আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
জাতিভেদ—হিন্দু সমাজের উপর তাহার অনিষ্টকর প্রভাব
(১) এক দিকে শিক্ষিত ও মার্জিতরুচি সম্প্রদায়, অন্য দিকে
কৃষক, শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সামাজিক প্রভেদ
ও অন্তরায়—পারিবারিক কলহের কারণ
বংশানুক্রমের প্রভাব সম্বন্ধে অনেক কথাই বলা হইয়াছে, মানিয়া লওয়াও হইয়াছে। জাতিভেদ-পীড়িত ভারতেও এমন কতক গুলি প্রমাণ পাওয়া যায়, যাহাতে মনে হয় যে, কতক গুলি বিশিষ্ট গুণ বংশানুক্রমিক। বর্তমান ভারতে পাশ্চাত্য ভাব ও শিক্ষা বিস্তারের পর, পুনা ও মাদ্রাজের ব্রাহ্মণ, বাংলার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ, এবং যুক্ত প্রদেশের অধিবাসী কাশ্মীরী পণ্ডিতদের মধ্য হইতেই সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে। স্যার টি. মাধব রাও, রঙ্গ চার্লু, বিচারপতি মুথুস্বামী আয়ার, ভাশ্যাম আয়েঙ্গার, প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ রামানুজম, রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, কেশব চন্দ্র সেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য বহু প্রধান ব্যক্তির আবির্ভাব এই কথাই প্রমাণিত করে। জাতিভেদ প্রথার অসুবিধা ও তাহার গুরুতর ত্রুটীও ইহাতে সম্পষ্ট ধরা পড়ে। বাংলার পাঁচ কোটী লোকের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থের সংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ মাত্র—অর্থাৎ তাহারা সমগ্র লোকসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগ মাত্র। অপর পক্ষে, ইংলণ্ডে সাধারণ শ্রেণীর মধ্য হইতে উদ্ভূত একজন চার্চিল ব্লেনহিমের যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়া ডিউক পদবীতে উন্নীত হন,—একজন পিট আর্ল অব চ্যাথাম হইতে পারেন। সাহিত্য জগতে একজন কসাইএর পুত্র “রবিনসন ক্রুসো”র প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার হন,—জেলের একজন হীন ব্যবসায়ী “পিলগ্রিম্স প্রোগ্রেস”[১] বই লিখিতে পারেন। ফ্রান্সেও এইরূপ দৃষ্টান্ত দেখা যায়। নরম্যাণ্ডির ডিউক উইলিয়ামের (পরবর্তীকালে উইলিয়ম দি কনকারার বা বিজয়ী উইলিয়াম) মাতা একজন চর্মকারের দুহিতা ছিলেন। প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পাস্তুরের পিতা একজন চর্মশিল্পী ছিলেন। নেপোলিয়ন সত্যই গর্ব করিতেন,—প্রত্যেক প্রাইভেট সৈনিক তাহার ঝোলার মধ্যে ফিল্ডমার্শাল বা প্রধান সেনাপতির চিহ্ন বহন করে। প্রসিদ্ধ মিশনারী উইলিয়াম কেরী মুচি ছিলেন এবং বর্তমান রাশিয়ার অন্যতম প্রবর্তক জোসেফ স্টালিন জীবিকা নির্বাহের জন্য জুতা সেলাই করিতেন। পাশ্চাত্য দেশের কৃষক, তন্তুবায়, নাপিত, জুতানির্মাতা, মুচী প্রভৃতি এবং আমাদের দেশের ঐ শ্রেণীর লোকের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে জনসাধারণের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ঐ সময়েও ইয়োরোপে সাধারণ লোকেদের মধ্যেই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। হারগ্রিভস এবং আর্করাইট, টেলফোর্ড, রবার্ট বার্নস, হিউ মিলার এবং অন্য অনেকে কঠিন পরিশ্রম করিয়া জীবিকা অর্জন করিতেন,—কিন্তু নিজের শক্তি বলে তাঁহারা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। আমাদের তাঁতিদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হইয়াছে।[২] অ্যানড্রু কার্নেগীর পিতা যন্ত্রযুগের পূর্বেকার তন্তুবায় ছিলেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁহার পরিবারে এক রকমের শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল দেখিতে পাই। ইয়োরোপের অন্যান্য দেশ হইতেও ইহার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। মুসোলিনীর পিতা কর্মকার এবং তাঁহার মাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। ম্যাসারিকের পিতা ছিলেন কোচম্যান এবং ম্যাসারিক নিজে ১৩ বৎসর বয়সে কর্মকারের শিক্ষানবিশরূপে হাপর চালাইতেন। কিন্তু তবু এই সব বংশ হইতেই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ জন্ম গ্রহণ করেন।
শ্রমিক দলের সৃষ্টিকর্তা জেম্স কেয়ার হার্ডির দৃষ্টান্ত দেখুন। “তিনি আট বৎসর বয়সে কয়লার খনিতে কাজ করিয়া জীবিকা অর্জন করিতেন। এক দিনের জন্যও তিনি কোন বিদ্যালয়ে পড়েন নাই। তাঁহার মাতা তাঁহাকে পড়িতে শিখাইয়াছিলেন, কিন্তু সতর বৎসর বয়সের পূর্বে তিনি নাম স্বাক্ষর করিতে পারিতেন না। তিনি নিজে শর্ট হ্যাণ্ড শিখেন; কয়লার খনির মধ্যে বসিয়া তিনি এই বিদ্যা আয়ত্ত করিতেন। তিনি কার্লাইল ও ষ্টুয়ার্ট মিল পড়িতেন এবং ২৩ বৎসর বয়সে তিনি জীবনের একটা আদর্শ, একটা দৃঢ় সঙ্কল্প লইয়া খনি হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।”—এ. জি. গার্ডিনার।
“লয়েড জর্জের পিতা ম্যানচেষ্টারের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন দরিদ্র স্কুল মাষ্টার ছিলেন, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য তিনি ঐ কাজ ত্যাগ করিয়া এমন বৃত্তি অবলম্বন করিলেন, যাহাতে বাহিরে খোলা জায়গায় কাজ করিতে পারা যায়। তিনি ওয়েসে তাঁহার স্বগ্রামে ফিরিয়া গেলেন এবং চাষের কাজ আরম্ভ করিয়া দিলেন।...... উইলিয়াম জর্জ যদিও শিক্ষকতা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তবু, তিনি তাঁহার পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করেন নাই। তাঁহার পড়িবার আগ্রহ পূর্বের মতই ছিল এবং শারীরিক শ্রমের কাজের পর বিশ্রামের সময় তিনি বই পড়িতেন।”[৩] তিনি তাঁহার বিধবা এবং দুইটি শিশু সন্তানকে রাখিয়া পরলোক গমন করেন। লয়েড জর্জের বয়স তখন দুই বৎসর মাত্র। লয়েড জর্জের মাতুল অবিবাহিত এবং দরিদ্র জুতা নির্মাতা ছিলেন, তিনি তাঁহার বিধবা ভগ্নী ও ভাগিনেয়দের ভার গ্রহণ করিলেন। এই মাতুলও জুতা সেলাই কাজের অবসরে অধ্যয়ন করিতে ভাল বাসিতেন।
বার্নস গরীব চাষার ছেলে ছিলেন। কার্লাইল বলেন, “বার্নসের পিতা একজন চরিত্রবান কৃষক ছিলেন, কিন্তু তিনি এমন গরীব ছিলেন যে, ছেলেমেয়েদের একালের স্বল্পব্যয়সাধ্য স্কুলে পাঠাইয়াও লেখাপড়া শিখাইতে পারেন নাই এবং বার্নসকে বাল্যকালে লাঙলের কাজ করিতে হইত।” বিভিন্ন কৃষকের ফার্মে কাজ করিয়া বার্নস সেই দারিদ্রের মধ্যেই বাস করিতে লাগিলেন। তের বৎসর বয়সে, তিনি স্বহস্তে শস্য মাড়াইতেন। ১৫ বৎসর বয়সে তিনি প্রধান মজুরের কাজ করিতেন। স্কুলে গিয়া তিনি তাঁহার স্বল্প অবসরের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সঙ্গে পড়িতে লাগিলেন। আহারের সময় তাঁহার এক হাতে চামচ, অন্য হাতে বই থাকিত। ক্ষেতে কাজ করিতে যাইবার সময়ও তিনি সঙ্গে কয়েক খানি বই লইয়া যাইতেন এবং অবসর সময়ে পড়িতেন।
মাইকেল ফ্যারাডে কর্মকারের ছেলে ছিলেন এবং প্রথম বয়সে দপ্তরীর দোকানে শিক্ষানবিশি করিতেন এবং অতি কষ্টে সামান্য আহারে জীবন ধারণ করিতেন।
কবি জেমস হগ নিয়মিত ভাবে শিক্ষা লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহাকে প্রায়ই স্কুল ছাড়িয়া পিতাকে ভেড়া চরানোর কাজে সহায়তা করিতে হইত।
টমাস কার্লাইল নিজেও কৃষকের ছেলে ছিলেন, একথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাঁহার পিতা পুত্রকন্যাদের সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র কৃষিক্ষেত্রে কাজ করিতেন এবং কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করিতেন। দরিদ্রের ঘরে জন্ম লাভ করিয়াও নিজের কৃতিত্ব বলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হইয়াছিলেন, এরূপ আরও কয়েকজন ব্যক্তির নাম পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে।
আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রে দরিদ্রের ঘরে জন্ম গ্রহণ করিলেও যে কোন ব্যক্তি প্রেসিডেণ্ট পদ লাভের আশা করিতে পারে। প্রেসিডেণ্ট উইলসন তাঁহার New Freedom নামক গ্রন্থে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব কোথায় তাহা সুন্দর রূপে বর্ণনা করিয়াছেন:—
“যখন আমি অতীত ইতিহাসের পাতা উল্টাই, আমেরিকা রাষ্ট্রের পত্তনের কথা ভাবি, তখন এই কথাটি আমেরিকার ইতিহাসের সর্বত্র লিখিত আছে দেখিতে পাই,—যে সমস্ত প্রতিভাশালী ব্যক্তি দরিদ্র অখ্যাত বংশ হইতে উদ্ভূত হন, তাঁহারাই জাতির জীবনে নূতন শক্তি ও উৎসাহের সঞ্চার করেন। ইতিহাস পড়িয়া যাহা কিছু জানিয়াছি, অভিজ্ঞতা ও ভূয়োদর্শনের ফলে যাহা কিছু জ্ঞান লাভ হইয়াছে, তাহাতে আমার এই প্রতীতি হইয়াছে যে, মানবের জ্ঞানসম্পদ সাধারণ মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। ঐক্য, জীবনীশক্তি, সাফল্য উপর হইতে নীচে আসে না, বৃক্ষ যেমন গোড়া হইতে রস পাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়া উঠে, পত্র পুষ্প ফলে ঐশ্বর্যশালী হয়, মানব সমাজেও ঠিক তেমনই ব্যাপার ঘটে। যে সমস্ত অজ্ঞাত অখ্যাত লোক সমাজের নিম্ন স্তরে তাহার মূল দেশে থাকিয়া জীবন সংগ্রাম করিতেছে, তাহাদেরই প্রচণ্ড শক্তির দ্বারা সমাজ উন্নত হইয়া উঠিতেছে। একটা জাতির সাধারণ লোকেরা যে পরিমাণে মহৎ ও উন্নত হয়, জাতিও ঠিক সেই পরিমাণে মহৎ ও উন্নত হয়।”
এই সব দৃষ্টান্ত হইতে এই মহান শিক্ষা লাভ করা যায় যে, কৃষক, খনির মজুর, নাপিত বা মেষপালকের বৃত্তিতে কোন সামাজিক অমর্যাদা নাই। ঐ সব দেশে পরিশ্রম করিয়া সাধভাবে জীবিকার্জন সম্মানজনক বিবেচিত হয়, কিন্তু আমাদের দেশে শ্রমের কোন মর্যাদা নাই। যাহারা ‘ভদ্রলোক’ বলিয়া পরিচিত, তাহারা অনাহারে মরিবে তব, কায়িক শ্রমের কাজ করিবে না,—বরং সামান্য বেতনের কেরাণীগিরিতে সন্তুষ্ট হইবে। অনেক সময় সে আত্মীয়ের গলগ্রহ হইয়া পরগাছার মত জীবন ধারণ করিতেও লজ্জিত হয় না।
আমাদের চামার, জোলা, তাঁতি, নাপিতেরা আবহমান কাল হইতে সেই একঘেয়ে পৈতৃক ব্যবসা করিয়া আসিতেছে, তাহাদের জীবনে কোন পরিবর্তন নাই, আনন্দ নাই। আমাদের কতকগুলি শ্রমশিল্পী অস্পৃশ্য জাতীয় এবং তাহারা যে ভাবে দিনের পর দিন পৈতৃক ব্যবসা চালায়, তাহাতে তাহাদের অবস্থার উন্নতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কিন্তু হিন্দ, ভারতের বাহিরে, লোকে যে কোন ব্যবসা বা জীবিকা অবলম্বন করিতে পারে, তাহাতে তাহাদের সামাজিক মর্যাদার হানি হয় না। সমাজের যে কোন স্তরে তাহারা বিবাহ করিতে পারে, এবং এই কারণে তাহারা দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া বহ, বাধা বিপত্তির মধ্যেও জীবনে সাফল্য লাভ করিতে পারে।
