আজকের আমেরিকা/মেডিরা

উইকিসংকলন থেকে

মেডিরা

 মেডিরা দ্বীপ আমাদের পথে আসবে তাই এখন থেকে সকল যাত্রীই মেডিরার কথা বলতে শুরু করেছে। দুঃখের বিষয় আমাদের জাহাজ সেণ্ট হেলেনা হয়ে আসেনি। সেজন্যই মেডিরা দেখবে বলে সকলের প্রাণে এত আনন্দ। আমার মনে হল মেডিরা বোধহয় তার ঠিক উচ্চারণ নয়, মদিরা হবে এবং মেডিরায় পৌঁছে বুঝতে পেরেছিলাম আমার অনুমান সত্য। জাহাজী সংবাদে একদিন বের হয়েছিল, জেনারেল ফ্রাংকো মেডিরা দ্বীপে সকল জাহাজের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে যে হের হিটলারের ইংগিত আছে, কিংবা মুসোলিনীর কোনও চালবাজী আছে, তা নিয়ে আলোচনা সর্বত্রই চলছিল। পরে ঐ জাহাজী সংবাদেই প্রকাশিত হয় চেম্বারলেন কি একটা অঘটন ঘটিয়েছেন যাতে করে সকল তর্কের অবসান হয়ে গেছে। নতুনকে সম্বর্ধনা করার আনন্দের চিন্তাধারা পুনরায় সকলের মাঝেই জেগে উঠল।

 আমাদের জাহাজ মেডিরা গিয়ে ভিড়বে এই সংবাদ পাওয়া মাত্র সকলেই খেলার দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার ভারতীয় সংগীকে বললাম, “ভায়া, এই বেলা হাতের মুঠা খুলে রেখ, দেখা যাক এরা আমাদের কাছে আসে কিনা।” উত্তরে তিনি বললেন, “ওরা টাকা নিবে কিন্তু খেলতে দিবে না।” আমি বললাম, “তার ভার আমার উপর রইল, আমি ওদের বেশ ভাল করে দেখে নিব।” আমার অনুমান ঠিক হয়েছিল। চাঁদার খাতা হাতে করে এক মিশনারী আমাদের কাছে এসেছিল। আমি চাঁদার খাতা হাতে নিয়ে বললাম, “আফ্রিকায় বাইবেল হাতে নিয়ে নিগ্রোদের যেমন ঠকাচ্ছেন, আমাদের কিন্তু সে রকম ঠকাতে পারবেন না, আমরা টাকা দিব কিন্তু প্রত্যেক খেলাতে আমাদের নাম দিতে হবে। যদি আমাদের সংগে দয়া করে কেউ না খেলেন, তবে আমরা মোটেই দুঃখিত হব না। আমরা দুজনাতেই খেলব। আমরা খেলতে চাই এবং আমরা খেলবই এটুকু মনে রাখবেন।” ক্ষণিকের জন্য লোকটার মুখ লাল হয়ে উঠল, পরীক্ষণেই তার মুখের অবস্থা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। আমি তাকে বললাম, “আপনি বেশ আত্মগোপন করতে পারেন, সেদিকে আপনি বাহাদুরী পেতে পারেন, নতুবা কি করে আফ্রিকায় নিগ্রোদের সর্বনাশ করতে পেরেছেন? এখন বলুন আমাদের কথায় রাজি আছেন কি?” অতি মিষ্ট স্বরে অতি মধুর কথায় বিনয় নম্রভাবে আমাদের বাবাজী বললেন, “নিশ্চয়ই খেলবেন।” আমরা প্রত্যেকে পনের শিলিং করে চাঁদার পাতায় সই করে দিলাম!

 দুতিন দিনের পরই হয়ত আমরা সাউথ্‌হাম্‌টনে পৌঁছব। আজ প্রভাতী খানা খেয়েই সবাই খেলায় লেগেছে। আমরা উপরে গিয়ে একটা বেন্‌চে বসে নানারূপ খেলা দেখছিলাম। মাঝে মাঝে আমরাও খেলায় যোগ দিয়েছি। আমাদের খেলার সাথী হত সাধারণত ইহুদীই।

