যদিও রাজনীতিক হইবার দুরাকাঙ্ক্ষা আমার কোন কালেই ছিল না, বক্তা হিসাবে প্রসিদ্ধ হইবার ইচ্ছাও আমার নাই,—তথাপি খ্যাতনামা রাজনৈতিক বক্তাদের বক্তৃতা শুনিবার সুযোগ আমি কখনও ত্যাগ করি নাই। ইলবার্ট বিল আন্দোলন যখন প্রবল ভাবে চলিতেছিল, তখন (১৮৮৩) উইলিসের কক্ষে লর্ড রিপনকে সমর্থন করিবার জন্য লিবারেল রাজনীতিকদের এক সভা হয়, আমি ঐ সভাতে যোগ দেই। জন ব্রাইট সভাপতির আসন গ্রহণ করেন,—বক্তৃাদের মধ্যে ডবলিউ. ই. ফরষ্টার, স্যার জর্জ কাম্বেল এবং লালমোহন ঘোষ ছিলেন। আমাদের স্বদেশবাসী লালমোহনের বক্তৃতা চমৎকার হইয়াছিল, যদিও তাঁহার পূর্বে ইংলণ্ডের তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ বক্তা ব্রাইট বক্তৃতা করেন। গ্ল্যাডষ্টোন, জোসেফ চেম্বারলেন, মাইকেল ডেভিট্, জন ডিলন, উইলফ্রিড লসন, লর্ড রোজবেরী, এবং এ. জে. ব্যালফুরের বক্তৃতা আমি শুনিয়াছি। আমি এডিনবার্গের একটি প্রসিদ্ধ জনসভাতেও উপস্থিত ছিলাম, ঐ সভায় প্রসিদ্ধ আফ্রিকা ভ্রমণকারী এইচ. এম. ষ্ট্যান্লি প্রধান বক্তা ছিলেন। ১৯২৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিরূপে আমি যখন ডাবলিনে যাই, তখন অতিথিদের সম্বর্ধনার জন্য একটি উদ্যান সম্মিলনী হয়। আমি সেখানে আইরিশ ফ্রি ষ্টেটের গবর্ণর জেনারেল মাননীয় টি. এম. হিলির সাক্ষাৎ লাভ করি। তিনি তখন বয়সে প্রবীণ এবং তাঁহার যৌবনের তেজস্বিতা কিছু শান্ত হইয়াছে। তাঁহার সহাস্য বদন এবং মধুর ব্যবহার দেখিয়া মনে হয় নাই যে, তিনিই পূর্বকালের সেই বিখ্যাত “টিম” হিলি; গত ১৮৮০ সালের কোঠায় ইনিই পার্লামেণ্টে চরম পন্থী, নিয়ত বাধাপ্রদানকারী পার্নেলের দলভুক্ত সদস্য ছিলেন।
ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে লালমোহন ঘোষের বাগ্মিতা উচ্চাঙ্গের ছিল। সুরেন্দ্রনাথের যে সব মুদ্রাদোষ ছিল, লালমোহনের তাহা ছিল না। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ নব্য বঙ্গের যুবকদের আদর্শ ছিলেন এবং তাঁহার আবেগময়ী ওজস্বিনী বক্তৃতা যুবকদের চিত্তের উপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিত। তাঁহার অদ্ভূত স্মরণশক্তিও ছিল। ভারতীয় জাতীয় মহাসভার পুনা অধিবেশনের প্রেসিডেণ্টরূপে তিনি অপূর্ব বক্তৃতা শক্তির পরিচয় প্রদান করেন। তিনি একটি বারও না থামিয়া তিন ঘণ্টা কাল অনর্গল বক্তৃতা করেন। তাঁহার হাতে যে মুদ্রিত অভিভাষণ ছিল, এক বারও তিনি তাহার সাহায্য গ্রহণ করেন নাই।
গোখেল বাগ্মী ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার সাবলীল বক্তৃতা বহু তথ্যে পূর্ণ থাকিত। তিনি সংখ্যাসংগ্রহে নিপুণ ছিলেন, বক্তৃতায় অনাবশ্যক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতেন না। তাঁহার মনে আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কোন সন্দেহ বা সংশয় থাকিত না, কেননা তথ্য সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। তিনি বাক্য সংযমের মূল্য বুঝিতেন এবং বেকনের প্রবন্ধের মত সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করিতেন। সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতা