আমি এসম্বন্ধে কিছুই বলব না। কারণ এসম্বন্ধে যদি বেশি বলতে যাই তবে এবিষয়েই একখানা বই লিখতে হবে। আজ আমেরিকায় ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পক্ষ হয়ে দুকথা যদি কেউ বলে তবে দুটিমাত্র সংবাদপত্রের কথা আমি বলতে সক্ষম হব। সেই সংবাদপত্র দুটি হল পিপুলস্‌ ওয়ার্ল্ড এবং ডেলি ওয়ার্কার। কখন কখন আমরা আমেরিকার অন্যান্য সংবাদপত্রে ভারতের কথা শুনতে পাই, তা হল তাদের স্বার্থ কথা বলা, এর বেশি এসম্বন্ধে আর কিছু বলা চলে না।

 এখানে আসার পর দান্তে বলে এক ভদ্রলোকের সংগে পরিচয় হয়। তিনি পৃথিবীর যত পরাধীন জাত আছে তাদের সকলের জন্যেই দরদী। আমাকে পাওয়ার পর তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন এবং আমাকে অনেক লোকের সংগে পরিচয়ও করে দিয়েছিলেন। মিঃ দান্তের স্ত্রীর অনুরোধে তিনি একটি সভার আয়োজন করেন। সভা একটি কাফেতে হয়েছিল। সভাতে হাজার লোক হবে বলে অনেকেই ধারণা করেছিল। কাফের ম্যানেজার প্রচার করেছিলেন মিঃ রামনাথ একজন হিন্দু, তিনি অকালটিস্ট স্পিরিচুয়েলিস্ট, অথবা যাদুকর নন, তিনি একজন পর্যটক। তাঁকে হবো (Hobo) অর্থাৎ এড্‌ভ্যানচারার বলে যেন ভুল না করা হয়। এই কারণ লোক হয়েছিল অনেক। আমরা যখন সভাস্থলে উপস্থিত হলাম তখন সকলকে আমার আগমনী জানান হল। কথাটা শুনে অনেকেই আমার দিকে চেয়ে দেখল। দুঃখের বিষয় আমার মুখ দেখে কেউ সন্তুষ্ট হল না। শরীরের রং যথায় শিক্ষা দীক্ষার মাপকাঠি তথায় মনুষ্যত্বের স্থান হতে পারে না। অতি কষ্টে মিঃ দান্তে সভাস্থ সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যার যা প্রশ্ন তা লিখে রাখুন, বয়রা তা নিয়ে আসবে। অনেকে আমার রূপ দেখে প্রশ্ন করাটাও হেয় মনে করেছিল। যারা প্রশ্ন করেছিলেন তাদের একটি কথার জবাব আমি দিয়েছিলাম। সেই প্রশ্নটির জবাব দিতে আমার আধঘণ্টা লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, “Blood preservation is nothing but barbarism. আমেরিকাবাসী যদি সে দোষে দোষী না হত তবে আজ হারলাম তৈরী হত না। শ্বেতকায়দের নিগ্রো-ভয় থাকত না।” কিন্তু কথাটা বলার সংগে সংগেই মনে হল দেশের কথা। গীতা থেকে আরম্ভ করে সেনবংশ পর্যন্ত বর্ণ-শংকরদের ভয়ে অস্থির ছিলেন। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে যদি হরিজনের কথা বলি তবে এখানে তা অবান্তর বলেই গণ্য হবে। বিদেশে গিয়ে কিন্তু এসব কথা বলা চলে না। দেশের এবং জাতের মান ইজ্জত বজায় রাখতে গিয়ে হাজার মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। পৃথিবীর লোক ক্রমেই দেশ বিদেশের সংবাদ নানা ভাবে অবগত হচ্ছে। এরূপ মিথ্যা কথা বলার কোন মূল্য থাকবে না। সময় থাকতে সংশোধন না করলে ভারতের দিকে কেউ সুদৃষ্টিতে চাইবে না। অতএব হুসিয়ার।

 এসব কথা বাদ দিয়ে এখন আমেরিকার কথা বলাই দরকার। ইচ্ছা হল বিশ্ববিখ্যাত ওয়ালস্‌ স্ট্রীটটা একটু বেড়িয়ে আসি। ওয়ালস্‌ স্ট্রীট আমার বাসস্থান হতে বেশি দূরে ছিল না। তবুও বাসে করেই রওয়ানা হলাম। বাস থেকে নেমেই পেলাম ওয়ালস্‌ স্ট্রীট। ধীর পদে নিক্ষেপে সেদিকে হাঁটতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম এখানে বসেই আমেরিকার ধনীরা পৃথিবীর বাণিজ্য, সাম্রাজ্যবাদ এবং মনরো নীতির ভাষ্য করে থাকেন। শুধু এই স্ট্রীটটুকু দেখার জন্যই আমেরিকা ছাড়াও বিদেশ হতে অনেক লোক আসে।

 ওয়ালস্‌ স্ট্রীট আমেরিকার অন্যান্য যে কোন স্ট্রীট হতে অল্প পরিসর। এটাকে যদি গলি বলা হয় তবে বোধহয় দোষ হবে না। তবে একথা মনে রাখতে হবে, ভারতে ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের মত একটিও স্ট্রীট নাই। তাজের তুলনা যেমন তাজই, ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের তুলনাও শুধু ওয়ালস্‌ স্ট্রীটই। স্ট্রীটের দুদিকে উচ্চ প্রাসাদগুলি দাঁড়িয়ে আছে। পথে অনেক লোক চলেছে, কিন্তু কারো মুখে হাসি নাই। তারা খুবই চিন্তিত এবং বেশ অতর্কিতে পথ চলেছে। মাঝে মাঝে একের সংগে অন্যের ধাক্কাও লাগছে। কিন্তু তারা ব্যবসা চিন্তায় এতই তন্ময় হয়ে হাঁটছিল যে শিষ্টাচার সূচক “দুঃখিত” কথাটা পর্যন্ত কারো মুখ হতে বার হচ্ছিল না। আমি এপথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলাম বলেই বোধ হয় অনেকের দৃষ্টি আমার দিকে পড়ছিল। ওয়ালস্‌ স্ট্রীট দেখতে আমি একা যাইনি আমার সংগে আরও তিনজন ভদ্রলোক ছিলেন। সংগের তিনজন আমেরিকান আমার পেছন পেছন চলছিলেন। একটা কালা আদমীর পেছনে তিনজন সাদা লোক হাঁটছে তা কম কথা নয়, এতে অনেকেরই জিজ্ঞাসু চোখ আমার উপর পড়ছিল। অনেকেই আমার সংগে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাথীরা তাতে বাধা দিচ্ছিল। শুধু জানিয়ে দিচ্ছিল আমি নিগ্রো নই, বিদেশী। ডিভাইন্‌ ফাদার যখন পথে চলেন তখন তাঁর সংগে অনেক সাদা লোকও চলে তাই অনেকে হয়ত ভাবছিল আমি নিগ্রো ধর্ম প্রচারক।

 সংগের তিনজন আমেরিকানের পরিচয় এখনও দেইনি এবং কি করে তাদের সংগে আমার পরিচয় হল সে কথাই এখন বলছি। নিউইয়র্ক আসার কয়েকদিন পরই গরম শুরু হয়। গরমে উলের সার্ট ব্যবহার করতে কষ্ট হচ্ছিল। শুনছিলাম নিউইয়র্কএ দোকানীরা পর্যন্ত নিগ্রোদের সংগে সৎব্যবহার করে না। দোকানীরা যাতে আমার সংগে সৎব্যবহার করে এবং আমাকে নিগ্রো না ভাবে সেজন্য মাথায় পাগড়ী বেঁধে পথে বের হব ঠিক করলাম। গরমের সময় দুপুর বেলা অল্প লোকই পথে বের হয়। তা বলে মনে করা উচিত নয় যে পথে লোক চলাচল একদম বন্ধ হয়ে যায়; পাগড়ী বেঁধে পথে বের হতে আমার মোটেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। বের না হলে নয় বলে একটা আংশিক নির্জনপথে চলাই ঠিক করলাম। পন্‌চম্‌ এ্যাভেনিউ তে না গিয়ে অষ্টম এ্যাভেনিউতেই যাওয়া ঠিক করলাম। পথে বের হয়ে কতকদূর যাবার পরই ইহুদী এবং আরবগণ “প্রিস্ট্‌, প্রিস্ট্‌” (ধর্ম পুরোহিত) বলে চিৎকার করতে লাগল। তাদের এড়িয়ে তাড়াতাডি হাঁটতে লগলাম। একটু এগিয়ে যাবার পর তিনটি আমেরিকান্‌ যুবতী আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং তাদের হাত দেখে যদি তাদের ভাগ্য বলতে পারি তবে প্রত্যেকে একটি করে ডলার দিবে সে লোভও দেখাল। তাদের কথায় আমি থমকে দাঁড়ালাম। তারা কি চিন্তা করে তিন ডলারের তিনখানা নোটি আমার হাতে দিতে চাইল। তাদের ডলার ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তারা আমেরিকান না ইউরোপীয়ান? যুবতীরা বলল তারা আমেরিকান এবং হিন্দু অকালটিস্ট, স্পিরিচুয়েলিস্ট পামিস্ট্‌ এসবের উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। তাদের কথা শুনে আমি বললাম এসব আমি মোটেই বিশ্বাস করি না, তারা ইচ্ছা করলে আমাকে রেহাই দিতে পারে। মেয়েরা বলল, “আমেরিকাতে হিন্দু এবং ইউরোপীয় জিপ্‌শীরা এসব করেই দুপয়সা রোজগার করে, আপনি তা থেকে বাদ যেতে পারেন না, এসব যদি আপনি না জানেন বলেন তবে নিশ্চয়ই আপনি হিন্দু নন।”

 “আপনাদের কি ধারণা যে আমরা এসব করেই দিন কাটাই? মহাত্মা গান্ধির নাম শুনেছেন কি?”