 ইহুদীরা আমাদের সংগে খেলার সময় বেশ হাসত, আমোদ করত, আর দেখাত তারা আমাদের বন্ধু। আমার সাথী দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসী, সে বুঝতে পারত না কে ইহুদী এবং কে ইউরোপীয়ান, তাই সে সকলকে সমানভাবেই ঘৃণা করত। অনেক দিন তাকে বলতে বাধ্য হয়েছি, একটি ব্যক্তিবিশেষকে ঘৃণা করা যায় তা বলে একটা জাতের উপর এতটা বিদ্বেষ অন্যায়। অর্থ-পিশাচরূপে ইহুদীদের যে বর্ণনা সেক্সপীয়ার দিয়ে গিয়েছেন তাঁর শাইলক চরিত্রে তা সত্য হতে পারে কিন্তু ইহুদীদের মধ্যেও অনেক মহাপুরুষ আছেন, যাঁরা পৃথিবীর কল্যাণের জন্য অনেক মহৎ কাজ করে গেছেন।

 মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। সূর্য ডান দিক হতে উঠেছে এবং বাঁ দিকে অস্ত যাচ্ছে। নীচে সমুদ্র শান্ত তাতে কোনওরূপ ঢেউ নাই―আমাদের দেশের বড় পুষ্করিণীর জলের মত ধীর এবং স্থির। আমরা সেই দৃশ্যই দেখছিলাম। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ো মাছ জাহাজের কাছে জল থেকে উঠে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিল এবং আমাদের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করছিল। বাস্তবিক দিনটা কাটছিল আনন্দেই। কিন্তু গত রাত্রে একটা বই পড়েছিলাম তাতে লেখক সমুদ্রের ভীষণতার কথা লিখেছিলেন। সমুদ্রের সংগে যাদের সাক্ষাৎ পরিচয় নাই এরূপ লেখক সমুদ্রের কত কাল্পনিক কাহিনীই না লিখেছেন। তাদের কল্পনার চোখের সামনে সমুদ্র সর্বদাই ভয়সংকুল হয়ে আছে, কল্পিত দৈত্যদানবের মত কত অতিকায় প্রাণী সমুদ্র তোলপাড় করছে। আমি বাস্তব সমুদ্রের আর কল্পিত কাহিনীর তুলনা করছিলাম এবং ভাবছিলাম, উচ্ছ্বাস ভাবপ্রবণতা কবিত্ব―এ সকল আর যার জন্যই হোক আমার মত বাস্তববাদীদের জন্য নয়। আমার ভাবনার অন্ত ছিল না, কখন যে আমাদের পাদরী আমার কাছে এসে বসেছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি। পাদরী তাঁর ডান হাতটা আমার কাঁধের উপর রাখতেই আমার দৃষ্টি তাঁর দিকে গেল।

 পাদরী বললেন, “ভাববেন না, আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই সাউথ্‌হাম্‌টনে যাব, ভগবান আমাদের সাহায্য করবেন।” পাদরীকে বললাম, “মহাশয় দয়া করে ভগবান এবং তাঁর পুত্রদের কথা আমাকে শুনাবেন না। আমার মংগলামংগল আমার হাতে। ভগবান এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষগণ আমাকে কোন সাহায্য করতে পারবেন না। এ সকল কথার উৎপত্তি হল ভয় হতে এবং এ সকল কথা শুধু ভয়েরই সৃষ্টি করে। সাময়িক উত্তেজনাও আনে বটে মদের নেশার মত, কিন্তু এর পর যখন মন দমে যায় তখন আর বুঝতে পারা যায় না কোথায় চলেছি। অতএব ক্ষমা করুন। কয়েকটি রজত মুদ্রার বিনিময়ে চোখে যে ঠুলি বেঁধেছেন তা অপসারণ করতে চেষ্টা করুন, দেখবেন ব্যান্তু, কালার্ড হিন্দু এরাও মানুষ। এদের জন্য পৃথক করে চার্চ তৈরী করতে হবে না।”

 জাহাজের যাত্রীরা সবাই খেলার আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছে। আমি ও আমার ভারতীয় বন্ধুটিও চুপ করে বসে ছিলাম না, যখনই ফাঁক পাচ্ছিলাম তখনই খেলায় যোগ দিয়ে সেই আনন্দের অংশ গ্রহণ করছিলাম। জাহাজের একটানা জীবনের মধ্যে সমস্ত দিনের অলস একঘেঁয়েমীব পর প্রাণে চন্‌চল সজীবতা ও বৈচিত্র্য লাভ করা যায় এই খেলার সময়টিতে।

