আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)
আত্মচরিত
প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ
আমার আত্মচরিতের বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হইল। আমাদের দেশে রসায়ন বিদ্যার চর্চা এবং রাসায়নিক গোষ্ঠী গঠনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস ইহাতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তদ্ব্যতীত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী অভিজ্ঞতামূলক সমসাময়িক অর্থনীতি, শিক্ষাপদ্ধতি ও তাহার সংস্কার, সমাজ-সংস্কার প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ক সমালোচনা এই প,স্তকের বিষয়বস্তু হইয়াছে।
বাঙালী আজ জীবন মরণের সন্ধিস্থলে উপস্থিত। একটা সমগ্র জাতি মাত্র কেরানী বা মসীজীবী হইয়া টিকিয়া থাকিতে পারেনা; বাঙালী এতদিন সেই ভ্রান্তির বশবর্তী হইয়া আসিয়াছে এবং তাহারই ফলে আজ সে সকল প্রকার জীবনোপায় ও কর্মক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত। বৈদেশিকগণের ত কথাই নাই, ভারতের অন্যান্য প্রদেশস্থ লোকের সহিতও জীবন সংগ্রামে আমরা প্রত্যহ হটিয়া যাইতেছি। বাঙালী যে 'নিজ বাসভূমে পরবাসী' হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ইহা আর কবির খেদোক্তি নহে, রূঢ় নিদারণ সত্য। জাতির ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাবৃত, তাহা বুঝিতে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তাই বলিয়া আশা ভরসার জলাঞ্জলি দিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিলেও চলিবে না। ‘বৈষ্ণবী মায়া’ ত্যাগ করিয়া দৃঢ়হস্তে বাঁচিবার পথ প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে।
বাল্যকাল হইতেই আমি অর্থ-নৈতিক সমস্যার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছি এবং পরবর্তী জীবনে শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার ন্যায় উহা আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া গিয়াছে। কিন্তু কেবল সমস্যার আলোচনা করিয়াই আমি ক্ষান্ত হই নাই, আংশিকভাবে কর্মক্ষেত্রে উহার সমাধান করিতে চেষ্টা পাইয়াছি। সেই চেষ্টার ইতিহাস আত্মচরিতে দিয়াছি। এই পুস্তকখানিকে জনসাধারণের বিশেষতঃ গৃহ-লক্ষীদের অধিগম্য করিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই নিঃশেষিতপ্রায় ইংরাজী সংস্করণের মূল্য পাঁচ টাকা নির্ধারিত হইয়াছিল। বাংলা সংস্করণের কলেবর ইংরাজী পুস্তকের তুলনায় কিঞ্চিৎ বৃহত্তর হইলেও ইহার মূল্য পাঁচ টাকার স্থলে মাত্র আড়াই টাকা করা গেল।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, সু-প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক শ্রীষুত প্রফুল্লকুমার সরকার এই পুস্তকের ভাষান্তর কার্যে আমাকে বিশেষ ষাহায্য করিয়াছেন এবং বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রচার বিভাগের শ্রীমান শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, এম. এ., মুদ্রাঙ্কন কার্যের ভার লইয়া আমার শ্রমের যথেষ্ট লাঘব করিয়াছেন।
প্রকাশকের নিবেদন
