বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ

নূতন কেমিক্যাল লেবরেটরি—মার্কিউরাস নাইট্রাইট—

হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস

 পরাতন একতলা গৃহে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগ অবস্থিত ছিল। কিন্তু এখন কাজ এত বাড়িয়া গিয়াছিল যে, ঐ গৃহে আর স্থান সঙ্কুলান হইতেছিল না। এফ, এ, পরীক্ষায় রসায়ন বিদ্যায় ব্যবহারিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল না বটে; কিন্তু বি, এ, ও এম, এ, পরীক্ষায় রসায়ন শাস্ত্রে ছাত্রের সংখ্যা প্রতি বৎসর বৃদ্ধি পাইতেছিল। লেবরেটরিতে অনিষ্টকর গ্যাস নিষ্কাষণের কোন ব্যবস্থা ছিল না,—বায়ু, চলাচলেরও ভাল ব্যবস্থা ছিল না। বস্তুতঃ যদিও ব্যবহারিক ক্লাস পূর্ণোদ্যমে চলিতেছিল, তথাপি গৃহের বায়ু বিশেষতঃ বর্ষাকালে, ধূম ও গ্যাসে আচ্ছন্ন হইয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ঘোর অনিষ্টকর হইয়া উঠিত।

 একদিন আমি প্রিন্সিপ্যাল টনীকে লেবরেটরিতে ডাকিয়া আনিলাম এবং চারিদিকে ঘুরিয়া গৃহের বায়ুতে কয়েক মিনিট নিঃশ্বাস লইতে অনুরোধ করিলাম। টনীর ফুসফুস স্বভাবতই একট, দুর্বল ছিল। তিনি দুই মিনিট লেবরেটরিতে থাকিয়া উত্তেজিতভাবে বাহির হইয়া গেলেন এবং শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টরকে সমস্ত অবস্থা বর্ণনা করিয়া একখানি কড়া চিঠি লিখিলেন। তিনি ইহাও লিখিলেন যে, সহরের হেল্‌থ অফিসার যদি একথা জানিতে পারেন, তবে কলেজের কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের স্বাস্থ্য বিপন্ন করিবার অপরাধে অভিযুক্ত করিলেও অন্যায় কিছু করিবেন না।

 পেড্‌লার সাহেবও বুঝিতে পারিলেন যে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামসহ একটি নূতন লেবরেটরি নির্মাণ করা একান্ত প্রয়োজন। তিনি ক্রফ্‌টকে সব কথা বুঝাইয়া স্বমতে আনয়ন করিলেন এবং বাংলা গবর্ণমেণ্টের নিকটও নূতন লেবরেটরির জন্য লিখিলেন। ১৮৯২ সালের জানুয়ারী মাসে একদিন ক্রফট ও স্যার চার্লস ইলিয়ট রসায়ন বিভাগ দেখিতে আসিলেন এবং নূতন লেবরেটরি সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করিলেন। আমরা শীঘ্রই জানিতে পারিলাম যে গবর্ণমেণ্ট নূতন লেবরেটরির প্ল্যান মঞ্জুর করিয়াছেন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন গবেষণাগারের একখানি বর্ণনাপত্র আমার নিকট ছিল, তাহাতে ঐ সম্পর্কে বহু নক্‌সা ও চিত্রাদি ছিল। আমাদের নূতন গবেষণাগারের প্ল্যানে উহা হইতে কোন কোন জিনিস গ্রহণ করা হইয়াছিল। পেড্‌লার জার্মানির কয়েকটি লেবরেটরির প্ল্যানও সংগ্রহ করিয়াছিলেন। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী বর্তমান গবেষণাগারের প্ল্যান তৈয়ারীর কাজে পেড্‌লারকে প্রভূত সাহায্য করিয়াছিলেন।

