বিষয়বস্তুতে চলুন

আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/জ্ঞান সিংএর বীরত্ব

উইকিসংকলন থেকে

১৯শে মার্চ ১৯৪৫:

 আজ কর্ণেল ধীলনের নিকট হইতে সুসংবাদ আসিয়াছে। একটা যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা অসীম বীরত্ব দেখাইয়াছে। নেতাজীর নিকট রিপোর্ট যাইতেছে। জ্ঞান সিংএর সহিত পরিচয় ছিল। তাহার মৃত্যু সংবাদে মন খারাপ হইয়া গেল। কিন্তু এ মৃত্যু বীরের।

 ঙগ্লাইঙ্গের নিকটে লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট কর্ত্তার সিংএর অধীনে একদল এবং কন্‌জাউঙ্গের উত্তর-পূর্বে লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিংএর অধীনে একদল সৈন্য ছিল। নিকটেই ছিল একদল জাপানী সৈন্য; তাহার নায়ক—কাপ্তেন মিদোরি কাওয়া।

 গত ১৪ই মার্চ সন্ধ্যা ৮৷৷৹টার সময় শত্রু কামান উত্তর-পশ্চিম দিক হইতে ভীষণ গোলা বর্ষণ করিতে লাগিল।

 ‘এ’ কোম্পানীর একটি পেট্রল লইয়া হাভিলদার নজর সিং ন্যায়ুঙ্গ্ অভিমুখে যাইতেছিলেন। সেই সময় শত্রুর একটি প্লেটুন্ রাস্তার পশ্চিম দিকে ঙগ্লাউঙ্গেব দিক হইতে আসিতেছে দেখা গেল। ইহারা আমাদের পেট্রল দলটী দেখিতে পাইয়া গুলি বর্ষণ আরম্ভ করিল।

 নজর সিংএর দল তাহার উত্তরে গুলিবৃষ্টি করিল। সাতজন শত্রু সৈনিক নিহত হইল। শক্রর অগ্রগতির সংবাদ নজর সিং ‘এ’ কোম্পানির হেড কোয়ার্টারে পাঠাইলেন।

 কমাণ্ডার কর্ত্তার সিং শত্রুকে বাধা দিবার জন্য সেকেণ্ড লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট্ দিত্তুরামকে পাঠাইলেন। দিত্তুরাম শত্রুকে বাধা দিলেন।

 প্রায় ১২-৩০টার সময় শত্রুর ১৫টী ট্যাঙ্ক, ১১টি আর্‌মার্ড্‌ কার এবং দশখানি ট্রাক আসিয়া ঐখানে উপস্থিত হইয়া গুলি ও বোমা বর্ষণ আরম্ভ করিল। আমাদের লোকেরা ব্রেন্ গান্ ও রাইফেলের গুলি দিয়া তাহাদের অভ্যর্থনা করিল।

 শত্রু সৈন্য দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া একদল ‘এ কোম্পানীকে এবং অন্য দল ‘বি’ কোম্পানীর দিকে অগ্রসর হইল।

 ‘বি’ কোম্পানী পূর্বেই সংবাদ পাইয়াছিল। শত্রুর যান্ত্রিক বাহিনী বি কোম্পানীকে ভেদ করিয়া পর্যুদস্ত করিতে চাহিয়াছিল; কিন্তু আমাদের সৈন্যদল প্রস্তুত থাকায় তা আর হইল না। তাহারা গাড়ী হইতে আমাদের ছাউনির উপর বোমা ফেলিতে ও কামান ছুঁড়িতে লাগিল। শত্রুর উৎকৃষ্ট যন্ত্রাদির নিকট আমাদের সৈন্যরা হতাশ হইয়া পড়িল। দুইটি মাইন্ ছিল; সে দু’টি ছোঁড়া হইল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দুটিরই লক্ষ্য বিফল হইল।

