আজকের আমেরিকা/ডিট্রয়

উইকিসংকলন থেকে

ডিট্রয়

 সুড়ংএর ওপারে ডিট্রয় নগর। ডিট্রয় প্রকাণ্ড নগর। এখানে আসার পর পাসপোর্ট পরীক্ষা হল। এই পরীক্ষায় আমাকে একটুও কষ্ট পেতে হয় নি। তবে ইমিগ্রেশন অফিসার আমার বন্ধুদের একটু যেন ধমকে কথা বললেন কিন্তু তাদের তাতে গ্রাহ্যই নাই; উল্টা ধমক দিয়ে বলল, “ইউ গাইজ্‌ আর টু ফ্যাট, এ?” এর মানে হল “তোমরা বেশ মোটা হয়েছ নয় কি?” ইমিগ্রেশন অফিসার ওদের কথা শুনেই চুপ। কেননা এই ভংগীটাই খাঁটী আমেরিকান। ওদের কথা কাটাকাটি শুনে আমার মনে হল, ওরা বেশ ভাল করেই জানে কি করে সরকারী চাকরবাকরদের শিক্ষা দিতে হয়। আমাদের লাগেজ পরীক্ষার পর তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল। আমার বন্ধুরা আমাকে একটা হোটেলে রেখে সেই রাত্রেই চিকাগোর দিকে রওনা হল। পথে শুনেছিল চিকাগোতে অনেক কাজ খালি পড়েছে। কাজের অন্বেষণে যাওয়া বড়ই চমকপ্রদা কাজ। অনেক সময় কাজ পাওয়া যায় না, তা বলে কি পেটে হাত দিয়ে বসে থাকতে হবে? নিশ্চয় না। পেটে এবং মাথায় হাত দিয়ে বসে কুকুর প্রকৃতির লোক, মানুষ কাজ না পেলে কেড়ে খায়। অনেকে বলেন আমেরিকায় অনেক ক্রিমিনেল্‌স আছে। যদি কেউ ক্রাইম করে তবে পরাধীন দেশের লোক, স্বাধীন দেশের লোক ক্রাইম করতে পারে না। ক্রাইম কাকে বলে তাও তারা জানে না!

 অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় যখন ছিলাম তখন অস্ট্রিয়াতে অনেক লোক বেকার ছিল। তা বলে কোন বেকারই ক্ষুধায় মরেনি। অথবা তাদের স্বাস্থ্যেরও হানি হয় নি। তারা প্রত্যেক পাঁচ জনে মিলে এক একটি দল বেঁধে ধনীদের বাড়ীতে যেত এবং প্রত্যেকে দশ সেণ্ট করে ধনীর কাছে চাইত। যে ধনী তাদের ভিক্ষার আদেশ অবহেলা করত, সেই ধনীর বাড়ী হতেই তারা সামনে যা পেত তাই কেড়ে নিয়ে এসে বাজারে বিক্রয় করত। প্রথম প্রথম স্থানীয় পুলিশ এসব পাপীদের জেলে পুরতে লাগল। জেলে কয়েদীর সংখ্যা প্রত্যহ বাড়তে লাগল। ধনীর দল দেখল এরূপ ভাবে যদি লোককে জেলে পুরতে হয় তবে অস্ট্রিয়ার শতকরা পঁচানব্বই জনকে জেলে পুরতে হবে। অস্ট্রিয়া হয়ে যাবে জেলখানা। সেজন্য বেকার মজুরদের ভিক্ষার্থীরূপে দেখলে সকলেই

কিছু কিছু দিত। এটাকে ক্রাইম্‌ বলে না, এটাকে বলে দরবারের অভাব মেটানো।

 আমেরিকাতেও সেরূপই চলে। আমেরিকার ধনীর দল পুলিশের সাহায্যে তাদের ব্যাংক এবং অন্যান্য ধন দৌলত পাহারা দিয়ে রাখে। বেকার মজুর সুযোগ পেলেই লুট করে। এতে নরহত্যা হয়। ক্ষুধা নীরবে কেউ সহ্য করতে পারে না। সুখের বিষয় এই তথাকথিত পাপীর দল ভুলেও কোন খাদ্য ভাণ্ডার লুট করে না, তবে অর্থাভাবে খাদ্য খেয়ে চলে গেলেও অর্থাগমে খাবারের দোকানের দেনা সর্বপ্রথমই মিটিয়ে দেয়।

 একদিন আমি একজন হোটেলের মালিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই যে তিনটি লোক ভাড়া না দিয়েই রুমে প্রবেশ করল তারা কি পুলিশের লোক? হোটেলের মালিক বললেন এই তিন জন ভদ্রলোক, বেকার মজুর, তাদের হাতে অর্থ নাই, এঁরা যখন কাজ পাবেন তখন তাঁর দেনাই সর্বপ্রথম মিটিয়ে দেবেন বলে মৌখিক প্রতিজ্ঞা করেছেন। এঅন্‌চলে মুখের কথারও মূল্য আছে কারণ ছোট বেলা হতে ছেলেমেয়েরা মুখের কথার উপর নির্ভর করেই চলে।

 ক্রাইম্‌ শব্দটি পুঁজিবাদীদের দ্বারা রচিত। গরীবকে পুঁজিবাদীরাই ক্রাইম্‌ করতে বাধ্য করে এবং পুঁজিবাদীরাই যারা ক্রাইম করে তাদের আইনের সাহায্যে ধরে শাস্তি দেয়। যে সকল পুঁজিবাদী দেশের লোক সৎসাহসী তারা আইনকে অমান্য করতে সকল সময়ই বাধ্য হয়, বিদেশের এবং পরাধীন দেশের লোক পুঁজিবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদপত্র পাঠ করে তাজ্জব হয়ে যায়। যাদের পূর্বপুরুষ শুধু স্বর্গ নরকই ভাবত, তাদের পক্ষে আমেরিকার যুবকদের সৎসাহসের কথা শুনে ঘৃণা হবার কথাই।

আমেরিকার সর্বত্র Daw (ডও) বলে একটা কথার প্রচলন আছে। তারই সংগে আর একটি কথারও প্রচলন হালে হয়েছে, তাকে বলা হয় রেস্ যাকে আমরা বলি ঘোড়দৌড়। “ডও” বলে কথাটার যেমন প্রচলন আছে, তেমনি তার কাজও চলে।

 নিউইয়র্কের ১০৮ নং স্ট্রীট যেখানে মেডিসন এ্যাভেনিউ কেটেছে, ঠিক তার মোড়ে একটি গ্রোসারী দোকান আছে। এই দোকানে গিয়ে আমি প্রায়ই ফোন করতাম নিজের ঘরেও ফোন ছিল, কিন্তু তা ব্যবহার না করে দোকানের ফোনই ব্যবহার করতে ভালবাসতাম। একদিন ফোন করে এসে দোকানের ভেতরই একটা চেয়ারে বসেছিলাম, অমনি দুজন লোক দোকানে প্রবেশ করে আমাকে চেয়ারে বসা দেখেই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। আমার একমাত্র অপরাধ, শরীরের রং আমার কালো। এদের অগ্নিশর্মা মুখ দেখে আমি একটুও ভয় পেলাম না, বরং আরও উৎসুক নয়নে আরও একটু চেয়ে থাকলাম। দোকানী তাড়াতাড়ি করে উঠে আগন্তুকদের কাছে কি বলল এবং আগন্তুকদের মুখের অবস্থা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন হল। একজন আগন্তুক আমার কাছে এসে বসল, এবং বলতে লাগল “এই দেখুন আমার বাবা একজন ঢেম্ জু” এ পর্যন্ত বলেই লোকটি কথা বন্ধ করল, তারপর দোকানদারের মুখের দিকে চাইল। দোকানদার ইংগিত করল। ফের লোকটি আমার আরও কাছে এসে বলল “আপনাদের দেশে কি ডও প্রথা প্রচলিত নাই? ডও প্রথা কাকে বলে তা আমি জানতাম না, সেজন্য লোকটিকে বললাম ডও প্রথা কাকে বলে আমি জানি না।

 লোকটি আমাকে দোকানের বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল দেশে অনেক বেকার মজুর আছে, তারা যে প্রকারে বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য ছোট খাট দোকানদার হতে সাপ্তাহিক কিছু কিছু করে চাঁদা আদায় করে, সেজন্য কোনও রসিদ দেওয়া হয় না। যে সকল দোকানদার “ডও” দেয় না তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। আমরা আজ আমাদের এলাকায় ডও আদায় করতে বের হয়েছি। প্রত্যেক দোকানদারই কিছু কিছু করে আজ দেবে। চাঁদার সাহায্যে অনেকগুলি বেকার খেয়ে বাঁচবে। আমি একটু হেসে বললাম “অহো সেকথা, আমাদের দেশেও তার প্রচলন আছে”। মিথ্যা বলতে আমার একটুও ঠেকল না, কারণ এরূপ মিথ্যার আশ্রয় না নিলে প্রথমত নিজের দেশের বদনাম হয়, দ্বিতীয়ত বিপদেও পতিত হতে হয়। উভয় সংকট হতে একটি মিথ্যা কথায় উদ্ধার পেয়ে ফের দোকানে এসে বস্‌লাম। লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম “আপনি সত্যিই কি একজন জু?” লোকটি বলল “না মহাশয় আমার বাবা একজন কোয়েকার, তিনি আমার কাজ পছন্দ করেন না বলেই আমি তাঁকে জু বলেছি। আপনি হলে কি বলতেন?” “আমি বল্‌লাম কাপুরুষ কারণ জুদের আমরা ঘৃণা করি না।” লোক দুটি আর কোন কথা না বলে দোকানদার হতে দুটি ডলার আদায় করল এবং বিদায় নিয়ে অন্য দোকানের দিকে রওয়ানা হ’ল। তাদের সংগেও মোটরকার ছিল। দোকান হতে বের হয়ে তারা মোটরে না বসে পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। তাদের নির্ভিক ভাবে কাজ করতে দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম।