 আমাদের সংগে খেলায় যোগ দিলেন দুজন ইহুদী। খেলার মধ্য দিয়েই তাদের পরিচয় পেলাম নিবিড়ভাবে এবং বুঝলাম আমাদের প্রতি এদের একটা প্রীতির বন্ধন হয়ে গেছে এরই মাঝে। খেলা শেষ হতেই ইহুদী দুজন আমাদের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে গল্প আরম্ভ করে দিলেন এবং বললেন, “আমাদের ইচ্ছা ছিল আপনাদের সংগে আলাপ করি কিন্তু পাছে কথা বলার জন্যে জাত যায়, সে ভয়ে কথা বলতে এতদিন সাহস করিনি।” আমাদের দেশে কথা বললে জাত যায় না, ছায়া মাড়ালে স্নান করতে হয়। ইহুদীরা বল্‌লেন, “পৃথিবীর যদি উন্নতি করতে হয়, তবে কথায় নয়, শক্তির সাহায্যে আইন প্রনয়ণ করে। যে পাপ করে, তাকে শাস্তি না দিয়ে পাপের উৎপত্তির কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই পাপের কারণকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। দেখছেন তো আমরা আপনাদের স্বেচ্ছায় হিংসা করছি না, আমাদের সমাজ বাধ্য করেছে আপনাদের হিংসা করতে। আমরা সমাজের কুনিয়ম মেনে নিচ্ছি। আমাদের এরূপ ক্ষমতা নাই যে এই সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হই, কারণ আমরা ইহুদী। মানুষের সমাজে আমাদের স্থান অতি হালকা, তারপর যদি অত্যাচারীদের সংগে যোগ দেই। তবে আমরাও যে অত্যাচারিত হব।” এরূপ খাঁটী কথা খুবই কম শুনতে পাওয়া যায়। আমরা ইহুদীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবিনে চলে এলাম।

 আমাদের ষ্টুয়ার্ট-ওয়েটারদের তখন অবসর সময় ছিল। তাই তারা সবাই মিলে এই সময়টাতে নানা রকমের বই পড়ছিল। আমাদের কেবিনের কাছেই চিফ ষ্টুয়ার্ট-এর কেবিন। কার কোন বই পড়া উচিত তিনিই সে সব ঠিক করে দেন। সেই বই দেওয়ার ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে দেখলাম একটু। লাইব্রেরীতে ছোট ছোট প্যামফ্লেট ছিল, বড় বড় বইও অনেক ছিল। তার দু-একটির নামও চোখে পড়ল। বইগুলি দেখে মনে হল এই জাহাজ বৃটিশের নয়, রুশ সোভিয়েটের। যত বই সবই সোভিয়েট সংক্রান্ত। অবশ্য এসব বই পাঠ করা আমার মত ইংরেজী জানা লোকের শোভা পায় না। সুন্দর সরল ভাষা। কিন্তু মাঝে মাঝে যে-দুএকটা শব্দ রয়েছে তার অর্থ যদি না বোঝা যায়, তবে সমগ্র বইটা পাঠ করেও কোন গ্যান হয় না। আমি কখনও কাউকে বলি না যে আমার ইংরেজী ভাষায় দখল আছে। তাই যে বইখানা চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম তা ফিরিয়ে দেবার বেলা বললাম, “মশায় কিছুই বুঝলাম না।” রুম-ষ্টুয়ার্ট বললেন, “বেশ এতে এমন কি আছে যে বুঝতে পারেন নি?” “ঐ যে দেখছেন একটা শব্দ এর অর্থের সংগে সমুদয় বইটার সম্বন্ধ।” রুম-ষ্টুয়ার্ট হেসে বললেন, “যদি সময় পাই, তবে মেডিরাতে গিয়ে আপনাকে কথাটার অর্থ বুঝিয়ে দিব।” কিন্তু সে কথাটির অর্থ তিনি আর বলেননি।

 আমাদের জাহাজ ক্রমশই মেডিরার কাছে এসে পড়ছিল। এই দ্বীপপুন্‌জ পর্তুগীজ-এর অধীনে। দূর থেকে এর মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দ্বীপপুন্‌জের অবস্থান অনেকটা ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার মাঝে, তবুও গাছপালা দেখে মনে হয়েছিল এতে পুরা ট্রপিক্যাল আবহাওয়া লাগে নি। জাহাজ ধীরে ধীরে জেটিতে লাগল। অগণিত লোক জাহাজের যাত্রীদের দর্শনের জন্য তীরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। জাহাজ থেকে নেমে একাই পথে বেড়িয়ে পড়লাম মেডিরা শহরটি ঘুরে দেখবার জন্যে। আমার ভারতীয় বন্ধুটি আর এলেন না কারণ তাঁকে এই অবসরে জাহাজের লণ্ড্রী দেখতে হবে।