আত্মচরিতের প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর পনেরো বছর অতীত হইয়াছে। ইতিমধ্যে প্রকাশনার ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। বর্তমান সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যাও বাড়িয়াছে। তাছাড়া বহু দুষ্প্রাপ্য চিত্রও সন্নিবিষ্ট করা হইয়াছে। এই সব নানা কারণে বইখানির মূল্য প্রথম সংস্করণের তুলনায় অনিবার্য কারণে বাড়াইতে বাধ্য হইয়াছি। ব্যায়বাহুল্যের জন্য এইরূপ একখানি মূল্যবান গ্রন্থ অপ্রকাশ্য থাকিবে, তাহা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। বাঙালী পাঠক সমাজ শুধু মূল্য বিচার না করিয়া গ্রন্থ-মূল্য বিচার করিবেন—এ বিশ্বাস আমাদের আছে। আচার্য্যদেবের শিষ্যগণের অন্যতম ডক্টর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ডাইরেক্টর, ইণ্ডিয়ান ইন্ষ্টিটিউট অফ্ টেকনলজি, খড়্গপুর, মহাশয় বইখানির মুখবন্ধ দিয়াছেন, সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
আজ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে কেন্দ্র করিয়াই আমার কথা। আমার স্মৃতিতে আসীন আচার্যদেব বালপ্রকৃতি, মধুরভাষী, শীর্ণদেহ, জ্ঞানতপস্বী, দেশপ্রেমিক এবং ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল।
আজও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই পঁয়তাল্লিশ বৎসর পূর্বেকার কথা যেদিন তাঁহার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে গুরুশিষ্যের সেই পরিচয় দিনের পর দিন ঘনীভূত নিবিড়তর ও সার্থক হইয়াছে। স্নেহমুগ্ধ মনে আজ সেই সকল দিনগুলি স্মরণ করিতেছি।
তাঁহার ক্লাশে যখনই শিক্ষালাভ করিতে যাইতাম অনভব করিতাম চারিদিকে নতুন হাওয়া বহিতেছে। শিশুর মতন খেলা মন লইয়া গুরুদেব আমাদের সকলকেই অতি আপনার জন করিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার কাছে জিজ্ঞাসা করিবার, আলাপ-আলোচনা করিবার, তর্ক করিবার, জানিয়া লইবার অবাধ স্বাধীনতা আমাদের ছিল। তিনি প্রণম্য, তিনি প্রাচীন, অসীম তাঁহার জ্ঞান কিন্তু তিনি আমাদের অতি নিকট বন্ধুসম ছিলেন। তাঁহার মধর হাসি— তাঁহার অকপট ব্যবহার তাঁহার নিরাড়ম্বর বাসগৃহ, তাঁহার শুচিস্নিগ্ধ বেশ, তাঁহার নিরলস, কর্মব্যস্ত জীবন, তাঁহার উৎসাহ যেন জাদুমন্ত্র বলে আমাদের জীবনধারাকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। তাঁহার অপরিমিত স্নেহের প্রভাবে ও সত্যদৃষ্টিতে এবং পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদানে আমরা আমাদের ভাবী জীবনপথের সিগ্ন্যাল দেখিতে পাইয়াছিলাম। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁহার বড় দুঃখ ছিল। তিনি বলিতেন পরীক্ষকের পেন্সিল মার্কার মনদণ্ডে এই শিক্ষার পরিমাপ হয়। তাই কোনও প্রকার গবেষণার রসধারায় আমাদের মানসক্ষেত্র উর্বর হয় না। অন্যান্য দেশের সহিত তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রভেদ লজ্জাজনক।
