আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/নেতাজীর প্রাণনাশের চেষ্টা
২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯২৮:
আজ লেফ্টন্যাণ্ট্ বিশ্বম্ভরদাসের নিকট শুনিলাম নেতাজীর প্রাণ নাশের চেষ্টার কাহিনী। বিশ্বম্ভর দাস বাহাদুর দলের নায়ক এবং নেতাজীর বাসভবনের রক্ষীদলের ভার তাঁহার উপর। নেতাজীর বাসভবনে দিনরাত্রি পাহারার ব্যবস্থা আছে। এই রক্ষীদল দুইভাগে বিভক্ত—একদল ইউনিফর্ম্ পরিয়া পাহারা দেয়, আর একদল সাধারণ অসামরিক পোষাকে থাকে। উভয়েরই নিকট রিভলভার প্রভৃতি থাকে। বাড়ীর বাহিরে পাঁচজন সৈনিক সাধারণ পোষাকে চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে। বাড়ীর প্রাঙ্গনের ভিতরে থাকে আটজন ইউনিফর্ম্ পরিহিত রক্ষী।
সেদিন অন্ধকার রাত্রি। তখন ১১টা। রক্ষী বদল যথারীতি হইল। একদল রক্ষী ব্যারাকে চলিয়া গেল, তাহাদের স্থান গ্রহণ করিল আর এক দল। বাড়ীর কম্পাউণ্ডের মধ্যেই সেনানিবাস। পাহারা শেষ হইলে এই রক্ষীরা যখন ফিরিয়া আসে, সেই সময়ে সেনানিবাসে ৫০।৬০ জন মাত্র সৈনিক ছিল।
বিশ্বম্ভর দাসের মনে হইল—কোন বাহিরের লোক সেনা নিবাসে প্রবেশ করিয়াছে। তিনি তখনি সকলকে লাইনে দাঁড়াইতে আদেশ দিলেন। প্রত্যেকে নিজের নাম ও সংখ্যা বলিল। দুইজন লোক একই নাম ও সংখ্যা বলিল! তিনি এই দুইজনকে গ্রেপ্তার করিতে আদেশ দিলেন। উহাদের মধ্যে একজন একটি রিভলভার বাহির করিয়া তুলিয়া ধরিল এবং পলায়নের চেষ্টা করিল। তখনি সকলে তাহার হাত হইতে রিভলভার কাড়িয়া লইল। দুইজনেই বন্দী হইল।
এই সময় নীচে গোলযোগ হওয়ায় নেতাজী বাড়ীর দ্বিতল হইতে জিজ্ঞাসা করিলেন—কি হইয়াছে। লোক দুইটি স্বীকার করিল, তাহারা নেতাজীকে হত্যা করিবার জন্য নিযুক্ত হইয়াছিল।
এই ঘটনার পর হইতে রক্ষীনিবাসের উপর কড়া নজর রাখা হইল।
এই মাসেই আর একবার নেতাজীর প্রাণনাশের চেষ্টা হয়। সেদিনও রাত্রিকাল—নিবিড় অন্ধকার। বিশ্বম্ভর নাথ বাড়ীর দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছিলেন। এই সময় একটি মোটার আসিয়া দাঁড়াইল এবং তাহার মধ্য হইতে একজন লোক নামিয়া আসিল। তাহাকে দেখিতে রাসবিহারী বসুর ন্যায়। সে গাড়ী হইতে নামিয়া নেতাজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিল। বিশ্বম্ভর নাথ তাহাকে তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিলে, সে বলিল—‘রাসবিহারী বসু’। আরও বলিল—‘আমি টোকিও হইতে আসিতেছি—খুব জরুরি দরকার। নির্জনে দেখা করিতে চাই।’
বিশ্বম্ভরনাথ রাসবিহারী বসুকে কখনো দেখেন নাই, তবে তাহার ছবি দেখিয়াছেন এবং সেই ছবির সহিত এই লোকটির সামঞ্জস্য আছে বলিয়া মনে হইল। তিনি তাহাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া নেতাজীকে তাড়াতাড়ি সংবাদ দিতে গেলেন।
রক্ষীদের মধ্যে একজন রাসবিহারী বসু যখন সিঙ্গাপুরে আসিয়াছিলেন, সেই সময় প্রায় এক সপ্তাহ কাল তাঁহার বাসায় পাহারা দিয়াছিল। রাসবিহারী বসু আসিয়াছেন শুনিয়া সে তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিতেছিল। তাহাকে দেখিবামাত্র বৃদ্ধ মোটারের মধ্যে উঠিয়া বসিল এবং গাড়ী চলিয়া গেল। রক্ষী বলিয়া উঠিল—‘এতো রাসবিহারী বসু নয়।’
এদিকে বিশ্বম্ভরনাথের কাছে রাসবিহারী বসু আসিয়াছেন শুনিয়া নেতাজী স্বভাবতই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি খুব বিস্মিত হইয়াছিলেন।
‘রাসবিহারী বসুতো টোকিওতে আছেন। আজ সন্ধ্যায় রেডিওতে তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়াছি; ইহার মধ্যে তিনি কি করিয়া আসিবেন। যাহা হউক লোকটিকে আমি দেখিতে চাই।’
বিশ্বম্ভরনাথ নীচে আসিয়া দেখিলেন—লোকটি পলায়ন করিয়াছে।