 ১৮৯৪ সালে আমরা নূতন বিজ্ঞানাগারে প্রবেশ করিলাম। শীঘ্রই ভারতের বিভিন্ন স্থান হইতে এই নূতন বিজ্ঞানাগার দেখিবার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ আসিতে লাগিলেন এবং এই ১৮৯৪ সাল হইতেই আমার রাসায়নিক গবেষণাকার্যে নূতন শক্তি ও উৎসাহ সঞ্চারিত হইল। আমি কতকগুলি দুর্লভ ভারতীয় ধাতু বিশ্লেষণ করিতেছিলাম, আশা ছিল যে যদি দুই একটি নূতন পদার্থ আবিষ্কার করিতে পারি। মিঃ (এখন স্যার) টমাস হল্যাণ্ড “জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া” বিভাগের একজন সহকারী এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূতত্ত্বের লেকচারার ছিলেন। তিনি অনগ্রহপূর্বক কতকগুলি ধাতুর নমুনা আমাকে দিতে চাহিলেন। আমি এই বিষয়ে নূতন গবেষণা আরম্ভ করিলাম। Crookes’ Select Methods in Chemical Analysis সেই সময়ে প্রামান্য গ্রন্থ ছিল এবং তাহারই অনুসরণ করিয়া আমি গবেষণা করিতে লাগিলাম। আমি গবেষণা কার্যে কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছি, এমন সময় আমার রাসায়নিক জীবনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটিল।

 মার্কিউরাস্ নাইট্রাইটের আবিষ্কার দ্বারা আমার জীবনে এক নূতন অধ্যায়ের সূত্রপাত হইল। যেরূপ অবস্থায় এই আবিষ্কার হইল, তাহা এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রথম বিবৃতির ভূমিকা হইতে উদ্ধৃত করিতেছি:—

 “সম্প্রতি পারদের উপর অ্যাসিডের ক্রিয়ার দ্বারা মার্কিউরাস নাইট্রেট প্রস্তুত করিতে গিয়া, আমি নীচে এক প্রকার পীতবর্ণের দানা পড়িতে দেখিয়া কিয়ৎ পরিমাণে বিস্মিত হইলাম। প্রথম দৃষ্টিতে ইহা কোন ‘বেসিক সল্ট’ বলিয়া মনে হইল। কিন্তু এরপ প্রক্রিয়া দ্বারা ঐ শ্রেণীর ‘সল্টের’ উৎপত্তি সাধারণ অভিজ্ঞতার বিপরীত। যাহা হউক, প্রাথমিক পরীক্ষা দ্বারা ইহা মার্কিউরাস সল্ট এবং নাইট্রাইট উভয়ই প্রমাণিত হইল। সুতরাং এই নূতন মিশ্র পদার্থ গবেষণার যোগ্য বিষয় মনে হইতেছে।”

 মার্কিউরাস নাইট্রাইট ও তাহার আনুষঙ্গিক বহুসংখ্যক পদার্থ এবং সাধারণ ভাবে মার্কিউরাস নাইট্রাইট সম্বন্ধে গবেষণার প্রকৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন এখানে নাই, কেন না তৎসম্বন্ধে শতাধিক নিবন্ধ রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধীয় সাময়িক পত্র সমূহে প্রকাশিত হইয়াছে। একটির পর একটি নূতন মিশ্র পদার্থ আবিষ্কৃত হইতে লাগিল, আর আমি অসীম উৎসাহে তাহা লইয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। নব্য রসায়নী বিদ্যার অন্যতম প্রবর্তক অমরকীর্তি শীলের ভাষায় আমিও বলিতে পারিতাম—“গবেষণা হইতে যে আনন্দ হয়, তাহার তুলনা নাই, ইহা হৃদয়কে উৎফুল্ল করে।” এই নবোন্মুক্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বিচরণ করা এবং তাহার অজ্ঞাত স্থান সমূহ আবিষ্কার করা, ইহাতে প্রতি মুহূর্তেই মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হইত। শিকারীরা জানেন যে শিকারকে হাতের মধ্যে পাওয়ার চেয়ে শিকারের অনুসরণ করাতেই অধিক আনন্দ। রস্কো, ডাইভার্স, বার্থেলো, ভিক্টর মেয়ার, ফলহার্ড এবং অন্যান্য বিখ্যাত রাসায়নিকদের নিকট হইতে প্রাপ্ত সম্বর্ধনাজ্ঞাপক পত্রাবলী আমার মনে যে কেবল উৎসাহের সঞ্চার করিল তাহা নহে, আমার কর্মেও অধিকতর প্রেরণা দান করিল।