তিব্বত ও বর্মা ভারতের সংলগ্ন,—যথাক্রমে তাহার উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য দিয়া বাংলা দেশ হইতে তাহারা তাহাদের সভ্যতা লাভ করিয়াছিল। তাহারা জাতিভেদ জানে না এবং তাহাদের স্ত্রীলোকেরা যে স্বাধীনতা ভোগ করে তাহা আমেরিকার স্ত্রীলোকদের পক্ষেও ঈর্ষার বিষয়। চীন দেশও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য দিয়া বাংলার নিকট তাহার সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন প্রভৃতির জন্য বহুল পরিমাণে ঋণী। ইয়োরোপীয় ও আমেরিকান লেখকেরা এক বাক্যে বলিয়াছেন যে, এই চীন দেশে তিন হাজার বৎসরের মধ্যে অস্পৃশ্যতা বলিয়া কিছু নাই এবং জগতের মধ্যে এই জাতির ভিতরেই জাতিভেদের প্রভাব সর্বাপেক্ষা কম। দরিদ্র পিতামাতার সন্তানেরা অতীতে অনেক সময়ই ‘মান্দারিন' হইয়াছে। আমাদের মধ্যে যে চামার সে চিরকাল চামারই থাকিবে এবং তাহার সন্তান সন্ততির সমাজে কোন কালে মর্যাদালাভের সম্ভাবনা নাই। তাহাদের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা এই ভাবে নষ্ট হইয়া গিয়াছে।
কৃষক, মেষপালক অথবা খনির মঞ্জুর অনেক সময় কবি বা ভূতত্ত্ববিদ হইয়া উঠে। যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে সে পালিত হয়, তাহার ফলে তাহার চরিত্রের গুণাবলীর সম্যক বিকাশের সংযোগ ঘটে। আর আমাদের দেশের কৃষক, মেষপালক বা চামার এমন অবস্থার মধ্যে বর্দ্ধিত হয় যে, তাহাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির কোন আশা নাই। ডাপ্টের 'ইনফার্নো’-র মত তাহাদের মাটির ঘরের দরজায়ও যেন এই কথাটি লিখিত আছে—“এখানে যে প্রবেশ করিবে, তাহাকে সমস্ত আশা ত্যাগ করিতে হইবে।” যে চোরা বালিতে সে পড়িয়াছে, তাহা হইতে তাহাকে উদ্ধার করিবার কেহ নাই। রবার্ট বার্নসের জীবনী হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত গলি পড়িলে বুঝা যায়, ব্রিটিশ কৃষক ও তাহার পারিবারিক জীবন এবং ভারতীয় কৃষক ও তাহার পারিবারিক জীবনের মধ্যে কি প্রভেদ! স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ইহাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগের চিত্রই অঙ্কিত হইয়াছে, বর্তমান কালে ব্রিটিশ কৃষকের পারিবারিক জীবনের বহ, উন্নতি হইয়াছে।
“বার্নসের শিক্ষা তখনও সমাপ্ত হয় নাই, সেই সময়ে তাঁহার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইল। স্কটল্যাণ্ডের কৃষকেরা তাহাদের কুটীরকেই স্কুলে পরিণত করে; যখন সন্ধ্যা কালে পিতা আগুনের কাছে আরাম কেদারায় বসেন, তখন তিনি মুখে মুখে ছেলেদের নানা বিষয় শিখাইতে আলস্য করেন না। তাঁহার নিজের জ্ঞানও খূব সঙ্কীর্ণ নহে, ইয়োরোপের ইতিহাস এবং গ্রেট ব্রিটেনের সাহিত্য তিনি জানেন। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব, কাব্য এবং স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাসই তাঁহার বিশেষ প্রিয়। স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাসে যেসব যুদ্ধ, অবরোধ, সঙ্ঘর্ষ, পারিবারিক বা জাতীয় কলহের কথা কোন ঐতিহাসিক লিপিবদ্ধ করেন না, একজন বুদ্ধিমান কৃষক, সে সমস্ত জানেন; বড় বড় বংশের ইতিহাস তাঁহার নখদর্পণে। স্কটল্যাণ্ডের গীতি কবিতা, চারণ গাথা প্রভৃতি তাঁহার মুখস্থ, এমন কি অনেক সুদীর্ঘ কবিতাও তাঁহার মুখস্থ আছে। যে সব ব্যক্তি স্কটল্যাণ্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করিয়াছেন, তাঁহাদের জীবনের কথা তাঁহার জানা আছে। এসব তো তাঁহার স্মৃতিপটেই আছে, ইহা ছাড়া তাঁহার শেলফের উপর পূথিপত্রও আছে। স্কটল্যাণ্ডের সাধারণ কৃষকের গৃহেও একটি ছোট খাট লাইব্রেরী থাকে,——সেখানে ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব এবং বিশেষ ভাবে কাব্যগ্রন্থাদি আছে। মিলটন এবং ইয়ং তাহাদের প্রিয়। হার্ডের চিন্তাবলী, ‘পিগ্রিস প্রোগ্রেস', সকল কৃষকের ঘরেই আছে। যাঁমজে, টমসন, ফার্গুসন, এবং বার্নস প্রভৃতি স্কচ লেখকদের গ্রন্থ, গান, চারণ গাথা, সবই ঐ গ্রন্থাগারে একত্র বিরাজ করিতেছে; বহ, ব্যবহারের ফলে ঐগুলির মলাট হয়ত ময়লা হইয়াছে, পাতা গুলি কিছু কিছু ছিন্ন কীটদষ্ট হইয়াছে।”
রক্ত সংমিশ্রণের ফলে species বা শ্রেণীর উন্নতি হয়, সন্দেহ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় সামাজিক প্রথা জাতিভেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং ইহার ফলে বংশানুক্রমিক উৎকর্ষ হয় না এবং নিম্ন স্তরের জাতিরাও উন্নতি লাভ করিতে পারে না। এই জাতিভেদ প্রথার ত্রুটি ভারতীয় মহাজাতির, অথবা যে কোন রক্ষণশীল দেশের ইতিহাস আলোচনা করিলেই বুঝা যাইতে পারে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম অবস্থায়, উচ্চবর্ণীয়েরাই (শিক্ষিত সম্প্রদায়) সর্বাগ্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার সংযোগ লাভ করিয়াছেন। ব্রিটিশ শাসন যখন সাদঢ় হইল, তখন আদালত স্থাপিত ও আইনকানুন বিধিবদ্ধ হইল। আমলাতন্ত্রের শাসনযন্ত্র সপ্রতিষ্ঠিত হইল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহও গড়িয়া উঠিল। সুতরাং আইনজীবী, স্কুল মাষ্টার, সেক্রেটারিয়েটের কেরাণী, ডাক্তার প্রভৃতির চাহিদা খুব বাড়িয়া গেল। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সহিত সংসৃষ্ট অসংখ্য কলেজের সৃষ্টি হইল এবং সেখানে দলে দলে ছাত্রেরা ভর্তি হইতে লাগিল; কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী বা উপাধিই পূর্বোক্ত ওকালতী, ডাক্তারী, কেরাণীগিরি প্রভৃতি পদ লাভের প্রধান উপায় ছিল। কিছু কাল ব্যবস্থা ভালই চলিতে লাগিল। কতক গুলি উকীল, ডাক্তার প্রভৃতি প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। কলিকাতা হাইকোর্টের তথা জেলা কোর্টের কতক গুলি জজের পদও ভারতবাসীকে দেওয়া হইল। শাসন ও বিচার বিভাগের নিম্ন স্তরের কাজগুলি সম্পর্ণরূপে ভারতবাসীদেরই দেওয়া হইতে লাগিল। কেন না ঐসব পদের জন্য যে বেতন নির্দিষ্ট ছিল, তাহাতে যোগ্য ইয়োরোপীর কর্মচারী পাওয়া যাইত না। এইরূপে এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় কেবল যে তাহাদের সক্ষম মস্তিষ্ক চালনার ক্ষেত্র পাইল তাহা নহে, তাহাদের জীবিকার্জনের পথও প্রশস্ত হইল।
কিন্তু অন্য দিক দিয়া, এই অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম ব্যবস্থা সমাজদেহকে বিষাক্ত করিয়া তুলিতে লাগিল। শুনা যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও যক্ষ্মার প্রথম অবস্থায় প্রতারিত হন, উহা তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষার প্রতি মোহের ফলে এখন ভীষণ প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। তাহারা সভয়ে দেখিল যে, তাহাদের সঙ্কীর্ণ কার্যক্ষেত্রে বিষম ভিড় জমিয়া গিয়াছে। ব্যবসা বাণিজ্য ইতিমধ্যেই অন্য লোকের হাতে চলিয়া গিয়াছে এবং ইহার অপরিহার্য পরিণাম বেকার সমস্যা ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করিতেছে। ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ব্যবসা বাণিজ্যে অনিচ্ছা ও ঔদাসীন্য হেতু জাতীয় উন্নতির গতি রুদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। দুই হাজার বৎসর পূর্বে ইশপ তাঁহার দূরদৃষ্টিবলে, এমন একটি সমাজশরীরের কল্পনা করিয়াছিলেন, যাহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে। হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরে আমরা সেই অসহযোগের দৃষ্টান্ত দেখিতেছি। বাংলাদেশের শতকরা ৫৫ ভাগ লোক, বংশ, জাতি ও ভাষায় এক হইয়াও, হিন্দু সমাজের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন। হিন্দু সমাজের ব্যবসায়ী জাতি— গন্ধবণিক, বর্ণবণিক, সাহা, তিলি—প্রভৃতিও হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিত, যদি শ্রীচৈতন্যের অভ্যুদয় না হইত। শ্রীচৈতন্য সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করিয়াছিলেন এবং জাতিভেদ উঠাইয়া দিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই।
এই সব জাতি হিন্দুসমাজের অভ্যন্তরেই রহিল এবং বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করিল, যদিও সমাজের নিম্ন স্তরে ইহাদের স্থান হইল। এখন হিন্দু সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। মুষ্টিমেয় লোক ইহার মস্তিষ্ক; কিন্তু বিশাল জনসমষ্টি যাহারা এই সমাজের দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাহারা ঐ মস্তিষ্ক হইতে পৃথক এমন কি বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। এ যেন পুরাণ বর্ণিত কবন্ধবিশেষ!
এই ঘোর নির্বুদ্ধিতার জন্য বাংলা বিশেষ করিয়া ভীষণ ক্ষতি সহ্য করিয়াছে। বাংলার চিন্তাশীল শিক্ষিত সম্প্রদায়—যাহাদের মধ্যে দেশহিতৈষণা, রাজনৈতিক বোধ প্রভৃতি জাগ্রত হইয়াছে, তাহারা ধনী ও ঐশ্বর্যশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। যখন কোন জাতীয় কার্যে অর্থের জন্য আবেদন করা হয়, কেহই তাহাতে সাড়া দেয় না। অসংখ্য অস্পৃশ্য জাতি—নমঃশূদ্র, পোদ প্রভৃতির কথা দূরে থাকুক,—সাহা, তিলি, বণিকরা পর্যন্ত যেন সমাজদেহের অকর্মণ্য অঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে, এবং বিদ্যুৎপ্রবাহ চালাইয়াও তাহাদের মধ্যে জীবনী শক্তি সঞ্চার করা যায় না।
আমি প্রকাশ্য বক্তৃতায় বহু বার হিন্দু সমাজের এই ‘অচলায়তনের’ কথা বলিয়াছি। সংবাদপত্রে কোন কোন পত্রলেখক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিয়াছেন, তিলি, সাহা, সুবর্ণবণিক, সৎচাষী, এমন কি নমঃশূদ্রদের মধ্যেও নব্য বাংলার কোন কোন কৃতী সন্তান জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা তুলিয়াভুলিয়া যান যে, প্রকারান্তরে তাঁহারা আমার কথাই সমর্থন করিতেছেন। বাংলায় কয়েকটি তিলি বংশ আছেন, যাঁহারা কয়েক শতাব্দী ধরিয়া জমিদার ও ব্যবসায়ী, তাঁহাদের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বরাবরই আছে। দীঘাপাতিয়া, কাশিমবাজার, ভাগ্যকুল, রাণাঘাট প্রভৃতি স্থানের তিলি বংশ হইতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ভব হইয়াছে,—তাঁহারা সর্বাংশেই উচ্চবর্ণীয়দের সমতুল্য। কৃষ্ণদাস পাল দরিদ্র তিলির গৃহে জন্ম গ্রহণ করিলেও সমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। সাহাগণও অনুরূপ গৌরবের দাবী করিতে পারে। জগন্নাথ কলেজ (ঢাকা), মুরারিচাঁদ কলেজ (শ্রীহট্ট), এবং রাজেন্দ্র কলেজ (ফরিদপুর), সাহাদের বদান্যতার ফলেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কলিকাতার কয়েকটি সুবর্ণবণিক পরিবার ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বেনিয়ান রূপে ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্য হইতেও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে।
কিন্তু বাংলাদেশের আদমসুমারীর বিবরণ পড়িলে, আমার কথার যাথার্থ্য প্রমাণিত হইবে। পূর্বে যে সব দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হইল, সেগুলি ব্যতিক্রম মাত্র। জাতিভেদ প্রথার ঘোর অনিষ্টকারিতা হিন্দু ভারতের সর্বত্রই জাজ্জ্বল্যমান।[৪]