 পর্তুগীজদের বাড়িঘর গীর্জা সব ছোট ছোট; পাথরে বাঁধান পথ যেমন হয় মেডিরাতেও ঠিক সেরূপই। মদের দোকানগুলি ইউরোপীয় ধরণে সজ্জিত। বিক্রেতা সকলেই স্ত্রীলোক। মদের দোকানগুলির দিকে তাকিয়ে আমার এই কথাই শুধু বার বার মনে হচ্ছিল যে, একটা জাতি আরেকটা জাতিকে কি ভাবে গ্রাস করে ফেলে। ইউরোপীয় সভ্য জাতগুলির মধ্যে ফরাসী পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশ জাত যে-সকল দেশকে অধীনস্থ করেছে এবং তাদের সংগে তারা যেমন সহজে মিশে যেতে পেরেছে। অন্য কোন জাত আজ পর্যন্ত তা পারেনি। মদের দোকানের একটি মেয়েকে দেখেই মনে হল এ মেয়েটি নিশ্চয়ই বর্ণসংকর, তার চুলই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মনে হল, এটা ঠিক করা চাই এই দ্বীপের আদি অধিবাসী নিগ্রো না পর্তুগীজ।

 ঐতিহাসিক সংবাদ আমি রাখি না, চোখের দেখা এবং অনুমান আমার এক মাত্র পন্থা। দেখেশুনে যতটুকু অনুমান হল তাতে বুঝলাম এখানকার আদি বাসিন্দা নিগ্রোই ছিল। নিগ্রোদের সংগে শ্বেতকায়গণ শক্তির সাহায্যে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করেছে। আবার এমনভাবে সেই সম্বন্ধ স্থির করেছে যে, নিগ্রো আর নাই বললেও চলে, সকলেই বর্ণসংকর ইউরোপীয়ান হয়ে গেছে।

 মদের দোকান দেখেই আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি বলে, যেখানে মদ তৈরী হয় সেখানে গোলাম। শ্বেতকায় ম্যানেজার আমাকে সাদর সম্ভাষণ করলেন এবং কয়েক কাপ্‌ মদের নমুনা দিলেন চেখে দেখবার জন্য! মদের প্রতি আমার দৃষ্টি ছিল না, আমার দৃষ্টি ছিল ম্যানেজার তাঁর বর্ণসংকর কর্মচারীদের প্রতি কেমন ব্যবহার করছেন তার প্রতি। এমন কি, কথা প্রসংগে জিজ্ঞাসা করেও ফেললাম, “প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে কোন বর্ণবৈষম্য আছে কি?” শ্বেতকায় ম্যানেজার বললেন, “এখানে কোনরূপ বর্ণ বৈষম্য নাই।” আমি বললাম, “যদি তাই হয়, তবে জিজ্ঞাসা করব মজুরীর দিক দিয়ে কোনও বর্ণবৈষম্য আছে কি অর্থাৎ যদি আপনার জায়গায় একজন অর্ধ-পতুগীজ কাজ করে, তবে আপনার অনুরূপ মাইনে পাবে কি? দ্বিতীয়ত ওদের এই ধরনের কাজ পেতে কখনও বেগ পেতে হয় কি, অথবা তাদের সেরূপ কাজ হতে বন্‌চিত করা হয় কি?” পর্তুগীজ ম্যানেজার হেসে বললেন, “সে রকম কিছুই নাই। তবে দরিদ্রের রক্ত শুষে ধনী যে অট্টালিকা তৈরী করে তা থেকে আমরাও বাদ যাই না; পথে ঘাটে চলাফেরা করলেই তা দেখতে পাবেন। আরও দেখবেন দরিদ্রতার জন্য মানুষের জীবনে যে অবনতি আসে, তা হতে আমরাও বাদ যাইনি। ধনীদের দোষনীয় বাসনা বড়ই প্রবল হয়। সেই দুষ্ট বৃত্তিকে দমন করার জন্য আমেরিকা এবং ইউরোপ হতে ধনীরা মেডিরাতে আসে। আজ যে সকল যাত্রী এই জাহাজে করে আসল সকলেই মেডিরা বেড়িয়ে দেখতে আসেনি, তারা এসেছে নানারূপ পাপ বাসনা পূরণ করতে। তাদের পাপবাসনাতে আহুতি দেবার জন্য অনেক যুবক যুবতী তৈরী হয়ে আছে। তাদের সংখ্যা কম নয়।” ম্যানেজারের কথায় মনে এমন একটা ধাক্কা এসে লাগল যা সামলাতে অনেক সময় লেগেছিল। আর কথা হল না, বেড়িয়ে চলে আসলাম। পথে দেখা হল কতকগুলি বুয়ার সেপাইদের সংগে।