 দরিদ্র, দীন মজুর, দরিদ্রনারায়ণদের আরও একটি কাজ চলে। কতকগুলি সংবাদপত্র তাদের সেই সৎসাহসকে বাধ্য হয়ে সাহায্য করে। কাজটি অতি সোজা। শহরের প্রত্যেক এলাকায় এক একটি কেন্দ্র আছে। কেন্দ্রগুলি প্রায়ই গ্রোসারী দোকানে হয়। দোকানদার জিনিস বিক্রয় করার সময় কখন কখন বেশ হাসে। যখনই হাসে তখনই তার হাতে জুয়াখেলার টিকিটের চাঁদা এসেছে বুঝতে হবে। দোকানী চাঁদার পয়সাগুলি গুণে নেবার সময়ই যিনি চাঁদা দিলেন তার ঠিকানার একখানা কাগজও সে সংগে দিয়ে দেয়। চাঁদা কত দিল তাও কাগজের টুকরায় লেখা থাকে। চাঁদা আদায় হয় বেলা বারটা পর্যন্ত। তারপরই চাঁদা আদায়কারী সেদিনের চাঁদা বাবদ কত টাকা হয়েছে তাই একটার মধ্যে যথাস্থানে জানিয়ে দেয়। বিকালের চারটার সময় যে কোন শস্তা সংবাদপত্র কৌশলে কোন এলাকার কে সেদিন লটারী পেল তাই জানিয়ে দেয়। এমন সুন্দর এবং সহজ ভাবে এতবড় একটি বেআইনী কাজ পৃথিবীর অতি কম স্থানেই হয়। এসব করতে লোকবল এবং অর্থবল যেমন থাকা চাই তেমনি থাকা চাই একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস।

 যার ঘাড়ে একবার এই ভূত চেপে বসে সে সহজে এ ভূতকে নামাতে পারে না। এপ্রোভার হয়ে রক্ষা পাবার উপায় থাকে না, ইন্‌ফরমারের স্থান সেখানে নাই। একেই বলে কর্মতৎপরতা এবং সাহসের পরিচয়। এরূপ লটারী পদ্ধতি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে আছে এবং আমেরিকার অনেক নগরে চোখ থাকলেই দেখতে পাওয়া যায়।

 সুখের বিষয় আমার সাথীরা সে রকমের লোক ছিলেন না, বাস্তবিকই তাঁরা কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলেন।

 গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানির স্টেশনের পেছনে একখানা পাঁচতলা বাড়ি, সেখানে অনেক যাত্রী সময়ে অসময়ে গিয়ে থাকে। এই হোটেলে কালো চামড়ার প্রবেশ নিষেধ নাই। বিনা আপত্তিতে একটি ঘর ভাড়া পাবার অধিকার পেয়ে অনেকটা শান্তি বোধ করলাম। হোটেলে রাত্রিবাস করবার উপযোগী একটি রুমের জন্য ভাড়া দিতে হয় এক ডলার। ঘরটার দরজা জানালা খুলে দিয়ে শহরের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। এমন সৌন্দর্য আমেরিকাতেই শুধু দেখা যায়। পৃথিবীর কত জায়গাতেই ত ঘুরলাম, এমনটি আর কোথাও দেখি নি। মাইলের হিসাবে অর্ধলক্ষ মাইল আমার ভ্রমণ করা হয়েছে। বাইসাইকেল পর্যটক হিসাবে, বাইসাইকেলে ভ্রমণের ইতিহাস শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত আমিই সকলের চেয়ে বেশী দেশ ও মাইল ভ্রমণ করেছি। তার রেকর্ড আমার কাছে আছে। যদি আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয় হতাম তবে আমার রেকর্ড সংরক্ষণের সুবন্দোবস্ত হত। যাই হোক, আমেরিকার নগরীর দৃশ্য, বিশেষ করে রাত্রিবেলায়, এক অভিরাম বস্তু। আমেরিকার শহর এবং নগরের রাত্রির সৌন্দর্যের সংগে ইউরোপ ও এসিয়ার কোনও নগরের রাত্রির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।

 গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানির স্টেশনগুলি জি আই পি এবং এ বি আর স্টশনের চেয়েও বড়। যাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। গ্রে হাউণ্ড বাস কোম্পানিতে বিনা টিকিটে কেউ ভ্রমণ করতে পারে না। রেলগাড়িতে আমেরিকায় অনেক লোক বিনা পয়সায় যাওয়া-আসা করে। রেল কোম্পানিকে ফাঁকি দেবার ইচ্ছা সব দেশেই আছে, তবে আমাদের দেশের মতন আমেরিকায় কেউ কখনও রেলগাড়ি লাইনচ্যুত করে সাধারণ লোকের সর্বনাশ করেছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি। আমেরিকার রেলগাড়িতে যে সকল দুর্ঘটনা ঘটে তা প্রধানত কোম্পানিদের দোষেই। নির্দোষ লোকের প্রাণহানি করে তারা এর প্রতিশোধ নেয় না, প্রতিশোধ নেয় অন্যভাবে।

 আমাদের দেশে যেমন ইমপ্রুভমেণ্ট ট্রাস্ট আছে, আমেরিকাতেও তেমনি আছে। আমাদের দেশের ইমপ্রুভমেণ্ট ট্রাস্টকে যেমন নানারকম সরকারী খেয়ালের আইন মেনে চলতে হয়, সে দেশে তেমন নয়। আমেরিকার ইমপ্রুভমেণ্ট ট্রাস্ট শুধু বিজ্ঞান-সম্মত আইন মানে। একবার নিজামের হায়দরাবাদ শহরে গিয়েছিলাম। পথে বার হবার পর কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে তাঁদের শহরটি সম্বন্ধে আমার ধারণা কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বলেছিলাম, “ভারতের অন্যান্য শহর যেমন, হায়দরাবাদও তেমনি। ওই দেখুন সামনে মসজিদ পথ বন্ধ করে রেখেছে, বাতাসের অবাধ গতিও বন্ধ করেছে, মসজিদ্‌বাড়ি থেকে পচা ইট খসে পড়ছে, তবুও দাঁড়িয়ে আছে পথের মাঝে। এতে শহরটির স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু নাগরিকদের সেদিকে হুঁশ নাই।”

 আমেরিকার প্রত্যেক শহরে এবং নগরীতে “ডাউন টাউন” বলে এক-একটা স্থান আছে। এই সব স্থানে সিনেমা হোটেল বড় বড় দোকান রেস্তারাঁ প্রভৃতি এবং আমোদ-প্রমোদের স্থান থাকে। ডাউন টাউন-এ গৃহস্থের বাসের উপযুক্ত স্থান থাকে না। ডাউন টাউন ছাড়া নগরের অন্যত্র কোথাও সিনেমা, বড় বড় দোকান এবং বিলাসিতার সামগ্রী বিক্রয় করতে হলে সর্বসাধারণের ভোট নিয়ে তা করতে হয়। আদেশ না পেয়েও যদি কোন দোকান কিংবা অন্য কিছু করা হয়, তবে তার স্থায়িত্বের ঠিক থাকে না। যদি কোনও লোক দোকানীর বিরুদ্ধাচরণ করবার জন্য জনমত যোগাড় করে, তবে দোকানীকে দোকান ছেড়ে চলে যেতে হয়। আমেরিকাতেও অনেক বে-আইনী কাজ হয়ে থাকে বটে, কিন্তু ধরা পড়লে তার আশু প্রতিবিধান হয়।