 “হাঁ শুনেছি তিনি একজন ফকির ছাড়া আর কিছুই নন।”

 মেয়ে তিনটিকে কাছে ডেকে এনে বললাম, “আপনারা হিন্দুদের সম্বন্ধে যে ধারণা করে রেখেছেন তা সম্পূর্ণ ভূল। হিন্দুদের মাঝে অনেক লোক আছেন যারা আপনাদের চেয়ে কম সভ্য নন। শিক্ষায় দীক্ষায় এমন অনেক হিন্দু আছেন যাদের সংগে আপনাদের দেশের অতি অল্প লোকেরই তুলনা করা যেতে পারে। এখন আপনারা পথ দেখুন।” আমি এখন হতে আর পাগড়ী ব্যবহার করব না, এতে লোকে যদি আমাকে নিগ্রো ভেবে অপব্যবহার করে তাও মাথা পেতে নিব। যখন আমি মেয়ে তিনটির সংগে কথা বলছিলাম তখন উল্লিখিত ভদ্রলোক তিনজনের একজন আমার সংগে পরিচয় করেন এবং পরে অন্য দুজন এসে যোগ দেন।

 আমেরিকায় দুটি রাষ্ট্রনৈতিক দল আছে। এই দুটি দলের মাঝে কখনও মতের মিল দেখা যেত না। এক দল অন্য দলকে টেক্কা দিয়ে নতুন কিছু করে জনসাধারণের সহানুভূতি অর্জন করত। এতে ফল ভালই হত। আমেরিকার পরিষ্কার এবং সুন্দর পথ ঘাট, বাড়ি ঘর, আর্থিক এবং নৈতিক উন্নতি তারই ফলে গড়ে উঠেছিল। আমেরিকার পূঁজিবাদীরা ভেবে দেখল, এরূপ দলাদলির ফলে তাদের বেশ ক্ষতি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তাদের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এদিকে আমেরিকান কন্‌স্টিটিউসন মতে এরূপ দল ভেংগে দিবারও অধিকার তাদের ছিল না। তাই তারা একটু নতুন পথ অবলম্বন করল। সে পথটি হল জনমতের প্রতিনিধিদের বশীভূত করে রাখা। কি প্রকারে সে কাজটি হয় তা এখানে বলার বিষয় নয়। আমি শুধু জেনেছিলাম এবং বেশ ভাল করে বুঝেছিলাম যে আমেরিকার জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের বশীভূত এবং ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের ধনীরাই আমেরিকার কাজ কর্মের চাবিকাঠি তাদের মুঠার মাঝে রেখে দিয়েছে। দুদিকের দৃশ্যাবলী দেখার জন্য ওয়ালস্‌ স্ট্রীটে আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে চলতে লাগলাম। বড় বড় বিল্ডিংগুলি দেখে সেখানে কি হয় না হয় তার কিছুরই সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই সাথীদের একটি পাবলিক স্থানে নিয়ে যেতে বললাম। সেয়ার মারকেট কাছেই ছিল, আমরা সেয়ার মারকেটের হলঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম। হলঘরে তখন অনেক লোক দাঁড়িয়ে বেচাকেনা করছিল। সেয়ারের দাম ক্রমাগতই নামছিল এবং বাড়ছিল। আমি সেয়ারের দাম উঠা নামার দিকে একটুও তাকাচ্ছিলাম না, শুধু লক্ষ্য করছিলাম লোকের আচার ব্যবহার, কারণ আমেরিকায় যাবার পূর্বে একদিন বোম্বের সেয়ার মারকেটে গিয়ে কতকগুলি পাগল দেখে ভয় হচ্ছিল এদের হাতেই যদি আমাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিতে হয় তবে বড়ই বিপদে পড়তে হবে। সুখের বিষয় ওয়ালস্‌ স্ট্রীটের সেয়ার মারকেট সেরূপ নয়। এখানে শৃংখলা বিরাজমান। ক্রেতা এবং বিক্রেতাগণ ধীরে কথা বলছিল। এক দলের কথার শব্দ অন্য দলের কানে পৌঁছচ্ছিল না। এটাকেই বলে ইউরোপীয় সভ্যতা। এখানে একে অন্যের সুযোগ এবং সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখেই কাজ করে। বম্বেতে সেরূপ কিছুই নাই।

 আমাকে দেখতে পেয়েই কতকগুলি সেয়ার বিক্রেতা কাছে আসল এবং শেয়ারের ফর্দ্দ হাতে দিয়ে শেয়ারের গুণাগুণ বলতে লাগল। তাদের কথায় বাধা দিয়ে বললাম আমি এখানে ব্যবসা করতে আসিনি। ব্যবসায়ীরা কেমন ব্যবসা করছে তাই দেখতে এসেছি, আমি একজন ভারতীয় পর্যটক মাত্র। আমাকে ঠাট্টা করে একজন বলল, “যদি আজ লক্ষ খানেক ডলার রোজগার করতে পারি তবে আমিও আপনার মত পর্যটক হব।” আমি বেশিক্ষণ এদের কাছে না দাঁড়িয়ে সাথীদের নিয়ে হলঘর হতে বেরিয়ে পড়লাম। ওয়ালস্‌ স্ট্রীটে এমন কিছুই ছিল না যা দেখে আমার আনন্দ হতে পারে, তাই সাথীদের নিয়ে ওয়ালস্‌ স্ট্রীট পরিত্যাগ করে অন্যত্র আর কিছু দেখার মত আছে কিনা তা দেখাতে বললাম।

 লোকে ওয়াশিংটন দেখতে যায়। আমি কিন্তু সেদিকে পা বাড়াইনি। সেখানে যেয়ে লাভ কি? ওয়াশিংটনে কি হবে কি না হবে তা ঠিক হয় ওয়ালস্‌ স্ট্রীটে। এখানে থেকেই আমেরিকার গতিপথ দেখা ভাল। শহর হিসাবে ওয়াশিংটন আমার দেখা উচিত ছিল, কিন্তু দক্ষিণ দিকে বর্ণবিদ্বেষ এতই প্রবল যে তাল সামলাতে পারব না বলেই সেদিকে পা বাড়াইনি।

 যে সকল ভারতবাসী ভারতের বাইরে যান তাদের প্রত্যেকের উচিত বিদেশীর সহানুভূতি অর্জন করা। সেরূপ সহানুভূতি অর্জন করতে হলে অর্থ এবং সময়ের দরকার। আমার কিন্তু এদুটার কোনটাই ছিল না। তবে যারা বিদেশে আড্ডা গেড়ে বসেছেন এবং দেশসেবাই যাদের একমাত্র কাজ, তারা না করতে পারেন এমন কাজ নাই। লোকমুখে শুনেছি, মিঃ হরিদাস ও মোবারক আলী এবং আরও কয়েকজন ভদ্রলোক আমেরিকাতে ভারতবাসীর জন্য বেশ খাটছেন, এমন কি তারা নিজের খেয়ে জংগলের মোষ পর্যন্ত তাড়াতে কসুর করছেন না। আর্ল বল্‌ডুইন যখন আমেরিকায় লেকচার দিতে গিয়েছিলেন তখন এই দুটি ভদ্রলোক নাকি আর্ল মহাশয়ের প্রত্যেক লেকচারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন।

 অনেক চিন্তা করে দেখলাম হারলামে থাকা উচিত হবে না। এদিকে আমার সংগে যে সামান্য অর্থ ছিল তারও একটা সুব্যবস্থা করতে হবে, তাই একদিন বাড়িওয়ালীর মেয়েকে সংগে নিয়ে একটি ব্যাংকে গেলাম। ব্যাংক ম্যানেজার ইংলিশম্যান, তিনি আমাকে নিগ্রো দুহিতার এক সংগে দেখে কিছুই মনে করলেন না, কিন্তু তার অন্যান্য সহকারীরা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিগ্রোরা কোন ব্যাংকে গিয়ে চেয়ারে বসতে সাহস করে না। আমি অভ্যাসবশেই একটা চেয়ার টেনে বসলাম এবং সংগের নিগ্রো মেয়েটিকেও অন্য একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।

 ম্যানেজার আমার সংগে কথা বলে একজন সংবাদপত্রের রিপোর্টারকে ডাকলেন। রিপোর্টার আমার দেশ এবং আমার সম্বন্ধে অন্যান্য সংবাদ নেবার পর জিজ্ঞাসা করলেন এমেরিকায় সাইকেলে বেড়িয়ে আমার কি লাভ হবে? আমি রিপোর্টারকে বললাম “এদেশ দেখাই আমার কর্তব্য, দেশে গিয়ে এদেশ সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে পারব। এরই মাঝে বুঝতে পেরেছি, যে সকল ধারণা আমার দেশের লোক আপনাদের দেশ সম্বন্ধে পোষণ করে তা মোটেই সত্য নয়। এদেশেও ডিমক্রেসী নাই। এদেশেও লোক অভুক্ত অবস্থায় থাকে। ডিমক্রেসী যে সকল দেশে বর্তমান আছে সেখানে কেউ উপবাস করে না। সোভিয়েট চীন, সোভিয়েট রুশিয়ায় তো কেউ উপবাস করে না। সকলেরই কাজ করার অধিকার আছে এবং সকলেই কাজ করছে। পূঁজিবাদীরা মুখে বলে তারা ডিমক্রেটিক, আসলে কিন্তু তারাও এক ধরনের ফেসিস্থ।” এসব কথা বলতে রিপোর্টারের সন্দেহ হল আমি ইন্‌টার ন্যাশনেল কমিউনিস্ট দলের একজন সভ্য। লোকটির ভুল ভেংগে দিয়ে বললাম, “আমি কোন দলের লোক নই, আমি একজন পর্যটক মাত্র। তবে অনেকদিন দেশ ভ্রমণ করে খাঁটি ডিমক্রেসীর সন্ধান পেয়েছি বলেই এসব কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। আমরা শুনেছি আমেরিকার সকলই ধনী, এখানে এসে দেখলাম বেকার মজুরের সংখ্যাও উপেক্ষা করার মত নয় এবং মজুরীর দামও কমতে আরম্ভ করেছে। তবে একটি কথা শুনে সুখী হবেন মিঃ রিপোর্টার, আপনারা এদেশে যত উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন অন্য কোন দেশ সেরূপ উন্নতি করতে সক্ষম হয়নি। আমি আপনাদের দেশের খারাপ দিকটা দেখার জন্য আসিনি, আমি এসেছি আপনাদের দেশের ভালর দিকটা দেখতে।”

 সংগের নিগ্রো মেয়েটি আমার কথা শুনছিল আর ভাবছিল। সে চেয়ারে বসে থাকতে পারছিল না। তার দুর্দশা দেখে ব্যাংকের কাজ শীঘ্র শেষ করে বাইরে এসে তাকে বিদায় দিলাম। সে বিদায়ের বেলা বলল, “সত্বর ফিরে এস, আমি তোমার কথা আজই আমার বন্ধু মহলে প্রচার করব।” মেরীকে বিদায় দিয়ে এবার আমি সুস্থ মনে পথে বেড়াতে লগলাম।

 নিউইয়র্ক নগরের ঠিক মধ্যস্থলে একটি পার্ক আছে তাকে বলা হয় সেণ্ট্রেল পার্ক। সেই পার্কটি দেখতে বড়ই ইচ্ছা হল। তারপর এ রৌদ্রে কোথায়ই বা আর যাই? সেণ্ট্রেল পার্কে গিয়ে সেই পার্কে বেড়াতে লাগলাম। পার্কটি বেশ বড়। গড়ের মাঠের দ্বিগুণ তা হবেই। তাতে নানারূপ বৃক্ষ। বৃক্ষগুলি সাজানো। মাঝে মাঝে সরোবর আছে। সরোবরে বেলে হাঁস এবং অন্যান্য পাখী এসে বিচরণ করে। মাছও সরোবরে প্রচুর রয়েছে। কিন্তু এখানে সুযোগমতে যদি দুষ্ট লোক কাউকে পায় তবে তাকে হত্যা করে যথাসর্বস্ব হরণ করে। এখানে এসে একজন সিলেটি ভদ্রলোকের সংগে পরিচয় হল। পরিচয় জানলাম তাঁর বাড়ি আমার গ্রাম হতে বার মাইল দূরে। দেশে তিনি মোল্লার কাজ করতেন, এখন তিনি একজন পাকা কমিউনিস্ট। তিনি আমাকে পেয়ে যত আনন্দ পেলেন আমি তার চেয়ে বেশী আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি যখন আমার পরিচয় পেলেন তখন তার চোখদুটো লাল হয়ে উঠল। তিনি কি কতকগুলো কথা বললেন তার একটাও বুঝলাম না, বোধ হয় হিব্রু ভাষায় কথা বলছিলেন। তার পর তিনি আমাকে একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। রেস্তোরাঁয় খাবারের যা অর্ডার করলেন তা শুনে অবাক হলাম। খাবার এলে বললেন, “গরু গরুই, দেবতা নয়, শূকরও তাই। খেয়ে হজম করতে পারবে তো ঠাকুর?” আমি নীরবে সবই গলাধঃকরণ করলাম। কথায় কথায় বললেন, “মিঃ প্যাটেল এসেছিলেন। লোকটি ভাল, কিন্তু পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদী বুদ্ধি আর স্বভাব, যতদিন সুযোগ ও সুবিধা থাকে ততদিনই বজায় থাকে, সহজে যায় না।”