বর্তমান বাংলা এবং ১৪শ, ১৫শ, ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় সাধারণ তন্ত্র সমূহ তথা চীনের মধ্যে পার্থক্য এখন বুঝিতে পারা যাইবে। এ বিষয়ে আমরা তাহাদের বহু শতাব্দী পশ্চাতে পড়িয়া আছি। আমাদের সমাজদেহ জীর্ণ ও দূষিত এবং উহার অভ্যন্তরে ক্ষয় রোগ প্রবেশ করিয়াছে।
জাপান প্রবল চেষ্টায় জড়তা ত্যাগ করিয়া জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের উচ্চশ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রভেদ চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হইয়াছে। আমরা যখন প্রমাণ করিতে যাই যে, এসিয়ার দেশ সমূহও রাজনৈতিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করিতে পারে, তখন আমরা জাপানের দৃষ্টান্ত দিই। কিন্তু জাপান তাহার সমাজ সংস্কারের জন্য কি করিয়াছে, তাহা সুবিধা মত আমরা ভুলিয়া যাই। ১৮৭০ খৃঃ পর্যন্ত জাপানের সামুরাইয়েরা আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের মতই সমস্ত সযোগ সুবিধা একচেটিয়া করিয়া রাখিয়াছিল। এটা ও হিনিনেরা (জাপানের অস্পৃশ্য জাতি) এত অপবিত্র ও নোংরা বলিয়া গণ্য হইত যে, তাহাদিগকে সাধারণ গ্রামে বাস করিতে দেওয়া হইত না। তাহাদের জন্য পল্লীর বাহিরে স্বতন্ত্র বাসস্থান নির্দিষ্ট করা হইত। ভারতের দক্ষিণ প্রদেশে এইরূপে ব্যবস্থা এখনও আছে। কিন্তু ১৮৭১ সালের ১২ই অক্টোবরের চিরস্মরণীয় দিনে, সামুরাইয়েরা দেশপ্রেম ও মহৎ ভাবের প্রেরণায় নিজেদের বিশেষ অধিকারগুলি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিল, কৃত্রিম শ্রেণীভেদ ও জাতিভেদ তুলিয়া দিল এবং এইরূপে একটি সঙ্ঘবদ্ধ বিশাল মহৎ জাতি গঠনের পথ প্রস্তুত করিল। ১৮৭১ সালে জাপানে যাহা সম্ভবপর হইয়াছিল, এই বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকেও ভারতে তাহা সম্ভবপর হইতে পারিল না। (৩১শ ভারতীয় জাতীয় সমাজ সংস্কার সম্মেলনে মদীয় সভাপতির অভিভাষণ দ্রষ্টব্য; ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯১৭)।
জাপান আরও বুঝিতে পারিয়াছিল যে, ব্যবসা বাণিজ্যে অবজ্ঞা করিলে চলিবে না। গত অর্ধ শতাব্দীতে ব্যবসা বাণিজ্যে জাপান কি আশ্চর্য উন্নতি করিয়াছে, তাহা এখানে বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, বর্তমানে ৪০ লক্ষ টনের জাপানী বাণিজ্য জাহাজ সগর্বে সমুদ্রে যাতায়াত করিতেছে। জাপানের কারখানায় ও তাঁতে উৎপন্ন পণ্য ভারতের বাজার ছাইয়া ফেলিয়াছে এবং বোম্বাইয়ের কাপড়ের কলগুলি জাপানী প্রতিযোগিতা সহ্য করিতে না পারিয়া লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। অথচ জাপান এই ভারত হইতেই প্রতি বৎসর ২৯ কোটী টাকার কাঁচা তূলা ক্রয় করে।[৫]
ভারতকে তাহার নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষতি সহ্য করিতে হইতেছে। জাতিভেদ বুদ্ধি ও প্রতিভাকে কেবল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ রাখে নাই, ইহা অন্তর্বিবাদ ও কলহের একটা প্রধান কারণ। সংক্ষেপে ভারতীয় মহাজাতি গঠনের পক্ষে ইহা প্রধান অন্তরায় স্বরূপে হইয়াছে। সহস্র প্রকারে ইহা সমাজের অনিষ্ট করিতেছে। জাপানেও তাহার নবজাগরণের পূর্বে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প- প্রাচীন প্রথায় সমাজের নিম্ন স্তরের লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যাহারা ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া অর্থোপার্জন করিত, সামুরাইয়েরা তাহাদের সঙ্গে সমান ভাবে মেলামেশা করিতে ঘৃণা বোধ করিত। কিন্তু জাপান যেন যাদুমন্ত্র বলে তাহার সামাজিক বৈষম্য বিলপ্ত করিয়া দিয়াছে, তাহার অভিজাত শ্রেণীর নানা ভাবেও সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে,—আর ভারত সেই পূর্বাবস্থাতেই অচল হইয়া আছে। ইহা যে তাহাকে ধ্বংসের পথে লইয়া যাইতেছে, তাহা ভাবিয়া দেখিবার সময় তাহার নাই।
(২) সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ—হিন্দু ভারতের উপর তাহার অনিষ্টকর
প্রভাব—আর্থিক উন্নতি এবং রাজনৈতিক বোধের উন্মেষ
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, সমুদ্র যাত্রা ও তাহার আনুষঙ্গিক সমুদ্র বাণিজ্য প্রভৃতি কেবল জাতির ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে নাই, তাহার মধ্যে রাজনৈতিক বোধও জাগ্রত করিয়াছে। প্রাচীন ফিনিসিয়া ও কার্থেজকে ইহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে। মধ্য যুগের ভিনিস ও ফ্লোরেন্সের সাধারণ তন্ত্রেও তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সব সহরের বন্দরে পৃথিবীর বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে পণ্য দ্রব্য আসিয়া জমা হইত। উহা তাহাদের গর্ব এবং প্রতিবাসীদের ঈর্ষার বিষয় ছিল।
“আমার প্রচেষ্টা কেবল এক বিষয়ে বা এক স্থানে নিবন্ধ নহে। কেবল বর্তমান বৎসরের আয়ই আমার সমস্ত সম্পত্তি নহে।” মার্চেণ্ট অব ভিনিস (সেক্সপীয়র)।
পুনশ্চ—“তাহার একখানি জাহাজ ট্রিপলিসে, আর এক খানি ইণ্ডিসে যাইতেছে। আমি রিয়ালটোতে জানিতে পারিলাম যে, তাহার তৃতীয় আর একখানি জাহাজ মেক্সিকোতে ও চতুর্থ জাহাজ ইংলণ্ডে যাইতেছে। তাহার একটি অভিযান বিদেশে ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে।”— মার্চেণ্ট অব ভিনিস।
রিয়ালটো জীবনের চাঞ্চল্যে পূর্ণ ছিল। মেডিচির সময়ে ফ্লোরেন্স তাহার গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছিল।[৬] ঐ স্থানে প্রসিদ্ধ শিল্পী, কবি, কূট রাজনীতিক এবং যোদ্ধাদের সমাগম হইত।
বাটেভিয়া সাধারণ তন্ত্রের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিতেছি। বাটোভিয়া ক্ষুদ্র দেশ, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস হইতে রক্ষা করিবার জন্য ইহার এক অংশে বাঁধ নির্মিত। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সাধারণ তন্ত্র ঐশ্বর্যে ও জনবলে বড় বড় সাম্রাজ্যকেও তুচ্ছ করিয়াছে। ইহার কারণ, তাহার প্রধান শক্তি ছিল নৌ-বল এবং বাণিজ্যে। আণ্টোয়ার্প, ওসটেণ্ড, লীজ, ব্রাসেল্স প্রভৃতি ঐশ্বর্যশালী সহর ছিল এবং ঐ সকল স্থানের অধিবাসীরা একদিকে যেমন ধনী অন্য দিকে তেমনই বীর ও দেশহিতৈষী ছিলেন। আবার হল্যাণ্ডই সর্বপ্রথম লুথারের সংস্কারবাদ গ্রহণ করিয়াছিল।
প্রথম চার্লসের রাজত্ব কালে লণ্ডনের ধনী বণিকেরাই পার্লামেণ্টারী সৈন্যের প্রধান সমর্থক ছিল। তাহারাই যুদ্ধের উপকরণ যোগাইত এবং তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই পিউরিটান মতাবলম্বী ছিল। পক্ষান্তরে রাজতন্ত্রীদের প্রধান সহায় ছিল, অভিজাত শ্রেণী এবং গ্রাম্য জমিদারগণ। ক্রমওয়েল জনবল ও ধনবলের সাহায্য সর্বদাই লাভ করিয়াছিলেন এবং সেইজন্যই তিনি লণ্ডন সহরের উপর কমনওয়েলথের পতাকা উড্ডীন করিতে পারিয়াছিলেন। লণ্ডন সহর এবং ব্রিস্টল তাঁহাকে এই জনবল ও ধনবল যোগাইত।[৭] সুতরাং দেখা যাইতেছে, কোন দেশে, শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উন্নত মতবাদ এবং রাজনৈতিক চেতনা, সমুদ্রযাত্রা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠরূপে জড়িত! যে সব দেশ কেবল মাত্র কৃষিবৃত্তির উপর নির্ভর করিয়াছে, সেখানেই স্বেচ্ছা-শাসনতন্ত্র এবং বিদেশী শাসনের প্রাধান্য দেখা গিয়াছে। তাহার অধিবাসীরা সাধারণতঃ প্রাচীন প্রথা ও কুসংস্কার আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে এবং তাহাদের দৃষ্টি সঙ্কীর্ণ ও অনুদার হইয়া পড়ে। বাক্ল তাঁহার—“সভ্যতার ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এই কথা বিশেষ ভাবে বলিয়াছেন:—
“আমরা যদি কৃষক ও শিল্পব্যবসায়ীদের তুলনা করি, তবে সেই একই নীতির ক্রিয়া দেখিতে পাইব। কৃষকদের পক্ষে আবহাওয়ার অবস্থা একটি প্রধান সমস্যা। যদি আবহাওয়া প্রতিকূল হইয়া দাঁড়ায় তবে তাহাদের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞান এখনও বৃষ্টির প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিতে পারে নাই। মানুষ পূর্ব হইতে এ সম্বন্ধে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারে না। সুতরাং লোকে মনে করিতে বাধ্য হয় যে, অতিপ্রাকৃত শক্তি বলেই ইহা ঘটে। আমাদের গির্জা সমূহে সেই কারণেই বর্ষার জন্য বা পরিষ্কার আবহাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়। ভবিষ্যৎ বংশীয়েরা আমাদের এই কার্য নিশ্চয়ই ছেলেমানুষি মনে করিবে,—আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যেরূপ ভীতি মিশ্রিত সম্ভ্রমের সহিত ধমকেতুর আবির্ভাব বা গ্রহণ দেখিত, তাহা আমরা যেমন ছেলেমানুষি বলিয়া মনে করি।... গ্রামবাসীরা যে সহরবাসীদের চেয়ে অধিকতর কুসংস্কারগ্রস্ত হয়, ইহা তাহার একটি প্রধান কারণ। সহরে যাহারা ব্যবসা বাণিজ্য কাজ কর্ম করে, তাহাদের সাফল্য নিজেদের শক্তি ও যোগ্যতার উপরেই নির্ভর করে, যে সমস্ত অতিপ্রাকৃত ঘটনা কৃষকদের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, সহরবাসীদের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই।”
বর্তমান চীনেও ইহার দৃষ্টান্ত দেখিতে পাওয়া যায়। উত্তর চীন কৃষিপ্রধান, এখানে চিরাচরিত প্রথা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্য, এবং এই অঞ্চল জাতীয় আন্দোলনের প্রধান বাধা স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে। পক্ষান্তরে দক্ষিণ চীনই প্রথম সান-ইয়াৎ সেনের আদর্শ ও মতবাদ গ্রহণ করে এবং এখানেই জাতীয়তা বোধ বিকাশ প্রাপ্ত হইয়াছে। ইহার কারণ, ক্যাণ্টনবাসীরা (দক্ষিণ চীনারা) ব্যবসা বাণিজ্যে চিরদিনই অগ্রণী, তাহারা উন্নতিশীল জাতিদের সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ পাইয়াছে এবং ফলে তাহাদের দৃষ্টি উদার হইয়াছে।[৮]
বাংলাদেশ তথা হিন্দু ভারত নির্বোধের মত জাতিভেদ প্রথাকে গ্রহণ করিয়াছিল এবং সমুদ্রযাত্রাকে নিষিদ্ধ করিয়াছিল। ইহার ফলে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সে কূপমণ্ডূক হইয়া উঠিল।—হিন্দু, সমাজের বাহিরের লোকদের সে ‘ম্লেচ্ছ’ আখ্যা দিল। সে নিজে ইচ্ছা করিয়া অন্ধ হইল এবং ধ্বংসের অভিমুখে দ্রুতবেগে ধাবিত হইতে লাগিল, আর তাহার দেশ, বিদেশী আততায়ীদের মৃগয়া ক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইল। কবির ভাষায় সত্যই—
“নিয়তির কঠোর বিধানে তাহার পূর্ব গৌরবের উচ্চ শিখর হইতে সে পতিত ধল্যবলুণ্ঠিত।”
(৩) জাতি সংমিশ্রণের সম্ভাবনা না থাকাতে, কলিকাতার
ঐশ্বর্যশালী অবাঙালীরা স্বতন্ত্র ভাবে বাস করিতেছে—
বাংলাদেশের সুখ দুঃখের সঙ্গে তাহাদের
কোন সম্বন্ধ নাই।