 খানিকক্ষণ পরে স্নান করবার জন্য স্নানাগারের দিকে রওয়ানা হলাম। স্নানাগারে ঢোকবার পথে একস্থানে লেখা আছে—এই হোটেল শুধু পুরুষদের জন্যই! স্নানাগারের সামনে লেখা রয়েছে—একজন করে স্নানাগারে প্রবেশ করবে! লেখাগুলি পড়ে মনে নানারূপ সন্দেহ হল। বাড়িটাও দেখে মনে হল এটা যেন গৃহস্থের বাড়ি; বর্তমানে পার্টিশন লাগিয়ে বাড়িটাকে হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। স্নানাদি সমাপ্ত করে ফল কিনতে বের হব এমন সময় পথে দেখা হল হোটেলের ম্যানেজারের সংগে। তিনি আমার পরিচয় পেয়ে বড়ই আদর করতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে বাড়িটার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। ম্যানেজার বললেন, “দেখে বোধ হয় এটি গৃহস্থের বাড়ি, কিন্তু এরূপ স্থানে গৃহস্থ থাকে না, থাকতে পারে না। কিন্তু কর্পোরেশনের চোখে ধূলা দিয়েই বাড়িটা রাতারাতি প্রস্তুত হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই চালাকি ধরা পড়ে এবং যিনি বাড়ি করেছিলেন তাকে দণ্ড দেওয়া হয়। তাই আপাতত এই কাঠের পার্টিশন; সত্বরই অন্য ব্যবস্থা হবে।” ঘুষ দেবার পাপ করা শুধু ভারতেই প্রচলিত নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই আছে, বিশেষত পুঁজিবাদীদের রাজত্বে। আমেরিকায় কনফিডেন্স ম্যন, ক্রুক প্রভৃতির সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। কে কোন্ মতলবে বাড়িখানা তৈরী করেছিল তা কে জানে। আমেরিকায় বাড়ি তৈরী কর গির্জা তৈরী কর, যা ইচ্ছা তাই তৈরী কর, স্বাস্থ্যবিধির আইন মেনে চলতে হবেই। এখানে আমেরিকা ধর্মের সাম্রাজ্যবাদ বর্জন করেছে দেখে ভারী আনন্দ হল।

 আমেরিকার মজুররা যেমনভাবে দিন কাটাচ্ছে, দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর কোনও দেশের মজুর তেমন সুবিধা পাচ্ছে না। আমেরিকার মজুর কোনও রকমে যদি সপ্তাহে তিন দিন কাজ করতে পারে তা হলে সপ্তাহের বাকী দিন কটা সে কাজ না করেই কাটিয়ে দিতে পারে, অবশ্য যদি সে স্ত্রীপুত্রপরিবার-বেষ্টিত না হয়। কলকাতার দু-হাজারী তিনহাজারী ইউরোপীয় কর্মচারীরা যেভাবে অবসর যাপন করে, আমেরিকার একক ঝাড়ুদারও সেইভাবে অবসর সময় যাপন করতে পারে এজন্য সপ্তাহে তার তিন দিন কাজ থাকলেই যথেষ্ট।

 হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে একটি ছোট রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। অনেক লোক তাতে বসে খাচ্ছিল। কেউ বা আপন আপন বন্ধুবান্ধবদের সংগে খাওয়া শেষ করে গল্প করছিল। সেসব কথায় দুঃখের ছায়া নেই, হালকা সরস আনন্দময় কথাবার্তা। মাঝে মাঝে তার দু-একটা আমারও কানে আসছিল―ম্যেকিরুনি, জো লুই, খেলার কথা, সুন্দরী বালিকাদের কথা ইত্যাদি। তার মানে ওই রেস্তোরাঁয় বসে যারা খাচ্ছিল তাদের কেউই বেকার নয়। যখন লোকের কাজ থাকে, অভাব তার থাকে না। (কথাটা শুধু আমেরিকাতেই খাটে), মনে তখন তার হাসিখুশির কথাই আসে। কর্মের গাম্ভীর্য দিনের শেষে কাজ শেষ হবার সংগে সংগেই শেষ হয়ে যায়। এখন কাজের কথা, দায়িত্বের কথা আর ওদের মনে নাই, তাই ওরা এখন সুখী। তারা এটাও ভাল করে জানে, যখন তারা বুড়ো হবে তখন তারা প্রত্যেকে পেনশন পাবে। পেনশন পাবে, তা দ্বারা তাদের ভরণ পোষণ চলবে, তারপর ‘হেম এণ্ড এগ’ আন্দোলন তো চলেছেই। তাই আমেরিকার মজুর কাজ করতে পারলেই সুখী। যারা কাজকর্ম খুঁজে পায় না বা যাদের মাঝে নূতন ভাবের সন্‌চার হয়েছে, তারাই অবনত ও বিষণ্ণ মুখে জীর্ণ বসনে আবৃত হয়ে পথে চলেছে। পাশ্চাত্য জাতকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। এদের মনের বল যে কত তা আমাদের ধারণাতীত। আমরা অনেক সময়েই পেটের নজির দিয়ে নিজেদের দুর্বলতাকে সমর্থন করি, এজন্য কাল্পনিক সম্মানের নজির দিতেও কসুর করি না; কিন্তু ওদের সেসব নাই।

 রেস্তোরাঁর দরজার সামনে একটু প্রকাশ্য স্থানেই বসেছিলাম এবং ওয়েটারকে দুধ আনতে বলেছিলাম। ওয়েটার গেলাসে করে ঠাণ্ডা দুধ এনে দিয়েছিল। ঠাণ্ডা দুধ খেতে চাইলে তার সংগে সরু খড়ের নল দেওয়া হয়। আমি ঠাণ্ডা দুধ খেতেই পছন্দ করি। খাচ্ছিলাম আর নানা কথা ভাবছিলাম। কিন্তু দরজার সামনে বসে নির্বিকার চিত্তে নিঃসংকোচে দুধ খাচ্ছি দেখে অনেকেই আমাকে পাড়াগেঁয়ে নিগ্রো বলে ভাবছিল, এবং বার বার আমার দিকে তাকাছিল। একখানা প্রভাতী সংবাদপত্রও আমার হাতে ছিল এবং মাঝে মাঝে সে দিকে চাইছিলাম। আমার এরূপ বেয়াদবি অনেকেরই বোধ হয় সহ্য হচ্ছিল না, তাই ওয়েটার একসময় আমার কাছে এসে বলল, “মশাই, এভাবে দরজার গোড়ায় অনেকক্ষণ বসলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়।”

 “কি রকম?”

 “আজ্ঞে তাই।”

 “এঁরা যে বসে আছেন, এঁদেরও বলুন।”

 “আগ্যে এঁরা আর আপনি, মানে―

 “বুঝেছি; ওরা শ্বেতকায় আর আমি কৃষ্ণকায়; এই তো?”

 পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বললাম, “একেই বলে আমেরিকান ডিমোক্র্যাসি। এরই এত বড়াই আপনারা করে থাকেন। অন্যায় হয়েছে এদেশে আসা, দূর থেকেই লিংকনকে স্মরণ করা উচিত ছিল কাছে এলে স্বপ্নভংগ হয়।” পরে বললাম, “আমি এদেশের লোক নই, আমি হিন্দু।” ওয়েটার তৎক্ষণাৎ বললে, “বসুন, বসুন, তবে বসুন, আমাদের ভুল হয়েছে।” আমি বললাম, “পুঁজিবাদী আমেরিকান আপনারা, আপনাদের ধন্যবাদ, নিগ্রোদের হরিজন করে রাখাই হল পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রথম সূত্র।”

 লোকটি আরও কি বলতে যাচ্ছিল, ইতিমধ্যে অনেকগুলি লোক এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। একটি লোক আমাকে বললে, “You talk against Imperialism. Why not against British?

 বললাম, “বিশেষ করে কোনও জাতের বিরুদ্ধে ত আর আমি

কিছু বলছি না, সাধারণভাবে নীতির বিরুদ্ধেই বলছি। আপনি বোধ হয়―”

 মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, কতকগুলি লোক “উনি একজন পাকা দরের হুভারপন্থী, চলুন বাইরে যাই,” বলে আমাকে সংগে করে বাইরে চলে এল। আমরা আমার হোটেলের দিকে চললাম।

 এদের সংগে নিয়েই হোটেলে আসলাম এবং নানা কথার পরে শুয়ে পড়লাম। পরদিন প্রাতে স্থানীয় হিন্দুদের সংগে দেখা করবার জন্য গেলাম। তাঁরা থাকেন লাফিয়েট ষ্ট্রীটে। মিঃ জগৎবন্ধু দেব-ই হলেন সকলের চেয়ে বয়সে বড় এবং আমেরিকার নাগরিক। তাঁর সংগে দেখা হবার পূর্বেই মিঃ হাসিমের সংগে দেখা হয়। হাসিম পূর্বে অশিক্ষিত ছিলেন, আমেরিকায় গিয়ে লেখাপড়া শিখেছেন। তাঁর হৃদয়ে অদম্য শক্তি, কাজে অসাধারণ পটুতা, দেশভক্তি তাঁর প্রবল। দেশের জন্য আত্মবলিদানে তিনি সর্বদা প্রস্তুত। তিনি আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন এবং থাকবার জন্য তৎক্ষণাৎ মিঃ নাগকে একটা রুম ভাড়া করে দিতে বললেন। তিনি পনর মিনিটের মধ্যে আমার জন্য ঘর ঠিক করে দিয়ে বললেন, “Settle up yourself, then we will have talk।” এবার আপনি বিশ্রাম করুন আমরা পরে এসে কথা বলব। আমি তাঁকে বাধা দিয়ে দুজনকেই বললাম, “চলুন আমার রুমেই গিয়ে বসি; সেখানে বিশ্রামও হবে কথাও হবে।” কংগ্রেস ষ্ট্রীটে আমার জন্য যে ঘর ভাড়া করা হয়েছিল তার মালিক ছিলেন একজন হংগেরীয়ান্‌।