হৃদয়ের উপর, আর গোখেলের বক্তৃতা মস্তিষ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করিত। ভারতের জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবর্তক আনন্দমোহন বসু এত দ্রুত অনর্গল বক্তৃতা করিতেন যে, রিপোর্টারদের পক্ষে তাঁহার বক্তৃতা লিপিবদ্ধ করা কঠিন হইত। তাঁহার বক্তৃতায় কিছু অনাবশ্যক উচ্ছ্বাসের কথা থাকিত। এই পুস্তকের পূর্বাংশে তাঁহার একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত হইয়াছে। কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতা ও ধর্মোপদেশও আমি বহুবার শুনিয়াছি। তিনি ছিলেন একাধারে ভাবুক ও ঋষি; কখনও যুক্তিতর্ক তুলিতেন না, আবেগময় ভাষায় নূতন বাণী শুনাইতেন।
আমি কয়েকজন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতা ও বক্তার কথা বলিলাম। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিশত বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে যে প্রসিদ্ধ সম্মেলন হইয়াছিল, তাহার কথা স্বভাবতই আমার মনে আসিতেছে। যে সমস্ত বিখ্যাত অতিথি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিমন্ত্রিত হইয়া দেশ বিদেশ হইতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে মহাসমারোহে সম্বর্ধনা করা হয়। এত বেশী বিখ্যাত পণ্ডিত ও প্রতিভাশালী ব্যক্তির একত্র সমাগম দেখিবার সৌভাগ্য কদাচিৎ ঘটে। এই সম্মেলনে সুপ্রসিদ্ধ সাফী ছিলেন; রোমে যখন সাধারণ তন্ত্র ঘোষণা করা হয়, তখন ম্যাজিনি, আর্মেলিনি এবং সাফী, এই তিনজনকে সর্বময় কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। সুয়েজ খালের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ফার্ডিনাণ্ড লেসেপ্স্, জীবাণু তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা প্রসিদ্ধ রাসায়নিক পাস্তুর, পদার্থবিজ্ঞানবিৎ শারীরতত্ত্ববিৎ এবং গণিতজ্ঞ হারমান ভন হেল্মহোল্জ, আমেরিকার প্রসিদ্ধ কবি জেমস রাসেল লাওয়েল, ইংলণ্ডের বিখ্যাত কবি রবার্ট ব্রাউনিং-সম্মেলনে এই সব বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। সাফী ও হেল্মহোল্জ বিশুদ্ধ ইংরাজীতে বক্তৃতা করেন এবং লেসেপ্স্ ও পাস্তুর মাতৃভাষা ফরাসীতে বক্তৃতা করেন।
আমি প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে এই বিবরণ লিখিতেছি, আমার বিশ্বাস আমার বিবরণে কোন ভুল হয় নাই।
পরিশিষ্ট (২)
উপসংহার
আমি সঙ্কোচ ও সংশয়পূর্ণ হৃদয়ে, জনসাধারণের সম্মুখে এই আত্মজীবনী উপস্থিত করিতেছি। যে কোন পাঠক সহজেই বুঝিতে পারিবেন যে, ইহার কোন কোন অংশ সংক্ষিপ্ত, কতকটা অসংলগ্ন। এক সময়ে আমার ইচ্ছা হইয়াছিল, গ্রন্থখানি আমূল সংশোধন করিয়া ছাপিতে দিব। কিন্তু ঘটনাচক্রে বর্তমান সময়ে আমার জীবন অত্যন্ত কর্মবহুল হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং আমূল সংশোধন করিতে গেলে পুস্তক প্রকাশে বিলম্ব হইত, অথচ এদিকে পরমায়ুও শেষ হইয়া আসিতেছে। এই সমস্ত কারণে ‘শুভস্য শীঘ্রং’ এই নীতি অবলম্বন করিয়া বহু দোষ ত্রুটী সত্ত্বেও আমি এই গ্রন্থ প্রকাশ করিলাম।