 তখন ৫ ও ৬ নং প্লেটুন্ পরিখার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল এবং নেতাজীর জয় ও ইন্‌কিলাব্ জিন্দাবাদ ধ্বনির সহিত বেয়নেট হস্তে শত্রুর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। শত্রুর মোটার বাহিনীর গতি রুদ্ধ হইল। শত্রু মোটার হইতে বাহির হইয়া আসিল। তখন এক ঘণ্টা কাল হাতাহাতি যুদ্ধ চলিল। কম্যাণ্ডার জ্ঞান সিং নিজেই সৈন্যদের মধ্যে থাকিয়া আক্রমণ চালাইতেছিলেন এবং তাহাদের উৎসাহিত করিতেছিলেন।

 ৫ নং প্লেটুনের কম্যাণ্ডার সেকেণ্ড্ লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট মঙ্গুরাম নিহত হইলেন এবং দুটি প্লেটুনের মধ্যে দশমাংশ মাত্র অবশিষ্ট রহিল। তখন জ্ঞান সিং ৪ নং প্লেটুন কমাণ্ডার সেকেণ্ড্ লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট্ রাম সিংকে ডাকিলেন। তিনি যখন আদেশ দান করিতেছিলেন, সেই সময় একটি বুলেট্ আসিয়া লাগিল এবং তিনি পড়িয়া গেলেন।

 জ্ঞান সিংএর মৃত্যুর পর একটু গোলযোগ উপস্থিত হয়। কিন্তু রাম সিং তখন পরিস্থিতি আয়ত্তে আসিয়া কোম্পানির অবশিষ্ট সৈনিকদের একত্র করিলেন।

 এই সময়ে শত্রু তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া স্থান ত্যাগ করিল। এই যুদ্ধ ১৪টা হইতে ১৬টা (২টা হইতে ৪টা) পর্য্যন্ত চলে। শত্রুপক্ষে ক্ষতি—৫০ জন হত এবং অনেক আহত।

 শক্রর যে দল ‘এ’ কোম্পানীর নিকটে আসিয়াছিল, তাহা গ্রামের উপর গোলা বর্ষণ আরম্ভ করে এবং গ্রামের মধ্যে প্রবেশে সক্ষম হয়। আমাদের কোম্পানির দিক হইতেও অগ্নিবর্ষণ করা হইল। প্রায় ১৮টার সময় (সন্ধ্যা ৬টা) শত্রু বেয়নেট্ ও টমি গান লইয়া আক্রমণ করিল।

 জাপানীরা তখন ট্যাঙ্কের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গ্রামে আগুন লাগাইয়া দিল। ইহাতে সুবিধা হইল এই যে ট্যাঙ্কগুলি আর অগ্রসর হইতে পারিল না এবং শত্রুকে বাধ্য হইয়া পলায়ন করিতে হইল।

 বি ইউনিট্ কোয়েব্যিওক্ গ্রামে ফিরিয়া আসিয়াছে।

 শত্রুর নিকট হইতে এই কয়টি জিনিষ পাওয়া গিয়াছে—

ব্রেন্ গান্
হাত গ্রেনেড্
গোলাগুলি ৩০৩ রাউণ্ড্



১০০

 একটি এল-এম-জি, একটি টমি গান এবং একটি রাইফেল জাপানীর পাইয়াছে।

 আমাদের নিহতের মধ্যে আছেন—লেফট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিং ও লেফট্‌ন্যাণ্ট মঙ্গুরাম এবং তাহা ছাড়া আরও ৫০ জন সৈনিক।

২০শে মার্চ ১৯৪৫:

 আজ পরামর্শ সভা ছিল। কর্ণেল সেহগল সংবাদ দিলেন যে জাপানীদের নিকট হইতে ৭৫টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংশী মাইন্ (এ্যাণ্টি-ট্যাঙ্ক মাইন্) পাওয়া গিয়াছে এবং উহার ব্যবহার পদ্ধতি আমাদের লোকেরা শিখিয়া লইয়াছে।