 দুপুরে আমরা আমাদের দেশের লোকের দ্বারা পরিচালিত রেস্তোরাঁতে খেয়ে এলাম। খাদ্যের সুন্দর বন্দোবস্ত। ডাল পাওয়া যায় না বলে আমেরিকান পীচ দিয়ে ডাল তৈরী করা হয়। হলুদের বদলে স্পেন থেকে একরকম হলদে গুঁড়া আনিয়ে তাই ব্যবহার করা হয়। আমেরিকাতে যে লঙ্কা পাওয়া যায় তা মিষ্টি। কিন্তু কাঁচা লংকার গন্ধ তাতে আছে, সেই গন্ধ পাবার জন্য মিষ্টি লংকার সংগে গোলমরিচ মিশিয়ে তরকারিতে দেওয়া হয়। তবুও ভারতীয় তরকারি খাওয়া চাই। মাঝে মাঝে আমেরিকার ধনী নিগ্রোরা এবং ‘সাদা নিগ্রো’রাও ‘হিন্দু কারি’র আস্বাদ নিতে আসে। ভারতের যদি কোন সংস্কৃতি থাকে তবে ‘কারি’ আর ‘শাড়ি’। ভারতীয় প্রথায় আমেরিকাতে হাতে করে খেতে দেওয়া হয় না। যদি হাতে খেতে হয় তবে ভিতরে বসে খেতে হবে, বাইরে বসে খেতে হলেই কাঁটা চামচ ব্যবহার করতে হবে।

 দুপুরবেলা খাবার সময় আমার আগমনে হিন্দুদের মধ্যে এক সাড়া পড়ে গেল। সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের ডাকা হল। তাঁদের সংগে অনেক কথা হল। কিন্তু আমাকে হিন্দুরা পূর্বেই বলে দিয়েছেন যে তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী বিষয়ে কথা বলতে হবে। “Out and out you should be a nationalist।” তাই হল; যাঁরাই এলেন, শুধু হিন্দুস্থান ও হিন্দু ছাড়া আর কোনও বিষয়ে কিছু বললাম না। ‘হিন্দু’ শব্দটা ব্যবহার করতে অনেক মুসলমান প্রাণে ব্যথা পেয়ে থাকেন তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তা বললে কি হবে, উপায় নাই; ইণ্ডিয়ান বললে এরা Red Indian ভাবে; ন্যাসন্যালিজম আজকের দিনে পুরানা কথা। আমি ন্যাসন্যালিষ্ট হয়ে একটি সাংবাদিকের সংগে কথা বলছিলাম। শ্রীযুক্ত জগৎবন্ধু দেব (ত্রিপুরা) আমাকে সেই আলাপে সাহায্য করেছিলেন।

 “আপনি বলছেন, জাতে আপনি হিন্দু, দেশ হিন্দুস্থান, যাকে ইংলিশে লেখা হয় ইণ্ডিয়া। আপনাদের দেশের সকল লোকই যে স্বাধীনতা চায় সে কিরূপ স্বাধীনতা?”  “এই ধরে নিন ক্যানাডার মত ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস্‌।”

 “এতে কি আপনাদের দেশের লোক সুখী হবে, না হতে পারে? রাজা, নবাব, জমিদার এসব কি রাখতে চান? এতে কি রিয়েল এস্টেট ওনার-এর সংখ্যা বাড়বে না? গরীবের সর্বনাশ হবে না? এতে কি সাদা পুঁজিবাদীদের জায়গায় ব্রাউন পুঁজিবাদীদের বসান হবে না?”

 “তা হোক মশায়, তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।”

 “এই ধরে নিন হরিজন, দরিদ্র, এরা কি উন্নতি লাভ করতে পারবে? এরা কি শিক্ষিত হয়েও ধনী হয়েও এ দেশের নিগ্রোদের মত সমাজের উচ্চ স্তরের লোকের সংগে মিশতে পারবে? এরা কি মানুষ বলে গণ্য হবে?”

 “হোক না হোক বয়ে গেল, আমাদের স্বাধীনতা হলেই হল।”

 ন্যাসন্যালিজম এর বেশী এগোয় না। ন্যাসন্যালিজম পুরাতন কথা। পুঁজিবাদী এবং সমাজের শত্রু এতে আত্মগোপন করে সুখে স্বচ্ছন্দে বসে থাকতে পারে।

 রিপোর্টারের সংগে কথা হবার পর শ্রীজগৎবন্ধু দেব বললেন, “ফরগেট ইট” ভুলে যান। আমি কিন্তু ভুলতে পারি নি। কেন যে বলেছিলেন ‘ভুলে যান’ তা আমি বেশ ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমেরিকায় যত হিন্দু আছেন তাঁরা প্রায়ই জাতীয়তাবাদী। জর্জ ওআশিংটন থেকে লিন্‌কন পর্যন্ত সকলেই জাতীয় ভাবের পূজারী ছিলেন। তাঁদের মতবাদ এখনও আমেরিকার শতকরা সত্তরজন লোক মেনে চলে। তারাই রাষ্ট্রের নীতি ধার্য করে। তাদের নীতি যারা মানে না তাদের তারা কোনওরূপ সাহায্য করে না। যদি দেখে সরকারী তহবিল থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত কেউ তাদের নীতির বিরুদ্ধে চলছে, অমনি তার সাহায্য বন্ধ কয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকায় এখনও হিন্দুরা বসবাস করবার অধিকার পায় নি; এমন অবস্থায় তাদের মনের আসল ভাব গোপন করাই কর্তব্য। দে মহাশয়ের মনের ভাব কি তা আমি জানতাম না, আমাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করিয়েছেন বলে মনে হল। পর্যটকদের এমন ভাবে অনেকে ব্যবহারে লাগায় তা আমি আগেও জানতাম তাই চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম।

 ভারতীয় পর্যটক বিদেশে ভারতের সম্বন্ধে সত্যপ্রচারের নানারকম বাধা বিঘ্ন পায়। এই সব বাধা বিঘ্ন দূর করবার আশায় বিট্‌ঠল ভাই পেটেল অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ডিট্রয় নগরীতে অনেক দিন ছিলেন। তাঁর দুঃখের কথা তিনি অনেক সময় বলতেন। অনেক অশিক্ষিত হিন্দুরাও সে করুণ কাহিনী শুনে অনেক অপকর্ম ছেড়ে দিয়েছিল। বৃদ্ধের চারিপাশে শতাধিক লোক সকল সময় বসে থাকত। তিনি মুসলমানদের মোল্লা ছিলেন না পীরও ছিলেন না, তবু তারা তাঁকে সর্বদা ঘিরে বসে থাকত তারা ভারতের অশিক্ষিত মুসলমান। শওকত আলি জানতেন, সাগর পারের মুসলমানরা পেটেলকে কত ভক্তি-শ্রদ্ধা করত, কত আদর-অভ্যর্থনা করত। যাঁরা দুঃখকষ্ট সয়ে ভারতের গরীবদের সংগে মিশেছেন তাঁরাই জানেন, ওরা কত উদার। আমি যখন ডিট্রয় পৌঁছই, বিট্‌ঠল ভাই পেটেলের কথা তখন প্রত্যেক লোকের কাছে শুনতে পেতাম। বিট্‌ঠল ভাই পেটেল যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন তিনি অনেক বেকার হিন্দুকে সাহায্য করেছিলেন। তারা হয়তো আর ভারতে ফিরে আসবে না, এলেই হয়তো দুঃখে কষ্টে তাদের জীবন কাটাতে হবে। আমেরিকাতে তাদের কাজ করবার অধিকার নাই সেইজন্যই তারা কষ্ট পাচ্ছে। কাজ করবার অধিকার নাই শুনে অনেকে হয়তো ভাববেন তাদের কেরানীগিরির অধিকার নাই। কেরানীর কাজের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। আমেরিকায় কোন পুরুষ লোক কেরানীর কাজ করে না। জুতা পরিষ্কার করা, পথ পরিষ্কার করা, কাপড় কাচা, নাপিতের কাজ, চাষার কাজ, ফেক্টরী মজুরের কাজ এসব কাজই ভারতবাসীরা চায়।