 এই সময়ে অধ্যয়ন ও লেবরেটরিতে গবেষণা—এই দুইভাগে আমি আমার সময়কে বণ্টন করিয়া লইলাম। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জন্যও কতকটা সময় নির্দিষ্ট থাকিল। অনিদ্রা রোগের জন্য, আমাকে অধ্যয়ন স্পৃহা সংযত করিতে হইত। গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে সন্ধ্যার পর আলোতে আমি কোন পড়ানো বা মানসিক পরিশ্রমের কার্য করিতে পারি নাই। এইরূপ কোন চেষ্টা করিলেই তাহার ফলে আমাকে অনিদ্রায় কাটাইতে হইত। “সকাল সকাল শয়ন করা ও সকাল সকাল ওঠা” এই নিয়ম আমি চিরদিন পালন করিয়াছি এবং আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখিয়াছি যে, সকাল বেলা একঘণ্টা অধ্যয়ন সন্ধ্যার পর বা রাত্রিকালে দুইঘণ্টা বা ততোধিক সময় অধ্যয়নের তুল্য; বিশেষতঃ যাহাকে দিনের অধিকাংশ সময় রুদ্ধবায়ু লেবরেটরিতে কাটাইতে হয় স্বাস্থ্যরক্ষার্থ তাহার পক্ষে প্রত্যহ অন্ততঃ দুইঘণ্টাকাল খোলাবাতাসে থাকা উচিত। শীত প্রধান দেশে অবস্থা বিশেষে এই নিয়মের অবশ্য পরিবর্তন করিতে হইবে। এডিনবারা বা লণ্ডনে শীতকালে সন্ধ্যার সময় দুই ঘণ্টাকাল লঘু সাহিত্য পাঠ করা আমার পক্ষে কিছুই ক্ষতিকর হইত না।

 এই সময়ে আমি আমার প্রিয় বিষয় রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস এবং প্রসিদ্ধ রসায়নাচার্যদের জীবনী সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছিলাম। কপের “ইতিহাস” দূরূহ গ্রন্থ, ইহার কঠিন সমাসযুক্ত লম্বা লম্বা পদগুলি পাঠ করা সুখকর নহে, কিন্তু বিষয়টি এমনই চিত্তাকর্ষক যে আমি ঐ গ্রন্থ নিয়মিত ভাবে পড়িতাম। আমি আমার মূল্যবান সকাল বেলা এই গ্রন্থ পাঠে ব্যয় করিতাম। আমি বেশ জানিতাম, আমাদের কবিরাজগণ বহু ধাতব ঔষধ ব্যবহার করিতেন; উদয়চাঁদ দত্তের Materia Medica of the Hindus নামক গ্রন্থে ইহার বিবরণ আছে। এই গ্রন্থে যে সমস্ত মূল সংস্কৃত গ্রন্থের নাম করা হইয়াছে, আমি কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া তাহার কয়েকখানি পড়িলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজ়ের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত Berthelot’s L’Alchimistes Grecs নামক গ্রন্থও পড়িলাম। তাহাতে আমার কৌতূহল আরও বর্ধিত হইল। এই সময়ে উক্ত প্রসিদ্ধ ফরাসী রাসায়নিক বার্থেলোর সঙ্গেই আমার পত্র ব্যবহার হইল। আমি তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম, তিনি বোধ হয় জানেন না যে, প্রাচীন ভারতবর্ষেও ‘আলকেমী’ শাস্ত্রের বিশেষ চর্চা হইত এবং এ বিষয়ে সংস্কৃতে বহু গ্রন্থ আছে। তিনি আমাকে যে উত্তর দেন, তাহা তাঁহারই যোগ্য। আমি নিম্নে ঐ পত্রের অংশ বিশেষের ইংরাজী অনুবাদ দিলাম।[] বড়ই দঃখের বিষয় এই সময়ে বহু প্রসিদ্ধ রসায়নবিদের নিকট হইতে আমি যে সব পত্র পাইয়াছিলাম, তাহা রক্ষা করি নাই। বার্থেলোর পত্রখানি ঘটনাক্রমে নষ্ট হয় নাই। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার বিশ্রামগৃহে জঞ্জালাধারে কতকগুলি কাগজ আমার চোখে পড়ে। উহারই মধ্যে বার্থেলোর পত্র ছিল।