মানুষের সকল শিক্ষার মূলে আছে সংযমের সাধনা। আচার্যদেব নিয়মকে সম্পূর্ণরূপে জানিয়া এবং মানিয়া চলিতেন। সেই জন্যই তাঁহার চিররুগ্ন দেহ তাঁহার কাজের অন্তরায় হয় নাই। নষ্টস্বাস্থ্য ফিরিয়া পাওয়ার অজুহাতে অলসভাবে দিনাতিপাত তিনি করেন নাই। আত্মশাসনব্রতে নিজেকে কঠোরভাবে নিয়োগ করিয়া বছরের পর বছর এই শীর্ণদেহখানিকে অপরিবর্তিত রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এক অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন কর্মযোগীরূপে তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। জীবনকে ধরাবাঁধা একটা প্রাত্যহিক ছকের মধ্যে আনিয়া তিনি যে কর্মবহুল জীবন যাপন করিয়া গিয়াছেন তাহা অতীব বিস্ময়কর। এক বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক তাঁহার সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন “ভারতের মুক্তি হয়তো প্রফুল্লচন্দ্রের জীবদ্দশায় হবে না—এই ক্ষীণকায় মানুষটির জীবন দেশের কাজে নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু অমর হয়ে থাকবে তাঁর ত্যাগের দান।”
অতি তরুণ বয়সেই তিনি উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে প্রকৃতির সহিত সত্য পরিচয় না থাকিলে জীবনে অশিক্ষার তমসা দূরীভূত হয় না। তিনি বুঝিয়াছিলেন আমাদের অধিকাংশ পরাভবের মূলে আছে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মশক্তির অকিঞ্চিৎকরতা। তাই তিনি কেবলমাত্র সাহিত্য ও ইতিহাস সাধনায় অনুরক্ত না থাকিয়া বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মশক্তির প্রভাবে দেশের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা দূর করিতে এবং সমস্ত দেশব্যাপী তন্দ্রাচ্ছন্ন যুব শক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার সময় তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সমিতিতে প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাইতেন। এই সকল প্রবন্ধে আচার্য দেবের মৌলিকত্ব, অসাধারণ মননশক্তি ও মনীষার ব্যঞ্জনা থাকিত। মারকিউরিয়াস নাইট্রাইট বা পারদ, সংক্রান্ত একাদশটি মিশ্রধাতুর আবিষ্কার করিয়া তিনি রাসায়নিক জগতে বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিলেন। রাসায়নিক জ্ঞানভাণ্ডারে তাঁহার দান বিশ্ববিশ্রুত। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার তাঁহার তুলনাহীন সৃষ্টি। অগণিত শিক্ষার্থীকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়া উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এই গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার এই অভিযানে আচার্যদেব ছিলেন সর্বাধিনায়ক। কিন্তু তিনি প্রায়ই বলিতেন “সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্তু পুত্র এবং শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।” এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে সেই আসনে অভিনন্দন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন—কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি নিজেকে দিয়েছেন—যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে। বস্তুজগতে প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উদ্ঘাটিত করে বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তার চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন। কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গৃহাস্থিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি।” আচার্যদেব আধুনিক ভারতীয় রসায়নাগারের স্রষ্টা। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও সায়েন্স কলেজ রসায়নাগারে তিনি মৌনব্রতাবলম্বী, অধ্যবসায়শীল সুদক্ষ বৈজ্ঞানিক। প্রোফেসার মিলভ্যান লেভীর মনে এই রসায়নাগার এই লীলাময় শিক্ষাঘর যেখান হইতে নবভারতের তরুণ রাসায়নিকেরা রূপ লইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। আচার্যদেবের গবেষণা ভারতকে বিশ্বের বিজ্ঞানক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দিয়াছে।
