আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/কিয়ঙ্ক পদাউঙ্গ

উইকিসংকলন থেকে

৭ই জানুয়ারী ১৯৪৫:

 আজ সকালে প্যারেডে কর্ণেল প্রেম কুমার সেহগল্ বক্তৃতা দিলেন। শুনিলাম—ইনি লাহোর হাইকোর্টের জজ অচ্ছুরামের পুত্র এবং দেরাদুন্ মিলিটারি স্কুলে সামরিক শিক্ষা লাভ করিয়াছেন।

 সেহ্‌গল বলিলেন—তাঁহার সৌভাগ্যক্রমে তিনি যে রেজিমেণ্টের ভার পাইয়াছেন তাহা ইতিপূর্ব্বেই রণক্ষেত্রে সুনাম অর্জ্জন করিয়াছে। তিনি সকলের সহযোগিতার জন্য আবেদন জানাইয়া বলিলেন যে যদি কোন অফিসার বা সৈনিকের কোন অভাব অভিযোগ থাকে তিনি তাহা দুর করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন।

 আজ সন্ধ্যায় অফিসারদের একটি আলোচনা সভা হইল। নেতাজী উপস্থিত ছিলেন।

 সংবাদ বিভাগের কর্ম্মচারী বলিলেন যে সম্প্রতি বাঙলা ও আসামে আমাদের যে বিমান পর্য্যবেক্ষণের জন্য গিয়াছিল তাহার অফিসারের রিপোর্ট হইতে জানা গিয়াছে যে আমেরিকার প্রচুর সমরোপকরণ, এরোপ্লেন, ট্যাঙ্ক, মোটার, মোটর সাইকেল, কামান প্রভৃতি আসিয়া পৌঁছিয়াছে এবং বার্ম্মার সীমান্তে চালান হইতেছে। অন্যান্য সূত্র হইতে খবর পাওয়া গিয়াছে যে বৃটিশ ও আমেরিকার সৈন্যসংখ্যা ২০ লক্ষের কম নয়।

 বার্ম্মায় জাপানীদের আড়াই লক্ষের বেশী সৈন্য নাই এবং তাহাদের এরোপ্লেন ও আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ইহার তুলনায় কিছুই নয়! জাপানীরা খুব কম সৈন্য ও এরোপ্লেনের সাহায্যে সমগ্র পূর্ব্ব এশিয়া দখল করিয়াছিল। ইহা সম্ভব হইয়াছিল শুধু এইজন্য যে তখন ইংরেজদের এই অংশে কিছুই ছিল না। কিন্তু বর্ত্তমানে অবস্থা পৃথক আকার ধারণ করিয়াছে। তখন ভারতবর্ষও প্রায় অরক্ষিত ছিল—বাঙলা ও আসাম হইতে ইংরেজরা সরিয়া পড়িবার ব্যবস্থা করিয়াছিল; যুদ্ধেরও প্রয়োজন হইত না। আজ এক শক্তিশালী যান্ত্রিক বাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত রহিয়াছে।

 নেতাজী বলিলেন—‘যন্ত্র অপেক্ষা মানুষই বেশী শক্তিশালী। আরাকান, চিন্ ও নাগা পাহাড় অঞ্চলে যান্ত্রিক বাহিনী বিশেষ কাজে লাগিবে না। বৃটিশ সৈন্যের মনোবল নষ্ট হইয়াছে। একবার আসাম ও বাঙলার মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলে দেশের লোক আমাদের সাহায্য করিবে। এখনো আমাদের যথেষ্ট সুযোগ রহিয়াছে।’

 এই সময় গত বৎসরের যুদ্ধে যে সকল সৈন্য দল ছাড়িয়া বিপক্ষে যোগদান করিয়াছিল তাহাদের কথা উঠিল।

 নেতাজী বলিলেন—‘আমাদের ফৌজ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আমরা সকলে দেশকে মুক্ত করিবার জন্য স্বেচ্ছায় চলিয়াছি আত্মদান করিবার জন্য—অর্থ বা পুরস্কারের প্রলোভনে নয়। আমাদের মধ্যে যদি কেহ এই দুঃখকষ্ট, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর সম্ভাবনায় ভয় পায়, তাহাকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধে পাঠানো না হয়।’

৮ই জানুয়ারি ১৯৪৫: মিংগালাদন্:

 আজ সকালে প্যারেডে নেতাজী উপস্থিত ছিলেন। রণাঙ্গনে যাত্রার পূর্বে তাঁহার বাণী দিলেন:—