পুস্তকের কোন কোন অংশ ৮।৯ বৎসর পূর্বে লিখিত হয়, ১৯২৬ সালে ইয়োরোপ যাতায়াতের সময় কতকাংশ লিখি। অন্যান্য অংশ বাংলার সর্বত্র, তথা ভারতের নানা প্রদেশে ভ্রমণের সময় গত কয়েক বৎসরে লিখিত হয়। এই সমস্ত কারণে পুস্তকের স্থানে স্থানে খাপছাড়া ও অসংলগ্ন বোধ হইতে পারে।
কেহ কেহ হয়ত পরামর্শ দিবেন যে, জুতা নির্মাতার শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যবসায়েই লাগিয়া থাকা উচিত, রসায়নবিদের পক্ষে তাহার লেবরেটরীর বাহিরে যাওয়া উচিত নহে। সৌভাগ্যক্রমে অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে, এই আত্মজীবনীতে কেবল রসায়নের কথা নাই, বাহিরের অনেক কথাও আছে।
আমি যাহা তাহাই, আমার মধ্যে পরস্পর-বিরোধী অনেক ভাব আছে। বার্নার্ড শ’ যথার্থই বলিয়াছেন, “কোন লোকই খাঁটি বিশেষজ্ঞ হইতে পারে না, কেননা তাহা হইলে সে একটা আস্ত আহাম্মক হইবে।” এই পুস্তকে যে সব বিষয় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহা পরস্পর-বিরোধী কতকগুলি ব্যাপারের একত্র সংগ্রহ; অথচ ইহা একজন বাঙালী রসায়নবিদের জীবন কাহিনীরূপে গণ্য হইতে পারে কিনা, পাঠকগণই তাহার বিচার করিবেন।
আমার জীবন বৈচিত্র্যহীন শিক্ষকের জীবন। কোন লোমহর্ষণ অভিযান, অথবা উত্তেজনাপূর্ণ বিপজ্জনক ঘটনা, আমার জীবনে ঘটে নাই। কোন রাজনৈতিক গুপ্ত কথাও উদগ্রীব পাঠকদিগকে আমি শুনাইতে পারিব না। কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস, বৈচিত্র্যহীন, চমকপ্রদ ঘটনাবর্জিত অনাড়ম্বর জীবনের সরল কাহিনী আমার দেশবাসীর নিকট বিশেষতঃ যুবকদের নিকট কিয়ৎপরিমাণে শিক্ষাপ্রদ ও হিতকর হইবে।
আমার জীবনের সমস্ত প্রকার কার্যকলাপের কথাই সংক্ষেপে বলা হইয়াছে। পুস্তক লিখিয়া শেষ করিবার পর, আমি ৪।৫ বৎসর উহা ফেলিয়া রাখি এবং বাংলার আর্থিক অবস্থা বিশেষরূপে অধ্যয়ন করি। আর্থিক ক্ষেত্রে বাঙালীর শোচনীয় ব্যর্থতা যে আমার ব্যক্তিগত ধারণা নয়, বাস্তব সত্য, তৎসম্বন্ধে আমি নিঃসংশয় হইতে চেষ্টা করি। দেখিলাম, এ সম্বন্ধে সে সমস্ত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি চিন্তা ও আলোচনা করিয়াছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহাদের সঙ্গে আমার মতের সম্পূর্ণ মিল আছে। আমি ঐ সব বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রন্থের পাদটীকায় উদ্ধৃত করিয়াছি।
আমি যুবকদের নিকট বক্তৃতার অনেক বার বলিয়াছি যে, আমি প্রায় ভ্রম ক্রমে রাসায়নিক হইয়াছিলাম। ইতিহাস, জীবন চরিত, সাহিত্য এই সব দিকেই আমার বেশী ঝোঁক। ইহাতে অসাধারণ কিছু নাই। হাক্স্লি বলিতেন যে, যদিও তিনি প্রাণিতত্ত্ববিৎরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, তবু দর্শন ও ইতিহাস তাঁহার মনের উপর চিরকাল প্রভাব বিস্তার করিয়া আসিয়াছে। “ইংলিশ মেন অব লেটার্স” সিরিজে হিউমের উপর তিনি যে নিবন্ধ লিখিয়াছিলেন, তাহাতেই এই উক্তি প্রমাণিত হয়। লর্ড হ্যাল্ডেন দর্শনশাস্ত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করিলেও, আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিকরূপেও অশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। এরূপ আরও বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে।