তখন দেশের দারুণ দুর্দিন। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকারে দেশ পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আচার্যদেব দেখিতে পাইলেন বাংলার এই যুবক সম্প্রদায় অভিমানী, সংগ্রাম বিমুখ, পরিশ্রমকাতর এবং পরমুখাপেক্ষী। তাহাদের জীবনের এই অসহায় অবস্থা প্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্রের চিত্তকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল। বাঙ্গালীর প্রধান অবলম্বন চাকুরী। কিন্তু চাকুরী কোথায়? বাঙ্গালী যুবককে চাকুরীর ভিখারী না হইয়া কর্মঠ ও স্বাবলম্বী হইবার আহ্বান তিনি জানাইলেন। সকল প্রকার বিলাস বর্জন করিয়া সংযম ও অধ্যবসায়ের বলে তাহারা নব নব জ্ঞানের সম্পদ জয় করিয়া লইতে পারিবে। আচার্যদেব তাঁহার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী, প্রেম এবং আত্মবিশ্বাস লইয়া সহস্র জীবনের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হইলেন। তাঁহার চিররুগ্ন দেহ এই কাজের গতিকে ব্যাহত করিতে পারে নাই। পথে পিছাইয়া পড়িবার মত ক্লান্তি তাঁহার ছিল না।
অতি সামান্য মূলধন সম্বল করিয়া তিনি এক ঔষধ তৈয়ারীর কারখানা প্রতিষ্ঠিত করিলেন। বাঙ্গালী যুবকগণকে ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী হইবার জন্য নানা ব্যবসায় ও নব নব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পথ করিয়া দিলেন। দারিদ্র্যের পাশবশক্তির বিরুদ্ধে এই নূতন ধরণের যুদ্ধের আহ্বানে বাংলার যুবকেরা আন্তরিকভাবে সাড়া দিল এবং কর্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সংপ্রতিষ্ঠিত করিতে অগ্রসর হইয়া আসিল। আচার্যদেবের চেষ্টায় বাংলার শিল্পক্ষেত্রে নূতন করিয়া প্রাণ সঞ্চার হইল। এই শীর্ণকায় মানুষটি কারখানার উন্নতিকল্পে সমস্ত শক্তি ও ইচ্ছা কেন্দ্রীভূত করিয়াছিলেন। এই কারখানাটি পরে একটি লিমিটেড কোম্পানীতে পরিণত করেন। ইহা বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম। এই কারখানা হইতে প্রতিদান যাহা পাইয়াছেন তাহা হয় কারখানার শ্রমিকদের জন্য ব্যয়িত হইত নয় অন্য এক তহবিলে জমা হইত, যাহা নিঃশেষে আর্তের সেবায় লাগিয়া যাইত।
বাংলার সমাজ জীবন ও রাজনীতি ক্ষেত্র হইতেও তিনি দূরে সরিয়া থাকেন নাই। সমাজের অনাচার, অত্যাচার, দুর্বলতা, কাপুরুষতা তাঁহাকে পীড়িত করিয়া তুলিত। তিনি তাঁহার গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে, বুদ্ধি দিয়া, জ্ঞান দিয়া, সহযোগিতা প্রবর্তক হৃদ্যতার মধ্য দিয়া মত্যুচ্ছায়াচ্ছন্ন বাংলার সমাজ জীবনে এক নূতন চেতনা আনিয়া দিলেন। যুবককাল হইতে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত তিনি বাংলার অতীত ও বর্তমান সমাজচেতনাকে তাঁহার রচনার মধ্যে পুঞ্জীভূত করিয়া জাতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়া