 সংবাদপত্রের রিপোর্টারকে বিদায় দিয়ে শ্রীযুক্ত দেবকে সংগে নিয়ে কাছেরই একটা থিয়েটার হলে গেলাম। সিঁড়ি ভয়ানক অপরিষ্কার ছিল। হলের চেয়ারগুলা অনেক দিনের পুরাতন। সভাপতির আসনের পিছন দিকের দরজার কাচ ভাংগা ছিল। দিবালোক তা দিয়ে ঢুকে এমন ভাবে শ্রোতাদের চোখে মুখে পড়ছিল যে, সে আলোর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালে সভাপতি বা বক্তার মুখই দেখা যায় না। রেষ্টরুমের (পাইখানা) অবস্থা এত কদর্য ছিল যে, সমস্ত হলটাতে তার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। যারা বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন তাদের পায়ের মোজা কতদিন যে ধোয়া হয়নি তার ঠিক নাই; পায়ের মোজা হতে দুর্গন্ধ বার হচ্ছিল। দুর্গন্ধের জন্য শ্রোতাদের কাছে বসা কষ্টকর হচ্ছিলl এরূপ শ্রোতা দেখতে পাওয়া যায় গির্জায়, যেখানে শ্রোতাদের কিছু খাবার খেতে দেওয়া হয়। চার্চের লেকচারে যদি খাওয়ার খেতে দেওয়া না হয়, তবে লোক চার্চে যেত কি না সন্দেহ। এই সভায় খাবারের কোনও বন্দোবস্ত ছিল না বরং শ্রোতাদের পকেটে হাত পড়বার সম্ভাবনা ছিল তবুও ঘরটা দেখলাম একেবারে লোকে ভর্তি হয়ে গেছে।

 যখন গিয়ে আমি গ্যালারিতে দাঁড়ালাম, তখন অনেকেরই মনে খট্‌কা লেগেছিল। এরা ভেবেছিল আমি একজন নিগ্রো। লোকের সে চাহনিতেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। নিগ্রো কি মানুষ নয়, তারা কি শিক্ষিত হতে পারে না? এই কথাটা নিয়েই অন্তত এক ঘণ্টা বলেছিলাম। শেষে বলেছিলাম, কাউকে দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা করা মানে ভবিষ্যতে নিজেরই দমিত হবার পথ প্রশস্ত করা।

 সুখের বিষয়, আমেরিকায় লেকচারের পর শ্রোতাদের পক্ষে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার প্রথা আছে। আমেরিকার সাধারণ লোক সংবাদপত্র পাঠ করে তৃপ্ত নয়, মুখের কথায় সংবাদ শোনবার আগ্রহই যেন তাদের বেশী। যখন বললাম আমি ভাল ইংলিশ জানি না বলে কেউ যেন কিছু মনে না করেন, তখন অনেকেই বললেন, আপনি ভাল ইংলিশ জানেন না শুনে আমরা আনন্দিত। ভাল ইংলিশ জানলে সরল ভাষায় সত্য কথা বলতে সক্ষম হতেন না, যত সব বুদ্ধি খাটানো বজ্জাতি আর কূটনীতিপূর্ণ ভাষার বাহুল্যে আমাদের কর্ণকুহর পূর্ণ হত। আজ আমেরিকার লোক আর জিজ্ঞাসা করে না ভারতে শিশু-বিবাহের কারণ কি, হরিজন কি করে হল। যারা ফিউড্যালিজ্‌ম-এর উৎপত্তির ইতিহাস পাঠ করেছে এবং সম্রাট সৃষ্টির কারণ শুনেছে, তারাই বুঝেছে হরিজনের সৃষ্টি কেমন করে হয়। ভারতের সাম্রাজ্যবাদ একদা হীন স্তরে পৌঁছেছিল তার সংবাদ অনেকেই জানত না। শুনেছি মার্কস্‌-ও নাকি সে সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলে যান নি। আমেরিকার নিগ্রোদের অবস্থার সংগে অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসীদের সংগে হরিজনদের তুলনাই হয় না। ভারতে হরিজনদের মনুষ্যত্ব থেকে বন্‌চিত করে রাখা হয়েছে এ কথা বলতে বাধ্য।

 আজ ডিট্রয়ের সাধারণ শিক্ষিত লোক ভারতের আধ্যাত্মিক সংবাদ জানতে চায় না। তারা জানতে পেরেছে, যে-দেশে মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বন্‌চিত করে রাখা হয়েছে, সেদেশের বড় বড় তথ্যপূর্ণ আধ্যাত্মিকতা―আধ্যাত্মিকতাই নয়। তবে যারা ভারতের আধ্যাত্মিকতার সংবাদ শুনে বিভোর হয়, সংবাদপত্রে ভারতের আধ্যাত্মবাদের বক্তৃতাদি আগাগোড়া ছাপিয়ে দেয়, তারা হল আমেরিকার ধনী সম্প্রদায়।[১] এই ধার্মিকরা অপরকে ঠকিয়ে ধনী হয়েছে, তাই চায় ধর্মযাজকদের ঘুষ দিয়ে একটু পারলৌকিক সদ্‌গতি সন্‌চয় করতে। তারা বড় বড় বিল্ডিং গড়ে দিচ্ছে এবং ধর্মযাজকদের সর্বতোভাবে সুখী রাখবার চেষ্টা করছে। যারা চোরের উপর বাটপাড়ি করে, তাদের মনের শক্তি অসীম। এই শক্তিই বোধ হয় ভারতের আধ্যাত্মিকতা।

 বক্তৃতার পর আমি পারিশ্রমিক চাই নি। সভাপতির কথায় গরীবরা পকেট খালি করে একটি টুপিতে ফেলতে লাগল আর বলতে লাগল, “আজ খাঁটী হিন্দুর কাছ থেকে পৃথিবীর অনেক সত্য সংবাদ শুনতে পেয়ে পকেট শূন্য করে ফিরতে দুঃখ নাই।”

 এখানকার নিগ্রোসমাজ বেশ বড়। শহরের একচতুর্থাংশ তাদেরই দখলে। তাদের বাড়িঘর আমেরিকানদের মত, তাদের চালচলনও সে রকমেরই। শিক্ষার দিক দিয়েও এরা খুব উন্নত। অনেক সময় দেখা যায় অনুপাতে শ্বেতকায়দের চেয়ে নিগ্রোরা বেশী শিক্ষিত। অর্থের দিক দিয়েও তারা দরিদ্র নয়। কোন অংশে কম না হলেও এরা হোটেলে শ্বেতকায়দের সংগে খেতে পায় না। শ্বেতকায়দের হোটেলে গিয়ে শুতে পায় না। এই ব্যবহারিক বৈষম্যের ফলেই এদের মাঝে দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে। শ্বেতকায়রা প্রতি পদেই সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে এবং সেই সুযোগ নেবার চেষ্টা করছে। নিগ্রো চাকরানী রান্না করতে পারে, বাসন মাজতে পারে, খাবার এনে টেবিলে দিতে পারে, পাশের ঘরে উত্তম শয্যায় শুতে পারে, মনিবের ছেলেমেয়েকে ঠেংগাতে পারে, অনেক সময় মনিবকে গাল দিতে পারে, কিন্তু ওই ঠেংগানো ছেলেই যখন শ্বেতকায়দের রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে বসে তখন ঘরের চাকরানী একসংগে রেস্তোরাঁতে প্রবেশ করতে পারে না।

 আমাদের দেশের জনৈক ভদ্রলোক ডিট্রয় শহরে বাস করেন। তিনি নিজকে মিঃ গুহ বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। লোকমুখে শুনলাম তিনি রুশিরার নাগরিক। রুশিয়ার নাগরিক বলেই তিনি কমিউনিজম সম্বন্ধে প্রকাশ্যে লেকচার দিতে সক্ষম হন। তাই যদি না হ’ত তবে বহু পূর্বেই তাঁর মুখ বন্ধ হবারও বন্দোবস্ত হত। সুখের বিষয় এই ভদ্রলোক অন্যান্য ভারতবাসীর মত শ্বেতপাড়াবাসী হবার প্রত্যাশী নন। তিনি থাকেন নিগ্রো পাড়ায়। লেকচার দেন তাদেরই কাছে এবং যাতে করে নিগ্রোদের উন্নতি হয় সে কথাই তাদের সকল সময় বলে থাকেন।

 ডিট্রয় প্রকাণ্ড শহর। এ শহরের লোকসংখ্যা অর্ধ লক্ষ বলেই শুনেছি। এখানে ফোর্ডের কারখানা রয়েছে। সকাল বেলা যখন মজুরের দল ফোর্ডের কারখানায় প্রবেশ করে সে দৃশ্য বড়ই সুন্দর। বিদেশ হতে যারাই ডিট্রয় শহর দেখতে আসে তারাই ফোর্ডের কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে সকাল বেলা মজুরদের কারখানায় প্রবেশ করা দেখে। সে দৃশ্য দেখতে সকলেরই ভাল লাগে। মজুরের দল সুবিন্যস্ত এবং তাজা মন ও শরীর নিয়ে কাজ করতে আসে, সকলেরই হাসি মুখ। সকলের হাত, পা, বুদ্ধি এবং শরীর কাজ করতে উৎসুক। সেদৃশ্য আরামদায়ক।

