আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরাট কুচকাওয়াজ
৫ই জুলাই ১৯৪৩:
আজ ভারতীয় জাতীয় বাহিনী আজাদ হিন্দ্ ফৌজের এক বিরাট সেনা সমাবেশ এবং কুচ-কাওয়াজ হইল। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে যে বাহিনী গঠিত হইয়াছিল, দলাদলির ফলে তাহা প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছিল। আজ সুভাষচন্দ্র নূতন করিয়া আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠনের সংবাদ ঘোষণা করিলেন।
‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকগণ!
‘আজ আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গর্বের দিন। ভগবানের অসীম অনুগ্রহ যে আজ তিনি আমাকে জগতের সমক্ষে ভারতের মুক্তি সেনা গঠনের কথা প্রচার করিবার সুযোগ দিয়াছেন। যে সিঙ্গাপুর একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্তম্ভ ছিল, সেইখানে আজ এই সেনাবাহিনী রণসজ্জায় দাঁড়াইয়া আছে। এই সেনাদলই ভারতকে ব্রিটিশ পাশ হইতে মুক্ত করিবে।
‘বন্ধুগণ, আমার সৈনিকগণ! তোমাদের সমর-ধ্বনি হইবে—দিল্লী চল, দিল্লী চল!
‘আমি জানি না, তোমাদের কতজন এই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঁচিয়া থাকিবে। কিন্তু আমি ইহা নিশ্চিত জানি যে আমরা শেষে নিশ্চয়ই জয়লাভ করিব। আমাদের মধ্যে যে সকল বীর বাঁচিয়া থাকিবেন, তাঁহারা দিল্লীর প্রাচীন লাল কেল্লায় বিজয় প্যারেড, না করা পর্য্যন্ত আমাদের কার্য্য শেষ হইবে না।
‘আমি বরাবর অনুভব করিয়াছি যে স্বাধীনতা লাভের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন আমাদের সবই আছে―নাই কেবল একটি জিনিষ—সেটি মুক্তিসেনা।
‘বন্ধুগণ! আজ তোমরাই ভারতের জাতীয় সম্মানের রক্ষক এবং ভারতের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত্ত প্রতীক। সুতরাং তোমাদের আচরণ এবং কার্য্যকলাপ যেন এমন হয় যে তোমাদের স্বদেশবাসী তোমাদের আশীর্বাদ করিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ বংশীয়েরা তোমাদের নামে গর্ব অনুভব করে।
আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি যে তোমাদের সুখে দুঃখে আনন্দে নিরানন্দে—অভাবে এবং জয়ে সকল অবস্থায়ই আমি তোমাদের মধ্যে থাকিব।
উপস্থিত আমি তোমাদের দিতে পারি কেবল ক্ষুধাতৃষ্ণা, দুঃখকষ্ট পথশ্রম এবং মৃত্যু! আমাদের মধ্যে কে ভারতকে স্বাধীন দেখিবার জন্য বাঁচিয়া থাকিব, তাহা আমরা গ্রাহ্য করি না। আমাদের কাছে শুধু ইহাই যথেষ্ট যে ভারত স্বাধীন হইবে এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমাদের যথাসর্বস্ব আমরা দান করিব। ইহা অপেক্ষা বড় কামনা আমাদের আর নাই। ভগবান আমাদের সেনাবাহিনীকে আশীর্বাদ করুন যেন আমরা আগামী যুদ্ধে জয়লাভ করি।
আজাদ হিন্দ্ ফৌজ ভারতের জাতীয় বাহিনী। ইহার নীতি, কার্য্যকলাপ এবং নেতৃত্ব—সমস্তই থাকিবে ভারতবাসীর হাতে। একজনও বিদেশী সৈন্যকে আমরা ভারতে প্রবেশ করিতে দিব না।
‘জাপানীরা ভারতকে স্বাধীন করিয়া দিবে, এরূপ ধারণা আমার নাই। ভারতবর্ষে প্রবেশ করিবে ভারতের জাতীয় বাহিনী; জাপানীদের আমরা ভারতবর্ষে যাইতে দিব না। যদি তাহারা আমাদের মতের বিরুদ্ধে যাইতে চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদেরও আমরা আক্রমণকারী বলিয়া গণ্য করিব। ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ভারতবাসীরই কর্ত্তব্য—আমরাই তাহা করিব।’
ভারতীয় যুদ্ধবন্দী ব্যতীত প্রবাসী ভারতবাসীদের মধ্য হইতেও সৈন্য সংগ্রহ করা হইবে। তিনি এই বাহিনীর প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থের জন্য আবেদন করিলেন।
এইখানে ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা হইল। অনেক দিন পরে এই বিদেশে চেনা লোক দেখিয়া আনন্দ হইল।
ব্যানার্জি বলিলেন—‘এবার সুভাষচন্দ্র নিজে সব ভার লইতেছেন। কাল তাঁহার সঙ্গে আমাদের কথা হইল।’
আমি বলিলাম—‘আপনার সঙ্গে তাঁহার আলাপ আছে কি?’
‘হাঁ, সামান্য পরিচয় ছিল। কলিকাতা কর্পোরেশনের এক নির্ব্বাচনের সময় আমি কলিকাতায় ছিলাম ও তাঁহার পার্টির জন্য খাটিয়াছিলাম।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘সুভাষচন্দ্র দলগঠন ও বক্তৃতা করিতে পারেন ভালো। আমি বোম্বে ও নাগপুরে তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়াছিলাম। কিন্তু এখানে যিনি নেতৃত্ব করিবেন, আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনা সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান থাকা দরকার হইবে না কি?’
ব্যানার্জি হাসিয়া বলিলেন—‘সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষ হইতে পলায়নের পর এতদিন জার্মানিতে ছিলেন। হিট্লার তাঁহাকে ইউরোপের রণাঙ্গনগুলি পর্য্যবেক্ষণের সুযোগ দিয়াছিলেন। তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন তাহা ভারতবর্ষে আর কাহারও নাই।’
সুভাষচন্দ্রের কলিকাতা হইতে পলায়নের কথায় আমার শিবাজীর পলায়নের কাহিনী মনে পড়িয়া গেল।