 বুয়ার সেপাইদের বড়ই আনন্দ। তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা নাই তাই দুহাতে খরচ করছে। মাঝে মাঝে উপরওয়ালা অফিসার এদের সাবধান করেও দিচ্ছিল;

 এখানে নূতন ধরনের গরুর গাড়ি দেখলাম। এক একটি গাড়িতে ছজন করে লোক বসতে পারে। প্রত্যেকটি গাড়ি দুটা বলদ টানে। এমন পুষ্ট পরিষ্কার বলদ আমাদের দেশে দেখেছি বলে মনে হয় না। গাড়িতে জোতা বলদগুলিকে যারা হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তারা একটা চাবুক দিয়ে বলদগুলিকে মারবার ভান করছিল মাত্র। লম্বা পাতলা চিক্কিণ বাঁশের লাঠির উপরে বাঁধা সূতা আকাশে ঘুরিয়ে যখন ঠাস্‌ করে শব্দ করে তখনই বলদ হুঁশিয়ার হয়ে চলতে আরম্ভ করে। বলদ একটু পরিশ্রান্ত হলেই যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়, তাতে যাত্রার সুবিধা হোক আর অসুবিধা হোক আসে যায় না। বুঝলাম যারা বৃষ মাংস ভক্ষণ করে তারা বৃষের সুখ সুবিধার দিকেও চায়, আর যারা বৃষ মাংস খায় না, তারাই বৃষের ল্যাজে সবচেয়ে বেশী মোচড় দেয়।

 মেডিরাতে বোধহয় অনেক কিছু দেখার ছিল, কিন্তু আমার আর ভাল লাগল না তাই জাহাজে ফিরে এলাম। জাহাজে এক রকমের মেলা বসেছে। নানারূপ পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভিড় জমে উঠেছে। দরকষাকষি এমন চলেছে যে যার দাম এক পাউণ্ড বলছে তার দাম এক শিলিং-এ নেমে আসছে। আমাদের দেশেও তা হয়। এই ধরনের দরাদারির জন্য বিদেশীরা আমাদের নিন্দা করে এবং বই লিখে কুৎসা রটায়, কিন্তু এখানে তার উল্টা। এখানে এটাকে আমোদের মধ্যে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে বারবণিতার সংখ্যা নিয়ে দেশবিদেশের লোক নানারূপ গল্প করে। আজ তাদের বারবণিতা তাদেরই ক্রোড়ে এই জাহাজের ডেকের উপর নীল আকাশের নীচে তাদেরই স্বরূপকে উদ্ঘাটিত করছে। এসব বিভৎস কদর্য দৃশ্য দেখতে আমার মোটেই ভাল লাগল না। এদিকে শহরে যে কয় কাপ মদ আমাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল তার সবটাই বাহাদুরী করে উদরসাৎ করায় অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। যখন এরূপ অস্বস্তি অনুভব হয় তখন কোন মতেই ঘরের বাইরে যাওয়া অথবা নিজের স্থান পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ইউরোপে দেখেছি মাতাল অবস্থায় অনেকেই অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে, সেজন্য কেউ দায়ী হয় না, পুলিশও সাহায্য করতে পারে না। তাই কেবিনে যাওয়াই একান্ত কর্তব্য ভেবে কেবিনে প্রবেশ করে নিজের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সাতটার সময় সেদিন ডিনার খাবার বন্দোবস্ত হয়নি। ডিনারের বন্দোবস্ত হয়েছিল রাত বারটায়। নির্দিষ্ট সময়ে যখন ডিনারের ঘণ্টি বাজল তখন শরীর ঠিক হয়ে গিয়েছিল। খাবার সমাপ্ত করে নানারূপ গল্প করার সময় শুনলাম আগামী পরশু বিকালের দিকেই আমরা সাউথ্‌হাম্‌টনে পৌঁছব। এই সংবাদ পরের দিন জাহাজী সংবাদপত্রে বার হল। সংবাদ বার হওয়া মাত্র সকল যাত্রীর মুখেই আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠল। সবাই পেট ভরে মদ খেতে লাগল। তারপর বিকালে হল একটা সভা। সভায় জাহাজের ক্যাপ্টেন সভাপতিত্ব করলেন। সকলেই কিছু কিছু বললেন। আমার বন্ধুটি একদম নীরব থাকাই পছন্দ করলেন। সেজন্য আমাকেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসীদের পক্ষ হয়ে এবং খাস ভারতবাসীর পক্ষ হয়েও কথা বলতে হয়েছিল। বলার নির্ধারিত সময় ছিল পাঁচ মিনিট, কিন্তু অর্ধঘণ্টা বলার পর উপসংহারে বললাম, “আর সময় ক্ষয় করে লাভ নাই, ভারতের সুখদুঃখের হিসাব ভারতবাসী যদি না করে তবে আর কেউ তার কুলকিনারাও করতে পারবে না, অতএব আমার স্বদেশের এবং স্বদেশবাসী যারা দক্ষিণ আফ্রিকাতে বাস করছেন তাদের দুঃখের কথা বলে এতক্ষণ আপনাদের আনন্দে বাধা দিয়েছি বলে ক্ষমা করবেন।” এই বলেই আমি আমার কথার শেষ করেছিলাম। সভা যখন সমাপ্ত হয়েছিল তখন সভায় আগত প্রত্যেকে এক একজন করে আমার করমর্দন করেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম সাদা কথার এখনও মূল্য আছে।