 আমাকে তিনি তার ঘরে নিয়ে গেলেন না, নিয়ে গেলেন ‘ইন্‌টার ন্যাশনাল’ নামীয় একটি হোটেল। যত রাজ্যের কমিউনিস্ট এই হোটেলটাতে বাস করে। কয়েকজন লোকের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েই তিনি হল ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কমরেডগণ, এই লোকটা আমার দেশ থেকে দুদিন পূর্বে এসেছে, একদম তাজা। এর সংগে কথা বলে বুঝতে পারবে ভারতে আমাদের কি অবস্থা। যদি পার তো কয়েক দিনের মধ্যে এটাকে মানুষ তৈরি করে ফেল।” পংগপালের মত অনেক লোক নীচে নেমে এল, তাদের মধ্যে ছিলেন দুজন ভারতীয় ছাত্র। কার্পূরতলার মহারাজা আমেরিকায় এসেছেন, তাঁরই কথা অনেকক্ষণ ধরে চলল। তারপর আমাকে জিগ্‌গাসা করা হল আমি তাঁরই দলের একজন কি না। মোল্লা মশায় লাফিয়ে উঠে বললেন, “না হে, লোকটা পেটি বুরজোয়া, আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি। আমার জন্ম হয়েছে কৃষকদের মাঝে, আর ওর জন্ম হয়েছে প্রকৃত পরশ্রমজীবিদের মাঝে। আমাদের রক্ত খেয়ে ওরা বাঁচে, তাই দেখাতে এনেছি এদের আকৃতি প্রকৃতি দেখতে কেমন, এদেশে যেমন এরূপ জীবের অভাব নাই, আমাদের দেশেও তেমনি সেরূপ জীবের অভাব নাই।”

 কমিউনিজমের প্রতি আস্থা থাকলেও এরূপ ক্ষেত্রে মন বিরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এদের কথা শুনে আমার মনের পরিবর্তন হয়েছিল, কিছুই ভাল লাগছিল না। এমনি যখন মনের অবস্থা তখন জর্জিক জাহাজের একজন অফিসার এসে হাজির হলেন। তাকে দেখেই চিনতে পারলাম; তিনিও আমাকে চিনতে পারলেন। দুজনায় একটু কথা হল, তারপর তিনি আমাকে ‘কমরেড’ রূপে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলের মুখের ভাব বদলে গেল। এইবার আমার পালা। মোল্লা মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এমন অশিষ্টাচার করে মানুষকে দলে টানা যায় না। লোককে রাগাতে নাই, বুঝাতে হয়। লোক বুঝুক, তারপর আপনিই দলে আসবে। যারা বুঝেও আসবে না, আজ আমার জন্য যে ব্যবস্থা করেছিলেন সেই ব্যবস্থা তাদের জন্য করতে পারেন। ধর্ম প্রচার এবং কমিউনিজম প্রচার এক নিয়মে হয় না। মনে রাখবেন, ধর্মপ্রচারের পিছনে রাজশক্তি থাকে, কিন্তু কমিউনিজন প্রচারের পিছনে রাজশক্তি থাকে না। কাজেই এরূপ ক্ষেত্রে, কাজে সফল হতে হলে ধৈর্যের দরকার, সাহসের দরকার, সহিষ্ণুতার দরকার। মোল্লা সাহেব, যাকে দলে টানবেন তাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিবেন, শত্রু বলে নয়।”

 অনেক কথা বলে গভীর রাত্রে যখন ফিরছি, মোল্লা সাহেব আমাকে তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “দেশের লোক কি এখনও বোঝে না যে, তাদের সুখ-শান্তি নাই, সুযোগ-সুবিধা নাই?” আমার বলার মত আর কিছুই ছিল না। সবিনয়ে মোল্লা মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। পরের দিন একশত আট স্ট্রীটের পূর্বদিকে একটা রুম ভাড়া করে চলে গেলাম। এখানে সবাই সাদা। সাদা লোকের কাছে না থাকলে নানারূপ অসুবিধা হয়। এখানে এসেই নিজের পরিচয় দিয়ে, নানারূপ বিষয় জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্থান পরিবর্তন করার পরই এমন অনেক লোকের সংগে দেখা হল যাতে নিউইয়র্কে পথ প্রদর্শকের অভাব হল না।

 অনেকেই হয়ত শুনেছেন আমেরিকার লোক ধনী। আমারও সেই ধারণা ছিল। আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরে কয়েক সপ্তাহ থাকার পরই নিত্য নূতন সংবাদ আমি পেতে লাগলাম। শ্রীহট্ট নিবাসী আমেরিকা প্রবাসীরা এবং অন্যান্য প্রবাসী ভারতবাসীরা আমাকে মিস্‌ মেয়ো লিখিত বই এর একটা পাল্টা বই লিখতে বললেন এবং সেই অনুযায়ী নানা স্থানের এবং নানা লোকের সংগে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। যে যা বলতেন সব কিছুতেই আমি সম্রাট নাসিরউদ্দীনের মত ‘তাই হবে’ বলে সায় দিতাম, কিন্তু আমার মনের কথা কারও কাছে বলতাম না। ঠিক করেছিলাম, আমেরিকাতে ভাল যা কিছু দেখব দেশে গিয়ে তারই কথা বলব। আমেরিকার দোষের কথা স্বদেশবাসীর কাছে বললে তাতে আমেরিকার ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে আমাদেরই।

 টাইম্‌স্ স্কোয়ার নিউইয়র্ক-এর একটি প্রসিদ্ধ স্থান। টাইম্‌স্‌ স্কোয়ার দুই ভাগে বিভক্ত, আপ ও ডাউন। আমাদের কথায় বলব “পাতলপুরী এবং আকাশ পুরী”। মর্ত্য বা উপরে ৪২নং স্ট্রীট ও ৫নং এভিনিউ এর সংযোগ স্থলে দিনরাত লোকের ভিড় লেগে থাকে। এমন ভিড় কলকাতার কোথাও দেখা যায় না। জনতা নিয়ন্ত্রণের নিয়মকানুন সর্বসাধারণ দ্বারা শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সংগে প্রতিপালিত হয়। এতে জনতার সকল রকমের সুবিধা হয়। ফুটপাথে যারা চলে তারা একে অন্যকে বাঁয়ে রেখে চলে। আলোর সাহায্যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হয়; অবশ্য পুলিশও থাকে। পুলিশ দুরকমের। যারা পুলিশের সাধারণ পোষাক পরে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, পদচারীদের নানা বিষয়ে সাহায্য করে। তাদের ছাড়াও আর একরকমের গুপ্ত পুলিশ আছে। তাদের দেখি নি। তাদের কথা শুনেছি মাত্র। তারা গুপ্ত পুলিশ, ওদের বলা হয় ‘জিম্যেন’। তাদের পোষাকের কোন বিশেষত্ব নাই। সাধারণ পোষাক পরেই তারা অপরাধীর সন্ধান করে বেড়ায়। শুনেছি, পথচারীদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা করে, ওরা তাদের কাছে ঘেঁষে না। ওদের ধারণা যারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় তারা পকেটমার জাতীয় নিকৃষ্ট জীব হতে পারে না।

 এইবার পাতালের কথা বলছি। লণ্ডনের মত এখানেও ভূগর্ভ রেলপথ আছে। কিন্তু লণ্ডনের চেয়ে লোকের চলাচল বেশী এবং স্টেশনগুলিও তুলনায় অনেক বড়। টাইম্‌স্ স্কোয়ার-এর স্টেশনের সংগে চেয়ারিং ক্রসের তুলনা হতে পারে না। টাইম্‌স্ স্কোয়ার হাওড়া স্টেশনের দ্বিগুণ। লোক চলাচল উপরে যেমন, নীচেও তেমনি। গাইড আছে, সে পথের সংবাদ দেয়। ডলারের ভাংগানি নিয়ে কয়েকটী লোক বসে থাকে, তাদের কাছে একশত ডলারের নোটও ভাংগানো যায় এবং তার জন্য কোনওরূপ বাট্টা দিতে হয় না। সুবিধা সব রকমে বিরাজ করছে। একটা দেখবার মতন জায়গা বটে। সেখানে গিয়ে অন্তত চার ঘণ্টা কাটালে স্থানটি কিরূপ তার কিছুটা বুঝতে পারা যায়।

 জায়গাটার কিন্তু বদনাম আছে। কয়েক দিন নানা লোকের সংগে সেখানে যাওয়া আসা করছিলাম, পরে একদিন একাকী গিয়ে বুঝতে পারলাম বদনাম যা আছে তা সত্য বটে। এই স্থানটি দেখে মনে হল মিস্‌ মেয়োকে গিয়ে বলি, তিনি যেমন ভারতবর্যের নর্দমা ঝাঁট দিয়ে বই লিখেছিলেন তেমনি হারলামের কোণ থেকে আরম্ভ করে টাইম্‌স্ স্কোয়ারের বুক পর্যন্ত ঝাঁট দিয়ে যদি বই লিখতেন তবেই বলতাম তিনি স্বাধীন লেখিকা। কিন্তু দেখা হয় নি। শুনলাম তিনি কোনও হিন্দুর (অর্থাৎ ভারতবাসীর) সংগে সাক্ষাৎ করেন না।

 মর্ত্য আর পাতালের কথা বলছি, এইবার স্বর্গ বা আকাশের কথা বলি। গংগা নদীর উপর একটা পুল আছে―সেরূপ পুল যদি হাওড়া থেকে আরম্ভ করে চন্দননগর পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয় এবং তার উপর যদি বোম্বাইএর মত ইলেক্‌ট্রিক ট্রেণ চলে তবে তা দেখতে যেমন হবে, এলিভেটরও ঠিক সেরূপ। এলিভেটরের উপর লিফ্‌ট্‌এ করে ওঠা যায়, পায়ে হেঁটে উপরে উঠার সিঁড়িও আছে। যাদের ভূঁড়ি মোটা তাদের পায়ে হেঁটে এলিভেটরে উঠতে দেখা যায়। অনেকের বিশ্বাস হেঁটে এলিভেটরে উঠলে পেট কমে। টাইম্‌স্‌ স্কোয়ারের কাছে, এলিভেটরের স্টেশনে বিকাল বেলা এবং রাত্রি দুটার পর ভয়ানক ভিড় হয়। এখানে নূতন জীবনের স্বাদপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণীরই ভিড় বেশী!

 নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি, এই তিনটি মাস নিউইয়র্ক নগরের গরিব লোকের পক্ষে বড়ই কষ্টকর সময়। যাদের ঘরভাড়া দিবার ক্ষমতা থাকে না, শীতে তাদের বড় কষ্ট হয়। শীত মানুষকে যেমন পরিশ্রমী করে তেমনি শক্তিহীনও করে দেয়। যাদের শক্তিহীন করে দেয়, তারাই বিপদে পড়ে। শীতের তীব্রতায় পথে আশ্রয়ের সন্ধানে হেঁটে যখন একেবারে কাতর হয়ে পড়ে তখন সেই ধনী দেশের গরিব লোকেরা আণ্ডার গ্রাউণ্ড রেলওয়েতে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। পাতাল শীতের সময় গরম থাকে। কিন্তু খাবার খেতে তাদের আবার মাটির উপর উঠে আসতে হয়। উপর নীচে যাওয়া আসা করতে দশ সেণ্টের দরকার। অথচ দশ সেণ্ট খরচ করলে ছোটখাটো গরিব-হোটেলে রাত কাটান যায়। তবু গরিবেরা পাতাল প্রবেশ করে, শুনেছি শীত ছাড়া আরও কারণ আছে। কিন্তু সেকথা আমার বলে দরকার নাই, মিস্‌ মেয়ো যদি তা বলতেন তবেই ভাল হত। শোনা যায় আমেরিকায় এই শ্রেণীর গরিবদের মনের গতি তত ভাল নয়।

 আমেরিকায় বেকারদের জন্য সাপ্তাহিক খাইখরচ বাবদ সাহায্য দেওয়া হয়। কিন্তু মনে রাখা উচিত, সাহায্য সহজলভ্য নয়, তাতে সুপারিশের দরকার হয়। তাছাড়া নাগরিকের অধিকার না থাকলে এ সাহায্য পাওয়া যায় না। সুপারিশ ও নাগরিকের অধিকার লাভ ভারতবাসীর পক্ষে যেমন কষ্টকর, ইউরোপীয়দের পক্ষে তত কষ্টকর না। হলেও সহজে তারাও নাগরিক হতে পারে না। এ এক বড় বালাই। গরিবদের বিক্ষোভের পুন্‌জীভূত ধূমরাশি ঊর্ধ্বাকাশে উঠছে, এখন বাকী শুধু অগ্নির সন্‌চার; হয়ত একদিন অনুকূল বাতাসের সন্‌চার হবে এবং আগুনও দেখা দিবে। তখনই প্রকৃতভাবে আমেরিকায় “বাই দি পিপুল, ফর দি পিপুল, অফ দি পিপুলের” স্বরূপ বিকশিত হবে।

 গত বৎসরের হিসাব মতে আমাদের দেশের লোক আমেরিকায় মাত্র তিন হাজার ছিল। নিউইয়র্ক, ডিট্রয়, স্টকটন, লুগাই ও ইম্‌পেরিঅ্যাল ভ্যালিতেই তারা থাকে। অন্যান্য স্থানে যে দু-একজন আছে তারাও উক্ত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত তবে তাদের সংগে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এখন আমি আর সকলের কথা ছেড়ে দিয়ে নিউইয়র্ক-এর ভারতীয়দেরই কথা বলব।

 নিউইয়র্ক-এর হিন্দুদের সংখ্যা পাঁচ-শ থেকে ছয়-শ; এর মধ্যে বাংগালী মুসলমানই শতকরা নব্বইজন। বাকী দশজন অন্যান্য ভারতবাসী। তাতে পান্‌জাবী, পারসী, বাংগালী হিন্দু, সিংহলীও আছে, এবং তারা প্রত্যেকেই দেশ থেকে ভাল রকম লেখাপড়া শিখেই গিয়েছিল। বাংগালী মুসলমানরা আমেরিকাতে নাবিক হয়ে যায় এবং জাহাজ থেকে পলায়ন করে চিরতরে আমেরিকায় বসবাস করবার চেষ্টা করে। যে কয়জন শিক্ষিত লোক আমেরিকায় গিয়েছে তারাও ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। আমেরিক সরকার বর্তমানে একটা আইন পাশ করেছেন; যে সকল বাদামী (Brown) ও হলদে (Yellow) বিদেশী ১৯২১ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে আমেরিকায় পৌঁছেছিল। তারা অর্ধ-নাগরিকরূপে গণ্য হবে। অর্ধ-নাগরিকের মানে হল তাদের নির্বাসন (Deportation) দেওয়া হবে না। আমেরিকার নাগরিক হলে যে সুবিধা পাওয়া যায় সে সব সুবিধা অর্ধ-নাগরিকরা পাবে না; তবে মাত্র আমেরিকায় থাকতে পারবে। এরা কাজকর্ম পায় না। আমেরিকার নাগরিকরা যেমনভাবে কাজ পেয়ে থাকে এদের সে অধিকার নাই। এরূপ অর্ধ-নাগরিক হওয়া কত কষ্টকর তা যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁরাই ভাল করে জানে।

 যাঁরা সমুদ্রে বেড়িয়েছেন অথবা নাবিকের সংগে কথাবার্তা বলেছেন তাঁরা হয়ত ভাল করেই জানেন কয়লাওয়ালা, আগুনওয়ালা, খালাসী ও তেলওয়ালা জাহাজে কি কঠোর পরিশ্রম করে। এ সকল চাকরি পেতে এবং তা বজায় রাখতে তাদের তিন মাসের মাইনে সারেংকে দিতে হয়। এইভাবে দিয়ে থুয়ে এবং নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা যখন আমেরিকার বন্দরগুলিতে গিয়ে উপস্থিত হয় তখন স্বতঃই তাদের পালিয়ে যাবার ইচ্ছা হয়। কিন্তু পালিয়ে যাবার পথ সুগম নয়। প্রথমত আমেরিকার বন্দরগুলিতে ভারতীয় নাবিকদের অবতীর্ণ হবার পাশই খুব কম দেওয়া হয়। তারপর যারা পাশ পেয়েও যায়, তারা যখন তীরে নামে, তখন হয় সারেং নয় টেণ্ডল তাদের সংগে থাকে। সারেং, টেণ্ডল সংগে থাকলে পালিয়ে যাওয়া অতীব কঠিন। তা ছাড়া সারেং ও টেণ্ডলগণ সদাসর্বদা নাবিকদের ‘কাফের’এর দেশে থাকতে মানা করে এবং আমেরিকায় যদি থেকে যায় তবে মরলে পরে নরকে যাবে বলে ভয় দেখায়। অনেকে পালাবার সুযোগ পেয়েও নরকে যাবার ভয়ে পালায় না। যারা নরকের ভয় পায় না, এবং সুযোগ পায়, তারাই পালায়। অনেকে আমার কাছে বলেছে তথাকথিত স্বর্গ মানুষের কল্পিত, বাস্তব স্বর্গে কিছুদিন বসবাস করে পরে নরকে গেলে দুঃখ করার কিছুই থাকবে না। ভারতীয় মজুরগণ আমেরিকাকে খাঁটি স্বর্গ বলেই ভাবে। বাস্তবিক আমেরিকার বাসগৃহ, পথ ঘাট স্বাস্থ্যবিধান, শিক্ষা প্রভৃতি আমাদের পক্ষে অনেকটা আমাদের দ্বারা কল্পিত স্বর্গেরই মত।

 পূর্বেই বলেছি আমেরিকার ডক থেকে বার হতে গেলে চুরি করে বার হওয়া যায় না। তবুও আমাদের দেশের লোক পালায়। আল্লা তাদের হৃদয়ে ভক্তি দিয়েছেন, বাহুতে শক্তি দিয়েছেন, মগজে বুদ্ধি দিয়েছেন। আমার মনে হয়, পৃথিবীর লোক যা করতে পারে না, আমাদের দেশের লোক যদি সুযোগ ও সুবিধা পায় ত তাও করতে পারে। আমি এখন পূর্ববর্ণিত মোল্লা সাহেবের পলায়ন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বলছি।

 রাত্রি তখন তিনটা। নদীতে তখন ভাঁটা পড়েছে। মোল্লা সাহেব রান্নাঘর থেকে বড় বড় দুটা তামার হাঁড়ি বার করে রশি বেঁধে জলে ছেড়ে দিয়ে সেই রশি ধরে নিঃশব্দে নদীতে নেমে পড়লেন। তারপর ভেসে চললেন সমুদ্রের দিকে। শীতের সময় জলে থাকা কত কষ্ট তা বোঝান কঠিন। সেদিন বোধহয় তাপমান যন্ত্রে এক কি দুই ডিগ্রি উত্তাপ ছিল। মোল্লা সাহেবের শরীর অবশ হতে লাগল, আল্লাকে স্মরণ করে, তিনি ভেসে চললেন। মোল্লার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল। অবশেষে মৃত্যুর হাত ধরেই তিনি তীরে গিয়ে ভিড়লেন।

 নদীতীরে লোকজন ছিল না, নদীর তীর নীরব এবং নিস্তব্ধ। মোল্লা সাহেব তীরে উঠে শরীরটাকে ঝেড়ে অবসন্ন পায়ের উপর সাহস করে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ডক থেকে বার হয়ে একটা কাঁফেতে গিয়ে এক গিনি ফেলে দিয়ে কাফি চাইলেন। কাঁফের মালিক এরূপ লোক অনেক দেখেছে, অনেক সাহায্যও করেছে। মোল্লার প্রতিও তার দয়া হল এবং একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে, খাইয়ে, ঘরের উত্তাপ বাংলা দেশের উত্তাপের মত করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মোল্লা পরম আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে উঠেই মোল্লা বুঝলেন তার সাহায্যকারী গতরাত্রে তাকে প্রথম নম্বরের হারাম ‘সরাব’ খাইয়ে দিয়েছিল। এতে তার ভয়ানক রাগ হয়। প্রাণদাতা বন্ধুকে মোল্লা ‘কাফের’ বললেন তারপর তার ঘর পরিত্যাগ করলেন। পথে অনেক স্বজেলাবাসীর সংগে দেখা হল। কাফের ও কাফেরী কাজের কথা বলার সংগে অকপটে নিজের পলায়ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। এমন কি কোন্ জাহাজ হতে পালিয়ে এসেছেন তাও বলে দিলেন। মুসলমান ভাইএর কাছে সত্য না বললে পাপ হবে ভেবেই বোধহয় মোল্লা সাহেব সত্য কথা বলেছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই যেদিন লোকটির একটু চৈতন্য হ’ল সেদিন বুঝলেন আমেরিকা থেকে বিদায় করে দেবার জন্য পুলিস তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং এই বিপদের মূলে আছে তারই মুসলমান জাতভাই, সেইদিনই তার মনে এক বিদ্রোহী ভাবের সৃষ্টি হয়। তিনি নাম পরিবর্তন করলেন, দাড়ি গোঁফ মুণ্ডন করলেন, কাফেরী টুপি মাথার দিলেন, ইংলিশ শেখবার জন্য নৈশ বিদ্যালয়ে যেতে লাগলেন, নূতন ভাবের নূতন ফুল মোল্লার হৃদয়ে ফুটে উঠল। ফুলের ফল যে কি হয়েছে তার বর্ণনা পূর্বেই দিয়েছি।