আমি স্বীকার করি, আমার মধ্যে অদ্ভুত স্ব-বিরোধী ভাব আছে। যদিও আমি একজন শিল্প ব্যবসায়ী বলিয়া গণ্য, তথাপি আমার তরুণ বয়স হইতেই আমি এই জগতের অনিত্যতা উপলব্ধি করিয়াছি এবং বিষয় সম্পত্তির উপর আমার বিরাগ প্রকৃতিগত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং শিল্পব্যবসায়ীরূপে সাফল্য লাভ করিতে যে গুণ বিশেষ ভাবে থাকা চাই, তাহা আমার নাই, কেন না, “অর্থমনর্থম্ ভাবয় নিত্যম্”—এই কথাটি সর্বদা আমার মনে রহিয়াছে। এই পুস্তকের সর্বত্র খৃষ্টের এই সুরই প্রধান—“পৃথিবীর ধনতত্ত্ব ও ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিও না, কেননা যেখানে ঐশ্বর্য, হৃদয়ও সেখানে থাকে।”
তৎসত্ত্বেও যদি কেহ ধৈর্য ধরিয়া এই বহি আগাগোড়া পড়েন, তবে দেখিতে পাইবেন, আমার জীবনের বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্যে একটা সংযোগসূত্র আছে এবং সেগুলি একই জীবন-প্রবাহের অংশ মাত্র। সংক্ষেপে তিনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমি লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করি নাই।
দুঃখের বিষয়, আত্মজীবনীতে ‘আমি’ শব্দটির পুনঃপুনঃ ব্যবহার অপরিহার্য। ইহাতে অহং জ্ঞানের ভাব অতিমাত্রায় ফুটিয়া উঠিবার আশঙ্কা আছে। সুতরাং যখনই এই শব্দ ব্যবহার করিয়াছি, তখনই আমার বিষম দায়িত্বের কথা স্মরণ হইয়াছে। যে ক্ষেত্রে আমি কাজ করিয়াছি, ভগবানের হস্তধৃত যন্ত্ররূপেই করিয়াছি। আমার ব্যর্থতা আমার নিজের, ভুল করা মানুষের স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জীবনে যদি কিছু সাফল্য হইয়া থাকে, তবে তাহা ভগবানের ইচ্ছাতেই হইয়াছে। বস্তুতঃ ভগবানই আমাদের জীবনের গতি নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন। লর্ড হ্যাল্ডেন তাঁহার আত্মজীবনীতে মানব জীবনের মধ্যে ভগবদিচ্ছার এই প্রভাবের কথা উল্লেখ করিয়াছেন:—
“যে সব বিষয়ে আমি সাফল্য লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমার কোন সাফল্যবোধ নাই। আমি কাজ করিয়াছি, এবং তাহাতে সুখ পাইয়াছি, এই পর্যন্ত। মানুষের নিকট হইতে বেশী সম্পদ, সম্মান, শ্রদ্ধা পাওয়ার চেয়ে, সে সুখ অনেক ভাল। কেন না ঐ সুখের মধ্যে এমন একটি জিনিষ আছে যাহা বাহিরের কোন কিছুই দিতে পারে না। বাহিরের ঘটনাবলী সম্বন্ধে আমি এই বলিতে পারি, যদি পুনরায় আমাকে প্রথম হইতে জীবন যাপন করিতে হইত, তবে পারতপক্ষে সব ঘটনার সম্মুখীন হইতাম না। একজন বিখ্যাত রাজনীতিক আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘আপনার যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ হইয়াছে, তাহার সাহায্যে পুনরায় কি আপনি নূতন ভাবে জীবন আরম্ভ করিতে চাহেন?’ আমি বলিয়াছিলাম—‘না’। আমি আরও বলি,—‘আমরা জীবনে যে সব সাফল্য লাভ করি, ঘটনাচক্র অথবা দৈবের অংশ তাহার মধ্যে কতটা, তাহা আমরা সম্যক ধারণা করিতে পারি না।’ উক্ত রাজনীতিকও উত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘আমিও পুনর্বার জীবন আরম্ভ করিতে চাই না, কেন না যে ঘটনাচক্র বা দৈব একবার আমার সহায় ছিল, সে যে পুনর্বার আমার প্রতি সদয় হইবে, তাহার নিশ্চয়তা কি?’ খুব শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনেও ঘটনাচক্রের প্রভাব যথেষ্ট এবং সকল ঘটনা ও অবস্থার মধ্যে সুখদুঃখে অনাসক্ত থাকিবার শিক্ষা দর্শনশাস্ত্রের নিকট হইতে আমাদের লাভ করিতে হইবে। জ্ঞান ও বুদ্ধি-মত নিয়ত কার্য করিয়া যে ফল হয়, তার বেশী মানুষ আশা করিতে পারে না।”