 হাজার হাজার মোটরকার একটানা স্রোতের মত ক্রমাগত গেট দিয়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করে। একটি লোকও কথা বলে না কিংবা একটি লোকও মোটরে হর্ন দেয় না, অভ্যস্তমতে অন্যের সুখসুবিধার দিকে দৃষ্টি রেখে কারখানাতে প্রবেশ করে। তাদের এই আচরণের পিছনে ধর্মের প্রেরণা নাই, কারও আদেশ নাই; আছে শুধু ডিসিপ্লিন। অনেকের ধারণা, যাদের অভাব নাই, শৃঙ্খলা তাদেরই থাকে। আমাদের দেশে অনেকের অভাব নাই, অথচ তাদের মাঝে ডিসিপ্লিনের লেশও দেখা যায় না। মজুর সমাজকে সাধারণত পশুর সংগে তুলনা করা হয়। ফোর্ডএর কারখানার মজুরদের দেখলে মনে হয় প্রত্যেকটি মজুর ভদ্র, শান্ত এবং সভ্য। আমাদের দেশে কেরাণী, ইন্‌জিনিয়ার, ডাক্তার এরা কিন্তু নিজেদের মজুর বলতে রাজি নয়। আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট হতে আরম্ভ করে ডিস্‌ওয়াসার সকলেই মজুর।

 মজুরের দল যখন কারখানায় প্রবেশ করে তখন তারা মাঝে মাঝে হর্ষধ্বনি করে। তাতে আমাদের দেশের অমুক কি জয়-এর মত ফোর্ডএর বা কারও নাম জড়িত থাকে না। তারা জয় দেয় নিজ নিজ জাতের―সর্বসাধারণের, কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়। আমাদের দেশের মজুর অনাহারে থাকে আর ফোর্ডের মজুররা পকেট ভরে মজুরি পায়, পেট ভরে খায়, প্রাণ ভরে ঘুমোয় এবং স্বচ্ছন্দে পরিশ্রম করে শরীরের রক্তচলাচল সতেজ রাখে; তাই তাদের পরিষ্কার মগজে নিত্য নূতন পরিকল্পনা জন্মাবার সুযোগ হয়। অন্য দেশের মজুরদের মাঝে যেমন দোষ গুণ সবই আছে ফোর্ডের কারখানাতেও যে দোষ একেবারে নাই তা নয়, তবে যখনই কোন দোষ দেখা দেয় এবং তা ধরা পড়ে তখনই তার প্রতিকার করা হয়। সুপারভাইজার, সাধারণ মজুর এবং ম্যানেজ্যর, সবাইকেই ফোর্ড বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের মধ্যে অফিসার ও সাবঅর্ডিনেট কেউ নয়, তাঁরা সকলেই মজুর ও সহকর্মী; সকলেরই মনে রাখা উচিত এই কারখানাতে কেউ কোনওরূপ বিশেষ অনুগ্রহ পাবে না; খোশামোদকারীকে ডিসমিস করে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রমোশন সেখানে ভোটের সাহায্যে হয়, প্রমোশন দেবার অধিকার কোনও ব্যক্তিবিশেষের নাই। এই ধরনের আরও এমন কতকগুলি আইন আছে, যা দেখলে মনে হয় সে সব নিয়ম রুশিয়া থেকে ধার করে আনা হয়েছে। এজন্যই ফোর্ডের কারখানায় ধর্মঘট হয় না এবং মজুরদের দেখলেই মনে হয় তাদের মনে সুখ শান্তি আছে।

 যুগের বাতাস এহেন কারখানাতেও বইছে দেখতে পেলাম। এরই মাঝে মজুরদের মাঝে রব উঠেছে মিঃ ফোর্ড নিজে থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য যারা কারখানার মুনাফা থেকে বৎসরের শেষে মোটা টাকা বার করে নেন, তা বন্ধ করতে হবে, মিঃ ফোর্ডকেও নূতন মতে নূতন পথে চলতে হবে।

 ফোর্ডের কারখানাতে আগে অনেক হিন্দু কাজ করতেন। বর্তমানে ইমিগ্রেসন আইন মতে যাদের সেকেণ্ড পেপার (second paper) নাই অর্থাৎ যারা আমেরিকার বাসিন্দা নয়, তাদের আর নূতন করে কাজ দেওয়া হয় না, উপরন্তু যারা পূর্বে কাজ করত তাদেরও কাজ থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এখন ফোর্ডের কারখানায় আর কোনও হিন্দু কাজ করে না।

 ভারতবাসীকে কাজ হতে তাড়িয়ে দিবার কারণ দেখান হয়েছে ভারতবাসী বিদেশী। বিদেশের লোক এসে যদি আমেরিকার লোকের কাজ কেড়ে নেয় তবে বড়ই পরিতাপের বিষয়। আমাদের দেশেও বলা হয় উড়ে এবং হিন্দুস্থানীরা বাংগালীর কাজ কেড়ে নিচ্ছে। কি সুন্দর কথা। যেকথা বলে আমেরিকার ধনীরা তাদের স্বদেশবাসী মজুরদের ক্ষেপিয়ে অপরের সর্বনাশ করছে সেই কথা আমাদের দেশের অর্থতত্ত্ববিদরাও উঁচু গলায় চিৎকার করে প্রতিধ্বনি করছেন মাত্র। বাস্তবিক পক্ষে মজুর কখনও মজুরের শত্রু হতে পারে না। ধনীরা মুনাফা বেশি করে পাবার জন্যই জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে মজুর দিয়ে মজুরের সর্বনাশ করায়।

 সুখের বিষয় আমেরিকার মজুররা আর ঘুমিয়ে নাই। তারা আজ আর সংকীর্ণ জাতীয় ভাবের দাস নয়। আমেরিকার মজুর যাতে তাদের অবস্থা এবং সকল মজুরের অবস্থা ভাল করে বুঝে সেজন্য ভারতীয় বেকার মজুরগণও চেষ্টা করছে। আমেরিকার ভারতীয় মজুরগণ আর ধর্মের দাস হয়ে থাকছে না। পূর্বে তারা ধর্মের দাস হয়ে থাকবার জন্যই আমেরিকার নাগরিকত্ব হারিয়েছে, সেকথা আজ অনেকেই বুঝতে পেরেছে। আজ আর তারা তাদের পৃথক সত্ত্বা দেখে না। তারা দেখতে পেয়েছে পৃথিবীর সমস্ত মজুর একটা শ্রেণী। সেই শ্রেণীতে তাদেরও স্থান, অতএব বিশেষ করে নিজের অথবা নিজের দেশেয় মজুরের কথা চিন্তা করে কোন লাভ নাই। মজুরদের মাঝে ছোট ছোট গণ্ডিগুলিই মজুরের শক্তি ক্ষয় করে এবং ধনীদের শক্তি বাড়িয়ে দেয়।

 ফোর্ডের কারখানা দুবার দেখতে গিয়েছিলাম। বড় বড় মেশিন, বড় বড় গুদাম, বড় বড় যন্ত্র দেখে যেমন মনে বিস্ময়ের সন্‌চার হয়েছিল, তেমনি কলকারখানার ল্যাবরেটরিতে ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র সব নিক্তি দেখে মনে হয়েছিল অত বড় মোটর তৈরী কাজে কত ক্ষুদ্র জিনিসেরও দরকার হয়। যারা এই কারখানায় কাজ করে তাদের পোষাক এবং আচার ব্যবহার দেখলে মনে হয় না এরা পদমর্যাদায় কেউ কারও চেয়ে ছোট। মনে হয় এদের মাইনের কোনও প্রভেদ নাই, এদের মধ্যে ছোট বড় নাই। কেউ কাউকে ‘বড়বাবু’ ‘বড়সাহেব’ বলে তোষামোদ করছে না, সবাই সমান ভাবে কাজ করে চলেছে। পরিশ্রম করছে বলে কারও কপালে ঘাম আর দিনের কাজ শেষ করেছে বলে কারও মুখে হাসি ফুটে উঠছে। কেউ অন্যকে হিংসা করে না। তারা প্রত্যেকে জানে কাজ করতেই হবে। নারী মজুরগণ পুরুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য সময় করে এসে পুরুষদের কাছে দাঁড়িয়ে সাহস দিচ্ছে, মিষ্টি কথা বলে পুরুষদের শক্তিশালী করে তুলছে।

 ফোর্ডের কারখানায় মজুরগণ যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনও তারা কিছু পায়। আমেরিকার অন্য কোন কারখানায় সেরূপ কোন ব্যবস্থা নাই। উৎপাদনের চাহিদা মিটিয়ে কল বন্ধ করে দেয়। কলের মালিকগণ লাভের টাকা দিয়ে আনন্দ করে আর মজুরগণ হাঁ করে অপেক্ষা করতে থাকে কখন আবার কল খুলবে। তবে আমাদের দেশের মজুরের মত তারা হাঁ করে থাকে না, তারা অন্য কিছু করে, যেজন্য অনেক সময় সেনেটের মেম্বারদেরও কেঁপে উঠতে হয়। আমার লেখা ভাগ্যক্রমে যদি কোন ভারতীয় মজুর পাঠ করে তবে হয়ত ভাববে আমেরিকার মজুরও হাঁ করে থাকে, আমাদেরও, তাই করা উচিৎ। সেজন্যই কথাটা আরও বিশদভাবে বলতে হচ্ছে। আমার মনে হয় এ সম্বন্ধে পূর্বে অনেক বলা হয়েছে সেজন্য কথা বাড়িয়ে আর লাভ নাই।