 নিউইয়র্ক নগরে পূর্বে এমন কয়েকজন ভারতীয় ছিল যারা এই ধরনের লোককে ধরিয়ে দিলে টাকা পেত কিন্তু নূতন আইন প্রচলিত হওয়ার এই ধরনের নীচ অপচেষ্টা বন্ধ হয়েছে। নিউইয়র্ক পৌঁছবার পর অনেক স্বদেশবাসী, মোল্লাসাহেবের মত তাদের পূর্ব অভ্যাস অনুযায়ী আমাকেও ঘিরে ধরেছিল; কিন্তু যখন জানল যে আমি যাত্রীরূপে এসেছি এবং এদেশে থাকব না তখন তারা উক্ত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দিল।

 এত দুঃখকষ্ট সহ্য করেও যারা আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছে, নিজের স্বদেশবাসী হয়ে এবং এমন কি নিজের জাতভাই হয়েও সামান্য লাভের জন্য এদের পুলিসের নিকট ধরিয়ে দেয় এবং ভারতে ফিরিয়ে পাঠাবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়―এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে? এটাও সহ্য করা যায়, যেহেতু এসব কাজ যারা করে তাদের হিতাহিত জ্ঞান নাই বললেও চলে। কিন্তু তার চেয়েও বড় দুঃখের বিষয় হল, অনেক শিক্ষিত ভারতবাসী আমেরিকাতে গিয়ে বাজে কাজে দিন যাপন করে অথচ এই সব হিতাহিত জ্ঞানশূন্য স্বদেশবাসীদের সৎবুদ্ধি দিয়ে পথে আনার কোন ব্যবস্থাই করে না। হউক না এ সকল লোক মুসলমান ধর্মাবলম্বী? বিদেশের লোক ত ধর্ম বিচার করে না, অথবা ধর্ম দিয়ে জাতের নামকরণও করে না, এটা জানা সত্ত্বেও উদাসীন হয়ে এসব নিরক্ষরদের উপকার না করা মহা অন্যায় কাজ। অনেকে আবার “ফেলোসিপ অব রিলিজিয়ন” নিয়ে বেশ চিৎকার করেন, এবং সে চিৎকার আমি স্বকর্ণে শুনেছি। কিন্তু এই নিরক্ষর মুসলমানরা কি সকল ধর্মের বাইরে? যে সকল ভারতীয় ধর্মপ্রচারক আমেরিকায় গিয়ে ধর্মপ্রচার করেন তাদের দৃষ্টিও ওদের দিকে পড়ে না। বিঠল ভাই প্যাটেল যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন তিনি এসব অশিক্ষিত লোকের মাঝেই বসে থাকতেন। এসব অশিক্ষিত লোক তাঁকে আপনজনই করে নিতে পেরেছিল কারণ বিঠল ভাইও এদের অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। অনেক আমেরিকান বিঠলভাইএর অনুরাগীদের সংখ্যা দেখে তাজ্জব হয়েছিল। যারা স্বদেশবাসীকে মূর্খ এবং অপদার্থ ভেবে দূরে রাখতে চান তাঁরা বোধহয় জানেন না, তাঁরা সমাজের কতবড় শত্রু।  পরাধীন দেশের লোক স্বাধীন দেশে গিয়ে অনেক সময়ই খাপ খাইয়ে বসবাস করতে পারে না। আমরা অনেক বৎসরের পরাধীন। আমাদের নানা দোষ থাকবারই কথা। এসব দোষ অনেক সময় আমরা অনুভব করতে পারি না। বিদেশীরা আমাদের দোষ অতি সহজে বুঝতে পারে। আমেরিকাতে ভারতের শিক্ষিত লোক ক’জন গিয়েছিলেন তার সন্ধান আমি পাইনি। যারা আমার সামনে এসেছেন অথবা যাদের আমি সন্ধান করতে পেরেছি তাদের কথাই আমি বলছি। এই লোকগুলির মাঝে কয়েকজন বেশ গুণী লোকও দেখেছি, কিন্তু শিক্ষিত এবং গুণী হলে কি হয়, বহু বৎসরের পরাধীনতা আমাদের দেশের শিক্ষিত এবং গুণী লোককেও অন্ধ করে রেখেছে। যারা একদম অশিক্ষিত অবস্থায় আমেরিকায় গিয়েছে তারা বরং অনেক সময় যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে পারে। দেশের কথা ভাবে, বিদেশীর সংগে খাপ খাইয়ে বসবাস করতে পারে। তবে এরূপ লোকের সংখ্যা খুবই কম। এরূপ লোক সাধারণত বাংলার একেবারে অজ পাড়াগাঁ হতে কলকাতায় এসে একদম নিউইয়র্ক অথবা সান্‌ফ্রান্‌সিস্কোতে গিয়ে জাহাজ হতে নেমে সরাসরি ইউরোপীয়দের সংগে মিশে গিয়েছিল। ভারতীয় ধর্মের প্রভাব এদের অন্ধ করে রাখতে পারেনি, ইম্‌পিরিয়েলিজমএর হিন্দু-মুসলমানীও এদের কাবু করতে সক্ষম হয়নি। এরা হিন্দু হয়ে জন্মেছে আর মরবেও হিন্দু হয়ে, ইণ্ডিয়ানত্ব এদের কাছে কখনও পৌঁছবে না। ১৯৪০ খৃঃ জানুয়ারী মাস পর্যন্ত আমেরিকার অশিক্ষিত হিন্দুদের মাঝে কোনরূপ বিকার দেখা দেয়নি। এখন যদি সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে থাকে তবে তা আমার অগ্‌গ্যাত।

 আমেরিকাতে যে সকল হিন্দু স্থানীয় লোকের একপাড়ার থাকে না অথবা এক পড়ায় থাকবার মত মানসিক শক্তি অর্জন করেনি, তারাই সংখ্যায় বেশী। এরা কখনও আমেরিকার নাগরিক হতে পাবরে বলে নে হয় না, কারণ এরা এখনও শিক্ষা এবং কৃষ্টি হতে অনেক দূরে রয়ে গেছে। যাঁরা আমেরিকার নাগরিক হয়েছেন তাঁদের শিক্ষা যেমন রয়েছে তেমনি হয়েছে তাঁদের কাল্‌চারের উন্নতি। ত্রিপূরা জেলার শ্রীযুক্ত জগৎবন্ধু দেব মহাশয়ের নাম এখানে উল্লেখ করে বাস্তবিকই আমি গর্ব অনুভব করছি।

 যে সকল হিন্দু আমেরিকাতে এখনও নাগরিক হতে সক্ষম হয়নি তারা শিক্ষাদীক্ষায় যেমন অনেক পেছনে পড়ে আছে তেমনি তাদের কাজকর্মের ফলে ভারতের বদনামও হচ্ছে। ভারতবাসীকে আমেরিকাতে নাগরিক হতে হলে নানারূপ পরীক্ষা পাশ করতে হয়। যেসকল হিন্দু নাগরিকত্ব পায়নি তারা মজুরী করবার অধিকার হতেও বন্‌চিত হয়। সজন্যই আমাদের দেশের লোক আমেরিকাতে বাধ্য হয়ে বেকার থাকে এবং নানারূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করে জীবিকা অর্জন করতে বাধ্য হয়। এসকল লোক শিক্ষার অভাবে নিজের নিকটস্থ আত্মীয়ের সর্বনাশ করতেও কোনরূপ সংকোচ মনে করে না। মিথ্যা মোকদ্দমা করা এদের একদিন পেশা ছিল বললেও দোষ হয় না। সেজন্য বোধহয় আজ নিউইয়র্কে যদি কোন অনাগরিক হিন্দু অন্য কোন অনাগরিক হিন্দুর বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়ে মোকদ্দমা করে তবে সেই মোকদ্দমা গ্রাহ্য হয় না।

 আমাদের দেশে এমন কতকগুলি আইন আছে যার সাহায্যে যে-কোন লোককে যে-কোন সময়ে গ্রেপ্তার করা যায়। আমেরিকাতে সেরূপ কোন আইন নাই। তথায় প্রথমেই প্রমাণ করতে হয় লোকটি দোষী নতুবা গ্রেপ্তার করা চলে না। ভারতবর্ষ হতে যেসকল লোক খালাসীর কাজ নিয়ে জাহাজ হতে পালিয়ে আমেরিকাতে বসবাস করছে, তাদের যদি জাহাজী আইন মতে গ্রেপ্তার করে ভারতে ফিরিয়ে পাঠাতে হয় তবে প্রমাণ করতে হবে অমুক নামের লোক আমেরিকার অমুক বন্দরে অবতরণ করে এতদিন গা ঢাকা দিয়ে রয়েছিল। এতটুকু প্রমাণ হবার পর জাহাজী আইনে দোষী লোকটিকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দেওয়া হয়। আমেরিকার পুলিশ এখন হিন্দুদের নাড়ীনক্ষত্র জেনে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে। যদি আমেরিকা হতে জাহাজী আইনে দোষী হিন্দুদের তাড়াতে হয় তবে হিন্দুদেরই সাহায্য নেওয়া দরকার নতুবা এ কাজটি কোন মতেই সম্পন্ন হবে না। তারপর এ কাজটি শুধু বেকার ভারতবাসীর দ্বারাই সম্ভব। ভারতীয় বেকার অর্থের লোভে সকল রকমের অন্যায় কাজই করতে রাজি হয়। কারণ তাদের দেশাত্মবোধ মোটেই নাই, তারা জানে শুধু নিজেকেই বাঁচাতে। সেজন্যই অনেক ভেবে চিন্তে এবং অনেক পরামর্শের পর হয়ত আমেরিকা সরকার আমেরিকা হতে ভারতবাসী নির্বাসনের কাজ ভারতবাসীর উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। এতে আমেরিকার সুবিধা হল অনেক কিন্তু ভারতবাসী আমেরিকাতে আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

 আমাদের প্রিয় নেতা প্যাটেল যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন তিনি চেষ্টা করেছিলেন যাতে করে ভারতবাসী এসব অন্যায় কাজ হতে দূরে থাকে। তিনি যতদিন আমেরিকায় ছিলেন ততদিন একটিও অনুরূপ ঘটনা ঘটেনি। তিনি কতকগুলি গণ্যমান্য লোককে বলে এসেছিলেন, আমেরিকাতে যেন হিন্দুর রক্তে হিন্দুর হাত আর কলংকিত না হয়। কিন্তু উপদেশে কি হয়, পাল্টা উপদেশ যদি পায় তবে ভারতবাসী আসল কথা ভুলে যায়। পরাধীন জাতের লোক ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানই বেশি দেখে, জাতের সম্মান যাতে বাড়ে সেদিকে মোটেই তাকায় না। একটা ইউরোপীয়কে বেশ করে নিন্দা কর, তার মা-বাবাকে বেশ করে গাল দাও সে হয়ত কিছুই বলবে না, কিন্তু যেই তার জাতের বিরুদ্ধে কিছু বলেছ অমনি সে তোমাকে মারতে আসবে। জাপানীরাও তাই। একজন জাপানীর সামনে তার ধর্মকে বেশ করে গাল দাও, তার মাতার চরিত্রে কলংক আছে বল, সে তোমাকে এড়িয়ে যাবে, কিন্তু যেই তার জাতের বিরুদ্ধে, তার দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলেছ আমনি সে তোমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। হয় সে মরবে নয় তোমাকে মারবে। আমরা তার বিপরীত। তারই ফলে আমরা পরাধীন।