 সেহগল্ বলিলেন—‘হয় আমরা আক্রমণ করিব, না হয় উহারা আমাদের আক্রমণ করিবে। যদি ১ নং ব্যাটেলিয়ানের রণাঙ্গন ভেদ করিতে শত্রু সমর্থ হয়, তাহা হইলে অন্য দুইটি ব্যাটেলিয়ন্ যেন অটল থাকে; কারণ আমরা যদি পোপা অঞ্চল ছাড়িয়া যাই, তাহা হইলে ১৯।২০ মাইলের মধ্যে জল পর্য্যন্ত পাইব না।

 কতকগুলি সৈনিক পলায়ন করিয়া বিপক্ষে যোগদান করিয়াছে। এ সম্বন্ধে নেতাজীর ১৩ই মার্চ তারিখের বিশেষ নির্দেশ পাঠ করিয়া শুনানো হইল।


 ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ দলের সকল অফিসার ও সৈনিকদের প্রতি— কমরেড্‌স্ আপনারা সকলে জানেন যে গত বৎসর যুদ্ধক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজ দলের অফিসার ও সৈনিকগণ যে সাফল্যলাভ করিয়াছিল এবং তাহারা দেশাত্মবোধ, সাহস ও আত্মবিসর্জ্জন দ্বারা শত্রু সৈন্যের উপর যে জয়লাভ করিয়াছিল উহার মধ্যেও কয়েকজন অফিসার ও সৈনিকের মনের দুর্ব্বলতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। আমরা আশা করিতেছিলাম যে নূতন বৎসর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব্বের সকল প্রকার ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা দুরীকৃত হইবে। কিন্তু সে আশা সফল হয় নাই। সম্প্রতি দ্বিতীয় ডিভিসনের হেড্ কোয়াটার্সের পাঁচজন অফিসারের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে আমরা এখন বুঝিতে পারিয়াছি যে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে এখনও অনেক দোষত্রুটি আছে এবং ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা সমূলে বিনাস করিবার জন্য আমাদের এখনও চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা যদি এখন ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা দূর করিতে পারি, তাহা হইলে আমি বলিব যে ভগবানেব কৃপায় এই সকল লজ্জাসূচক ও ঘৃণ্য ঘটনা আমাদের নিকট আশীর্ব্বাদ স্বরূপ আসিয়াছিল। সুতরাং আমাদের সৈন্যবাহিনীর উন্নতির জন্য আমি সকল প্রকার সম্ভব পন্থা অবলম্বন করিতে মনস্থ করিয়াছি। আমার বিশ্বাস যে এই সকল কার্য্যে আমি আপনাদের যথাসাধ্য সাহায্য পাইব।

 ভীরুতা ও কাপুরুষতা সম্পূর্ণরূপে দূর করিতে হইলে নিম্নলিখিত উপায়গুলি অবলম্বন করিতে হইবে:—

 (ক) যদি কেহ তাহার ব্যবহারে ভীরুতার পরিচয় দেয় বা বিশ্বাসঘাতকতার কার্য্য করে তাহা হইলে এন. সি. ও বা সিপাহি যাহাই হউক না কেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রত্যেক সৈন্যই যে কোন পদমর্য্যাদাবিশিষ্ট উক্ত প্রকার যে কোন ব্যক্তিকে বন্দী করিতে বা গুলি করিতে পারেন।

 (খ) আজাদ হিন্দ ফৌজের যে সকল সভ্য নিয়মানুযায়ী কার্য্য করিতে বা সাহসের সহিত যুদ্ধ করিতে অনিচ্ছুক তাহাদের আমি ভবিষ্যতে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছাড়িয়া যাইবার সুবিধা দিতেছি। এই সুবিধা সংবাদ পাইবার পর এক সপ্তাহ বহাল থাকিবে।