জে. এস. মিল সংশয়বাদীরূপে গণ্য (কেহ কেহ তাঁহাকে নিরীশ্বরবাদীও বলেন); কিন্তু তিনি এক স্থানে বলিতে গেলে অদৃষ্টবাদের বা ভগবানের বিধানের উপর তাঁহার বিশ্বাস জ্ঞাপন করিয়াছেন, যথা:—
“কেহ নিজের কোন কৃতিত্ব ব্যতীতই ধনী হইয়া জন্ম গ্রহণ করেন, কেহ কেহ বা এমন অবস্থার মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন যে, নিজের কার্যের দ্বারা ধনী হইতে পারেন। অধিকাংশ লোককেই সমস্ত জীবনে কঠোর পরিশ্রম ও দারিদ্র ভোগ করিতে হয়। অনেকে অতি নিঃস্ব ভিখারীরূপে জীবন যাপন করিতে বাধ্য হয়। জীবনে সাফল্য লাভের প্রধান উপায়—জন্ম বা বংশ, তার পর ঘটনাচক্র এবং সুযোগ সুবিধা। যিনি ধনীর গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন নাই, তিনি সাধারণতঃ নিজের পরিশ্রম ও কার্যদক্ষতা বলেই তাহা লাভ করেন বটে, কিন্তু কেবল মাত্র কার্যকুশলতা বা পরিশ্রমে কিছুই হইত না, যদি ঘটনাচক্র ও সুযোগ সুবিধা তিনি না পাইতেন। অল্প লোকের ভাগ্যেই সেরূপ ঘটিয়া থাকে।... চরিত্রের সদ্গুণ অপেক্ষা কর্মশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি জীবনে সাফল্য লাভের পক্ষে বেশী প্রয়োজন। অধিকাংশ লোকের পক্ষে, তাঁহাদের চরিত্র যতই সৎ হোক না কেন, অনুকূলে ঘটনাচক্রের সাহায্য ব্যতীত জগতে সাফল্য লাভ সম্ভবপর নয়।”
আমার জীবনের বিবিধ কর্মবৈচিত্র্যের মধ্যে আমি নিম্নলিখিত শাস্ত্রবাক্যটির তাৎপর্য অনুভব করিয়াছি:—
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন
যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।
বাঙালীদের ত্রুটী ও দৌর্বল্য সম্বন্ধে আমি অনেক কথা বলিয়াছি; আমার এই সময়োচিত সাবধান বাণী অরণ্যরোদনে পর্যবসিত হইবে না, এই আশাতেই ঐ সব কথা বলিয়াছি। বাঙালীর চরিত্রে অনেক মহৎ গুণ আছে এবং আমি নিজেকে বাঙালী বলিয়া গর্ব অনুভব করি। কিন্তু একটা প্রধান বিষয়ে, জীবিকা সংগ্রহ ও অর্থ সংস্থানে—সে অক্ষমতা প্রদর্শন করিয়াছে। গত ৪০ বৎসর ধরিয়া বাঙালীর এই অন্ন সমস্যার কথা আমি চিন্তা করিয়াছি এবং আমি সশঙ্ক চিত্তে দেখিতেছি যে, বাঙালী তাহার ‘নিজ বাসভূমে’ জীবন সংগ্রামের প্রতিযোগিতায় আত্মরক্ষা করিতে পারিতেছে না। এই সব কথা লিখিবার সময় আমি বাংলার গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করিতেছি এবং বাংলার বালক ও যুবকদের কার্যকলাপ বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করিতেছি। তাহাদের শীর্ণ দেহ, রক্তহীন বিবর্ণতা, জ্যোতিঃহীন চক্ষু, অনাহার-ক্লিষ্টতারই পরিচয় প্রদান করে। তাহার মুখে একটা অসহায় ভাব। পরাজয়ের গ্লানি যেন তাহার সমগ্র চরিত্রের মধ্য দিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে এবং ক্রমেই গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবিয়া যাইতেছে। যে জাতির যুবকশক্তি এই ভাবে নৈরাশ্যপীড়িত এবং মানসিক অবসাদগ্রস্ত হইয়া পড়ে, তাহাদের ভবিষ্যতের কোন আশা থাকে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমার জীবনসায়াহ্নে আমি একেবারে আশা ত্যাগ করিতে পারিতেছি না।