 এই পত্র আমার মনের উপর অসীম প্রভাব বিস্তার করিল। এই একজন শীর্ষস্থানীয় রসায়নবিৎ জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হইয়াছেন, অথচ যৌবনের উৎসাহে রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি নূতন অধ্যায় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের জন্য আগ্রহান্বিত, আর আমি যুবক হইয়াও যথোচিত উৎসাহ সহকারে কাজে অগ্রসর হইতে পারিতেছি না! আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ বহিয়া গেল এবং কার্যে নতন উৎসাহ আসিল।

 বার্থেলোর অনুরোধে আমি ‘রসেন্দ্রসারসংগ্রহের’ ভূমিকার উপর নির্ভর করিয়া একটি প্রবন্ধ লিখিলাম এবং তাঁহার নিকট উহা পাঠাইয়া দিলাম। আরও বেশি আলোচনার ফলে আমি দেখিতে পাইলাম যে হিন্দু রসায়ন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ‘রসেন্দ্রসারসংগ্রহ’ খুব বেশি মূল্যবান নহে। বার্থেলো আমার প্রবন্ধ অভিনিবেশ সহকারে পড়িলেন এবং তাহা অবলম্বন করিয়া Journal des Savants পত্রে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখিলেন। তিনি ঐ মুদ্রিত প্রবন্ধের এক কপি এবং সিরিয়া, আরব ও মধ্য যুগের রসায়ন সম্বন্ধে তিন খণ্ডে সমাপ্ত তাঁহার বিরাট গ্রন্থও একখানি পাঠাইলেন। আমি সাগ্রহে ঐ গ্রন্থ পড়িলাম এবং সঙ্কল্প করিলাম যে ঐ আদর্শে হিন্দু রসায়নের ইতিহাস আমাকে লিখিতেই হইবে। আরও একটি কারণে আমার মনে উৎসাহ বর্দ্ধিত হইল। একদিন সন্ধ্যাকালে এসিয়াটিক সোসাইটির সভায় যোগ দিয়াছিলাম। সভাগৃহে টেবিলের উপর একখানি Journal des Savants দেখিতে পাইলাম এবং তাহাতে বার্থেলোর লিখিত একটি প্রবন্ধের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল।