তুলিয়াছেন। এই সাহিত্য তাঁহার দরদী মনের দীর্ঘ তথ্যপূর্ণ ইতিহাস। তাঁহার স্বদেশ প্রেমের আর একটি নিদর্শন ভারতীয় রাসায়নিক শাস্ত্রের ইতিহাস আলোচনা করা। তাঁহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁহার রচিত এই বিস্মৃত অতীতের গৌরবময় সংস্কৃতির কাহিনী দেশের ভবিষ্যত চিত্তকে সঞ্জীবনীর রসধারায় অভিষিক্ত করিবে। পরাধীনতার জ্বালা আচার্য প্রফল্লচন্দ্রের মনকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। স্বরাজের স্বপ্ন তিনি দেখিতেন—স্বরাজ পাইবার জন্য তিনি পাগল হইয়া উঠিলেন। বাংলার যুব শক্তি দেশকে মুক্ত করিবার জন্য যে বৈপ্লবিক কর্ম প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল তাহাতে আচার্য রায়ের সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণা কম নহে। আচার্য রায়ের আবাসস্থল সায়ান্স কলেজ হইতে গোপনে শৈলেন ঘোষের আমেরিকা যাত্রা ইহার একটি দৃষ্টান্ত।
উপনিষদে কথিত আছে যিনি এক তিনি বলেন, “আমি বহু হইব।” সৃষ্টির মূলেই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রও নিজের চিত্তকে বহুমানবের দুঃখের মধ্যে নিমজ্জিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। দেখিয়াছি বিজ্ঞানের মায়া কাটাইয়া তিনি রাজপথে বাহির হইয়াছেন ভিক্ষার ঝুলি লইয়া। দুর্যোগে, সঙ্কটে, ভূমিকম্পে, জলপ্লাবনে আর্তের পরিত্রাণের জন্য তাঁহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে টানিয়া লইয়াছিলেন এই জনসেবার কাজে। ধনীরা দিয়াছে প্রচুর অর্থ। সহস্র সহস্র গৃহ হইতে আসিয়াছে মুষ্টিভিক্ষা ও রাশি রাশি বস্ত্র। দলে দলে যুবকেরা স্বেচ্ছাসেবকরূপে তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে খুলনা, দামোদর, উত্তর বঙ্গ ও বিহারে অন্নবস্ত্র ও ঔষধ বিতরণের জন্য। আচার্যদেবের আগমন দুর্গতদের দিয়াছে শান্তির প্রলেপন, দিয়াছে এ সুন্দর ভুবনে বাঁচিয়া থাকিবার আশা।
স্বার্থ বলিতে তাঁহার অবচেতন মনেও কিছু ছিল না। দেশের দরিদ্রনারায়ণের পরিত্রাণের জন্য তিনি আপনাকে বিলাইয়া দিয়াছিলেন। বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া লইয়া এই সর্বত্যাগী বৃদ্ধ, কর্মবীর মহাপুরুষ জীবনসন্ধায় কালের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করিয়া গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে ঘুরিয়া দেশবাসীকে আহ্বান করিয়াছেন দেশসেবায় জনহিতকর কার্যে নিজেদের উৎসর্গীকৃত করিতে। দরিদ্র, সূচতা, অস্পৃশ্যতা ও পরাধীনতার অভিশাপে অসাড় হইয়াছিল দেশের লক্ষ লক্ষ মন। তিনি সেই অসাড় মনকে জাগাইয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছিলেন—সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছিলেন তাঁহার অভিনব চিন্তাশক্তির ধারায়। তাঁহার অতিপ্রাণশক্তির প্রাচুর্য দেশের পঙ্গু কর্মক্ষেত্রগুলি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল।
মর্তের বন্ধনমুক্ত আচার্যদেবের জীবনগীতা হইতে বাংলার যুবকেরা যুগে যুগে উদ্যমশীল জীবনের আদর্শ গ্রহণ করিয়া অনুপ্রাণিত হইতে পারিবে এবং বাংলার শিল্পক্ষেত্রগুলি নিত্য নবতর প্রেরণা লাভ করিতে পারিবে। আচার্যদেবের ত্যাগের অনির্বাণ দীপ্তিতে আমাদের এই মাটীর মা এই বাংলাদেশ ভাস্কর হইয়া আছে।[১]