একজন শিক্ষাব্যবসায়ী হিসাবে, আমি পুনঃ পুনঃ বলিয়া আসিয়াছি—বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মোহ বাঙালী চরিত্রের একটা প্রধান ত্রুটী। অন্য জাতিদের তুলনায় বাঙালীদের মধ্যেই এই মোহ বোধ হয় খুব বেশী। বার্নার্ড শ’ বলিয়াছেন,—“নির্বোধের মস্তিষ্কই দর্শনকে নির্বুদ্ধিতায়, বিজ্ঞানকে কুসংস্কারে, এবং শিল্প সাহিত্যকে পাণ্ডিত্যগর্বে পরিণত করে। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা।” “পণ্ডিত ব্যক্তি অলস, সে পড়িয়া সময় নষ্ট করে। তাহার এই মিথ্যা জ্ঞান হইতে দূরে থাকিতে হইবে। অজ্ঞতা অপেক্ষাও ইহা ভয়ঙ্কর। কর্মতৎপরতাই প্রকৃত জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায়।” কথাগুলি খাঁটি সত্য। ঐ প্রসিদ্ধ লেখকের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া আমিও বলি,—“কোন ব্যক্তি যে বিষয়ে নিজে কিছু জানে না, সে যদি অপর এক অযোগ্য ব্যক্তিকে সেই বিষয়ে শিক্ষা দেয় এবং তাহাকে বিদ্যালাভের জন্য সার্টিফিকেট দেয়, তবে, শিক্ষার্থীটি ‘ভদ্রলোকের শিক্ষা’ সমাপ্ত করিল বলা যায়।” কিন্তু এই শিক্ষার ফলে তাহার সমস্ত জীবন ব্যর্থ হইয়া যায়।
আমি বাঙালী চরিত্র বিশ্লেষণ করিয়া তাহার দোষ-ত্রুটি দেখাইতে দ্বিধা করি নাই। অস্ত্রচিকিৎসকের মতই আমি তাহার দেহে ছুরি চালাইয়াছি এবং ব্যাধিগ্রস্ত অংশ দূর করিয়া তাহাতে ঔষধ প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু বাঙালী আমারই স্বজাতি এবং তাহাদের দোষ-ত্রুটীর আমিও অংশভাগী। তাহাদের যে সব গুণ আছে, তাহার জন্যও আমি গর্বিত, সুতরাং বাঙালীদের দোষ কীর্তন করিবার অধিকার আমার আছে।
আমাদের চোখের সম্মুখেই পৃথিবীতে নূতন ইতিহাস রচিত হইতেছে। বেশী দিন পূর্বের কথা নয়, চীনা ও তুর্কীরা পাশ্চাত্যের অবজ্ঞা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পাত্র ছিল। তাহারা অলস, দুর্বল, ক্ষয়গ্রস্ত জাতির দৃষ্টান্তরূপে উল্লিখিত হইত। কিন্তু ঈশ্বরপ্রেরিত নেতাদের পরিচালনায় তাহারা শতাব্দীর নিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিয়াছে, নিজেদের জড়তা ও নৈরাশ্য পরিহার করিয়াছে এবং জগতের বিস্ময়বিস্ফারিত চোখের সম্মুখে নবযৌবনের শক্তি লাভ করিয়াছে।
সুতরাং বাঙালী তথা ভারতবাসী—কেন পশ্চাৎপদ থাকিবে, তাহাদের জাতীয় জীবন কেন পূর্ণতা লাভ করিবে না, তাহার কোন কারণ আমি দেখিতে পাই না।
“এরিয়োপেজিটিকার” কবি মিল্টনের গম্ভীর উদাত্ত বাণী আমার স্মৃতিপথে ভাসিয়া আসিতেছে—
“আমার মানস নেত্রে আমি একটি মহৎ জাতির নব অভ্যুদয় দেখিতেছি,—বীর্যশালী কেশরীর মতই নিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিয়া সে তাহার কেশর সঞ্চালন করিতেছে।”