লম্বার্ডরা যখন ইংলণ্ডে যাইয়া বাস করে, তখন তাহারা তাহাদের ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল; লণ্ডন সহরের লম্বার্ড ষ্ট্রীট এখনও তাহাদের ঐশ্বর্য ও প্রভাবের স্মৃতি বহন করিতেছে।[৯] আল্ভার অত্যাচারের ফলে ফ্লেমিশরা ইংলণ্ডে গিয়া বাস করিয়াছিল। ইহারাই পশম ব্যবসায়ে উন্নত প্রণালীর প্রবর্তন করে। হিউগেনটস্রাও ইংলণ্ডের ঐশ্বর্য গঠনে এইরূপে সহায়তা করিয়াছে। ফ্রান্স যখন ধর্মান্ধতার বশবর্তী হইয়া “এডিক্ট অব ন্যব ন্যাণ্টিস্” প্রত্যাহার করে, তখন তাহার প্রায় ৪০ হাজার হিউগেনট অধিবাসী নিকটবর্তী প্রোটেষ্টাণ্ট দেশ সমূহে গিয়া আশ্রয় নেয়। ঐ সব দেশে তাহারা তাহাদের বীরত্ব, সাহস ও কর্মকুশলতার অবদান বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল। বলা বাহল্য ইহারা দুই এক পুরুষের মধ্যেই ঐ সব দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল। জন হেনরী ও কার্ডিনাল নিউম্যান এই দুই কৃতী ভ্রাতা, ডাচ্ বংশজাত, সম্ভবতঃ হিব্রু রক্তও এই বংশে ছিল। তাঁহাদের মাতা হিউগেনট বংশীয়।
হারবার্ট স্পেন্সার বলিতেন, তাঁহার মাতা ছিলেন হিউগেনট বংশীয় এবং সেই জন্যই প্রচলিত ধর্ম মতের বিরুদ্ধে তাঁহার একটা বিদ্রোহের ভাব ছিল।
প্রসিদ্ধ জার্মান বৈজ্ঞানিক হেল্মহোল্জের মাতা উইলিয়াম পেনের বংশীয় ছিলেন। হেল্মহোল্জের দেহে জার্মান, ইংরাজ এবং ফরাসী রক্ত মিশ্রিত হইয়াছিল। উইলিয়াম অরেঞ্জের সহকর্মী ও বন্ধু বেণ্টিঙ্ক বাটেভিয়ান বংশোদ্ভূত এবং তিনি নিজে ইংলণ্ডের একটি প্রসিদ্ধ অভিজাত বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ফরাসী ঔপন্যাসিক আলেকজান্দার ডুমার দেহে নিগ্রো রক্ত ছিল। লাডউইগ মণ্ডের জন্ম ও শিক্ষা জার্মানীতে, তিনি ইংলণ্ডে গিয়া ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেন এবং সেখানেই বসবাস করেন। তাঁহার অংশীদার জন ব্রুনারের সহযোগিতায় তিনি সেখানে একটি বৃহৎ অ্যালকালির কারখানা স্থাপন করেন। তিনি তাঁহার শিক্ষা-স্থান জার্মানীর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন অর্থ দান করেন, ইংলণ্ডের ডেভি ফ্যারাডে গবেষণার জন্যও তেমনি প্রভূত অর্থ দান করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র আলফ্রেড মণ্ড একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যবসায়ী এবং দেশপ্রেমিক ইংরাজ। দেশভক্ত চীনা রাজনীতিক ইউজেন চেন বলেন যে, তাঁহার দেহে চীনা, ব্রিটিশ এবং আফ্রিকান রক্ত আছে। অধিক দৃষ্টান্ত দিবার প্রয়োজন নাই।
যে সমস্ত বিদেশী ইংলণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে, ইংলণ্ডের দ্বার তাহাদের জন্য উন্মুক্ত। তাহার এই উদার নীতির জন্য সে যথেষ্ট লাভবান হইয়াছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, ইংলণ্ড বহু ইহুদীকে তাহার মধ্যে গ্রহণ করিয়াছে। এই মিশ্রণের ফলে ইংরাজ জাতির অশেষ উন্নতি হইয়াছে। বেঞ্জামিন ডিজ্রেলি (লর্ড বিকনসফিল্ড), জর্জ জোয়াকিম গশেন, এডুইন মণ্টেগু, স্যামুয়েল হারবার্ট এবং রুফাস আইজ্যাকস্ (লর্ড রেডিং), ইংরাজ জাতির সঙ্গে একাত্মভাবে মিশিয়া গিয়াছিলেন এবং রাজনীতিক রূপে ইংলণ্ডের স্বার্থ রক্ষার জন্য সর্বদা অবহিত ছিলেন। ইংলণ্ডে অনিষ্টকর জাতিভেদ প্রথা না থাকার জন্য, ইহারা দুই এক পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক আদান প্রদানের ফলে ইংরাজ জাতিভুক্তই হইয়াছিলেন।[১০] পক্ষান্তরে বাংলাদেশে, ঐশ্বর্যশালী অবাঙালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় স্বতন্ত্রভাবে বাস করে, বাঙালী জাতির সঙ্গে তাহাদের কোন সম্বন্ধ নাই। ধনী মাড়োয়ারী ও গুজরাটীরা (ভাটিয়া) ধর্মে হিন্দু, তাহারা গঙ্গাস্নান করে এবং কালী মন্দিরে পূজা দেয়, গো-মাতাকেও পবিত্র মনে করে, কিন্তু তবু বাঙালীদের সঙ্গে তাহাদের ব্যবধান বিস্তর, উভয়ের মধ্যে যেন দুর্ভেদ্য চীনা প্রাচীর বর্তমান।
আমার বক্তব্য এই যে, জাতিভেদ বাঙালীর বর্তমান দুর্ভাগ্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী। যদি বাঙালী ও মাড়োয়ারীর মধ্যে বিবাহের প্রথা থাকিত তবে উভয়ের মিশ্রণের ফলে এমন একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর লোক হইত, যাহাদের মধ্যে উভয় জাতির গুণই বর্তমান থাকিত। এক জন বিড়লা যদি কোন মুখোপাধ্যায়ের কন্যাকে বিবাহ করিত, তাহা হইলে তাহাদের সন্তানেরা একের ব্যবসা বুদ্ধি এবং অন্যের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক লাভ করিত। গোয়েঙ্কার কন্যার সঙ্গে বসুর ছেলের বিবাহ হইলে তাহাদের সন্তানের মধ্যে উভয় জাতির গুণেই থাকিত। প্রসিদ্ধ ব্যবহারশাস্ত্রবিৎ স্যার হেনরী মেইন বলিয়াছেন যে, মানবজাতির সামাজিক প্রথা সমূহের মধ্যে জাতিভেদের মত এমন অনিষ্টকর কু-প্রথা আর নাই। তাঁহার এই কথা একটুও অতিরঞ্জিত নহে। বিবাহের কথা দূরে থাকুক, পরস্পরের মধ্যে আহার ব্যবহারও নাই। এমন কি মাড়োয়ারীদের মধ্যেও কয়েকটি শাখা জাতি আছে, যথা—আগরওয়ালা, অসোয়াল, মহেশ্বরী প্রভৃতি—ইহাদের পরস্পরের মধ্যেও বিবাহ হয় না। ফলে এই হইয়াছে যে, বাঙালী ও মাড়োয়ারী পরস্পরের মধ্যে দুরতিক্রম্য ব্যবধান। সাধারণ বাঙালীরা ল্যাপল্যাণ্ডবাসীদের সামাজিক প্রথা আচার ব্যবহার সম্বন্ধে যেমন কিছুই জানে না, মাড়োয়ারীদের সম্বন্ধেও তেমনি কিছুই জানে না। মাড়োয়ারীদেরও বাঙালীদের সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নাই। ঐশ্বর্যশালী জৈন সম্প্রদায় সম্বন্ধেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য (মাড়োয়ারীদের মধ্যেও কেহ কেহ জৈন ধর্মাবলম্বী)। মাড়োয়ারী, জৈন এবং হিন্দুস্থানী ক্ষেত্রীরা বহু পুরুষ হইল বাংলা দেশে বসবাস করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে ব্যবসা বুদ্ধি বিশেষ রূপে বিকাশপ্রাপ্ত হইয়াছে। কিন্তু বাঙালীর দুর্ভাগ্যক্রমে সে ইহাদের স্বজাতীয় বলিয়া গণ্য করিতে পারে নাই। মাড়োয়ারী প্রভৃতিদের মধ্যে ব্যবসা বুদ্ধি বংশানুক্রমিক, কিন্তু তাহাদের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি নাই। সেই জন্য তাহারা কেবল সঙ্কীর্ণচেতা নহে, ঘোর কুসংস্কারেরও বশবর্তী। তাহারা কোন ভাল কাজে হয়ত টাকা দিতে আপত্তি করিবে, কিন্তু একজন বাবাজী বা গেরুয়াধারীর পাল্লায় পড়িয়া পূজা হোমের জন্য সহস্র সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিবে; তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া জুয়াখেলায় হাজার হাজার টাকা নষ্ট করিবে। এই ভাবে কত অর্থের অপব্যয় হয়, আমি তাহার কিছু খবর রাখি। সাধারণ বাঙালী সাহা বা তিলিরাও এবিষয়ে মাড়োয়ারী, জৈন প্রভৃতিরই মত। তাহারা অনেক সময় মাড়োয়ারীদের উপরেও টেক্কা দেয়।
আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্র ‘স্যার তারকনাথ পালিত রিসার্চ্চ স্কলার’ ছিলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলন এবং চিরকৌমার্যের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়া দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি পূর্ব বঙ্গে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, এবং অবনত শ্রেণীদের শিক্ষা ও উন্নতি সাধনের জন্য কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন। ঐ অঞ্চলে বহু ধনী সাহা ব্যবসায়ী আছেন। একদিন তিনি তাঁহাদের এক জনের নিকট গেলেন এবং বিদ্যালয়ের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু উক্ত ব্যবসায়ী তাঁহার প্রার্থনায় কর্ণপাত করিলেন না। এমন সময়ে একজন দাড়িওয়ালা বাবাজী আসিয়া উপস্থিত হইল। তৎক্ষণাৎ ঐ ব্যবসায়ীটি বাবাজীর পদতলে পড়িয়া মিনতি করিয়া বলিলেন, “প্রভু, আমি আপনার ও আপনার চেলাদের কি সেবা করিতে পারি?” সাধু চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া উত্তেজিত ভাবে প্রথমেই এক সের গাঁজা (মূল্য প্রায় ৮০৲ টাকা) দাবী করিলেন। গাঁজা দেওয়া হইলে সাধু কিঞ্চিৎ শান্ত হইলেন। তারপর আটা, ঘি, প্রভৃতি বহুবিধ খাদ্যদ্রব্যের তালিকা হইল। এই সব খাদ্যে সাধু ও তাঁহার নিষ্কর্মা চেলাদের উদর পূজা হইবে। এক কথায় ব্যবসায়ীটি কোন দ্বিধা না করিয়া সাধু ও তাঁহার চেলাদের জন্য তখনই পাঁচ শত টাকা খরচ করিয়া ফেলিলেন, কেন না তাঁহার মতে উহা পুণ্য কার্য। কিন্তু তিনিই আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পাঁচটি টাকা দিতে অসম্মত হইলেন, যদিও ঐ বিদ্যালয়ের দ্বারা তাঁহার স্বজাতীয় ছেলেরাই অধিকতর উপকৃত হইবে।[১১]
আমি আর একটি দৃষ্টান্ত দিব। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলার নূতন গৃহের জন্য অতি কষ্টে সাধারণের চাঁদা হইতে আট হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছেন। আর তাহারই দুই এক মাইলের মধ্যে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী জয়পুর হইতে আনীত শ্বেত ‘মাক্রানা’ প্রস্তরের একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছেন! এই বহুমূল্য প্রস্তর দিয়াই কলিকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মিত হইয়াছে।[১২] ঐ মন্দিরে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর প্রায় ছয় লক্ষ টাকা ব্যয় হইয়াছে। ইহার উপর মন্দির সংলগ্ন একটি ধর্মশালার জন্যও তিনি অনেক টাকা ব্যয় করিয়াছেন। আর একজন ধনী মাড়োয়ারী, হিন্দুদের প্রসিদ্ধ তীর্থ পুষ্কর ক্ষেত্রে ১২ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছেন!
এই সব মন্দির ও ধর্মশালায় সেকেলে গোঁড়া পুরোহিত এবং গাঁজাখোর সাধুদেরই আড্ডা। সুতরাং এই সব দান হইতে সমাজের খুব কমই উপকার হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কেবল মাড়োয়ারীদের দায়ী করিয়া কি হইবে? কচ্ছী মেমন এবং নাখোদা মুসলমানেরা কলিকাতার ধনী ব্যবসায়ী, কিন্তু তাহাদের কোন শিক্ষা ও সংস্কৃতি নাই এবং তাহাদের দৃষ্টি মাড়োয়ারীদের মতই সঙ্কীর্ণ, তাহারা মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কার করিতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিবে, কিন্তু বিদ্যালয় বা হাঁসপাতাল নির্মাণের জন্য এক পয়সাও দিবে না। হালের একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি:—
“কচ্ছী মেমন বা নাখোদা মুসলমানদের বদান্যতায় জাকেরিয়া স্ট্রীটে—বাংলার মধ্যে বৃহত্তম মসজিদ নির্মিত হইতেছে। ইহার জন্য ব্যয় পড়িবে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। ভারতে এরূপ মসজিদ আর নাই। ইমারতটি চারতলা হইবে এবং স্থাপত্য শিল্প ও সৌন্দর্যের অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন হইবে। প্রধান গম্বুজের উচ্চতা হইবে ১১৬ ফিট, দুইটি প্রধান মিনার ১৫১ ফিট করিয়া উচ্চ হইবে এবং তাহার নীচে ২৫টি ছোট ছোট মিনার থাকিবে। এম. এস. কুমার মসজিদটির নক্সা প্রস্তুত করিয়াছেন এবং তাঁহারই তদারকীতে উহা নির্মিত হইতেছে।”—The Illustrated Weekly Hindu (27th July, 1980).