 ফোর্ডের কারখানায় দুদিন যাবার পরও মনে হত আবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু সেরূপ করবার মত সুযোগ আমার হয়ে উঠেনি। আমাকে চিকাগোর দিকে রওয়ানা হবার পূর্বে ডিট্রয়ের আরও অনেক কিছু দেখতে সময় ক্ষেপণ করতে হয়েছিল। ডিট্রয় নগরে অনেকগুলি পার্ক আছে। লেক্‌এর তীরে একটি পার্কে বসেছিলাম আর লেক্‌এর জল কেমন করে তীরে এসে আঘাত করছিল তারই দিকে লক্ষ্য করছিলাম। এমন সময় একটি লোক আমারই পাশে বসল।

 লোকটির কপাল হতে ঘাম পড়ছিল। পোষাক অপরিষ্কার ছিল, পায়ের জুতা ছেঁড়া ছিল। সে আমার কাছে বসেই একটা সিগারেট চাইল। আমি তাকে সিগারেট দিয়ে ভাবলাম এদের যত লজ্জা সবই নিজের লোকের কাছে। অশ্বেতকায়দের কাছে এরা ভিক্ষা করতেও কোনরূপ লজ্জা অনুভব করে না। কারণ, অশ্বেতকায়দের এরা মানুষ বলে স্বীকার করে না। লোকটি যুবক। বয়স বোধহয় আঠার উনিশ হবে। তবে শরীরের গঠন দেখলে মনে হয় তার বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। যুবক জানত না আমি তাকে ভয়ও করি না, তার কোন তোয়াক্কাও রাখি না। সেজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম, “কাজের খোঁজে গিয়েছিলে বুঝি?” লোকটি বলল, “বেশ বুঝতে পেরেছ ত? সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘুরে এলাম কোথাও কোন কাজ পেলাম না। পায়ের জুতা ক্ষয় হয়ে গেছে। ভয় করার কিছুই নেই, আর একটা দিন দেখব তারপর হেস্তনেস্ত একটা কিছু ঠিক করে নেব।”

 আমেরিকার যুবকগণ যখন কাজ পায় না তখন তারা গলায় দড়ি দিয়ে গংগায় ডুবতে যায় না। ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিয়ে পথে বসে না। তাদের দেশে এখনও ভাগ্য এবং ভগবানের স্থান নাই। তাদের আছে পুরুষত্ব। কাপুরুষ, ধূর্ত, এবং ইতরগণই ভাগ্য এবং ভগবানের কথা বলে সকল অন্যায় কাজই করে। যুবককে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দিকে যাবে স্থির করেছো? যুবক হেসে বললে “তুমি কি আমাকে গ্রেপ্‌স বয় ভাবলে নাকি? এত বড় শরীরটা কাজেই লাগবে হে। দেখিয়ে দেব, বুঝিয়ে দেব।” তারপর সে কতক্ষণ হাসলে। উঠবার পূর্বে আমার কাছ থেকে দশ সেণ্ট চেয়ে নিয়ে নিকটস্থ একটা রেস্তোরাঁয় বসে এক পেয়ালা কাফি খেয়ে আমার কাছে পুনরায় আসল। তাকে আর একটা সিগারেট দিলাম। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, “তুমি কাদের দালাল হে?” আমি হেসে বললাম, “আমি কারো দালাল নই। তবে সবই ত জানি।” যুবক ফের আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “বলত কোন দলে যোগ দেওয়া ভাল?” আমি আরও একটু হেসে বললাম, “আমি কোন দলের সন্ধান রাখি না, আমি বিদেশী পর্যটক। আমি একজন হিন্দু তোমাদের দেশ দেখতে এসেছি। এদেশে নানারূপ দলের কথা আমাদের দেশের লোকের কাছে শুনেই সেজন্যই এত কথা বলতে সক্ষম হলাম। তোমার মত আরও অনেক যুবকের সংগে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, তারাও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে কোন দলে যোগ দেবে? আমি প্রত্যেককে বলেছি কমিউনিষ্ট দলে যোগ দাও তবেই ভবিষ্যতে ভাল হবে।” যুবক কি একটা কথা বলে আমার কাছ থেকে উঠে চলে গেল। বোধহয় ফ্রেন্‌চ বলেছিল। যখনই কারো রাগ হয় তখনই তাদের মাতৃভাষা কণ্ঠে এসে ভর করে। আমাদের যখন রাগ হয় তখন আমরা ইংলিশ আরবী, ইরাণী সবই বলি শুধু বলি না মাতৃভাষা।

 শক্তিমন্ত যুবকগণ যখন কাজ পায় না তখন তারা দলে যোগ দেয় আমি জানতাম। এই যুবকগণ, প্রায়ই ডাকাতের দল গঠন করে এবং রাজকর্মচারী বড় বড় ধনী, ব্যবসায়ী এবং সর্বসাধারণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বেশ শাস্তি দেয়। বড় বড় ডাকাতি, নরহত্যা তাদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। যখনই হত্যার সংখ্যা বেড়ে চলে তখনই সরকারের চাপে ধনীরা নতুন নতুন কাজ আরম্ভ করে। ধনীরা টাকা ব্যাংকে রেখেই সুখী হয়, তারা টাকা খাটাতে চায় না, তারা যখন দেখে লোক না খেয়ে মরছে তখন তারা সুখী হয়। এটা রীতি নয় নীতি। আমেরিকার ধনীরা সেই ‘সুনীতি’ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আজ আমেরিকাতে এত বিল্ডিং উঠেছে এই ডাকাতদেরই আদেশে। এত স্কুল কলেজ, শিশুসদন, বৃদ্ধদের পেন্‌সন, মাতৃজাতির রক্ষা, কারো লেকচার শুনে অথবা কারো অনুকম্পায় গড়ে উঠছিল না, ঐ বেকার মজুররা যখন ডাকাতি করত, ধনীদের বেতনভুক চাকর সাম্রাজ্যবাদীরা যখন দেখত, আর পারা যায় না। তখনই তারা ধনীদের চাপ দিয়ে নানা সৎকাজে নামাত। আমাদের নব পরিচিত যুবকও সে সব দলেরই কোনও একটাতে যোগ দিতে চলেছিল।

 আমেরিকার নিগ্রোেরা এরূপ দলে যোগ দেয় না তবে সাহায্য করে। নিগ্রোরা বড়ই কম কথা বলে এবং তাদের কাছ থেকে কোন গোপনীয় কথা বের করতে পারা যায় না। সেজন্য নিগ্রোরা আমেরিকানদের এজেণ্টের কাজে নিযুক্ত হয়। নিগ্রোদের যেমন করে আমেরিকানরা নির্যাতন করে তেমনি নিগ্রো সাহায্য ছাড়া এদের চলেও না। লক্ষ্য করে দেখেছি যখন কোন নিগ্রো কোন আমেরিকানের সংগে কথা বলে তখন নিগ্রো প্রায়ই হয় উপদেষ্টা আর আমেরিকান হয় আদেশ-পালক।

 এরূপ নিয়ম কিন্তু সর্বত্র সকল সময় প্রতিপালিত হয় না। এটি শুধু আমেরিকাতেই দেখতে পাওয়া যায় এবং আমেরিকার নিগ্রো দ্বারাই সম্ভবে। অনেক সময় দেখা যায়, আমেরিকান ছেলেমেয়েরা নিগ্রো চাকরের ঘরে খেতে এবং থাকতে ভালবাসে। যেদিন আমেরিকান যুবক মাতৃগৃহ হতে বিতাড়িত হয় সেদিন মা যেমন করে কাঁদে, তেমনি কাঁদে নিগ্রো চাকর।

 ইউরোপ এবং আমেরিকার সর্বত্র ছেলেদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই নিয়মের আর্ষ প্রয়োগও আছে। ধনীরা তাদের ছেলেদের তাড়ায় না। তাদের ছেলে যদি অপদার্থও হয় তবুও তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয়। আমি সাধারণ লোকের ছেলেদের কথাই বলছি। আমেরিকায় মধ্যবিত্ত বলে আর একটি শ্রেণী নাই। ধনীরা যখন গরীব হয় তখন তারা হয়, গরীব শ্রেণীভুক্ত মধ্যবিত্ত হয় না আর গরীবরা যখন ধনী হয় তখন তারাও মধ্যবিত্ত শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়েই ধনী হয়। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত বলে একটি শ্রেণী পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা এখন না বলে যা বলতে যাচ্ছিলাম তাই বলছি।

 আমেরিকান মা শিশুরক্ষার ভার নিগ্রো চাকর অথবা চাকরাণীর হাতেই ছেড়ে দেন। এতে ছেলেমেয়েরা নিগ্রো ঘেঁসা হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠে তবে কেন লিন্‌চ্‌ করা হয়। শুধু নিগ্রোদেরই লিন্‌চ্‌ করা হয় না। শ্বেতকায়দেরও আমেরিকাতে লিন্‌চ্‌ করা হয়। শ্বেতকায়দের লিন্‌চ্‌ করার কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয় না, শুধু নিগ্রোদের কথাই প্রকাশিত হয়।