 আমাদের দেশের লোক আমাদের কি করে সর্বনাশ করে তারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া ভাল মনে করি। আফ্রিকা হতে লণ্ডন আসার পর আমার মন এতই দমে যায় যে বর্ণ-বিদ্বেষের অত্যাচারকে আমি যেমন ঘৃণা করতাম তেমনি অবহেলাও করতাম। আমার মনে সদাসর্বদা হিন্দুর জাতিভেদের কথাই মনে আসত বেশি করে এবং সেই জাতিভেদের অত্যাচার হতে ভারতবাসীকে কি করে মুক্ত করা যায় তারই কথা চিন্তা করতাম। নানা চিন্তায় অনেক সময় আমার দরকারী কথাও মনে থাকত না। যা হউক তখনকার দিনের ‘দেশ’ কাগজের লেখক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে মাঝে মাঝে পত্র লিখে প্রকৃতিস্থ রাখতেন। তিনি আমাকে পত্রযোগে জানিয়েছিলেন নিউইয়র্কে অনেক বাংগালী বাস করে এবং তাদের মাঝে অনেকেই নিরক্ষর। লণ্ডনে হিন্দুস্থান এসোসিয়েসনের সেক্রেটারী মিঃ সুরাত আলীও এই শ্রেণীর কয়েকটি লোকের ঠিকানা দেন। সেই ঠিকানা অনুযায়ী নিউইয়র্কে একখানা পত্রও লিখেছিলাম। তার পরই আবার সকল কথা ভুলে যাই।

 নিউইয়র্কে দু’সপ্তাহ থাকার পর কয়েকজন সিলেটি মুসলমানের সংগে সাক্ষাৎ হয়, তারা আমাকে একটি প্রশ্ন বেশ জোর দিয়েই জিজ্ঞাসা করে, সেই প্রশ্নটি হল আমি কোন জাহাজে এবং কবে এসেছি। যখন আমি বললাম জর্জিক নামক জাহাজে এসেছি তখন তারা আমার কথায় বিশ্বাস করল না এবং আমাকে বেশ ভাল করেই অবহেলা করল। আমিও তাদের সংগে কথা বললাম না। আমি ভাবলাম এরা নিরক্ষর এবং মূর্খ।

 ঘটনাক্রমে একদিন একজন হিন্দু বাংগালীর সংগে সাক্ষাৎ হয়। তিনি সিলেটি মুসলমানদের এক সংগে থাকেন এবং এদের যাতে উন্নতি হয় সেই চেষ্টাই সকল সময় করেন। তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে যান এবং আরও তিনজন সিলেটি মুসলমানের সংগে পরিচয় করিয়ে দেন। এই তিনজন সিলেটি মুসলমান আমি কোন জাহাজে এসেছি সে প্রশ্ন করেনি। তবে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এমন কোনো সিলেটি মুসলমান আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনি কোন্‌ জাহাজে এসেছেন?” আমি বলেছিলাম তিনজন লোক আমাকে সেরূপ প্রশ্ন করেছে। তবে তাদের নাম জানি না। সেদিনই এই তিনজন লোকে আমাকে তাদের আড্ডায় নিয়ে যায়। আড্ডাটি একটি অজ্ঞাত স্থানে অবস্থিত। নিউইয়র্কএর মত স্থান, যথায় কেউ পথ ভুল করে না, তথায়ও তাদের আড্ডায় যাবার সময় আমার পথ ভুল হয়েছিল। আমরা গিয়েছিলাম টেক্‌সিতে। কখন যে কোন পথ ধরে কোথায় গেলাম তার কিছুই বুঝলাম না। যখন আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছলাম তখন সে স্থানে কয়েকজন লোককে আরবি ধরনে বসে কাফি খেতে দেখলাম। আমি যাবামাত্র তিনজনই এক সংগে উঠে আমাকে সম্বর্ধনা করলেন। আমি একখানা মাদুরের ওপর বসলাম। এক পেয়ালা কাফি আমাকে খেতে দেওয়া হল এবং একজন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আমার পরিচয় পেয়ে অন্য একজন একটা দেরাজ খুলে আমার প্রেরিত চিঠিখানা আমার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন এটা আমারই চিঠি কি না? আমার হাতের লেখা চিঠি তৎক্ষণাৎ চিনলাম এবং বললাম, “মহাশয়গণ আশা করেছিলাম আপনারা জাহাজে যাবেন এবং জাহাজ হতে নামতে সাহায্য করবেন কিন্তু সেদিন আপনারা আমাকে মোটেই সাহায্য করেন নি।” উপবিষ্ট ভদ্রলোকদের মাঝে যার বয়স একটু বেশি বলেই মনে হল, তিনি বললেন, “আমরা ভেবেছিলাম আপনি জাহাজ হতে পালাতে চান এবং সে বিষয়ে আমাদের সাহায্য চান। যদি জানতাম আপনি পেসেন্‌জার হয়ে আস্‌ছেন তবে কমের পক্ষে হাজার লোক গিয়ে আপনাকে সম্বর্ধনা জানাতাম। আমরা আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে পারিনি বলে বড়ই দুঃখিত এবং যাতে আপনি উপযুক্ত সম্মান পান তার ব্যবস্থা করা হবে।” তারপরই শুরু হল অন্য কথা। সে কথার সংগে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না সেজন্য আমি মুখ ফিরিয়ে বসে কাফি খাচ্ছিলাম।

 আমার সংগে এদের আর বিশেষ কোন কথা হল না। সেদিনের মত বিদায় নিয়ে আমি চলে এসেছিলাম এবং এদের কথা একরূপ ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন একজন লোক এসে আমাকে জানাল যে সিলেটি মুসলমানদের মাঝে একটি সভা হবে এবং সেই সভায় আমার ভ্রমণকাহিনী বলতে হবে। নিধারিত দিনে সভাতে উপস্থিত হবার পর একজন লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই সভায় এমন কেহ কি আছে যে জিজ্ঞাসা করেছে আপনি কোন্‌ জাহাজে এসেছেন?” যে কয়জন লোক আমাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিল তাদের দেখিয়ে দিলাম। এই কাজটি করার পরই আমাকে সে রুম হতে বের করে দিয়ে অন্য রুমে বসতে দেওয়া হল। বের হয়ে যাবার পূর্বে শুধু শুনেছিলাম “ধরে ফেল”। সিলেটি কথায় ধরে ফেল কথাটাকে বলা হয় “ধইরা ফালাও”। কোনও জীব হত্যার সময় এরূপ কথার ব্যবহার হয়ে থাকে। চিন্তিত মনে আমি আমার মেসে এসে শয্যা গ্রহণ করেছিলাম। সেদিন বিকালবেলা কারো সংগে সাক্ষাৎ করিনি। যাতে করে কোনও হিন্দুর সংগে দেখা না হয় সেজন্য বলুওয়ার্ড নামক স্থানে অনেকক্ষণ ভ্রমণ করে একটি রুশ দেশীয় ফিলম্‌ দেখে রুমে ফিরে আসি।

 পরে এই ঘটনা সম্পর্কে নানা গল্প শুনেছিলাম। কোনও একটি লোক নাকি একেবারে উধাও হয়েছিল। আর একটি লোক নাকি গুরুতর আঘাতে অনেক দিন শয্যাশায়ী ছিল। এখন কথা হল এমন হয় কেন?

 নবপরিচিত বাংগালীর সংগে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। খাবারের উত্তম ব্যবস্থা ছিল। অনেক দিন বিদেশে থাকার জন্য হাতে ভাত খেতে মোটেই ভাল লাগত না। তাদের ঘরেও কাঁটা চামচ থাকত। তারা যখন আমার এক সংগে খেত, কখনও তাদের হাতে ভাত খেতে দেখিনি। আমার ধারণা ছিল, কাঁটা চামুচ দিয়ে এরা শুধু আমারই সামনে খায়, অন্যথায় দক্ষিণ হস্তের ব্যবহারই করে। এরা সাত তলাতে থাকত। তাদের খাবার ঘরের খিড়কী দরজা যখন খোলা থাকত, তখন ষ্ট্রীটের বিপরীত দিকের মুখোমুখী বাড়ির লোক এদের খাবার ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে বেশ ভাল করেই দেখতে পেত। সেজন্য খিড়কী দরজার পর্দা প্রায় সব সময়ই বন্ধ থাকত। একদিন আমি খিড়িকী দরজার পর্দা সরিয়ে দিয়ে হাত দিয়েই ডাল ভাত খেতে লাগলাম। তখন অন্যান্য লোক বসার ঘরে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ একজন এসে যখন দেখল আমি খিড়িকী দরজা খুলে হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছি, তখন সে চটপট করে খিড়কী দরজার পর্দা নামিয়ে দিয়ে আমার দিকে রক্ত চক্ষু করে বলল আমরা ভাবতাম আপনি অনেকগুলি দেশ দেখে একটু সভ্য হয়েছেন, কিন্তু এখন দেখছি আপনার কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সভ্যই হউন, আর না হউন তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না, আমাদের এই সমাজে থাকতে হয়, অতএব এই সমাজের নিয়ম মেনে চলাই হ’ল এক মাত্র কাম্য। আমরা স্বদেশে যেতে চাই না। মজুরের স্বদেশ বলতে কিছুই নাই। যেখানে মজুর পেট ভরে খেতে পায়, থাকবার উত্তম স্থান পায় এবং মজুরের মজুরীর সংগে উপযুক্ত সম্বল পায় সে স্থানই হ’ল মজুরের স্বদেশ। আমরা যদিও নাগরিক হইনি, একদিন নাগরিক হব এই আশা করেই এখানে আছি।” আমি লোকটির কথায় মোটেই জবাব দিলাম না, কারণ এটা হ’ল আমার ইচ্ছাকৃত কাজ। খাবার খেয়ে বসবার ঘরে গিয়ে দেখলাম সকলেই মাথা নত করে রয়েছে। আমি এদের এই দুরবস্থা দেখে নিজের দোষ স্বীকার করলাম এবং তাদের বললাম, “আপনারা যে এতটুকু উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন, সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ।”

 আর একটি লোক দুঃখ করে বলল, “অনেকে স্বদেশ স্বদেশ বলে চিৎকার করে, কিন্তু যারাই দেশে গিয়েছে তারাই বুঝতে পেরেছে স্বদেশের মানে কি? কলিম উল্লার ছেলে ছলিমের দেশে যাবার পর সে জ্ঞান বেশ হয়েছে। ছলিমের সমাজে একটুও সম্মান ছিল না। দেশে ফিরে যাবার পর তাকে কেউ সম্মান ত দেয়ই নি উপরন্তু হিংসার বশবর্তী হয়ে তার যথাসর্বস্ব অপহরণ করেছে। আমরা আর দেশে যেতে চাই না। এদেশেই যাতে আমরা সুখে থাকতে পারি, তার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা করছি। এতে যদি আপনাদের মত নবাগত এসে বাদ সাধে, তবে আমরা তা নীরবে সহ্য করব না। আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আমাদের দেশের কতকগুলি মোকদ্দমা-প্রিয় লোক এদেশে এসেও পূর্বের অভ্যাসমত এখানেও অনর্থক মিথ্যা মোকদ্দমার সৃষ্টি করেছিল। তারা এত দূরে এসেও এত নিকৃষ্ট কাজে অগ্রসর হওয়াতে