এবিষয়ে মাদ্রাজ সৌভাগ্যশালী, চেটিদের মধ্যে অনেকেই ধনী মহাজন ও ব্যাঙ্কার। তাহারা মাদ্রাজ প্রদেশেরই লোক। তাহারা যে অর্থ উপার্জন করে, তাহা মাদ্রাজেই থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহাদের দৃষ্টান্ত সঙ্কীর্ণ ও অনুদার। একজন অন্নমালী চেটিয়ার (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বলিলেও হয়। এই সব চেটিয়া মন্দির সংস্কার এবং বিগ্রহের অলঙ্কারে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে।[১৩]
গঙ্গাসাগর স্নানের সময় (মকর সংক্রান্তিতে সহস্র সহস্র যাত্রী পুণ্য লাভার্থে ব্যয় এবং ধনী মাড়োয়ারীরা বাবাজী ও ভিক্ষুকদের যাতায়াতের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে। তাহারা মনে করে উহাতে তাহাদের পুণ্য হইবে। আজিমগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ) ও অন্যান্য স্থানে বহু ধনী জৈন আছেন; তাঁহারা ঐ সব স্থানে প্রায় তিন শত বৎসর হইল বাস করিতেছেন। তাঁহারা আবু পর্বত এবং পলিতানায় (গুজরাট) প্রতি বৎসর তীর্থ দর্শনে যান। তাঁহারা এই উপলক্ষ্যে এক এক জন ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করিয়া থাকেন। মধ্যযুগে ইয়োরোপীয় খৃষ্টানদের মনে জেরুজেলাম তীর্থে ক্রুজেড সম্বন্ধে যেরূপ মনোভাব ছিল, এই জৈনদের মনোভাবও অনেকটা সেইরূপ। যে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলাম, তাহা ব্যতিক্রম নহে, সাধারণ নিয়ম এবং উহা হইতেই ব্যাপার কিরূপে দাঁড়াইয়াছে বুঝা যাইতে পারে।
শুধু, মাড়োয়ারী বা জৈনদের দোষ দিলেই বা কি হইবে, যাঁহারা চিন্তানায়ক হইবার দাবী করেন, এখন সব কলেজে শিক্ষিত বাঙালীরাও, পৌরোহিত্যের কুসংস্কার আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছেন এবং নানা অসম্ভব গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা পোষণ করেন। তাঁহারাও সাধারণ লোকদের মতই সাধুদের মোহে প্রলুব্ধ ও প্রতারিত হন। মুন্সীগঞ্জের সত্যাগ্রহই তাহার দৃষ্টান্ত। সেখানকার উকীলেরা (কেহ কেহ তন্মধ্যে এম. এ. বি. এল.) নিম্নজাতীয়দিগকে মন্দিরে প্রবেশ করিতে দিতেছেন না।[১৪]
অ্যানড্রু কার্নেগী কেবল তাঁহার নিজের জন্মভূমিতে নয়, তাঁহার বাসভূমিতেও ‘শ্রমিক প্রতিষ্ঠান’ স্থাপন করিবার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়াছেন। তিনি আমেরিকাতে ‘গবেষণা মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন এবং স্কটল্যাণ্ডের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও বহু অর্থ দান করিয়াছেন। রকফেলারও ঐ উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়াছেন। চীনাদের উন্নতির জন্য এবং গ্রীষ্মদেশীয় রোগ সমূহ (tropical diseases) নিবারণের জন্যও তিনি অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়াছেন। যদি সাপ্তাহিক ‘লণ্ডন টাইমসের’ কোন একটি সংখ্যা পড়া যায়, তাহা হইলে দেখা যাইবে, বহু ধনী নিজেদের উইলে লোকহিতের জন্য দান করিয়াছেন এবং ইহার মধ্যে ‘অপাত্রে দান’ খুব কমই আছে। বৎসরের পর বৎসর এইরূপে বহু দানে বিদ্যালয় ও হাঁসপাতাল সমূহ পুষ্ট হইতেছে অথবা নূতন বিশ্ববিদ্যালয়, বা যক্ষা, ক্যান্সার, গ্রীষ্ম দেশীয় রোগ সমূহ সম্বন্ধে গবেষণা করিবার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অর্থ জমা হইতেছে।[১৫]
‘বার্নাডোস হোমস’, যক্ষ্মানিবাস, সহরের জনবহুল অঞ্চলে নূতন পার্ক, কৃষির উন্নতি, গোজাতির উন্নতি—এই সব কাজে পাশ্চাত্যের দাতারা প্রতিনিয়তই অর্থ দান করিতেছেন। আর আমাদের দেশে ধনী ব্যবসায়ীদের শিক্ষা দীক্ষা নাই, তাহাদের দৃষ্টি অনুদার, সঙ্কীর্ণ, তাহারা বহু অর্থ ব্যয় করিয়া যে সব মন্দির নির্মাণ বা সংস্কার করে, সেগুলি কেবল চরিত্রহীন পুরোহিত এবং গাঁজাখোর বাবাজী ও সাধুদের আড্ডা।
ভারতের মধ্যে কেবল একটি সম্প্রদায় ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি করিয়াছে। পক্ষান্তরে শিক্ষা সংস্কৃতিতেও তাঁহারা উন্নত, তাঁহাদের মধ্যে বহু দাতা ও দেশহিতৈষীর উদ্ভব হইয়াছে। আমি বোম্বাইয়ের পার্শীদের কথা বলিতেছি। তাঁহাদের সংখ্যা অতি অল্প—মোট এক লক্ষের বেশী নহে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে উদার দৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বদান্যতার অভাব নাই। ইংরাজ ও আমেরিকান লোকহিতৈষী দাতাদের সঙ্গে তাঁহাদের তুলনা করা যাইতে পারে। জে. এন. টাটা, কামা, জিজিভাই, ওয়াদিয়া প্রভৃতি কয়েকটি প্রসিদ্ধ পরিবার ব্যতীতও, এমন বহু পার্শী ধনী পরিবার আছেন, যাঁহারা দানশীলতার জন্য বিখ্যাত।[১৬]
গুজরাটীরা কর্মশক্তি ও লোকহিতৈষণায় পার্শীদের চেয়ে পশ্চাৎপদ নহে। বিঠলদাস ঠাকুরসী অথবা গোকুলদাস তেজপাল ব্যতিক্রম নহেন। পুরুষোত্তমদাস ঠাকুরদাসের মত লোক স্ব-সম্প্রদায়ের অলঙ্কার স্বরূপ। তিনি যে কেবল বিচক্ষণ ব্যবসায়ী তাহা নহে, আধুনিক অর্থনীতি শাস্ত্রেও তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্য। মাড়োয়ারীদের সঙ্গে তুলনার গুজরাটীরা অধিকতর উদার দৃষ্টি সম্পন্ন এবং দেশানুরাগী। লোকহিতের জন্য নিজের স্বার্থবুদ্ধি কিরূপে সংযত করিতে হয়, মাড়োয়ারীদের সে বিষয়ে এখনও অনেক শিখিবার আছে। সে কেবল স্বার্থের প্রেরণায় অর্থোপার্জন করে। গুজরাটে একটি প্রচলিত কথা আছে—“তমে মাড়োয়ারী থেই গেয়া”—(তুমি মাড়োয়ারী হইয়াছ)। ইহা তিরস্কার বাক্য রূপে ব্যবহৃত হয়।
বাংলার আর একটি দুর্ভাগ্যের কথা বলিব যে সমস্ত মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া এ দেশে কয়েক পুরুষ ধরিয়া বাস করিতেছে, তাহারাও বাংলাকে নিজেদের দেশ বলিয়া মনে করে না। তাহারা বাঙালীর ব্যবসা বাণিজ্য দখল করিয়া প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিতেছে। কিন্তু এই ঐশ্বর্য হইতে, তাহাদের বাসভূমি বাংলার কোন উপকার হয় না। কলিকাতার অধিকাংশ ধনী ব্যবসায়ী বিকানীরের লোক এবং তাহারা বিকানীরেই নিজেদের ঐশ্বর্য লইয়া যায়। ব্রিটিশেরা যতদিন বাংলায় থাকে, ততদিন খানসামা, বাবুর্চী, আয়া প্রভৃতির বেতন বাবদ এবং মুরগী, ডিম, মাছ প্রভৃতি কিনিয়া কিছু টাকা বাংলায় দেয়। কিন্তু মাড়োয়ারী এ দিক দিয়াও বাংলাকে এক পয়সা দেয় না। সে তাহার নিজের খাদ্য দ্রব্য আটা, ডাল, ঘি প্রভৃতি নিজের দেশ হইতে লইয়া আসে। তাহার ভৃত্যরাও হিন্দুস্থানী এবং নিরামিষভোজী বলিয়া তাহারা মুরগী, ডিম, মাছ প্রভৃতিও কিনে না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাতাদের দানের পরিমাণ প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা, কিন্তু কোন মাড়োয়ারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু দান করে নাই। নাগপুরের যে ধনী ব্যবসায়ীর কথা পূর্বে বলিয়াছি, মাড়োয়ারী ধনীদের মনোবৃত্তি অনেকটা সেইরূপ।[১৭]
মাড়োয়ারীরা বাংলাদেশের অথবা মধ্য প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য উদার ভাবে দান করিতে কুণ্ঠিত। যে দেশে সে ঐশ্বর্য সঞ্চয় করে, সে দেশ তাহার নিকট হইতে কোন উপকার পায় না। কিন্তু আর একজন শিক্ষিত ও ধনী হিন্দুর নাম আমি উল্লেখ করিব। যে দেশে তিনি অর্থোপার্জন করিয়াছেন, সেই দেশের প্রতি তাঁহার কৃতজ্ঞতার ঋণ স্মরণ করিয়া, তিনি উহার প্রতিদানে প্রায় সমস্ত সম্পত্তি দিয়াছেন। ইনি রাও বাহাদুর লক্ষ্মীনারায়ণ, কাম্তীর ব্যবসায়ী। সম্প্রতি (নভেম্বর, ১৯৩০) নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থার জন্য তিনি ৩০ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।
কলিকাতার ধনী মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের নিকট আমি ক্ষমা লাভের প্রত্যাশী। মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের বিরদ্ধে মাড়োয়ারী বলিয়াই আমার কোন অভিযোগ নাই। তাহারা মোটেই কৃপণ নহে; যখনই কোন স্থানে বন্যা বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখনই তাহারা মুক্তহস্তে দান করে। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব এবং সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির জন্য তাহার দান অনেক সময়ই অপাত্রে ন্যস্ত হয়। সুখের বিষয়, ইহার ব্যতিক্রম আছে। ঘনশ্যাম দাস বিড়লার মত লোক যে কোন সম্প্রদায়ের গৌরব স্বরূপ। ভারতের আর একজন মহৎ সন্তান, যিনি দেশপ্রেম, অতুলনীয় ত্যাগ ও অশেষ বদান্যতায় দেশবাসীর চিত্তে স্থায়ী আসন অধিকার করিয়াছেন সেই শেঠ যমুনালাল বাজাজও এই মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের লোক। আশার কথা, মাড়োয়ারীদের মধ্যে, বিশেষভাবে আগরওয়ালা শাখার মধ্যে, ধীরে ধীরে নব জাগরণ হইতেছে।[১৮]
সম্প্রতি আমি কয়েকজন তরুণ মাড়োয়ারীর সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তাহারা মহদন্তঃকরণবিশিষ্ট এবং ভবিষ্যতে মাড়োয়ার, বিকানীর, যোধপুরের মুখে উজ্জ্বল করিবে। কিন্তু বর্তমানে তাহাদের কোন প্রতিষ্ঠা নাই।
এই ছত্রগুলি দুই বৎসর পূর্বে লিখিত হয়। সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা হইতে আমার পূর্বোক্ত অভিযোগগুলি প্রমাণিত হইবে:—
“পিলানী সহর জয়পুরের মহারাজা বাহাদুরের আগমনে সরগরম হইয়া উঠে; গত ৬ই ডিসেম্বর তারিখে উক্ত সহরে নূতন বিড়লা কলেজ ভবনের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যেই মহারাজার আগমন হইয়াছিল।”
“১৯২৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে উন্নীত হয় এবং ছাত্রাবাসের জন্য প্রকাণ্ড গৃহ সমূহ নির্মিত হয়। রাজা বলদেওদাস বিড়লা এই বিদ্যালয়ের একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন এবং উহার ব্যয় নির্বাহের জন্য ‘বিড়লা এডুকেশন ট্রাষ্ট’ করেন। ট্রাষ্টের ভাণ্ডারে এখন ১২ লক্ষ টাকা জমা হইয়াছে। ১৯২৯ সালে স্কুলটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পরিণত হয়, ১৯৩০ সালে উহার সঙ্গে বাণিজ্য শিক্ষার ক্লাস যোগ করা হয়।”— লিবার্টি, ৮ই ডিসেম্বর ১৯৩১।
বিড়লারা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২৬ হাজার টাকা দান করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের জন্মভূমিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁহারা ১২ লক্ষ টাকারও বেশী দান করিয়াছেন। বিড়লা ভ্রাতারা বাংলা দেশে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়া থাকেন, কিন্তু বাংলায় বাস তাঁহাদের নিকট প্রবাস মাত্র।
স্মরণ রাখিতে হইবে, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং উদার দৃষ্টির দিক দিয়া, বিড়লারা উচ্চশ্রেণীর মাড়োয়ারী। কিন্তু তবু, তাঁহারা তাঁহাদের জাতিগত সঙ্কীর্ণতা এবং গ্রাম্য অনুদার ভাব ত্যাগ করিতে পারেন না।
(৪) হিন্দু রক্ষণশীলতার পুনরভ্যুদয় ভারতের
উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ
আমাদের বহু হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা গীতায় উচ্চাঙ্গের অধ্যাত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবেন, হিন্দু ধর্মের সার্বভৌমিক উদারতা এবং অন্য ধর্মের চেয়ে তাহার শ্রেষ্ঠতার ব্যাখ্যা করিবেন, অস্পৃশ্যতার তীব্র নিন্দা করিবেন। কিন্তু যখন এই সব তত্ত্ব ও উপদেশ কার্যে পরিণত করিবার সময় উপস্থিত হয়, তখন তাঁহারাই সর্বাগ্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। অধ্যাপক ওয়াদিয়া বলিয়াছেন:—
“আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা হিন্দুধর্মের উদারতা সম্বন্ধে অজস্র শ্লোক উদ্ধৃত করেন, কিন্তু যদি কেহ সেগুলি আন্তরিক বলিয়া গ্রহণ করেন, তবে তিনি একান্তই নিরাশ হইবেন। উদ্ধৃত শ্লোকগুলি কেবল লোকদেখানোর জন্য, কাজ করিবার জন্য নহে। আমার মনে হয় যে, হিন্দুধর্মকে উদার ও সার্বভৌম প্রমাণ করিবার জন্য এত বেশী সময় ব্যয় করা হইয়াছে যে, তদনুসারে কাজ করিবার সময় পাওয়া যায় নাই! ভয় হইতেই নির্যাতন আসে; এই ভয়কে জয় না করিলে, কেহই পূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভ করিতে পারে না।”—দার্শনিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতা (ডিসেম্বর, ১৯৩০)।