 (গ) অনিচ্ছুক সৈন্যদিগকে স্বেচ্ছায় অজাদ ফৌজ ছাড়িয়া দিবার সুবিধা প্রদান ছাড়াও আমি আমাদের সৈন্যদলকে নিখুঁত করিতে চাই। আমাদের সাহায্য করে নাই অথবা বিজয়ের সময়ে আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে এইরূপ সন্দেহ যাহাদের প্রতি রহিয়াছে তাহাদের বহিষ্কৃত করিতে হইবে। আমার এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জন্য আমি আপনাদের পূর্ণ সহযোগিতা চাই এবং আশা করি যে যদি কোন ভীরু বা বিশ্বাসঘাতক আমাদের সৈন্যদলের মধ্যে এখনও থাকে তাহা হইলে আপনারা এ সম্বন্ধে প্রাপ্য সংবাদ আমাকে বা আমার বিশ্বাসী অফিসারদের দেবেন।

 (ঘ) কিন্তু বর্ত্তমানে উপরোক্ত প্রথা অবলম্বন করিলেই আমাদের কার্য্য শেষ হইবে না, ভবিষ্যতেও পর্য্যবেক্ষণের প্রয়োজন। সুতরাং ভবিষ্যতে আজাদ হিন্দ ফৌজদলের প্রত্যেকের চোখ খুলিয়া পর্য্যবেক্ষণ করা কর্ত্তব্য। ইহার ফলে তাহারা ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কোন লক্ষণ দেখা দিলেই ধরিতে পারিবে। ভবিষ্যতে আজাদ হিন্দ ফৌজের কোন ব্যক্তি যদি ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কোন চিহ্ন পান তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তিনি মুখে অথবা লিখে আমাকে বা নিকটস্থ অফিসারদের নিকট রিপোর্ট পেশ করিবেন। অর্থাৎ, এখন হইতে সকল সময় প্রত্যেক সৈন্যের মনে করা উচিত যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের এবং ভারতীয় জাতির সম্মান ও যশের মূর্ত্ত প্রতীক।

 (ঙ) বহিস্করণ ও অনিচ্ছুক ব্যক্তিগণের আমাদের সৈন্যবিভাগ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিবার পর যদি ভীরু ও বিশ্বাসঘাতকের কোন সন্ধান পাওয়া যায় তাহা হইলে তাহার শাস্তি হইবে মৃত্যু।

 (চ) কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে আমাদের সৈন্যদের ভিতর একটি নৈতিক প্রাচীর প্রস্তুত করিতে হইলে, ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণার ভাব জাগাইয়া তুলিতে হইবে। এই সৈন্যদলের মধ্যে প্রত্যেকের মনে এই ভাব জাগাইয়া তুলিতে হইবে যে কাপুরুষ ও বিশ্বাসঘাতকের ন্যায় ঘৃণ্য কাজ আর নাই। আমাদের সৈন্যবাহিনী হইতে কাপুরুষ ও বিশ্বাসঘাতকদের তাড়াইয়া দেওয়ার জন্য কি করিয়া ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে ঘৃণার ভাব জাগাইয়া দেওয়া যায় সে সম্বন্ধে পৃথক ভাবে নিয়মাবলী প্রদত্ত হইবে।

 (ছ) বহিষ্করণের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রত্যেক সৈন্যকে এই বলিয়া নূতন করিয়া শপথ গ্রহণ করিতে হইবে যে যতদিন পর্য্যন্ত আমাদের মাতৃভূমির মুক্তি না হয় তত দিন সে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালাইবে।

 (জ) যাহারা কাপুরুষ ও বিশ্বাসঘাতকের সন্ধান দিতে পারিবে তাহাদিগকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হইবে।

(স্বাঃ) সুভাষ চন্দ্র বসু

সর্ব্বাধিনায়ক

আজাদ হিন্দ ফৌজ