আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/বোমা বর্ষণ ও তাহার ফল

উইকিসংকলন থেকে

২৩শে ডিসেম্বর ১৯৪১:

 সাইরেনের শব্দ—উঁয়া-আ-আ—উঁয়া-আ-আ! নিশ্চয়ই সতর্ক করিবার মহড়া। কি বিশ্রী শব্দ! মনে হইতেছে যেন লক্ষ লক্ষ পুত্র শোকাতুরা জননী একসঙ্গে আর্ত্তনাদ করিতেছে। বাতাস চিরিয়া সেই করুণ সুর চারিদিক ছাইয়া ফেলিয়াছে। উয়া—আ-আ, উয়া—আ-আ-আ ···। সাইরেন্ কিছুক্ষণ কাৎরাইয়া কাৎরাইয়া কাঁদিয়া চুপ করিল। রাস্তার যানবাহন-লোক চলাচল সব কখন থামিয়া গিয়াছে। চারিদিকে একটা গমগমে ভাব।

 একটু পরেই কাণে গেল এরোপ্লেনের শব্দ—কিন্তু যেন অন্য ধরণের। ভম্-ভম্-ভম্ ভম্—যেন অসংখ্য ভীমরুল একসঙ্গে গুঞ্জন করিয়া উড়িয়াছে। জানালা হইতে দেখিলাম—প্রায় ৩৫।৩৬ খানা এরোপ্লেন ঝাঁক বাঁধিয়া চলিয়াছে অনেক উচ্চে।

 দুরে ত্রস্ত আকাশের পটে এক ঝলক আলোক বিদ্যুতের তরবারির মতন ঝলসিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের বুক চিরিয়া একটা শব্দ হইল—সোঁ-ও-ও-ও। তারপরই—গুম্-গুম্-গুম-গুম্। বোমা পড়িতেছে। মনে হইল অফিস অঞ্চলে। আমার ঘরের জানালা-দরজা জিনিষপত্র মধ্যে মধ্যে কাঁপিয়া উঠিতেছে।

 মেশিন গান্, এণ্টি-এয়ারক্রাফ্‌ট্‌, বোমার শব্দ একসঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে। মেঘে ও মাটিতে যুদ্ধ চলিয়াছে। আকাশে বাতাসে, মাটিতে চারিদিকে মৃত্যুর বন্যা। মনে হইতেছে— রেঙ্গুন শহর বুঝি আজ ধ্বংশ হইয়া যাইবে। মাথার উপরে মৃত্যুর দূত। হঠাৎ মুহূর্ত্তগুলি যেন অচল হইয়া গিয়াছে।

 দেখিলাম—দূরে লেলিহান অগ্নিশিখা দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে। নিবিড় ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে মাথা তুলিয়াছে।

 আবার সাইরেন বাজিল—একটানা শব্দ। অল ক্লিয়ার্। যাক্— আজকার মতন আমরা বঁচিয়া গেলাম।

 বোমার শব্দের তুলনায় বাড়ীঘরের ক্ষতি বেশী হয় নাই। কিন্তু অফিস অঞ্চলের রাস্তায় অনেক লোক মরিয়াছে। শেল্‌টার গ্রহণ না করাই তাহার কারণ।

 রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী শ্যামানন্দের নিকট শুনিলাম যে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের দুইটি পাকা বাড়ী ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত ঘরই নষ্ট হইয়াছে।

 পাকা বাড়ীর এক তলায় থাকিলে এই বোমা হইতে অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়।

২৬শে ডিসেম্বর ১৯৪১:

 আজ আবার রেঙ্গুনে বোমা পড়িল। সেদিন অপেক্ষা আজ লোক মরিয়াছে কম।

১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪২:

 জাপানীরা মৌলমেন্ ও মার্তা‌বান্ দখল করিয়াছে এবং সিতাং নদী পর্য্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছে।

 রেঙ্গুনের অনেক দোকানে ধারে মাল দিয়াছি। কিন্তু যেখানে সকলেই যথাসর্ব্বস্ব ফেলিয়া পলাইতেছে, সেখানে আমার পাওনা টাকা আদায়ের সম্ভাবনা কোথায়? তবু চেষ্টা করিতেছি। পথেও তো খরচ আছে। ষ্টীমার ও এরোপ্লেনে জায়গা পাইবার আশা নাই। শেষে হয়তো হাঁটা পথেই যাইতে হইবে।

১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪২:

 দুর্ভেদ্য সিঙ্গাপুরেরও পতন হইয়াছে। রেঙ্গুন হইতে বেশীভাগ লোকই পলায়ন করিয়াছে। যে ২।১ জন চলিতেছে, তাহাদের মুখে উৎকণ্ঠার ভাব। পথে আয়ারকে একটি ল্যাঞ্চার (রিক্সার) উপর দেখিলাম। ছোট একটি মোট লইয়া চলিয়াছে। আমায় জিজ্ঞাসা করিল—‘আপনি এখনো আছেন?’ তারপর এদিক-ওদিক চাহিয়া চাপা গলায় বলিল—‘জাপানীরা আসিয়া পড়িল যে।’

 সত্যই কি জাপানীরা আসিতেছে? প্রকৃত সংবাদ কোথায় গেলে পাই? মনে পড়িল, রাও পোষ্টমাষ্টার জেনারেলের অফিসে কাজ করে; সে হয়তো বলিতে পারে। চলিলাম স্ট্রাগু রোডে পি-এম-জির অফিসে। কিন্তু অফিস প্রায় জনশূন্য।

 এখান হইতে চলিলাম ‘সান্’ পত্রিকা অফিসে। তাহার নিশ্চয়ই সংবাদ রাখে। চারদিন কোন সংবাদপত্র বিক্রয় করিতে দেখি নাই। সান্ বর্মীদের সর্বাপেক্ষা প্রতিপত্তিশালী দৈনিকপত্র। অফিসে গিয়া দেখিলাম তালা বন্ধ।

 পথে ল্যাঞ্চার (রিক্সা) একটিও নাই। দু’একখানি গাড়ী কদাচিৎ চলিতেছে।

 এক কাপ চা হইলে ভালো হইত। কিন্তু একটি দোকানও দেখিলাম না।