সুতরাং, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, হিন্দুসভা এবং সংগঠনের ঝুড়ি ঝুড়ি বক্তৃতা সত্ত্বেও, প্রত্যহই বহু হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতেছে। কেনই বা করিবে না? সামাজিক ব্যাপারে, ইসলাম জাতি, বর্ণ অথবা মতামতের পার্থক্য স্বীকার করে না। অস্পৃশ্যতা ইসলাম ধর্মে অজ্ঞাত। কার্লাইলের মতে, ইহা মানুষের মধ্যে সাম্যবাদের প্রচার করে। কার্লাইল অন্যত্র বলিয়াছেন,—“যে মানুষের কথা শুনিয়া বুঝা যায় না, সে কি করিবে বা কি করিতে চায়, তাহার সঙ্গে কোন কাজ করা অসম্ভব। সেই মানুষকে তুমি বর্জন করিবে, তাহার সংস্পর্শ হইতে দূরে থাকিবে।” আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, নমঃশূদ্র বন্ধুরা হিন্দু নেতাদের ভণ্ডামীতে বিরক্ত হইয়া অন্য ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করিতে উদ্যত হইবে।[১৯] হিন্দু সমাজের জটিল ব্যবস্থা ও স্তরভেদের মধ্যে বহু দুর্বল স্থান আছে। এক দিকে মুষ্টিমেয় উচ্চশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোক—ইহারা প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণীয়; আর এক দিকে লক্ষ লক্ষ অনুন্নত শ্রেণীর লোক, ইহারা সকলেই নিম্ন জাতির। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ইহাদেরই মধ্যে গণ্য। সুতরাং শোষোক্ত শ্রেণী যে উচ্চ শ্রেণীদের আহ্বানে সাড়া দিবে না, ইহা স্বাভাবিক। বিশাল হিন্দু সমাজ বিস্তীর্ণ সমুদ্রের মত; বিভিন্ন জাতি এবং উপজাতি উহার স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মত ছড়াইয়া আছে—তাহাদের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। একই ভাব ও জীবন-প্রবাহ এই সমাজের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত নহে। উচ্চবর্ণীয় ও নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে নিয়ত কোলাহলে—এই সমাজের অনৈক্য ও বিচ্ছেদের ভাব প্রকাশ পাইতেছে।
রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই ‘অচলায়তন’ হিন্দু সমাজের নানা অর্থহীন প্রথা ও জীর্ণ আচারের নিন্দা করিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধীর ৬৩তম জন্মদিনে—রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর নিকট যে বাণী প্রদান করেন, তাহাতে তিনি বলিয়াছেন:—
“যুক্তিহীন কুসংস্কার, জাতিভেদ এবং ধর্মের গোঁড়ামি, এই তিন মহাশত্রুই আমাদের সমাজের উপর এতদিন প্রভুত্ব করিয়া আসিতেছে। সমুদ্রপার হইতে আগত যে কোন বিদেশী শত্রুর চেয়ে উহারা ভয়ঙ্কর। এই সব পাপ দূর করিতে না পারিলে, কেবল মাত্র ভোট গণনা করিয়া বা রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করিয়া আমরা স্বাধীনতা লাভ করিতে পারিব না। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে এই কথাই আমাদের স্মরণ করিতে হইবে, কেননা মহাত্মাজী নবজীবনের সাহস এবং স্বাধীনতালাভের দুর্জয় সঙ্কল্প আমাদিগকে দান করিয়াছেন। জড়তা ও অবিশ্বাস হইতে আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতা—মহাত্মা তাঁহার অতুলনীয় চরিত্র প্রভাবে এই বিরাট আন্দোলনই দেশে সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা আমরা উপলব্ধি করিতেছি। সেই সঙ্গে ইহাও আমরা আশা করি যে, এই আন্দোলনে জাতির মনে যে শক্তি সঞ্চার হইবে, তাহার ফলে আমাদের বহু দিনের সামাজিক কুপ্রথা এবং জীর্ণ আচারের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল রাশিও দূর হইবে।”
(৫) বংশানুক্রম ও আবেষ্টন—সুপ্রজনন বিদ্যা—
আমার জীবনে ঐগুলির প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা
একটি দরিদ্র কৃষক বালিকা তাহার পিতার মেষপাল চরাইতে চরাইতে, এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্য দর্শন করিল। সে স্পষ্ট দৈববাণী শুনিতে পাইল;—দৈববাণী তাহাকে অর্লিন্সকে পরাধীনতা হইতে মুক্ত করিবার জন্য অনুজ্ঞা দিতেছে। সে অমানুষিক শক্তি লাভ করিল এবং বহু দুঃসাহসিক বীরত্ব প্রদর্শন করিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাট্যকার “সোয়ান অব অ্যাভন” (অ্যাভনের শ্বেত হংস) বাণীর বরপুত্র সেক্সপীয়রের পিতামাতা কবিত্বের ধার ধারিতেন না ও নিরক্ষর ছিলেন। যীশু, মহম্মদ, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, অথবা নিউটনের জীবনে এমন কোন গুণ ছিল না, যাহাকে বংশানুক্রমিক মনে করা যাইতে পারে।
প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ উইলিয়ম হার্শেল হ্যানোভার সহরের সৈন্যবিভাগের একজন কর্মচারীর পুত্র ছিলেন। হার্শেলের মাতার সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, “তিনি নিজে লিখিতে জানিতেন না, বিদ্যাচর্চার প্রতি বিমুখ ছিলেন, নবযুগের ভাবধারাও তাঁহার মনকে স্পর্শ করে নাই। কিন্তু তাঁহার পুত্রকন্যাদের সকলেরই সঙ্গীত বিদ্যার প্রতি অনুরাগ ছিল, হার্শেল ১৭ বৎসর বয়সে ইংলণ্ডে গিয়া অর্গানবাদক এবং সঙ্গীতশিক্ষকরূপে জীবিকা অর্জন করেন। প্রত্যহ প্রায় ১৪ ঘণ্টা কাল অর্গান বাজাইয়া ও সঙ্গীত শিক্ষা দিয়া তিনি রাত্রিকালে নির্জনে গণিত শাস্ত্র, আলোকবিদ্যা, ইটালীয় অথবা গ্রীক ভাষা—অধ্যয়ন করিতেন। এই সময়ে তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রও অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করেন।” (লজ)।......“আলোকবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা তিনি গভীর ভাবে আলোচনা করিতেন, বালিশের পরিবর্তে বই মাথায় দিয়া ঘুমাইতেন, আহারের সময়েও পড়িতেন এবং অন্য কোন বিষয় চিন্তা করিতেন না। তিনি জ্যোতিষের সমস্ত অত্যাশ্চর্য রহস্য জানিবার জন্য সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। যে গ্রেগোরিয়ান রিফ্লেক্টর যন্ত্র তিনি ব্যবহার করিতেন, তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া, তিনি নিজে দূরবীক্ষণ তৈরী করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি তাঁহার শয়ন গৃহকেই কারখানায় পরিণত করিলেন এবং অবসর সময়ে দর্পণ লইয়া ঘষা-মাজা করিতে লাগিলেন।” “সঙ্গীত সম্বন্ধে প্রতিভার পশ্চাতে বংশানুক্রমিক গুণ থাকা চাই, এ কথা হ্যাণ্ডেলের জীবনে প্রমাণিত হয় না। তাঁহার পরিবারের কেহই সঙ্গীত বিদ্যা জানিত না। বরং হ্যাণ্ডেলের পিতামাতা তাঁহার বাল্যকালে তাঁহাকে গান বাজনা করিতে দিতেন না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও হ্যাণ্ডেল সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া আট নয় বৎসর বয়সে সুরশিল্পী হইয়া উঠিলেন।” রামমোহন রায় গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ সময়ে সমাজে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামি প্রবল ছিল। কৈশোর বয়সেই একেশ্বর বাদ সম্বন্ধে তিনি পার্সীতে একখানি পুস্তিকা লেখেন,—উহার ভূমিকা ছিল আরবী ভাষায়। তাঁহার এই বিপ্লবমূলক সামাজিক মতবাদের জন্য তিনি পিতৃগৃহ হইতে বিতাড়িত হইলেন। এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। বস্তুতঃ গ্যাল্টন, কার্ল পিয়ার্সন প্রভৃতি বংশানুক্রমিক বিদ্যার ব্যাখ্যাতারা যেখানে বংশগত গুণের একটি দৃষ্টান্ত দিবেন, তৎস্থলে তাহার বিপরীত নয়টি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে।
কেবল সহোদর ভ্রাতাদের নয়, যমজ ভ্রাতাদেরও রুচি, প্রবৃত্তি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকমের দেখা যায়। মহাকবি মিলটন ক্রমওয়েলের একজন প্রধান সমর্থক; পক্ষান্তরে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্রিষ্টোফার ইংলণ্ডের গৃহযুদ্ধের সময় রাজতন্ত্রবাদী ছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে তিনি কেবল পোপের প্রতি ভক্তিসম্পন্ন হন নাই, দ্বিতীয় জেমসের রাজত্বে বিচারকের পদও গ্রহণ করিয়াছিলেন। রাজশক্তিকে তিনি সর্বদা সমর্থন করিবেন, এরূপ প্রতিশ্রুতিও দিয়াছিলেন।[২০]
সুপ্রজনন বিদ্যা সম্বন্ধে আমার এত কথা বলিবার কারণ এই যে, আমি আমার নিজের রুচি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলিতে চাই। আমার চরিত্রের কোন কোন বৈশিষ্ট্য পৈতৃক ধারা হইতে প্রাপ্ত মনে করা যাইতে পারে। কিন্তু আমার বাল্যকালেই আমি যে ব্যবসা বুদ্ধি লাভ করিয়াছিলাম, তাহার কোন বংশানুক্রমিক ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি পূর্বেই বলিয়াছি কৃষিকার্যের প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ ছিল। আমি কোদাল দিয়া মাটী কাটিতাম, এবং নিজে চাষ করিয়া বীজ বুনিয়া নানারূপ ফসল উৎপাদন করিতাম। গোবর, ছাই এবং গলিত পত্রের সার দিয়া জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করিতাম। কৃষকেরা যে প্রণালীতে চাষ করিত, তাহা আমি মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করিতাম। আমি দেখিতাম, যে পোড়া পাতার ছাই ব্যবহারে জমির উর্বরতা বাড়ে এবং ঐ জমিতে কচু ও কলা প্রভৃতি ভাল হয়। অবশ্য, আমি তখন জানিতাম না যে,—গাছের পাতার ছাইয়ে যথেষ্ট পরিমাণে পটাশ আছে। অন্য নানা রকম ফসলও আমি জন্মাইতাম। আমি এই সব কাজ ইচ্ছা মত করিতে পারিতাম, কেননা আমার পিতামাতা এ বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দিতেন এবং এই উদ্দেশ্যে মজুর প্রভৃতি কাজে লাগাইবার জন্য অর্থও দিতেন। অর্দ্ধ শতাব্দী পূর্বে আমি যে নারিকেল ও সুপারির গাছ রোপণ করিয়াছিলাম, তাহা এখনও বাল্যের মধুর স্মৃতি জাগরুক করে। কলিকাতায় আসিবার পর হইতে আমি গ্রীষ্মের ছুটী ও শীতের ছুটীর প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম,—ঐ সময়ে বাড়ী গিয়া মনের সাধে চাষের কাজ করিতে পারিব, ইহাই ভাবিতাম। আমার স্বভাবগত ব্যবসাবুদ্ধিও এই সময়ে প্রকাশ পাইত। আমাদের জমিতে যে ফসল হইত তাহার সামান্য অংশই পরিবারের প্রয়োজনে লাগিত। উদ্বৃত্ত ফসল হাটে বাজারে বিক্রয় করিতে হইত। ইহাতে চাষের খরচা উঠিয়া লাভের সম্ভাবনা থাকিত।
এই সময় হইতে আমার দোকানদারী বুদ্ধি বা ব্যবসাবুদ্ধির[২১] বিকাশ হইল। গ্রামের জমীদারের ছেলে হইয়া জমির ফসল হাটে বাজারে বিক্রয় করি, ইহাতে আমাদের কোন কোন প্রতিবেশী লজ্জা বোধ করিতেন। কিন্তু আমি উহা গ্রাহ্য করিতাম না। কয়েক বৎসর পরে আমার এই ব্যবসাবুদ্ধি বিপদে আমার সহায় স্বরূপ হইল। আমার পিতা ভাবপ্রবণ লোক ছিলেন, এক সময়ে তিনি ঝোঁকের মাথায় একটি কাজ করিয়া লোকসান দিয়াছিলেন। এইচ. এইচ. উইলসনের সংস্কৃত-ইংরাজী অভিধান ঐ সময়ে দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ৪০।৫০ টাকাতেও উহার এক খণ্ড পাওয়া যাইত না। একজন পণ্ডিত ব্যক্তি আমার পিতাকে ঐ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিতে সম্মত করেন। পণ্ডিত নিজে পুস্তকের মুদ্রণ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করিবার ভার লইলেন এবং পিতাকে বুঝাইলেন বই বিক্রী করিয়া খুব লাভ হইবে। বই ছাপা হইল। কিন্তু আশানুরূপ বিক্রয় হইল না এবং আমার পিতার প্রায় সাত হাজার টাকা লোকসান হইল। তখনকার দুইজন সপরিচিত সংস্কৃত গ্রন্থ প্রকাশক পণ্ডিত জীবানন্দ বিদ্যাসাগর এবং ভুবনমোহন বসাক প্রতি কপি নাম মাত্র দুই টাকা মূল্যে কয়েক শত বই কিনিলেন। তাঁহারা ব্যবসায়ী লোক ছিলেন, সুতরাং বই বিক্রয় করিয়া তাঁহাদের বেশ লাভ হইল। কিন্তু অবশিষ্ট কয়েক শত খণ্ড বই আমাদের বাড়ীতেই রহিল। আমি পুরানো কাগজের দরে উহা বিক্রী করিতে রাজী হইলাম না। আমি সযত্নে সেগুলি বাঁধাই করিয়া রাখিলাম। বাংলার আর্দ্র জল বায়ুতে উই ও কীটের হাত হইতে এই সমস্ত বই রক্ষা করা দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু আমার যত্ন ও পরিশ্রমের পুরষ্কার কয়েক বৎসর পরে মিলিল। ১৮৭৮ সালে আমাদের কলিকাতার বাসা তুলিয়া দিতে হইল, কেননা পিতা তখন ঋণগ্রস্ত হইয়া সব দিকে খরচ কমাইতে বাধ্য হইলেন। ৮০নং মুক্তারাম বাবুর ষ্ট্রীটের একটি বাড়ীতে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলাম। এই সময় আমার ব্যবসাবুদ্ধি কাজে লাগিল। পিতা আমার মাসিক খরচের টাকা পাঠাইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। কিন্তু তাঁহার অবস্থা বুঝিয়া, আমি তাঁহাকে এই দুশ্চিন্তা হইতে নিষ্কৃতি দিবার জন্য ব্যস্ত হইলাম। আমি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলাম, উইলসনের অভিধান প্রতি খণ্ড ছয় টাকা মূল্যে বিক্রয় হইবে। কলিকাতার পুস্তক বিক্রেতাদের নিকট হইতে এবং ভারতের নানাস্থান হইতে অর্ডার আসিতে লাগিল। বই বেশ বিক্রী হইতে লাগিল এবং আমি সাহস পূর্বক পুস্তক বিক্রয়ের এজেন্সি খুলিয়া বসিলাম। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র রায় অ্যাণ্ড ব্রাদার্সের নামে উইলসনের অভিধান প্রকাশিত হইয়াছিল, সুতরাং আমার এজেন্সিরও ওই নাম দিলাম। আমার কোন মূলধন ছিল না, সুতরাং অভিধান বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনের নীচে এই কথাটিও লেখা থাকিল—“মফঃস্বলের অর্ডার যত্নের সহিত সরবরাহ করা হয়।” বাড়ীর দরজায় “জি. সি. রায় অ্যাণ্ড ব্রাদার্স, পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক”—এই নামে একখানি সাইন বোর্ড টাঙাইয়া দিলাম। মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম যে, কলেজের পড়া শেষ হইলে আমি পুস্তক বিক্রয়ের ব্যবসা অবলম্বন করিব।[২২] ঐ সময়েও সরকারী চাকরীর প্রতি আমার একটা বিরাগের ভাব ছিল। কিন্তু গিলক্রাইষ্ট বৃত্তি পাইয়া আমার সমস্ত মতলব বদলাইয়া গেল। ভগবানের ইচ্ছায়, আমার যাহা কিছু শক্তি ও যোগ্যতা বিজ্ঞানসেবা ও দেশের অন্যান্য নানা কাজে নিয়োজিত হইল।