ইণ্ডিয়ান ইনষ্টিটিউট
|
|
শ্রীজ্ঞানচন্দ্র ঘোষ
|
- ↑ ‘লোকসেবক’ হইতে মুদ্রিত
সূচীপত্র
প্রথম খণ্ড
আত্মকথা
পরিচ্ছেদ |
পৃষ্ঠা |
॥ |
জন্ম—পৈতৃক ভদ্রাসন—বংশ-পরিচয়—বাল্যজীবন |
১ |
॥ |
‘পলাতক’ জমিদার—পরিত্যক্ত গ্রাম—জলাভাব—গ্রামগুলি কলেরা ও ম্যালেরিয়ার জন্মস্থান |
১১ |
॥ |
গ্রামে শিক্ষালাভ—কলিকাতায় গমন—কলিকাতা—অতীত ও বর্তমান |
১৫ |
॥ |
কলিকাতায় শিক্ষালাভ |
২১ |
॥ |
ইউরোপ যাত্রা—বিলাতে ছাত্রজীবন—ভারত বিষয়ক প্রবন্ধ—‘হাইল্যাণ্ডে’ ভ্রমণ |
৩৬ |
॥ |
গৃহে প্রত্যাগমন—প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত |
৫৩ |
॥ |
বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস—তাহার উৎপত্তি |
৬৩ |
॥ |
নূতন কেমিক্যাল লেবরেটরি—মার্কিউরাস নাইট্রাইট—হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসতি |
৭৫ |
॥ |
গোখেল ও গান্ধীর স্মৃতি |
৮২ |
॥ |
দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা—বঙ্গভঙ্গ—বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ |
৮৬ |
॥ |
বাংলায় জ্ঞানরাজ্যে নব জাগরণ |
৯৪ |
॥ |
নবযুগের আবির্ভাব—বাংলাদেশে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা—ভারতবাসীদিগকে উচ্চতর শিক্ষাবিভাগ হইতে বহিষ্করণ |
১০২ |
॥ |
মৌলিক গবেষণা—গবেষণা বৃত্তি—ভারতীয় রসায়নিক গোষ্ঠী |
১০৭ |
ভারতীয় রসায়ন গোষ্ঠী—প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে অবসর গ্রহণ—অধ্যাপক ওয়াটসন এবং তাঁহার ছাত্রদের কার্যাবলী—গবেষণা বিভাগের ছাত্র—ভারতীয় রসায়ন সমিতি |
১২১ |
॥ |
বিজ্ঞান কলেজ |
১২৯ |
॥ |
সময়ের সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার |
১৩৭ |
॥ |
রাজনীতি-সংসৃষ্ট কার্যকলাপ |
১৪৯ |
বাংলায় বন্যা—খুলনা দূর্ভিক্ষ—উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা—অল্পদিন পূর্বেকার বন্যা—ভারতে অনুসৃত শাসনপ্রণালীর কিঞ্চিৎ পরিচয়—শ্বেতজাতির দায়িত্বের বোঝা |
১৫৪ |
দ্বিতীয় খণ্ড
শিক্ষা, শিল্পবাণিজ্য, অর্থনীতি ও সমাজ সম্বন্ধীয় কথা
পরিচ্ছেদ |
পৃষ্ঠা |
॥ |
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা |
১৭৩ |
শিল্পবিদ্যালয়ের পর্বে শিল্পের অস্তিত্ব—শিল্পসৃষ্টির পূর্বে শিল্পবিদ্যালয়—ভ্রান্ত ধারণা |
২১২ |
॥ |
দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান |
২২৬ |
॥ |
চরকার বার্তা—কাটুনির বিলাপ |
২৪২ |
॥ |
বর্তমান সভ্যতা—ধনতন্ত্রবাদ—যান্ত্রিকতা এবং বেকার সমস্যা |
২৫৫ |
১৮৬০ ও তৎপরবর্তীকালে বাংলার গ্রামের আর্থিক অবস্থা |
২৬৬ |
বাংলার তিনটি জেলার আর্থিক অবস্থা |
২৭৭ |
কামধেনু বঙ্গদেশ—রাজনৈতিক পরাধীনতার জন্য বাংলার ধন শোষণ |
২৮৭ |
বাংলা ভারতের কামধেনু—বাঙালীদের অক্ষমতা এবং অবাঙালী কর্তৃক বাংলার আর্থিক বিজয় |
২৯৬ |
॥ |
জাতিভেদ—হিন্দ, সমাজের উপর তাহার অনিষ্টকর প্রভাব—একদিকে শিক্ষিত ও মার্জিতরুচি সম্প্রদায়, অন্যদিকে কৃষক, শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সামাজিক প্রভেদ ও অন্তরায়—পারিবারিক কলহের কারণ |
৩৩৮ |
পরিশিষ্ট: |
(১) যে সব মানষকে আমি দেখিয়াছি |
৩৬০ |
(২) উপসংহার |
৩৬২ |
(৩) নির্ঘণ্ট |
৩৬৯ |
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।