 সাউথ্‌হাম্‌টন অতি কাছে। এর পূর্বেও আমি লণ্ডনে গিয়েছিলাম। সেবারে আমি ছিলাম ক্লান্ত রিক্তহস্ত এবং পেটের ক্ষুধায় জর্জরিত। এবার কিন্তু তা নয়। এবার খেয়ে খেয়ে ডিস্‌পেপসিয়া ধরেছে। পকেটে টাকা আছে। টাকা এবার মনে আনন্দ এনে দিয়েছে। তাই সে আনন্দকে বাড়িয়ে তোলার জন্য লণ্ডন দেখার একটা ফর্দ করে নিলাম এবং ঠিক করলাম এবার লণ্ডন প্রাণ ভরে দেখে নিব।

 দূর থেকে সাউথ্‌হাম্‌টনের লাইট হাউসের আলেক রেখা দেখে মন উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। আমাদের ও নেটিভদের আনন্দ সমান নয়। তাদের হল মাতৃভূমি আর আমাদের হল বিদেশ।

 পিঠ-ঝোলাতে সামান্য জিনিষপত্র চড়িয়ে দিয়ে জাহাজ হতে নেমে পড়লাম। আমরা সবাই গিয়ে বসলাম রেলষ্টেশনের কাষ্টম হাউসে। সেখানে জিনিষপত্র পরীক্ষা হবে। কাষ্টম হাউসে একটি রেস্তোরাঁও ছিল, তাতে সকলে চা পানে ব্যস্ত ছিল। আমিও চায়ের আদেশ দিলাম।

 সাউথ্‌হাম্‌টনে একটা সুন্দর নিয়ম আছে। যেই বিদেশ হতে একটা বড় জাহাজ এল অমনি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। আমাকেও নেটিভদের সংগে স্পেশাল ট্রেনে ওয়াটারলু ষ্টেশন পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আমাদের জন্য বসবার স্থানের রিজারভেসন ছিল না বলেই সর্বত্র বসবার অধিকার ছিল। নিশ্চিন্ত মনে একটা কামরাতে ঢুকে পড়লাম। গাড়ি ছাড়ল এবং চলল লণ্ডনের দিকে। ওয়াটারলু ষ্টেশনে নামার পর আমার পরিচিত কালো আদমীদের দ্বারা পরিচালিত ওয়াই. এম. সি. এ.-তে গিয়ে উঠলাম। এখানে এসে মনে হল দক্ষিণ আফ্রিকার অমানুষিক ‘কালার বারের’ গন্ধ কিছুটা দূর হয়েছে। এখানে তবুও কতকটা স্বাধীনতা আছে। যারা বলেন ইংলণ্ডে কালার বার নাই তারাও কিন্তু সত্য কথা বলেন না। এখানেও কালার বার আছে, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মত নয়। আমেরিকার দিকে আর এক ধাপ এগিয়ে আসছি দেখে মনে বড়ই আনন্দ হয়েছিল।