 পড়িয়া রোমাঞ্চিতকলেবর হইলাম। আমি একজন রসায়নশাস্ত্রের নবীন অধ্যাপক। সহকারী অধ্যাপক বলিলেই ঠিক হয়। আমার কোন খ্যাতিও নাই। অপর পক্ষে বার্থেলো একজন শীর্ষস্থানীয় রাসায়নিক এবং রসায়ন শাস্ত্রের বিখ্যাত ইতিহাসকার। অথচ তিনি আমাকে Savant বা মনীষী বলিয়া উল্লেখ করিতেছেন। আমার মনে এই ধারণা হইল যে কোন উচ্চতর সৃষ্টি কার্যের জন্য আমার জীবন বিধাতা কর্তৃক নির্দিষ্ট হইয়াছে।[] আমার কার্যের বিপুলতার কথা ভাবিয়া আমি বিচলিত হইলাম না। রসায়ন বিষয়ে হস্তলিখিত পুঁথির সন্ধানে আমি প্রবৃত্ত হইলাম। Aufrecht’s Catalogus catalogorum, ভাণ্ডারকর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এবং বার্ণেলের সংস্কৃত পুঁথির বিবরণ পাঠ করিলাম। ভারতবর্ষের বড় বড় লাইব্রেরি সমূহ এবং লণ্ডনস্থ ইণ্ডিয়া আফিসের লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের নিকটও পুঁথির খোঁজ করিলাম। পণ্ডিত নবকান্ত কবিভূষণ প্রত্যহ ৪।৫ ঘণ্টা করিয়া এই কার্যে আমাকে সাহায্য করিতেন। তাঁহাকে আমি কাশীতে সংস্কৃত পুঁথির সন্ধানে পাঠাইলাম। ভারতবর্ষে সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহে যাঁহাদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁহারাই জানেন উই এবং অন্যান্য কীট উহার উপর কি অত্যাচার করে। বাঙ্গলার আর্দ্র আবহাওয়ায় পুঁথি বেশি দিন টিকে না। এক একখানি তন্ত্রের ৪। ৫ খানি করিয়া পুঁথি সংগ্রহ করিতে হইয়াছিল। কেন না ভূমিকা অথবা উপসংহার পোকায় কাটিয়াছিল। ইহা ছাড়া বিভিন্ন পুঁথির মধ্যে পাঠের অনৈক্য আছে। পাঠককে ব্যাপারটা বুঝাইবার জন্য Bibliotheca Indica তে “রসার্ণব” তন্ত্রের উল্লেখ করা যাইতে পারে।[] হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস পুস্তকের প্রথম ভাগের ভূমিকা হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত কয়েক ছত্র গ্রন্থ প্রণয়নে আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিবে—

 “স্যর্ উইলিয়ম জোন্সের সময় হইতে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রত্যেক বিভাগেই বহু ইউরোপীয় ও ভারতীয় সুধী গবেষণা করিয়াছেন। তাঁহাদের পরিশ্রমের ফলে আমরা বহু তথ্যের সন্ধান পাইয়াছি এবং তাহা হইতে সাহিত্য, দর্শন, জ্যোতিষ, পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দুদের জ্ঞানের কিছু পরিচয় আমরা পাইয়াছি। চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়েও কিছু কিছু আলোচনা হইয়াছে। কিন্তু একটি বিষয় এপর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হইয়াছে। বস্তুতঃ এরূপ মনে করা যাইতে পারে যে, জটিলতার জন্যই এতাবৎ এই ক্ষেত্রে কেহ অগ্রসর হন নাই।”

 হিন্দু রসায়নের ইতিহাস পাঠ করিলেই যে কেহ বুঝিতে পারিবেন, কার্যটি কিরূপ বিরাট এবং দুরূহ। কিন্তু স্বেচ্ছায় আমি এই দায়িত্ব ভার গ্রহণ করিয়াছিলাম। এবং কাজে যখন আনন্দ পাওয়া যায়, তখন তাহাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না, বরং উৎসাহ বর্দ্ধিত হয়। আমার পক্ষে বড়ই আনন্দের বিষয়, প্রথম ভাগ বাহির হইবামাত্র ভারতে ও বিদেশে সর্বত্র এই গ্রন্থ অশেষ সমাদর লাভ করিল। ভারতীয় সংবাদপত্রের ত কথাই নাই,—ইংলিশম্যান, পাইওনিয়ার, টাইমস্ অব ইণ্ডিয়া প্রভৃতিও এই গ্রন্থের প্রশংসাপূর্ণ দীর্ঘ সমালোচনা করিলেন। একখানি সংবাদপত্রে লিখিত হইয়াছিল যে এই গ্রন্থ monumental labour of love অর্থাৎ হৃদয়ের প্রীতি হইতে উৎসারিত অক্লান্ত সাধনার ফল। Knowledge, Nature এবং American Chemical Journal প্রভৃতিতেও এই গ্রন্থের প্রশংসাপূর্ণ সমালোচনা বাহির হইয়াছিল। বার্থেলো স্বয়ং Journal des Savants পত্রে ১৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী দীর্ঘ সমালোচনা করিয়াছিলেন (জানুয়ারী, ১৯০৩)।