- ↑ ইংলণ্ডের সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধের সময়ে সাধারণ শ্রেণীর মধ্য হইতে যে সব বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ভব হইয়াছিল, বাক্ল তাঁহাদের একটি তালিকা দিয়াছেন। উহা হইতে আমরা কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি:
“বড় বড় পাদরী, কার্ডিনাল বা আর্কবিশপ প্রভৃতি দ্বারা যেমন ‘রিফর্মেশানের’ সহায়তা হয় নাই, সমাজের নিম্ন স্তরের সাধারণ লোকদের দ্বারাই হইয়াছে, ইংলণ্ডের বিদ্রোহও তেমনি সমাজের নিম্ন স্তরের অতি সাধারণ লোকদের দ্বারাই হইয়াছে। যে ২।৪ জন উচ্চপদস্থ লোক জনসাধারণের পক্ষে যোগ দিয়াছিলেন, তাঁহারা শীঘ্রই পরিত্যক্ত হইয়াছিলেন এবং যেরূপ দ্রুতবেগে তাঁহাদের পতন হইয়াছিল, তাহাতেই বুঝা গিয়াছিল, হাওয়া কোন দিকে বহিতেছে। যখন অভিজাতবংশীয় সেনাপতিদিগকে বিতাড়িত করিয়া নিম্ন স্তরের মধ্য হইতে সেনাপতিদের নিযুক্ত করা হইল, তখনই ভাগ্যের পরিবর্তন আরম্ভ হইল, রাজতন্ত্রবাদীরা সর্বত্র পরাস্ত হইতে লাগিলেন।...ঐ যুগে দরজী ও শ্রমিকেরাই সাধারণের কাজ চালাইবার যোগ্য বিবেচিত হইল এবং রাষ্ট্রক্ষেত্রে তাহারাই প্রধান স্থান গ্রহণ করিল।...সেই সময়ের তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ভেনার, টাফনেল এবং ওকে। ইঁহাদের মধ্যে যিনি নেতা, সেই ভেনার ছিলেন মদ্য ব্যবসায়ী, তাঁহার সহকারী টাফনেল ছিলেন সূত্রধর, এবং কর্নেলের পদে উন্নীত হইলেও, ওকে ইসলিংটনের একটি মদের কারখানার স্টোরকিপারের কাজ করিতেন।
“এগুলি ব্যতিক্রম নয়। ঐ যুগে লোকের যোগ্যতার উপরই তাহাদের উচ্চ পদ লাভের সম্ভাবনা নির্ভর করিত এবং কোন লোক যোগ্য হইলে তাহার জন্ম যে কুলেই হোক, যেরূপ ব্যবসায়েই সে লিপ্ত থাকুক, তাহার উন্নতি নিশ্চয়ই হইত। স্কিপন একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন, বিদ্যালয়ে কোন শিক্ষা লাভও তিনি করেন নাই; তৎসত্ত্বেও তিনি লণ্ডন সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ক্রমে তিনি সেনাদলের সার্জেণ্ট-মেজর-জেনারেল, আয়র্লাণ্ডের সেনাপতি এবং ক্রমওয়েলের কাউন্সিলের ১৪ জন সদস্যের অন্যতম হইয়াছিলেন—History of Civilization in England. - ↑ হিন্দুদের গল্পে ও কাহিনীতে মুসলমান তাঁতি বা জোলারাই নির্বোধ বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। (গ্রিয়ারসন—Bihar Peasant Life))। হিন্দু তাঁতিরাও ঐ রূপে বিদ্রূপের পাত্র। পক্ষান্তরে ইংলণ্ডের তাঁতিরা তাহাদের বুদ্ধি বলে নানা নূতন আবিষ্কার করিয়া কার্যক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিয়াছে। এ সম্বন্ধে হারগ্রিভস ও অ্যানড্রু কার্নেগীর নাম উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে। তাঁহারা উভয়েই তাঁতির ঘরে জন্মিয়াছিলেন।
- ↑ David Lloyd George by J. N. Edwards.
- ↑ “তৃতীয় শতাব্দীতে এই সংকীর্ণতার অনিষ্টকর ফল দেখা গিয়াছিল। রোমক সমাজ অবসাদে ক্ষয় হইতে লাগিল, একটা গুপ্ত কারণ উহার জীবনী শক্তি নষ্ট করিতে লাগিল। যখন একটা রাষ্ট্রের একটা বৃহৎ সম্প্রদায় দূরে অলস ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে, সাধারণের হিতের জন্য কিছুই করে না,—তখন বুঝিতে হইবে, ঐ রাষ্ট্রের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।” Renan’s Marcus Aurelius.
- ↑ প্রাচীন জাপানে ব্যবসায়ীরা সমাজের নিম্ন স্তরে স্থান পাইত। “কিন্তু নব্য জাপান সভ্যতার পুনর্গঠন করিতে গিয়া দেখিল যে, তাহার বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়—সেই বিরাট কার্যের অযোগ্য। নূতন নূতন শিল্প উৎপাদনের জন্য যে মূলধনের প্রয়োজন, তাহা তাহারা যোগাইতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশের মত আগেকার বৃহৎ শিল্প উৎপাদনের অভিজ্ঞতা তাহাদের নাই। তাহারা সমাজের নিম্ন স্তরে অধীনতার মধ্যে থাকিতেই অভ্যস্ত ছিল। সুতরাং উদ্ভাবনী বা প্রেরণা শক্তি তাহাদের নিকট হইতে আশা করা অন্যায়। সুতরাং প্রথম হইতেই—রাষ্ট্রই এ বিষয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিল; নূতন ব্যবসায়ী শ্রেণী ব্যাঙ্কার, বণিক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রাচীন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হইতে আসে নাই,—সামুরাইদের সম্প্রদায় হইতে আসিয়াছিল। এই সামুরাইদের পূর্ব বৃত্তি এবং বিশেষ অধিকার প্রভৃতি তখন আর ছিল না।” Allen: Japan.
- ↑ “ভিনিসের রাস্তা ও জলপথ যখন জীবনের স্রোতে পূর্ণ হইত, রিয়ালটো যখন বাণিজ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিত, তখন ভিনিস সহরকে কিরূপ দেখাইত, বর্তমানে তাহা কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু ফ্রেট ফেবার, পিয়েট্রো, কাসোলা এবং সর্বোপরি—ফ্রান্সিসকো পেট্রাকের বর্ণনা হইতে আমরা সেই ঐশ্বর্য ও গৌরবের কিছু পরিচয় পাই। পেট্রার্ক সোচ্ছ্বাসে বলিয়াছেন—‘নদীর উপরে আমার গৃহের বাতায়ন হইতে আমি জাহাজগুলিকে দেখিতে পাই, আমার গৃহের চূড়া হইতে জাহাজের মাস্তুলগুলি উচ্চ। তাহারা জগতের সর্বত্র যায় এবং সর্বপ্রকার বিপদের সম্মুখীন হয়। তাহারা ইংলণ্ডে মদ্য লইয়া যায়, সিথিয়ানদের দেশে মধু বহন করে, আসিরিয়া, আর্মেনিয়া, পারস্য ও আরবে জাফ্রান, তৈল, বস্ত্র চালান দেয়; গ্রীস ও মিশরে কাষ্ঠ বহন করে। তাহারা আবার ইয়োরোপের সর্বত্র বহন করিবার জন্য নানা দ্রব্য বোঝাই করিয়া আনে। যেখানে সমুদ্রে শেষ হইয়াছে, সেখানে নাবিকেরা জাহাজ ছাড়িয়া স্থলপথে গিয়া ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করে। তাহারা ককেসাস, পর্বত এবং গঙ্গা নদী অতিক্রম করিয়া পূর্বে সমুদ্রে গিয়া উপনীত হয়।”—The Venetian Republic.
- ↑ “প্রায় অর্থ শতাব্দী ধরিয়া লণ্ডন সহর রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ধর্মসংস্কারের প্রধান সমর্থক ছিল।” মেকলে—ইংলণ্ডের ইতিহাস।
“সহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই পিউরিটানদের প্রাধান্য খুব বেশী ছিল।”—ঐ
“লণ্ডনের ধনী বণিকদের অধিকাংশই ছিল পিউরিটান।” কার্লাইল—“ক্রমওয়েল”।
“লণ্ডন সহরই এই সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমর্থক ও অর্থসাহায্যকারী ছিল।”—ঐ - ↑ প্রণালী উপনিবেশ, ডাচ ইস্ট ইণ্ডিস এবং ফিলিপাইন দ্বীপ পুঞ্জে চীনারা সংখ্যাবহুল এবং শক্তিশালী। প্রধানতঃ তাহাদেরই প্রদত্ত অর্থে চীনের জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছে, সম্পদের দিনে ও বিপদের দিনে সমান ভাবে তাহারা সাহায্য করিয়াছে। মালয়েসিয়ার চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কাণ্টনের অধিবাসীদের বংশধর। তাহারা চীনাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক জাতীয়তাবাদী।”—Upton Close: The Revolt of Asia.
পুনশ্চ—“দক্ষিণ চীন ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্য দিয়া প্রথমে বহির্জগতের সংস্পর্শে আসিয়াছিল।... দক্ষিণ চীনই বণিক, নাবিক ও লস্করের জন্ম দিয়াছিল এবং তাহারা বহু বিচিত্র দেশ ও তাহার অধিবাসীদের সংস্পর্শে আসিয়াছিল।
“এই দক্ষিণ চীন হইতে প্রথম ছাত্রের দল আসিয়াছিল যাহারা প্রাচীন প্রথা ও সংস্কারের বাহিরে বিদেশে ‘বর্বরদের’ নিকট শিক্ষা লাভ করিতে গিয়াছিল। পাশ্চাত্যের নাবিক, বণিক ও মিশনারীদের শিল্প ও বিজ্ঞানের সঙ্গে এই দক্ষিণ চীনের লোকেরা বহুকাল হইতেই পরিচিত ছিল। সুতরাং তাহাদের নিজেদের সঙ্গে বিদেশীদের পার্থক্য কোথায় তাহা জানিবার জন্য তাহারা কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছিল।”—Monroe: China—A Nation in Evolutio - ↑ ১৩শ হইতে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম দেশ হইতে যে সব ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ী আসিয়াছিল, তাহাদের সাধারণ নাম দেওয়া হইত ‘লম্বার্ড’, যদিও তাহারা সকলেই লম্বার্ড প্রদেশের লোক ছিল না।
- ↑ “নর্মান কর্তৃক ইংলণ্ড বিজয়ের পর প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত অ্যাংলো-নর্মান ও অ্যাংলোস্যাক্সনদের মধ্যে কোন সম্বন্ধ ছিল না। এক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল উদ্ধত গর্ব, অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল নীরব অবজ্ঞা। একই দেশে বাস করিলেও তাহারা ছিল দুই ভিন্ন জাতি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা জন এবং তাঁহার পুত্র ও পৌত্রগণের রাজত্ব কাল পর্যন্ত উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ দেশাত্মবোধ উদ্বুদ্ধ হয় নাই। কিন্তু এই সময় হইতে প্রাচীন বিবাদের ভাব দূর হইতে থাকে। স্যাক্সনেরা নর্মানদের বিরুদ্ধে আর গৃহ বিবাদে যোগ দিত না, নর্মানেরাও স্যাক্সনদের ভাষাকে ঘৃণা করিত না, কিম্বা ইংরাজ নামে অভিহিত হইতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিত না। সম্প্রদায়ের লোক অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের বিদেশী মনে করিত না। তাহারা মনে করিত, তাহারা একই জাতি; তাহারা সমবেত চেষ্টায় সমগ্র জাতির স্বার্থরক্ষা ও কল্যাণ সাধন করিতে শিখিয়াছিল।”—
Creasy: The Fifteen Decisive Battles of the World.
পুনশ্চ—“যাহারা উপলিয়ামের পতাকাতলে যুদ্ধ করিয়াছিল এবং অন্য পক্ষে যাহারা হ্যারল্ডের পতাকাতলে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাদের পৌত্রেরা পরস্পরের সঙ্গে বন্ধত্ব সূত্রে আবদ্ধ হইতে শিখিতেছিল। এই বন্ধুত্বের প্রথম নিদর্শন গ্রেট চার্টার (ম্যাগনা চার্টা), ইহা তাহাদের সমবেত চেষ্টায় লব্ধ এবং তাহাদের সকলের হিতই ইহার মূল লক্ষ্য।”—মেকলে, ইংলণ্ডের ইতিহাস।
“চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই ইংলণ্ডের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলন মিশ্রণ আরম্ভ হইয়াছিল। এইরূপে টিউটনিক বংশের তিনটি শাখার সঙ্গে আদিম ব্রিটনের মিশ্রণে যে জাতির উদ্ভব হইল, পৃথিবীর কোন জাতির চেয়েই তাহারা নিকৃষ্ট নহে।”—মেকলে, ইংলণ্ডের ইতিহাস। - ↑ এই অংশের প্রুফ দেখিবার সময়, আমি জানিতে পারিলাম যে, একজন তিলি ব্যবসায়ী মহাসমারোহে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ দিয়াছেন। তিনি একখানি বিমান যান ভাড়া করিয়া কন্যার বাড়ীতে উপহার দ্রব্য পাঠাইয়াছেন, দুইখানি প্রথম শ্রেণীর গাড়ী যুক্ত স্পেশ্যাল ট্রেনে বরযাত্রীদিগকে লইয়া গিয়াছেন। এইরূপে বাহ্য আড়ম্বরের জন্য তিনি হাজার হাজার টাকা ব্যয় করিতেছেন। কিন্তু এই ব্যক্তিই হয়ত তাঁহার স্বজাতীয় বালিকাদের শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করিতে অল্প কয়েক শত টাকাও দিতে চাহিবেন না। খুব সম্ভব যে অর্থ এখন তিনি অপব্যয় করিতেছেন, তাহা তাঁহার পিতা মাথায় পণ্যের বোঝা বহিয়া অতি কষ্টে উপার্জন করিয়াছিল। সে তাহার জীবিতকালে মোটর গাড়ীতেও চড়ে নাই, আর তাহার ছেলে—ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহে বিমানযান ভাড়া করিয়া উপহারদ্রব্য পাঠাইতেছে!