অনেকেরই দৃষ্টি তাদের উপর পড়ল। অনেকে তাদের ভাল উপদেশ দিল, কেউ বা ভয়ও দেখাল। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হ’ল না তখন উপযুক্ত ব্যবস্থার ফলে এখন তারা সে কুঅভ্যাস পরিত্যাগ করেছে। আপনিও যদি পুনরায় হাতে খান তবে আপনার প্রতিও সেরূপ কোন ব্যবস্থা হতে পারে।”

 বৃটিশ কলোনীতে উৎশৃংখল ভাবে চলাকেই ডিমক্রেসী বলে। উৎশৃংখলতার প্রশ্রয় সর্বত্র দেওয়া চলে না। ভারতে যেমন করে ধর্মের নামে উৎশৃংখলতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে অন্যত্র তেমন কোথাও দেওয়া হয় না। প্রথম প্রথম যারা আমেরিকাতে গিয়েছিল তারা পাজামা পরে লম্বা সার্ট গায়ে দিয়ে পথে যেত। শ্রীহট্টের লোক জাল বুনে নদী নালা হতে মাছ ধরত। শিখরা পাগড়ী বেঁধে থিয়েটারে যেত। এসব অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকবার জন্য সর্বসাধারণ যখন নিষেধ করত, তখন সেই পুরাতন ধর্মপ্রীতি এবং বর্বরোচিত স্বদেশপ্রেম জেগে উঠত। ফলে ভারতবাসীকে আমেরিকানরা নাগরীকত্ব আর দিল না। যাদের দিয়েছিল তাও কেড়ে নিল। কোনও অন্যায় কাজ করে তাকে স্বদেশীকতার আবরণ দিয়ে, সেই অন্যায়কে চালাবার চেষ্টাকেই বর্বরোচিত স্বদেশপ্রেম বলে। এরূপ হীন কাজ যাতে আর না হয় সেজন্য অনেকগুলি ভারতবাসী আপ্রাণ চেষ্টা করছে দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম।

 “আমি মোকদ্দমা করব, আমি পাজামা পরব, আমি পাগড়ী বাঁধব তাতে তোমার কি? যদি কোন অনিষ্ট হয় তবে আমার হবে।” এই রকমের কথা যারা বলে এবং এরকমের কথা যারা মেনে চলে তারা সমাজে বাস করার উপযুক্ত নয়। যে কয়জন ভারতবাসী এরকমের কথা বলে নিজের মতকে সমর্থন করেছিলেন; শুনেছি তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। যারা শাস্তি পেয়েছিল তাদের অনেকে নাকি “ডিস্‌এপিয়ার” হয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতদিন আমেরিকায় থাকব ততদিন হাতে খাব না, কাঁটা চামচ ব্যবহার করব, নতুবা “ডিস্‌এপিয়ার” হতে হবে।

 আমেরিকাতে যাবার পর হিন্দুরা এক নতুন জীবন লাভ করে। সেই নতুন জীবনে তারা যা পায় তারা আটকে রাখতে চায়। তাই তারা টাকা পায় না, তারা সম্মান পায় না, তারা পায় সুখ এবং সুবিধা। একখানা ফারনিস্ট ফ্ল্যাটে তারা পায় চারটি রুম। একখানা বসবার ঘর―যাতে থাকে একটা লম্বা ভেলভেট দিয়ে মোড়া বেন্‌চ, যাতে বসলে কোমরের অর্ধেকটা ডেবে যায় এবং স্প্রিংএর বেশ সুন্দর একটা ঝাঁকানি লাগে। এতে ইচ্ছা করলে শুয়েও থাকা যায়। তারপর আরও কিছু থাকে, যেমন দুখানা টেবিল, দুখানা আরাম চেয়ার, চারখানা বসবার চেয়ার ইত্যাদি। শোবার রুমে থাকে এমন একখানা বিছানা যা ভারতবাসী অনেক সময় সেই বিছানার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কাছেই বাথরুম। সে রুমে থাকে গরম এবং ঠাণ্ডা জলের নল―টবে সে জল নিয়ে যত ইচ্ছা তত স্নান কর। রান্না ঘয়ে বাসন এবং গামছা দেওয়াই থাকে, গ্যাসের উনুন থাকে, হাত ধুইবার জন্য গরম এবং ঠাণ্ডা জলের পাইপ থাকে। এরূপ আরামদায়ক রুম তার সাপ্তাহিক ভাড়া মাত্র আট ডলার। যে সকল দরিদ্র মজুর কুঁড়ে ঘরে বাস করেছে, চৌকীদার হতে আরম্ভ করে যার তার কাছে সকাল হতে ঘুমানো পর্যন্ত অপমানিত হয়েছে, সেই লোকরাই আমেরিকায় গিয়ে ইংলিশ শিখে জগতের সংবাদ রাখবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাকে যদি তুমি পন্‌চাশ ডলার পাবার বদলে ভারতে পাঠাবার বন্দোবস্ত কর তবে সে প্রতিহিংসা নিবে না কেন? এই করে আমেরিকায় হিন্দু হিন্দুর রক্তে প্রায়ই হাত কলংকিত করছে।

 আমি অপরের কথিত সুসমাচার আমার বই-এ লিপিবদ্ধ করব না, আমি নিজে যা দেখেছি এবং আমার নিজের জীবনের উপর দিয়ে যা ঘটে গেছে তারই কথা শুধু বলব। অনেকে হয়ত বলবেন, এযে আত্মজীবনী হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমেরিকার সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানতে চাই। ভ্রমণ-কাহিনীতে নিজের ভ্রমণ কথা ছাড়া আরও কিছুই থাকে না। আমার দৃষ্টিতে যা আসবে তাই আমি পাঠক সমাজকে ভাষার সাহায্যে বলতে চেষ্টা করব। এর বেশী বলতে গেলেই আমার পক্ষে অনধিকার চর্চা হবে। অনধিরকার চর্চায় কুফল যেমন হয় তেমনটি অন্য কিছুতে হয় না।

 সান্‌ফ্রানসিস্‌কো যাবার পর আমি ঔপন্যাসিক ধরনে স্থানীয় তথ্য যোগাড় করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম এই অজ্ঞাত স্থানে কে আমার শত্রুতা করবে! একটি ব্যাংকে আমার টাকাগুলি জমা রেখে দিয়েছিলাম। টাকা আনবার জন্য প্রায়ই আমাকে ব্যাংকে যেতে হত। একদিন টাকা নিয়ে বের হয়েছি। এমনি সময় দেখলাম একজন পান্‌জাবী আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমার তাতে চিন্তা করার কি আছে? তবে এই মাত্র ভেবেছিলাম লোকটি আমার স্বদেশবাসী পান্‌জাবী―শীতের দেশে অনেকদিন বাস বরে তার শরীরের রং বদলে গেছে এবং দেখতে অনেকটা গৃক অথবা ইটালীয়ানদের মতই হয়ে গেছে। এরপর আমি এন্‌ত্রপলজির কথা নিজেই চিন্তা করছিলাম।

 কয়েকদিন পরই একটি আমেরিকান যুবকের সংগে আমার পরিচয় হয়। যুবকটি অলস এবং বেকার। এরূপ ভেগাবণ্ড আমেরিকায় প্রায়ই দেখা যায়। এরা কোন কাজই করতে রাজি নয়। যুবকটী আমার কাছ হতে সামান্য সাহায্য চেয়েছিল, আমি তাকে তার আশার অতিরিক্ত কিছু দেওয়ায় সে প্রায়ই আমার রুমে আস্‌ত এবং কালিফরনিয়ার হিন্দুদের কথা বলত। সে এমন কিছু বলত না যাতে আমি ওদের জীবনযাত্রার কিছু বিশেষত্ব অনুভব করতে পারি। সে শুধু বলত হিন্দুরা বড়ই কৃপণ, তাদের পকেটে একটি ডলার যদি একবার প্রবেশ করে তা আর বের হয় না। হিন্দুরা অতি অল্প খাদ্য খেয়ে সন্তুষ্ট থাকে। তার সেই কথাটির সত্যতা আমিও অনুভব করেছিলাম। একটি লোকের নিদারল্যাণ্ড ব্যাংকে পন্‌চাশ হাজার ডলার জমা ছিল, সেই লোকটির ঘরে গিয়ে দেখি যে সামান্য কয়টি মূল পাতা সিদ্ধ করে তারই সাহায্যে চপাতি খাচ্ছে। এরূপ কৃপণের পন্‌চাশ হাজার ডলার আমেরিকাতে থেকে জমানো কষ্টকর কাজ নয়।

 একদিন সেই যুবকটির সংগে আমি একটি সিনেমা দেখতে যাই। রাত বারটার সময় সিনেমা ঘর হতে বের হয়ে সে মারকেট স্ট্রীটের দিকে রওয়ানা হয়েছিল আর আমি হাওয়ার্ড স্ট্রীট ধরে থার্ড স্ট্রীটের দিকে চলছিলাম। পথে দোকানগুলিতে কি কি জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার দৃশ্য দেখে চলছিলাম। একটি সিনেমা ঘর পার হয়ে দুখানা দাকানের সামনে যে বাতি ছিল তা অতীব অনুজ্জ্বল এবং সেই অনুজ্জ্বল আলোয় সাজানো জিনিসগুলি বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি যখন মন দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম তখন হঠাৎ আমার পেছন দিক হতে একটা লোক পিস্তলের অগ্রভাগ দিয়ে আমাকে একটা খোঁচা মারে। আমি তৎক্ষণাৎ তার দিকে ফিরেই দেখলাম লোকটি আমেরিকান এবং আমাকে হত্যা করার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে লোকটিকে বল্‌লাম “বস গিভ্‌ মি এ বাট্‌” অর্থাৎ হে প্রভু দয়া করে আমাকে আপনার হাতের অর্ধদগ্ধ ভুক্তাবশিষ্ট সিগারেট টুকরাটি দিয়ে বাধিত করুন। আমার কথা শুনে লোকটি আমার দিকে একটু চেয়ে দেখল তারপর আমার হাঁটুতে এবং ঊরুতে কয়েকটি পদাঘাত করে তার হাতের সিগারেটটি আমার হাতে দিয়ে বলল “গেট্‌ আউট্‌ ইউ ডেম্‌ নিগার, ইউ আর সেইভড্‌” অর্থাৎ অসভ্য নিগ্রো এখান হতে চলে যা, তুই আজ বেঁচে গেলি। আমি ক্ষণকাল বিলম্ব না করে নিকটস্থ একটি রেস্তোরাঁতে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং নিগ্রো প্রথায় এক পেয়ালা কাফি চাইলাম। দোকানী আমাকে এক পেয়ালা কাফি দিল এবং তাই হাতে করে নিয়ে ফুটপাথের উপর বসে টুপিটা আরও একটু টেনে দিয়ে কাফি খেতে লাগলাম। যখন আমি কাফি খাচ্ছিলাম তখন সেই পিস্তলধারী লোকটি আমার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমাকে দেখিয়ে বলছিল আজ এই গাধাটা বেঁচে গেল এবং আর একটা লাথি আমার পিঠে লাগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। আমি কান পেতে শুনছিলাম লোকটি বলছিল শয়তান হিন্দুটা গেল কোথায়? একে পাওয়া মাত্র হত্যা করতে হবে।