 আমেরিকার লোক বড়ই মাতৃভক্ত। ডিট্রয়ে অনেকবার সাদা এবং কালোতে লড়াই হয়েছে, কিন্তু যেখানে নিগ্রো রমণী ঝাঁটা হাতে করে শ্বেতকায়দের আক্রমণ করেছে সেখানেই শ্বেতকায়রা বন্দুক, পিস্তল এবং অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্র পরিত্যাগ করে পালিয়েছে। আমেরিকানরা নিগ্রো রমণীকেও তাদের শ্বেতকায় মা বোনদের মতই সম্মান করে।

 আমেরিকায় লিন্‌চ্‌ প্রথা কেন প্রবর্তিত হয়েছিল, কে অথবা কারা এর প্রবর্তন করেছিল তা আমি জানি; তবে এসব কথা অশ্লীল হবে বলেই এখানে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। শ্বেতকায়দের লিন্‌চ্‌ যাতে না করা হয় সেজন্য স্ত্রীলোকদের দোষ দেখিয়ে একখানা ফিল্মও করা হয়েছিল, সে ফিল্ম এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। পান্‌জাবীরা আমেরিকায় গিয়ে সার্ট অর্থাৎ আরবী ভাষায় যাকে বলা হয় কামিজ লম্বা পেণ্টের উপরে ঝুলিয়ে রাখত বলেই হয়ত ভারতবাসী আমেরিকার নাগরিক হতে পারবে না। পন্‌চাশ বৎসরের পুরাতন অপকর্মের ফলের জের আমাদের টান্‌তে হবে। ইরাণীরা বলে “আপ রুচি খানা আর পর

রুচি পরনা।” আমরা প্রবাদটি জানি কিন্তু প্রবাদ অনুযায়ী কাজ করি না।

 ডিট্রয় নগরে যখন আমি একাকী ভ্রমণ করতাম তখন ইচ্ছা করেই নিগ্রোদের মত কথা বলতাম এবং ফেল্ট হেটের অগ্রভাগটা ঘোমটার মত টেনে দিতাম। এতে আমার মাথার চুল এবং লম্বা নাক অনেকটা লুকাতে পারতাম। চলার মাঝেও রকম আছে। যদি কারো একাজটি করতে হয় তবে মন হতে কর্ম তালিকা বাদ দিয়ে ধীরে সুস্থিরে পথ চলতে হবে। দেওয়াল ঠেস দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে থাকতে হবে, পথচারীকে বুঝাতে হবে যে তুমি একজন বেকার নিগ্রো। পৃথিবীর খাবার অন্বেষণ ছাড়া আর কিছু তোমার করার নাই, তবেই নানা লোক নানা কথা তোমার কাছে বলতে ভয় করবে না।

 ডিট্রয় শুধু কলকারখানার কেন্দ্র নয়। আমাদের দেশের লাটগণ শীতের সময় পাহাড়ে পর্বতে চলে যান এখানেও ঠিক সেরূপ গরমের সময় অনেক ধনী লোকের সমাগম হয়। ধনীদের মুখ হতে নানা কথা অতর্কিতে বেরিয়ে পড়ে। ধনীর গৃহমজুর সে সংবাদ চড়া দামে সংবাদপত্রে বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়। সংবাদ বিক্রি করার জন্য দরিয়া বিবির মত “দিল্লীতে সংবাদ বিক্রির জন্য দৌড়াতে হয় না।”

 পলিটিক্সই হ’ল লোকের প্রাণ। সেই প্রাণ নিয়ে যারা খেলা করে তাদের প্রতি লোক তাকিয়ে থাকে। ১৯৩৯ খৃঃ অঃ সেপ্টেম্বর মাসে আমি ডিট্রয় পৌঁছি। সে সময়ে ডিট্রয়ে বেশ হল্লা গোল্লা করে রাষ্ট্রনীতির কথা চর্চা হচ্ছিল। আমি রাষ্ট্রনীতির কথা শুনতে বেশ ভালবাসতাম বলেই সেই কথাগুলি কান পেতে শুনতাম এবং যতদূর পারি ততটুকু কাগজে এবং মনের কোণে টুকে রাখতাম।

 ওদের কথা শুনে মনে হ’ত আমেরিকার মজুরশ্রেণী আমেরিকার ধনিকদের মত ভূমি সাম্রাজ্যবাদ মোটেই পছন্দ করে না। আমেরিকার মজুর বেশ ভাল করেই জানে তাদের কাঁচা মালের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয় না। খনিজ দ্রব্য তাদের প্রচুর আছে, তবে কেন কয়েক মণ চিনি, আর শনের জন্য ফিলিপাইনোদের নিজের ঘরে ডেকে এনে কাজ দেওয়া হবে। ফিলিপাইনোরা আমেরিকা হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হউক ইহাই হল মজুর শ্রেণীর মনের কথা। মজুরের কথা শুনে ধনীরা চলে না। ধনীরা মজুরদের খাটায়, মজুরদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করে, মজুর তাই মাথা পেতে সহ্য করে, অতএব মজুরের কথার কোন মূল্যই নাই।

 কথা হচ্ছিল বেকার মজুরদের কি করে খাটানো যায়। বৎসরের মধ্যে কয়েক মাসই কলের মালিক কল বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয় কারণ বাজারের চাহিদার বেশি যদি মাল উৎপাদন করা যায় তবে মাল সস্তা হয়ে যাবে, বাজার মন্দা হবে, ডলারের ভাও কমে যাবে, এটা যে একটা মহা ফেসাদ। সেই ফেসাদ কি করে মিটিয়ে ফেলা যাবে তাই নিয়ে হচ্ছিল কথাবার্তা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোক কি করল না করল তা নিয়ে আমেরিকার ধনীরা মোটেই মাথা ঘামাতে চায় না।

 মজুরদের সি, আই, ও হতে বেকারী ভাতা দেওয়া হয়, তাই নিয়ে অনেক ধনী অনেক সময় বিগড়ে যায়। এদিকে যদি মজুর মরে যায় তবে ভবিষ্যতে কাজও চলবে না, মহা চিন্তার বিষয় বটে, সংকটের কথা বটে, বিপদের কথা বটে। মজুরকে খেতে দিতে ভাল লাগে না, মজুর মরে গেলেও কল চলবে না, এটা কি কম চিন্তার বিষয়। স্বর্গভূমি আমেরিকা, তোমার কোলের ধনীরা কি করে শান্তি পেতে পারে সেকথা তারা চিন্তা করে বের করতে পারছে না; তা দেখে চীনের ছোট্ট সোভিয়েটও হাসে! হাসবার কথাই। মানুষের যখন অর্থলিপ্সা বেড়ে যায় তখন তার হিতাহিত জ্ঞানও লোপ পায়। সুখের বিষয় আমেরিকার বৃটিশের মত ভূমি সাম্রাজ্য নাই, তাতেই রক্ষা, নতুবা আমেরিকায় ধনীরা কবে পাগল হয়ে নিজের মাথায় নিজে পিস্তল মারত তার ঠিক নাই।

 ডিট্রয়ের নিগ্রো অন্‌চলে একটি ভারতীয় খাবারের দোকান আছে। সেই খাবারের দোকানে আমাকে এক দিন নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েও ছিলাম। রেস্তোরাঁর সামনে কোনরূপ সাইনবোর্ড টাংগানো ছিল না। কিন্তু পথিক সে পথে গেলেই বুঝতে পারে ভারতীয় রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কারি পাউডারের গন্ধ ঘরের সামনের দরজা খুললেই পথ আমোদিত করে। একজন শ্রীহট্টবাসী এই হোটেলটি পরিচালনা করেন এবং তিনি নিজে পাকও করেন। তিনি প্রত্যহ দুবার করে পাক করেই বিশ্রাম নেন। দোকানের ক্রেতা এবং বিক্রেতা সকলেই নিগ্রো।

 খাবার খেয়ে খুব আনন্দই পেয়েছিলাম। সর্বপ্রথম সুপ্‌ দেওয়া হয়েছিল, মটর ডাল পাতলা করে পাক করে তাতে জাফ্‌রাণ দিয়ে বেশ সুন্দল রং ধারানো ছিল। দ্বিতীয় দফায় ছিল একটি প্লেটে সামান্য ভাত এবং এক থালা শস্যবাটা দেওয়া মাছ, অন্য আর একটি প্লেটে পেঁয়াজ এবং টমেটো কাটা।

 তৃতীয় পদ ছিল সামান্য ভাত, মুরগীর মাংস এবং আমের চাটনী। চতুর্থ বারে এল ফুলকপির ডালনা আর সামান্য ভাত। তারপরই দই এবং পায়স দেওয়া হয়। এই দুটি পদ খাওয়া হয়ে গেলে ছোট্ট পেয়ালা কাফে খেতে দেওয়া হয়। এতগুলি সুখাদ্যের জন্য মাত্র পঁচাত্তর সেণ্ট চার্জ করা হয়। এখানে শুধু নিগ্রোরাই আসে বলে দামও সস্তা। নিউইয়র্কে এই ধরণের খাদ্যের দাম হয় এক ডলার পচিশ সেণ্ট।

  1. যীশুখৃষ্ট পুনরায় পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে সহস্র বৎসর কাল রাজত্ব করবেন এই মতে বিশ্বাসী।