 ১৯০৩ সালের মার্চ মাসের Knowledge পত্রিকায় লিখিত হইয়াছিল—“অধ্যাপক রায়ের গ্রন্থ বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে মহৎ দান এবং বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাঠকগণ হিন্দু রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে এই জ্ঞাতব্য তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ পাঠে নিশ্চয়ই সুখী হইবেন।”

 ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহার সম্পাদিত Calcutta Journal of Medicine, (১৯০২, অক্টোবর) পত্রে লিখিয়াছিলেন—

 “সাময়িক পত্রের চিরাচরিত নিয়ম এই যে, যে সব গ্রন্থ সমালোচনার্থ সম্পাদকদের নিকট প্রেরিত হয়, কেবল সেই সব গ্রন্থেরই সমালোচনা করা হয়। বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা ঐ নিয়মের ব্যতিক্রম করিয়াছি। কেন না এ ক্ষেত্রে আমাদের স্বদেশপ্রেম সম্পাদকীয় মর্যাদার বাধা মানে নাই। এই শ্রেণীর গ্রন্থের সমালোচনা করা আমরা কর্তব্য মনে করি। বর্তমানকালে যে বিজ্ঞানের যথার্থ উন্নতি হইয়াছে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে সেই বিজ্ঞানের কিরূপে অবস্থা ছিল, তৎসম্বন্ধে ঐ বিজ্ঞানে পারদর্শী কোন পণ্ডিত কর্তৃক ঐতিহাসিক গবেষণা বস্তুতঃই আমাদের দেশে দুর্লভ। সূতরাং এরূপ গ্রন্থের কথা উল্লেখ না করা আমাদের পক্ষে কর্তব্যচ্যুতি হইত।

 “ভারতবাসীদিগকে এই অপবাদ দেওয়া হয় যে, তাহারা অত্যুক্তিপ্রিয়। তাহাদের ঐতিহাসিক বোধ নাই। সতরাং এই বহুবিনিন্দিত ভারতবাসীরা যে ঐতিহাসিক গবেষণা আরম্ভ করিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সভ্যতা সম্বন্ধে সত্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছে, ইহা এ যুগের একটি বিশেষ লক্ষণ। এইরূপে সত্যানুসন্ধান ও হিসাবনিকাশ দ্বারাই জাতি নিজের অভাব, ত্রুটী, অক্ষমতা প্রভৃতি বুঝিতে পারে এবং তাহার সংস্কারের পন্থাও নির্দ্ধারিত হয়, এবং পার্থিব সমস্ত বিষয়ে জাতির ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্য, উন্নতি ও অবনতির হিসাবনিকাশ ইতিহাসই করে। এই কারণে আমরা কেবল কর্তব্যবোধে নয়, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডি, এস সি, কৃত ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস, প্রথম ভাগ’ গ্রন্থের উল্লেখ করিতেছি। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া এই গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহের জন্য তিনি অক্লান্ত ভাবে পরিশ্রম করিতেছিলেন।”

 ইংরাজ রাসায়নিকেরা সাধারণতঃ রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসের প্রতি উদাসীন এবং টমসনের পর আর কেহ ইংরাজী ভাষায় রসায়ন শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য কোন ইতিহাস লিখেন নাই। তাঁহারা অন্য ভাষা হইতে লেডেনবার্গ বা মায়ারের গ্রন্থ অনুবাদ করিয়াই সন্তুষ্ট আছেন। তবে আমার গ্রন্থের জন্য বিলাতে বরাবরই কিছু চাহিদা ছিল,—ইহাতে মনে হয়, অন্ততপক্ষে কতকগুলি লোক এই বিষয় জানিবার জন্য আগ্রহান্বিত। ১৯১২ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে আমাকে সম্মানসূচক ডি, এস-সি, উপাধি দেওয়ার সময় ভাইসচ্যান্সেলার বলেন,—