 কাফি খেয়ে, কাপটি ফেরত দিয়ে, নিগ্রো প্রথা মতে হেঁটে রুমে গিয়ে হাত পা ছেড়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লাম। পদাঘাতের অবমাননা, প্রাণের ভয়, এসব নানা চিন্তা মনকে অস্থির করে তুলেছিল। আমরা বলি জীবন তুচ্ছ, কিন্তু আমার কাছে আজ মনে হতে লাগল জীবন অমূল্য সম্পদ। প্রতিহিংসা কার উপরে আদায় করব? কেন আমাকে হত্যা করা হবে? এসব চিন্তা একটার পর একটা এসে আমাকে চিন্তিত করে ফেলছিল। ইচ্ছা হয়েছিল বার থেকে ওয়াইন এনে খেয়ে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হই। কিন্তু ভয় হল পাছে কেউ এসে গুলী করে। নানা চিন্তায় রাত কাটতে লাগল। সকাল হল। আমি হাতমুখ ধুয়ে বাড়িওয়ালীর ঘরে গেলাম। বাড়িওয়ালী আমার গম্ভীর মুখ দেখেই বুঝলেন আমার কিছু বিপদ হয়েছে। আমাকে তিনি সকল কথা খুলে বলতে বললেন। আমিও যা ঘটেছিল তা তাকে বললাম। তিনি আমার কথা শুনে একটু চিন্তা করেই টেলিফোন হাতে নিয়ে জনৈক হিন্দুকে ডাকলেন এবং জবাবও পেলেন। তাদের মাঝে যা কথা হয়েছিল তা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাদের কথার অবিকল নকল দেওয়া গেল।

 “আপনি কোথা হতে কথা বলছেন?”

 “এখন আমার কোন নম্বর দিব না।”

 “তবে বিশ্বাসঘাতকটা আপনার ওখানেই থাকে?”

 “বিশ্বাসঘাতক বলবেন না, লোকটি ভূপর্যটক, তার প্রমাণ দিতে সক্ষম হব। তার সংগে সাইকেল আছে, সংবাদপত্রের কাটিং আছে, তিনখান পাসপোর্ট আছে, যদি আদেশ করেন তবে এসব নিয়ে আমি আসতে পারি।”

 “আপনার কি মনে হয় লোকটা ঠিক ঠিকই নির্দোষ?”

 “যদি নির্দোষ না হত তবে আমি এরূপ কথা কখনও বলতাম না।”

 “আপনি সাইকেল ছাড়া আর সব দলিল নিয়ে আসবেন।”

 “তাই হবে।”

 আমি আর ঘর হতে বের হলাম না, বাড়িওয়ালী আমার কাগজপত্র নিয়ে গন্তব্য স্থানে গেলেন এবং আমার কাগজ দেখালেন। আমার কাগজপত্র দেখার পরই বোধহয় তাদের সন্দেহ দূর হয় এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে ফোনে ডাকা হয়। ফোনে যে সকল কথা হয়েছিল তারও অবিকল নকল দিলাম।

 “ক্ষমা করবেন মহাশয়, আমরা ভেবেছিলাম আপনি ইমিগ্রেসন বিভাগে কাজ করেন। সাইকেল নিয়ে বের হন না কেন?”

 “স্যানফ্রানসিস্‌কো ভয়ানক উঁচু নীচু শহর, এখানে পায়ে হাঁটতেই পছন্দ করি।”

 “আপনি আজ বিকালে সাইকেলে মারকেট স্ট্রীটে বেড়াবেন আমরা দেখব আপনি ভিড়ের মাঝে কেমন সাইকেল চালাতে পারেন। আর একটা কথা, আপনি টমাস কুক ব্যাংকে এবং মারকেট স্ট্রীটের শেষ সীমার বইএর দোকানে রোজ যান কেন?”

 “টমাস কুক ব্যাংকে আমি টাকা রেখেছি। রোজ যে টাকা দরকার হয় তাই নিয়ে আসি, আর মারকেট স্টীটের শেষ ভাগে ফেরি বোটের কাছে যে দোকানে আমি যাই তথায় বৈদেশিক দৈনিক সংবাদপত্র পাওয়া যায়, তথায় গিয়ে বৈদেশিক দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ করি।”

 “তাই বুঝি?”

 “হাঁ।”

 “নমস্কার।”

 বাড়িওয়ালী ঘরে এসে আমার রুমে আসলেন এবং হাঁপাতে লাগলেন। একটু শান্ত হয়ে তিনি আমাকে বললেন, “কাল আপনার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। আপনি নিগ্রোদের চালচলন এবং কথা বলার কায়দা বেশ শিখেছেন বলেই রক্ষা পেয়েছেন। যাক আজ বিকালেই আপনি সাইকেলে মারকেট স্ট্রীটে যান এবং বেশ করে বেড়িয়ে আসুন। এদের এখনও সন্দেহ রয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে একজন লোক আপনাকে একটা দলিল দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আপনি আপনার জানামত একজন উকিলের বাড়িতে তাকে নিয়ে যেতে, আপনি তাতে রাজি হননি, এতেই তাদের সন্দেহের কারণ আরও বেড়ে যায়। এখন আপনি নিরানব্বই পারসেণ্ট নিরাপদ। বিকালে যদি সাইকেলে করে মারকেট স্ট্রীটে বেড়িয়ে আসতে পারেন তবে আর ভয় নাই।

 আমেরিকার রাজপথে কেউ সাইকেল ব্যবহার করে না। অ্যাক্‌সিডেণ্ট হবার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যাক্‌সিডেণ্ট হবে এই ভয়ে আমি সাইকেল উঠিয়ে রাখিনি, আমার সাইকেল চালাতে কষ্ট হত তাই সাইকেল উঠিয়ে রেখেছিলাম।

 বিকাল বেলা থার্ড স্ট্রীট থেকে বের হয়ে হাওয়ার্ড স্ট্রীট দিয়ে মারকেট স্ট্রীটে পৌঁছে অনেকক্ষণ বেড়ালাম। বেড়াবার সময় দু’ একজন হিন্দু আমার সামনে এসে পড়েছিল এবং এমনি ভাবে দাঁড়িয়েছিল যাতে আমাকে সাইকেল থামাতে হয় কিন্তু সাইকেল চালাতে আমি বেশ পারদর্শী হয়েছিলাম। কখনও বেল বাজাতাম না। ধীরে সাইকেল চালিয়ে আমি লোকের পেছন চলতে সক্ষম হতাম। হিন্দুরা বুঝেছিল আমি প্রকৃতই একজন বাইসাইকেলী ভূপর্য্যটক। পরদিন আবার ফোনে কথা হয়েছিল। আশ্বাস পেয়েছিলাম আমি এখন মুক্ত। কেউ আমাকে আর হত্যা করতে চেষ্টা করবে না। যদিও আমি মুক্ত হয়েছিলাম কিন্তু সেই পদাঘাতের কথা এখনও মনে আছে। তারপর মনে আছে সামান্য অর্থের বিনিময়ে ভারতবাসী বিদেশে গিয়েও সাজানো সোনার সংসারে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। আরও দুঃখ হয় আমাদের নিকৃষ্ট মানসিক বৃত্তি দেখে, এর বেশি এখানে ভারতবাসীর সম্বন্ধে বলার কিছুই নাই।

 জ্যারনেলিষ্ট শব্দের অর্থ আমাদের দেশে “সংবাদপত্রসেবী” বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও জ্যারনেলিষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা আমাদের মত করে না। মজুরী শব্দের অর্থ ভাল করে অবগত হলেই এসব বাজে শব্দের ব্যবহার হতে রক্ষা পাওয়া যায়। আমি এখন জ্যারনেলিষ্ট শব্দই এখানে ব্যবহার করব। “সংবাদপত্রসেবী” শব্দ ব্যবহার করার সময় এ পৃথিবীতে কখন আসবে তা জানি না। যখন লোক ঠিক ঠিক ভাবে সংবাদ পত্রের সেবা করবে তখন “কর্তা ইচ্ছা কর্ম” হবে না। সাহিত্যিক মজুরগণ তখন স্বাধীনভাবে আপন আপন মনের কথা বলতে সক্ষম হবে। আমাদের দেশে হালে পূঁজিবাদ গঠন হতে আরম্ভ হয়েছে। পূঁজিবাদীরা সাহিত্যিক মজুর প্রচুরভাবে খাটাতেও আরম্ভ করেছে। আমাদের দেশে এমন কোন সাহিত্যিক মজুর নাই যিনি পূঁজিবাদীর কাছে তাঁর মজুরী বিক্রয় করার সময় ইচ্ছামত কলম চালাতে সক্ষম হন। তাঁকে পূজিবাদীর মনমত চলতে হয়! আমেরিকা পুরাতন পূঁজিবাদী, ইংলণ্ড তার চেয়েও পুরাতন, অতএব তারা ভাল করেই জানত এবং এখনও ভাল করেই জানে কি করে সাহিত্যিক মজুরদের খাটাতে হয়।

 পুরাতন সাহিত্য ঘাঁটা আমার অভ্যাস নেই। নিউইয়র্কে যতগুলি প্রগতিশীল লোকের সংগে আমার দেখা হয়েছিল, প্রায়ই দেখতাম তারা পুরাতন সাহিত্য নিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করে। জ্যন পেটারসন নামে একটি লোক একদিন আমাকে তার ঘরে নিয়ে যায় এবং আমাদের দেশ সম্বন্ধে নানা লোকের অনেক বই দেখায়। তাতে দেখতে পেলাম একটি সুন্দর প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধটিতে যা লেখা হয়েছে তার সারমর্ম চুম্বকে দিলাম।

 “হিন্দুরা কালীমাতার পূজা করে। তারা যখন বৃটিশের বিরুদ্ধে কোন গোপনীয় পরামর্শ করে তখনও কালীমাতার পূজা করেই কর্মস্থলে যায়। যদি কোনও বৃহৎ হত্যাকাজে কৃতকার্য হয় তবে তারা কালীমাতার মুর্তির সামনে নরবলি দেয়।” প্রবন্ধটা বেশ মন দিয়ে পড়েছিলাম বলেই অনেক দিন মনে রয়েছিল। এই প্রবন্ধ মাদার ইণ্ডিয়া নামক বইখানা প্রকাশিত হবার পূর্বেই প্রকাশ হয়েছিল। যিনি ‘সংবাদপত্রের সেবা’ করেছিলেন তার পেট বোধ হয় বেশ মোটা ছিল, নতুবা আমেরিকার গদর পার্টিকে হেয় করার জন্য এত বড় প্রবন্ধ তিনি লেখতেন না। সুখের বিষয় আমেরিকাতে যারা জারনেলিজম্‌ করে তারা সংবাদপত্রের সেবা না করে নিজের সেবার দিকেই বেশ দৃষ্টি রাখে।

 ভারতবাসীকে অপদস্থ করার জন্য দেশে এবং বিদেশে সর্বত্র সমানভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রকারের অপদস্থতা হতে রক্ষা পাবার জন্য যদি কেহ কেহ চেষ্টা করে তবে তা মোটেই দোষের নয়।