 ‘গত বৎসর আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রথম রণক্ষেত্রে বিপক্ষের সম্মুখীন হইয়াছিল। রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ্ ফৌজ যে বীরত্ব দেখাইয়াছে তাহা গৌরবময় এবং আমার আশার অতীত। তাহারা শত্রু ও মিত্র সকলেরই প্রশংসা লাভ করিয়াছে। আমরা যখনি যেখানে তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছি, সেখানেই তাহাদের পর্যুদস্ত করিয়া পরাজিত করিয়াছি। আমরা পরাজিত হই নাই; অসম্ভব বৃষ্টি এবং অন্যান্য বাধাবিঘ্নের ফলে আমরা রণকৌশলের খাতিরে ইম্ফল রণাঙ্গন হইতে আমাদের সেনাবাহিনী ফিরাইয়া আনিতে বাধ্য হই।

 ‘আমরা এক্ষণে এই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিতে চেষ্টা করিতেছি।

 ‘এই বৎসর যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ণীত হইবে। ইম্ফল্ পর্বতমালা ও চট্টগ্রামের সমতলভূমিতে ভারতের স্বাধীনতা ও আমাদের ভাগ্য নির্দ্ধারিত হইবে।

 ‘গত বৎসর আমাদের কিছু লোক শত্রুপক্ষে যোগদান করিয়াছিল। আমরা যখন রণাঙ্গণে যুদ্ধে রত থাকিব, তখন আমি চাহি না যে একজনও বিপক্ষে চলিয়া যায়। সুতরাং যদি কেহ মনের দৌর্বল্য, কাপুরুষতা বা অন্য কোন কারণে রণাঙ্গনে যাইতে অক্ষম বলিয়া মনে করে, সে যেন তাহার রেজিমেণ্টের কমাণ্ডারের নিকট তাহা বলে; তাহা হইলে তাহাকে অন্য কার্য্যে নিয়োগ করা হইবে।’

 ‘আমি তোমাদের কাছে কুসুমাচ্ছাদিত স্বপ্নের কাহিনী চিত্রিত করিতে চাহি না। যখন তোমরা রণাঙ্গনে উপস্থিত হইবে তখন তোমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও অন্যান্য দুঃখকষ্ট এবং এমন কি মৃত্যু পর্য্যন্ত বরণ করিতে হইতে পারে। আমাদের বিপক্ষ যতদূর সম্ভব তৈয়ারী হইয়াছে; আমাদের সমস্ত সম্বল নিযুক্ত করিতে হইবে—

 ‘সব ত্যাগ কর—সব দিয়া ফকির হও।’

 নেতাজীর কণ্ঠস্বরে যাদু আছে; তাঁহার বাণী সকলের মনে নূতন উৎসাহের সঞ্চার করিয়াছে।

২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫: পোপা

 আজ পোপায় পৌছিয়াছি। পোপা পর্বত ৪৯৩১ ফিট উচ্চ; উত্তর বর্মার মিঙ্গিয়ন জেলার দক্ষিণে। আমরা যেখানে আছি, সেখান হইতে পোপার সর্ব্বোচ্চ শিখর অনেক দূর।

১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫:

 গতকল্য কর্ণেল ধীলন এখানে আসিয়া পোঁছিয়াছেন। তাঁহার নেহরু রেজিমেণ্টের অবস্থা বড় খারাপ—অনেকের বন্দুক নাই, আবার অনেকের সঙ্গে বিছানা বা গরম কাপড়ও নাই। এই রেজিমেণ্টের প্রায় তিনশত লোক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আসিয়া পৌছিয়াছে।

 আজ কর্ণেল সেহগল আসিলেন।

২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫:

 আজ সকালে কিয়ঙ্ক্ পদাউঙ্গ শহরে পৌঁছিয়াছি। এখান হইতে সংবাদ লইয়া এরোপ্লেনে যাইতে হইবে নেতাজীর অফিসে।

 বৃটিশ বাহিনী বর্মার উপর জোর আক্রমণ চালাইয়া অগ্রসর হইতেছে। মান্দালয় পৌছিয়া শুনিলাম—নেতাজী টউঙ্গগি গিয়াছেন।

 এখানে কর্ণেল সেহগলের রণাঙ্গন হইতে একজন অফিসার আসিয়ছেন। তাঁহার নিকট জানিলাম—ইংরেজ সৈন্য কর্ণেল ধীলনের রণাঙ্গনের একস্থানে গত ১৭ই তারিখে ইরাবতী নদী পার হইয়াছে। কর্ণেল ধীলনের রেজিমেণ্টের মধ্যে ভয়ানক বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইয়াছে। সৈন্যরা কাহারও কথা শুনিতেছে না; তাহাদের মনোবল নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অনেকে পলায়ন করিয়াছে। এদিকে কর্ণেল আজিজ অসুস্থ। কর্ণেল শাহ নওয়াজ আজিজের রেজিমেণ্ট পরিচালনার ভারও গ্রহণ করিয়াছেন।