 “তিনি (আচার্য রায়) গবেষণা কার্যে সুদক্ষ এবং ইংরাজী ও জার্মান বৈজ্ঞানিক পত্রসমূহে তাঁহার বহু মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার প্রধান কীর্তি— ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’। কেবল বিজ্ঞানের দিক দিয়া নয়, ভাষাজ্ঞানের দিক দিয়াও এই গ্রন্থে তাঁহার প্রভূত ক্ষমতার পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে। এবং এই গ্রন্থ সম্বন্ধে একথা বলা যাইতে পারে যে ইহার সিদ্ধান্তগলিতে কোন অস্পষ্টতা নাই এবং শেষ কথা বলা হইয়াছে।”

 সুখের বিষয়, গ্রন্থ প্রকাশের পর হইতে এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক পত্রাদিতে এই গ্রন্থ প্রশংল্লার সহিত উল্লিখিত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, হারমান সেলেঞ্জ তাঁহার Geschichte der pharmazie (1904) গ্রন্ধে হিন্দু রসায়নের ইতিহাস হইতে তির্যকপাতন, ঊর্দ্ধ্বপাতন প্রভৃতির বিবরণ উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং ১২শ ও ১৩শ শতাব্দীতেও যে ঐ সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রণালী ভারতবাসীরা জানিত, এজন্য বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন।

 অধ্যাপক আলেকজেণ্ডার বাটেক (বোহিমিয়া) ১৯০৪ সালে লিখিয়াছেন—“আমি আমার মাতৃভাষাতে আধুনিক প্রাকৃত বিজ্ঞান সমূহের ইতিহাস, ছোট ছোট বক্তৃতার আকারে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিতেছি। এই সম্পর্কে আপনার গ্রন্থ ‘হিন্দু, রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’ হইতেও একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উদ্ধৃত করিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিতেছি।”

 সাণ্টে আরেনিয়স্ তাঁহার Chemistry in Modern Life (লিওনার্ড কৃত ইংরাজী অনুবাদ) গ্রন্থে ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস’ হইতে বিস্তৃত ভাবে উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং ধাতব, বিশেষ করিয়া পারদ সংক্রান্ত ঔষধ ব্যবহারে হিন্দুরাই পথ প্রদর্শক একথা বলিয়াছেন।

 এই গ্রন্থের অধুনাতন সমালোচনা ইটালীয় ভাষায় লিখিত Archives for the History of Science-এ দেখিতে পাওয়া যায়। নিম্নে তাহার কিয়দংশের ইংরাজী অনুবাদ প্রদত্ত হইল:—

 “সমস্ত সভ্যদেশেই আজকাল বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট হইতেছে। যদিও ইহার ফলে অনেক সময় অকিঞ্চিৎকর গ্রন্থাদি প্রণীত ও প্রকাশিত হয়, তাহা হইলেও তথ্যপূর্ণ মূল্যবান গ্রন্থেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সকল দেশেই এমন কতকগুলি লোক দেখা যায়, যাহারা কেবল নকলনবীশ, অথবা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ স্বাদেশিকতা হইতে যাহারা মনে করে যে বিজ্ঞান কেবলমাত্র একটি দেশে অর্থাৎ তাহাদের নিজের দেশেই উন্নতি লাভ করিয়াছে। আবার এমন লোকও আছেন যাঁহাদের পাণ্ডিত্য এবং তথ্যানুসন্ধানে যোগ্যতা আছে, যাঁহারা বিচার বিশ্লেষণ করিতে পারেন এবং যদিও তাঁহারা নিজের দেশের কথা গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে বলেন, তাঁহাদের মন সংস্কারের বশবর্তী নহে, তাঁহারা উদার দূরদৃষ্টির অধিকারী। এই শ্রেণীর লোকের লিখিত গ্রন্থ পড়িবার ও আলোচনা করিবার যোগ্য। ভারতে রসায়নবিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে স্যর পি, সি, রায় এই সম্মানের আসনের যোগ্য তিনি বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। কিন্তু রায়ের যে গ্রন্থ দ্বারা তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় হইবে, উহা হইতেছে ‘হিন্দু, রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’ নামক বিরাট গ্রন্থ; ইহাতে প্রাচীনকাল হইতে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’ লিপিবদ্ধ হইয়াছে।”