- ↑ মধ্যপ্রদেশে বাংলার চেয়েও মাড়োয়ারীদের বেশী প্রাধান্য। রাইপুর, বিলাশপুর, ছত্রিশগড় প্রভৃতি স্থান মাড়োয়ারীদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছে।
- ↑ “এসব ব্যাপারে কিরূপ প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত আমি দিতেছি। ৯ বৎসর পূর্বে আমি যখন পুনর্বার রামনাদে যাই, তখন দেখি সেখানে ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি মন্দিরের সংস্কার হইতেছে।”—J. B. Pennington: India, Jan 13, 1919.
- ↑ ‘সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক স্পেনের অধঃপতন সম্বন্ধে মর্মস্পর্শী ভাষায় নিম্নলিখিতরূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—
“যে জাতি সতৃষ্ণ নয়নে কেবল অতীতের দিকে চাহিয়া থাকে, সে কখনও উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে না। উন্নতি যে সম্ভবপর, ইহাই তাহারা বিশ্বাস করে না। তাহাদের নিকট প্রাচীনতাই জ্ঞানের প্রতীক এবং প্রত্যেক উন্নতিচেষ্টাই বিপজ্জনক। স্পেন ঠিক এই অবস্থায় আছে। এই কারণে স্পানিয়ার্ডদের মধ্যে এমন অচলতা ও জড়তা, তাহাদের মধ্যে জীবনের চাঞ্চল্য নাই, আশা উৎসাহ নাই। এই কর্মবহুল যুগে তাহারা সভ্য জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে। বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়, এই বিশ্বাসে তাহারা কিছুই করিতে চায় না। তাহারা বিশ্বাস করে যে, প্রাচীনকাল হইতে যে জ্ঞান তাহারা পরম্পরাক্রমে লাভ করিয়াছে, বর্তমান যুগে তার চেয়ে বেশী জ্ঞান লাভ করা যায় না। এই কারণে তাহারা তাহাদের সঞ্চিত জ্ঞান ভাণ্ডার রক্ষা করিবার জন্যই ব্যস্ত, নূতন কোন পরিবর্তনের কল্পনা তাহারা সহ্য করিতে পারে না, যদি তাহার ফলে প্রাচীন জ্ঞানের মূল্য কমিয়া যায়!... এদিকে মানুষের জ্ঞান জগতে যুগান্তর সৃষ্টি হইতেছে, মনুষ্য প্রতিভা অভূতপূর্ব উন্নতি করিতেছে। স্পেন নিশ্চিন্তভাবে ঘুমাইতেছে, বহির্জগতের কোন আঘাতে সে সাড়া দেয় না, নিজেও বহির্জগতে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। ইয়োরোপীয় মহাদেশের এক কোণে মধ্য যুগের ভাব প্রবাহ ও সঞ্চিত জ্ঞানের ধ্বংসাবশেষ স্বরূপ এই বিশাল দেশ নিশ্চেষ্টবৎ পড়িয়া রহিয়াছে। এবং সকলের চেয়ে দুর্লক্ষণ স্পেন তাহার এই শোচনীয় অবস্থাতেই সুখী। যদিও ইয়োরোপের মধ্যে সে সর্বাপেক্ষা অনুন্নত দেশ, তবু সে নিজেকে সর্বাপেক্ষা উন্নত মনে করে। যে সব জিনিষের জন্য তাহার লজ্জিত হওয়া উচিত, সেই সব জিনিষের জন্যই সে গর্বিত।”
এই সব মন্তব্য ভারতের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অধিকতর প্রযোজ্য। স্পেনে অন্ততঃপক্ষে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা নাই অথবা স্পানিয়ার্ড এবং ইংরাজ, ফরাসী বা অন্য কোন জাতীয় লোকের সঙ্গে বিবাহের বাধাও নাই। - ↑ প্রসিদ্ধ কৃত্রিম রেশম ব্যবসায়ী মিঃ স্যামূয়েল কোর্টল্ড মিড্লসেক্স হাসপাতালে একটি নূতন ইনস্টিটিউটের জন্য পূর্বে ৪০ হাজার পাউণ্ড দিয়াছিলেন, সম্প্রতি তিনি ঐ উদ্দেশ্যে আরও ২০ হাজার পাউণ্ড দান করিয়াছেন।
স্যার উইলিয়াম মরিস মোটর গাড়ী নির্মাতা। তিনি সম্প্রতি ঘোষণা করিয়াছেন যে, এ বৎসর তাঁহার ফার্ম হইতে তিনি যে ২০ লক্ষ পাউণ্ড লভ্যাংশ পাইবেন, তাহার সমস্তই লোকহিতের জন্য ব্যয় করিবেন।
লেডী হাউস্টন লণ্ডনের সেণ্ট টমাস হাসপাতালে বিনা সর্তে এক লক্ষ পাউণ্ড দান করিয়াছেন।
সম্প্রতি একটি তারের খবরে (নভেম্বর, ১৯৩১) প্রকাশ পাইয়াছে,—স্যার টমাস লিপটনের সম্পত্তির ট্রাস্টিগণ সম্পত্তির সমস্ত আয়ই গ্লাসগো, লণ্ডন এবং মিড্লসেক্সের নিকটবর্তী হাসপাতাল ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠানসমূহে দান করিবেন স্থির করিয়াছেন। এই সম্পত্তির মূল্য দশ লক্ষ পাউণ্ডের বেশী হইবে। - ↑ পরলোকগত স্যার ডোরাব টাটার উইল অনুসারে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি লোকহিতকর কার্যে দান করা হইয়াছে। এই সম্পত্তির মূল্য ২।৩ কোটী টাকা।
- ↑ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাড়োয়ারীদের দান যে অতি সামান্য তাহা নিম্নলিখিত তালিকা হইতে বুঝা যাইবে:—
“কেশোরাম পোদ্দার (আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মেডাল ফাণ্ড) ১০,০০০৲; বিড়লা হিন্দী লেকচারশিপ ফণ্ড ২৬,২০০৲; গণপতি রাও খেমকা (পঞ্চম জর্জ করোনেশান মেডাল ফণ্ড) ১,০০০৲; মোট ৩৭,২০০৲।
বোম্বাইয়ের অধিবাসীদের মত মাড়োয়ারীদের যদি দেশহিতৈষণার ভাব থাকিত তবে তাহারা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে, যথা—বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ, চিত্তরঞ্জন জাতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান পরিষৎ, মূক বধির বিদ্যালয়, অন্ধ বিদ্যালয় প্রভৃতিতে কয়েক কোটি টাকা দান করিত। “যাহার প্রচুর আছে, তাহার নিকটেই লোক বেশী প্রত্যাশা করে।”
পক্ষান্তরে, অ্যান্ড্রু কার্নেগী তাঁহার বাসভূমির হিতসাধনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন। “পিট্সবার্গে আমি ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছি। আমি পিট্সবার্গ সহরে জনহিতকর কার্যে ২ কোটী ৪০ লক্ষ পাউণ্ড দিয়াছি বটে, কিন্তু পিট্সবার্গ হইতে আমি যাহা পাইয়াছি, উহা তাহার কিয়দংশ মাত্র। পিট্সবার্গ ইহা পাইবার অধিকার রাখে।”—আত্মচরিত। - ↑ মাড়োয়ারী নিখিল ভারত আগরওয়ালা মহাসভায় দুইটি অধিবেশনে সভাপতিরা যে বক্তৃতা করিয়াছেন, তুলনার জন্য তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত হইল:—
“প্রতিদিনই আমরা হৃদয়বিদারক পারিবারিক অশান্তির কথা শুনিতে পাই, উহা এ যুগের অনুপযোগী বিবাহ প্রথারই কুফল। বালিকাকে অল্প বয়সেই তাহার পিতৃগৃহের লেখাপড়া খেলাধূলার আবহাওয়ার মধ্য হইতে ছিনাইয়া লওয়া হয় এবং তাহারই মত একটি নির্দোষ বালকের সঙ্গে তাহার বিবাহ হয়। কিছুদিন পরেই আমরা শুনিতে পাই যে, বালকটির মৃত্যু হইয়াছে এবং একটি বালবিধবা রাখিয়া গিয়াছে। জীবনে ঐ বালবিধবা যে অপরিসীম দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা অবর্ণনীয়। এরূপ দৃষ্টান্তও দেখিতে পাই, একজন বৃদ্ধ জীবনের শেষ সীমায় আসিয়া তাহার নাতিনীর বয়সী বালিকাকে বিবাহ করে, কেন না উক্ত বৃদ্ধ বিপত্নীক জীবন যাপন করিতে অক্ষম। আপনারাই বিবেচনা করুন এরূপ বিবাহের কি বিষময় পরিণাম, ইহা সমাজ শরীরকে ক্ষয় করিতেছে।”
১২শ নিখিল ভারত মাড়োয়ারী আগরওয়ালা মহাসভার সভাপতিরূপে শ্রীযুত ডি. পি. খৈতান বলেন, শিক্ষার অভাব, রক্ষণশীলতা, বাল্যবিবাহ, পর্দা প্রথা প্রভৃতি সামাজিক উন্নতির গতি প্রতিহত করিতেছে। - ↑ ১৭-৬-৩১ তারিখের দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে “উচ্চবর্ণীর হিন্দুদের অত্যাচার” শীর্ষক নিম্নলিখিত সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল:—
“ঢাকায় সংবাদ আসিয়াছে যে, শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ মহকুমার সমগ্র নমঃশূদ্র সম্প্রদায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতে উদ্যত হইয়াছে। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ডাঃ মোহিনীমোহন দাস সুনামগঞ্জ বার লাইব্রেরী এবং কংগ্রেস কমিটীর নিকট এ বিষয়ে সত্য সংবাদ জানিবার জন্য তার করেন। তিনি উত্তর পাইয়াছেন যে, ঘটনা সত্য। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের অত্যাচার এবং ঢাকার একজন মুসলমান মৌলভীর প্রচারকার্যের ফলেই এরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে।”
যে খৃষ্টান ধর্ম ভগবানের পিতৃত্ব এবং মানবের ভ্রাতৃত্ববোধের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া দাবী করে, মুসলমান ধর্ম স্থানে স্থানে তাহাকেও অতিক্রম করিতেছে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টি উদার গণতন্ত্রমূলক। জনৈক আধুনিক লেখক বলিয়াছেন—“ইসলাম ধর্ম মরুভূমির মধ্যে জন্ম লাভ করিরাছিল। মরুভূমি সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র। ইসলাম ধর্ম অতি শীঘ্রই তিন মহাদেশে বিস্তৃত হইয়া পড়ে। ইহার মধ্যে কোন দিনই জাতিবৈষম্য নাই। ইসলামের নিকট সব মুসলমানই ভাই ভাই, তাহারা—বাণ্টু, বা বার্বার, তুর্ক বা পারসীক, ভারতবাসী অথবা জাভাবাসী—যাহাই হোক না কেন। এ কেবল ভাবজগতের সাম্য নহে, দৈনন্দিন জীবনে ও সামাজিক আচার ব্যবহারে এই সাম্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায়। এই সাম্যই দরিদ্র ও নিম্ন স্তরের লোকদের ইসলাম ধর্মে আকর্ষণ করে; তাহারা জানে যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলে, অন্য সমস্ত মুসলমানের সমান হইবে। আমার মনে হয়, আফ্রিকা মহাদেশ জয় করিবার জন্য খৃষ্টান ধর্ম ও মুসলমান ধর্মের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলিতেছে, তাহাতে ইসলামই বিজয়ী হইবে। খৃষ্টান মিশনারীরা যদি বর্ণবৈষম্যের কুসংস্কার, শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান ত্যাগ করিয়া খৃষ্টান ধর্মের সত্যকার ভ্রাতৃত্ববাদ আন্তরিক ভাবে প্রচার না করে, তবে তাহারা ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারিবে না।”
মসজিদে আমীর এবং ফকির পাশাপাশি বসিয়া উপাসনা করে। এই কারণেই মালয় উপনিবেশ, জাভা, বোর্নিও এবং সুমাত্রায় ইসলাম ধর্ম এত দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে। - ↑ মেণ্ডেলের নিয়ম এবং বাইসমানের বীজাণুতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সুপ্রজনন বিদ্যার এই সব আপাতবিরোধী ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কিন্তু উহা অসম্পূর্ণ।
জনৈক আধুনিক বিশেষজ্ঞ বলিয়াছেন—“ব্যক্তির চরিত্র-বিকাশের উপর বংশানুক্রম ও পারিপার্শ্বিকের প্রভাব সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকারের। বংশানুক্রম ব্যক্তির চরিত্রের ভবিষ্যৎ বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে,—পারিপার্শ্বিক কতকগুলি গুণের বিকাশে সহায়তা করে, কতকগুলিতে বাধা দেয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নূতন কিছু সৃষ্টি করিতে পারে না।” - ↑ আমি ব্যাপক ভাবে এই শব্দ ব্যবহার করিতেছি। নেপোলিয়ান ইংরেজ জাতিকে অবজ্ঞাভরে বলিতেন—“দোকানদারের জাতি”।
- ↑ এখানে বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে, আমার তিন জন ছাত্র (রসায়নে এম. এস-সি.) ক্ষুদ্র আকারে পুস্তক ব্যবসা আরম্ভ করিয়া, এখন উহা সুবৃহৎ ব্যবসায়ে পরিণত করিয়াছেন; বলা বাহুল্য যে, তাঁহারা আমার দ্বারা অণুপ্রাণিত হইয়াছেন। তাঁহাদের ফার্মের নাম চক্রবর্তী, চাটার্জী অ্যাণ্ড কোং, পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক। আমার বাল্যকালের মনের আকাঙ্ক্ষা এই দিক দিয়া চরিতার্থ হইয়াছে।