 ভন লিপম্যান তাঁহার Entstehung und Ausbreitung der Alchemie (বার্লিন, ১৯১৯) গ্রন্থে হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস দুই খণ্ডের সারাংশ বিস্তৃতভাবে উদ্ধৃত করিয়াছেন।

 হিন্দু, রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসের প্রথম ভাগ প্রণয়ন করিতে আমাকে এত কঠোর ও দীর্ঘকালব্যাপী পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল যে, আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধে অধ্যয়ন ও গবেষণা করিতে আমি সময় পাই নাই। অথচ আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র ইতিমধ্যে দ্রুতবেগে উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছিল। এই সময়ে রেলে ও র‍্যামজে Argon আবিষ্কার করেন এবং তাহার পরই Neon, Xenon ও Krypton আবিষ্কৃত হয়। বেকেরেল, রাদারফোর্ড ও সডী কতকগুলি কম্পাউণ্ড ও খনিজ পদার্থের আলোক বিকীরণের ক্ষমতা সম্বন্ধে পরীক্ষা ও আলোচনা করেন এবং কুরী-দম্পতী রেডিয়ম আবিষ্কার করিয়া এই বিষয়ে গবেষণার পূর্ণতা সাধন করেন। রামজে দেখাইলেন যে, রেডিয়ম হইতে বিকীরণই গ্যাস হেলিয়ামে রূপান্তরিত হয় এবং পদার্থের রূপান্তরের ইহাই অকাট্য প্রমাণ। ডেওয়ার এই সময়ে বায়ুকে তরল পদার্থে পরিণত করিলেন। হাইড্রোজেনকে তরলীকৃত করা আর এক বিস্ময়কর ব্যাপার। যখন একটির পর একটি এই সমস্ত যুগান্তরকারী আবিষ্কার হইতেছিল, সেই সময়ে আমি প্রাচীন হিন্দুদের রসায়নজ্ঞানের গবেষণা লইয়া ব্যস্ত ছিলাম। সুতরাং আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে সংযোগ হারাইয়াছিলাম। এই কারণে হিন্দু, রসায়নের ইতিহাসের প্রথম ভাগ শেষ করিয়া আমি পরাতত্ত্বের গবেষণায় কিছুকাল বিরত হইলাম এবং কয়েক বৎসরের জন্য হিন্দু, রসায়নের ইতিহাস দ্বিতীয়ভাগ প্রণয়ন ও প্রকাশ স্থগিত রাখিলাম। আমি এখন নব্য রসায়ন বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় স্থাপনের জন্য ব্যস্ত হইলাম। এখানে বলা যাইতে পারে যে, আমার গবেষণাগারের কাজ কখনও স্থগিত হয় নাই। বস্তুতঃ এই সময়ে, বৈজ্ঞানিক পত্রিকাসমূহে, বিশেষভাবে লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির পত্রে, ‘নাইট্রাইট’ সম্বন্ধে আমার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল।

  1. “আপনার গবেষণার চিত্তাকর্ষক ফলাফলের সংবাদে পুলকিত হইলাম। ইউরোপ এবং আমেরিকার ন্যায় এশিয়া খণ্ডেও যে বিজ্ঞানের সার্বভৌম এবং নৈর্ব্যক্তিক রূপের সমাদর ও চর্চা চলিয়াছে তাহা জানিয়া আনন্দ হইল”—
  2. ফ্রুডের কৃত কালইিলের জীবনচরিতে আছে যে কার্লাইলের আর্থিক অবস্থা যখন অত্যন্ত শোচনীয়, তাঁহার Sartor Resartus গ্রন্থ কোন প্রকাশকই লইতে চাহিতেছিলেন না। সেই সময়ে মহাকবি গ্যেটের একখানি পত্র পাইয়া তাঁহার মনে নূতন বল ও উৎসাহের সঞ্চার হইল।
  3. The Rasarnavam or the Ocean of Mercury and other Metals and Minerals—Ed. by P. C. Ray and H. C. Kaviratna, published by the Asiatic Society of Bengal, 1910.